দাড়ি-বিলাপ[১]

হে আমার দাড়ি!

একাদশ বর্ষ পরে গেলে আজি ছাড়ি

আমারে কাঙাল করি, শূন্য করি বুক!

শূন্য এ চোয়াল আজি শূন্য এ চিবুক!

তোমার বিরহে বন্ধু, তোমার প্রেয়সী

ঝুরিছে শ্যামলী গুম্ফ ওষ্ঠকূলে বসি!

কপোল কপাল ঠুকি করে হাহাকার –

‘রে কপটি, রে সেফটি (safety) গিলেট রেজার!’….

একে একে মনে পড়ে অতীতের কথা–

তখনও ফোটেনি মুখে দাড়ির মমতা!

তখনও এ গাল ছিল সাহারার মরু,

বে-পাল মাস্তুল কিংবা বিপল্লব তরু!

স্বজাতির ভীরুতার ইতিহাস স্মরি

বাহিয়া বি-শ্মশ্রু গণ্ড অশ্রু যেত ঝরি।

নারীসম কেশ বেশ, নারীকেলি মুখ,

নারিকেলি হুঁকা খায়!–পুরুষ উৎসুক

নারীর ‘নেচার’ নিতে, হা ভারত মাতা!

নারী-মুণ্ড হল আজি নর বিশ্বত্রাতা!

চলিত কাবুলিওয়ালা গুঁতো-হস্তে পথে

উড়ায়ে দাড়ির ধ্বজা, আফগানিয়া রথে

সুকৃষ্ণ নিশান যেন! অবাক বিস্ময়ে

মহিলা-মহলে নিজ নারী-মুখ লয়ে

রহিতাম চাহি আমি ঘুলঘুলি-ফাঁকে,

বেচারি বাঙালি দাড়ি, কে শুধায় তাকে?

চলিত মটরু মিঞা চামারুর নানা,

মনে হত, এ দাড়িও ধার করে আনা

কাবুলির দেনা-সাথে! বাঙালির দাড়ি

বাঙালির শৌর্য-সাথে গিয়াছে গো ছাড়ি!

দাড়ির দাড়িম্ব বনে ফেরে নাকো আর

নির্মুক্ত হিড়িম্বা সতী, সে যুগ ফেরার!

জামাতারে হেরি শ্বশ্রু লুকান যেমনি!

‘রেজারে’ হেরিয়া শ্মশ্রু লুকাল তেমনি!…

ভোজপুরী দারোয়ান তারও দাড়ি আছে,

চলিতে সে দাড়ি যেন শিখীপুচ্ছ নাচে!

পাঞ্জাবি, বেলুচি, শিখ, বীর রাজপুত,

দরবেশ, মুনি, ঋষি, বাবাজি অদ্ভুত,

বোকেন্দ্র-গন্ধিত ছাগ সেও দাড়ি রাখে,

শিম্পাঞ্জি, গরিলা–হায়, বাদ দিই কাকে!

এমন যে বটবৃক্ষ তারও নামে ঝুরি,

ঝুরি নয় ও যে দাড়ি করিয়াছে চুরি

বনের মানুষ হতে! তাই সে বনস্পতি আজ!

দাড়ি রাখে গুল্মলতা রসুন পেঁয়াজ!

হাটে দাড়ি, মাঠে দাড়ি, দাড়ি চারিধার,

লক্ষ খারে ঝরে যেন দাড়ি-বারিধার!

ঝরে যবে বৃষ্টিধারা নীল নভ বেয়ে

মনে হয় গাড়ি গাড়ি দাড়ি গেছে ছেয়ে

ধরণীর চোখে-মুখে, সে সুখ-আবেশে

নব নব পুষ্পে তৃণে ধরা ওঠে হেসে!

মুকুরে হেরিয়া নিত বি-শ্মশ্রু বদন

লজ্জায় মুদিয়া যেত আপনি নয়ন।

হায় রে কাঙালি,

রহিলি তুই-ই হয়ে মাকুন্দা বাঙালি!

এতেক চিন্তিয়া এক ক্ষুর করি ক্রয়

চাঁছিতে লাগিনু গাল সকল সময়।

বহু সাধ্য-সাধনায় বহু বর্ষ পরে

উদিল নবীন দাড়ি! যেন দিগন্তরে

কৃষ্ণ মেঘ দিল দেখা অজন্মার দেশে,

লালিমলি-পার্সেল যেন অঘ্রানের শেষে!

সে দাড়ি-গৌরব বহি সু-উচ্চ মিনারে

দাঁড়াইয়া ঘোষিতাম, ‘এই দাড়িকারে

নিন্দে যারা, তারা ভীরু তারা কাপুরুষ!

হায় রে বেহুঁশ,

নারী তো নরের রূপ পেতে নাহি চায়,

তাদের হয় না দাড়ি, গুম্ফ না গজায়!

দাড়ি রাখি হইয়াছি শ্রীহীন মিঞা!

কিন্তু বন্ধু, তোমরা যে শ্রীমতী অমিয়া

হইতেছ দিনে দিনে!

কেবা নর কেবা নারী কেহ নাহি চিনে!’

কে কাহার কথা শোনে, ওরা করে ‘শেভ’,

আমারে দেখিলে বলে – ‘ঐ অজদেব!’

হই অজ-মুণ্ড আমি তবু দক্ষ-রাজা,

দক্ষেরই জামাতা শিব–(খায় খাক গাঁজা!)

দিনে দিনে বাড়ে দাড়ি রেজার-কর্ষণে,

শস্য-শ্যামা ধরা যেন হলের ঘর্ষণে!

* * *

একাদশ বর্ষ পরে–হায় রে নিয়তি

কে জানে আমার ভাগ্যে ছিল এ দুর্গতি!

সেদিন কার্জন-হলে দিলীপকুমার

আসিল গাহিতে গান, কে করে শুমার

কত যে আসিল নর কত সে যে নারী!

ঠেসাঠেসি ঘেঁসাঘেঁসি, কত ধুতি শাড়ি

ছিঁড়িল পশিতে সেথা! চেনা নাহি যায়

কেবা নর কেবা নারী–এক কেশ এক বেশ, হায়!

সে নিখিল নারী-সভা মাঝে

হেরিলাম, আমারি সে জয়ডঙ্কা বাজে

মুখে মুখে দিকে দিকে! আমি কৃষ্ণ-সম

একাকী পুরুষ বিরাজিনু অনুপম।

সম্মুখে বালিকা এক গাহিতে বসিয়া

ভুলি গেল সুর লয় মোরে নিরখিয়া।

বলে, ‘মাগো, ও কী দাড়ি, দেখে ভয় লাগে!

সুর মম ভয়ে সারদার কোল মাগে,

বাহিরিতে চাহে নাকো।

উহারে সম্মুখ হতে সরাইয়া রাখো!’

গর্বে নাড়ি দাড়ি

কহিলাম–‘গান! তব সাথে মম আড়ি!’

সরোষে যেমনি যাব বাহিরিতে আমি,

বিস্ময়ে হেরিনু, মম দাড়ি গেছে থামি

বাঁধিয়া যায় গো দাড়ি নিমেষের ভ্রমে?

চিৎকারিল নারীদল নব নব সুরে,

বানর নরের দল হাসিল অদূরে

ঝিঁঝিট-খাম্বাজে কেহ, কেহ মালকোশে,

হিন্দোলে হুঙ্কারে কেহ ওস্তাদি আক্রোশে!

আসিল নারীর স্বামী, স্বামীর শ্যালক,

পলাইতে যত চাহি পিছে লাগে শক!

দেখেছি অনেক ব্রোচ, বহু সেফটিপিন,

হিরিনি নাছোড়বান্দা হেন কোনদিন।

আমারও স্ত্রীর ব্রোচ কাঁটা বহুবার

বাঁধিয়াই ছাড়িয়াছে তখনই আবার!

যত পালাইতে চাই তত বাঁধে দাড়ি,

দাড়ি লয়ে পড়ে গেল শেষে কাড়াকাড়ি

পুরুষ নারীর মাঝে! ক্ষুরে ও কাঁচিতে

হাসিতে হল্লাতে গোলে কাশিতে হাঁচিতে

লাগিল ভীষণ দ্বন্দ্ব!…. যখন চেতনা

ফিরিয়া পাইনু গৃহে, হেরি আনমনা

হাসিছে গৃহিণী মম বাতায়নে বসি।

জাগিতে দেখিয়া কহে, ‘এতদিনে শশী

হল মেঘ-মুক্ত প্রিয়!’ মুকুরে হেরিয়া মুখ কহিলাম আমি,

‘আমি কই?’ সে কহিল, ‘মুকুরেতে স্বামী!’

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. কোন প্রফেসার বন্ধুর দাড়ি-কর্তন উপলক্ষে রচিত।