শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি

সচিবালয়ের বিশৃঙ্খলা দেখে আমি হতোদ্যম হয়ে যাই। এই সময় আমার যেসব সহকর্মী ডেপুটি কমিশনার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই জেলা প্রশাসনে টিকতে পারেননি। তাঁরা সচিবালয়ে ফিরে আসেন। কামাল সিদ্দিকী ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজের বর্ণনা করে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের কন্যা খুলনার মুক্ত অঞ্চল দেখতে আসেন। কামাল সিদ্দিকী তাঁকে এই প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি দেন। এই প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত পি এন হাকসারের কাছে চলে যায়। এর ফলে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। কামাল সিদ্দিকী ঢাকায় তদবির করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে আসেন। ওয়ালিউল ইসলাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হন। তবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়েই সবচেয়ে বেশি হরিলুট চলছিল। তাই আমি সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হতে চাই। তখন শিক্ষাসচিব ছিলেন প্রফেসর আজিজুর রহমান মল্লিক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব অবসর গ্রহণ করার পর কামাল সিদ্দিকী আমার নাম ড. মল্লিকের কাছে প্রস্তাব করেন। ড. মল্লিক সংস্থাপনসচিবকে আমাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য একটি আধা সরকারি পত্র পাঠান। কিন্তু সংস্থাপনসচিব কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন না। আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল বা মহাসচিব রুহুল কুদুসের কাছে গেলাম। তাকে গিয়ে বললাম যে আমাকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে বদলি না করলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব। তিনি আমাকে উত্তেজিত না হতে অনুরোধ করেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি হই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ১৯৭১ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রধান হুইপ পদে নির্বাচিত হন। মুজিবনগরে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়, তখন আওয়ামী লীগ দলের হুইপ হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি তিনি ছিলেন অনুগত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল সংযত। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ড. এ আর মল্লিক দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হয়ে চলে যান। তাঁর স্থলে আসেন ১৯৫৪ ব্যাচের সিএসপি এ এস নূর মোহাম্মদ। শুনেছি এ এস নূর মোহাম্মদ নাকি পাকিস্তান সরকারের একজন চৌকস আমলা ছিলেন। তিনি জেনেভায় বিশ্ববাণিজ্য সম্পর্কে আলোচনায় পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তাঁকে শিক্ষাসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিএসপি হওয়ার আগে তিনি কোনো স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। হেডমাস্টারের অনেক স্বভাব তার মধ্যে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত থাকে। তিনি সব ব্যাপারেই ছিলেন প্রাচীনপন্থী। এমনকি বানানের ক্ষেত্রেও যেখানে ‘ী’-এর পরিবর্তে ‘ি’ চালু হয়েছে, তা তিনি মানতে চাইতেন না। তিনি সাধু ভাষায় লিখতে পছন্দ করতেন, আর আমরা পছন্দ করতাম চলতি ভাষায়। সুতরাং তার কাছে কোনো সারসংক্ষেপ পাঠালে তিনি বানান এবং ভাষা নিয়ে অনেক প্রশ্নবোধক চিহ্ন মোটা কলমে করতেন, তারপর নাম স্বাক্ষর করতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে আদৌ বিশ্বাস করতেন না। আমি ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপসচিব। তিনি প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কারণ দর্শানোর জন্য পত্র লিখতে আমাকে আদেশ করতেন। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করতেন, তখন তিনি আমাকে দোষ দিতেন। উপাচার্যরা আমার অভিমত জানতেন। তাই কেউই তাঁর বক্তব্য বিশ্বাস করেননি। আমার এবং তার মধ্যে সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল তিক্ত। তবে সান্ত্বনা ছিল এই যে যেখানে শিক্ষাসচিব আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন, সেসব বিষয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলে তিনি শিক্ষাসচিবের আদেশ বাতিল করে দিতেন এবং আমার সঙ্গে একমত পোষণ করতেন।

পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু শিক্ষার বিষয়টি পরিচালনা করত। স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষা ছাড়া আরও তিনটি বিষয় যুক্ত হয় : (১) সংস্কৃতিবিষয়ক কার্যাবলি, (২) বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও (৩) ক্রীড়া ও যুবকদের কার্যাবলি। এই অতিরিক্ত কাজের জন্য দুটি নতুন যুগ্ম সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়। একটি পদ সংস্কৃতি, ক্রীড়া এবং যুব কল্যাণসংক্রান্ত বিষয়গুলোর দায়িত্বে ছিল। এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৯৪৮ ব্যাচের ইপিসিএস ক্যাডারে নিযুক্ত এ কে এম জাকারিয়াকে। তিনি দিনাজপুরের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীও দিনাজপুরের লোক ছিলেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। এই অতিরিক্ত কাজ সামলানোর জন্য দুটি সেকশন সৃষ্টি করা হয়। আরেকজন যুগ্ম সচিব নিযুক্ত করা হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য। এই যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. ফারুক আজিজ খানের ওপর। ড. ফারুক আজিজ খান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন। মুজিবনগরে থাকতেই তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তার অধীনে একটি শাখাপ্রধানের পদ সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ে একটি উপশিক্ষা উপদেষ্টার পদ সৃষ্টি করা হয়। তবে এ পদ যখন সৃষ্টি হয়, তখন আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল স্থানাভাব। দুজন যুগ্ম সচিব ও তিনজন সেকশন অফিসারসহ পাঁচজন অফিসারের জায়গা দিতে হবে। কিন্তু তাদের জন্য কোনো আলাদা জায়গা নেই। এর ফলে জায়গা ভাগাভাগি করতে হয়। তিনজন শাখা প্রধানকে বিদ্যমান শাখাসমূহে টেবিল চেয়ার দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক যুগ্ম সচিবের জন্য একটি উপসচিবের কামরা দেওয়া হয়। আমার জন্য কোনো কামরা প্রথম চার মাস ছিল না। ড. ফারুক আজিজ খানকে যে কামরা বরাদ্দ করা হয়, সেই কামরায় একটি ইজিচেয়ার ছিল। মধ্যাহ্নভোজনের পর কর্মকর্তাদের বিশ্রামের জন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কক্ষে ইজিচেয়ার দেওয়া হতো। ফারুক আজিজ খানের কক্ষে যে টেবিল-চেয়ার ছিল, সেখানে তিনি অফিস করতেন আর ইজিচেয়ারে বসে আমি আমার অফিস করতাম। ছোটখাটো নোট ইজিচেয়ারে বসেই লিখতাম, যেখানে বড় নোট লিখতে হতো, সে ক্ষেত্রে নথি বাড়িতে নিয়ে হাতে নোট লিখতাম। স্থানাভাব ছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা ছিল বাংলা টাইপরাইটারের নিদারুণ ঘাটতি। মন্ত্রণালয়ে চারটি বাংলা টাইপরাইটার ছিল। একটি টাইপরাইটার শিক্ষামন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ করা হয়। বাকি তিনটি টাইপরাইটার দিয়ে সারা মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম চালাতে হতো। কোনো কিছু টাইপ করতে হলে টাইপিস্টের কাছে তা পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে হতো। টাইপিংয়ে ছোটখাটো ভুল হলে দ্বিতীয়বার টাইপ করা হতো না, কলম দিয়ে সেগুলো শুদ্ধ করা হতো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমার দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ

(১) উচ্চশিক্ষা। (২) শিক্ষা সংস্কার (৩) পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (৪) চারটি শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (৫) সংস্কৃতিবিষয়ক কার্যাবলি (৬) ক্রীড়াবিষয়ক কার্যাবলি ও। (৭) যুবকদের সংক্রান্ত কার্যাবলি।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ড

সরকারের অনুমোদিত পাঠ্যসূচি অনুসারে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রদের জন্য বই ছাপিয়ে তা বিনা মূল্যে বিতরণ করত। শিক্ষার উন্নয়ন খাতের একটি উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ ছিল পাঠ্যপুস্তকের জন্য। আমি এই উপবিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে অনুরোধ করি তারা যেন তাদের প্রকাশিত সব পাঠ্যপুস্তকের একটি কপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। আমি বইগুলো পড়া শুরু করি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমি প্রায় পনেরো মাস কাজ করেছি। তাতে বাংলা এবং সমাজবিদ্যা সম্পর্কের বইগুলো পর্যালোচনা করতে পেরেছিলাম। এই পর্যালোচনায় দেখা যায় যে বইগুলোর মান খুবই নিচু এবং অধিকাংশ বই অজস্র ত্রুটিতে ভরা। নবম এবং দশম শ্রেণির ভূগোল বইটি পর্যালোচনা করে চার শ রও বেশি ভুল নজরে আসে। এ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক এবং তাঁর সহকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন। এই বইয়ে লেখা হয়েছে যে কাশ্মীর ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত। আসলে কাশ্মীর উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত। কাশ্মীরকে ভারত অধিকৃত বলে দেখানো হয়েছে। এ ধরনের বক্তব্য স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার অবশ্যই গ্রহণ করে না। বোর্ডের চেয়ারম্যান ভুলের জন্য ক্ষমা চান। এবং এ সম্পর্কে একটি আলাদা ছাপার ভুলের তালিকা (Errata) ছাপিয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে নতুন করে সেই মুহূর্তে বই ছাপানোর জন্য কাগজ নেই এবং বইটি লেখার জন্যও সময় লাগবে। সুতরাং এই ত্রুটিপূর্ণ বই দিয়েই আরও এক বছর চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বাংলা বইগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমার চোখে দুটি ত্রুটি ধরা পড়ে। প্রথমত, প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বইয়ে বিখ্যাত লেখকদের লেখা নির্বাচন করা হয়। তবে বিখ্যাত লেখকের কোনো সংজ্ঞা নেই। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ব্যক্তি লেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের লেখাও অন্তর্ভুক্ত করা হতো। আমার মনে হয় লেখক নির্বাচনের একটি ভিত্তি নির্ধারণ করা উচিত এবং কোন ধরনের লেখকের লেখা নিচের শ্রেণিতে এবং কোন ধরনের লেখকের লেখা ওপরের শ্রেণিতে পড়াতে দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে সুনির্ধারিত নীতি থাকা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষা শুধু বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতির জন্য শেখানো হয় না, বাংলা ভাষার মাধ্যমে ছাত্রদের সব বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য প্রকাশের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাই সাহিত্যের বাইরেও বিজ্ঞান, ব্যবহারিক বিষয়সহ সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। এর সঙ্গে ছাত্রদের বয়সের কথাও মনে রাখতে হবে। একজন পাঁচ বছরের শিশুর কতগুলো শব্দ এবং কতগুলো ধারণা জানার প্রয়োজন, তা গবেষণা করে নির্ণয় করা যেতে পারে। সেই অনুসারে ৫ থেকে ১৩-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রদের পাঠ্যসূচি নিধারণ করতে হবে। এর জন্য গবেষণার প্রয়োজন। বাংলাদেশ অথবা পশ্চিম বাংলায় কেউই এ সম্পর্কে গবেষণা করেনি। অথচ উনবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের বাংলা পাঠ্যবই প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা বইটির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এই বইয়ে যেসব শব্দ এবং ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট।

পাঠ্যপুস্তকের সমস্যা সমাধানের জন্য আমি শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারিনি। তবে পত্রপত্রিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে এ সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। এর কারণ হলো পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বই লেখকদের যথেষ্ট সম্মানী দেন। না এবং বই সম্পাদনার দায়িত্ব দেন কমিটির ওপর। কমিটি ঠিকমতো কাজ করে না। তার ফলে বইয়ের মান নিচুই থেকে যায়। উপরন্তু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য এবং সরকারের রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের জন্যও পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থার বদলে যদি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকের মধ্য থেকে সরকার দুটি কিংবা তিনটি পাঠ্যপুস্তককে পড়ানোর উপযুক্ত বলে স্বীকৃতি দেবেন। এর ফলে এদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে এবং ছাত্ররা ভালো পাঠ্যপুস্তক পাবেন।

শিক্ষা বোর্ডসমূহের কার্যকলাপ

শিক্ষা বোর্ডসমূহ পরীক্ষা পরিচালনা করে। পরীক্ষার ফি থেকে এরা প্রচুর অর্থ লাভ করে। বিশেষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে বোর্ডগুলোর লাভ ক্রমেই বাড়ছে। প্রকৃত ব্যয়ের ভিত্তিতে পরীক্ষার ফি নির্ধারিত হওয়া উচিত। প্রতিবছর ফির হার সরকারের পর্যালোচনা করা উচিত। তারপরও শিক্ষা বোর্ডের লাভ থাকবে। এ লাভের অর্থ বর্তমানে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন ভাতা’র নামে নিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি আইনে এসব ভাতা সিদ্ধ নয়। এর ফলে হিসাব নিরীক্ষায় আপত্তি হচ্ছে কিন্তু কোনো বোর্ডই এসব আপত্তি মেটাচ্ছে না। সরকারের উচিত এ ধরনের অনাচার বন্ধ করা।

পরীক্ষা পরিচালনার ফলে যে লাভ হয়, তা বোর্ডের কাছে না রেখে বোর্ডের অধীন স্কুলগুলোর অবকাঠামো নির্মাণে সাহায্য হিসেবে দেওয়া উচিত। গবেষণাগার এবং লাইব্রেরির জন্যও লাভের একটি অংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বাজেটে ব্যয়ের দারুণ উল্লম্ফন ঘটে। অথচ আয় প্রায় স্থির থেকে যায়। ব্যয় বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে নির্দিষ্ট কাজের জন্য যেসব অনিয়মিত কর্মচারী নিয়োগ করা হতো, তাঁদের সবাইকে ছাত্রসংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কর্মচারী ঘোষণা করা হয়। এর ফলে ব্যয় বিপুল বেড়ে যায়, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবার মান নেমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায় যে এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই। সরকার অতিরিক্ত কোনো বরাদ্দ দিলে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো সম্ভব হবে না। এই সমস্যা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকট রয়েছে। এখনো বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০ শতাংশ বরাদ্দ শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ভাতার জন্য ব্যয় করা হয়ে থাকে। যদি ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রশাসন চালানো সম্ভব হয়, তাহলে প্রচুর অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে এবং এই অর্থ গবেষণাগার ও পাঠাগারে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত করা যেতে পারে।

শিক্ষার সংস্কার

পাকিস্তান আমল থেকে মাঝেমধ্যে শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিক্ষা সংস্কারের জন্য শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ষাটের দশকে শরিফ কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যে শিক্ষা সংস্কার করা হয়, তার বেশির ভাগই পরে প্রত্যাহার করতে হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের নীতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৭২ সালে সরকার ডক্টর কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। এ কমিশনের সদস্যসচিব ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশসমূহ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা সংস্কার শিক্ষা কমিশনের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে না করে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে চালু করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সেল শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে কাজ করবে এবং বাস্তবায়িত সংস্কারসমূহের মূল্যায়ন করবে।

সংস্কৃতি এবং ক্রীড়াবিষয়ক কার্যাবলি

১৯৭২ সালে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত অফিসগুলো চালু ছিল–

(১) প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর (2) বাংলাদেশ আর্ট কাউন্সিল (৩) কপিরাইট অফিস (৪) জাতীয় পাঠাগার ও মহাফেজখানা (৫) সরকার পরিচালিত পাঠাগারসমূহ (৬) সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত বিশেষ প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা।

ক্রীড়ার ক্ষেত্রে শরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বরাদ্দ ছিল অপ্রতুল, নেতৃত্ব ছিল দুর্বল। এ প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। যে কাজ এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি।

সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও ভারত সফর

পাকিস্তান আমলে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা মুসলমান দেশসমূহ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন সাংস্কৃতিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় তিনটি দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় : (১) পূর্ব জার্মানি, (২) রাশিয়া ও (৩) ভারত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার কখনো সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। তাই সাংস্কৃতিক চুক্তির কোনো নজির। ছিল না। এ সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে সাংস্কৃতিক চুক্তির অনুলিপি সংগ্রহ করি এবং এর ভিত্তিতে ভারত, পূর্ব জার্মানি ও রাশিয়া সরকার কর্তৃক প্রেরিত সাংস্কৃতিক চুক্তির খসড়াসমূহ পরীক্ষা করি এবং চুক্তির খসড়া প্রণয়ন করি। খসড়াসমূহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের অনুমোদন এবং মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে স্বাক্ষর করা হয়। ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়।

এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল হাসান এবং বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মেরি এন্ডারসন জাহাজে ভারতীয় শিক্ষামন্ত্রী মেঘনা নদী ভ্রমণকালে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যপত্রও অনুমোদিত হয়। কার্যপত্র অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভারতের শিক্ষাসচিব এবং ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা (যিনি ১৯৪৮ ব্যাচের একজন আইএএস ও বাঙালি। কর্মকর্তা ছিলেন) এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা ড. জালালউদ্দিন। ড. জালালউদ্দিন বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি লাভ করেছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য থাকায় তাঁকে বাইরে গবেষণার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। তিনি পালিয়ে ভারতে যান এবং ভারত থেকে সোভিয়েত রাশিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান। রাশিয়া থেকে পিএইচডি করার পর তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ১৯৭১ সালে তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন যুগ্ম সচিব এ কে এম জাকারিয়া, কামাল সিদ্দিকী এবং আমি।

ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের কিছুদিন পর ভারত সরকার বাংলাদেশকে তাদের নিখিল ভারত পল্লি অঞ্চলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশে তখন পেশাদার ক্রীড়াবিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবু জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের খেলায় (কুস্তি, কাবাডি, শরীরচর্চা ইত্যাদি) যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে প্রায় ৪০ জনের একটি টিম গঠন করা হয়। ড. জালাল প্রস্তাব করেন যে আমি যেন এই ক্রীড়া দলের মিশনপ্রধান হয়ে ভারতে যাই। আমি তাকে জানাই, আমার ক্রীড়ায় কোনো আগ্রহ নেই এবং আমি যেতে চাই না। তিনি এসে স্বীকার করলেন যে শুধু নিখিল ভারত পল্লি অঞ্চলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য আমার ভারত যাওয়ার দরকার নেই। তবে আমি ভারতে গেলে ভারত সরকার আমাকে ভারতের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করতে পারবে এবং আমাকে দিল্লির বাইরে বিভিন্ন স্থানে ও পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এবং বিশ্বভারতীতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তার অনুরোধে আমি এই দলের প্রধান হিসেবে ভারতে যাই। এই দলের মধ্যে আমাকে সহায়তা করার জন্য ছিলেন মিসেস বকুল নামে শরীরচর্চা কলেজের একজন অধ্যাপিকা। তার সঙ্গে ছিলেন শেখ কামালের বাগদত্তা সুলতানা কামাল। সুলতানা কামাল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। তিনি একটি মহিলা কাবাডি দলের সদস্য ছিলেন। দিল্লি যাওয়ার আগে স্পোর্টস ফেডারেশন থেকে আমার দৈনিক ভাতা ছাড়াও আরও পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বলা হয় যে এই অর্থ দিয়ে আমি বিশেষ খরচ করতে পারব এবং স্পোর্টসম্যানদের কারও কোনো সমস্যা হলে এখান থেকে অর্থ সাহায্য দিতে পারব।

আমি উড়োজাহাজে করে দিল্লি যাই। দিল্লিতে একটি ক্রীড়া চক্রের ক্লাবে আমাকে রাখা হয়। ক্লাবে থাকার ব্যবস্থা ভালোই ছিল কিন্তু খাবার নিয়ে সমস্যা হয়। আমি যেহেতু নিরামিষ খাই না, সেহেতু তারা আমার জন্য আমিষের ব্যবস্থা করে। এই আমিষের বেশির ভাগই ছিল মহিষের মাংস, যেটা আমি মোটেও পছন্দ করতাম না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাকে একটি গাড়ি দেয়। এই গাড়িতে করে আমি বাংলাদেশ দূতাবাসে যাই। সেখানে। আমার ব্যাচমেট মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে ভালো গরুর মাংস খেতে পাই। জিজ্ঞাসা করে। জানতে পারি দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার অঞ্চলে খাঁটি গরুর মাংস পাওয়া যায়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ খেলার বাইরে আমার জন্য আরেকটি কর্মসূচি তৈরি করে। এ কর্মসূচি অনুসারে আমি ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার (যার সঙ্গে ঢাকায় আমার দেখা হয়েছিল) সঙ্গে দেখা করি। তিনি তাঁর অফিসের একজন কর্মকর্তাকে আমার সঙ্গে ডিউটি করার জন্য দায়িত্ব দেন এবং তাঁকে আমার কর্মসূচির একটি তালিকা দেওয়া হয়। এই তালিকা অনুসারে আমি বিড়লা ভবন, যেখানে মহাত্মা গান্ধী নিহত হন, সেখানে যাই। ভারতীয় জাতীয় জাদুঘরে যাই, ভারতীয় সরকারি মহাফেজখানায় যাই, জওহর লাল নেহরু স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘরে যাই।

রোববার দিন তারা আমাকে আগ্রা নিয়ে যায়। আগ্রায় যাওয়ার সময় আমার বন্ধু মহিউদ্দিন ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হই। গল্প করতে করতে আমরা আগ্রায় পৌঁছালাম। আগ্রায় তাজমহল ও আগ্রার দুর্গ দেখার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ফতেহপুর সিক্রিতে। ফতেহপুর সিক্রিতে সম্রাট আকবর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পানির অভাবে সেখানে রাজধানী রাখা সম্ভব হয়নি। ফতেহপুর সিক্রিতে সেলিম চিশতির মাজার ছিল। সেলিম চিশতির আশীর্বাদে সম্রাট আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই বিশ্বাস করেন, সেলিম চিশতির দোয়া পেলে ছেলেসন্তান। হওয়া সম্ভব। তাই সেই মাজারের সামনে লাইন দিয়ে ভক্তদের দেখা যায়, যারা পুত্রসন্তান লাভের আশায় সেলিম চিশতির মাজারে সুতা বাঁধার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফতেহপুর সিক্রি থেকে আমরা সেকেন্দ্রায় সম্রাট আকবরের সমাধিতে যাই। তাজমহলের আদিরূপ আকবরের সমাধিতে দেখা যায়।

পরদিন ছিল নিখিল ভারত পল্লি অঞ্চলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী উৎসব। সেদিন আমাকে ওই উৎসবে থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। আমি আমার বন্ধু মহিউদ্দিনকে নিয়ে ওই অনুষ্ঠানের পেছন দিকে বসেছিলাম। আমার দল কোনো প্রতিযোগিতাতেই ভারতীয় প্রাদেশিক দলগুলোর সঙ্গে টিকতে পারেনি। হঠাৎ ঘোষণা শুনলাম যে বাংলাদেশ মার্চপাস্টে প্রথম হয়েছে। এবং বাংলাদেশের দলপতি আকবর আলি খান এ পুরস্কার গ্রহণ করবেন। আমি ভারতীয় উপরাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছাই এবং তাঁর কাছ থেকে একটি স্মারক গ্রহণ করি।

দিল্লির কর্মসূচি শেষ হলে আমি কলকাতায় ফিরে আসি। এখানে পশ্চিম বাংলার শিক্ষাসচিব এবং পশ্চিম বাংলার ডিপিআইয়ের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। এই আলোচনায় স্কুলে বাংলা ভাষার পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়নের জন্য আমি বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার যৌথ গবেষণার প্রস্তাব রাখি। পশ্চিম বাংলার প্রতিনিধিরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তবে পরে এ ব্যাপারে আর কাজ হয়নি। বাংলাদেশে এ প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন ছিল না। অনেকে মনে করতেন। যে এ ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে পশ্চিম বাংলা বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের বাজার গ্রাস করবে। সুতরাং তারা সহযোগিতার পক্ষে ছিলেন না।

কলকাতা থেকে তিন দিনের সফরে আমি বোলপুরে বিশ্বভারতীতে যাই। বিশ্বভারতীতে আমার প্রটোকলের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিশ্বভারতী ভূসম্পত্তি অফিসের একজন কর্মকর্তাকে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শ্যালকের ছেলে। ছোটবেলায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন। তার পিতা পতিসর কাছারিতে ঠাকুর পরিবারের আমলা ছিলেন।

আমাকে বিশ্বভারতীর অতিথি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ বরাদ্দ করা হয়। রাতে আমাকে বিশ্বভারতীর উপাচার্য প্রতাপচন্দ্র চন্দের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক। আমি যখন বিশ্বভারতীতে যাই, তখন বিশ্বভারতীতে ছুটি ছিল। তাই সব অধ্যাপক ক্যাম্পাসে ছিলেন না। উপাচার্য জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের নিমন্ত্রণ করেন। উপস্থিত অধ্যাপকেরা অনেকেই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণা করেন। পরের দুদিন আমাকে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ঘুরিয়ে দেখানো হয়। আমাকে বোলপুরের অদূরে সুরুল গ্রামে শ্রীনিকেতনে নিয়ে যাওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের একমাত্র ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট এখানে একটি পল্লি উন্নয়ন একাডেমি গড়ে তোলেন। সেই একাডেমিতে রেশম এবং সুতার ওপর তখন গবেষণা চলছিল। আমাকে সেসব গবেষণা দেখানো হয়।

বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথ যেসব ভবনে ছিলেন, সে ভবনগুলোও ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তিন-চারটি ছোট ছোট বাংলো সেখানে ছিল। রবীন্দ্রনাথ একটি বাংলোতে কিছুদিন থাকার পর তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসত। তাই তার জন্য আরেকটি নতুন ভবন করতে হতো। এভাবে দু-তিন বছর পরপর তিনি ভবন পরিবর্তন করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য এ ভবনগুলোতে দেখতে পাই। আমাকে শান্তিনিকেতন ভবনও দেখানো হয়। ১৮৬৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরের কাছে ২০ বিঘা জমি রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে কিনেছিলেন। সেখানে তিনি একটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন, যা ‘শান্তিনিকেতন’ পরিচিতি লাভ করে। ১৮৮৮ সালে দেবেন্দ্রনাথ ট্রাস্ট ডিড করে শান্তিনিকেতনের জমি উৎসর্গ করেন এবং এর ব্যয়নির্বাহের জন্য জমির কিছু অংশ দেবোত্তর করে দেন। ট্রাস্ট ডিডে তিনি শর্ত আরোপ করেন :

তথায় কোনো মূর্তি বা প্রতিমা বা প্রতীক পূজা হইতে পারে না। কোনো ধর্মের নিন্দা, মদ্য, মৎস্য, মাংসভোজন নিষিদ্ধ; নিন্দনীয় আমোদ-আহ্লাদও হইতে পারে না।

এই শর্তের জন্যই এখনো শান্তিনিকেতনে কোনো পূজা করতে দেওয়া হয় না, অথচ বেদ, বাইবেল, কোরআন অথবা ত্রিপিটকের মতো ধর্মশাস্ত্র পাঠ করতে ও ব্যাখ্যা করতে উৎসাহিত করা হয়।

বাংলাদেশে মৌলবাদীরা প্রচার করে থাকেন যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু পৌত্তলিকতার প্রচারক ছিলেন। বাস্তবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীতে শান্তিনিকেতনে পৌত্তলিকতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।

বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় আমি শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি রক্ষার্থে যে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেই জাদুঘরের জন্য সহায়তা চাই। সেখানে আমি জানতে পারি শিলাইদহের কুঠিবাড়ি ১৯২০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথের মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাগ্যকুলের জমিদারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে শিলাইদহের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির কোনো যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং সেখানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি রক্ষার্থে বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলায় বসে যেসব ছবি এঁকেছিলেন, তার অনুলিপি পাঠানো যেতে পারে। আরও সিদ্ধান্ত হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের যে পূর্ণাঙ্গ রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছিল, তার একটি সেট এ জাদুঘরে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া আরও কী কী দেওয়া যেতে পারে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা যেতে পারে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম এবং বই শিলাইদহে পাঠিয়েছিল।

বিশ্বভারতী থেকে কলকাতায় ফিরে এসে দেখতে পাই যে বাংলাদেশের মহিলা কাবাডি দল আটকা পড়ে আছে। তারা দাবি করে যে তাদের দলনেত্রীর কাছে একটি ব্যাগে পাসপোর্ট ছিল। ব্যাগটি হারিয়ে যায়। তাই তারা যেতে পারছেন না। আমি কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা এদের ট্রাভেল পারমিট দেয়। দু-তিন দিন কলকাতায় থেকে ট্রাভেল পারমিট নিয়ে এরা ঢাকায় ফিরে আসে।