১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের বন্যা

১৯৫৪ সালে ৮ থেকে ১২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন চৈত্র মাসে। অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরেরই শ্রাবণ মাস থেকে দেশে বন্যা শুরু হয়। নবীনগর থানার মতো জলাভূমিতে বন্যা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই বেশ পানি হতো। প্রায় প্রতিবছরই তিতাস নদের পাশ দিয়ে নবীনগরের সঙ্গে দক্ষিণের গ্রামগুলোতে যাওয়ার যে সড়ক ছিল, সেটা প্রায়ই বন্যায় ভেসে যেত এবং মাস দুয়েক পথচারীদের পানির মধ্য দিয়ে চলাফেরা করতে হতো। এই রাস্তা। থেকে ডান দিকে কয়েক গজ দূরেই ছিল আমাদের স্কুলের গেট। তাই প্রায়। বর্ষাতেই আমাদের পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো।

শরৎকালে পূজার ছুটি হতো। পূজার ছুটিতে বাবার আদালত বন্ধ থাকত, আবার স্কুলও প্রায় তিন সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকত। তাই ওই সময়টা ছিল আমাদের বেড়ানোর সময়। প্রতিবছর পূজার ছুটিতে আমরা তিন ফুফুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম। আমার চার ফুফু ছিলেন। তাদের মধ্যে বড় জন আমাদের জন্মের আগেই মারা যান। আমরা প্রায় এক সপ্তাহের জন্য নৌকা ভাড়া করে। বের হতাম।

প্রথমে আমরা কালঘরা গ্রামে মেজ ফুফুর বাড়ি যেতাম। সেখানে পূজার। ছুটিতে বেশির ভাগ সময়ই আমার ফুফাতো বোনদের ছেলেমেয়েরাও নানার বাড়ি বেড়াতে আসত। এদের মধ্যে থাকত মাহতাব উদ্দিন আহমদ (যিনি পরবর্তী জীবনে বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী হয়েছিলেন), মেজবাহ উদ্দিন (যিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন) এবং ফরহাত উল্লাহ পেরু (যিনি আইএফআইসি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন)। এদের সঙ্গে আমরা খেলাধুলা করতাম। আমাদের ফুফা ছিলেন অত্যন্ত আরামপ্রিয়। তিনি ভাগচাষিদের দিয়ে জমি চাষ করাতেন। বছরের ছয় মাস গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, বাকি ছয় মাস মেয়েদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। যেদিনই আমরা কালঘরা যেতাম, সেদিনই মানিকনগর বাজারে মাছ কেনার জন্য লোক পাঠানো হতো। মানিকনগর বাজার ছিল মেঘনা নদীর পাড়ে। সে বাজারে তখন বিরাট রুই, কাতলা, আইড়, চিতল ইত্যাদি মাছ পাওয়া যেত। বড় মাছ আনা হতো এবং বহু ধরনের পদ রান্না করা হতো, যাতে এক দিনেই এ মাছ শেষ হয়ে যায়, কেননা মাছ সংরক্ষণের তখন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফুফুর বাড়ি ছিল জলাভূমির মধ্যে। এই বাড়ির চার দিকেই ছিল পানি। প্রায় প্রতিদিনই আমার একমাত্র ফুফাতো ভাই খুশু ভাই বিকেলবেলায় মাছ ধরতে ছিপ ফেলতেন। প্রতিদিনই তিনি প্রচুর পরিমাণ ট্যাংরা, বাইলা এবং বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ ধরতেন। সেসব মাছও আমরা খেতাম। কালঘরাতে দু-তিন দিন থাকতাম। ওই সময়ে কালঘরা থেকে আমরা রসুল্লাবাদ যেতাম এবং সেখানকার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। উপরন্তু বাবা তার পিতৃপুরুষদের কবর জিয়ারত করতেন। তবে রসুল্লাবাদের পৈতৃক বাড়িতে আমরা কখনো থাকতাম না।

কালঘরা থেকে আমরা যেতাম রতনপুর গ্রামে সেজ ফুফুর বাড়িতে। সেখানেও রামচন্দ্রপুর বাজার থেকে মেঘনার মাছ আসত এবং প্রচুর খাওয়াদাওয়া হতো।

সবশেষে আমরা আসতাম ছোট ফুফুর বাড়ি শাহবাজপুর গ্রামে। ফুফা পুলিশের চাকরি করতেন। তাই তাঁর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া হতো টেবিল চেয়ারে। শুধু মাছই খাওয়া হতো না, সঙ্গে মোরগ এবং খাসিও খাওয়ানো হতো। ছোট ফুফুর বাড়ি বেড়ানো শেষ হলে আমরা নবীনগর ফিরে যেতাম।

প্রত্যেক ফুফুর বাড়িতেই বাবা গেলে বোনেরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত, আবার আসার সময়ও তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত। এই কাদার বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে বলে তখন মনে হতো না। এখন মনে হয় যে এই কাদাতে বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। আমার বাবারা ছিলেন তিন ভাই। আমাদের জন্মের আগেই আমাদের বড় চাচা এবং ছোট চাচা মারা যান। তিন ভাইয়ের মধ্যে তখন শুধু এক ভাই জীবিত ছিলেন। কাজেই বাবাকে দেখলে ফুফুরা বাকি দুই ভাইয়ের কথা স্মরণ করে কাঁদতেন।

বর্ষাকাল ছাড়া আমরা ফুফুদের বাড়িতে সাধারণত যেতাম না। কারণ, বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় পায়ে হেঁটে যেতে হতো। তা-ও কোনো সড়ক ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমির আইল ধরে যেতে হতো। বার দুয়েক পায়ে হেঁটে কালঘরা যেতে হয়েছিল অসুস্থ দাদিকে দেখার জন্য। একবার আম্মা গিয়েছিলেন সঙ্গে। তিনি পালকিতে করে গিয়েছিলেন, আর আমরা পায়ে হেঁটে। পরেরবার আম্মা যাননি, আমি বাবা এবং আমার ছোট ভাই জসিম গিয়েছিলাম। দুইবারই যাওয়ার কারণ ছিল দাদির অসুস্থতা। দাদি তখন মেজ ফুফুর সঙ্গে থাকতেন।

দ্বিতীয়বার যখন আমরা কালঘরা থেকে নবীনগর ফিরে আসি, তখন একটি ঘটনা ঘটে। আমরা কালঘরা থেকে রওনা হয়ে শ্রীরামপুর গ্রাম পার হয়ে গোপালপুর গ্রামের দিকে আসি। গোপালপুর গ্রামের প্রবেশপথে তখন একটি বিরাট বটগাছ ছিল। এই বটগাছের নিচে যখন আসি, তখন বাবা জ্বর অনুভব করেন। আমরা তাই বটগাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিই। তখন গোপালপুর গ্রামের নবীনগর স্কুলের ছাত্ররা স্কুলে যাচ্ছিল। তারা আমাকে তাদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার জন্য ডাকল। আমি ভাবছিলাম যে বাবার জ্বর হয়তো বেশি নয়, তাই আমি তাদের সঙ্গে স্কুলের দিকে চলে যাই। এদিকে জসিম তখন বাবাকে নিয়ে একলা। বাবার জ্বর বেড়ে যাওয়াতে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বাবাকে রেখে সে লোক ডাকতে যেতে পারছিল না। তার ভয় হচ্ছিল অসুস্থ বাবাকে শিয়াল আক্রমণ করতে পারে। তাই অনেক কষ্টে বাবাকে নিয়ে নবীনগর ফিরে আসে। আমি বাসায় আসার পর সে বাবাকে ফেলে স্কুলে যাওয়ার জন্য আমার সমালোচনা করে। এটি অবশ্য সে বাহবা নেওয়ার জন্য করেনি। জসিমের প্রকৃতিই ছিল এই রকম। কেউ বিপদে পড়লে তাকে রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমার মনে আছে একবার একটি ছেলে আমাকে গাল দিয়েছিল। আমি ছেলেটির সঙ্গে ঝগড়া না করে চলে আসি। জসিম যখন এ খবর শোনে, তখন সে আমাকে বলে যে তুমি আমাকে বলোনি কেন? আমি তাকে পিটিয়ে দিতাম। সে ছিল ডানপিটে এবং বহির্মুখী। আমি ছিলাম শান্ত ও অন্তর্মুখী।

১৯৫৪ সালে যে বন্যা আসে, সেটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। প্রথমত, এমন প্রবল বন্যা গত ১০০ বছরে হয়নি। পানিতে শুধু রাস্তাঘাট ডোবেনি, ঘরবাড়িও তলিয়ে যায়। আমাদের প্রতিটি ঘরে পানি ওঠে। এর আগে বর্ষাকালে বড়জোর উঠানে পানি উঠত, কিন্তু ঘরের মধ্যে পানি উঠত না। বন্যার সময়ে আমরা চৌকির ওপরে ঘুমাতাম, কিন্তু চৌকির নিচে বন্যার পানি প্রবাহিত হতো। একঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার জন্য বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়। রান্নাবান্নাও সব চৌকিতে বসে করতে হতো। বন্যা প্রায় আড়াই মাস ধরে ছিল। আমরা ভাবলাম যে উঠানের পানিতে আমরা সাঁতার কাটা শিখব। কিন্তু কয়েক দিন সাঁতার শেখার চেষ্টা করার পরই আমার ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়া হয়। কুইনাইন ইনজেকশন নিতে হয় এবং অনেক দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। এর ফলে ১৯৫৪ সালের বন্যায় সাঁতার শেখা হয়নি। ১৯৫৫ সালে আবার বন্যার পুনরাবৃত্তি দেখা দেয়। আমি ভাবলাম এ বছর সাঁতার শিখব। কিন্তু কয়েক দিন চেষ্টা করতে না করতেই আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলাম। তাই আর সাঁতার শেখা হয়নি। এরপর ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েডের ভয়ে আমি আর সাঁতার শেখার চেষ্টা করিনি। তাই আমি এখনো সাঁতার কাটতে পারি না।

পরপর দুই বছর বন্যা হওয়াতে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১৯৫৫ সালে খাদ্যাভাব বিশেষভাবে প্রকট হয়। এই সমস্যায় শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, এ সমস্যা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও আক্রান্ত করে। আমার মনে আছে, ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে আমাদের চালের মজুত শেষ হয়ে যায়। চাল কেনার জন্য গ্রামে টাকা পাঠানো হয়েছিল কিন্তু চাল তখনো আসেনি। আমাদের বাড়িতে তখন খুদ ছাড়া কোনো চাল ছিল না। দুই দিন আমরা খুদ খেয়ে ছিলাম। আমার বাবা-মা চালের অভাবে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। পরে গ্রাম থেকে চাল আসায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই সময়টাতেই দারিদ্র্যের সমস্যা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছি।