চতুর্দশ অধ্যায়
স্বাধীন বাংলাদেশ
১ জানুয়ারি ১৯৭২-সেপ্টেম্বর ১৯৭৩

ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার আনন্দ অনেক ম্লান হয়ে আসে যখন সংবাদ আসে যে বদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্তে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী নিধনের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়, তবু জীবন থেমে থাকে না। স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হয়।

সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসন গড়ে তোলা। প্রথম জেলা প্রশাসক মনোনীত হন ওয়ালিউল ইসলাম। যশোর সেনানিবাস পতনের পর ৯ ডিসেম্বর পূর্বাহ্নে যশোর কালেক্টরেটে জনাব ওয়ালিউল ইসলামের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার ১৭টি জেলায় জেলা প্রশাসক নিয়োগ করে। এই নিয়োগগুলো ছিল নিম্নরূপ:[১]

(১) শামসুল হক, ইপিসিএস, কুষ্টিয়া। (২) সৈয়দ আবদুস সামাদ, সিএসপি, চট্টগ্রাম। (৩) আকবর আলি খান, সিএসপি, সিলেট। (৪) খসরুজ্জামান চৌধুরী, সিএসপি, ময়মনসিংহ। (৫) মামুনুর রশীদ, সিএসপি, বরিশাল। (৬) কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ, সিএসপি, কুমিল্লা। (৭) কামাল উদ্দীন সিদ্দিকী, সিএসপি, খুলনা। (৮) কাজী লুফুল হক, ইপিসিএস, পাবনা। (৯) জহুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, ইপিসিএস, রাজশাহী। (১০) বিভূতিভূষণ বিশ্বাস, ইপিসিএস, পটুয়াখালী। (১১) এম ইসহাক, ইপিসিএস, টাঙ্গাইল। (১২) আবদুল মোমেন, ইপিসিএস, ফরিদপুর। (১৩) জে এন দাস, ইপিসিএস, নোয়াখালী। (১৪) মোহাম্মদ আশরাফ, ইপিসিএস, পার্বত্য চট্টগ্রাম। (১৫) আবদুল লতীফ ভূইয়া, ইপিসিএস, বগুড়া। (১৬) আমানত উল্লাহ, ইপিসিএস, দিনাজপুর। (১৭) এম আবুল কাশেম, ইপিসিএস, রংপুর।

ঢাকা জেলায় প্রথমে ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ করা হয়নি। পরবর্তীকালে নাটোরের মহকুমা প্রশাসক কামাল উদ্দীনকে এই জেলার ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ করা হয়। আমাকে ১৯ ডিসেম্বর সিলেটের ডেপুটি কমিশনার পদে যোগ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক আদেশ দেওয়া হয়। যে কর্মকর্তা আমাকে আদেশটি দেন, তিনি জানান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে অবিলম্বে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গেলাম। প্রধানমন্ত্রী সিলেটের ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হওয়ায় আমাকে অভিনন্দন জানান। এরপর তিনি বলেন, সিলেটের ডেপুটি কমিশনার হিসেবে তার জন্য আমাকে একটি বিশেষ কাজ করতে হবে। বিশেষ কাজটি কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে আবদুস সামাদ আজাদকে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করতে হবে। আবদুস সামাদ আজাদ তার নিজের লোক। সিলেট যাওয়ার আগে তিনি আমাকে আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

আমি কিছুক্ষণ পর আবদুস সামাদ আজাদের শয়নকক্ষে উপস্থিত হই। তিনি তখন থিয়েটার রোডের দোতলার একটি কক্ষে থাকতেন। তাঁর কাছে যাওয়ার পর তিনি আমাকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানান এবং বলেন, সিলেট জেলাতে আমার অনেক কাজ করতে হবে। কী কাজ করতে হবে প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, ‘দাঁড়ান এখনই বলছি।’ বলে একটি কাগজ নিলেন। সেই কাগজে সিলেট থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নামের তালিকা লিখলেন। এরপর যারা তার সমর্থক, তাঁদের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিলেন। যারা তার সমর্থক, নন, তাঁদের নামের পাশে ক্রস মার্ক দিলেন। তিনি বললেন, যারা তার সমর্থক তাদের অনুরোধ রাখতে হবে আর যারা তার সমর্থক নন, তাঁদের অনুরোধ রাখার আগে তাঁর সমর্থকদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর তিনি আরেকটি তালিকা তৈরি করলেন। সেই তালিকায় কিছু রাজনৈতিক নেতার নাম ছিল। তিনি বললেন, এই তালিকায় যাদের নাম আছে, তাঁরা দেওয়ান ফরিদ গাজীর গুন্ডা। এঁদেরকে যত তাড়াতাড়ি পারেন জেলে ঢোকাবেন। অন্যথায় জেলায় শান্তি স্থাপিত হবে না। তিনি আমার সাফল্য কামনা করলেন।

আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, যে আশা নিয়ে আবদুস সামাদ আজাদ আমাকে সিলেট নিতে চাচ্ছেন, সে আশা পূরণ করা আমার জন্য সঠিক হবে কি না। আমরা যখন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দিই, তখন আমাদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল দেশের আইন এবং বিধির ভিত্তিতে আমাদের জেলা প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে। এখানে কে সন্তুষ্ট হলো আর কে অসন্তুষ্ট হলো, সেটা বড় কথা নয়; কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের ব্যবস্থা অচল মনে হলো। আমি যদি সিলেটে গিয়ে আবদুস সামাদ আজাদের নির্দেশমতো কাজ না করি, তাহলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী আমাকে সিলেট থেকে বদলি করে দেবেন। আর যদি আবদুস সামাদ আজাদের হাতের পুতুল হিসেবে আমি কাজ করি, তাহলে আমার ডেপুটি কমিশনার হওয়ার কোনো অর্থ হয় না। যতই এ সম্পর্কে ভাবতে থাকি, ততই আমি উত্তেজিত হতে থাকি। যাঁদের কাছ থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ নিতাম, তারা তখন কলকাতায় নেই। ওয়ালিউল ইসলাম যশোরে ডেপুটি কমিশনার পদে যোগ দিয়েছেন। কামাল। সিদ্দিকী খুলনায় ডেপুটি কমিশনার পদে যোগ দেওয়ার জন্য চলে গেছেন। কাজী রকিবউদ্দিন কুমিল্লায় ডেপুটি কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন। এঁদের কারও সঙ্গেই পরামর্শ করার কোনো উপায় ছিল না।

এদিকে আমাকে সিলেট যাওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। আমি সম্ভবত ২১ বা ২২ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডাক বহনকারী বিমানে করে কলকাতা থেকে রওনা হই। বিমানটি প্রথমে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যায়। সেখান থেকে অরুণাচল প্রদেশের একটি বিমানবন্দরে নামি। তারপর মিজোরামে একটি বিমানবন্দরে নামি। মিজোরাম থেকে শিলচর যাই। শিলচরে যখন পৌঁছি, তখন প্রায় বিকেল চারটা। আমাদের বিমানবন্দরে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে আলোচনা করে জানি, সিলেট যেতে হলে শিলচর থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তা করতে হবে। অন্যথায় আমি আগরতলায় যেতে পারি। সেখান থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি সিলেট যেতে পারি।

আমি আগরতলা চলে গেলাম। সেখানে রকিব যে বাসা ভাড়া করেছিল, সে বাসায় গিয়ে উঠলাম। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানা যায় আগরতলা থেকে সিলেটে যাওয়ার রাস্তা তখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। তাই আমাকে শিলচর ফিরে যেতে হবে অথবা আমি আগরতলা থেকে ঢাকায় যেতে পারি। ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমি আগরতলা থেকে ঢাকা গেলাম। ঢাকায় গিয়ে প্রথমে আনুদার বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি যে আমার ছোট ভাই জসিম তখন। ঢাকায় ফিরে এসেছে। কাছেই ধানমন্ডিতে জসিমের বাসা। আমি জসিমের সঙ্গে চলে গেলাম। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিলাম। কেউ প্রাণে মরেনি কিন্তু নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাবা-মা তখনো নবীনগরে ফিরে যাননি, কণিকাড়ায় আমার মামাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অনেক বন্ধুবান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ী মারা গেছেন। এসব দুঃখের কাহিনি শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। আওয়ামী লীগের রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় সিলেট যাওয়ার ইচ্ছা আমার অনেক কমে যায়। আমি সচিবালয়ে যাই। আমাকে। তৎক্ষণাৎ সিলেট যেতে বলা হয়। কিন্তু সিলেট যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা হয় না। আমি শেষ পর্যন্ত সিলেট যাইনি।

সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা

সচিবালয়ে তখন বিশৃঙ্খলা চলছে। নুরুল কাদের খান তখন সংস্থাপনসচিব। সংস্থাপনসচিব হিসেবে তিনি তার পছন্দমতো লোকদের ইচ্ছেমতো পদোন্নতি দিচ্ছেন। তাঁর বড় ভাই একজন সার্কেল অফিসার (রাজস্ব বিভাগ) ছিলেন। পাকিস্তান শাসনামলে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করেছেন। হঠাৎ তাকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করে সার্কেল অফিসার রেভিনিউ থেকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর আগে এ ধরনের পদোন্নতি কাউকে দেওয়া হয়নি। ঢাকা শহরে ডেপুটি কমিশনার পদে নিয়োগ করা হয় নাটোরের মহকুমা প্রশাসক কামাল উদ্দিন আহমদকে। ঢাকায় তখন পাকিস্তানিদের অনেক বড় বড় বাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। এ বাড়িগুলো দখল করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ অভিযানে সহায়তা করেন ঢাকার ডেপুটি কমিশনার। ১৬ ডিসেম্বরের পর যারা মুক্তিবাহিনীর আদৌ সদস্য ছিলেন না, তাঁরা নিজেদের মুক্তিবাহিনীর সদস্য বলে দাবি করেন। এই ধরনের নকল মুক্তিযোদ্ধারা ১৬ ডিভিশন’ নামে পরিচিত হন। অনেক পরিত্যক্ত বাড়ি ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের সহযোগিতায় সামরিক এবং বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা দখল করে নেন। সাধারণ মানুষের বাড়িঘর লুট করা হয়। আমার ছোট ভাই জসিম। ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে চাকরি করত। তার বাসায় একজন উর্দু ভাষাভাষী অফিসার থাকত। এই উর্দু ভাষাভাষী অফিসারকে ধরার নাম করে যখন তাদের কেউ বাসায় ছিল না, তখন বাসায় হামলা করে জসিমের বিদেশি টেলিভিশন ও টেপ রেকর্ডার লুট করে নিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারদের সুস্পষ্ট আশ্বাস সত্ত্বেও এগুলো পুনরুদ্ধার করার কোনো ব্যবস্থাই করা যায়নি। এ ধরনের লুটপাটের পরিস্থিতিতে আমার সিলেটের ডেপুটি কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণ করার ইচ্ছা একেবারেই উবে যায়।

আমি বঙ্গভবনে হোসেন তৌফিক ইমামের সঙ্গে কাজ করতে থাকি। ইতিমধ্যে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ আহমদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হন। এর ফলে সিলেটে নতুন ডেপুটি কমিশনার নিয়োগের অত্যাবশ্যকীয়তা থাকে না। আমি সাত দিনের ছুটির জন্য একটি দরখাস্ত দিয়ে বাড়ি চলে যাই। আমরা ঢাকা থেকে ছোট ভাই জসিমের গাড়িতে করে কুমিল্লা হয়ে কোম্পানীগঞ্জ যাই। কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রাস্তার যুদ্ধে বিশেষ ক্ষতি হয়নি। তবে রাস্তা ছিল অত্যন্ত খারাপ। তবু এই রাস্তা দিয়ে আমরা নবীনগর পর্যন্ত যাই। নবীনগরে গিয়ে দেখতে পাই বাবা-মা ফিরে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে কয়েক দিন কাটিয়ে আমি আবার ঢাকায় ফিরে আসি।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ওয়ালিউল ইসলাম, (প্রকাশিতব্য)। একাত্তরের ইতিকথা, পৃষ্ঠা-২০৫