ভালো বইয়ের সন্ধান

প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফল আশানুরূপ না হওয়ায় আমি আইএ পরীক্ষায় মেধাতালিকায় উচ্চ স্থান অধিকার করব–এ ধরনের কোনো বাসনা নিয়ে লেখাপড়া করছিলাম না। কিন্তু ঢাকা কলেজে আসার পর পড়াশোনায় আমার আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। নবীনগর স্কুলে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন যথেষ্ট পড়ার বই পেতাম না। ঢাকা কলেজের ছাত্র হওয়ার পরে দেখলাম যে পড়ার। বইয়ের কোনো অভাব নেই। ঢাকা কলেজের পাঠাগার তখন প্রায় ৯০ বছরের পুরোনো। পাঠাগারের জন্য প্রতিবছরই সরকার থেকে মঞ্জুরি দেওয়া হতো। এর ফলে সব বিভাগেই প্রচুর বই ছিল। এই পাঠাগারেই আমি Bury-এর লেখা প্রাচীন গ্রিস সম্বন্ধে বই পড়ি, মমসনের প্রাচীন রোমের ইতিহাস পড়ি, বার্নসের ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশন সম্পর্কে বই পড়ি, হেগেনের ফরাসি বিপ্লবোত্তর আধুনিক ইউরোপ সম্পর্কে ও হেইজের আধুনিক ইউরোপ সম্পর্কে বই পড়ি। তেমনি বাংলায় প্রচুর উপন্যাস এবং কবিতার বই পড়ি।

পাঠাগার থেকে আমরা একসঙ্গে দুটি বই ধার করতে পারতাম। তবে ঢাকা কলেজে আমার কোনো দিনই পরপর দুটি ক্লাস ছিল না। দুটি ক্লাসের মধ্যে ফাঁক থাকত। এই ফাঁকের সময়টুকুতে আমি পাঠাগারে বসে পড়াশোনা করতাম। যেহেতু পাঠাগারের কর্মচারীরা আমাকে চিনত, তাই তারা মূল পাঠাগারে বই পড়তে আমাকে কোনো বাধা দিত না। এভাবে বই পড়তে পড়তে একদিন দৈনিক আজাদ-এর একটি বাঁধানো ঈদসংখ্যা আমার নজরে আসে। সেখানে দেখতে পাই আমার শিক্ষক শওকত ওসমানের লেখা জননী নামক উপন্যাস। উপন্যাসটি পড়ে আমার ভালো লাগে। একদিন ক্লাসে আলোচনা করার সময় আমি শওকত ওসমান স্যারকে জিজ্ঞেস করি, ‘তাঁর জননী উপন্যাসটি বাজারে পাওয়া যায় কি না?’ শওকত ওসমান বললেন, ‘না, এই বই প্রকাশ করতে পারিনি। আজাদ পত্রিকায় উপন্যাস প্রকাশের পরই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এই উপন্যাসের কোনো কপিও আমার কাছে নেই।’ আমি বললাম ঢাকা কলেজ পাঠাগারে এর একটি অনুলিপি আছে। শুনে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, ‘বাবা, আমাকে দেখাও কোথায় ওই বই আছে।’ আমি তাকে পাঠাগারে নিয়ে যাই এবং সেখানে গিয়ে তিনি পত্রিকাটি নিজের নামে ইস্যু করে নেন। কয়েক বছর পর জননী উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

কলেজ যখন খোলা থাকত, তখন কলেজের পাঠাগারে পড়াশোনা করতাম। কলেজ যখন বন্ধ থাকত, তখন পড়তে যেতাম কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি। তখন সবেমাত্র কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি চালু হয়েছে। সেখানে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার একটি সেট ছিল। যখনই কোনো কিছু জানতাম না, তখনই সে সম্পর্কে এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে খোঁজ করতাম। তা ছাড়া ওই পাঠাগারে অক্সফোর্ডের মূল ইংরেজি অভিধান ছিল। সুতরাং কোনো শব্দের অর্থ জানতে হলে অভিধান বের করে দেখে নিতাম। ওই পাঠাগারে পাকিস্তানের ওপর অনেক ভালো বই ছিল। সেসব বই ব্যবহার করে আমি পৌরশাস্ত্রের বিভিন্ন প্রশ্নের ওপর নোট তৈরি করি।

এ ছাড়া যখন রোজার ছুটি হতো, তখন আমি ইন্ডিয়ান ইনফরমেশন বিভাগ পরিচালিত জিন্নাহ অ্যাভিনিউয়ে তাদের পাঠাগারে পড়তে যেতাম। সেখানে বিশেষ করে সুকুমার সেনের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং বাংলা উপন্যাসের ধারা সম্পর্কে শ্রীকুমার চক্রবর্তীর একটি বই পড়ে উপকৃত হই।

এই সময়ে আমি বই কেনা শুরু করি। আমি বিভাগীয় বৃত্তি মাসে ১০ টাকা করে পেতাম। উপরন্তু আমার বড় বোন বীণা আপা খুলনা থেকে আমাকে মাসে ১০ টাকা মানি অর্ডার করতেন। এই ২০ টাকা দিয়ে মাসে আমি অনেক বই কিনতে পারতাম। তখন মহিউদ্দিন অ্যান্ড সন্সের পেঙ্গুইন এবং পেলিকেনের প্রকাশিত অনেক বই সস্তায় কিনতে পাওয়া যেত। আমার মনে আছে মহিউদ্দিন অ্যান্ড সন্স থেকে টি এস ইলিয়টের একটি সমালোচনা গ্রন্থ মাত্র দেড় টাকায় কিনি। এই বইয়ের বর্তমান মূল্য কমপক্ষে চার-পাঁচ শ টাকা হবে। এ ছাড়া তখন অনেক বাংলা সিনে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হতো উল্টোরথ এবং সিনেমা জগৎ। পূর্ব পাকিস্তান। থেকে প্রকাশিত হতো সচিত্র সন্ধানী। এসব পত্রিকা আমি কিনতাম এবং গোগ্রাসে গিলতাম। অনেক বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তবে বিশেষ কোনো বিষয়ের ওপর সেটি কেন্দ্রীভূত হয়নি।