নবম অধ্যায়
রাজশাহীতে শিক্ষানবিশকাল
অক্টোবর ১৯৬৮ — নভেম্বর ১৯৬৯
সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণার্থীদের নানা বিষয়ে পড়ানো হতো। কিন্তু প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য শুধু বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণার্থীকে দক্ষ করা নয়; মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচিত কর্মকর্তাদের অফিসার হওয়ার উপযুক্ত করা। সিভিল সার্ভিসের সমালোচকেরা দাবি করতেন যে একাডেমিতে প্রশিক্ষণার্থীদের উন্নাসিক কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলা হতো। সাধারণ মানুষের জন্য তাদের কোনো উৎসাহ ছিল না। আমার মনে হয় এ সমালোচনাটি ঠিক নয়। দুর্বিনীত কর্মকর্তা সৃষ্টির জন্য কোনো একাডেমির প্রয়োজন হয় না, যেখানেই একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়, সেখানেই কর্মকর্তারা কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই জালেম হয়ে ওঠেন। এই প্রসঙ্গে Lord Acton-এর বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে, ‘Power corrupts and absolute power corrupts absolutely.’ কাছে মনে হয় সিভিল সার্ভিস একাডেমির প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য ছিল ২৪ ঘণ্টা দায়িত্বের জন্য কর্মকর্তাদের প্রস্তুত করা।
১৯৬৮ সালের অক্টোবরে লাহোর একাডেমির কর্মসূচিসমূহ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে আমরা ঢাকায় ফিরে আসি। ঢাকায় তখন সার্ভিসেস অ্যান্ড জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের উপসচিব ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ, যিনি পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঢাকায় পৌঁছার পরদিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদের পোস্টিং অর্ডার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমাকে রাজশাহী জেলার শিক্ষানবিশ অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নিয়োগ করা হয়েছে। আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমি রাজশাহী যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। বিমানে করে তখন ঈশ্বরদী পর্যন্ত যাওয়া যেত। ঈশ্বরদী থেকে ট্রেন অথবা গাড়ি করে রাজশাহী যেতে হতো। ঢাকার বন্ধুবান্ধব পরামর্শ দিল যেন। আমি ডেপুটি কমিশনারের কাছে ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী যাওয়ার জন্য একটি জিপ পাঠানোর ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে একটি তারবার্তা পাঠাই। ঈশ্বরদীতে নেমে আমি কোথাও জিপ দেখতে পাইনি। সৌভাগ্যবশত পিআইএ ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী পর্যন্ত যাত্রীদের জন্য একটি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করেছিল। আমি অগত্যা সবশেষে কোনো রকমে ওই মাইক্রোবাসে স্থান করে নিলাম। ঘণ্টা তিনেক পরে গাড়ি রাজশাহী সাহেববাজার পিআই এ অফিসে হাজির হয়। গাড়ি থেকে নেমে দেখি একটি সরকারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামার পর এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে আমাকে প্রশ্ন করেন। যে আমার নাম আকবর আলি খান কি না? আমি হ্যাঁ বলাতে তিনি পরিচয় দেন যে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট নাজির আবদুর রহিম। তিনি এসেছেন আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গাড়িতে বসতেই তিনি বললেন, ডেপুটি কমিশনার তাঁকে পিআইএ অফিস থেকে আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি রাজশাহীর বাইরে সফরে গেছেন এবং সন্ধ্যার পর তিনি শহরে ফিরবেন। ফিরেই তিনি আমাকে ফোন করবেন। আমার সঙ্গে তাকে একটি জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
আমি রাজশাহী সার্কিট হাউসে এসে নামলাম। সার্কিট হাউসে তখন দুটি অংশ ছিল। একটি অংশে ছিল পাঁচটি কামরাসহ একটি ভবন। একটি কামরা ড্রয়িং কাম ডাইনিং হিসেবে ব্যবহৃত হতো আর চারটি কামরা ছিল শয়নকক্ষ। সার্কিট হাউসের নতুন ভবন ছিল দ্বিতলবিশিষ্ট। দ্বিতল ভবনে চারটি কক্ষ ছিল। তার মধ্যে একটি কক্ষ ছিল ভিভিআইপিদের জন্য। নিচের তলায় ছিল একটি কনফারেন্স রুম এবং একটি ডাইনিং রুম ও একটি শয়নকক্ষ। এই শয়নকক্ষটিতেই থাকতেন আমার পূর্ববর্তী প্রশিক্ষণার্থী হাবিবুন নবী আশিকুর রহমান, তিনি মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে চলে গেছেন। তাঁর শূন্য কক্ষটি আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়। কক্ষটিতে একজনের থাকার জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছিল। এমনকি বাথরুমের পাশে জিনিসপত্র রাখা এবং সাজসজ্জার জন্য একটি ছোট কক্ষও ছিল। পরে সার্কিট হাউসে আরও দুটি তলা বাড়ানো হয়েছে। তবে এই কক্ষটি ২০০১ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল।
সার্কিট হাউসে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ডেপুটি কমিশনার খন্দকার আসাদুজ্জামানের টেলিফোন কল আসে। তিনি বলেন, ‘তুমি এসেছ ভালো হয়েছে। আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে ডিনার খাবে। অ্যাসিস্ট্যান্ট নাজির রহিম তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে আসবে। আমি রাত আটটার দিকে ডিসির বাংলোয় যাই। তিনি তখন কনফিডেনশিয়াল রুমে বসে কাজ করছিলেন। আমি যাওয়ার পর খাওয়াদাওয়া হয়। টেবিলে আমাদের সঙ্গে আরও যোগ দেন মিসেস আসাদুজ্জামান এবং তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। খেতে খেতে আসাদুজ্জামান আমার বাড়ি কোথায়, বাবা কী করেন এ ধরনের পরিচিতিমূলক প্রশ্নগুলো সেরে নেন। তারপর বলেন, ‘তুমি আমার জন্য ঠিক সময় এসে পৌঁছেছ। ঠিক সময় কেন তা আমি বুঝতে পারিনি, তাঁর দিকে তাকাতেই বললেন, ‘ঠিক সময় এ জন্য যে আমার নওগাঁর মহকুমা প্রশাসক। মহীউদ্দীন খান আলমগীর পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি হয়ে গেছে। আগামী পরশু দিন সে নওগাঁ থেকে চলে যাবে। অথচ গত তিন দিন ধরে নওগাঁ মহকুমায় আত্রাই নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত এবং সেখানে সুষ্ঠুভাবে রিলিফ কাজ পরিচালনার দরকার রয়েছে। তুমি কাল ভোরে নওগাঁ চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে ত্রাণের সব দায়িত্ব বুঝে নেবে।
আমি সবে রাজশাহীতে এসেছি। সার্কিট হাউস এবং ডিসির বাংলো ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। আমার ইচ্ছা করছিল যে যদি এই সফর অন্তত দু-দিন পেছানো যায়। আমি বললাম, ‘স্যার, বন্যাদুর্গত অঞ্চলে কাজ করতে হলে টিএবিসি (টাইফয়েড, এমিবিক, বেসিলারি, কলেরা) প্রতিষেধক নেওয়া উচিত। আমি গত দু-তিন বছর টিএবিসি নিইনি। যদি অনুমতি দেন, তাহলে টিএবিসি নিয়ে দিন দুয়েক পরে আমি নওগাঁ যাই।’
আসাদুজ্জামান বললেন, না, তোমাকে কালকেই যেতে হবে। তোমাকে কাল ভোর পাঁচটার সময় টিএবিসি ইনজেকশন দেওয়া হবে। ভোর ছযটার সময় তোমাকে জিপে করে নাটোরে নিয়ে সান্তাহারগামী ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে (রাজশাহী থেকে সরাসরি সান্তাহার যাওয়া যেত না, ট্রেন বদল করে সান্তাহার যেতে অনেক সময় লাগত)। তিনি সহকারী নাজিরকে ডাকলেন এবং বললেন রাজশাহী মিউনিসিপ্যালটির কোনো ভ্যাকসিনেটরের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ করে সকাল পাঁচটায় আমাকে টিএবিসি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পরদিন সকালে রহিম ঠিক পাঁচটার সময় এসে হাজির। আমাকে টিএবিসি ইনজেকশন নিতে হলো। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে রাজশাহীর সহকারী নাজির রহিম খুবই করিতকর্মা ছিল। বস’দের আদেশ সে যেকোনো মূল্যে প্রতিপালন করত। বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি, তখন রহিম গণভবনের নেজারতে চাকরি পায় এবং সেখানে নেজারতের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাকে রাজশাহীতে ফেরত পাঠানো হয়। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের নাজির হিসেবে সে অবসর গ্রহণ করে।
আমি নাশতা খেয়ে নাটোরের উদ্দেশে রওনা হলাম। টিএবিসি ইনজেকশন নিলে আমার জ্বর উঠত। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নাটোর পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার জ্বর উঠতে শুরু করে। ট্রেনে যখন উঠি, তখন দেহে ১০০ থেকে ১০১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। এই জ্বর নিয়ে আমি সান্তাহারে নামি। সান্তাহার স্টেশনে নওগাঁর এসডিও ম্যালেরিয়া নির্মূল বিভাগের একটি গাড়ি রিকুইজিশন করে আমার জন্য পাঠিয়ে দেন। এই গাড়ি আমাকে নওগাঁ সড়ক ও রাজপথ বিভাগের পরিদর্শন বাংলোতে নিয়ে আসে। বিকেলবেলায় মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানান। সন্ধ্যায় যখন তাঁর বাড়িতে আমি যাই, তখন তিনি অফিসের শেষ কাজকর্ম করছিলেন। আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গিয়ে সেখানে আমার জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী বললেন তাদের কয়েকটি ফেয়ারওয়েলে যেতে হবে। আমার জ্বর। তাই বেশি রাত পর্যন্ত সজাগ থাকা সম্ভব নয়। আমি যেন তাঁর বাড়ির খাবার খেয়ে রাতে রেস্টহাউসে গিয়ে বিশ্রাম করি। পরদিন সকালে তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন।
আমি তাদের সাফল্য কামনা করি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি এসডিওর অফিসে যাই। সেখানে ত্রাণের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানি, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পত্নীতলা ও মহাদেবপুর থানা দুটি। নওগাঁ থেকে মহাদেবপুর হয়ে পত্নীতলা যাওয়ার যে সড়ক আছে, তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এখন পত্নীতলা যেতে হলে পাহাড়পুরের পাশ দিয়ে একটি বিকল্প সড়কে উঠে অনেক ঘুরে পত্নীতলা যাওয়া যাবে। আমি এ বিকল্প সড়ক দিয়ে পত্নীতলায় রওনা হয়ে যাই। সেখানে সার্কেল অফিসারকে খুঁজে বের করি এবং তাঁর সঙ্গে নৌকায় করে বন্যা-উপদ্রুত অঞ্চলে যাই। এই অঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল, তবে কেউ মারা যায়নি। আমি দেখতে পাই যে ওই অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। সুতরাং ত্রাণ কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে।
আমি রাতে নওগাঁ শহরে ফিরে আসি। পরের দিন আবার একই সড়ক। দিয়ে আমি পত্নীতলায় যাই। সেখান থেকে সড়ক দিয়ে আমি মহাদেবপুর পর্যন্ত পৌঁছি। সেখানে নৌকা করে আমি আবার বন্যাদুর্গত অঞ্চল ঘুরতে যাই। বিকেলবেলা আমি নওগা ফিরে আসি। সেদিন সন্ধ্যায় ডেপুটি কমিশনার ফোন করেন দুদিন পর তিনি নওগাঁ আসছেন। এই দুদিন আমি প্রত্যেক দিনই রিলিফের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করছিলাম। এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছিলাম। দুদিন পর ডেপুটি কমিশনার নওগাঁ আসেন। তখন বন্যার পানি নেমে গেছে। তিনি রিলিফের কাজকর্ম দেখে সন্তুষ্ট হন এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের হাতে রিলিফের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে নিয়ে রাজশাহী ফিরে আসেন। প্রায় দিন সাতেক পর আমি রাজশাহীতে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করি।
আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দায়িত্ব
প্রশিক্ষণার্থীদের জেলা প্রশাসনে সংযুক্ত করা হতো জেলা প্রশাসনের কাজকর্ম শেখার জন্য। আমাকে প্রথমেই অনেকগুলো বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাকে ইংলিশ বিভাগের অফিসার ইনচার্জ করা হয়। ইংলিশ বিভাগের দায়িত্ব ছিল ডেপুটি কমিশনারের অফিসের সব সাধারণ চিঠিপত্রের জবাব দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এই বিভাগের দায়িত্বে থাকতেন ডেপুটি কমিশনারের অফিসের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি ডেপুটি কমিশনারের অফিসে যেসব চিঠিপত্র আসত, সেসব চিঠিপত্র ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্ধারিত বিভাগে পাঠাতেন। আমি তিন-চার দিন তার সঙ্গে বসে এ কাজটি করা দেখি। আমাকে ডেভেলপমেন্ট বিভাগের অফিসার ইনচার্জ করা হয়। প্রতি মাসে জেলার সব উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে একটি সভা হতো। এই সভার কার্যপত্র উন্নয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক তৈরি করা হতো। তিনি সভার সিদ্ধান্তগুলোও লিপিবদ্ধ করতেন।
আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ শেখার জন্য সপ্তাহে দুদিন রাজশাহী সদর এসডিওর অফিসে কাজ করতে হতো। মাস দুয়েক পর আমাকে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমি সদর এসডিওর আদালতে পুলিশ ফাইল এবং জেনারেল ফাইলের কাজ করতাম। এখানে সব মামলা রুজু করা হতো এবং বিচারের জন্য প্রস্তুত মামলাগুলো ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে বিতরণ করা হতো, আসামিদের জামিন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। মহকুমার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ও মহকুমার সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য এই কাজটি ছিল অত্যাবশ্যক। আমি কয়েক মাস এ কাজটি করি। এর ফলে মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আমার দায়িত্বের জন্য সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ লাভ করি।
এ ছাড়া ট্রেজারিতে প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে সপ্তাহে কমপক্ষে এক দিন। ট্রেজারি অফিসারের সঙ্গে বসতে হতো। তখন রাজশাহীতে ট্রেজারি অফিসার ছিলেন আবদুর রহিম নামের একজন ইপিসিএস অফিসার। তিনি ছিলেন ১৯৫৯ ব্যাচের সিএসপি আবদুস সালাম এবং আবদুস সামাদের বড় ভাই। তিনি ট্রেজারির বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। আমার আরেকটি দায়িত্ব ছিল জেলা জজদের আদালতে বিচারের সময় উপস্থিত থেকে তিনটি মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ শুনে তা লিপিবদ্ধ করা এবং সাক্ষ্য আইনের কোন ধারায় তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তা মার্জিনে উল্লেখ করা। জেলা জজ তা সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হলে প্রাদেশিক সরকারকে তা জানিয়ে দিতেন। আমার ওপর তখন এত কাজ অর্পিত হয়েছিল যে এ কাজটি আমি সম্পন্ন করা দূরে থাকুক, শুরুই করতে পারিনি। কিছুদিন পরপর বিভাগের দায়িত্ব পরিবর্তন করা হতো। আমাকে লাইব্রেরি এবং LAO (ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অফিসার)-এর দায়িত্ব ছাড়া আর সব বিভাগের দায়িত্ব কমপক্ষে এক মাসের জন্য দেওয়া হয়। আমি এনডিসি (নেজারত ডেপুটি কালেক্টর) এবং আরডিসির (রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর) দায়িত্বও পালন করেছি।
এসব আনুষ্ঠানিক কাজের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। অনানুষ্ঠানিকভাবে আমি ছিলাম আমার ডেপুটি কমিশনারের একান্ত সচিব। ডেপুটি কমিশনারের অফিসে ঢুকতে হলে আমার অফিস দিয়ে ঢুকতে হতো। ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার জন্য যখন কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি আসতেন, তখন তিনি আমার রুমে বসে অপেক্ষা করতেন। এভাবেই রাজশাহীর আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা কামারুজ্জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমার অফিসে এসে বসতেন। আমি তাকে ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতাম। ডেপুটি কমিশনার যখন রাজশাহীর বাইরে কোনো প্রকল্প বা অফিস পরিদর্শনে যেতেন, তখন তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। কীভাবে অফিস পরিদর্শন করতে হয়, সে সম্পর্কে প্রথম সবক আমি খন্দকার আসাদুজ্জামানের কাছ থেকেই পাই। আবার ডেপুটি কমিশনার যখন রাতে বোয়ালিয়া ক্লাবে যেতেন, তখনো তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। প্রায় সারা দিনই আমাকে ডেপুটি কমিশনারের পাশে থাকতে হতো। এর ফলে আমার ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারদের চেয়েও বেশি ছিল। নাটোরে তখন মহকুমা প্রশাসক ছিলেন ১৯৬৫ ব্যাচের আখতার আলী। ডিসি অফিসে নাটোরের কোনো ফাইল আটকে গেলে তিনি আমাকে ফোন করতেন। আমি বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলাম।