আমাদের বাসস্থান

নবীনগরে যে বাড়িতে আমরা বাস করতাম এবং এখনো করি, সে বাড়িটি ছিল আদিতে নবীনগর আদালতের প্রথম মুসলমান আইনজ্ঞ আবদুস সোবহান ওরফে আব্দু মিয়ার বাসস্থান। তিনি থানার পাশে একটি বিরাট এলাকা কিনে। নেন এবং সেখানে তার বাসস্থান নির্মাণ করেন। তাঁর বাসস্থানের পাশে তার মুহুরিকেও একটি ঘর তৈরি করে দেন। ১৯২০-এর দশকে তিনি অবসর গ্রহণ করলে নবীনগর আদালতে একমাত্র মুসলমান উকিল হিসেবে যোগ দেন আমার বাবার বড় ভাই ফজলে আলী খাঁ। আব্দু মিয়া অবসর গ্রহণ করলে এই বাড়িটি তিনি তাঁর একমাত্র ভাগনে কালঘরা গ্রামের ফজলে আলীকে দান করেন। ফজলে আলী ছিলেন আমাদের ফুফা। ফজলে আলী খাঁ তার ভগ্নিপতি ফজলে আলীর কাছ থেকে বাড়িটি ভাড়া নেন। ত্রিশের দশকে ফজলে আলী খাঁ মারা গেলে তার জায়গায় ওকালতি করতে আসেন আমার বাবা আমীর আলী খাঁ। তিনিও ভাড়াতেই ওই বাড়িতে থাকেন। পরবর্তীকালে ফজলে আলী তার বড় মেয়ের জামাই প্রকৌশলী জিন্নত আলীকে বাড়িটি দান করেন। জিন্নত আলীর কাছ থেকে ১৯৬০-এর দশকে আমার মা এবং আমার বড় বোন সালমা খান। জায়গাটি কিনে নেন। সেই সময় থেকে এই জমির মালিক আমাদের পরিবার। অবশ্য যে অংশটুকু আব্দু মিয়া তাঁর মুহুরিকে দিয়েছিলেন, সে অংশটুকুর মালিকানা তিনি তাঁকে লিখে দেন। ওই অংশটুকু তাই এখন স্বতন্ত্র। নবীনগরের বাড়িটির দক্ষিণ দিকে ছিল নবীনগর থানা। এর পূর্ব দিকে ছিল সাবরেজিস্ট্রারের অফিস এবং বাসা। পশ্চিম দিকে ছিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল পরিচালিত দাঁতব্য চিকিৎসালয়। উত্তর দিকে ছিল তহশিল অফিস। বাড়িটির উত্তর-পশ্চিম দিকে নিচু জলাভূমি ছিল এবং সেখানে বাঁশ ও বেতের জঙ্গল ছিল। এই নিচু জলাভূমির পাশে পাকা পায়খানা ছিল। বাড়িটিতে একটি ছোট পুকুর ছিল। পুকুরটি যদিও ছোট ছিল কিন্তু পুকুরটিতে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যেত। পুকুরটির উত্তর পাড়ে একটি বিশাল বকুলগাছ ছিল। এই বকুলগাছ কে এবং কখন বপন করেছিল, তা জানা যায় না। তবে আমরা যখন ছোট, তখন সবাই বলত গাছটি কমপক্ষে ১০০ বছরের পুরোনো। এই বিশাল গাছটি ছিল এলাকার পাখিদের অভয়ারণ্য। বিশেষ করে শীতকালে অজস্র পাখি এই গাছে এসে আশ্রয় নিত। পাখিদের কলকাকলিতে আমাদের বাড়ি মুখর হয়ে উঠত। এ গাছে প্রচুর বকুল ফুল ফুটত। জঙ্গলের পাশে অবস্থিত থাকায় এবং সেখানে সাপ থাকায় ভয়ে আমরা সাধারণত ফুল কুড়াতে যেতাম না। তবে হিন্দু ছেলেরা প্রায় প্রতিদিনই ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যেত এবং লঞ্চঘাটে গিয়ে বকুল ফুলের মালা বিক্রি করত। নবীনগরে তখন কোনো উঁচু দালানকোঠা ছিল না। তাই আমাদের বাড়ির বকুলগাছটি অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। আমরা যখন লঞ্চে করে নবীনগর আসতাম, তখন লঞ্চঘাট থেকে বকুলগাছটি দেখা যেত। বকুলগাছটির আধ্যাত্মিক শক্তি নিয়ে অনেক গুজব ছিল। কেউ কেউ। বকুলগাছের ছাল জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেত। লোকে বিশ্বাস। করত এই বকুলগাছের যে ক্ষতি করবে, সে তার নিজের ক্ষতি করবে। ১৯৫০ এর দশকে কে একবার একটি মরা ডাল কেটে ফেলেছিল, এর ফলে নাকি লোকটি মারা যায়। বকুলগাছটি স্বমহিমায় অনেক দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল। আশির দশকে একদিন গাছটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এরপরই গাছটি মারা যায়। এখন আর গাছটির চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পুকুরের পূর্ব পাশে ছিল কদমগাছ। বর্ষাকালে প্রচুর কদম ফুল ফুটত এবং অনেক কদম ফুল পুকুরের পানিতে পড়ত। বাড়ির পূর্ব দিকে সাবরেজিস্ট্রারের অফিসের পাশে একটি রজনীগন্ধাগাছ ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে ফুলের সুবাস পাওয়া যেত। সেখানে নাকি সাপও দেখা যেত। বাহিরবাড়ির মাঝখানে ছিল একটি নিমগাছ। নিমগাছ বাড়ির বায়ু শোধন করত। ছোটবেলায় আমরা এবং আশপাশের লোকজন নিমপাতা খেতাম এবং ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতাম।

আমাদের ছোটবেলায় আমাদের বাড়িটিতে দুটি অংশ ছিল। একটি অংশে আমরা থাকতাম। সেখানে চারটি ঘর ছিল। একটি বড় ঘর। যেখানে ছোটবেলায় আমরা সবাই থাকতাম। দক্ষিণের ভিটায় একটি ঘর ছিল, যেখানে অতিথিরা থাকতেন। একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর আমরাও ওই ঘরে থাকতাম। দক্ষিণের ঘরের দক্ষিণে একটি বড় ঘর ছিল। তাকে আমরা বলতাম বৈঠকখানা। বৈঠকখানায় মক্কেলদের থাকার জন্য দুটি চৌকি ছিল। এ ছাড়া মক্কেলদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য বাবার একটি বড় টেবিল এবং পাঁচ ছয়টি চেয়ার ও টুল ছিল। মুহুরির জন্য একটি আলমারি ছিল। সেখানে মুহুরি তার কাগজপত্র রাখতেন। আরেকটি আলমারি ছিল, যাতে বাবার আইনের বইপত্র রাখা হতো। এ ছাড়া বড় ঘরের পূর্ব পাশে ছিল রান্নাঘর। রান্নাঘরে চুলা ও মিটসেফ ছাড়াও একটি চৌকি ছিল। আমরা ছোটবেলায় চৌকিতে বসে খেতাম। বাড়িতে তখন খাওয়ার জন্য চেয়ার-টেবিল চালু হয়নি। ১৯৬৫ সালে। রসুল্লাবাদে আমাদের পৈতৃক ভিটায় যে ঘর ত্রিশ বছর ধরে শূন্য অবস্থায় পড়ে ছিল, সেই ঘরটিকে এনে নবীনগরে পাকা ভিটার ওপরে নির্মাণ করা হয়। তখন বড় ঘরে টেবিল-চেয়ারে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আমার মা ১৯৭২ সালে একটি ছোট দালান নির্মাণ করেন। ১৯৭২ সালের পর আমাদের পরিবার দালানেই থাকে এবং ঘরগুলো ভাড়া দেওয়া হয়।

আমাদের বাড়ির দ্বিতীয় অংশে পশ্চিম পাশে একটি ছোট বাড়ি ছিল। সমবায় বিভাগ যত দিন পর্যন্ত নিজের জায়গা কিনে সমবায় বিভাগের অধিকর্তার জন্য অফিস এবং বাসা নির্মাণ না করে, তত দিন পর্যন্ত এ বাড়িটিতে সমবায় বিভাগের কর্মকর্তা ভাড়া থাকতেন। এ বাড়িতে তিন-চার বছর বাস করেছেন আবদুল আউয়াল, তিনি সাংসদ আলী আহমদ খানের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তারপর এখানে চার-পাঁচ বছর ছিলেন সমবায় বিভাগের আরেক অধিকর্তা–আফসার উদ্দিন সাহেব। পরবর্তীকালে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে থাকতেন। আফসার উদ্দিন সাহেব চলে যাওয়ার পর সমবায় বিভাগের নিজস্ব জায়গায় অধিকর্তার জন্য বাড়ি তৈরি করা হয়। তাই সমবায় বিভাগের কোনো কর্মকর্তা এখানে আর ভাড়া নেননি। বছর দুয়েক এ বাড়িটি আমার খালা ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর দুই ছেলে ও ছোট মেয়েরা এ বাড়িতে থাকতেন। পরে তারাও কণিকাড়ায় চলে যান এবং সে ভিটার ঘর বিক্রি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে বাড়ির এ অংশে তরিতরকারি চাষ করা হতো।