মুক্তিযোদ্ধা সেল

ঢাকায় ফিরে আসার পর আমাকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে মুজিবনগর সেলের উপসচিব নিয়োগ করা হয়। আমি এই পদে যোগ দিই। এই পদের দায়িত্ব ছিল দুটি। একটি দায়িত্ব ছিল মুজিবনগর সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশে কোনো চাকরি পাচ্ছেন না, তাদের চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিল পাকিস্তান থেকে যারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে, তাদের বাংলাদেশ সরকারে যোগ দেওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া। দ্বিতীয় কাজটি তখনো পুরোদমে চালু হয়নি। অল্প কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী তখন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আফগানিস্তান এবং ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসছিলেন। তবে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা কেউ কেউ চাকরির জন্য এই সেলের কাছে আসতেন।

সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে তখন অনেক পরিবর্তন হয়। প্রথমত, সৈয়দ হোসেনকে যুগ্ম সচিব পদে নিয়োগ করা হয়। সৈয়দ হোসেন পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সচিবালয়ের একজন সেকশন অফিসার ছিলেন। সেকশন অফিসার থেকে পদোন্নতি হলে উপসচিব হয়। কিন্তু তাঁকে সরাসরি যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তার কারণ, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট বোনের স্বামী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে তিনি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে তাঁর প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। এই সময়ে নিয়মবহির্ভুত পদোন্নতির জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের ওপর অনেক চাপ আসে। সৈয়দ হোসেন যদিও নিজে নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, তবু তিনি অনেক ক্ষেত্রে বেআইনি পদোন্নতি প্রতিহত করেন।

এই সময়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে মুজিব বাহিনীর কর্মকর্তাদের সরকারের বেসামরিক পদে নিয়োগ করা হবে। এই উদ্দেশ্যে তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদকে। ১৯৭২ সালে ১ হাজার ৩১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ ব্যাচ হিসেবে উচ্চতর বেসামরিক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগের দুটি তালিকা করা হয়। প্রথম তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর একটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস নামে নতুন একটি সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই দুটি তালিকাভুক্ত কর্মকর্তাদের দুষ্টু লোকেরা পরবর্তীকালে ‘তোফায়েল সার্ভিস অব বাংলাদেশ’ নামে ডাকত। এই নিয়োগের দুর্বলতা ছিল দুটি। প্রথমত, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে কর্মকর্তা নিয়োগ করা বাঞ্ছনীয় ছিল। এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব ছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের। কিন্তু পাবলিক সার্ভিস কমিশন। কোনো পরীক্ষা নেয়নি; তারা তোফায়েল আহমেদের তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগে অনাপত্তি জ্ঞাপন করে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় চাকরি হলে তা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধে আদৌ অংশগ্রহণ করেননি, তাদেরকেও তোফায়েল আহমেদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমার একজন সহপাঠী ছিলেন, যিনি ছাত্রজীবনে একজন ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন–পরবর্তীকালে তিনি সার্কেল অফিসার রেভিনিউ পদে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরকারের অধীনে কাজ করেন। তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কারণ, তিনি শেখ মনির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

যেভাবে এসব নিয়োগের প্রক্রিয়া করা হয়, তা সাধারণত সরকারি নিয়োগের সময় করা হয় না। আমার মনে আছে, এ তালিকা যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিন আমার পাশের রুমে কর্মরত সংস্থাপন বিভাগের আরেক উপসচিব এ টি এম শামসুল হুদার কক্ষে অনেক গন্ডগোল শোনা যায়। হুদা সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী আমার কক্ষে এসে বলেন, ‘স্যার, মুক্তিযোদ্ধারা আমার স্যারকে মারতে যাচ্ছে। আমি ওই কক্ষে গেলাম। যাওয়ার পর দেখতে পাই একজন নিয়োগের চিঠি নিয়ে হুদাকে বলছেন, এই ব্যাটা রাজাকারের পোলা, তুই আমার বাবার নামে চাকরি দিয়েছিস কেন? আমার নামে ঠিক করে অবিলম্বে নিয়োগ দে।’

উপসচিব হুদা আমাকে নথিটি দেখালেন। নথিটিতে যে তালিকা রয়েছে, সেসব ব্যক্তিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই তালিকার ওপরে এবং নিচে প্রতি পৃষ্ঠায় তোফায়েল আহমেদ ও বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর রয়েছে। এই তালিকায় যদি কোনো ভুল হয়, তাহলে তা সংশোধনের জন্য নথি বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠাতে হবে। এই নথি পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দরখাস্ত দিতে হবে। যদি দরখাস্ত না দেওয়া হয়, তাহলে ভুল হয়েছে–এ দাবি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কিন্তু দরখাস্ত দিয়ে ভুল সংশোধন করানোর মতো ধৈর্যও তখন ওই ব্যক্তির ছিল না। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তার কাছ থেকে দরখাস্ত আদায় করে তাঁকে সেদিনের মতো বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তোফায়েল আহমেদের মনোনীত কর্মকর্তাদের চাকরি দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রশাসনে রাজনীতিকরণ শুরু হয়।

এই সময় সেনাবাহিনীর আরেকটি আদেশ প্রশাসনে রাজনীতিকরণের জন্ম দেয়। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল আগে এ সম্পর্কে বিধি প্রণয়ন করা এবং সব নিয়োগবিধির ভিত্তিতে সম্পন্ন করা। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এ কাজটি করেনি। তার ফলে পদোন্নতি নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। অমুক্তিযোদ্ধা মেধাবীরা যাতে একেবারে বাদ না পড়েন, সে জন্য মাহাবুবুজ্জামান কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তবে কোটা ব্যবস্থা শুধু মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করা হয়নি। মাহাবুবুজ্জামান জেলাভিত্তিক কোটা ব্যবস্থারও প্রবর্তন করেন। জেলা কোটার ফলে অনেক মেধাবী প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়।

সেনাবাহিনীতে সব মুক্তিযোদ্ধাকে দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। এর ফলে অনেক সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের পাকিস্তান সরকারে যেসব সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিক কাজ করেছে, তাদের আগে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হয়। বেসরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ১৯৮৩ সালের আগে কোনো বিধি ছিল না। সরকার আশির দশকে এই বিধি প্রণয়ন করে। এই বিধির লক্ষ্য মুক্তিযোদ্ধাদের পদোন্নতি দেওয়া নয়, এর লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশাসনিক শূন্যতায় তাদের যে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল, তা রক্ষা করা। তবে এই বিধি পরিবর্তন সত্ত্বেও মুজিবনগর সরকারের সচিবদের বাংলাদেশ সরকারে অতিরিক্ত সচিব পদে নামিয়ে দেওয়া হয়। নয়জন কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তাদের সব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দেশ স্বাধীন হওয়ার দু-তিন মাসের মধ্যে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো পদোন্নতি হয়নি। এর পরেও পাকিস্তান সরকারের অধীনে যারা কাজ করেছেন, তাঁদের মনের দুঃখ মেটেনি। মরহুম সুলতান উজ জামান খান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাদেশিক সরকারের সচিব ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব হন। তখন মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশাসনিক শূন্যতায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে যেসব কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁদের সম্বন্ধে উম্মা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন :

আমি আগেই উল্লেখ করেছি, সিএসপিসহ কিছু অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা যারা মুজিবনগর গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁরা চাকরিতে কেবল দু’বছরের জ্যেষ্ঠতাই লাভ করেননি, সেই সঙ্গে দু’এক ধাপ ত্বরিত পদোন্নতি পেয়ে সরাসরি সচিবের পদ লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে স্থল পরিবহন সংক্রান্ত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব। আবদুস সামাদ (সিএসপি, ১৯৫৯) শেষোক্ত শ্রেণীভুক্তদের অন্যতম ছিলেন।[১]

দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অজস্র সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এবং অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁদের কোনো পদোন্নতি হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় সুলতান-উজ জামান খান সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে প্রাদেশিক সরকারের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় সচিবের পদে পদোন্নতি লাভ করেছেন। তাদের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার কোনো শাস্তি হয়নি, কারণ দেশ গড়ার জন্য তখন অভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তার প্রয়োজন। এ ধরনের সরকারি কর্মকর্তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সরকার–উভয়ের কাছ থেকেই পদোন্নতি নিয়েছেন। তাঁরা গাছেরও খেয়েছেন, তলারও কুড়িয়েছেন। আবার কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান একেবারে অগ্রাহ্য করেছেন। যেমন : বাংলাদেশের অর্থসচিব মতিউল ইসলাম নিজেকে বাংলাদেশের প্রথম অর্থসচিব হিসেবে জাহির করেছেন।[২] অথচ বাংলাদেশের প্রথম অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থসচিব ছিলেন। তার এই অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

এ সময়ে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেই নয়, দেশে জনগণের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছিল। দাবি করা হচ্ছিল, দেশের ভেতরে যারা ছিলেন, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পদাঘাতে নিষ্পেষিত হয়েছেন এবং প্রতিমুহূর্তে তাদের মৃত্যুর ভয়ে থাকতে হয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের প্রাণের ভয় ছিল না। কয়েক মাস ভারতে কষ্টভোগের পর তারা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। সমালোচকেরা যে তথ্যটি বিবেচনায় নেননি, সেটি হলো প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা পাকিস্তানের প্রশাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করেছেন। যারা দেশের ভেতরে থেকে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই নমস্য কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। সরকারি কর্মচারীরা, যারা দেশের ভেতরে ছিলেন, তাঁরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে বাধ্য হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে পাবনার তখনকার একজন এডিসির অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। বর্তমানে কর্মকর্তাটি কারও কারও কাছে বিতর্কিত। কেননা তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে বরিশালে জেলা প্রশাসক থাকাকালে বিএনপির রাজনীতিবিদ আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তা সব সময় বহাল ছিল এবং তা আজও অটুট রয়েছে। এই কর্মকর্তার নাম এম এ হাকিম। তিনি ১৯৬৫ ব্যাচের সিএসপি কর্মকর্তা। ১৯৯৭ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ২০০৭ সালে মাদারীপুর-১ আসনে তাঁকে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে লেখকের বিএনপিপ্রীতি সত্ত্বেও তার আত্মজীবনীতে বিএনপির কোনো ছায়া পড়েনি। তাঁর কাছে যা সত্য মনে হয়েছে, তা-ই তিনি লিখেছেন এবং কোনো রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার করেননি। সিভিল সার্ভিসে ৩২ বছর: স্মৃতি সম্ভার[৩] শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তার বর্ণনা অকপট এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে সত্য। লেখককে এ জন্য ধন্যবাদ জানাই।

হাকিম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাবনার এডিসি পদে বদলি হন। ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই তার পাবনা যোগদানের তারিখ ছিল। ১৯৭১ সালের ২ জুলাই ঢাকায় রিকশা দুর্ঘটনার ফলে তিনি পাবনায় যোগ দেন ১৪ জুলাই তারিখে। যদি দুর্ঘটনার জন্য ১২ দিন পর পাবনায় যোগ দিতে পারেন, তবে ইচ্ছা করলে পাবনায় না গিয়ে তিনি ভারতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি পাবনায় জয়েন করেন। এই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন:

আমি পাবনা জয়েন করে দেখতে পাই যে, সেখানকার প্রশাসন প্রায় সম্পূর্ণভাবে মিলিটারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পাবনার ডিষ্ট্রিক্ট মার্শাল ’ল এডমিনিষ্ট্রেটের (ডিএমএলএ)-এর অফিস ও সেনা ছাউনি স্থাপন। করা হয়েছে শহরের উত্তর পশ্চিম দিকে ওয়াপদা কলোনীতে। শহরের আরও কয়েকটি স্থানে মিলিটারীদের অফিস স্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়া সেনাসদস্যদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ করে আহতদের জন্য একটি ফিল্ড এ্যামবুলেন্স হসপিটাল স্থাপন করা হয়েছিল। পাবনা শহরের অনেক লোকজন গ্রামে চলে গিয়েছিল। বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেকেই তাদের পরিবার অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা একা থাকতেন।[৪]

পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য তাঁকে কী করতে হয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা তাঁর আত্মজীবনীতে রয়েছে। তিনি লিখেছেন:

আমার জয়েন করার কিছুদিন পর সরকার থেকে আদেশ গেল রাজাকার বাহিনী গঠন করার জন্য। ইতিপূর্বে জেলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিল মিলিটারীদের নির্দেশক্রমে। এসব শান্তি কমিটির প্রধান কাজ ছিল পাক সেনাদের বিভিন্ন কাজে ও অপারেশনে সাহায্য করা। এদের পাশাপাশি রাজাকার বাহিনী সৃষ্টি করে তাদেরকে অস্ত্র (রাইফেল) দেওয়া হলো মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাক সেনাদের সাহায্য করার জন্য। রাজাকার বাহিনী গঠনের সময় ডিএমএলএ-কে কোনো কোনো বিষয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতে হয়েছিল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে (আবদুল কুদুস) জেলা প্রশাসক লিয়াজোঁ অফিসার হিসাবে নিয়োজিত করেছিলেন। অনেক ব্যাপারে আমাকেও জড়িত হতে হয়েছে মার্শাল ল কর্তৃপক্ষের সাথে। এসব কাজ করার ইচ্ছা না থাকলেও প্রকাশ্যে তা বলা যেত না। জেলা প্রশাসনের কাজ ছাড়াও পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে মিলিটারীদের জন্য অনেক কিছু করতে বাধ্য হয়েছি। তবে আমি যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব করছি তা মুক্তিযোদ্ধারা ও তাদের সমর্থনকারী লোকজন বুঝতে পারত। পৌরসভার একজন ওভারসিয়ার (মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী)-এর মাধ্যমে পাবনার মুক্তিবাহিনীর ২/১ জন কমান্ডারের সাথে গোপনে আমার যোগাযোগ হতো। তারা আমাকে বিভিন্ন কাজের জন্য বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে তা করে দিতাম। অনেক সময় তাদের জন্য আমি সাহায্য পাঠাতাম। পাবনা শহরে এ সময়ে মুসলিম লীগ, জামাত ও নেজামে ইসলাম দলের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দল- সমূহের নেতাগণ ছিলেন না। প্রশাসনের প্রয়োজনে আমাদেরকে ঐসব নেতাদেরকে ডাকতে হতো এবং তাদের সহযোগিতা নিতে হতো।[৫]

তিনি আরও লিখেছেন:

অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডও ধীরে ধীরে জোরদার হতে থাকে। বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনীর অপারেশনের সংবাদ মাঝে মাঝে জানা যায়। এমন অবস্থার মধ্যে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মিলিটারী কর্তৃপক্ষ পাবনা শহরে একটি হোল্ডিং ক্যাম্প তৈয়ার করে। পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এ ক্যাম্পের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানি সরবরাহ, ল্যাট্রিন, ড্রেন, ইত্যাদির ব্যবস্থা আমাকে করে দিতে হয়েছিল। গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুর রহমান কিছু নির্মাণ কাজ করে দিয়েছিলেন। পাক-মিলিটারী অফিসাররা আমাদের দ্বারা তাদের প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নিত ঠিকই, কিন্তু তারা আমাদেরকে বিশ্বাস করত না। আমরাও সব সময়ে একটা ভয় বা আতংকের মধ্যে থাকতাম। জানি না কোনো কারণে মিলিটারীরা। আমাদেরকে সন্দেহ করলে আর নিস্তার নেই। ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন চালাতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্যাতন। করে বা গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। আমাকে যখনই কোনো কাজে মিলিটারী ক্যাম্পে বা অফিসে যেতে হতো তখনই মনের মধ্যে একটা অজানা আতংক এসে যেত কি জানি কি হয়। অন্যদিকে আমার পরিবারের লোকজন ভয়ে ভয়ে থাকত এবং আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত স্বস্তি পেত না। আমার মনে হয় বাঙালী অফিসার যারাই ঐ সময়ে এদেশে কাজ করেছে তাদের সকলেরই এরূপ একটি ভীতিকর ও অজানা আশংকার মধ্যে কাটাতে হয়েছে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকেও বিপদ আসার সম্ভাবনা ছিল। ঐ সময়ে আমরা উভয় সংকট পরিস্থিতিতে দারুন ভীতিকর অবস্থায় জীবন যাপন করেছি।[৬]

প্রশ্ন ওঠে, কেন সরকারি কর্মকর্তারা এই ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেননি। অবশ্যই যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তারা বিশ্বাস করতেন যে সংগ্রামে পাকিস্তানিরা জয়যুক্ত হবে। তাই মাত্র ১৪ জন সিএসপি কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অথচ শতাধিক সিএসপি কর্মকর্তা ভারতে পলায়নের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের দাসত্ব করেছেন। এঁরাই মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নন। এঁদের অনেকেরই রাজাকারদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য বিচার হওয়া উচিত ছিল। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কার দেওয়ার নাম করে তিন প্রজন্ম পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা সৃষ্টি কতটুকু সঠিক ছিল, সে সম্পর্কেও প্রশ্ন রয়েছে।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. সুলতান-উজ জামান খান, স্মৃতির সাতকাহন এক আমলার আত্মকথা, ২০০৭ (ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ), পৃষ্ঠা-৩১৩।
  2. Md. Matiul Islam, Rebuilding the War-Devastated Financial Sector of Bangladesh. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রশাসন সান্নিধ্যের দুর্লভ স্মৃতি, 2021, (ঢাকা : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়)।
  3. এম এ হাকিম, সিভিল সার্ভিসে ৩২ বছর : স্মৃতি সম্ভার, ২০১২, (ঢাকা : প্রকাশক এম এ হাকিম), পৃষ্ঠা-১০৪।
  4. এম এ হাকিম, প্রাগুক্ত, ২০১২, পৃষ্ঠা-৭৩
  5. এম এ হাকিম, প্রাগুক্ত, ২০১২, পৃষ্ঠা-৭৪-৭৫
  6. এম এ হাকিম, প্রাগুক্ত, ২০১২, পৃষ্ঠা-৭৬-৭৭