বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। প্রথমে তাঁকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। তিনি সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনেন। তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকারপ্রধান হন এবং বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। সাধারণত কোনো রাজনৈতিক নেতা আমাকে না ডাকলে আমি কখনো তার সঙ্গে পরিচয় করতে যেতাম না। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আসার পর প্রায় সব উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবু আমি নিজের উদ্যোগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। তাই আমার সঙ্গে তাঁর সরাসরি পরিচয় ছিল না। শিক্ষা কমিশনের যখন প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তখন গণভবনে বঙ্গবন্ধু তাতে সভাপতিত্ব করেন। শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সঙ্গে সভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করার জন্য গণভবনে উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু সভায় উপস্থিত হলে শিক্ষামন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মুজিব ভাই, এ হচ্ছে আমার মুক্তিযোদ্ধা উপসচিব আকবর আলি খান। বঙ্গবন্ধু আমার পিঠে একটু হাত বোলালেন। তারপর সভাপতির আসন গ্রহণ করলেন। এই ছিল জীবনে আমার তার সঙ্গে একমাত্র সংযোগ। কিন্তু শিক্ষা। মন্ত্রণালয়ে কাজ করার ফলে তার সঙ্গে আমার তিনটি পরোক্ষ সংযোগ। ঘটেছিল, যা আমার মনে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে।

প্রথম সংযোগটি ঘটেছিল ১৯৭২ সালের শেষ দিকে, যখন দেশে রাজাকারদের শাস্তি দেওয়ার জন্য রাজাকার দমন আইন পাস করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে রাজাকারদের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে। আইন অনুসারে পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে এবং কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দেয়। অভিযুক্ত শিক্ষকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর শরণাপন্ন হন। চৌধুরী। সাহেব সরাসরি গণভবনে বঙ্গবন্ধুর কাছে হাজির হন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীকে ডেকে নেন। তারা তিনজন বসে সিদ্ধান্ত নেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রাজাকারদের সহযোগিতার অভিযোগ উত্থাপিত হলে পুলিশ কোনো তদন্ত করবে না। এ ধরনের সব অভিযোগ তদন্ত করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নিযুক্ত একটি কমিটি। তাঁরা এই কমিটির সদস্যদের নামও ঠিক করেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে সেই তালিকা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাতে সারসংক্ষেপ ওই দিনই পাঠানো যায়, তার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী সচিবালয়ে। এসে আমাকে কাগজটি ধরিয়ে দিয়ে এ সম্বন্ধে এক ঘণ্টার মধ্যে সব কাগজ। প্রস্তুত করতে বলেন। আমি তাকে বলি যে এর আইনগত দিক রয়েছে এবং এ সম্পর্কে সারসংক্ষেপ পেশ করার আগে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিতে পারলে ভালো হতো। ইউসুফ আলী বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আদেশ দিয়েছেন। এ আদেশ সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি সারসংক্ষেপ এবং আদেশের খসড়া তৈরি করে নিয়ে আসুন।

আমি আমার কক্ষে ফিরে এসে আদেশের খসড়া তৈরি করি এবং টাইপিস্টকে অবিলম্বে সেটি টাইপ করে দিতে অনুরোধ করি। তারপর আমি নোটশিটে লিখি, শিক্ষামন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন যে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং শিক্ষামন্ত্রীর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রাজাকারদের সঙ্গে সহযোগিতার তদন্তের ভার নিম্নরূপ কমিটির হাতে অর্পণ করা হবে। আমি শিক্ষামন্ত্রীকে বলি এই সিদ্ধান্তটির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। থানার দারোগাকে আইন করে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আর চ্যান্সেলরের কমিটিকে একটি নির্বাহী আদেশে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। নির্বাহী আদেশে নিযুক্ত কমিটির ক্ষমতা কখনো আইনে নিযুক্ত তদন্তকারী কর্মকর্তার চেয়ে বেশি হতে পারে না। শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে প্রস্তাবিত বিজ্ঞপ্তির খসড়া আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পেশ করলাম।

এক ঘণ্টা হতে না হতেই শিক্ষামন্ত্রীর তাগাদা আসতে শুরু করে। আমি বিজ্ঞপ্তিটি টাইপ হলে ফাইলটি তৈরি করে শিক্ষাসচিবের স্বাক্ষর নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে দিই। শিক্ষামন্ত্রী কিছু না পড়েই তার স্বাক্ষর দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নথি পাঠিয়ে দেন। পরদিন সকালে গণভবন থেকে আমার কাছে জানতে চাওয়া হয় রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত এসেছে কি না। আমি তাঁকে জানাই ফাইল তখনো ফেরত আসেনি। তিনি আমাকে রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফাইলটি দ্রুত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করতে পরামর্শ দেন। রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব জানান তিনি দ্রুততার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে নথি দাখিল করেছেন কিন্তু রাষ্ট্রপতি এটি স্বাক্ষর করেননি। এরপর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়, তবু রাষ্ট্রপতি ফাইলটি স্বাক্ষর করেননি। প্রতিদিনই আমি গণভবনে যোগাযোগ করতাম এবং প্রতিদিনই একই উত্তর পেতাম।

সাত দিন পর অধ্যাপক ইউসুফ আলী আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি এই ফাইল সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য তাঁকে বঙ্গভবনে ডেকেছিলেন। রাষ্ট্রপতি ফাইলটি দেখিয়ে বলেন, ‘ফাইলে যে নোটটি আছে, সেটি কি আপনি পড়েছেন?’ ইউসুফ আলী বলেন, ‘স্যার, নোটটি আমার এক উপসচিব লিখেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং সে কারণে আবেগপ্রবণ। রাষ্ট্রপতি তাঁকে বললেন, তিনি মোটেও আবেগপ্রবণ নন এবং তাঁর বক্তব্য সঠিক। আমি এক সপ্তাহ ধরে সরকার গঠিত কমিশনের বৈধতা সম্পর্কে বিভিন্ন হাইকোর্টের রায় পর্যালোচনা করেছি। আমার সিদ্ধান্ত হলো উপসচিবের বক্তব্য সঠিক। তাই আমি এ প্রস্তাব অনুমোদন করতে চাই না। আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যান এবং তাঁকে বলেন এ কাজটি করা আইনসংগত হবে না বলে আমি মনে করি। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম এবং তাঁকে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বলেছি। তিনি বলেছেন বিচারপতি চৌধুরী যদি এ কাজটিকে আইনসম্মত বলে মনে না করেন, তাহলে এটি না করাই ভালো হবে।’ তিনি নথিটি ইউসুফ আলীকে ফেরত দেন। ইউসুফ আলী নথিটি আমাকে দিয়ে বলেন যে এ ব্যাপারে আমাদের আর কিছু করার নেই। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সচিবালয়ে একটি গুজব ছিল যে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমি প্রশ্ন তুললাম। এবং আমার কিছুই হলো না। আমি বুঝতে পারলাম ঠিক প্রশ্ন করার থাকলে প্রশ্ন করা যাবে কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্যে ভুল প্রশ্ন করা হলে ক্ষমা করা হবে না।

কিছুদিন পর ইউসুফ আলী বঙ্গভবন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসে আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন যে বঙ্গবন্ধু তাকে ঢাকায় ইসলামি একাডেমি চালু করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। পাকিস্তানে ইসলামি একাডেমি প্রথম চালু করেছিলেন আইয়ুব খান। ইসলামি একাডেমির পরিচালক ছিলেন আবুল হাশিম। পাকিস্তান ছিল একটি ধর্মরাষ্ট্র, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। ইসলামি ধর্মরাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি করাতে কোনো অসুবিধা নেই; কিন্তু একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি চালু করা হলে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠতে পারে। আমি ইউসুফ আলীকে বললাম, আপনি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। সেই রাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি করা কি যুক্তিসংগত হবে? আমি ইউসুফ আলীকে এ সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি নোট পাঠাতে অনুরোধ করি। ইউসুফ আলী চিন্তা করে বলেন, ‘আপনি আপনার বক্তব্য লিখিতভাবে দেন। আমি তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করব। আমি উৎসাহিত হয়ে এ সম্পর্কে বইপত্র জোগাড় করে নোট লিখতে শুরু করি। রাতে বাসায় বসে নোট লিখতাম। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার একটি হস্তলিখিত নোট তৈরি করি, যা টাইপ করলে হয়তো ২০ পৃষ্ঠার মতো হতো। আমি আমার নোটে ইসলামি একাডেমি পুনরায় স্থাপন করলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে তা যে সাংঘর্ষিক হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য লিখি। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সম্পর্কেও বক্তব্য উপস্থাপন করি। সবশেষে আমি যুক্তি দেখাই ইসলামি একাডেমি স্থাপন করলে তা রাষ্ট্রের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এর কারণ হলো ধর্মের প্রতিটি প্রশ্নেই মতবিরোধ রয়েছে। যদি ইসলামি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে প্রতিটি বিতর্কিত প্রশ্নে ইসলামি একাডেমির বক্তব্য রাষ্ট্রের জন্য চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। ধর্মের বিষয়ে সব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে আমি লাহোরের কাদিয়ানি দাঙ্গা সম্পর্কে বিচারপতি মুনির কমিশনের তদন্ত রিপোর্টের উল্লেখ করি। বিচারপতি মুনির ইসলামের সংজ্ঞা সম্পর্কে ১৪০ জন আলেমকে প্রশ্ন করেছিলেন। ১৪০ জন আলেম ১৪০ ধরনের জবাব দিয়েছেন। কেউ কারও সঙ্গে একমত হননি। সুতরাং ইসলামি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলে রাষ্ট্রের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আমি নথি দাখিল করলে শিক্ষাসচিব এবং শিক্ষামন্ত্রী কোনো কিছু না লিখে শুধু স্বাক্ষর করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠান। এই ফাইল যাওয়ার পর প্রায় মাস তিনেক এ সম্বন্ধে আমরা আর কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। তিন মাস পর আমার বিরাট নোটের নিচে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা ছোট একটি নির্দেশ পেলাম। তিনি লিখেছেন, ‘ইসলামি একাডেমি সম্বন্ধে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা পড়লাম। আলোচককে ধন্যবাদ। তবে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি হলো এখানে ইসলামি একাডেমির প্রয়োজন রয়েছে। তাই ইসলামি একাডেমি স্থাপনের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা নিন। আমার মনে হয় এ ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর অফিসেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব মশিউর রহমান লিখেছেন :

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে একটি নথি পাওয়া গেল। চল্লিশ-পঞ্চাশ পৃষ্ঠা দীর্ঘ নোটের মূল বক্তব্য অসাম্প্রদায়িক দেশে ধর্মবিষয়ক এরূপ প্রতিষ্ঠান যুক্তিহীন, অসাম্প্রদায়িক তত্ত্বের সাথে সংগতিহীন। বঙ্গবন্ধুর কাছে নথি উপস্থাপন করলে নথিটি রেখে দিতে বলেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কয়েকবার তাগাদা দেন। এক-দেড় মাস পরে বঙ্গবন্ধু নিম্নোক্ত মর্মে সিদ্ধান্ত দিলেন, এ দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দরকার আছে, থাকবে। আমাদের বোঝালেন, সাধারণ মোল্লা-মৌলভিদের আরবি ভাষা ও ধর্মশাস্ত্র জ্ঞানের ঘাটতি আছে, কিন্তু তাদের প্রভাব ব্যাপক। ধর্মান্ধতা দূর করতে ও ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান বিস্তারে ফাউন্ডেশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্যই গভীর।[১]

ধর্মশাস্ত্র জ্ঞান প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে তার সিদ্ধান্ত যে নির্ভুল, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধু শুধু ইসলামি একাডেমি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন; কিন্তু তার পরবর্তী শাসকেরা শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়েছে। এই বিধান সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ বেশি সদস্যের অনুমোদন নিয়ে এখনো চালু রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ শুধু সাম্প্রদায়িকতার অনুপস্থিতি। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে অধিকাংশ মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার তৃতীয় স্মৃতি হলো সরকারি চাকরি থেকে আমার ইস্তফাদানের সময়ে তাঁর লিখিত বক্তব্য। ১৯৭৩ সালে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপকের পদে নিয়োগ পেয়ে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করি। এই পদত্যাগপত্র যখন তার কাছে যায়, তখন তিনি জানতে চান আমি কেন পদত্যাগ করছি। উত্তরে তাঁকে জানানো হয় সরকারি চাকরিতে আমি ক্লান্ত এবং আমি পড়াশোনা করতে চাই। উত্তরে তিনি নাকি বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আরও ক্লান্ত হবে; সেখানে গিয়েও সে টিকে থাকতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করে যে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে আমাকে লিয়েনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে দেওয়া যেতে পারে। নথিতে বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লিখলেন :

১৫। অনুমোদন করা হল।

১৬। তবে তিন বৎসরের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। দেশ গড়ার কাজে তার বিশেষ ভূমিকা আছে।

–শেখ মুজিব।

তিন বছর পর ফিরে আসতে পারিনি, তবে সাত বছর পরে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সরকারে ফিরে এসেছিলাম। সরকারের বিশেষ ভূমিকা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়েছিল। আমি সরকারে ফিরে আসি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সভাপতি, অর্থসচিব এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মতো পদে তিনটি সরকারের অধীনে গুরুদায়িত্ব পালন করি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আমাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছিলেন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. এ কে এম মশিউর রহমান, ২০২১, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও প্রশাসন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রশাসন, (ঢাকা : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়), পৃষ্ঠা-১৫৩