» » একাদশ অধ্যায়

বর্ণাকার

২৭ মার্চ ১৯৭১–১ এপ্রিল ১৯৭১

পরের দিন (২৭ মার্চ ১৯৭১) বন্দুকের জন্য আবার দরবার শুরু হয়। স্থানীয় লোকজন এসডিপিওর কাছে বন্দুক চায়। তিনি বলে দেন যে এসডিও হুকুম দিলে তিনি বন্দুক দেবেন। অন্যথায় সরকারের বন্দুক রক্ষা করার জন্য তার পুলিশ সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। সুতরাং সবাই আমার আদেশের জন্য উপস্থিত হন। কিন্তু আমি এই জনতার মধ্যেও উপদল দেখতে পাই। মানিক চৌধুরীর সমর্থকেরা বন্দুক নেওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে উদ্গ্রীব ছিল কিন্তু কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতার মনে মানিক চৌধুরীর সমর্থকদের বন্দুক দেওয়া সঠিক হবে কি না, সে সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল। আমি এ সম্পর্কে লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবের সঙ্গে পরামর্শ করতে চেয়েছিলাম। তিনি তখন আগরতলা সীমান্তে। তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব ছিল না। আমি তার কাছে একজন বার্তাবাহক পাঠাই। সারা দিনেও রব সাহেবের কাছ থেকে কোনো বার্তা পাইনি। আমি জনতাকে বলি যে আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করছি এবং আগামীকাল এ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত দেব।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বন্দুকের জন্য দুই দাবিদার আমার বাংলোয় এসে হাজির হয়েছে। হবিগঞ্জের জনগণের পক্ষ থেকে এসেছেন মেজর সি আর দত্ত। মেজর সি আর দত্তের বাড়ি হবিগঞ্জ মহকুমা শহরে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি দুই মাসের ছুটি নিয়ে হবিগঞ্জে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি হবিগঞ্জে একজন মুক্তিযোদ্ধা নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। অন্যদিকে দাবিদার ছিলেন একজন ক্যাপ্টেন। এই তরুণ অফিসারকে পাঠিয়েছেন মেজর খালেদ মোশাররফ। মেজর খালেদ মোশাররফ দাবি করছেন যে বন্দুকগুলো যদি তাকে দেওয়া হয়, তাহলে তার সদ্ব্যবহার হবে। তবে বন্দুকগুলো যদি স্থানীয় লোকজনকে দেওয়া হয়, তাহলে এ বন্দুকগুলোর হিসাব রাখা যাবে না। এ সম্পর্কে আমার উপস্থিতিতে ক্যাপ্টেন সাহেব এবং মেজর সাহেব তর্ক শুরু করেন। তর্কের মাধ্যমে সমাধান না হওয়ায় তারা তাদের রিভলবার বের করে একে অপরকে গুলি করার হুমকি দেন। আমি কোনো রকমে তাদেরকে কোনো অপ্রীতিকর কাজ করা থেকে বিরত করি এবং প্রস্তাব করি অফিসে আমি এ ব্যাপারে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। অফিসে যাওয়ার আগেই আমি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবের পরামর্শ পাই।

অফিসে যাওয়ার পর মানিক চৌধুরী একটি রিভলবার নিয়ে আমার অফিসে হাজির হন এবং ধমকের সুরে বলেন, আমি তাঁকে বন্দুক দেওয়ার আদেশ না দিলে তিনি আমাকে গুলি করবেন। ততক্ষণে কর্নেল রবের কাছ থেকে আমি পরামর্শ পেয়ে গেছি যে স্থানীয় লোকজনকে বন্দুকগুলো দেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। আমি হেসে একটা কাগজ নিয়ে বন্দুকগুলো আনসারের মহকুমা কমান্ডারের মাধ্যমে দেশ রক্ষার জন্য দেওয়ার আদেশ দিই। কমান্ডার মানিক চৌধুরী এই আদেশ নিয়ে ট্রেজারির রক্ষীদের দেন। ট্রেজারির রক্ষীরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ নিয়ে বন্দুকগুলো মানিক চৌধুরীর অনুসারীদের হাতে দেয়। এরা বন্দুকগুলো নিয়ে সোজা সিলেটের দিকে রওনা হয়ে যায়।1

বন্দুক দেওয়ার আদেশে আমি আমার পদবি নিম্নরূপে বর্ণনা করি। ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আকবর আলি খান এসডিও হবিগঞ্জ’। আমি আকবর আলি খান বানানটি একটু ভিন্নরূপে লিখি। সাধারণত আলি শব্দটি বাংলায় ‘ী’ দিয়ে লেখা হয়। আমি ‘ি দিয়ে লিখি। খান শব্দটি বানানে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে লেখা হয়। আমি চন্দ্রবিন্দু দিয়ে লিখি না। একটানা আমার স্বাক্ষর নিম্নরূপ আকার ধারণ করে।

আকবর আলি খান

মুক্তিযুদ্ধের মুহূর্তে আমি এই স্বাক্ষর শুরু করি এবং আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও এই একই স্বাক্ষর আমি সব কাগজপত্রে করে থাকি। আমি কানাডায় সাড়ে পাঁচ বছর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আট বছর ছিলাম। সেসব দেশের ব্যাংকেও আমি বাংলায় চেকে এই স্বাক্ষর করেছি এবং এ স্বাক্ষর নিয়ে পৃথিবীর কোথাও আমার কোনো অসুবিধা হয়নি।

হবিগঞ্জে এসডিওর বাংলোতে আমি একা থাকতাম। ২৬ মার্চের পর অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিল যে একা থাকা আমার পক্ষে মোটেও সমীচীন নয়। বিভিন্ন কারণে অনেক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আমার ওপর অসন্তুষ্ট থাকতে পারে। তারা রাতে হামলা চালানোর চেষ্টা করতে পারে। আমি তাই ২৯ মার্চে হবিগঞ্জে বিডি হল নামে একটি ডাকবাংলোতে রাতে থাকি। সেখানে আবদুল লতিফ নামে একজন শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা সপরিবার থাকতেন। ৩০ মার্চ আমি লাখাই যাই। লাখাইয়ে থানা ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে দুদিন থাকি। আমি লাখাই থেকে ২ এপ্রিল হবিগঞ্জে যাই।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আমি ভুলে বলে ফেলেছিলাম তাকে আমি নিজ হাতে হবিগঞ্জ ট্রেজারিতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলাম। আসলে হবিগঞ্জ ট্রেজারিতে কোনো অস্ত্র প্রদানের অনুষ্ঠান হয়নি।