সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
অলীক মানুষ
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’ উনিশ-বিশ শতকের মুসলিম অন্দর মহলের এক তথ্যপূর্ণ ডকুমেন্টশন। তিনি নিমোর্হভাবে তার সহজাত ভাষায় বুনেছেন অসংখ্য কাহিনী-উপকাহিনীর মধ্যে দিয়ে একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। একশ বছরের এই লৌকিক-অলৌকিকের মন্ময় আখ্যানটি রচিত হয়েছে কোলাজ রীতিতে। কখনো সহজ বয়ানে, কখনো মিথ ও কিংবন্তী আবার কখনো ব্যক্তিগত ডায়েরী, সংবাদপত্রের কাটিং জুড়ে দিয়ে দূর সময় ও বিস্ময়কর মানুষের বৃত্তান্ত। বাঙালি হিন্দু মুসলমান জীবনে এক অনাবিষ্কৃত এক সত্যের উদ্ভাসন।
এরকম উপন্যাস দুই বাংলায় বিরল। পাঠ অমৃতসমান। কেননা অমৃতপাঠ থেকেই জানতে পারি :
…‘এখন ভাবি, পুরুষের জীবনে ওই যেন কঠিন নির্বাসনের কষ্ট-কাল! নারীর জরায়ু থেকে বেরিয়ে এসে নিরন্তর নারীর সঙ্গে স্পর্শে-সাহচর্যে বেড়ে উঠতে উঠতে তারপর সে ধীরে ধীরে দূরে যেতে থাকে অথবা তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় দূরে। নারীর শরীর, নারীর স্তন, নারীর ঠোঁট তাকে অচ্ছুৎ করে ফেলে। নিষিদ্ধ হয়ে ওঠে প্রিয় এক জগৎ, এবং নির্বাসিতের মতো, অচ্ছুতের মতো, তারপর দূরে সরে থাকা। আবার প্রতীক্ষায় থাকা, কবে ফিরবে প্রিয়তম ঘরে? কবে ফিরে পাবে সে নারীর শরীর, নারীর স্তন, নারীর ঠোঁট এবং নারীর জরায়ূ–শরীরের পারুষ্যের যৌবনের রক্তমূল্য দিয়ে সবল পেশীর শক্তি দিয়ে হবে তার প্রত্যাবর্তনজনিত পুনরাভিষেক? করে সে ফিরবে পুরনো কোমল ঘরে? কৈশোরের সেই প্রতীক্ষা আর নির্বাসনের কাল।’
লেখকবৃত্তান্ত
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক। তিনি খোশবাসপুর গ্রামে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পলাতক কিশোরের জীবন অতিবাহিত করেছেন। রাঢ় বাংলার লোকনাট্য “আলকাপের” সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ে নিমজ্জিত হয়ে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন। আবার একদিন সহসা সব ছেড়ে তিনি শুনলেন নিজের নাড়ির আওয়াজ – তাঁর ভেতরে অন্তর্নিহিত লেখকসত্তার ধ্বনি। শুরু হলো সাহিত্যের সাধনা।
তাঁর “ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু”, “ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন”, “তরঙ্গিনীর চোখ”, “জল সাপ ভালোবাসা”, “হিজলবিলের রাখালেরা”, “রণভূমি”, “উড়োপাখির ছায়া”, “রক্তের প্রত্যাশা”, “মৃত্যুর ঘোড়া”, “গোঘ্ন”, “রানীরঘাটের বৃত্তান্ত”, ইত্যাদি অসংখ্য ছোটগল্পের জন্য বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থায়ী আসন পেয়েছেন।
সিরাজের প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস – “নীলঘরের নটী” প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। একের পর এক প্রকাশিত হয় “পিঞ্জর সোহাগিনী”, “কিংবদন্তীর নায়ক”, “হিজলকন্যা”, “আশমানতারা”, “উত্তর জাহ্নবী”, “তৃণভূমি”, “প্রেমের প্রথম পাঠ”, “বন্যা”, “নিশিমৃগয়া”, “কামনার সুখদুঃখ”, “নিশিলতা”, “এক বোন পারুল”, “কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি”, “নৃশংস”, “রোডসাহেব”, “জানগুরু” ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর গল্প ও একাধিক গ্রন্থ ভারতের সমস্ত স্বীকৃত ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এমনকি ইংরেজি তো বটেই, বিশ্বের বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
ক্ষুদে ও কিশোর পাঠকদের দাবি মেটাতে তিনি সৃষ্টি করলেন “গোয়েন্দা কর্নেল” নামে একজন রহস্যময় চরিত্র, যাঁর মাথা জোড়া টাক, ঠোঁটে চুরুট, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার, এখন প্রজাপতি ও পাখি দেখতে ভালোবাসেন। অথচ তিনি অনেক অপরাধ ও হত্যার কিনারা করে শখের গোয়েন্দাগিরি করেন। “গোয়েন্দা কর্নেল” পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
সিরাজ কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে। দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে চাকরি ও লেখালেখি সমানতালে চালিয়ে গেছেন। তাঁর জ্ঞান ও অধীত বিদ্যাসমূহ তাঁকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিদ্বানসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব – সব বিষয়েই তাঁর বিস্ময়কর জ্ঞান ও বিদ্যার গভীরতা তাঁকে পণ্ডিত মহলে উচ্চ আসন এনে দিয়েছে।
তিনি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা প্রদত্ত আকাদেমি পুরস্কার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রদত্ত নরসিংদাস পুরস্কার, রাজ্য সরকার দ্বারা প্রদত্ত বঙ্কিম পুরস্কার, এছাড়া ভূয়ালকা পুরস্কার সহ আরও অনেক অনেক পুরস্কার, সম্মান, পদক প্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁর অনেক কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তাঁর “মানুষ ভূত” চলচ্চিত্র ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চে ক্রমাগত অভিনীত হয়ে চলেছে…
অলীক মানুষ
প্রথম প্রকাশ : বৈশাখ, ১৩৫৫
দে’জ পাবলিশিং ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০৭৩
প্রচ্ছদ : গৌতম রায় প্রকাশক : সুভাষচন্দ্র দে।
লেজার টাইপ সেটিং : পেজমেকার্স ২৩বি রাসবিহারী এভিনিউ, কলকাতা ৭০০০২৬
মুদ্ৰক : স্বপনকুমার দে। দে’জ অফসেট ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩
উৎসর্গ
আব্দুর রউফ, প্রীতিভাজনেষু
Hatred is one of the passions that can master a life, and there is a temperament very prone to it, ready to see life in terins of vindictive melodrarna, ready to fine stimulus and satisfaction in frightful dem onstrations of ‘justice’ and ‘revenge’.
– H.G. wells