রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০-এর দশকে রাজশাহীর মতিহার অঞ্চলে স্থায়ী ক্যাম্পাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কাজ শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুম, পাঠাগার, ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাস এবং শিক্ষকদের থাকার জন্য ভবন নির্মাণ করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তখন সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন তালুকদার মনিরুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে আগে থেকেই আমার পরিচয় ছিল। তিনি সাদরে আমাকে আমন্ত্রণ জানান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ক্লাব ও তাঁর বাসস্থানে নিমন্ত্রণ করেন। তাঁর স্ত্রী রাজিয়া খানম তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। তার পিতা ছিলেন বড়াইগ্রাম উপজেলার সার্কেল অফিসার (রাজস্ব)। আমি তালুকদার মনিরুজ্জামান ও তার স্ত্রীকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। তালুকদার মনিরুজ্জামানের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হতো। তাঁর কাছ থেকে অনেক বই এবং প্রবন্ধ নিয়ে পাঠ করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইপিএসইউর সদস্য আবদুল কাদের ভূঁইয়া সমাজকল্যাণ বিভাগে সহকারী অধ্যাপক ছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পাঁচজন খুবই ক্ষমতাশালী অধ্যাপক ছিলেন। এঁদেরকে পঞ্চপাণ্ডব বলা হতো। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ইংরেজির জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ইতিহাসের আজিজুর রহমান মল্লিক ও সালাউদ্দিন আহমদ, ফলিত রসায়নের অধ্যাপক ফজলে হালিম চৌধুরী ও অর্থনীতির অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন। অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদের সঙ্গে পরিচয় হলো। সময় পেলে তাঁর বাসায় আড্ডা দিতে যেতাম। তিনি তাঁর প্রেসিডেন্সি কলেজের স্মৃতি, সুশোভন সরকারের ছাত্র হিসেবে তার অভিজ্ঞতা। এবং র্যাডিকেল হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের কর্মী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর কাছে আমি রাজশাহী পৌরসভার লাইব্রেরির খোঁজ পাই। তিনি নিজে একদিন আমাকে এই পাঠাগারে নিয়ে যান। ১৮৯০ সালের দিকে এ পাঠাগারের পুস্তক সংগ্রহ শুরু হয়। এ পাঠাগারে আমি প্রবাসী এবং মডার্ন রিভিউর প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সব খণ্ড দেখতে পেয়েছি। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ লেখকের অনেক বইয়ের প্রথম সংস্করণ এই পাঠাগারে ছিল। আমি যখন পাঠাগারটি দেখতে যাই, তখন পাঠাগারটির ভবন অনেক দিন মেরামত করা হয়নি। ভবনটি অবিলম্বে মেরামত করা প্রয়োজন। আমি রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনার খন্দকার আসাদুজ্জামানকে লাইব্রেরিটি দেখাতে নিয়ে যাই। আমার ঐকান্তিক তদবিরের ফলে তিনি জেলা কাউন্সিল তহবিল থেকে ভবনটি মেরামত করার জন্য ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। ১৯৬৯-৭০ সালের অর্থবছরের প্রথম দিকে এই অনুদান দেওয়া হয়। কাজ শুরু হওয়ার আগেই আমি রাজশাহী থেকে হবিগঞ্জ বদলি হয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল কি না, আমি তা জানি না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার তখন মাত্রই গড়ে উঠছিল। পুরোনো বইপত্র খুব বেশি ছিল না, তবে নতুন বইপত্র ছিল অনেক। লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি বই বাছাই করতাম এবং কোনো এক অধ্যাপকের নামে সেগুলো ধার নিয়ে পড়তাম। রাজশাহীতে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন এবং সহকারী অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আড্ডার আরেকটি সুন্দর জায়গা ছিল বরেন্দ্র জাদুঘর। জাদুঘরটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে ছিল। শহরের মূল কেন্দ্রে এটি অবস্থিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের শিক্ষক এখানে আড্ডা দিতে আসতেন না, যাদের শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ ছিল, কেবল তারাই এখানে আসতেন। এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুখলেসুর রহমান। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি সম্পর্কে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু যেহেতু ইসলামের ইতিহাসে তিনি এমএ পাস করেছেন, সেহেতু তাঁকে ওই বিভাগেই শিক্ষকতা করতে হতো। ড. রহমান জাদুঘর থেকে একটি উঁচু মানের সাময়িকী প্রকাশ করতেন। তিনি ছিলেন ভোজনরসিক। অতিথিদের আপ্যায়নে তার কোনো কার্পণ্য ছিল না। স্কচ-হুঁইস্কি ছাড়া কোনো মদ অতিথিকে তিনি দিতেন না। তিনি রাজশাহীর আশপাশের অঞ্চলে যেখানে হাটে গরু জবাই করা হতো, সেখানে নিয়মিত যেতেন এবং কাবাবের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের গোশত তার ফ্রিজে এনে ভরে রাখতেন। কোনো অতিথি গেলেই শুরু হতো কাবাব তৈরির ধুম। প্রায়ই বিকেলে আমি জাদুঘরে যেতাম এবং তার আতিথ্য আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেছি। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ২০০৭ সালে। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন। জাদুঘরের বাইরে বহুতলবিশিষ্ট ভবনের একটি ফ্ল্যাটে তিনি থাকতেন। তখনো তার আতিথেয়তা কমেনি। সৌভাগ্যবশত বৃদ্ধ পিতাকে তখন আর্থিকভাবে সমর্থন করতেন আমেরিকা প্রবাসী তাঁর ছেলে তৈমুর।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া রাজশাহী শহরে আরেকটি সরকারি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। এই কেন্দ্রটি পাকিস্তান সরকারের অর্থে পরিচালিত হতো। কেন্দ্রটির নাম ছিল পাকিস্তান কাউন্সিল। এর পরিচালক ছিলেন তোফায়েল আহমদ এবং উপপরিচালক ছিলেন এককালীন সাংবাদিক গোলাম কিবরিয়া। কিবরিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে আমার আত্মীয়তা ছিল এবং সেই সূত্রে কিবরিয়াদের বাড়িতে অনেক খাওয়াদাওয়া করেছি। পাকিস্তান কাউন্সিলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথি করে দাওয়াত দেওয়া হতো। এই প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমার ছবিসহ সংবাদ তখনকার দৈনিক এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল।