একাদশ অধ্যায়
মুক্ত হবিগঞ্জ
৭ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৯৭১
৭ মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। রমনা রেসকোর্স ময়দানে সেদিন অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার ডাক দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক প্রশাসন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরিচালনা করতে হবে। প্রথমে ঘোষণা করা হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিও ও টিভিতে প্রচারিত হবে। রেডিও-টিভির স্থানীয় প্রশাসন এই ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা ঠিকই করেছিল কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে সরাসরি প্রচার করতে দেয়নি। পরবর্তীকালে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ প্রশমিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করা হয়।
তখন হবিগঞ্জ মহকুমায় তিনটি টিভি ছিল। একটি ছিল শাহজীবাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রে টিলার ওপরে ম্যানেজারের বাংলোতে আর দুটি ছিল চা-বাগানের উঁচু টিলার ওপরে অবস্থিত দুই চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে। অবশ্য রেডিও অনেক ছিল। রেডিওতে আমরা তাঁর বক্তৃতা শোনার চেষ্টা করছিলাম। যদিও তাঁর বক্তৃতা সরাসরি শুনতে পাইনি, তবু তাঁর বক্তব্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা তাই পরের দিন খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশসমূহ পাঠ করি এবং এগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করি।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল যেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে স্থানীয় প্রশাসন কর্মসূচি নির্ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে যেখানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব সমন্বিত বা ঐক্যবদ্ধ ছিল, সেখানে প্রশাসন চালানো ছিল সহজ। হবিগঞ্জে স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সব নেতা কর্মী ঐকমত্য ছিলেন। তবে তাদের নেতারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না। হবিগঞ্জে জাতীয় সংসদের তিনজন সদস্য ছিলেন। এঁরা তিনজনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। তবে এঁদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ মোস্তফা আলী জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জ ও লাখাই থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আশা করতেন যে যেহেতু তিনি দলের সভাপতি ও নির্বাচিত প্রতিনিধি, সেহেতু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হবে। তবে বাহুবল, চুনারুঘাট ও মাধবপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মানিক চৌধুরী। তিনি ছিলেন বয়সে তরুণ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তাঁর সঙ্গে অন্যান্য দলের সম্পর্ক ছিল খুবই খারাপ।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব। তিনি বানিয়াচং-নবীগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের সমস্যা বুঝতেন। তাই তার পরামর্শ নেওয়া ছিল আমার জন্য সহজ। ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে তাঁর খুবই সুসম্পর্ক ছিল। আমার সবচেয়ে বড় চাচাতো ভাই মেজর শওকত আলী খাঁন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব একই ব্যাচে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সূত্রে আমি তাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। তিনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁর উপস্থিতির ফলে সৈয়দ মোস্তফা আলী এবং মানিক চৌধুরীর দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে আমার পক্ষে প্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবের সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে স্বাধীনতার পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা খসরুজ্জামান চৌধুরী লিখেছেন :
Akbar Ali Khan was lucky. his was an area not accessible by the army. He was lucky because he had one elected representative who was a retired army Colonel. This gentleman was Lt. Col. M. A. Rab who was elected on Awami League ticket. A staunch supporter of Bangalee nationalism and the rights for the Bangalees. Lt. Col. M. A. Rab (He is now a Major General and is a full time Managing Director of the Freedom Fighters Welfare Trust) had never been looked upon favourably by the ruling army clique. Akbar Ali Khan was lucky to get his support, advice and active cooperation.1
লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপসেনাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং নীরবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দীর্ঘদিন তাঁকে বড় ধরনের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এ বিষয়টি নিয়ে আমার মনে ক্ষোভ ছিল। ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন, তখন কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার বাড়িও রব সাহেবের নির্বাচনী এলাকায়। তিনি রব সাহেবের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য যখন মনোনয়ন চাওয়া হয়, তখন আমি কিবরিয়া সাহেবকে অনুরোধ করি যেন তিনি রব সাহেবের নাম প্রস্তাব করেন। জবাবে কিবরিয়া সাহেব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দেশে ছিলেন না। আমি যেহেতু তার সঙ্গে কাজ করেছি, সেহেতু তাঁর নাম আমার পক্ষে প্রস্তাব করাই শোভনীয় হবে। অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে আমি তার নাম প্রস্তাব করি। অর্থসচিব হিসেবে আমি জাতীয় পুরস্কার কমিটির সদস্য ছিলাম। আমি তার মনোনয়নের পক্ষে মৌখিক বক্তব্য পেশ করি। কমিটি তাঁর নাম স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করে। তবে কমিটির সভাপতি আমাকে বলেন, তাদের সব সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেন না। কাজেই যদি রব সাহেবের পুরস্কার নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে আমাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি এবং এই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য অনুরোধ করি। জনাব রবকে সে বছর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।
৭ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রশাসন চালু ছিল ঠিকই কিন্তু ২৫ মার্চ পর্যন্ত সবাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। যেহেতু হবিগঞ্জে কোনো সেনানিবাস ছিল না, সেহেতু এখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি। ঢিলেঢালাভাবে প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছিল।