নবীনগর স্কুলের স্মৃতি

নবীনগর স্কুলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ১৯৪৮ সাল থেকে। আমার বয়স তখন সাড়ে তিন বছর। নবীনগর স্কুলে তখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল না। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রদের সুবিধার্থে স্কুলের পাকা দালানের উত্তর দিকে একটি বড় টিনের ঘরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস হতো।

নবীনগর স্কুলে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি ভর্তি হই ১৯৫০ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে। ওই ক্লাসে আমার সহপাঠী ছিলেন আলমনগর গ্রামের মোজাম্মেল হক এবং আবদুল জব্বার, গাছমোরা গ্রামের আবুল কাশেম, নবীপুরা গ্রামের আবদুল রাজ্জাক প্রমুখ। আমার ক্লাসে গৌরাঙ্গ নামে একজন তুখোড় হিন্দু ছাত্র ছিল। তার পিতা দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করতেন। বছর দুই পরে গৌরাঙ্গ নবীনগর স্কুল থেকে পিতার কর্মস্থলে চলে যায়। পরে সে ভারত থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফল করে উত্তীর্ণ হয়। তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণিতে কোনো বিষয়ে আমি প্রথম হলে, অন্য বিষয়ে গৌরাঙ্গ প্রথম হতো।

অনানুষ্ঠানিকভাবে নবীনগর স্কুলে তখন দুটি শাখা ছিল। প্রথম শাখা ছিল নিম্নমাধ্যমিক এবং দ্বিতীয় শাখা ছিল উচ্চমাধ্যমিক। উভয় শাখায় হিন্দু শিক্ষকদের প্রাধান্য ছিল। তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের বাংলা এবং অঙ্ক পড়াতেন গুরুচরণ রায়। নিচের দিকে মুসলমান শিক্ষক ছিলেন করিম স্যার ও কাজী সাহেব। করিম স্যার ছিলেন স্কাউটের শিক্ষক। স্কুলের ছাত্রদের তিনি সপ্তাহে এক দিন ড্রিল করাতেন। কাজী সাহেব ভূগোলে আগ্রহী ছিলেন এবং আমাদের ভূগোল পড়াতেন। স্কুলের হেড মৌলভি আমাদের আরবি পড়াতেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর স্কুলগুলোতে উর্দু পড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। আমাদের স্কুলে রাজ্জাক স্যার ছিলেন উর্দুর শিক্ষক।

উচ্চমাধ্যমিকে ইংরেজি পড়াতেন নিবারণ বাবু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পরীক্ষায় তিনি ইংরেজিতে ডিস্টিংশন পেয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের বিপ্লবী নেতাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বিপ্লবী অতীনভদ্র কুমিল্লা থেকে প্রায়ই তাঁর বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। অতীনভদ্র একবার আমাদের ইংরেজির খাতা দেখেছিলেন। খাতা দেখে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের আরেকজন শিক্ষক ছিলেন প্রমথনাথ বর্ধন। তিনি বাংলা এবং ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। তিনি ছিলেন নাট্যকার। নিজে তিনি নাটক লিখতেন, অভিনয় এবং পরিচালনাও করতেন। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন তিনি দু-তিনবার স্কুলের নাটক পরিচালনা করেছিলেন।

সুরেশ বাবু ছিলেন হেড পণ্ডিত। তিনি সংস্কৃত এবং বাংলা পড়াতেন। বাংলার শিক্ষক ছিলেন সুধীন্দ্র বাবু। সুধীন্দ্র বাবুর পিতা একসময় নবীনগর স্কুলের হেড পণ্ডিত ছিলেন। তিনি তাঁর ছেলেকে প্রথমে সংস্কৃত টোলে পড়াশোনা করান। তিনি যখন টোলে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পান, তখন তাঁর পিতা চাকরি থেকে অবসর নেন। তার পিতার শূন্য পদে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তিনি প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়েই আইএ পাস করেন। আইএ পরীক্ষার কয়েক বছর পর তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বিএ পাস করেন। আমরা যখন তাঁর ছাত্র, তখন তিনি বিএ পড়ছিলেন। আমরা প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করার পর তিনি বিএ পাস করেন। এরপর তিনি এমএ পড়েন এবং বহিরাগত প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। এর কয়েক বছর পর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তিনি ভারতে অভিবাসন করেন এবং ত্রিপুরা রাজ্যের শিক্ষা বিভাগে স্কুল পরিদর্শনের কাজে যোগ দেন। সুধীন্দ্র বাবু একজন অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। একদিকে বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে ছাত্রদের যা জানা উচিত, তা তিনি খুবই যত্ন নিয়ে পড়াতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। কাজেই সাহিত্যপাঠের আনন্দ তার ক্লাসে আমরা সবাই পেতাম। নবীনগর স্কুলে আমার মতে সুধীন্দ্র বাবুই ছিলেন সবচেয়ে সেরা শিক্ষক। নিচের ক্লাসে বাংলা ও ইংরেজি পড়াতেন ধীরেন্দ্র বাবু নামে আরেকজন শিক্ষক। আমাদের স্কুলজীবনের শেষের দিকে একজন মুসলমান শিক্ষক যোগ দেন। তাঁর নাম ছিল জহিরুল ইসলাম। তিনি ইংরেজি ভাষার একজন ভালো শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু স্কুলে পাঁচ-ছয় বছর চাকরি করার পর তার যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে। তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দেন এবং কিছুদিনের মধ্যে মারা যান।

উচ্চ ইংরেজি স্কুলে অঙ্ক এবং বিজ্ঞান পড়াতেন দুজন হিন্দু শিক্ষক। একজনের নাম ছিল নগেন্দ্রনাথ। তিনি বিএসসি পাস করেছিলেন। আরেকজনের নাম ছিল সুরেন্দ্রনাথ। সুরেন্দ্র বাবু বিএ পাস করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ অঙ্ক পড়াতেন। তিনি নবম এবং দশম শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক অঙ্ক পড়াতেন এবং নবম ও দশম শ্রেণিতে অতিরিক্ত অঙ্ক পড়াতেন। অবিনাশ বাবু ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক। আমি তার অতি প্রিয় ছাত্র ছিলাম। নবম এবং দশম শ্রেণিতে সব ইতিহাসের প্রতিটি পরীক্ষায় আমি সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছি। তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন যে, ইতিহাস ভালো করে পড়ো, ইতিহাসে তোমার লেটার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

আমি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হওয়ার সময় নবীনগর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী এমএ, বিটি। তিনি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত নবীনগর স্কুলে প্রধান শিক্ষকের কাজ করেছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হওয়ার কারণে তিনি বাজিতপুর উপজেলায় কুলিয়ারচর স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে চলে যান। তার স্থানে আসেন জনাব কেরামত আলী বিএ, বিটি। তিনি বরিশালের একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল নবীনগর থানার কালঘরায়। তাই তিনি এ পদে আগ্রহের সঙ্গে যোগ দেন। স্কুলে যোগ দেওয়ার। পর কিছুদিন তাকে ছাত্রদের হোস্টেলে থাকতে হয়। সে সময়ে দু-একজন ছাত্রনেতার সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। এর ফলে স্কুলে ছাত্র আন্দোলন হয়। এই আন্দোলনের ফলে তাকে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এরপর নবীনগর স্কুলে আসেন প্রধান শিক্ষক হয়ে আবদুল হালিম এমএ, বিটি নামে একজন প্রধান শিক্ষক। তিনিও বেশি দিন টিকতে পারেননি। তাঁকেও নবীনগর স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হয়। স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে সৈয়দ আহমদ নামে একজন শিক্ষক আসেন। তাঁর ডিগ্রি ছিল বিএ, বিটি। তিনি আমেরিকানদের অনুকরণে ইংরেজি বলার চেষ্টা করতেন। এ নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ নিয়ে অনেক দিন দলাদলি চলছিল।

১৯৫৫ সালে আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন রায়পুরা থানার বাঁশগাড়ি গ্রামের আবদুর রহমান খান নামের একজন ছাত্র নবীনগর স্কুলে ভর্তি হয়। পরবর্তী চার বছর প্রথম স্থান নিয়ে আমাদের মধ্যে লড়াই হতো। এক বছর আমরা দুজনই একসঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। আবদুর রহমান খান অঙ্কে খুবই ভালো ছিল। অঙ্কের শিক্ষক সুরেন্দ্র বাবু আশা করেছিলেন যে আবদুর রহমান খান বাধ্যতামূলক অঙ্ক এবং অতিরিক্ত অঙ্ক উভয়টিতেই লেটার মার্ক বা ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পাবে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় সে অবশ্য পাঠ্য অঙ্কে লেটার ঠিকই পেয়েছিল কিন্তু অতিরিক্ত অঙ্কে মাত্র ৪৩ নম্বর পায়। অঙ্ক ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আমি সাধারণত বেশি নম্বর পেতাম। অঙ্কে আমার কোনো বিতৃষ্ণা ছিল না, অঙ্কশাস্ত্রে যুক্তির প্রয়োগ আমার খুবই ভালো লাগত। তবে যেহেতু অল্প বয়স ছিল, সেহেতু খুবই ছটফটে ছিলাম এবং অতি সাধারণ যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের অঙ্কে ভুল করে বসতাম। আমার মনে আছে যে ক্লাস নাইনে ষান্মাসিক পরীক্ষায় অঙ্কে মাত্র ৪২ নম্বর পেয়েছিলাম। খাতাটি দেখিয়ে অঙ্কের শিক্ষক সুরেন্দ্র বাবু বলেছিলেন, ৪২ নম্বর পেলেও এ খাতাটি সবচেয়ে ভালো হয়েছে। খাতাটি পড়লেই বোঝা যায় যে ছাত্রটি যুক্তি প্রয়োগ করে অঙ্কের সমাধান করেছে। কিন্তু ছোটখাটো যোগ, বিয়োগ ইত্যাদিতে সে এত অমনোযোগী যে তাকে বেশি নম্বর দেওয়া সম্ভব হয়নি।