ড. জোহার শাহাদতবরণ এবং উত্তাল রাজনীতি

আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ দেখা দিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তা দমন করার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যায়। তারা ছাত্রদের গুলি করার চেষ্টা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জোহা তাতে বাধা দেন। বর্বর পাকিস্তান বাহিনী ড. জোহাকে গুলি করে এবং তিনি। ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ড. জোহাকে হত্যার পর ডেপুটি কমিশনারকে তার। লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হয়। ওই সময়ে যাতে কোনো নতুন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, সে জন্য ডেপুটি কমিশনারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নিতে হয়। ড. জোহার মৃত্যুতে ডেপুটি কমিশনারসহ আমরা সবাই ভেঙে পড়ি। ড. জোহা মামুনুর রশীদের খালুশ্বশুর ছিলেন। তাঁর বাড়িতে আমি দাওয়াত খেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গেলে প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। ড. জোহা মারা যাওয়ার পর ডেপুটি কমিশনার আসাদুজ্জামান একেবারেই ভেঙে পড়েন। তখন আমাদের পুরো ব্যাচ তাকে মানসিক সমর্থন দেওয়ার জন্য প্রায় সারা দিন তার সঙ্গে থাকতাম।

বুনিয়াদি গণতন্ত্র তদন্ত কমিশন

বুনিয়াদি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ এ বিক্ষোভ নিরসনের জন্য প্রতিটি জেলায় একটি সামরিক শাসন টিম নিযুক্ত করে। এই টিমের প্রধান ছিলেন সেনাবাহিনী মনোনীত একজন মেজর। সদস্য ছিলেন সিঅ্যান্ডবির একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন জেলার একজন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার। খন্দকার আসাদুজ্জামান তাঁর কোনো অতিরিক্ত জেলা কমিশনারকে একজন মেজরের অধীনে কমিটি সচিবের দায়িত্ব দিতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি সরকারকে লিখলেন, রাজশাহীতে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তাদের কাউকে এই তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। সুতরাং রাজশাহী জেলার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে এই কমিটির সচিবের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। রাজশাহীতে যে মেজরকে কমিটির সভাপতি করা হয়, তিনি খুবই ভালো লোক ছিলেন। আমার প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সুতরাং কমিটির সব কাজ আমাকেই করতে হয়েছে। তত দিনে বিভিন্ন জেলায় সামরিক আইন কমিটির অনেক দুর্নীতিবাজ বুনিয়াদি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং তাদের গ্রেপ্তার করেছে। রাজশাহী জেলা থেকে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ রাজশাহীর কমিটির সভাপতি মেজরকে চাপ দেয়।

অন্যদিকে ডেপুটি কমিশনার আমাকে বুনিয়াদি গণতন্ত্রীদের যেন অহেতুক সামরিক আইনের মুখোমুখি হতে না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেন। শেষ পর্যন্ত একজন বুনিয়াদি গণতন্ত্রের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়। তিনি ছিলেন বড়াইগ্রাম উপজেলার একজন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। একটি পাকা রাস্তা নির্মাণের ব্যাপারে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, এ ধরনের অভিযোগ ওঠে। নির্বাহী প্রকৌশলী মেপে দেখতে পান। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে যে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে, তা কাগজ-কলমে যা রয়েছে, তার প্রায় ৪০ ভাগ কম। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের সামরিক আদালতে বিচার হয় এবং তাকে দুই বছরের জেল দেওয়া হয়। আমি এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য কয়েকটি সমীক্ষা করি। এই সমীক্ষার তথ্য সংগ্রহ করে দেন সার্কেল অফিসাররা (উন্নয়ন)। এসব সমীক্ষার ভিত্তিতে আইন সংশোধনের জন্য আমরা কতগুলো সুপারিশ করি। সব জেলার সুপারিশসমূহ একত্র করে প্রাদেশিক সরকার স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কতিপয় সুপারিশ মন্ত্রিসভায় পেশ করে। তবে এ ব্যাপারে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

সচিবালয় প্রশিক্ষণ এবং পূর্ব পাকিস্তান সফর

জুলাই মাসের শেষ দিকে সচিবালয়ে প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের ব্যাচকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগেও আমাদের দুবার ঢাকায় আসতে হয়েছিল। একবার ১৯৬৯ সালের মার্চে। তখন সব আইন ট্রেজারি রুল নিয়ে চার-পাঁচ দিন আমাদের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। পরীক্ষার শেষ দিন ছিল ভূমি আইনের পরীক্ষা। ঘণ্টাখানেক আমরা ভূমি আইনের প্রশ্নের জবাব মনোযোগ দিয়ে লিখি। ঘণ্টাখানেক পর আমাদের পূর্বতন ব্যাচের একজন সহকর্মীকে নকলের কাগজসহ ধরে ফেলা হয়। এসব কাগজ জমা দিলে তার চাকরি চলে যেতে পারে। উপস্থিত অনেক সহকর্মীর মনে ধৃত সহকর্মীর জন্য সমবেদনা জেগে ওঠে। আমাদের ব্যাচের ১৩ জনের মধ্যে আমরা ৭-৮ জন হইচই করা শুরু করি। শেষ পর্যন্ত ধৃত সহকর্মীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করে তার খাতাটি রেখে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে তিনি যা লিখেছেন, তাতে পাস। করার সম্ভাবনা ছিল না। এ ব্যাপারটি মীমাংসা হতে প্রায় এক ঘণ্টা চলে গিয়েছিল। আমরাও খাতাগুলো জমা দিয়ে চলে এলাম। গন্ডগোল না করলে অবশ্যই এ পরীক্ষায় পাস করতাম। গন্ডগোল করায় আমাদের ভূমি আইনে সেই পরীক্ষায় পাস করা হয়নি। পরীক্ষা না দিয়ে আমরা একজন সহকর্মীর উপকার করেছি ঠিকই কিন্তু ন্যায়নীতির দিক থেকে দেখতে গেলে এ ধরনের উপকার করা ঠিক হয়নি। জুন ১৯৬৯-এ আমরা ভূমি আইনে পরীক্ষা দিই। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য দিন চারেক ঢাকা সফরের অনুমতি পাই। এই পরীক্ষায় আমরা পাস করে যাই।

জুলাই ১৯৬৯-এর দিকে আমাদের ব্যাচের সচিবালয়ে সংযুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। সচিবালয় সংযুক্তিতে কীভাবে সচিবালয় থেকে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং সচিবালয়ে কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

সচিবালয়ে সব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। সচিবেরা তাদের মন্ত্রণালয় কীভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করেন এবং মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম কীভাবে উন্নত করা যাবে, সে সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনার কথাও আমাদের জানান। ওই সময় সচিবালয়ে কর্মরত উপসচিবদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ হয়। বিশেষ করে নাজেম আহমদ চৌধুরী এবং রশীদুর রেজা ফারুকীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সচিবালয়ে প্রশিক্ষণের শেষ দিন আমাদের চিফ সেক্রেটারির দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। সফিউল আজম। আমাদের ব্যাচের মিজানুর রহমান শেলীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে তার পরিচয় ছিল। উপরন্তু আমাদের ব্যাচের এ কে শামসুদ্দীনের সঙ্গে তাঁর শ্যালিকার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাই তিনি আমাদের ব্যাচের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক আচরণ করেন। তিনি জানতে চান, আমাদের প্রশিক্ষণের কোনো ফাঁক রয়েছে। কি না। শাহেদ সাদুল্লাহ বলেন, আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন জেলা শহরে সফর করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। সফিউল আজম বললেন, ‘খুব ভালো প্রস্তাব এবং পূর্ব পাকিস্তানে তোমাদের সফরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কোথায় যেতে চাও? আমরা জবাব দিলাম, ‘আমরা সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে সফর করতে চাই।’ সফিউল আজম এতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, আমাদের কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এই পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে। তোমরা পূর্ব পাকিস্তান সফর করবে কিন্তু এই সফরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প, দত্তনগর কৃষি খামার এবং ঠাকুরগাঁও নলকূপ সেচ প্রকল্প। এসব প্রকল্প সম্পর্কে তখন আমাদের কোনো ধারণা ছিল না।

আমাদের পূর্ব পাকিস্তান সফর শুরু হয় কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থেকে। ভেড়ামারায় তখন গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের সদর দপ্তর ছিল। এই প্রকল্পে গঙ্গার পানি কপোতাক্ষ নদে প্রবাহের চেষ্টা করা হচ্ছিল এবং সেখান থেকে খাল কেটে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। তখনো ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়নি। তাই জিকে প্রকল্পে তখনো পানির অভাব দেখা দেয়নি। তবে সেচ ব্যবস্থাপনায় কৃষকেরা তখনো অংশগ্রহণ করছিলেন না। এই প্রকল্পের সাফল্যের জন্য সমবায় সমিতি গঠন অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয়।

আমরা ভেড়ামারা থেকে দত্তনগর কৃষি খামারে যাই। দত্তনগর কৃষি খামার বাংলাদেশের বৃহত্তম কৃষি খামার। এটি যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (যা এখন ঝিনাইদহ জেলা নামে পরিচিত) একটি কৃষি খামার। হেমেন্দ্রনাথ দত্ত নামে জনৈক ব্যক্তি প্রায় তিন হাজার একর কৃষিজমির ওপর এই কৃষি খামার তৈরি করেন। তিন হাজার একর কৃষিজমির মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার একর চাষের জমি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হেমেন্দ্রনাথ দত্ত খামার ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার এই খামার অধিগ্রহণ করে। ১৯৬২ সালে শস্যবীজ উৎপাদনে খামারটি কাজে লাগানোর জন্য বিএডিসির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই খামারে শুধু ধান ও গমের মতো শস্যের বীজই উৎপাদিত হয় না, শাকসবজির বীজও উৎপাদিত হয়। এখানে আসার পর বীজ উৎপাদনের সমস্যাগুলো আমরা বুঝতে পারি।

দত্তনগর থেকে আমরা ঠাকুরগাঁওয়ে যাই। পথে ঝিনাইদহে গাড়ি ওভারটেক করা নিয়ে মামুনুর রশীদের সঙ্গে প্রশিক্ষণরত সামরিক কর্মকর্তাদের ঝগড়া হয়। মামুনুর রশীদ অতি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সামরিক কর্মকর্তাদের পেছনে ফেলে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে এগিয়ে যান। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠাকুরগাঁও সেচ প্রকল্প চালু করে। গভীর নলকূপ দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করা হয়; কিন্তু কৃষকেরা সেচের সুযোগ গ্রহণে উৎসাহী ছিলেন না। তসলিম উদ্দিন আহমদ নামে একজন ইপিসিএস অফিসারকে এ প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। তিনি কৃষকদের সমবায় সমিতি গঠনে উৎসাহিত করেন এবং এর ফলে সেচব্যবস্থার সুফল জনগণ পেতে চলেছে। আমরা ঠাকুরগাঁও থেকে তেঁতুলিয়া সীমান্ত পর্যন্ত যাই এবং সেখান থেকে হিমালয় পর্বতমালা দেখতে পাই। তেঁতুলিয়া থেকে আমরা যে যার কর্মস্থলে ফিরে যাই। এই সফরের পরেই আমাদের ব্যাচের কর্মকর্তারা মহকুমার দায়িত্ব পেতে শুরু করেন। শাহেদ সাদুল্লাহ অক্টোবর ১৯৬৯ সালে কক্সবাজারের এসডিও হন, মিজানুর রহমান শেলী এবং আবদুশ শাকুর যথাক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বান্দরবানে অক্টোবর মাসেই এসডিওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শাহ মোহাম্মদ ফরিদ ২৭ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে এসডিওর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন রাজবাড়ীতে। এর এক সপ্তাহ পর, অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ৩ ডিসেম্বরে আমি হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করি।