পাঠ্যক্রমবহির্ভূত প্রশিক্ষণ

আমাদের স্কুলে একটি বিরাট খেলার মাঠ ছিল। সেখানে নিয়মিত ফুটবল খেলা হতো। আমি স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলিনি। তবে ছোট মাঠে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম। বাসায় শীতকালে ভাইবোনেরা মিলে ব্যাটমিন্টন খেলতাম। কিন্তু খেলায় আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।

লেখাপড়া ছাড়া আমি বিতর্কে অংশ নিতাম এবং আবৃত্তি করতাম। যত দূর মনে পড়ে সুধীন্দ্র বাবু এবং জহিরুল ইসলাম–এই দুজন শিক্ষকের প্রচেষ্টায় নবীনগর স্কুলে বিতর্ক সভা গড়ে ওঠে। এই বিতর্ক সভায় আমি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতাম। আমার ক্লাসের আবদুর রহমান খান, মোজাম্মেল হকসহ আরও কয়েকজন এবং আমাদের এক বছরের সিনিয়র শরিফুল ইসলাম (যিনি বাংলাদেশ কলেজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন) বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সেসব বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো। একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা হয়েছিল সুয়েজের যুদ্ধ নিয়ে। আরেকটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা হয়েছিল বিজ্ঞান কি আমাদের জীবনে আশীর্বাদ, না অভিশাপ? বিজ্ঞানের বিপক্ষে বলতে গিয়ে আমি যাযাবরের দৃষ্টিপাত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলি, ‘বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ এই উদ্ধৃতি শুনে সারা বিতর্ক সভা হাততালি দিয়ে আমাকে উৎসাহ জোগায়। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমি চ্যাম্পিয়ন হতাম।

বিতর্ক ছাড়াও আমি নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করতাম। প্রথমে বাংলা কবিতা আবৃত্তি করতাম কিন্তু ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করার সাহস হতো না। আমি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র, তখন স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমাকে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করতে স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আদেশ দেওয়া হয়। এই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও শোয়েব সুলতান খান। তিনি বাংলা জানতেন না। তাই ইংরেজি কবিতা আবৃত্তিরও ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রতিযোগিতায় আমাকে সাহায্য করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় চান মিয়া (ভালো নাম মনে করতে পারছি না) নামের স্কুলের একজন ইংরেজি শিক্ষককে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির এবং ছাত্রদের বেত মারতে দ্বিধা করতেন না। তিনি আমাকে আবৃত্তির জন্য বেছে দেন Thomas Gray-এর লেখা Elegy Written in a Country Churchyard’ শীর্ষক কবিতাটি। কবিতাটি অনেক বড় ছিল, তাই পুরো কবিতাটি আমার পড়তে হয়নি। যতটুকু মনে পড়ে কবিতাটির নিম্নলিখিত চরণগুলো আমি আবৃত্তি করেছিলাম :

The curfew tolls the knell of parting day,

The lowing herd wind slowly o’er the lea,

The ploughman homeward plods his weary way,

And leaves the world to darkness and to me.

Now fades the glimmering landscape on the sight,

And all the air a solemn stillness holds,

Save where the beetle wheels his droning flight,

And drowsy tinklings lull the distant folds:

Save that from yonder ivy-mantled tow’r

The moping owl does to the moon complain

Of such as, wand’ring near her secret bow’rs,

Molest her ancient solitary reign.

Some village Hampden, that, with dauntless breast,

The little tyrant of his fields withstood,

Some mute inglorious Milton here may rest,

Some Cromwell guiltless of his country’s blood.

Th’applause of list ning senates to command,

The threats of pain and ruin to despise,

To scatter plenty o’er a smiling land,

And read their history in a nation’s eyes,

Their lot forbade: nor circumscrib’d alone

Their growing virtues, but their crimes confined;

Forbade to wade thro’ slaughter to a throne,

And shut the gates of mercy on mankind,

The struggling pangs of conscious truth to hide,

To quench the blushes of ingenuous shame,

Or heap the shrine of luxury and pride

With incense kindled at the Muse’s flame.

The boasts of heraldry, the pomp of power

All that beauty, and all that wealth ever gave

Away a like the inevitable hour

The paths of glory lead but to graves.[১]

কবিতা আবৃত্তি এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতা ছাড়াও স্কুলে অনেক সময় রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর পাকিস্তান একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে নবীনগরে একটি রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এই রচনা প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে, তাকে সোনার মেডেল দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এই সোনার মেডেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তখনকার নবীনগরের মুন্সেফ সাহেব। রচনা প্রতিযোগিতার বিচারকমণ্ডলীর সভাপতিও ছিলেন তিনি। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমি প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। বিচারকদের বিবেচনায় আমার রচনা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। আমাকে একটি মেডেল দেওয়া হয়। এটি পুরোপুরি সোনার ছিল না, তামার ওপরে হালকা সোনার আস্তরণ ছিল।

ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। ১৯৫৭ ৫৮ সালে ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা এনএসএফ নামে একটি ডানপন্থী ছাত্রসংগঠন গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সভাপতি হন আতিকুল ইসলাম ভূঁইয়া (তিনি পরবর্তীকালে হাবিব ব্যাংকে কাজ করতেন এবং উত্তরা ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। তবে অসুস্থতার জন্য তিনি অবসরের নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন)। আতিকুল ইসলাম ভূইয়া নবীনগরে আসেন এবং আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে তাদের সম্মেলনে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমি বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে ওই সম্মেলনে যোগ দিই। এতে বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমি প্রথম স্থান অধিকার করি। আমার বক্তৃতা শুনে এনএসএফের সভাপতি ইব্রাহিম তাহা এবং সম্পাদক এ আর ইউসুফ খুবই সন্তুষ্ট হন এবং আমাকে কয়েকটি বিশেষ পুরস্কার প্রদান করেন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. Wolpert, Stanley. Jinnah of Pakistan 1994. New York: Oxford University Press