শৈশবের স্মৃতি

অনেকের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর হয়। এদের শিশুকালের স্মৃতি স্পষ্টভাবে মনে থাকে। তবে অনেকে এ ধরনের স্মৃতি মনে রাখতে পারে না। সাত বছর বয়সের আগে আমার কোনো স্পষ্ট স্মৃতি মনে নেই। আমার যখন তিন বছর বয়স, তখন পাকিস্তানের জন্ম হয়। এ ঘটনার কোনো স্মৃতি আমার নেই। আমার বড় বোন মীনা বুজি আমার যখন চার বছর বয়স, তখন মারা যান। তাঁর স্মৃতিও আমার মনে অস্পষ্ট। আমার যখন ছয় থেকে সাড়ে ছয় বছর বয়স, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। আমার মা-বাবা আমাকে ছোটকাল থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতে উৎসাহিত করতেন। সেই সময় স্কুলে প্রতিবছরই বছরের শেষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো এবং সেই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় যারা প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করত, তাদের পুরস্কার দেওয়া হতো। আমি যখন প্রথম শ্রেণিতে পড়ি, তখন কাজী নজরুল ইসলামের ‘খুকী ও কাঠবেরালি’ কবিতাটি আবৃত্তি করি। আমার মা আমাকে অনেক কষ্ট করে কবিতাটি মুখস্থ করান। আমি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করলাম :

কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?

গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?

বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও—

ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,

খাও একা পাও যেথায় যেটুক!

বাতাবি-নেবু সকলগুলো

একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!

তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?

ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!

কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল?

দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!

পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!

তাই তো তোর নাকটি বোঁচা!

হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস

একলাই খাও হাপুস হুপুস!

পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!

হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!

ইস! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!

আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!

কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি’ হবে? বৌদি হবে? হুঁ!

রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!

এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?

ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?

আর খেয়ো না পেয়ার তবে,

বাতাবি-নেবুও ছাড়তে হবে!

দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট? অ’মা দেখে যাও!-

কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!

একটি ছোট ছেলের এত শক্ত কবিতা আবৃত্তি শুনে বিচারকেরা খুবই সন্তুষ্ট হন এবং সারা স্কুলের যেসব আবৃত্তিকার ছিল, তাদের মধ্যে আমাকে প্রথম পুরস্কার দেওয়া হয়। আমি তো মহাখুশি হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। কয় দিন পরে দেখলাম যে এ পুরস্কারের শুধু আনন্দই নেই, এ পুরস্কারের সাজাও আছে। আমাকে দেখলেই আমার ক্লাসের এবং দু-তিন ক্লাসের ওপরের ছাত্ররা কাঠবিড়ালি বলে ডাকত। এ ডাকনাম ঘুচতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে নবীনগর স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে পড়ানো হতো। প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নবীনগর উচ্চবিদ্যালয়ের অংশ ছিল না। তবে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছাত্ররা যাতে পড়তে পারে, তার জন্য নবীনগর স্কুলে একটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্কুলের দালানের পেছনে একটি বড় টিনের ঘর করা হয়। এই টিনের ঘরে দক্ষিণা বাবু নামে একজন শিক্ষক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রদের পড়াতেন। দক্ষিণা বাবুর চেহারা মনে নেই, তবে স্কুলের ঘরটি অনেক বড় ছিল–এ কথা স্পষ্ট মনে আছে।

সাত বছর থেকে দশ বছর পর্যন্ত নবীনগর স্কুলে আমাকে বাংলা এবং অঙ্ক পড়াতেন গুরুচরণ রায়। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ক্লাসে তাঁর কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে তিনি ছাত্রদের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করতেন। যেসব ছাত্র তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারত, তাদের খুশি হয়ে বলতেন, ‘তুই এক চান্সে ম্যাট্রিক পাস করবি’ আর যাদেরকে কান ধরতে আদেশ করতেন, তাদেরকে বলতেন, ‘গরু, তুই কোনো দিনই ম্যাট্রিক পাস করতে পারবি না।’

তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি এই তিন বছর গুরুচরণ বাবু ছিলেন আমার গৃহশিক্ষক। সন্ধ্যায় তিনি আমাকে পড়াতে আসতেন। আমার সঙ্গে আমাদের পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সনাতন সাহার ছেলে ব্রজকিশোর সাহাও পড়ত (ঝড়ের দিনে জন্ম হওয়াতে ওর ডাকনাম ছিল তুফাইন্যা)। আমরা হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতাম না। ওর বাবাও হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রভেদ করতেন না কিন্তু তুফাইন্যা ভিন্নমত পোষণ করত। শীতকালে যখন তুফাইন্যা আমাদের বাড়িতে পড়তে আসত, তখন তার গায়ে ভালো শীতের কাপড় থাকত না। একদিন খুব ঠান্ডা পড়াতে সে পড়ার সময় শীতে কাঁপছিল। আমি তাকে আমার চাদর এনে পরতে দিই। সে কোনোমতেই সেই চাদর গায়ে দিতে রাজি হয়নি। প্রশ্ন করাতে সে বলে এই চাদরের গায়ে ‘শেইখ্যা শেইখ্যা অর্থাৎ ‘শেখ অথবা মুসলমানের গন্ধ করে। কয়েকবার ফেল করার পর তুফাইন্যা প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে। এরপর সে কলকাতায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে ঠিকাদারির ব্যবসা করে এবং ভারতে বিয়ে করে। সম্প্রতি সে কলকাতায় মারা গেছে।

গুরুচরণ বাবু শুধু কড়া শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি অত্যন্ত স্নেহশীলও ছিলেন। বিভিন্ন পূজা-পার্বণে তাঁর বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রণ থাকত। সেখানে মিষ্টি, দই, দুধ, চিড়া, খই, মুড়ি ইত্যাদি খাওয়ানো হতো। গুরুচরণ বাবুর ছেলেরা ভারত বিভাগের আগেই কলকাতার দিকে বসতি স্থাপন করেন। গুরুচরণ বাবু অবসর গ্রহণের পর তাঁর বড় ছেলের কাছে চলে যান। তার বড় ছেলে কলকাতার নিকটস্থ রিষরাতে একটি পাটকলে ম্যানেজারের কাজ করতেন। সেই ছেলের বাড়িতেই তিনি মারা যান।

১৯৫১ সালে পাকিস্তানে একটি বড় রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের তত্ত্বালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁন আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। সেই সংবাদ লিয়াকত আলী খাঁনের বড় ছবিসহ আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয়। এই ছবির নিচে লেখা হয় ‘খুদা পাকিস্তানকি হেফাজত করো’। ছবিটি আমার খুবই ভালো লেগেছিল। তাই কাগজের পৃষ্ঠাটি আমার শোবার ঘরে বেড়ার ওপর আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখি। চার-পাঁচ বছর এই ছবিটি অটুট ছিল।