মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অবদান

মুজিবনগর সরকারের অধীনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতাই হচ্ছে একটি জাতির সবচেয়ে বড় পুরস্কার। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বিশ্বের, বিশেষ করে ভারতের জনগণের কাছে ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব পতাকা ব্যবহার করত। সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের তরুণেরা, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু শিল্পগোষ্ঠী, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনসমর্থন সৃষ্টি করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যারা বাংলাদেশি অভিবাসী ছিলেন, তারা মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই সংগঠিত হন এবং বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।

মুজিবনগর সরকার ইয়ুথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে সুযোগ করে দেয়। এদের সবাইকে একসঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে নামানো সম্ভব ছিল না। তাই তাঁদের মধ্যে হতাশার কারণ ছিল। এই হতাশা দূর করার জন্য সরকার মনস্তাত্ত্বিক এবং শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে। যেসব সরকারি কর্মকর্তাকে সরকারের চাকরি দেওয়া সম্ভব হয়নি, তাঁদের ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইয়ুথ ক্যাম্প কর্মসূচি সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত না হলে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের আশঙ্কা ছিল। ইয়ুথ ক্যাম্প সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের যুবকদের একটি সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত করে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পুনর্গঠনের জন্য একটি পরিকল্পনার প্রয়োজন। ছিল। মুজিবনগর সরকার অতি অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আগামী এক বছরের জন্য বিভিন্ন পণ্য ও সেবার চাহিদা নির্ণয় করে। অন্যদিকে অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করে। নভেম্বর মাসে যখন ভারত-পাকিস্তান। যুদ্ধ প্রায় নিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়, তখন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা ছিল একটি জটিল ও দুরূহ কাজ। আমলাতন্ত্র তখন দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগে ছিল যারা। মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলা সরকারে কাজ করছিল। অন্যদিকে ছিল পাকিস্তানের তাঁবেদার সরকারের কাজে নিযুক্ত আমলারা। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের খুব বেশি হলে শতকরা ২০ ভাগ মুক্তিবাহিনীকে সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার জন্য দেশের ভেতরে কাজ করছিল। কিন্তু যখনই তারা ধরা পড়ার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতো, তখন তারা পালিয়ে যেত। এ ছাড়া যারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে, তাদের ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়েছে। যুদ্ধের পরিবেশে এদের মধ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করা সম্ভব ছিল না। যুদ্ধের শেষে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তাদের অনেক স্পর্শকাতর পদে নিয়োগ দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কর্মরত কর্মচারীদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রোধ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন, এ রকম অনেক কর্মকর্তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন মুজিবনগরের কর্মকর্তারা। তবে সবাই এই উপকারের কথা মনে রাখেননি। অনেক পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে ওই সময় কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতে হয়েছে। তাঁরা এটাকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে ধরে নেন এবং পরবর্তীকালে প্রতিবিপ্লবের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার ক্ষতি করে।

মুজিবনগর সরকার শরণার্থী সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির ব্যবস্থা করে। এতে কর্মচারীদের মনোবল বেড়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মুজিবনগরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যে বেতন দেওয়া হতো, তার অর্থ ভারত সরকার দেয়নি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে অর্থ ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই অর্থের একটি অংশ ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করে সরকারের খরচ চালানো হচ্ছিল। অবশ্য ভারতের অনেক প্রাদেশিক সরকার এক কোটি থেকে দশ কোটি রুপি পর্যন্ত অনুদান বাংলাদেশ সরকারকে দেবে বলে ঘোষণা করে। তবে সে অর্থ আসার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ভারতের প্রশাসকদের মনে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের দক্ষতা এবং যোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অনেক প্রশাসক মারা যাওয়ায় তারা ধরে নেয় যে ভারতীয় বাহিনী যখন বাংলাদেশে যাবে, তখন সেই বাহিনীর সমর্থনে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের নেই। তাই তারা পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বাঙালি আইএস কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বাংলাদেশের ১৯টি জেলার জন্য ডেপুটি কমিশনার পদে মনোনয়ন দেন। তারা বাংলাদেশ সরকারকে এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট বুঝতে পারে যে এটি একটি মারাত্মক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ভারতীয় অফিসারদের ডিসি নিয়োগ দিলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যবস্থায় রাজি হয়নি। বাংলাদেশের যেসব প্রশাসনিক ও পুলিশের কর্মকর্তা তখন মুজিবনগর সরকারের অধীনে ছিল, তাদের মধ্যে যথেষ্ট ভালো কর্মকর্তা ছিল। তবে তাদের অনেকের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের দেশপ্রেম, তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে–এই বিশ্বাসে বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস থেকে ১৯টি জেলার ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ডিসিরা প্রশাসনের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের তাদের জেলায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। মুজিবনগর সরকার না থাকলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে দ্রুততার সঙ্গে প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা করা সম্ভব হতো না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আমলাতন্ত্র এই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহায়তা করেছে। কিন্তু আমলাতন্ত্রের কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব ছিল না। এর ফলে পাকিস্তান কিংবা ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বলতা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রশাসনে প্রতিফলিত হয়।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

নভেম্বর, ১৯৭১ থেকে ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক সহায়তা অনেক বাড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ভারত এবং পাকিস্তান বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে ভারত আক্রমণের চেষ্টা করে। এর ফলে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথমে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভুটান সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের অনেক জায়গা দখল করে নেয়। এবং করাচি ও লাহোরের সংযোগ সড়কের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিন ডুবিয়ে দেওয়া হয় এবং ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি বন্দরে বারবার আক্রমণ চালায়। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সব বিমান দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিমানবন্দরগুলোতে লুকিয়ে রাখা হয়। এর ফলে পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ভারতীয় নৌবাহিনী একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের সহায়তায় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কয়েকটি সেনাছাউনির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। এই অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর আবদুল মোতালেব মালিক ইস্তফা দেন। জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলী আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সৈনিকদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেন। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলবেলা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সর্বাধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি ভারতের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। ১৬ ডিসেম্বর আমি এবং কামাল সিদ্দিকী থিয়েটার রোড অফিসে সকালবেলা খোঁজখবর নিতে যাই। দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ আসে যে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য অনুরোধ আসে। ওই দিন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী একটি হেলিকপ্টারে করে সিলেট সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পরিচালনা করছিলেন। এ সময়ে পাকিস্তান বাহিনীর গুলিতে হেলিকপ্টারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আক্রমণে ওসমানীর গায়ে কোনো আঘাত লাগেনি কিন্তু তার সঙ্গী ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ কর্নেল এম এ রব আহত হন। তাই জেনারেল ওসমানীর পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যদি জেনারেল ওসমানী কলকাতায় থাকতেন, তাহলেও তিনি ভারতীয় সেনানায়কের কনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে এই অনুষ্ঠানে যেতেন কি না, সন্দেহ রয়েছে।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারও তখন কলকাতায় ছিলেন না। তিনি ব্যারাকপুরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁকে দ্রুত কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি যখন ঢাকায় যাওয়ার জন্য থিয়েটার রোডের অফিস থেকে যাচ্ছিলেন, তখন আমরা সেই অফিসে ছিলাম। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার যাওয়ার পর আমরা নিশ্চিত হই যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবশ্যই আত্মসমর্পণ করবে। আমরা বাসায় ফিরে গিয়ে রেডিওর সামনে বসে পড়ি। রেডিওতে ঘোষণা এল শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হলো।[১]

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. মুক্তিযুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনার জন্য পড়ুন : (১) B.Z. Khasru, Myths and Facts Bangladesh Liberation War, 2010 (Rupa Publications India Pvt. Ltd.), () Srinath Raghavan, A Global History of the Creation of Bangladesh, 2013, (Permanent Black) (৩) মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান, ফ্যান্টমস অব চিটাগং দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ, ২০০৫ (ঘাসফুল নদী)