» » কালো জিন এবং শাদা জিন বৃত্তান্ত

বর্ণাকার

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

অলীক মানুষ

কালো জিন এবং শাদা জিন বৃত্তান্ত

দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামি শফিউজ্জামানের একজন কালো আর একজন শাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিল। এদেশের গ্রামাঞ্চলে শিশুরা চারদিকে অসংখ্য কালো মানুষ দেখতে-দেখতে বড় হয় এবং নিজেরাও কালো হতে থাকে। কিন্তু শাদা মানুষ, যার লোম ভুরু ও চুলও প্রচণ্ড শাদা, ভীষণ চমকে দেয়।

এর আগে শফিউজ্জামান ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ ঘোষিত হন। একবার তাঁকে সাত বছরের জন্য জেলা থেকে নির্বাসিত করা হয়। ইংরেজের আইন একেক সময়ে ভারি অদ্ভুত চেহারা নিত।

কিন্তু শফিউজ্জামান ছিলেন আরও অদ্ভুত। কারণ তাঁর পিতা ছিলেন মুসলিমদের ধর্মগুরু। শিষ্যরা তাঁকে বুজুর্গপির বলে মনে করত, যদিও পিরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনিই জেহাদ করে বেড়াতেন মুলুকে-মুলুকে। তাঁর পুরো নামটি প্রকাণ্ড। সৈয়দ আবুল কাশেম মুহম্মদ বদি-উজ-জামান আল হুসায়নি আল-খুরাসানি।

বদিউজ্জামান ছিলেন যেমন অমায়িক, মিষ্টভাষী আর ভাবপ্রবণ, তেমনি খামখেয়ালি, জেদি আর হঠকারী। বারবার ঠাঁইনাড়া হওয়া ছিল স্বভাব। শফিউজ্জামানের জন্ম কাঁটালিয়া নামক পদ্মাতীরবর্তী এক গ্রামে। যখন তাঁর তিন বছর বয়স, তখন বদিউজ্জামান গেরস্থালি তুলে নিয়ে পোখরায় যান। শফির পাঁচ বছর বয়সে পোখরা থেকে বিনুটি-গোবিন্দপুর, দশ বছর বয়সে নবাবগঞ্জ, বারো বছর বয়সে কুতুবপুর, ষোলতে খয়রাডাঙ্গা, আর পরের বছরই মৌলাহাট। শফির জন্মের আগেও এরকম ঘটেছে। তার মা সাইদ-উন-নিসা, সংক্ষেপে সাইদা, সেইসব ঘটনা শফিকে হয়তো অনেকটা রঙ চড়িয়েই শোনাতেন। প্রথম স্টিমার দেখা ও ইলিশ খাওয়া আর প্রথম জঙ্গলের বাঘের মুখোমুখি হওয়ার রোমহর্ষক গল্প। একবার গোরুর গাড়িতে টাপরের পেছনকার পরদা তুলে হাত বাড়াচ্ছেন আর হাতে কচি আম ঠেকছে, এত আমের গাছ রাস্তার দুদিক থেকে ঝুঁকে এসেছে টাপরের ওপর। সেই আম খেতে খেতে শেষে পেটে নাড়ি কচলানো ব্যথা। বুজুর্গ স্বামীর দোওয়া পড়ে ফুঁ দেওয়া জল খেয়েই শেষে সেরে গেল। সারবে না কেন? মৌলানার সঙ্গে আসমান থেকে জিনেরা নিশুতি রাতে দলিজঘরে দেখা করতে আসত। জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়ত শাদা রোশনি। জিনেদের কণ্ঠস্বর ছিল গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো অর্থাৎ ধাতব ও সঙ্গীতময়। তাদের ভাষা সাইদা বুঝতেন না। তাঁর শাশুড়ি মাঝরাত্তিরে বউবিবিকে জাগিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতেন, জিনের সঙ্গে বদুর বাত করা শুনতে চেয়েছিলে। ওই শোনো! সাইদা তখনও নাকি বালিকা। তাঁর স্বামীর বয়স তাঁর বয়সের আড়াইগুণ প্রায়। সাইদা বলতেন, আমাকে একবার জিন দেখাবেন বলায় উনি রাগ করে এক হপ্তা ‘ইত্তেকাফ’ নিয়েছিলেন।

‘ইত্তেকাফ’ শফি দেখেছেন। ব্যাপারটা আসলে নির্জনে মৌনীভাবে ঈশ্বরচিন্তা। কিন্তু বদিউজ্জামান তো পাহাড় বা অরণ্য এলাকার বাসিন্দা ছিলেন না যে পাহাড়ের গুহায় বা জনহীন জঙ্গলের ভেতর কুটির করে এক সপ্তাহের খাদ্য ও পানীয় নিয়ে ঈশ্বরচিন্তায় বসবেন। তিনি যেতেন মসজিদে। সব মসজিদই এদেশে পূর্বদুয়ারি। দক্ষিণপূর্ব কোনায় মশারি খাঁটিয়ে ঢুকে পড়তেন। মুসল্লি শিষ্যরা ওই কয়েকটি দিন যতটা সম্ভব নিঃশব্দে নমাজ পড়ে যেত। নৈলে মসজিদ তো নমাজান্তে সামাজিক আলোচনার মজলিশ, কখনও বিচারসভাও। সেকারণে হই-হট্টগোলও চূড়ান্ত রকমের হয়ে থাকে। হুজুর ‘ইত্তেকাফ’-ব্রত নিলে তারা তাঁকে বরং সাহায্য করত। মসজিদ এলাকায় জোরে কথা বলতে দিত না কাউকে। লোকচক্ষুর অন্তরালে একটি কালো মশারির ভেতর আব্বা হারিয়ে গেলে বালক শফি খুব অবাক হয়ে যেত। তার বড়ভাই নুরুজ্জামান সুদূর দেওবন্দ মাদ্রাসায় তালেব-উল-আলিম – শিক্ষার্থী। মেজভাই মনিরুজ্জামান জন্ম-প্রতিবন্ধী। মুখ দিয়ে লালা বেরুত। নড়বড় করে পাছা ঘষটে উঠোন থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে ঘর, শেষে রান্নাশালে গিয়ে মায়ের পিঠে সেঁটে যেত। তাই শফিকেই আব্বার খাবার পৌঁছে দিতে হতো মসজিদে। একে তো মসজিদের ভেতর আবছায়া, তাতে ওই কালো মশারি। খাবার পাশে রেখে শফি চোখদুটো তীক্ষ্ণ করে ভেতরটা দেখতে চাইত। আব্বার সঙ্গে কথা বলা বারণ। বললেও তিনি জবাব দেবেন না। কিন্তু শফির ইচ্ছে করত, মশারিটা একবার খপ করে তুলে দেখেই পালিয়ে যায়।

ভেতরে কী করছেন আব্বা? ওখানে কোনো জিনও ঢুকে পড়েনি তো? কিংবা ভেতরে আব্বা আছেন তো? মূহুর্মূহু এইসব প্রশ্ন জাগত মনে। কখনও অজানা ভয়ে তার গা ছমছম করে উঠত। সেইসব মুহূর্তে তার ইচ্ছে করত, প্রচণ্ড চেঁচামেচি করে উঠবে। অনেক কষ্টে এই ইচ্ছেকে দমন করত শফি। তারপর কোন মুসল্লি এসে পড়লে তাকে দেখে সে ভুরু কুঁচকে জিভ বের করে মাথা নাড়তে নাড়তে তার একটা হাত ভরে টানত এবং বাইরে নিয়ে যেত। ফিসফিসিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করত। শফি বলত, এঁটো থালা নিয়ে যেতে হবে না? সেজন্যেই তো বসে আছি। মুসল্লি বলত, সে ভার আমার। যানদিকিনি আপনি। ঘর যানদিকিনি।

ধর্মগুরুর বাড়ির ছেলে বলে কাচ্চাবাচ্চাদেরও লোকে আপনি-টাপনি করত। কিন্তু শুধুই মুখের ভক্তি নয়। বালক শফি দেখেছে, সারাবছরই কত জায়গার লোক দেখা করতে আসছে হজুরের সঙ্গে। টাকাকড়ি ভেট দিচ্ছে পায়ের কাছে। কেউ আসছে গোরুরগাড়ি বোঝাই খন্দ ফলমূল নিয়ে। দলিজঘরের বারান্দায় জমে উঠছে শস্যের বস্তা। শাক-সবজির স্তূপ। পুকুরের মাছ। মুরগি-মোরগ। আস্ত খাসি। আর কোরবানির পরবে তো দলিজঘরের একপাশে খেজুরতালাই বিছানো থাকত। আর তাতে জমে উঠত মাংসের পাহাড়। সত্যি পাহাড়। শফির চেয়ে উঁচু।

দয়ালু মৌলানা কিন্তু অনেকটাই বিলি করে দিতেন গরিব-গুরবোদের। রোজই ভিখিরির ভিড়, ফকিরফাঁকরার ভিড়, মুসাফির লোকের ভিড় দলিজের সামনের চত্বরে। ওরা সবাই মুসলিম ছিল না। হিন্দুসমাজের নিচুতলার নিরন্নরাও এসে দাঁড়াত। কুনাইপাড়ার একচোখ কানা সরলাবুড়ি, যাকে মায়ের হুকুমে সল্লাপিসি বলতে বাধ্য হয়েছিল শফি, ইদ বা কোরবানির দিন সে খুব ভোরবেলাতেই এসে বসে থাকত ওই চত্বরে। একটা প্রকাণ্ড নিমগাছ ছিল সেখানে। তখনও পাখ-পাখালি ডেকে ওঠেনি। বদিউজ্জামান দলিজঘরেই রাত কাটাতেন। সবে উঠে চাপাগলায় ঈশ্বরের প্রশস্তি উচ্চারণ করছেন। তামাচিনির বৃহৎ বদনা আর ময়ুরমুখো ছড়িটি হাতে নিয়ে মসজিদে ফজরের নমাজে যাবেন বলে দরজা খুলতেই ‘আঁই বাবা!’

ওই ছিল সল্লাকানির সাড়া দেওয়া। এসেছে জানাতে আচমকা বেড়ালের ম্যাও করে চেঁচিয়ে ওঠার মতো ওই দুটি শব্দ। নিঝুম দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সাইদা মেঝেয় বসে সুরে ধরে বাংলা পুঁথি পড়ছেন। শাশুড়ি কামরুন্নিসা চোখ বুজে শুয়ে কান করে শুনছেন। চৌকাঠের কাছে একদঙ্গল পাড়ার মেয়ে জুটেছে। শুনতে শুনতে কেউ ঢুলছে। ভাদুর মা তো বারান্দায় গড়িয়েই পড়ত। ওদিকে ভাদু মাঠ থেকে ফিরে সারা পাড়া মা মা করে গর্জে বেড়াচ্ছে। এদিকে বাদশাহ নমরুদ খাঁটিয়ার শীর্ষে মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে তিনটে শকুনকে লোভ দেখিয়ে আসমানে উঠেছেন, হাতে তীরধনুক, খোদার বুকে তীর মারবেন। আর খোদা মুচকি হেসে ফেরেশতাকে বলছেন, বেচারা নমরুদকে খুশি করো। ওর ছুঁড়ে মারা তীরের ডগায় রক্ত মাখিয়ে ফেরত পাঠাও। তখন ফেরেশতারা রক্ত চেয়ে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে। শেষে মাছ দিল রক্ত। আর খোদা বললেন, হে মাছ, এরপর থেকে মরা অবস্থাতেও তুমি হারাম বলে গণ্য হবে না। সেই সময় আচমকা ‘আঁই মা!’

ভাদুর মা তড়াক করে উঠে বসে চুল বাঁধতে লাগল। সদুর বউয়ের দুলুনি কেটে লালা মুছতে থাকল। বাকি মেয়েরা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। কামরুন্নিসাও ফোকলা দাঁতে হাসতে মুখ তুলে বললেন, কৈ, সরো সরো। দেখি সল্লাকানিকে। সাইদা চাপাগলায় হুঁশিয়ারি দিলেন, চুপ চুপ। গলাবাজি কোরো না তো তোমরা। শুনতে পেয়ে নসিহত (ভর্ৎসনা) করবেন।

বদিউজ্জামান দলিজে। তাই এই হুঁশিয়ারি । শফি মায়ের আঁচল টেনে বলে, আম্মা! বলুন না, তারপর কী হল? তীরে মাছের রক্ত মাখিয়ে কী করল?

সাইদা চোখ পাকিয়ে বলেন, রক্ত না, খুন।

কেন আম্মা?

হিঁদুরা রক্ত বলে।

এসব ঘটনা কুতুবপুরে থাকার সময়। গ্রামটা ছিল বড়ো। হিন্দু-মুসলমান প্রায় সমান-সমান। মাঝখানটাতে নোম্যানস ল্যান্ডের মতো একটা চটান। নিমগাছের জঙ্গল। কী খেয়ালে বদিউজ্জামান কনিষ্ঠ পুত্রকে সেখানে নিসিং পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করিয়েছিলেন। নিমের জঙ্গলের ভেতরে পায়েচলা পথ। চৈত্র মাসে নিমফুল ফুটে মিষ্টি গন্ধে মউমউ করত। গন্ধটা যখনই কোথাও পেয়েছে, শফির নাকে এসে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপটা মেরেছে নিসিং পণ্ডিতের তামাকের গন্ধ। এক গন্ধ আরেক গন্ধের পেছনে ওত পেতে আছে। একটা কালো মানুষের পেছনে যেমন একটা শাদা-মানুষ।

চটানটাকে বলা হত মানকের চটান। মানিক নামে কোনো লোক ছিল হয়তো। মানকের চটান পেরুলেই ছোট্ট ঘরে পাঠশালা। তালপাতার ছোট-ছোট চাটাই যার যার তার-তারটা। সাইদা নিজের হাতে যত্ন করে শফির চাটাই বুনে দিয়েছিলেন। সফি সেই চাটাই ছিঁড়ে চিবুত। তার চেয়েও ধেড়ে পড়ুয়াদের ভিড়ে সে সবসময় সিঁটিয়ে থাকত।

শফির বৃত্তি পরীক্ষার আগেই বদিজ্জামান তল্পি গুটোলেন কুতুবপুর থেকে খয়রাডাঙ্গার মুসলমান জমিদার ইটের বাড়ি দিচ্ছেন হুজুরকে। সেখানে মিনার আর গম্বুজওয়ালা বিশাল মসজিদ। পাশে মাদ্রাসা, সারবন্দি তালেবুল আলিমদের থাকার ঘর। চত্বরে ফোয়ারা। ফুলবাগিচা। দুনিয়ায় যেন বেহেশতের একচিলতে প্রতিবিম্ব।

দেউড়িতে রোজ সন্ধ্যায় নমাজের পর নহবত বাজে। জমিদার আশরাফ খানচৌধুরি হুজুরের কথায় নহবত বন্ধ করে দিয়েছেন। ফরাজিমতে দীক্ষা নিয়েছেন। গান-বাজনা হারাম ঘোষিত হয়েছে। কড়া পরদার হুকুম জারি হয়েছে। খোঁড়াপিরের আস্তানায় হত্যে দেওয়া, মানত, আগরবাতি, পিদিম, কবরে মাথা ঠেকানো, জ্যৈষ্ঠের শেষ রবিবারে বৈকালিক মেলা–সবকিছু বন্ধ। পিরের খাদিম বা সেবক, যার মাথায় জটা ছিল, গেরুয়া কাপড় পরতেন, ঝাড়ফুঁক করতেন, মাদুলি দিতেন, বেগতিক দেখে সদর শহরে পালিয়ে গেছেন। গুজব রটেছিল, বদুমৌলানা একশো লোক নিয়ে থান ভাঙতে আসছেন। সদরে আবুতোরাব উকিলের মেয়ের কাঁধ থেকে হারামজাদা এক জিনকে ধরে জটাধারী খাদিম শিশিতে ভরেন এবং গঙ্গায় ফেলে দেন। কৃতজ্ঞ উকিল আদালতে তাঁর পক্ষ থেকে দরখাস্ত ঠুকেছেন নাকি। তা ঠুকুন। বদুমৌলনা গঙ্গা থেকে শিশিবন্দি জিনটাকে উদ্ধার করবেন। তারপর কী হবে বোঝাই যায়।

এসব কথা শুনতেও পেতেন বদিউজ্জামান। কিন্তু এড়িয়ে থাকতেন। তিনি ফরাজি ধর্মগুরু। পূর্ববাংলার প্রখ্যাত ফরাজি আন্দোলনের প্রবক্তা হাজি শরিয়তুল্লার মুরিদ–শিষ্য। প্রচণ্ড পিউরিটান। হাত দুটো নাভির ওপরে রেখে নমাজ পড়েন। সুরা ফাতেহা আবৃত্তির পর উচ্চকণ্ঠে ‘আমিন’ বলেন। প্রার্থনারীতি ও ধর্মীয় আচরণে অসংখ্য এমন পার্থক্য মেনে চলেন অন্য তিনটি মজহাব বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তবে জিনে তাঁর আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ পবিত্র কোরানে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন, আমি জিন ও ইনসান (মানুষ) সৃষ্টি করেছি। জিন বানানো হয়েছে আগুন থেকে, মানুষকে মাটি থেকে। জিনরা অগ্নিজাতক। তারা আলোর মানুষ। বাস করে সপ্তস্তবক আসমানের কোনও একটি স্তবকে। (আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় অন্য একটি গ্যালাক্সিতে) কাজেই জিন আছে। জিন থাকলে দুনিয়ায় তাদের আনাগোনা ঠেকাবে কে?

নিসিং পণ্ডিতের পাঠশালা ছেড়ে বরং খুশিই হয়েছিল শফি। কথায়-কথায় বেত মারতেন পণ্ডিত। শফি ভীষণ অবাক হয়ে যেত। তাকে পাড়ার দাড়িচুল-পাকা বুড়োরাও আপনি বলে। এমন কি শফি বিশ্বাস করত, তাদের বাড়ির লোকেরা মরবে না। কুতুবপুরে থাকার সময় তার আর একটি ভাই হয়েছিল। একবছর পরে একদিন সে পাঠশালা থেকে ফেরার সময় তার মরে যাওয়া শুনে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল। এ তো অসম্ভব ব্যাপার। বাড়ি ফিরে কান্নাকাটি শুনে সে থ। তারপর প্রায়ই কবরখানায় গিয়ে ছোট্ট কাঁচা কবরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করত সামনের শ্যাওড়াগাছটার দিকে। শেষে রাগেদুঃখে ভ্যা করে কেঁদে ফেলত।

পণ্ডিতের বেতের কথা শফি বাড়িতে চেপে যেত। ভাগ্যিস মুসলমানপাড়ার কোনও ছেলে পাঠশালায় পড়তে যেত না। কিন্তু মুসলমানদের ধর্মশিক্ষা আবশ্যিক। তাই ছোটরা মসজিদে একজন ওস্তাদজির কাছে আরবি পড়তে যেত! ওস্তাদদজিকে নিযুক্ত করা হয়েছিল হুজুরের সুপারিশে। তিনি একদা তাঁর তল্পিবাহক ‘তালেবুল আলিম’ ছিলেন। এদিকে মেয়েরা পড়তে আসত সাইদার কাছে। উঠোনে সারবেঁধে বসে দুলে দুলে তারা পড়ত; আলেফ জবর আ। বে জবর বা। তে জবর তা।

কুতুবপুর থেকে চলে যাওয়ার কথা শুনে শিষ্যদের সে কী হাউহাউ করে কান্না!

এসব সময় বদিউজ্জামানের চিরাচরিত একটি আনুষ্ঠানিক রীতি ছিল। একেবারে শেষ সময়ে মসজিদে নমাজের পর ভাষণ শুরু করতেন; বেরোদানে ইসলাম– ইসলামের ভ্রাতৃবৃন্দ! আল্লাহ পাক আমাকে জিন্দেগি-ভর রাহি মুসাফির করেছেন। যদি বলেন, আপনার দেশ কোথায়? আমার কোনো দেশ নেই ভাইসকল! আমার দেশ সারা দুনিয়া।

এরপর হুজুর গ্রামবাসী মোমিনবৃন্দের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন আবেগ মাখা কণ্ঠস্বরে। প্রতিটি ছোটবড় ঘটনা উল্লেখ করে বুকে হাত রেখে বলতেন, সব আমার দেলে গাঁথা রইল। ভুলি নাই। ভুলব না। তবে আমার আবার সময় হয়েছে, ‘উঠো মুসাফির, কদম বাঢ়াও, আগেসে এক মঞ্জিল হ্যায়।’

শিষ্যবৃন্দ (সমস্বরে) । হুজুর! হজুর! এ কী বলছেন! এ যে আসমান থেকে বাজ এসে পড়ল মাথায়।

(প্রবল কান্নার ধ্বনি)

হুজুর॥ ভ্রাতৃবৃন্দ! আল্লাহ বলেছেন, কিছু চিরস্থায়ী নয়। কেউ কাউকে বেঁধে রাখতে পারে না। তাই আল্লাহ বলেছেন, কোনোকিছুর জন্য শোক হারাম। মৃতের জন্য শোক হারাম। নষ্ট হওয়ার জন্য শোক হারাম। কিছু হারানোর জন্য শোক হারাম। যে তোমার কাছ থেকে চলে যাচ্ছে, তার জন্য শোক হারাম।

(কান্নার ধ্বনির শ্বাসপ্রশ্বাসে রূপান্তর। চতুর্দিকে ফোঁসফোঁস নাক ঝাড়ার আওয়াজ।)

সর্দারশিষ্য (কাঁধের ডোরাকাটা রুমালে চোখ মুছে)॥ হুজুর, এদফা আপনার মঞ্জিল কোথায়?

হুজুর (বিষণ্ণ হেসে)॥ খয়রাডাঙ্গা।

সর্দারশিষ্য (নাক মুছে)॥ জায়গা ভালো। জমিদার মোছলমান। কিন্তু আমরা যে এতিম হয়ে গেলাম হজুর!

হুজুর (চোখ মুছে)॥ আল্লার হাতে আপনাদের রেখে যাচ্ছি। নজর রাখবেন, যেন আউরত লোকেরা বেপর্দা না হন। গানবাজনা যেন না শোনা যায়। মোহররমে আর যেন তাজিয়া জুলুস গ্রামে না ঢোকে। কেউ যেন পিরের থানে মানত দিতে না যায়। কেউ নমাজ কামাই করলে জরিমানা করবেন। দোসরা বার করলে সাত হাত নাক খবদা সাজা দেবেন। তেসরা বার করলে পঁচিশ কোড়া মারবেন। আর তারপর করলে গ্রাম থেকে নিকালে দেবেন শয়তানকে।…

হজুর চলে গেলে সেসব অবশ্য কিছুই করা হত না। কারণ তাতে দলাদলি ও হাঙ্গামার আশঙ্কা ছিল। মেয়েরা আবার বেপরদা হয়ে মাঠে মরদ-ব্যাটাদের নাশতা দিয়ে আসত। শাদি লাগলে ঢোল বাজিয়ে গীত গাইত আগের মতোই। নাচত এবং সঙ দিত। পাশের গায়ের হানাফি মজহাবের জোয়ানরা মোহররমের মিছিল এনে খবর পাঠাত ঢুকবে নাকি এবং অনুমতিও পেত। তবে প্রধান ফরাজিরা দেখে না দেখা বা শুনেও না-শোনার ভান করে আড়ালে গিয়ে বসত। বাংলা পুঁথিগুলো বানান করে-করে সুর ধরে পড়তঃ ‘লাখে লাখে মরে লোক কাতারে কাতার/শুমার করিয়া দেখি পঞ্চাশ হাজার।…’ সেই কবে এসে ইরফান মৌলবি বাংলা মক্তব খুলেছিলেন। তখনই কিছু লোকের যা বাংলা হরফ শেখা, শ্লেটে দাগড়া দাগড়া ‘স্বরে অ, স্বরে আ।’ পাঁচন আর লাঙ্গলের মুঠিধরা হাতে দড়কচা পড়ে গেছে। ধান পুঁতে হাতে পায়ে হাজা।

খয়রাডাঙ্গায় গিয়ে একটা বছর না কাটতেই আবার তল্পি গুটোলেন বদিউজ্জামান। জমিদার সাহেব হুজুরকে দেখে আসন ছেড়ে সালামের জবাব দেননি। সেদিনই সন্ধ্যায় কজন অনুগত শিষ্যকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, এশার নমাজের পর রওনা হবেন সেকেচ্ছা। খানকতক গাড়ি এখনই দরকার।

বদিউজ্জামানের সংসার সবসময় তৈরি থাকত, কখন হুকুম জারি হবে, উঠে পড়ো, গুটিয়ে নাও। কিন্তু খয়রাডাঙ্গা থেকে যেমন করে উঠে পড়তে হয়েছিল, সে যেন একটা শেকড় পড়ানোর ব্যাপার। সেই প্রথম ইটের ঘরে থাকা। প্রথম নিজস্ব একটি ইঁদারা। আর শফির বয়স তখন প্রায় সোল। পৃথিবীর কিছু কিছু কুয়াশা তার চারপাশ থেকে অপসৃত। সেই প্রথম সে বন্ধুতার স্বাদ পেয়েছে যৌনতা বুঝেছে। তার কষ্ট হচ্ছিল খয়রাডাঙ্গা ছেড়ে চলে যেত। এখানকার মেয়েরা তার চোখে পরি হয়ে উঠেছিল।

মৃদু আপত্তি করেছিলেন সাইদা। কিন্তু বদিউজ্জামান অমনি অগ্নিমূর্তি হয়ে বললেন, খামোশ বুড়বক ঔরত!

কামরুন্নিসা তখন চলচ্ছক্তিরহিত। ধরে ওঠাতে হয়। খাইয়ে দিতে হয়। অর্ধাঙ্গে পক্ষাঘাত। শুধু বললেন, কেন বেটা? বদিউজ্জামান জবাব দিলেন না। জোব্বার আস্তিন গুটিয়ে কেতাব গোছাতে থাকলেন। এইসব সময় তাঁবেদার জিনেরা এসে যেত মানুষের চেহারায়। সামান্য সময়ের মধ্যে লটবহর তারা ছাড়া কে গোছাতে পারবে?

অনেক পরে শফি বুঝতে পেরেছিল আব্বার খয়রাডাঙ্গা ছাড়ার কারণ কী। খোঁড়া পিরের প্রতি নবদীক্ষিত ফরাজিদের গোপন ভক্তি থেকে গিয়েছিল। তারা বাইরে ফরাজি হলেও ভেতর-ভেতর হানাফি। তাছাড়া মাদ্রাসার আলেমরা বদিউজ্জামানের একাধিপত্য বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। তার চেয়ে বড় কথা, তাঁরা ফরাজি মত মেনে নেননি। এমন কী ‘বাহাছ’ অর্থাৎ প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধেরও ডাক দিয়েছিলেন। জমিদারসাহেব বিব্রত বোধ করছিলেন। বদিউজ্জামানের বহু ব্যাপারে বাড়াবাড়ি দেখে বিরক্ত হচ্ছিলেন। ভদ্রলোক ছিলেন সঙ্গীতের ভক্ত। বাংলা উপন্যাস ভালবাসতেন। বিকেলে আরামকেদারায় বসে থাকতেন এবং মাদ্রাসা থেকে পালা করে একজন পড়ুয়া এসে তাঁকে উপন্যাস পড়ে শোনাত। এমন কি আলবোলায় তামাক খাওয়া তাঁর আজীবন অভ্যাস, কিন্তু ফরাজি হওয়ার পর ধূমপান হারাম গণ্য। বদিউজ্জামান নাকি তাঁর কাছে গেলে তামাকের গন্ধ পেতেন এবং ধর্মগুরুসুলভ ভৎর্সনা, যাকে বলা হয় ‘নসিহত’, করতেন। লোকের সামনে শাস্ত্রীয় এই ভৎর্সনা সহজ মনে মেনে নিতে পারছিলেন না জমিদারসাহেব।

মাসটা ছিল চৈত্র। আগের বর্ষায় ভাল বৃষ্টি হয়নি। রাস্তাঘাট শুকনো খটখটে। বারো ক্রোশ দূরে সেকেচ্ছা যেতে সিধে নাকবরাবর রাস্তাই বেছে নেওয়া হয়েছিল। শীতলগাঁয়ের কাছে মৌরালা নদী পেরুলে তিনক্রোশের একটি অনাবাদি মাঠ পড়ে। উলুশরার মাঠ। আসলে মাঠ নয়, উলুকাশের জঙ্গল। শীতের শেষে সেখানে গাড়ি চলার রাস্তা হয়ে যায়। রাস্তা বলতে শুধু কাশবন ভেঙে দুটি চাকার দীর্ঘ আঁকাবাঁকা দাগ। তারপর আবার উঁচু মাটির আবাদি মাঠ। সেখানে আবার স্থায়ী সড়ক। সেকেড্ডা পৌঁছুতে পরদিন বিকেল হয়ে যাবে।

এবার তল্পি গুটোনোর সময় সেই আনুষ্ঠানিক রীতির ব্যতিক্রম ঘটালেন হুজুর। তবু খবর পেয়ে ছোটখাট একটা ভিড় হল। গম্ভীর হুজুর দুচার কথার কৈফিয়ত দিলেন। কিন্তু অন্ধকারে কোনো ক্রন্দন শোনা গেল না। না কোনো দীর্ঘশ্বাস। সাতখানা গোরুর গাড়ি, দুখানায় টাপর চাপানো। পেছনে পাঁচখানা গাড়িতে গেরস্থালির লটবহর। শেষে গাড়ির পেছনে বাঁজা গাইগোরু মুন্নি টানটান করে বাঁধা। নিঃসন্তান প্রাণীটি ছিল ভীষণ বৈরাগিনী। দড়ি ছেঁড়ার তাল করত। বারবার নিখোঁজ হয়ে বিস্তর ভোগাতও শফিকে।

ধাড়ি ছাগল কুলসুম সওয়ার হয়েছিল দ্বিতীয় গাড়ির টাপরের পেছনে। তার দুদিনের ছানাদুটোকে এক প্রধান শিষ্য পেছনের খোলাগাড়িতে কোলে নিয়ে বসে ছিল। বেচারি সারারাত ঘুমোতে পারেনি। কিন্তু খয়রাডাঙ্গার শিষ্যদের মধ্যে সেই ছিল হুজুরের সবচেয়ে অনুগত মানুষ। পুণ্যের লোভ ছিল তার অসম্ভব বেশি। ভোরবেলা যখন এই অদ্ভুত কারাভাঁ শীতলগাঁয়ের নদীটির ধারে পৌঁছল, তখন তার মার্কিন থানের লুঙ্গি এবং ফতুয়া হলুদ হয়ে গেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। প্রায় বুজে যাওয়া নদীর শুকনো বালিতে গাড়িগুলো দাঁড়ানোমাত্র সে ছানা দুটিকে নিয়ে লাফ দিল। সেখানেই তাদের ছেড়ে দিয়ে নদীর হাঁটুজলে উপুড় হয়ে পড়ল।

ছানাদুটি লম্ফঝম্ফ করে মাকে ডাকছিল। কুলসুমকে নামিয়ে দেওয়া হল তাদের কাছে। তখন কুলসুম ঠ্যাং ফাঁক করে দাঁড়িয়ে তাদের দুধ খেতে দিল এবং খুদে লেজ দুটোকে দুধারে মুখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে পুঁকতে থাকল।

বদিউজ্জামান ক্ষীণ নদীস্রোতের দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চটি খুলে রেখে তামচিনির বদনাটিতে জল ভরলেন। কিনারায় বসে উপাসনার প্রক্ষালন ‘ওজু’ সেরে নিলেন। সাতখানা গাড়ির সাতজন গাড়োয়ান আর তিনজন শিষ্য নদীতেই ওজু করল। তারপর হুজুরের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। পরিস্কার বালির ওপর ফজরের নমাজ শুরু হল। সামনে হুজুরের পরিচিত ময়ূরমুখো ছড়িটি পোঁতা।

ঠিক এইসময় নদীর ওপারে পশ্চিমে ঈষৎ উঁচুপাড়ের ওপর ভোরের ধূসর আলোয় একটি ছায়ামূর্তি ফুটে উঠল।

দ্বিতীয় টাপর চাপানো গাড়ির ভেতর ছিলেন সাইদা, তাঁর রুগ্ণা শাশুড়ি আর কিশোর শফি। সাইদা গাড়ির আড়ালে বদনা নিয়ে নেমেছিলেন। প্রার্থনাকারীরা অন্যদিকে রয়েছে দেখে আশ্বস্ত হলেন। তারপর বাকি দিকগুলিকে দেখে নিলেন। সেসব দিকে কোনো বেগানা মরদলোক আছে কি না এতে নিঃসশয় হওয়ার পর পা বাড়ালেন নদীর দিকে। এসব সময় তাঁকে খাঁচা থেকে বেরিয়ে পড়া পাখির মতো লাগে। নড়বড় করে পা ফেলেন। দুনিয়ার প্রকাশ্য মাটিতে হাঁটতে তাঁর যেন কষ্ট হয়। বহুকাল ধরে পাতার তলায় চাপাপড়া ঘাসের মতো বিবর্ণ তাঁর গায়ের রঙ। সামান্য দূরে একটি কাশঝোঁপ তাঁর লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কিছুতেই যেন পৌঁছুতে পারছিলেন না সেখানে। সারারাত গাড়ির ঝাঁকুনিতে শরীর অবশ। গিঁটে গিঁটে ব্যথা হয়ে গেছে। আর এই নরম বালি। বিব্রত বোধ করছিলেন সাইদা। এখনই যে সুরুজ বেরিয়ে পড়বে পুবে! দাগকাটা দুধের সরের মতো সেখানে মেঘ জমে আছে আর ক্রমশ লাল আভা ফুটে উঠছে। সাইদা যেন পয়গম্বর এব্রাহিমের পরিত্যক্তা নির্বাসিতা স্ত্রী বিবি হাজেরার মতো বিশাল মরুভূমিতে জলের খোঁজে ছুটে চলেছেন।

শফি সারারাত ঘুমোতে পারেনি। খয়রাডাঙ্গা তাকে পেয়ে বসেছিল। কতবার তার ইচ্ছে করছিল, চুপিচুপি গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিল সে। মাদ্রাসার পেছনে বটগাছটার তলায় মৌলবি নাসিরুদ্দিনের মেয়ে জহরা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার স্বপ্নটা ভেঙে গেল। একটানা শো শো ঘস ঘস অদ্ভুত শব্দ শুনে সে উঠে বসল! পর্দা ফাঁক করে দেখল বালির চড়ার ওপর গাড়ি চলেছে।

গাড়ি থামলে সে লাফ দিয়ে নেমেছিল। তারপর ঘুরে নদীর ক্ষীণ স্রোতটার দিকে তাকাতেই স্বপ্নের কষ্টটা চলে গেছে। সে দৌড়ে নদীর জল ছুঁয়েছিল। তারপর আব্বা তাকে ডাকলেন, শফিউজ্জমান!

শফি সাড়া দিয়ে বলল, জি!

ওজু করো বেটা! আমরা এখানেই ফজরের নমাজ পড়ব।

নমাজে দাঁড়িয়ে সামনে নদীর ওপারে তাকিয়েই শফি চমকে উঠেছিল। ছাইমাখানো আলোয় কালো এক মূর্তি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শফির মনে হল, তার চোখদুটোকেও সে দেখতে পাচ্ছে। জন্তুর চোখের মতো কি? যেন নীল চকচকে দুটি চোখ এবং তা শুধু শফিকেই দেখছে। শিউরে উঠল শফি।

করজোড়ে মোনাজাতের সময়ও আঙুলের ফাঁক দিয়ে শফি লক্ষ্য রেখেছিল কালো মূর্তিটার দিকে। সে তেমনি দাঁড়িয়ে।

নমাজ শেষ হওয়ার পর একজন গাড়োয়ান তাকে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল, এ ভাই! উলুশরার মাঠে রাস্তা হয়েছে?

লোকটার গলা শুনে আরও চমকে উঠল শফি। খ্যানখেনে এমন কণ্ঠস্বর কি মানুষের? সেও চেঁচিয়ে বলল, হয়েছে!

গাড়োয়ান তবু জিগ্যেস করল, হয়েছে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, হয়েছে। তবে কিনা—

তবে কিনা?

নদীটা ছোট। তত কিছু চওড়া নয়। হাওয়া বন্ধ ছিল। আস্তে কথা বললেও শোনা যেত। কিন্তু গ্রামের মানুষজনের চেঁচিয়ে কথা বলাই অভ্যাস। ততক্ষণে ওপারের উঁচুপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা স্পষ্ট হয়েছে। তার পরনে একফালি ন্যাতা। ঝাঁকড়া চুলেও একটা ন্যাতা জড়ানো। কিন্তু সে সাঁওতাল বা মুশহর নয়, সেটা তার কথাতেই বোঝা যাচ্ছিল। খুব স্পষ্ট আর জোরালো তার উচ্চারণ। আকাশের নিচে নদীর ওপর তার কণ্ঠস্বর গমগম করছিল, যেন ধ্বনি নয়, প্রতিধ্বনি।

গাড়োয়ান আবার চিৎকার করল, তবে কিনা?

সে একটু ঘুরে হাত তুলে বলল, পাকুড়গাছের কাছে যেয়ে ডাইনের লিকে গাড়ি ঘোরাতে হবে। নৈলে–

নৈলে?

বাঁয়ের লিকে গেলে গুপিডাঙ্গার নামুতে কেঁওলির বিল। তবে কিনা যাওয়া হবে কোথা?

সেকেচ্ছা-মখদুমলগর।

সে তো বিরভুঁই জেলায়।

তাই বটে।

হঠাৎ লোকটা হনহন করে চলে গেল। ঠিক অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মতো। শফির বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। চোখ বড়ো করে উঁচুতে নীলধূসর আকাশের বিশাল পটের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা ভীষণ শূন্য করে দিয়েছে আকাশটাকে। কালো একটা রহস্যময় কে ও?

শফি আড়চোখে আব্বাকে দেখে নিল। মা বলেছিলেন, দুরকম জিন আছে। ভাল জিন, মন্দ জিন। ভাল জিনের গায়ের রঙ ফিট শাদা, ধপধপে কাফনের থানের মতো। কালো জিনের গায়ের রঙ মাটির হাঁড়ির তলার মতো ভূসকালো। বদিউজ্জামান তাঁর কেতাববোঝাই টাপর দেওয়া গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে তখনও তসবিহ (জপমালা) জপছেন। ন্যালা মেজভাই মনিরুজ্জামান টাপরের ভেতরে থেকে মুখ বের করে হাত চুষছে আর খ্যা খ্যা করে হাসছে। সাইদা গাড়ির আড়াল দিয়ে এইমাত্র মেজছেলের খোঁজ নিতে এলেন। একটাই ভয় ছিল। বিছানায় পেচ্ছাপ করে দেয় আঠারো বছর বয়সের ছেলেটি। পবিত্র কেতাবগুলি যদিও চট আর কাপড়ে বাঁধা রয়েছে, কিছু বলা যায় না। সাইদা ফিসফিস করে বললেন, ইস্তেঞ্জা (মূত্রত্যাগ) করবি বেটা? কানে গেলে বদিউজ্জামান জপ থামিয়ে বললেন, খাওয়ার ইন্তেজাম করো। সাইদা, চলে গেলেন নিজের গাড়িতে। গাড়ির তলা দিয়ে তাঁর এলোমেলো পা ফেলা এবং লাল চটি দুটো দেখতে পেল শফি।

আব্বার কোনো ভাবান্তর না দেখে অবাক হয়েছিল শফি। নিশ্চয় একটা কালো জিন এসেছিল। ও কখনও মানুষ হতে পারে না।

কিছুক্ষণ পরে তুমুল চেঁচামেচি করে গাড়িগুলোকে নদীর চালু পাড় বেয়ে যখন ওপারে ওঠানো হল, আবার শফির গা শিউরে উঠল। এ কোথায় চলে এসেছে তারা? যতদূর চোখ যায়, ধূসর উলুকাশের বন। জনমানুষহীন খাঁ খাঁ নিঝুম এক দুনিয়া। এখানে এক কালো মানুষের কথা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। খুব আদিম এই ভূখণ্ডে মানুষের পায়ের ছাপ খুঁজে মিলবে না। সাতখানা গাড়ি সার বেঁধে চলেছে। সাতজোড়া চাকায় একটানা ঘস ঘস ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ। তার সঙ্গে উলুকাশের ঘষা-খাওয়া শোঁ শোঁ শনশন অদ্ভুত ধারাবাহিক শব্দ। অবাধ এই তৃণভূমিতে এতক্ষণে সূর্যের লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। সবার আগে এবার কুলসুমকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে একজন প্রবীণ শিষ্য। ছানাদুটিকে অদ্ভুত দক্ষতায় বুকে চেপে রেখেছে সে। মুন্নি শেষ গাড়িটির পেছনে আগের মতোই বাঁধা। এতক্ষণে শফি গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামল। সাইদা পর্দা ফাঁক করে দেখেই প্রায় চেঁচাতে যাচ্ছিলেন। বলদের পিঠের ওপর এমনি করে ঝাঁপিয়ে পড়তে আছে? এক্ষুণি বুকের ওপর চাকা চলে গিয়ে কলজে ফেটে যেত না বাছার? গাড়োয়ান হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল।

শফি একা হতে চাইছিল। চ্যালেঞ্জের একা ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসেছিল। শেষ গাড়ির পেছনে চলে গিয়ে সে ঝোঁপ থেকে একটা ডাল ভেঙে নিল। ডালটা শক্ত করে ধরে সে তৃণভূমিতে চারদিকে তাকিয়ে কালো জিনটিকে খুঁজতে থাকল।

ভয় পেয়ে শফি এরকম করত। একবার সন্ধ্যার পর গোরস্তানের পাশ দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে তেমনি হঠাৎ রুখে দাঁড়িয়েছিল সে। চিড়খাওয়া গলায় চিৎকার করে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, চলে আয়, দেখি। পরে খুব লজ্জা পেয়েছিল সে। যদি কেউ শুনে থাকে, তাকে মেজভাইয়ের মতো পাগলা ভাববে যে? কিন্তু মজার কথা, পরে তাকে মেহেদি নামে একজন লোক বলেছিল, হ্যাঁ গো, সেদিন গোরস্তানে কার সঙ্গে তকরার করছিলেন? শফি বলেছিল, ও কিছু না চাচা! কিছু না।

উলুশরার মাঠে সকালের আলোয় তারপর সে ‘কালা জিনে’র কথা ভুলে গেল। ক্রমশ সে একটা নতুন আর অচেনা দুনিয়ার ঢুকে পড়েছিল। টের পাচ্ছিল, এ কোনো মানুষের দেশ নয়। ঘাসফড়িংগুলো কি কিড় করে ডাকছিল। ডাকছিল পাখপাখালি। কাঁটাগাছের ফুলন্ত ঝোঁপ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছিল কাশের ডগা ছুঁয়ে। একখানে খরগোশ দেখে গাড়োয়ানরা হল্লা করতে লাগল। একজন হুজুরের কাছে জানতে চাইল, খরগোশ হালাল না হারাম। হুজুর ফতোয়া দিলেন, জরুর হালাল। কিন্তু তখন খরগোস উধাও। শফি-একটা শেয়াল দেখল। একটা খেঁকশিয়ালি তার পায়ের ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেল। একটা ঢ্যামনা সাপ ছুটে গিয়ে ব্যানাবনে ঢুপে পড়ে। শফি বুঝতে পারছিল এটা মানুষের দুনিয়া নয়। সে ছিপটিটাকে শক্ত করে ধরে সতর্কভাবে হাঁটছিল। মাঝেমাঝে মুন্নিকে ছিপটির ঘা মারছিল নেহাত অকারণে। পোকামাকড়ের ডাক, পাখপাখালির ডাক, সাতখানা গোরুর গাড়ির ঘসটানো ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ, উলুকাশের শোঁ শোঁ শনশন আওয়াজের মধ্যে দিয়ে শফি চলেছে তো চলেছে। কখন হাওয়া উঠেছে। কাশবন দুলতে লেগেছে। কত অদ্ভুত নতুন-নতুন শব্দ। রোদ পড়লে মাথার টুপিটা খুলে পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখল শফি।

তারপর হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে পর-পর সাতখানা গাড়ি থেমে গেল।

শফি কী হয়েছে দেখার জন্য দৌড়ে সামনে চলে গেল। তারপর থমকে দাঁড়াল। সামনে জল।

বদিউজ্জামান অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। আগের লোকটিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। কুলসুম এই সুযোগে দড়ি ঢিলে পেয়ে হাঁটু বাঁকা করে জল খেয়ে নিচ্ছে। গাড়োয়ান বোবাধরা গলায় বলে উঠল, হা আল্লা!

একটু স্তব্ধতা হকচকানি। তারপর কথা ফুটল লোকগুলোর। একজন চিৎকার করে উঠল, হারামি! নাফরমান।

সেই কালো লোকটি যে ভুলপথে পাঠিয়ে দিয়েছে, বুঝতে পারছিল সবাই। গাড়োয়ানরা তার উদ্দেশে ক্রোধ বর্ষণ করতে থাকল। তাদের মনে ভীষণ এবং জঘন্য গালাগালি। কিন্তু হুজুরের সামনে মুখখিস্তি করা চলে না। শফি তার আব্বাকে আবার লক্ষ্য করছিল। বদিউজ্জামানের নিষ্পলক দুটি চোখ জলের দিকে। ঈষৎ কুঞ্চিত। হাতের তসবিহদানা স্থির। ঠোঁট একটু ফাঁক হয়ে আছে। শফি মনে মনে বলল, আব্বা! আমি জানতাম।

সে ঘুরে দ্বিতীয় গাড়ির দিকে তাকাল। টাপরের পরদার ফাঁকে মায়ের একটা চোখ দেখা যাচ্ছে। শফির ইচ্ছে করল, মায়ের কাছে গিয়ে কালা জিনের কথাটা তোলে। কিন্তু কারুর কাছে ব্যাপারটা ধরা পড়েনি দেখে সে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। আর তার মনের ভেতর ঘুরে বেড়াতে থাকল ‘আমি জানতাম’ এই শব্দটা।

একজন জলে একটু নেমেই ব্যস্তভাবে উঠে এল। বলল, সর্বনাশ হুজুর। অগাধ পানি।

আরেকজন বলল, খাগড়ির সোঁতা না এটা?

তাই বটে।

কিন্তু এত পানি থাকার তো কথা না।

সেটাই আশ্চর্য লাগছে।

একজন ডাইনে-বাঁয়ে দূরে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে কোথায় লোকে বাঁধ দিয়ে পানি আটকেছে। বোরোধান পুঁতেছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই তো হারা রঙ ঝিকমিকোচ্ছে! তাকিয়ে দ্যাখো অসিমুদ্দিন।

অসিমুদ্দিন তাকিয়ে দেখল। সে বয়সে সবচেয়ে প্রবীণ। তার কপালে নমাজপড়ার কালচে ছোপ। পরনে খাটো লুঙ্গি গায়ে কোরা থানের পাঞ্জাবি। মাথায় তালশির দিয়ে তৈরি টুপি। সে গম্ভীর কণ্ঠস্বর ডাকল, হুজুর পিরসাহেব!

জি! বদিউজ্জামান আস্তে সাড়া দিলেন।

শয়তান আমাদের মুসিবতে ফেলে দিয়েছে।

জি।

হুজুর! এ মুসিবত থেকে বাঁচার রাস্তা আপনার হাতে। আপনি একটা কিছু করুন।

শফি বুঝতে পারছিল লোকটা কী বলতে চাইছে। উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠল সে। কালো জিনের কারচুপি সম্ভবত ধরতে পারছে ওরা। কিন্তু আব্বা চুপ কেন? জিনেরা তো তাঁর কথা শোনে!

এইসময় সাইদার চাপা ফুঁপিয়ে ওঠা শুনতে পেল শফি। তারপর আব্বার গর্জন শুনল। বেঅকুফ নাদান ঔরত! বেশরম কাঁহেকা!

অসিমুদ্দিন ডাকল, হুজুর!

গর্জন করার পর কান্নাটা থেমে গিয়েছিল। বদিউজ্জামান চোখ বন্ধ করেছেন। ঠোঁট কাঁপছে। নাসারন্ধ্র ফুলে উঠেছে। তারপর সুর ধরে উচ্চারণ করলেন, আউজুবিল্লাহে শয়তান-ইর রাজিম। বিসমিল্লাহে রহমান-ইর রহিম।

বদিউজ্জামানের কণ্ঠস্বর ছিল জোরালো, উদাত্ত। জমিদারি মসজিদের মিনারে উঠে কোনো-কোনো ফজরে আজান দিতেন নিজেই। সারা খয়রাডাঙ্গার ঘুম ভেঙে যেত। মধুরস্বরে কোরান আবৃত্তিকারদের বলা হয় কারি এবং কোরান যাদের মুখস্থ তাঁরা হাফিজ। বদিউজ্জামান ছিলেন কারি এবং হাফিজ দুই-ই।

কোরানের সুরা ইয়াসিন আবৃত্তি করছিলেন তিনি। বিপদে-আপদে এই সুরা আবৃত্তি করা হয়। নীলধূসর চৈত্রের আকাশের নিচে সেই গম্ভীর ও উদাত্ত ধ্বনি ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারদিকে। বলদগুলোও যেন শ্বাস ফেলতে ভুলে গিয়েছিল। চারপাশে কাশবনে শনশন হাওয়ার শব্দ, বনচড়ুইয়ের ঝাঁকে অস্ফুট ডাকাডাকি, ঘাসফড়িঙদের প্রচ্ছন্ন চিৎকার, তার মধ্যে সঙ্গীতময় ওই পবিত্র ঐশী-ধ্বনিপুঞ্জ। খাগড়ির সোঁতার ওপারে দুটি শাদা সারস মর্মর পাথরের মূর্তি হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে অলৌকিক ঘটনাটি ঘটল। একেই বলে বুজুর্গের মোজেজা–দিব্যশক্তির নিদর্শন। পরে চাপা গলায় লোকগুলিকে বলাবলি করতে শুনেছিল শফি, এ মোজেজাই বটে। হুজুরের অসাধ্য তো কিছু নাই।

বহুবছর পরে শফি ইংরেজ সাহেব দেখেছিল। কিন্তু উলুশরার কাশবনে খাগড়ির সোঁতারও পারে যাকে দেখেছিল, তার সঙ্গে ইংরেজ সাহেবের কোনো তুলনাই হয় না। আরও পরে সে প্রথম ধুতরার ফুলের গড়ন প্রকাণ্ড চোঙবসানো গ্রামোফোন যন্ত্র দেখেছিল এবং রেকর্ডে ‘জন্মাষ্টমী’ নামে নাটক শুনেছিল। সেই ধাতব কণ্ঠস্বর শুনে হঠাৎ খুব চেনা মনে হয়েছিল– আগেও কোথায় যেন শুনেছে। কিন্তু মনে পড়েনি। তখন শফির মন ভারাক্রান্ত, মগজে অন্য দুনিয়ার ঝড়।

ভরা সোঁতার ওপারের শাদা সারসগুলি হঠাৎ উড়ে যাওয়ায় সবার দৃষ্টি পড়েছিল সেদিকে। উঁচু কাশবনের ভেতরে থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল অসম্ভব শাদা এক মানুষ। দিনের উজ্জ্বল আলোয় তার শাদা চুল, শাদা ভুরু, শাদা চোখের পাতা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তার মুখে গোঁফদাড়ি ছিল না। সে চিৎকার করে বলল, রাস্তা ভুল হয়েছে। তারপর হাত তুলে ইশারায় এপারে সোঁতার বাঁদিকটা দেখিয়ে বলল, কিনারা ধরে চলে যান।

বদিউজ্জামান আবৃত্তি বন্ধ করেননি। কণ্ঠস্বর নামিয়ে এনেছিলেন মাত্র। অসিমুদ্দিন বলল, এদিকে তো লিক (চাকার দাগ) নাই ভাইজান!

ওপারের শাদা লোকটি বলল, তাতে কী? গাড়ি ডাকান। আমি এপারে থেকে সঙ্গে যাচ্ছি।

গাড়ির মুখ ঘোরানো হল। কাশের বন ভেঙে গাড়িগুলো সোঁতার সমান্তরালে চলতে থাকল। এবারে পায়ে হাঁটার সমস্যা। তাই সবাইকে গাড়িতে উঠতে হল। কুলসুমকে রাতের মতো চাপানো হ’ল সাইদার টাপরের পেছনে। শফি চাপল মায়ের গাড়িতে গাড়োয়ানের পেছনে। সাইদা পরদার ফাঁকে ডানদিকে তাঁকিয়ে ওপরের শাদা লোকটিকে দেখছিলেন। তাঁর চোখের চাউনিতে বিস্ময় ঝিলিক দিচ্ছে। শফি ফিসফিস করে ডাকল, আম্মা!

কী বেটা?

শফি চুপ করে গেল। সে জিনের কথা বলবে ভাবছিল। কিন্তু তার কথা শুনে যদি শাদা জিন অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে আব্বা হয়তো তাকে ভীষণ বকবেন।

শাদা মানুষটির পরনেও একফালি ন্যাতা। শাদা চুলগুলো খোঁচাখোঁচা। কিছু জড়ানো নেই। সে মাঝেমাঝে কাশের ভেতরে ঢাকা পড়ছিল। তখন অসিমুদ্দিন চেঁচিয়ে তাকে ডাকছিল, ভাইজান! ভাইজান!

তখনই সে কাশের পরদা ফাঁক করে সাড়া দিচ্ছিল, আছি, আছি। চলেন, চলেন। তার শাদা দাঁতে রোদ্দুর ঝকমকিয়ে উঠছিল।

পোয়াটাক চলার পর সত্যি একটা বাঁধ দেখা গেল। বাঁধের ওপাশে সোঁতার বুকে গাঢ় সোনালি বালির চড়া। শাদা লোকটি বলল, এইখানে পার হয়ে আসেন। আর ওই যে দেখছেন বাবলাবন, ওখানে গেলেই আবার লিক পাবেন। তা যাবেন কোথা আপনারা?

সেকেড্ডো-মখদুমলগর।

গাড়িতে উনি কে?

হুজুর পিরসাহেব।

লোকটা কপালে হাত ঠেকিয়ে বদিউজ্জামানের উদ্দেশে বলল, সালাম হুজুর! তারপর সে কাশবনের ভেতর ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ তার শাদা মাথাটা দেখা গেল। তারপর সে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অসিমুদ্দিন মৃদু হেসে চাপাগলায় বলল, সবই হুজুরের কেরামতি। আমিন। রব্বুল আলামিন!

উলুশরার মাঠে একজন কালোমানুষ বিপদে ফেলেছিল, একজন শাদা মানুষ এসে তাদের উদ্ধার করে গিয়েছিল। সদরে দায়রা আদালতে ফাঁসির হুকুম শোনার পরই শফিউজ্জামানের চোখে ভেসে উঠেছিল চৈত্রমাসের সেই আশ্চর্য দিনটি। সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়ে একটি আশ্চর্য সময়। প্রাচীন একটি মোজজা। আব্বা যদি আজ বেঁচে থাকতেন।…