প্রবেশিকা পরীক্ষা

১৯৫৮ সালে আমি ক্লাস টেনে উঠি। পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানে একটিমাত্র মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ছিল। ওই বোর্ডে প্রতিবছর চার শ থেকে পাঁচ শ ছাত্র প্রথম শ্রেণিতে পাস করত। প্রথম শ্রেণির ছাত্রদের মধ্যে খুব বেশি হলে পনেরো বিশজন স্টার মার্ক বা শতকরা ৭৫ ভাগ নম্বর পেত। নবীনগর স্কুলের প্রবেশিকা পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার থাকার মতো দুটি বাড়ি ছিল। একটি বাড়ি পইরতলায়। সেটি ছিল আমার ছোট খালার বাড়ি। তবে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো পইরতলা থেকে দুই-তিন মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। উপরন্তু আমার অনেক খালাতো ভাই-বোন ছিল। সুতরাং সেখানে পড়াশোনার অসুবিধা হতে পারে, তাই সিদ্ধান্ত হলো খালার বাসায় থাকব না। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সমবায় বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত নিবন্ধক আফসার সাহেব থাকতেন। তিনি নবীনগরের সমবায় বিভাগের যখন নিবন্ধক ছিলেন, তখন প্রায় বছর চারেক আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। তাঁর ছেলে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের আর কোনো সন্তান ছিল না। সুতরাং বাড়িটি ছিল নির্পাট এবং ওই বাড়ি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গার্লস স্কুল, যেটা আমাদের পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল, সেটি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে। তাই আমার মা সিদ্ধান্ত নেন যে ওই বাড়ি থেকেই আমি প্রবেশিকা পরীক্ষা দেব। যেহেতু ছোটবেলায় তারা আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন, সেহেতু যত্নের কোনো ত্রুটি তারা রাখেননি। শুধু একটি সমস্যা হয়েছিল। আমার যেদিন অঙ্ক ও আরবি পরীক্ষা (তখন সকালে অঙ্ক পরীক্ষা হতো আর বিকেলে আরবি পরীক্ষা হতো) তার দুই দিন আগে গৃহকত্রী এক দুঃস্বপ্ন দেখেন। সেই দুঃস্বপ্নের প্রতিকারের জন্য একজন ওঝা জোগাড় করা হয়। ওঝা রাত ১১টার সময় ওই বাড়িতে এসে ভূতকে ডেকে পাঠান এবং সবাইকে অভিশাপমুক্ত করেন। ভূত তাড়াতে প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল। পরের দিন আমার যে দুই পরীক্ষা হয়, সেই পরীক্ষার ফল খুব একটা সন্তোষজনক হয়নি। আরবি ব্যাকরণে একটি প্রশ্নের ভুল উত্তর দিই। অঙ্কে আমার হিসাবে কমপক্ষে ৮৫ নম্বর পাব বলে মনে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি অঙ্কে লেটার (৮০ শতাংশ) নম্বর পাইনি। পেয়েছিলাম ৭৭ শতাংশ নম্বর। আরবিতে পেয়েছিলাম ৬৮ শতাংশ নম্বর।

আমার সবচেয়ে ভালো পরীক্ষা হয়েছিল ভূগোলে। এ বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল গভীর। তিন-চারটি বই থেকে নোট করে আমি ভূগোল পড়তাম এবং প্রশ্নের উত্তরে আমি অনেক রেখাচিত্র ও মানচিত্র দিই। আমার মনে আছে আমি বেশ কয়েকটি অতিরিক্ত খাতা নিয়ে উত্তর লিখেছিলাম। সে সময় পরীক্ষাকেন্দ্রের একজন পর্যবেক্ষক প্রায় পুরো সময় আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর যখন আমি খাতা দিয়ে আসি, তখন পর্যবেক্ষক আমাকে জানান, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক। তিনি আমার উত্তরগুলো দেখেছেন এবং তিনি নিশ্চিত যে আমি ভূগোলে লেটার পাব। পরীক্ষার যখন ফল বেরোল, তখন দেখা গেল যে ভূগোলই একমাত্র বিষয় যেখানে আমি প্রথম শ্রেণির নম্বরও পাইনি। মাত্র ৫৪ শতাংশ নম্বর পেয়েছি। এর ফলে আমি আইএতে ভূগোল নিইনি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় আমি ৬৮.৮ শতাংশ নম্বর পাই। স্টার নম্বর পাওয়ার জন্য আরও ৫২ নম্বর ঘাটতি ছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফল আমার জন্য তাই মোটেও সন্তোষজনক ছিল না।

১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা হয়ে গেল। ফলাফল বেরোতে তখনো তিন মাস বাকি। লেখাপড়ার চাপ নেই, একেবারেই নিরঙ্কুশ ছুটি। এ সময়ে আমি একটি কবিতা লিখি, একটি নাটক রচনা করি এবং ইতিহাস সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখি। কবিতাটি ইত্তেফাঁক পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। এটি মুদ্রিত হয়নি। এই কবিতার পর আমি আর কোনো কবিতা লিখিনি। ধরে নিই কবিতা লেখার প্রতিভা আমার নেই। পল্লি উন্নয়ন নিয়ে একটি নাটক লিখি। প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার নাটক। নাটকটি লেখার পর লেখাটি পর্যালোচনা করি। আমার কাছে মনে হলো যে এ ধরনের নাটক মঞ্চস্থ হলে দর্শকেরা মোটেও তা গ্রহণ করবেন না। তাই নাটকের খাতাটি ছিঁড়ে ফেলে দিই। আরেকটি প্রবন্ধ লিখি। প্রবন্ধের নাম ‘একেই কি বলে ইতিহাস? সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে যেসব ভিত্তিহীন গুজব ছিল, সেগুলো নিয়ে এই প্রবন্ধে আলোচনা করি। এই প্রবন্ধ লেখার জন্য ইসলামিক লিটারেচার নামে একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত তিন-চারটি প্রবন্ধ থেকে তথ্য ব্যবহার করি। প্রবন্ধটি মাসিক মোহাম্মদীতে পাঠানো হয়। মাস ছয়েক পরে আমি যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, তখন প্রবন্ধটি ছাপা হয়। এই প্রবন্ধ ছাপার পর আমি দীর্ঘদিন কিছুই লিখিনি। তবে পরবর্তীকালে আমি যা লিখেছি, সবই প্রবন্ধ। প্রবন্ধের বাইরে আর কিছু লেখার চেষ্টা করিনি।

প্রবেশিকা পরীক্ষা পাসের পর আমি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান পড়া ছেড়ে দিই। তবে প্রবেশিকা পর্যায়ে যে দুটি বিজ্ঞানসংক্রান্ত বিষয় পড়েছি (অঙ্ক ও ঐচ্ছিক বিজ্ঞান) দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে ভালো নম্বর পেয়েছিলাম। তবে বিজ্ঞানের গবেষণার পদ্ধতির ওপর আমার আস্থা স্কুলে থাকতেই গড়ে ওঠে। এই আস্থা গড়ে ওঠে আমার পিতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে। আমার পিতা মনে করতেন যে আধুনিক বিজ্ঞান সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং ধর্মের অনুশাসন বিজ্ঞানের আলোকে প্রয়োগ করতে হবে। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে ধর্মের ব্যাখ্যা ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। বাইরে থেকে কোনো ব্যাখ্যা কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। মুশকিল হলো নবম শ্রেণিতে কিছু সহপাঠী ছিল, যারা বিজ্ঞানবিরোধী ছিল তারা দাবি করে যে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে সূর্য পৃথিবীর চার পাশে ঘোরে অথচ ভূগোল বইয়ে পড়ানো হচ্ছে যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। ইসলামবিরোধী ভূগোল পাঠ বন্ধ করা উচিত। আমি প্রতিবাদ করায় তারা আমাকেও ইসলামবিরোধী বলে আখ্যা দেয়। এই পর্যায়ে স্কুলের শিক্ষকেরা আমাকে এ ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক না করতে পরামর্শ দেন। তাঁরাও অভিমত প্রকাশ করেন যে ধর্মের ব্যাখ্যা ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। সারা জীবন ধরে যারা ধর্মের বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত, তাদের যেমন আমি শ্রদ্ধা করি এবং যারা আমার সঙ্গে একমত নয়, তাদের মতের প্রতিও আমি সমভাবে শ্রদ্ধাশীল।