সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
অলীক মানুষ
বিম্ব এবং প্রতিবিম্ব
সেই কালো জিন আর শাদা জিনের কাহিনী পরবর্তী সময়ে পল্লবিত হয়ে বহুদুর ছড়িয়ে পড়ে আর যে পিরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফরাজি মৌলানা বদিউজ্জামান জেহাদ করে বেড়িয়েছেন, ক্রমশ প্রকান্তরে তার কাছেই আত্মসমর্পণ করেন। তাঁর ফুঁদেওয়া জল নেওয়ার জন্য বহুদূর থেকে লোকেরা এসে ভিড় জমাতে থাকে। জুম্মাবারে তাঁর পাগড়ি ছুঁয়ে ‘তওবা’ করার জন্য মসজিদের ভেতর থেকে বাইরে অব্দি একটা কিউ সৃষ্টি হয়। তাঁর পাগড়ির রঙ হয়ে ওঠে সবুজ। কারণ পয়গম্বরের প্রিয় রঙ ছিল সবুজ। তাই তিনি জনসমাবেশে সবুজ পাগড়ি পরে হাজির থাকতেন। পরে তাঁকে তাওবা-অনুষ্ঠানের বহর দেখে পাগড়িটিকে অসম্ভব দীর্ঘ করতে হয়েছিল। মাথায় পরার পর পাগড়িটিকে ঈষৎ বেমানান মনে হলেও উপায় ছিল না। আসলে ইসলামী তওবা খ্রিস্টানি কনফেসনেরই মতো। পাপ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা। তওবা করার সময় লোকেরা এত জোরে কান্নাকাটি করত যে একদিন হরিণমারার দারোগা মুকুন্দ সিং মসজিদের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ভীষণ চমক খেয়ে থমকে দাঁড়ান এবং ধরেই নেন একটা খুনখারাপি হয়েছে। সাইদা বেগম এই গল্পটা খুব রঙ চড়িয়েই শোনাতেন তাঁর দুপুরের আসরে। জিনদুটির গল্পের চেয়ে মেয়েরা দারোগাবাবুর গল্পটিরই বেশি পক্ষপাতিনী ছিল। কারণ এই দারোগার গল্পে একটা ঘোড়া ছিল, যাকে জিনে ধরেছিল।…
তবে এও ঠিক, কালো জিন আর শাদা জিনের অলৌকিক কাহিনী পল্লবিত হওয়ার মূলে ছিলেন সাইদা ও খয়রাডাঙার সেই অসিমুদ্দিন। দুজনেই কাহিনীর বীজ বুনেছিলেন। সাইদা মেয়েদের মনে আর অসিমুদ্দিন পুরুষদের মনে। তার চেয়ে বড় কথা, বদিউজ্জামান যে সেকেড্ডা-মখদুমনগর যেতে মাঝপথে বাদশাহি সড়কের ধারে মৌরাহাটেই সেবার আটকে যান, তার পেছনেও যেন জিনদুটির কিছু কারসাজি ছিল।
সাইদা আর অসিমুদ্দিন দুজনেই বিশ্বাস করতেন এই কথা। বস্তুত চৈত্রমাসের সেই দিনটিতে পর-পর দুবার মোজেজা বা দিব্যশক্তির নিদর্শন দেখা গিয়েছিল। উলশরার তৃণভূমি পেরিয়ে সাতখানা গোরুর গাড়ির অদ্ভূত কারাভাঁ যখন বাদশাহি সড়কে পৌঁছয় তখন দলের প্রত্যেকটি লোক ছিল চঞ্চল আর হাসিখুশি। এবার যে-কোনো বাধার বিরুদ্ধে জান কোরবান করে শহিদ হতে তারা তৈরি ছিল। শফি হাত থেকে সেই ছিপটিটি ফেলেনি। সে বারবার সন্দিগ্ধভাবে পিছু ফিরে দেখছিল, যদি কোনো জিন তাদের অনুসরণ করে থাকে, সে কালো না শাদা। আর অসিমুদ্দিন চাপা স্বরে সঙ্গীদের বলছিল, সে খাগড়ির সোঁতা পেরিয়ে দাবানলের মতো আঁকা-বাঁকা একটি ভগ্নরেখা আবিষ্কার করে এসেছে। এমন কী তার বিশ্বাস, শাদা জিনটিকে চোখের কোনা দিয়ে যেন আকাশ থেকেই নামতে দেখেছিল সে। আর সে ভেবেছিল, দিনের বেলায় ‘তারা খসে পড়া’ সম্ভব কি না। স্বর্গ থেকে নির্বাসিত শয়তান যখন আকাশের আনাচে-কানাচে গিয়ে স্বর্গে অনুপ্রবেশের ছিদ্র সন্ধান করে, তখন সতর্ক স্বর্গপ্রহরী ফেরেশতা তার দিকে নক্ষত্র ছুঁড়ে মারে। শয়তান প্রাণভয়ে পৃথিবীতে পালিয়ে আসে। রাতের আকাশে সেটাই তো দেখা যায়। তারপর অসিমুদ্দিন হাত তুলে বলেছিল, ওই দেখা যায় মৌলাহাট। সেবার শুখার বছর ওখান থেকেই ধান কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। দুনিয়ার কোথাও আবাদ ছিল না। মৌলাহাটে ছিল। ক্যানে কী—অসিমুদ্দিন আবার হাত তুলে বলেছিল, ‘ওই দ্যাখো শেরের দীঘির পাড়। ওই দীঘির পানির থই নাই। সেই পানিতে চাষবাস হয়েছিল। আর ওই দ্যাখো লদী। লদীর নাম বাম্ভনী। যদি বলো এমন নাম ক্যানে– তো সেই কথাটা বলি শোনো।
শফি সঙ্গ ধরেছিল অসিমুদ্দিনের। এতক্ষণে সে বুঝতে পেরেছিল এই লোকটি গল্পের জাদুকর। এক ব্রাহ্মণ আর এক পিরের অলৌকিক লড়াইয়ের কথা শুনে সে অবাক হয়েছিল। গল্পটি ঈষৎ অশালীন, কিংবা হয়তো কিছু তাৎপর্য ছিল, যা বোঝার মতো বোধবুদ্ধি ছিল না শফির। ব্রাহ্মণ বলেছিলেন, আমি প্রস্রাবে নদী তৈরি করতে পারি। আর পির বলেছিলেন, আমি সেই নদী রুখে দিতে পারি। নদী তৈরি হল এবং পির দিলেন পাথর দিয়ে রুখে। এই অদ্ভুত লড়াই-যখন তুঙ্গে, তখন রফা করতে এলেন দেবরাজ ইন্দ্র আর হজরত আলি। রফা হল পাথরের বাঁধ থাকবে, তবে নদীর বয়ে যাওয়ার জন্য বাঁধে পাঁচটা ছিদ্র হবে। মৌলাহাটের ওধারে নদীর ওপর যে জিনিসটাকে এখন সাঁকো বলা হয়, সেটাই সেই পিরের বাঁধ। গল্পটা শুনে সবাই হাসতে লাগল। তখন অসিমুদ্দিন চোখে ঝিলিক তুলে জিগ্যেস করল, তাহলে কে জিতল? ব্রাহ্মণ, না পির? ঠিক করতে না পেরে সবাই একবাক্যে বলল, দুজনেই সমান। শুধু শফি বলল, ব্রাহ্মণ। তখন অসিমুদ্দিন হাসতে হাসতে বলল, আমরা মোছলমানরা চিরকাল বোকা। শুধু গায়ের জোরটুকুন আছে। বুদ্ধি বলতে নাই। তারপর অসিমুদ্দিন পায়ের তলার সড়কটা দেখিয়ে আবার একটা গল্প বলেছিল। সেটা বাদশাহি সড়কের গল্প। সেও হিন্দু মুসলমানের গল্প।
উত্তরের দেশের বাদশাহ দক্ষিণদেশে গেছেন। দক্ষিণদেশে হিন্দুরাজত্ব। একশো মন্দির। বাদশাহ মন্দির ভেঙে ফিরে যাচ্ছেন, মন্দিরের ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিশাপ দিলেন, বাড়ি ফিরলেই তোমার মরণ। অসিমুদ্দিন বড় করে শ্বাস ফেলে বলল, বাড়ি ফিরলেই আমার মরণ? বাদশাহ খুব ভাবনায় পড়ে গেলেন। ভাবছেন, খুবই ভাবছেন, ভেবেই যাচ্ছেন। হঠাৎ এল এক ফকির। ফকির মুচকি হেসে বলল, অ্যাই বাদশা! বাড়ি ফিরলেই যদি মরণ, তবে ফেরার পথে সড়ক বানা। কোরোশ-অন্তর দীঘি খোঁড়। সেই দীঘির পাড়ে মসজিদ বানিয়ে দে। মহলে ফিরতে-ফিরতে তুই চুল পেকে দাঁত ভেঙে থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে যাবি। বাম্ভনের অভিশাপ ঝুট হয়ে যাবে। আর বাস্! অসিমুদ্দিন খিকখিক করে হাসতে লাগল। এই যে দেখছ হেঁটে যাচ্ছি আমরা, এই সেই সড়ক। আর ওই নজর হচ্ছে সেই এক দীঘি। দীঘির পাড়ে জঙ্গলের ভেতরে ওটা কী দেখছ? গুম্বুজ। মসজিদের গুম্বুজ।… অসিমুদ্দিন শুখার বছরে ধান কিনতে এসে দেখে গেছে, সেই মসজিদে শেয়ালের আস্তানা। চামচিকের নাদি পড়ে আছে। দেখে কষ্ট হয়।
অসিমুদ্দিন! হুজুর ডাকছিলেন। জলদগম্ভীর তাঁর কণ্ঠস্বর। আগের গাড়িতে তিনি বসে আছেন গাড়োয়ানের পেছনে। হাতে তসবিহদানা– জপমালা। চোখদুটি অর্ধমুদিত। তাঁকে ভীষণ গম্ভীর দেখাছিল।
অসিমুদ্দিন ছাগলছানা দুটি কাদির আলিব কোলে দিয়ে লম্বা পায়ে এগিয়ে এল। ডাকছেন হুজুর?
অসিমুদ্দিন! আমরা শেরের দীঘির ঘাটে খানা সেরে নেব। জোহরের নমাজ পড়ব। তারপর রওনা দেব।
প্রধান শিষ্য সেই বার্তা পৌঁছে দিতে-দিতে পিছিয়ে শেষ গাড়ির কাছে এল। সবাই বলল, ইনশাল্লাহ। আর গাড়োয়ানরাও বলল যে বলদগুলো মাঠের আলকাটা লিকে হেঁটে বড় পরিশ্রান্ত। তারা ঠিক একথাই ভাবছিল। কিন্তু সাহস করে বলতে পারছিল না। নকিব নামে এক গাড়োয়ান করুণ হেসে বলল, তাড়াতাড়ি গাড়ি বাঁধতে ধুরিতে তেল দেওয়া হয়নি। তাই গাড়িটা বড় আওয়াজ দিচ্ছে। এবার গাড়ি বেঁধে ধুরিতে তেল দিতে হবে। নৈলে কখন মড়াত করে ভেঙে যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আশঙ্কা সত্যি হয়েছিল। দীঘির শানবাঁধানো ঘাটের শিয়রে এক প্রকাণ্ড বটগাছ ছিল। সেই বটতলায় সাতখানা গাড়ি এলোমেলোভাবে ঢুকতে না ঢুকতে সত্যিই মড়াত করে নকিব গাড়োয়ানের গাড়ির ধুরি ভেঙে গেল। ভাগ্যিস সে-গাড়িতে শুধু গেরস্থালির জিনিসপত্র ছিল। কিন্তু এ এক বিপদই বলতে হবে। ধুরিটা এমনভাবে ভেঙেছে যে তাপ্পি মেরে কাজচলা গোছেরও করা যাবে না। তাড়াহুড়োয় কেউ বাড়তি ধুরি নিতে ভুলে গেছে। নতুন ধুরি মৌলাহাট থেকে সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু তাতে সময় লাগবে। গাড়ির ধুরি বাঁধা সামান্য কাজ নয়।
আবার মুখগুলি বড় গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। আবার কালো জিনের পাল্লায় পড়া গেছে, তাতে সন্দেহ ছিল না কারুর। খুব ব্যস্তভাবে সবাই নকিবের গাড়িটিকে খালি করে জিনিসপত্র বটতলায় গুঁড়ির কাছে জড়ো করছিল। গাড়ি খালি হলে নকিব আর ফজল গ্রামের দিকে চলে গেল নতুন ধুরির খোঁজে। শফি তার বুজুর্গ পিতাকে লক্ষ্য করছিল। বদিউজ্জামান ছায়ায় একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকার পর পিছনে ঘুরে উঁচু পাড়ের দিকে তাকালেন। ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের ভেতর বাদশাহি মসজিদের গম্বুজটাকে দেখলেন সম্ভবত। গম্বুজে একটা ফাটল ছিল। তারপর শফি দেখল, তার পিতা ময়ুরমুখো ছড়িটি নিতে এলেন গাড়ি থেকে। ছড়িটি হাতে নিয়ে তিনি ধীর পদক্ষেপে পাড়ে উঠে গেলেন। ঝোঁপের ভেতর তাঁর শাদা আলখেল্লা ঝলমলিয়ে উঠছিল। শফির গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। একটা কিছু ঘটতে চলেছে আবার। সে ভাবতে পারছিল না এবারে কী ঘটবে। আব্বা কি শাদা জিনটিকে দেখতে পেয়েছেন? সাইদা আর কামরুন্নিসার গাড়িটা বটগাছের গুঁড়ির আড়ালে বাঁধা হয়েছিল। সেখানে অসিমুদ্দিন শিগগির অন্য একটা গাড়ির টাপরের সঙ্গে একটা শাড়ি আটকে রীতিমতো জেনানা মহল বানিয়ে দিয়েছে। সেই পর্দার ফাঁকে সাইদার পা দেখতে পাচ্ছিল শফি। ছুটে গিয়ে মাকে তার আব্বার ওই রহস্যময় গমনের কথা বলবে ভাবছিল শফি। কিন্তু ঠিক তখনই দীঘির ঘাটের দিকে তার চোখ গিয়েছিল। সে জলের শব্দ শুনে থাকবে। ঘুরে দেখল দুটি মেয়ে ঘাটের সামনে কালো জলে সাঁতার কাটছে। দুজনেরই বুকে দুটি পেতলের কলসি উপুড় করা। কলসি আঁকড়ে ধরে তারা উপুড় হয়ে ভেসে পা ছুড়ছে। কালো জল শাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। একজনের গায়ে বেশি জল এসে পড়ায় আপত্তি করতে গিয়েই সে শফিকে দেখল এবং কলসিটিকে ছেড়ে জলের ভেতর দাঁড়িয়ে গেল। অবাক চোখে সে শফিকে দেখছিল। অপর মেয়েটিও এতক্ষণে শফিকে দেখতে পেয়েছে। সেও একইভাবে দাঁড়িয়ে শফিকে দেখতে থাকল। তারপর শফিই অবাক হয়ে গেল। দুটি মেয়ের মুখের গড়ন হুবহু এক। শফি যমজ ছেলে দেখেছিল কুতুবপুরে থাকার সময়। এই মেয়েদুটিও কি যমজ? সে ভাবছিল, কাছে গিয়ে দেখবে সত্যি তাই নাকি। কিন্তু বিশেষ করে অচেনা মেয়েদের– যারা শাড়ি পরে আছে, তাদের কাছে যাওয়া উচিত হবে কি না বুঝতে পারছিল না। তারপর তার মাথায় বুদ্ধি খেলেছিল। সে একদৌড়ে মায়ের কাছ থেকে তামচিনির বদনাটা চেয়ে নিল এবং সোজা গিয়ে ঘাটে নামল। ঘাটের ধাপ জায়গায়-জায়গায় ভাঙা। শ্যাওলা গজিয়ে আছে। সে মুখ নামিয়ে ধাপে নামছিল। সেই সময় মেয়েদুটি হেসে উঠল। একজন বলল,পা পিছলে যাবে! অন্যজন ভুরু কুঁচকে তাকাল সঙ্গিনীর দিকে, অচেনা ছেলের সঙ্গে কথা বলায় তার আপত্তি। শফি সাবধানে নেমে জল ভরার জন্য বসল। তখন তাকে সাবধান করে দিয়েছিল, সে বলল, তোমাদের বাড়ি কোথা গো?
শফি বলল, আমরা সেকেচ্ছা যাব।
প্রথমা খিলখিল করে হেসে উঠল। শুধোচ্ছি বাড়ি কোথা, বলে কী সেকেচ্ছা যাব। দ্বিতীয়াও এবার না হেসে পারল না।
শফি বুঝল তার জবাব ঠিক হয়নি। একটু হেসে সে বলল, আমরা আসছি খয়রাডাঙা থেকে।
প্রথমা বলল, খয়রাডাঙায় বাড়ি! আমরা গেছি সেখানে। পীরের থানে, মেলা বসে পউষ মাসে– সেই মেলায় গেছি।
শফি বলল, আর মেলা তো বসে না।
দ্বিতীয়া একটু অবাক হয়ে বলল, বসে না? কেন বসে না বলে তো?
শফি গম্ভীর হয়ে বলল, আমার আব্বা পিরের থান ভেঙে দিয়েছেন।
প্রথমা বাঁকা হেসে বলল, কে তোমার আব্বা? ইশ! থান ভেঙে দিয়েছে। ভারি আমার মুরোদ।
মেয়েদুটির বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়। তারা শফিকে তুমি-তুমি করায় শফির আত্মসম্মানে লাগছিল। সে মুখ উঁচু করে বলল, আমার আব্বা বড় মৌলানা।
দ্বিতীয়া বলল, মৌলানা বলে থান ভাঙতে হবে? এমন তো শুনিনি কখনও। রুকু, ছেলেটা কী বলছে শোন।
রুকু মুখ টিপে হাসছিল। জল কুলকুচি করে আকাশে ছুঁড়ে বলল, থান কেউ ভাঙে? ও আমাদের সঙ্গে তামাশা করছে।
শফি জলভরা বদনা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। খুব গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা থান টান মানি না। আমরা ফরাজি।
দুই বোন একসঙ্গে চমকে উঠে বলল, কী বললে?
আমরা ফরাজি।
দুজনে আবার হেসে উঠল। রুকু একটু তেজি। সে সুর ধরে ছড়া কাটল:
ফরাজিদের নমাজপড়া
টেকির মতন মাথানাড়া॥
শফির কান লাল হয়ে উঠল। অনেক জায়গায় হানাফি সম্প্রদায়ের ছেলেরা এই ছড়া গেয়ে তাকে উত্যক্ত করত। সে ভীষণ খেপে গিয়ে ঢিল ছুঁড়ে ভাগিয়ে দিত তাদের। এরা যদি ছেলে হত, সে হাতের বদনাটা ছুঁড়ে মারত। কিন্তু এরা মেয়ে। তাছাড়া এরা যে যমজ দুটি বোন তা সে বুঝতে পেরেছে। সে তাদের উপেক্ষা করল। আর এইসময় গাড়োয়ানরা বালতি হাতে ঘাটের দিকে আসছিল। তাই দেখে মেয়ে দুটি শাড়ি টেনে মাথা ঢাকল। তারপর ঝটপট কলসিতে জল ভরে ঘাটের একটা পাশ দিয়ে ভয়পাওয়া ভঙ্গিতে উঠে গেল। তারা ঘাটের মাথায় ভিড় দেখে থমকে দাঁড়াল একটু। তারপর সেদিকে না গিয়ে দীঘির ধারে-ধারে ভেজা শাড়ির শব্দ করতে-করতে পালিয়ে যাওয়ার মতো হেঁটে গেল। তারা মসজিদের ওপাশে ঝোঁপের ভেতর দিয়ে চলে গেলে তখন শফি ফিরে এল বটতলায়। রাগে দুঃখে অস্থির সে। মেয়েদের কাছে জীবনে এই প্রথম সে অপমানিত।
আর এরপরই হুজুর পির বদিউজ্জামানের দ্বিতীয় মোজেজা দেখা গিয়েছিল। মোজেজা ছাড়া আর কী বলা যায় একে? নকিব আর ফজল গ্রামে নতুন ধুরির খোঁজে গিয়েছিল। ওরা যখন ফিরে এল, তাদের সঙ্গে একশো লোক। লোকগুলির মুখেচোখে ঐশী নিদর্শন অনুসন্ধানের প্রচণ্ড আকুলতা, আর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আকাশে। তারা ছবিতে আঁকা মানুষের মতো স্থির আর শব্দহীন। সেই জনতাকে দেখে অসিমুদ্দিন কিন্তু প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কারণ সে-যুগে ফরাজিতে দীক্ষিতদের ওপর কোথাও-কোথাও হামলা ঘটত। সে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে হুজুরকে খুঁজতে গিয়েই চমকে উঠল। অভিভূত হল সে। তার ঠোঁটদুটি কাঁপতে থাকল। তার সারা শরীরে রোমাঞ্চ দেখা দিল। দীঘির উঁচু পাড়ে শাহি মসজিদের প্রান্তে একখণ্ড পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন বদিউজ্জামান। ওইখানে কোনো বৃক্ষলতা নেই। চৈত্রের নীলধূসর আসমানের গায়ে আঁকা শাদা আলখেল্লা আর শাদা পাগড়িপরা মূর্তিটিকে দেখে মনে হয় ওই মানুষ দুনিয়ার নন। অসিমুদ্দিন সঙ্গে-সঙ্গে বুঝতে পারল আবার একটি মোজেজা ঘটতে চলেছে। সে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, আলহামদুলিল্লাহ! হে ঈশ্বর, সকল প্রশংসা শুধু তোমার। আর মৌলাহাটের সেই জনতাও অভিভূত। তারা ঘুম-ঘুম কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনি তুলল, আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! তারপর তারা গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রমে এগিয়ে গেল সেই দিকে। পরগম্বর ইশা মানুষকে মেষপালের উপমা দিয়েছিলেন। বস্তুত মৌলাহাটের এই মানুষগুলি মেষপালের মতো দীঘির পাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছিল। তারা ফারসি-হরফখোদিত কালো গ্রানাইট শিলাটির সামনে গেলে বদিউজ্জামান প্রথমে সম্ভাষণ করলেন, আস-সালাম। তারপর বদিউজ্জামান তার বিশাল দুই হাত প্রসারিত করে আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে বললেন, বেরাদানে ইসলাম!…
এরপর তিনি যে ভাষণটি দেন, মৌলাহাটের মুসলমানেদের কাছে বংশপরম্পরায় একটি কিংবদন্তি-ভাষ হয়ে ওঠে। তারা বলত, হুজুর আমাদের কানে গরম সীসার মতো কিছু কথা ঢেলে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমরা অন্য কথা শুনতে পাই না। যদি বা শুনতে পেতাম, আমাদের কানের দুয়ার বন্ধ।
কিশোর শফি বটতলায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখছিল। পর্দার ফাঁক থেকে সাইদাও উঁকি দিয়ে দেখছিলেন। তিনিও অসিমুদ্দিনের মতো প্রথমে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, লোকগুলি নিশ্চয় হানাফি মজহাবের এবং তাই তারা ফরাজি ধর্মগুরুকে হয়তো আক্রমণ করতে যাচ্ছে। পক্ষাঘাতগ্ৰস্তা কামরুন্নিসা জিগ্যেস করেছিলেন, কী হল বউবিবি? অত পায়ের শব্দ হচ্ছে কেন? আমার বদুর কি কোনো বিপদ হল? কামরুন্নিসা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন।…বউবিবি! তুমি কথা বলছ না কেন? সাইদার বুক কাঁপছিল। বিরক্ত হচ্ছিলেন শাশুড়ি বিবিজির প্রতি। একই উদ্বেগসংকুল দৃষ্টিতে সাইদা খুঁজছিলেন শফিকেও। শফি পর্দার ভেতর মায়ের কাছে চলে এলে সে নিরাপদ। কারণ ওরা স্ত্রীলোকদের ওপর হামলা করবে না। তিনি শফিকে দেখতে পেয়ে শরিয়তি অনুশাসন তুচ্ছ করে ঈষৎ চড়া গলায় ডাকলেন, শফি। শফি! পর্দাব্যুহের ফাঁকে তাঁর পাতাচাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাসে আর কোমল হাতখানিও নড়তে লাগল। সেই হাতে তিনগাছি করে সবুজ কাঁচের চুড়ি ছিল। চুড়ির শব্দে বটতলায় আবিষ্ট অসিমুদ্দিনের চমক ভাঙল। সঙ্গে সঙ্গে সে চাপা স্বরে এবং মৃদু হেসে বলল, আল্লাহ আমাদের। ভর করবেন না মা-জননী। বাছা শফি-উজ্জামান। জলদি যেয়ে দেখুন, আম্মাজান তলব করেছেন।
শফি গ্রাহ্য করল না। সে দীঘির উঁচু শিলাখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তার আব্বা আর সামনে বসে-পড়া মেষপালটিকে দেখছিল। দেখতে-দেখতে যমজ বোনেদের কথাই ভাবছিল সে। তারা যদি এবার এই দৃশ্যটা দেখতে পেত! রাগ দুঃখ-অপমান ভুলে তারা শফির মনটা নির্মল হল। সে মনে-মনে বালিকাদুটিকে ক্ষমা করে দিল। আর অসিমুদ্দিন তার উদ্দেশে চাপা গলায় বলে, উঠল, কী দেখছেন বাপজান? তামাম মৌলাহাট ফরাজি হয়ে যাবে। আলহামদুলিল্লাহে রব্বুল আলামিন! এমন কী ঝটপট দুহাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে সে মুখে ঘষতে থাকল। শুধু গাড়োয়ানদের কোনো দৃকপাত ছিল না। তারা নিঃশব্দে দীঘি থেকে জল এনে বলদগুলিকে জাবনা খেতে দিচ্ছিল। নকিব তার ভাঙা ধুরিটাতে বারবার হাত বুলিয়ে পরখ করছিল। পরে সে বলেছিল, হুজুর সাহেবের কথা শোনামাত্র আমার ধুরির কথা চাপা পড়েছিল। চাদ্দিকে অমনি ছুটোছুটি, হাঁকডাক, ওরে সব আয়, বদুপির এসেছেন। বদুপির এসেছেন। বলতে বলতে সে এক ঝড় বইয়ে দিলে। আর ফজল বলেছিল, নকুর কথা ধরো না। কী হয়, কী বলে? আসলে হাটতলায় একটা শালিশি বসেছিল। অনেক লোক ছিল সেখানে। আমি একজনকে আড়ালে ডেকে কালো জিন শাদা জিনের কথাটা বললাম। হুজুরের কেরামতির কথা বললাম। তবে তো–
একটা কিছু ঘটেছিল, তাব প্রকৃত বর্ণনা আর পাওয়া যাবে না। শুধু এইটুকু বোঝা যায়, মৌলানা বদিউজ্জামান মৌলাহাট অঞ্চলে বদুপির নামে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর সম্পর্কে কিছু গল্পও পল্লবিত হয়ে থাকবে। যেমন, জিনেরা তাঁর সঙ্গে ধর্ম আলোচনা করতে আসত, গোরস্থানে মৃতেরা তাঁর ‘আসসালামু আলাইকুম’ সম্ভাষণের জবাব দিত। তবে তার চেয়ে বড় কথা, মৌলাহাটের পায়ের তলায় ব্রাহ্মণী নদীতে পিরের সাঁকোটি পিরতন্ত্রের মহিমা প্রচার করে এসেছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। তারা বংশপরম্পরা প্রতীক্ষা করত সেইরকম কোনো অলৌকিক শক্তিধর পুরুষ তাদের সামনে এসে দাঁড়ান। আর চৈত্রের সেই দুপুরে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের পটে শাদা পোশাকপরা গৌরবর্ণ সুন্দর সেই পুরুষকে দেখামাত্র তারা বুঝতে পেরে থাকবে, এই সেই মোজেজাসম্পন্ন মানুষ, যার কথা তাদের পিতা-পিতামহ প্রপিতামহরা বলে এসেছে। তারা যখন মিছিল করে তাঁকে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে, তখন দেখা গেল রাস্তার দুধারে আরও মানুষ সারবদ্ধ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। স্ত্রীলোকেরা জানালা-দরজার ফাঁকে বা পাঁচিলের চাষের মই ঠেকিয়ে তাতে সাবধানে উঠে গিয়ে উঁকি মারছিল। কিছু বেহায়া বা স্বৈরিণী স্ত্রীলোক পুরুষদের ভিড়েই দাঁড়িয়েছিল। পুরুষেরা তাদের তাড়া করে বাড়িতে ঢোকাল। আরও বহু পুরুষ উঁকি মেরে থাকা স্ত্রীলোকদের হাত-ইশারায় সরে যেতে বলল। তারা ভ্রূ কুঞ্চিত করে হুঁশিয়ারি দিয়ে আগে-আগে হাঁটছিল।
বস্তুত মৌলাহাটের মুসলমানদের জীবনে সে ছিল এক ঐতিহাসিক দিন। উৎসবের সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বদিউজ্জামান সোজা গিয়ে মসজিদে ঢুকেছিলেন। প্রকাণ্ড মসজিদটি পাকা। প্রাঙ্গণে ইঁদারা ছিল। জোহরের নামাজের সময় এত ভিড় হল যে রাস্তা অব্দি তালাই বিছিয়ে নামাজ পড়তে হয়েছিল।
আর তখন দীঘির ঘাটে বটতলায় শুধু দুটি গাড়ি। একটি সাইদা আর তাঁর শাশুড়ির। অন্যটি বেচারা নকিবের। বাকি গাড়িগুলি লোকেরা এসে নিয়ে গেছে। সাইদার পর্দার অন্য প্রান্ত বটের ঝুরির সঙ্গে বাঁধা হয়েছে। সাইদা তাঁর প্রতিবন্ধী মেজ ছেলেকে গুড়মুড়ি খাওয়াচ্ছিলেন। শফি নকিবের কাছে দাঁড়িয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকটি স্ত্রীলোককে চাদর মুড়ি দিয়ে হদন্ত হয়ে আসতে দেখল সে। স্ত্রীলোকেরা পর্দার আড়ালে সাইদার কাছে গেলে নকিব করুণ হেসে বলল, আম্মাজানদের বেবস্থা হল। এবারে আমার হলে বাঁচি।
একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক পর্দা থেকে বেরিয়ে সোজা নকিবের কাছে এল। ঘোমটার আড়াল থেকে সে বলল, বিবিজিদের গাড়িখানা বলদ জুতে নিয়ে এসো বাবা!
নকিব বলল, তা না হয় যাচ্ছি। কিন্তু এ গাড়ির ধুরি যে ভাঙা! এত সব জিনিস পড়ে রইল।
স্ত্রীলোকটি শফিকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল, এই ছেলেটা থাকবে। তুমি এসো বাপু! বিবিজিরা বললেন, নমাজের অক্ত (সময়) যাচ্ছে। জলদি করো!
সাইদাদের নিয়ে গাড়িটি চলে গেল। ওই গাড়ির আসল গাড়োয়ান তখন গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়ছে। শফি তার ওপর বিরক্ত হয়ে বসে রইল। সে এখানে থাকলে অন্তত নকিব তার কাছে থাকত। নির্জন বটতলায় দুটি জাবনা-খাওয়া গোরু, একটা ভাঙা গাড়ি আর গেরস্থালির জিনিসপত্রের পাহারায় তাকে একা রেখে সব চলে গেল! অভিমানে গম্ভীর হয়ে রইল সে।
শেষ বসন্তে বটগাছটিতে চিকন কচি পাতা, আর সাতভাই নামে মেটে-ধূসর রঙের পাখিগুলি কলরব করছিল। বাদশাহি সড়কে ধুলো উড়ছিল। মাঝে মাঝে শূন্য মাঠ থেকে ঘূর্ণি হাওয়া খড়কুটো, শুকনো পাতা আর ধুলোর শরীর নিয়ে সড়ক পেরিয়ে যাচ্ছিল। ওপাশে পোড়ো জমিতে কোঙাগাছের নীল-শাদা ঝকঝকে জঙ্গলের ওপর গিয়ে প্রচণ্ড হুলস্থুল। তারপর কোথায় হনুমান ডাকল। শফি তার ছিপটিটা শক্ত করে ধরে হনুমানের দলটাকে খুঁজতে থাকল। তার অস্বস্তি হচ্ছিল। এবার তাকে একা পেয়ে সেই কালো জিনটা যদি হনুমান লেলিয়ে দেয়। দীঘির ঘাটে ততক্ষণে একজন-দুজন করে মেয়েরা স্নান করতে এসেছে। তাকে দেখে তারা ঘোমটা টেনে কিছু বলাবলি করছিল। শফির অস্বস্তিটা তাদের দেখতে পেয়েই চলে গেল। তখন সে পাখিগুলিকে তাড়া করল। একটি কাঠবেড়ালির পেছনে লাগল। আসলে সে আর তত বালক নয় সে প্রকৃতির এইসব ছোটখাট জিনিসগুলি তার আগ্রহের সঞ্চার করে, কিংবা সেগুলি তাকে ভুলিয়ে রাখতে পারবে। সে তাকে একলা ফেলে রেখে যাওয়ার অভিমান এড়াতে চাইছিল। সে অবাক হচ্ছিল ভেবে, তার মাও তাকে কিছু বলে গেলেন না! তার কথা সবাই ভুলে গেল কেন?
হয়তো সেই শেষ বসন্তের দিনটিতে সেই প্রথম শফি এই বিরাট, পৃথিবীতে একা হয়ে গিয়েছিল, পিছিয়ে পড়েছিল দলভ্রষ্ট হয়ে– তারপর বাকি জীবন সে একা হয়েই বেঁচে ছিল। জীবনে বহুবার অস্থিরতার মধ্যে ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত শফিউজ্জামানের আশ্চর্যভাবে মনে পড়ে যেত মৌলাহাটের দক্ষিণপ্রান্তে শাহি মসজিদের নিচে প্রকাণ্ড বটতলায় একলা হয়ে পড়ার ঘটনাটি। সেদিন যেন সবাই তাকে ভুলে গিয়েছিল। তারপর থেকেই ভুলেই রইল।
কিন্তু স্নানার্থিনীরা যখন চলে যাচ্ছে, তখন তাদের একজন শফিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল। সে এক বৃদ্ধা। সে থপথপ করে একটু এগিয়ে এসে শফিকে একটু দেখল তারপর ফোকলা মুখে একটু হেসে বলল, বড় সোন্দর ছেলে। কে বাবা তুমি?
এক যুবতী খিলখিল করে হেসে উঠল। দাদি। পছন্দ হয় নাকি দেখো। দেখে—
বৃদ্ধা ঘুরে কপট ক্রোধে মুঠি তুলে বলল, মর হারামজাদি! লোভ হচ্ছে যদি তুই কর।
যুবতীটিও এগিয়ে এল। বলল, তুমি পিরসাহেবের সঙ্গে এসেছ বুঝি? শফি গম্ভীরমুখে বলল, আমি পিরসাহেবের ছেলে।
সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধা ভিজে থানের কাপড় মাথায় টেনে ঘোমটা দিল। যুবতীটি গ্রাহ্য করল না। সে বলল, তুমি এখানে কী করছ? তোমার আম্মাজানরা তো দরিবুবুর বাড়িতে আছেন। তোমাকে কেউ ডেকে নিয়ে যায়নি?
শফি বিরক্ত হয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছেন না গাড়ির ধুরি ভেঙে গেছে?
যুবতী ভাঙা গাড়ি, বলদ দুটি আর জিনিসপত্রের স্তূপটি দেখে নিয়ে বলল, ও। বুঝেছি! তা তুমি চলে এসো আমার সঙ্গে। এসো, এসো। কত বেলা হয়েছে। এখনও হয়তো পেটে কিছু পড়েনি! এসো।
শফি বলল, না।
সে কী? যুবতীটি হাসল। কিছু চুরি যাবে না। আমাদের মৌলাহাটে চোর নাই। আর পিরসাহেবের জিনিসে হাত দিলে তার হাত পুড়ে যাবে না? তুমি এসো তো আমার সঙ্গে।
বৃদ্ধাও বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিছু চুরি যাবে না বাবা। আপনি যান আয়মনির সঙ্গে। আয়মনি, তুই নিয়ে যা বাছাকে। আহা, মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। আয়মনি, নিয়ে যা ভাই!
আয়মনি নিঃসঙ্কোচে শফির কাঁধে হাত রেখে টানল। তার হাতে একগোছা কাঁচের রঙিন চুড়ি। তার ভিজে হাতের স্পর্শ ফিকে আড়ষ্ট করছিল। সে পা বাড়াল। আয়মনি তার কাঁধ ছাড়ল না। রাস্তার ওধারে চষাজমির আলপথে গিয়েও শফির কাঁধটা সে পেছন থেকে ছুঁয়ে রইল।
চষা জমিগুলির শেষে একটা পোড়ো জমি। ঘন কোঙা আর কোবনে ভরা সেই জমির বুক দিয়ে একফালি পথ। শফির আগে তিনজন সদ্যঃঝাতা স্ত্রীলোক হাঁটছিল। বৃদ্ধা সবার শেষে। কেয়াবনের ভেতর গিয়ে আগের স্ত্রীলোকেরা বারবার ঘুরে শফিকে দেখে নিচ্ছিল। কেয়াবনের পর মাটির বাড়িগুলি খড়ের চাল মাথায় চাপিয়ে ঠাসবন্দি দাঁড়িয়ে ছিল। সরু একফালি গলিরাস্তায় ঢুকে টিনের চাল চাপানো একটি বাড়ির দরজার সামনে অগ্রবর্তিনীরা থেমে গেল। এবার আয়মনির হালকা পায়ে সামনে গিয়ে বলল, এসো। দরজার ভেতর ছোট্ট উঠোনে একপাল মুরগি চরছিল। আয়মনি মুরগিগুলিকে হটিয়ে দিল। তারপর আবার বলল, এস।
বারান্দায় তক্তাপোষে এক প্রৌঢ় বসে বাঙলা পুঁথির পাতা ওল্টাচ্ছিল। শক্ত সমর্থ এক মানুষ সে। তার শরীরটি তাগড়াই। খালি গা। পরনে শুধু লুঙ্গি। তার মুখে একরাশ দাড়ি। সে অবাক হয়ে তাকাল। তখন আয়মনি মৃদু হেসে বলল, বাপজি, বলো তো এই ছেলেটা কে?
প্রৌঢ় লোকটি একটু হাসল।…কে রে আয়মনি? আমি তো চিনতে পারছি না।
আয়মনি রহস্য ফাঁস করার ভঙ্গিতে বলল, তোমাদের পিরসাহেবের ছেলে। ঘাটের বটতলায় বেচারা একা দাঁড়িয়ে ছিল– না খাওয়া না দাওয়া! ডেকে নিয়ে এলাম।
আয়মনির বাবা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল।…আসুন, আসুন বাবা! কী কাণ্ড দেখ দিকিনি! ওদিকে-সবাই পিরসাহেবকে নিয়ে মত্ত। কারুর কি খ্যাল নাই এদিকে? এইমাত্র মসজিদ থেকে আসছি। জানতে পারলে তো–
আয়মনি বলল, বাপজি! শিগগির বটতলায় যাও দিকিনি! ধুরি ভেঙে গাড়ি পড়ে আছে। জিনিসপত্র পড়ে আছে। কারুর খ্যাল নাইকো। তুমি যেয়ে দেখো কী ব্যবস্থা হল।
আয়মনির বাবা বারান্দার আলনা থেকে একটা ফতুয়া টেনে ঝটপট পরল। তাক থেকে তালশিরের তৈরি টুপিটাও নিয়ে পরতে ভুলল না। তারপর সে বেরিয়ে গেল। শফিকে তত্তাপোষে বসিয়ে আয়মনি শুকনো কাপড় পরতে গেল ঘরের ভেতর। শফি দেখল, তক্তাপোষে পড়ে থাকা পুঁথিটা কাছাছুল অম্বিয়া। পয়গম্বর এবং বুজুর্গ পুরুষদের কাহিনী। আয়মনি শুকনো শাড়ি জড়িয়ে পেতলের বদনায় জল আনল। বলল, হাতে মুখে পানি দিয়ে নাও ভাই! এবেলা আর গোসল করতে হবে না।
শফি উঁচু বারান্দায় বসে হাত-পা-মুখ ধুয়ে ফেললে আয়মনি তাকে একটা গামছাও দিল। একটু পরে সেই তক্তপোশে মাদুর আর তার ওপর ফুল-লতা-পাতার নকশাওয়ালা একটুকরো দস্তরখান বিছিয়ে তাকে খেতে দিল। আয়মনি পাখা নেড়ে হাওয়া দিতে দিতে বলল, তোমাকে খাওয়াবার কপাল হবে সে কি জানতাম? তাহলে তো মুরগি জবাই করে রাখতাম। সে কথা বলতে বলতে বারবার হাসছিল। তার কোনোরকমে আটকে রাখা ভিজে চুল থেকে টপটপ করে জল ঝরে পিঠের দিকের কাপড় ভিজে যাচ্ছিল। আয়মনি বলছিল, আম্মাজানের জন্য ভেব না। ওঁরা দরিবুবুর বাড়িতে আছেন। ওই যে দেখছ তালগাছ, ওটাই দরিবুবুর বাড়ি। দরিবুবুরা বড়লোক। কোনো অযত্ন হবে না। দরিবুবুর বাড়িতে এক্ষুনি খবর পাঠাচ্ছি— তোমার নাম কী ভাই?
শফি আস্তে আস্তে বলল, শফিউজ্জামান।
আয়মনি আবার হেসে উঠল। অত খটোমটো নাম আমার মনে থাকবে না। আমি শফি বলব। কেমন?
শফি একটা তরকারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে সন্দিগ্ধভাবে জানতে চাইল, এটা কী। আবার হাসিতে ভেঙে পড়ল আয়মনি। মোলান খাওনি কখনও? রূপমতীর বিল থেকে বেচতে এসেছিল আজ। বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে তো! বিলে খালি পদ্ম আর পদ্ম। তুমি দেখে অবাক হবে দুনিয়ার সব পদ্ম কি রূপমতীর বিলেই পুঁতে দিয়েছিল খোদা? সেই পদ্মের শেকড়ের ভেতর থাকে মোলান। কেউ কেউ বলে মুলান। চিবিয়ে দেখো, কী মিষ্টি, কী তার স্বাদ! আমি তো কাঁচাই খেয়ে ফেলেছি। আর শফি, তুমি ভাই এগুলো খাচ্ছ না। খাও। খেয়ে বলো তো কী জিনিস?– পারলে না তো? চ্যাং মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে মাসগুলান মুসুরির ডালের সঙ্গে বেটে বড়া করেছি। তুমি আমলি খাও তো? আমলি-দেওয়া পুঁটি মাছ পেলে আমার তো আর কিছু রোচে না।
আমলি বা তেঁতুল কীভাবে সংগ্রহ করেছে আয়মনি, সেই গল্প বলতে থাকল। ওদিকে একটা পুকুর আছে। তার নাম জোলাপুকুর। ওদিকটায় জোলাদের পাড়া– সেই যারা তাঁত বোনে। তো সেই পুকুরের পাড়ে অনেক তেঁতুলগাছ আছে। হনুমানের পাল এসে তেঁতুল খায়। যদি তুমি ঢিল ছোড়, হনুমানগুলান কী করবে জান? তোমাকে তেঁতুল ছুঁড়ে মারবে। তখন তুমি আঁচল ভরে কুড়োও যত খুশি। হাস্যমতী আয়মনির ভিজে চুল খুলে গেল হাসির চোটে। বলল, শফি, তুমি তো পিরসাহেবের ছেলে। কত ভালোমন্দ খেয়েছ। আমরা সামান্য চাষাভূষো মানুষ। তোমার সম্মান করার মতো কীই বা আছে?…বলে আয়মনি আবার ভাত আনতে গেল। শফির খিদেও পেয়েছিল প্রচণ্ড। আর আমলি-দেওয়া পুঁটিমাছটাও ছিল সুস্বাদু। তার আর কোনো অভিমান ছিল না। সে শুধু আয়মনিকে দেখছিল। একটু শৌখিন মনে হচ্ছিল যুবতীটিকে। তার কানে সোনার বেলকুঁড়ি ঝিলমিল করতে দেখে মনে পড়ছিল, তার মায়ের কানেও এমন বেলকুড়ি নেই। সামান্য পাথর বসানো দুটো দুল আছে, তা হয়তো সোনার নয়। সাইদার হাতের চুড়িগুলিও তাঁর শাশুড়ির জেদে পরা। নৈলে বদিউজ্জামান মৃদু নসিহত করতেন। তাঁর মতে, অলঙ্কারকে ভালোবাসলে শয়তান হাসে। শয়তানকে হাসবার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। আর হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, পয়গম্বরের বালিকাবধূ বিবি আয়েশার শৌখিনতায় পয়গম্বর তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, ওই বাহ্যিক সৌন্দর্য কোনো সৌন্দর্য নয়। কারণ তা তোমাকে মৃত্যুর পর আর অনুসরণ করবে না। পক্ষান্তরে মৃত্যুর পর যা তোমার অনুগামী হবে, তা হল তোমার আত্মার সৌন্দর্য। বিবি আয়েশা একবার কানের দুল হারিয়ে ফেলে কী বিপদে না পড়েছিলেন। দুল খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এদিকে পয়গম্বর সদলবলে রওনা হয়ে গেছেন। যে উটের পিঠে চাপানো তাঞ্জামে আয়েশার থাকার কথা, তা পর্দা-ঢাকা। ফলে উটচালক বুঝতে পারেননি বিবি আয়েশা কোথা। শেষে এক ব্যক্তি সেখানে দৈবাৎ এসে পড়েন এবং হজুরাইনকে দেখে সসম্ভ্রমে নিজের উটে চাপিয়ে পয়গম্বর সকাশে পৌঁছে দেন। পরিণামে বিবি আয়েশার নামে কলঙ্ক রটনাকারীরা কলঙ্ক রটনার ছিদ্র পায়। আর ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ ঘোষিত হয়। কলঙ্ক রটনাকারীদের জন্য লানৎ (অভিসম্পাত) বর্ষিত হয়। পবিত্র কোরানে একটি সুরা আছে এ-বিষয়ে। সাইদা, তুমি হুশিয়ার! আমার হুজুর পয়গম্বর সাল্লেলাহ আলাইহেস্সাল্লাম বিবি আয়োকে একটু শিক্ষা দিয়েছিলেন মাত্র।
শফি শেষ গ্রাস মুখে তুলে থমকে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। উঠোনে যারা এসে দাঁড়িয়েছে এবং শফির দিকে মিটিমিটি হেসে তাকিয়ে আছে, তারা সেই যমজ বোন! এক বোন অপর বোনের অবিকল প্রতিবিম্ব যেন। শফির শরীর মুহূর্তে কঠিন হয়ে গেল। আয়মনি বলল, আয় রুকু! রোজি আয়! এই দ্যাখ, কাকে ধরে এনেছি। আর ও শফি, এই দেখ দরিবুবুর দুই বেটি। দিলরুখ আর দিল আফরোজ। আমরা বলি রুকু আর রোজি।
রুকু বারান্দায় উঠল। রোজি রান্নাঘরে আয়মনির কাছে গেল। আর রুকু একটু হেসে শফিকে বলল, তখন তুমি রাগ করেছিলে?…