।। বাইশ।।
দিন যায় তবু পাখি দুটো উড়ে আসে। জাহাজের পেছনে পেছনে কেবল উড়ছে। দিগন্তে কখনও উড়ে যাচ্ছে। ঝড়ের সমুদ্র পেলে আনন্দের শেষ থাকে না। যখন জাহাজে কেউ বের হতে পারে না, বৃষ্টিপাত প্রবল, ঝড়ো হাওয়ায় অস্পষ্ট এক কালো ঝাপসা অন্ধকারে সিওল-ব্যাংক এগিয়ে যাচ্ছে তখনও সেই পাখি উড়ে উড়ে আসছে। অথবা কক কক করে ডাকছে। অনেক দূর থেকে সেই শব্দ কখনও ঝড়ের রাতে অথবা কুয়াশার রাতে শোনা যায়।

অথবা যখন আকাশ নির্মল থাকে সমুদ্র শান্ত থাকে এবং আবহাওয়া সুন্দর থাকে তখনও পাখি দুটো উড়ে আসছে। সকালের রোদ ডানা থেকে পিছলে যাচ্ছে। আর কি যাদু জানে, মাস্তুলের ডগায় পাখি দুটো ঠিক বসে না, একেবারে উঁচুতে দুটো বাজ-পাখির মতো গ্লাইড করতে থাকলে সবার আগে জ্যাক ছুটে আসে ডেকে। সে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়ায়। দেখে, চড়ুই দুটো ঠিক জালির ভেতর আছে কিনা। যদি না থাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। হাতে বড় একটা লোহার রড। ছোঁ মারলেই আঘাত হানবে। এবং আর যারা থাকে সে ডেবিড। ছোটবাবু সতর্ক নজর রাখে চারপাশে—না নেই। আর্চিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে দু’লাফে উইনচের তলা থেকে তেল কালি মুখে হাজির। সামনে যা পায় তুলে ঢিল ছুঁড়তে থাকে।

পাখি দুটো ভয় পায় না। হাওয়ায় ভেসে থাকে। আসলে পাখি দুটো বুঝতে পারে ছোটবাবুর ঢিল অত উঁচুতে উঠবে না। ওরা, পাখায় ঢেকে রেখেছে যেন জাহাজকে। নিশ্চিন্তে ওরা উড়ে বেড়াচ্ছে। জ্যাকও ঢিল ছুঁড়ছে। ডেবিড, মৈত্র এবং ইয়াসিন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে। যদি নেমে আসে, অথবা কাউকে আক্রমণ করে।

কত বড় পাখি! ডেবিড ভেবে পায় না আসলে এ-দুটো এ্যালবাট্রস কিনা, না অন্য পাখি! প্ৰশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে যে-সব এ্যালবাট্রসদের আস্তানা রয়েছে তাদের ভেতর এ-জাতীয় পাখিগুলো বিরল। প্রশান্ত মহাসাগরে অতিকায় এ্যালবাট্রসদের আস্তানা আছে সে শুনেছে। কখন দেখা দেবে কেউ বলতে পারে না। দেখা দিলে জাহাজের পক্ষে ভাল। কিন্তু বড় হিংস্র এদের স্বভাব। পুরুষগুলো বেশী মারমুখো হয়। এ-সব তথ্য ডেবিড পাখি সংক্রান্ত কোন বইয়ে পায় নি। প্রাচীন নাবিকের মুখে শুনেছে, এবং শুনেছে আশ্চর্য সব তথ্য।

কাজেই ইচ্ছে করলেই সে কাপ্তানের কেবিন থেকে বন্দুকটা নিয়ে এসে এদের গুলি করে নামাতে পারে না। এদের হাত থেকে কোনরকমে তাহিতি পর্যন্ত চড়ুই দুটোকে রক্ষা করতে পারলেই হয়ে গেল। তাহিতি থেকে এরা প্রথম কিনবে একটা পাখির খাঁচা। চড়ুই দুটোকে খাঁচায় এবার ভরে ফেলবে। তারপর আর ভয় থাকবে না।

তখন ছোটবাবু দেখেছে, এ্যালবাট্রসের তাড়া খেয়ে চড়ুই দুটো আর কাছে আসতে চায় না। এমন কি দেখেছে ওর বাকসোটাতে ঘুমোয় না। এনজিন-ঘরে থাকে। কিন্তু ভাল লাগবে কেন। একটু মুক্ত আকাশের নিচে উড়তে না পারলে ভাল লাগবে কেন। আর ভয় এই দুই বড় পাখির। কখন কি হবে কেউ বলতে পারছে না।

জ্যাকের সেজন্য সব কিছুর ভেতর এই এক কাজ পাখি দুটোর দিকে লক্ষ্য রাখা। সে যখন দেখে এ্যালবাট্রস দুটো জাহাজের খুব কাছাকাছি, তখনই তার মাথা ঠিক থাকে না, লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে আসে, আর আর্চি তেমনি সেয়ানা, সেও কোথা থেকে বের হয়ে আসে, যেন আর্চি ঘুমোয় না, আর্চি সারারাত জেগে থাকে জ্যাক কোথায় কখন থাকে দেখার জন্য। দেখা হলেই জ্যাকের সব যেন গন্ডগোল হয়ে যায়। মাথায় কিছু থাকে না। সে সোজা হাঁটে না, ঠিক উল্টো মুখে নেমে গেলে মজা পায় আর্চি। আর আর্চি তার ছোটখাট চেহারা নিয়ে কিম্ভুতকিমাকার। জ্যাক তখন ছুটেও পার পায় না। পেছনে তাকিয়ে দেখে, না আসছে না। সে দম ফেলে দাঁড়ায়। আবার ডাকে, ডেবিড, আসছে, আসছে। ম্যান-এ্যালবাট্রসটা এগিয়ে আসছে।

চড়ুই দুটো না থাকলে তার নিচে না নামলেও হত। চড়ুই দুটো না থাকলে, সে চুপচাপ’ কেবিনে কাটিয়ে দিতে পারে। সন্ধ্যার পর ছোটবাবু আর ডেবিড ওর কেবিনের পাশে চুপচাপ বসে থাকে। বারোটা-চারটা ডেবিডের ওয়াচ। সুতরাং চারটা থেকে আটটা পর্যন্ত ডেবিড আর ছোটবাবু বসে থাকে চুপচাপ। পোর্ট-হোল খুলে জ্যাক তখন সারাক্ষণ গল্প করতে পারে।

কিন্তু ছোটবাবুর ভারী প্রিয় পাখি দুটো। এ-পাখি দুটো আসার পর ছোটবাবুর বিষণ্ণতা কেটে গেছে। ছোটবাবু পাখি দুটোর জন্য বিশেষ করে মিসেস স্প্যারোর জন্য কেমন এক মায়া অনুভব করে থাকে। জ্যাকের এ-সব আগে ভাল লাগত না। এগুলো অসভ্যতা। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে ছোটবাবু যা ভালবাসে, সে তা ভালবাসে। এটা কেন হয় সে বুঝতে পারে না। পাখি দুটোকে রক্ষা করার কেমন একটা নৈতিক দায়িত্ব পেয়ে সে বেশ একটা ভাল কাজ করে যাচ্ছে জাহাজে—আর তখন সেই লোকটা, ও কি ভয়ঙ্কর, বাবাকে সে অনায়াসে বলে দিতে পারে, কিন্তু মনে হয় আবার নির্বাসনের দিনগুলি চলে আসবে! জাহাজিরা যদি টের পেয়ে যায় সে মেয়ে, তবে বাবা ঠিক পিসির কাছে পাঠিয়ে দেবেন। পিসির মুখ ভাবলেই ভয়ে তার রক্ত হিম হয়ে আসে—এবং সে বুঝতে পারে ভয় থেকে এক একটা আকস্মিক ঘটনা ঘটে যায়। সে রেগে গিয়ে পিসির সুন্দর চুল কেটে দিয়েছিল। পিসির পোশাকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। জাহাজে এমন সব খবর খুব একটা মিথ্যা না—এতে আসে যায় না জ্যাকের। কেবল এখন নির্বাসনে যাবার আতঙ্কে আর্চির সব সহ্য করে যাচ্ছে। বাবাকে কিছু বলতে পারছে না। আর বাবা পাঠিয়ে দিলেই সে যাবে কি করে! ছোটবাবুকে ফেলে কোথাও গিয়ে সে থাকতে পারবে না। তার ভীষণ কান্না পাবে।

সিউল-ব্যাঙ্ক যাচ্ছে তার সুহাস গতিতে। পাখি দুটো আকাশের ওপর সমান তালে ভেসে চলেছে। এবং এখন বেশ এই জাহাজ আর দুই বড় এ্যালবাট্রস ভেসে চলেছে। নীল জলধি বলা যায়, সাদা জাহাজ, সাদা পাখি আর বুদবুদ জলে, নীল জলে অসংখ্য প্রাচীন জীবেরা ঘোরাফেরা করছে। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কোথাও ভেসে উঠলে অসংখ্য বুদবুদ হয়ে যায়। সমুদ্রের বুকে জলরাশির ভেতর এই সব লক্ষ কোটি বুদবুদ দেখলে ছোটবাবুর এমনই মনে হয়। মনে হয় সমুদ্রেই তার নিবাস। এই সব অতিকায় হাঙ্গর অথবা তিমি কিংবা ধরা যাক যে সব সোর্ড ফিস ছুটে যাচ্ছে জলের নিচে এবং কখনও কখনও অতিকায় তিমিমাছকে গেঁথে ফেলছে—সেখানে যেমন এক যুদ্ধ রয়েছে ওপরেও তেমনি যুদ্ধ। পাখি দুটো উড়ছে, ওরা আহার খুঁজছে। চারপাশে সবাই আহারের জন্য নানাভাবে হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। কেবল মানুষ আহার বাদেও হিংসা চরিতার্থ করতে চায়। এ-সব মনে হলেই ফিসফিস গলায় কেউ যেন ডাকে—জ্যাক, আমি এখানে।

জ্যাক দেখতে পায়, এলি-ওয়ের মুখে, বড় একটা উইন্ডসেলের আড়ালে ছোটবাবু দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাক অবাক। কি করে টের পেয়েছে ছোটবাবু, সে আসছে।

—কোথায়?

—এখানে।

—এখানে কি!

—দেখো না এসে।

জ্যাক দেখল, চড়ুই পাখি দুটো পরস্পর ঠোঁট থেকে কি কেড়ে খাচ্ছে।

—এখানে তোমরা! আর কত জায়গায় খুঁজে মরছি।

ছোটবাবু বলল, জ্যাক তাহিতিতে নেমেই একটা খাঁচা কিনে ফেলব।

—এ্যালবাট্রস জাহাজের পেছনে ততদিন উড়তে নাও পারে।

ছোটবাবু বুঝল, তার আগেই ফিরে যেতে পারে পাখি দুটো।

—তবে যাচ্ছে না কেন? জ্যাক বলল, কত বড় পাখি দুটো না!

—ভীষণ! দেখলে চোখ ফেরানো যায় না।

—কি নীল চোখ!

ছোটবাবু বলল, এই, আমি যাচ্ছি, মেজ-মিস্ত্রির ওয়াচ থেকে উঠে আসার সময় হয়েছে।

—মেজ মিস্ত্রি লোক ভাল না।

—খুব বাজে। আমাকে অযথা গালাগাল করে!

–ধরে থাপ্পড় লাগাতে পার না! ঘুষি, ঘুষি মারতে পার না।

—ঠিক মারবো—কি বাজে দ্যাখো, সব ঠিকঠাক করে রাখি আর মেজ-মিস্ত্রি এসেই কি যে করে না! তারপরই কি যেন অন্যায় করে ফেলেছে ছোটবাবু, মুখে ভীতির ছাপ। সে ফের বলল, এই জ্যাক।

—কী? সে চেয়ে থাকল। আর এমন সুন্দর চোখে সে যখন তাকিয়ে থাকে ছোটবাবু কেন যে বুঝতে পারে না।

ছোটবাবু বলল, তুমি কিন্তু আবার কাপ্তানকে বলে দিও না।

—কি বলব?

—এই যে বললাম—ঠিক একদিন মেরে বসব।

—বললে কি হবে?

—আমাকে ডেকে পাঠাবেন। বকবেন।

—জ্যাক বলল, তুমি কিছু করতে যেও না ছোটবাবু

—আমাকে অযথা খাটায়। রাত সাতটার আগে আজকাল ছাড়ছে না।

জ্যাক কি বলবে! জ্যাক জানে মেজ-মিস্ত্রি এখন থেকে অনেক অন্যায় কাজ করে যাবে। তবু সহ্য করা ছাড়া উপায় কি

জ্যাক বলল, ছোটবাবু, একটা কথা বলব?

—আমাকে?

—হ্যাঁ তোমাকে। তুমি মেজ-মিস্ত্রিকে কিছু বলতে যেও না। প্লিজ!

—আরে না না। আমার সাহসই হবে না। খুব রাগ হয়, জানো কাল আমাকে বয়লারের নিচে পাঠিয়েছে। স্কাম-বক্স ক্লিয়ার হচ্ছে না, কে করবে, ডাকো ছোটবাবুকে। কি যে দরকার বুঝি না, ওটা জ্যাম থাকলে এমন কি ক্ষতি বল!

জ্যাক এনজিনের কলকব্জা সম্পর্কে কিছু বোঝে না। কিন্তু বয়লারের নিচে, জাহাজ চালু অবস্থায় কেউ ঢুকতে সাহস পায় না। তা ছাড়া শীতের সমুদ্রে জাহাজ নেই। গরম, ভীষণ গরম। দু-চার দিন না গেলে জাহাজ আরও নিচে নেমে না গেলে গরম কমবে না। ওপরে টন টন কয়লা পুড়ছে, নিচে ছোটবাবু! ভাবতে বুক শুকিয়ে যায়। সে বলল, নিচে ঢুকলে কি করে?

ছোটবাবু হাসল। বলল, কি করব বল! বললাম, বড় একটা বস্তা দিতে। না হলে তো ঝলসে যাব। পিঠে মাথায় বস্তা চাপিয়ে ঢুকে গেলাম।

—পারলে করতে!

—হ্যাঁ। মেজ-মিস্ত্রি অবাক। ও ভেবেছিল, আমি রাজী হব না। খুব বোকা ভেবেছে আমাকে। দুঃখে চোখ ভার হয়ে এল জ্যাকের। কত সহজে বলে যাচ্ছে ছোটবাবু—যেন কিছুই না কাজটা। একটা মরণপণ কাজের ভেতর জীবন নিয়ে ছোটবাবু ছুটছে। সে মুখ ফিরিয়ে সমুদ্র দেখতে থাকল। ওর চোখে জল দেখলে ছোটবাবু ভাববে, জ্যাক খুব ছেলেমানুষ। সে সমুদ্র দেখতে দেখতেই বলল, কি দরকার ছিল ছোটবাবু তোমার ছ’নম্বর হওয়ার! কি দরকার ছিল তোমার জাহাজে আসার?

জ্যাক বয়সী মানুষের মতো কথা বলছে। এখন জ্যাককে কিছুতেই মনে হয় না নাবালক। বরং জ্যাক তরুণ। বিচার-বুদ্ধিতে জ্যাক তার চেয়েও প্রাজ্ঞ। সে বলল, বা কত ভাগ্য আমার! আমি দেশে যখন ফিরব ও তুমি বুঝতে পারবে না, আমার মা আমাকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পাবেন। আমি তো এমনি চেয়েছিলাম। জ্যাক আমি খুব বড় হতে চাই। সবাই বলবে, ছোটবাবু খুব বড় মানুষ। বাবা, আমার ছোট ভাই-বোনেরা, জ্যাঠামশাই আমার জ্যাঠিমা আমাকে যখন দেখবে, আমার গায়ে জাহাজি পোশাক, সাদা হাফ সার্ট প্যান্ট, মাথায় এংকোরের নীল টুপি, আমি তাদের কাছে কি যে হয়ে যাব না!

জ্যাক মুখ ফেরাল না। সেই এক গ্রাম্য বালকের বড় হবার আশা। এই সামান্য কাজের ভেতরই ছোটবাবুর বড় হবার স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে। সে বলল, ছোটবাবু, আর কেউ খুশী হবে না?

—আবার কে হবে?

—বারে তুমি যে বলতে…….?

–কি বলতাম!

—তোমার লিটল প্রিন্সেস!

ছোটবাবু ভুলেই গিয়েছিল, সে তার মাকে লিটল প্রিন্সেস বলেছে। বলল, অঃ আমার মার কথা বলছ!

জ্যাক অবাক! সে ফিরে দাঁড়াল। দেখল, ছোটবাবুকে। ছোটবাবুর মুখে চোখে কি যে আশ্চর্য যাদু থাকে! সে ভাবল কিছু বলবে, কিন্তু কি বলবে, কিছু বলতে পারছে না। ঠোঁট কাঁপছে। এতদিন একটা ভীষণ চাপা অভিমান ছিল ছোটবাবুর ওপর। ছোটবাবু কি জানত না, জাহাজে বনি নামে একজন মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। সে কেন তার লিটল প্রিন্সেসের কথা ভাববে।

ছোটবাবু বলল, এই জ্যাক কি হয়েছে?

ছোটবাবু তুমিও ভাল না।

—আমি ভাল না কেন? আমি তো কিছু করি নি।

—তুমি ভীষণ ভীষণ…..

ছোটবাবু তারপরই দেখল জ্যাক দৌড়ে যাচ্ছে। ডেকের ওপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। ছোটবাবু বুঝতে পারল না, জ্যাক এভাবে কেন দৌড়াচ্ছে।

কারণ ছোটবাবু তো জানে না আনন্দে জ্যাকের চোখ দিয়ে অজস্র বারিধারা নেমে আসছে। জ্যাক এখন সোজা নিজের কেবিনে ঢুকে গেছে। এবং বালিসে মুখ গুঁজে দিয়েছে। ছোটবাবু তুমি আমাকে কি যে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! আমি আর কাউকে ভয় পাই না।

এবং পরদিনই সবাই ছুটে গেল মেজ-মিস্ত্রির কেবিনে। মেজ-মিস্ত্রি পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। সে হেঁটে আসছিল বোট-ডেক ধরে, মনে হল পায়ে কেউ কি দিয়ে হ্যাঁচকা মেরেছে! সঙ্গে সঙ্গে একেবারে উপুড় হয়ে পড়েছে ডেকে। নাক দিয়ে অনেকটা রক্ত পড়েছে। কিন্তু কিভাবে কি যে হল কেউ বুঝতে পারে নি।

ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারল না। কেউ বলল, জাহাজের সেই অশুভ শক্তি। কেবল ছোটবাবু বুঝতে পেরে গুম হয়ে গেল। সে জ্যাকের সঙ্গে দু’দিন কথা বলল না।

জ্যাক থাকতে না পেরে বলল এই, তুমি কথা বলছ না কেন?

—কি বলব।

—যা খুশী।

ছোটবাবু বলল, জ্যাক তুমিও ভাল না

—আমি তো খারাপ সবাই জানে। নতুন কি দেখলে?

—তুমি কেন মেজ-মিস্ত্রিকে এভাবে ফেলে দিলে? যদি দেখতে পেত।

—ও দেখবে! তা হলেই হয়েছে। ও এখন কি দেখে তুমি তো জান না। কি খুঁজে বেড়ায় তুমি তা বোঝ না। কেবল এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে। নিচে কি আছে, কোথা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওর মাথায় যদি থাকত…….

ছোটবাবু বলল, কাউকে অহেতুক কষ্ট দিতে নেই।

—তোমাকে দিচ্ছে কেন?

ছোটবাবু আর কিছু বলতে পারল না। সে বুঝতে পারছে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে ওর সঙ্গে। জ্যাক তুমি আমার জন্য এটা করেছ?

জ্যাক খুব সাদাসিধেভাবে বলল, হ্যাঁ।

—জ্যাক তুমি কি? ওতে ওর রাগ তো বেড়ে যাবে।

—টের পেলে তো। বলেই জ্যাক বলল, ঐ দ্যাখো আসছে। নেমে আসছে।

ছোটবাবু দেখল, অতিকায় এ্যালবাট্রস দুটো জাহাজের দিকে উড়ে আসছে।—কোথায় আছে ওরা? —দাঁড়াও দেখছি। জ্যাক দৌড়ে চলে গেল। ছোট কাজ ফেলে যেতে পারে না! সে জ্যাককে দেখে যেমন টুপ করে ভেসে উঠেছিল উইনচের তলা থেকে, ফের সে উইনচের নিচে ডুবে গেল।

এখন কে বলবে একটা মেয়ে জাহাজের সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে পাখি দুটোকে। সে চিৎকার করছে, মিঃ স্প্যারো, মিসেস স্প্যারো তোরা কোথায়? ওরা উড়ে আসছে। ভেতরে ঢুকে যাও। কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না। গেল কোথায়? কাপ্তান হুইলঘরে বসে দেখতে পাচ্ছেন, জ্যাক এংকোর ফেলার জিপসিতে উঠে পাখি দুটোকে খুঁজছে। বেশ আছে। জ্যাক, ছোটবাবু, ডেবিড বেশ আছে পাখি দুটোকে নিয়ে। এবং কাপ্তান নিজেও কতদিন দেখেছেন, চা-এর সঙ্গে সামান্য রুটি আপেল এলে উড়তে উড়তে চলে এসেছে তারা। তখন এই মহাসমুদ্রের শান্ত স্বভাবের ভেতর পাখি দুটো বড় বেশি ডাঙার খবর বয়ে আনে। পাখি দুটোকে খাবার ছুঁড়ে দিতে তারও কম ভাল লাগে না।

তা ছাড়া মেয়েটা এভাবে বেশ দিন মাস কাল জাহাজে কাটিয়ে দিচ্ছে। কিছু তো নেই। সব সময় বই পড়তে ভাল লাগবে কেন, এখন বয়স বাড়ছে। চারপাশের গাছাপালার ভেতর বড় হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু কপাল মন্দ, সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে মরছে। মেয়ের এই একাকীত্বের জন্য বেদনাবোধ যখন খুবই তীব্র হয়ে ওঠে, তখন আর বসে থাকতে পারেন না। একা একা পায়চারি করেন। মনে হয়, সেই ভয়ঙ্কর দিনে তিনি যেন শুনেছিলেন তুমি আমাকে এটা কি করলে! তোমার পাপ হবে না, তোমার শাস্তি হবে না, তোমার শাস্তি হবে না! আর বুড়োবয়সে মেয়েটার নির্জন একাকীত্বের ভেতর সেই শাস্তিকে তিনি অনুভব করতে পারেন। তাঁর তখন ঈশ্বর চিন্তা পর্যন্ত খারাপ লাগে।

তখন ছোটবাবু দেখল, জ্যাক হাসি হাসি মুখে ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দু-হাত একসঙ্গে করে কি দেখাল ইশারায়। ছোটবাবু উইনচের তলায় নাট-বোল্ট খুলছে। চিত হয়ে আছে। কিছুটা দেখা যাচ্ছে। এবং জ্যাক ইশারা করলে সে আর শুয়ে থাকতে পারল না। বের হয়ে বলল, কি ব্যাপার!

—তাড়াতাড়ি এস।

জ্যাক কিছু বলছে না।—কী? বলবে তো?

—এস। না দেখলে বিশ্বাস হবে না।

জ্যাক লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে। এখন বিকেল। সূর্য এবার পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জমালার ওপাশে নেমে যাবে, এবং সূর্যাস্তের রঙ যেমন মনোহারিণী থাকে তেমনি, চারপাশে উজ্জ্বল লাল নীল হলদে আভা, কখন সমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছে আর কখন ভেসে উঠছে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। আর এভাবে ওদের শরীরের রঙ পাল্টে যাচ্ছে। কখনও বেগুণী কখনও মেরুন, কখনও ক্রিসেন্থিমাম। ছোপ ছোপ রঙের ভেতর ওরা যখন বাক্সোটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল তখন কে বলবে ওদের দুজনের কাছে পৃথিবীতে এর চেয়ে আর কিছু বিস্ময়ের আছে। পাখি দুটো হলদে নীল ছোট মারবেল গুলির মতো ডিম পেড়েছে। আর অহংকারে ওদের পা পড়ছে না। কেবল মাথার ওপর পাখি দুটো উড়ছে। আর কিচকিচ করছে।

ছোটবাবু বলল, কী?

জ্যাক বলল, কী?

ওরা দুজনেই পাখি দুটোকে প্রশ্ন করল।

তখন মৈত্র যাচ্ছে। সে বলল, কি করছিস রে ছোটবাবু?

—এসে দ্যাখো না।

মৈত্র এসে বলল, সাবাস!

সারেঙসাবকে ছোট ডেকে আনল, চাচা দেখে যান কি হয়েছে!

জ্যাক দু-লাফে একেবারে কোথায় চলে গেল। একটু পরে সবাই দেখছে, জ্যাক, তার বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে।

কাপ্তান এসেও উঁকি দিলেন। তিনি দেখলেন। দেখলেন ছোট্ট একটা কাঠের বাক্সের এক পাশে খড়কুটো দিয়ে বানানো ঘরে পাখি দুটো সুন্দর সুন্দর সব ডিম পেড়েছে। জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, কে আবিষ্কার করেছে?

জ্যাক বলল, আমি। বাবা আমি খুঁজতে এসে দেখি দুজনে চোরের মতো এখানে পালিয়ে আছে। ও মা কাছে যেতেই দেখি ওরা উড়ে গেল তারপরে না বাবা….। আহা জ্যাকের চোখ কি উজ্জ্বল! এভাবে প্রায় সকলেই এসে দেখে গেল। কাপ্তান নিজে এসে দেখে গেলেন যখন, তখন জাহাজিরা না দেখে থাকে কি করে। চড়ুই দুটো এ-জাহাজের যাত্রীর মতো। প্রায় সবাই পাখি দুটোর ভালমন্দ নিয়ে ভাবতে থাকল। কাপ্তান পাখি সম্পর্কে নানারকম কথা বলতে বলতে উঠে গেলেন। পাশে চীফ- অফিসার, রেডিও-অপারেটর। এই সব পাখি দীর্ঘদিন সমুদ্রযাত্রায় নানারকম বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। এরা যে সত্যি ডিম পাড়ে, জাহাজিদের কথাবার্তা শুনে একেবারে মনে হবে না। যেন সিউল-ব্যাংক জাহাজে চড়ুই দুটো প্রসব করল।

এই ডিম দেখার পর মৈত্রমশাই মুখ গোমড়া করে থাকল। সে টাকা পাঠাতে পারে নি বুয়েনএয়ার্স বন্দর থেকে। ভেবেছিল ভিকটোরিয়া থেকে মোটা টাকা পাঠাবে। কম্বল এবং কিছু উলেন জামা বিক্রি করে যা পেয়েছে পাঠিয়েছে। ওতে কি হবে। সন্তান হবার সময় কত কিছুর দরকার। সে লিখেছিল আমি ঠিক পাঠাচ্ছি। কাজ কারবার যা করেছে ওতো সব রেখে এসেছে বুয়েন-এয়ার্সে। এখনও মেয়েটির কথা ভাবলে চোখে ঘুম আসে না। বিজবিজে ঘা। ওর ক’দিন থেকে এই একটা ভাব, কুঁচকির নিচে বিজবিজে কি যে দেখা যাচ্ছে, জ্বলছে। বন্দর না এলে কিছু করতে পারছে না। পালিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবে। সে তো আর এ-সব কাউকে বলতে পারে না। কেবল টাকা টাকা। অমিয় কি সব এনে জড় করছে লকারে। অমিয় বলল, দাদা, আমি দ্যাখো ঠিক রাজা হয়ে বাড়ি ফিরব।

মৈত্র বলল, কচু।

—দেখ না। বলে লকার খুলে দেখাল।

—কি করেছিস? সারেঙসাবকে বলেছিস চাবি পাচ্ছিস না! আর এ-সব হচ্ছে!

—তুমি দেখ না। এই যে, বলে অমিয় একটা বড় তাল, প্রায় সোনার পিন্ডের মতো দেখতে, মৈত্রকে দেখাল। কয়লার ছাই থেকে এ-সব উজ্জ্বল ধাতুপিন্ড সংগ্রহ করেছে। এখন তেমন বেশি হচ্ছে না। ইন্ডিয়ান কোল পুড়লে চকচকে এমন সব ধাতুপিন্ড—আর সবই মনে হয় অমিয়র, কিছু রয়েছে এর ভেতর—সে কুড়িয়ে আনে। আর যা ভেবে থাকে, এই সব সঞ্চিত ধাতুপিন্ড নিয়ে সে কোন বড় দ্বীপে নেমে যাবে। কেউ টের পাবে না। আসলে কয়লার ছাই বলে কেউ বুঝতেই পারে না, এর ভেতর এমন অমূল্য কিছু পড়ে থাকতে পারে। সেই যেন প্রথম এটা আবিষ্কার করেছে। একবার শুধু যাওয়া। লকারের নিচের তাকটা ভরে গেছে। যদি সত্যি সোনা হয়ে যায়, অথবা এমন ধাতুপিন্ড, যা আরও অমূল্য, সে তো এভাবে গলে গলে কয়লা থেকে হীরক হয়ে যাওয়ার গল্প শুনেছে। শুনেছে, কোন এক কয়লাবালা এক পিন্ড হীরক পেয়েছিল। কয়লা টানতে টানতে বড় বড় চাঁই ভেঙ্গে ফেলতেই উজ্জ্বল রত্নরাজি। এবং সে সারেংকে দেখিয়েছিল। সারেং কাপ্তানকে। কাপ্তান বলেছিল, কিছু না, কাচ। তারপর বলেছিল, ফেলে দাও। কোলবয় ফেলছে না, নিয়ে যাচ্ছে। তিনি ফের ধমক দিলে, সে ফেলে দিয়েছিল। তারপর চলে গেলে কাপ্তান কুড়িয়ে নিয়েছিল সাত রাজার ধন এক মাণিক, এবং জাহজে কেউ জানল না কাপ্তান বোকা বানিয়ে সব কেড়ে নিল। সে এমন বোকামি করছে না। মৈত্রেরও এমন একটা চালাকি মনে মনে থাকতে পারে। অমিয় বেশ ভাল করে তালা মেরে টেনে দেখল। না, এত সহজ নয় খোলা। কেবল একটা ভয় রয়েছে, যে কোনো সময় কাপ্তান সাফাইয়ে এসে এটা খুলে দেখতে পারেন। যা শোলার উপদ্রব হয়েছে! ওর লকারটার ভিতরে এখন যত আরশোলার রাজত্ব। রাজ্যের সব আরশোলা ওর লকারে জড় হয়েছে। চাবি পাচ্ছে না বলে খোলা যাচ্ছে না। গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। সব আরশোলা তাড়া খেয়ে ওর লকারে পালিয়ে আছে।

এবং লকারটা খুললেই সারা ঘরময় সেই আরশোলা উড়তে থাকে। যেন একটা দুটো না, অজস্ৰ এবং বেলুনের মতো হয়ে যায়, রং-বেরংয়ের বেলুন। বেশি উড়তে থাকলে বিপদ, সবার ঘরে উড়ে যাবে। কেউ তো জানে না, সব এসে এখন এই একটা লকারে আশ্রয় নিয়েছে। এত গ্যাসেও কোন ফল হচ্ছে না। এবং যেমন লকার খুলে দেখার একটা কাজ আছে অমিয়র, মালপত্র ঠিক আছে কিনা, না কেউ গেঁড়া মেরেছে, সবচেয়ে ভয় মৈত্রকে। যেভাবে টাকা টাকা করছে যে কোনো সময় ঠিক ফাঁক করে দিতে পারে—সুতরাং মাঝে মাঝে খুলে ফেলতে হয়, খুলে দেখার সময় আরশোলা উড়ে বেড়ালে আবার তাদের ধরতে হয়। ধরে ধরে একটা একটা করে ভরে রাখতে হয়! এখন তো কারো কেবিনে আর ছেড়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আগে সে বড়-মিস্ত্রির কেবিনে এইসব আরশোলা মধ্যরাতে ছেড়ে দিত। আপেল ডিম তোলার সময় ওর হাত থেকে পাখির মতো একটা একটা করে আরশোলা উড়ে যেত, যেন অজস্র পাখি এবং বোধ হয় অজস্র চড়াই, ছোট ছোট পাখি, উড়ে উড়ে অল্প আলোতে নানাবিধ ছায়া ঘোরাফেরা করলে একটা হাত এবং ঝুলন্ত হাত, পাশে কি রয়েছে, নেশার ভেতর চোখের পলক পড়ত না—সে এভাবে একটা মহৎ কাজ করেছে জাহাজে উঠে। শালাকে ভাগিয়েছে। এমন ভাবে সুন্দরী মেয়েদের কাঁচা মাংস খেতে সে কাউকে দেখে নি। টাকার জোর থাকলে সব হয় না।

সব হয় না বললে কি হবে, লাফিয়ে লাফিয়ে একটা একটা করে খপ করে ধরছে, আর লকারে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। খোঁয়াড়ে ছাগল ঢুকিয়ে দেবার মতো। সে ধরছে আর বলছে, টাকা! না টাকাই সব না। টাকা! টাকা আছে, সব আছে। প্রেমিকা আমার, মুক্তো আমার, আমি টাকা নিয়ে যাব। কত টাকার খাঁকতি দেখাব।

মৈত্র এ-সব দু-একদিন লক্ষ করছে, ছোটবাবুও লক্ষ্য করত। অমিয় বিড়বিড় করেছ বকছে। এখন মৈত্র ওপরে থাকলে, গোপনে লকার খুলে দেখলে এটা বেশি হয়। এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে তার লড়াই। যতদিন লড়াইয়ে না জিতছে ততদিন অমিয়র যেন শান্তি নেই। এ-সব কারণে জীবনপণ করে সে সামনাসামনি সেই অদৃশ্য শত্রুর ডামি পেয়ে গেলে লোভ সামলাতে পারে না। কব্জা করে তবে ছাড়ল। ছোটবাবুরও উপকার হয়ে গেল। ছ-নম্বর হয়ে গেল। তাহিতিতে ছোটবাবুকে একটা ভোজ দিতে হবে। না হলে অমিয় ছোটবাবুর পিছনেও লাগবে।

এ-সব মনে হলেই ওর মনে হয় অদৃশ্য সেই শত্রু মহান নায়কের মতো গোঁফ মুচড়ে মুচকি হাসছে। সে তখন স্থির থাকতে পারে না। জাহাজে উঠে এত দিন সে কাউকে বুঝতে দেয়নি, তার ভালবাসার মেয়েকে কেউ কেড়ে নিয়েছে। ঠিক কেড়ে নিয়েছে বললে ভুল হবে, যেন ইচ্ছে করেই সেই মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেল। কারণ, অমিয়র কি আছে! শরীর বাদে ওর কিছু নেই। বাউন্ডুলে, চুল বড়, দাড়ি ঠিক মতো কামায় না, স্নান করে না, কেমন এলোমেলো, তারপর মদ্যপান, কোথায় যে টাকা পেত বাংলা মদের। এ-সব নানা অজুহাত দেখিয়ে ফুস করে উড়ে গেল।

সে খপ করে আরশোলা ধরত আর বলত, টাকা! টাকা কামিয়ে একটা দ্বীপ কিনে ফেলব। তারপর চাষাবাদ। চারপাশে সমুদ্র দ্বীপের। দ্বীপের একপাশে উঁচু পাহাড়, পাহাড়ে একটা আমলকি গাছ থাকবে। তার নিচে ছোট্ট কুটির। নিচে বেলাভূমি, মৎস্য শিকারের অবাধ সুযোগ, পাশে ফুলের রাজত্ব, এক পাশে আঙুর ক্ষেত, পাশেই আঙুর পচিয়ে মদ, পাশেই আপেলের বাগান, পৃথিবীর যাবতীয় সুদৃশ্য গাছপালা এনে সে লাগাবে, তারপর সুন্দরী রূপবতী মেঘবরণ চুলের কন্যার হাতে ফুল দিয়ে বলবে, আমি পৃথিবী জয় করলাম।

আসলে সে চায় প্রতিশোধ। সে যে কত বড় তা দেখাতে চায়। সে এভাবে চারপাশে নানারকম কারুকার্যময় জীবন দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তাহিতিতেই সে প্ৰমাণ করবে, এগুলো কি। সে বলল, এই যাবি মৈত্ৰ!

—কোথায়?

—কি ভেবে বলল, না থাক। পরে বলব। মৈত্রকে অমিয় কিছু আর বলল না।

—কিছু বলছিস না যে?

—এই বলছিলাম ছোট নাই তো। খুব খালি খালি লাগছে।

—তা আর ভেবে কি হবে।

—ছোটর খারাপ লাগে না আমাদের ছেড়ে থাকতে?

—জিজ্ঞেস করে দেখ না।

—এখন তো কথাই বলতে পারি না। কোথায় যে থাকে!

—উইনচের নিচে পড়ে থাকছে।

এভাবেই জাহাজ যায়। আর ছোটবাবু উইনচের তলায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। দুলে দুলে জাহাজ যায়। আসলে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে মনে হয় আকাশটাই দুলছে। রাত হয়ে গেলে মনে হয় নক্ষত্র দুলছে। উইনচের নিচে শুয়ে তার মা-বাবার মুখ এবং সেই দূরদেশে রয়েছে জন্মভূমি, সব তরমুজের লতা, এবং বড় অশ্বত্থ গাছ এ-সবের ভেতর মনে পড়ে ছোট্ট এক মেয়ে—সে তো এখন ওর মতো বড় হয়ে গেছে। নাকে ওর নথ ছিল। ঠিক দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে ওর মুখ এখন আকাশের গায়ে ভেসে উঠছে। কি বড় নথ, আর কি বড় চোখে ওকে দেখছে। সারা আকাশময় শুধু নক্ষত্র! এখন কি মাস, এ-মাসে কি তার আগে পুজো হয়ে গেছে! আকাশের গায়ে প্রতিবিম্ব ভেসে উঠলে সুদূরের সেই দুর্গাপুজোর কথা মনে হয়। চারপাশে ড্যাং ড্যাং বাজনা বাজছে। কি যে হয়, কিসের বাজনা, কেন এতদূর থেকেও সে স্পষ্ট শুনতে পায় বাজছে, দুর্গাপুজোর বাজনায় সারা শরীর ওর ফুলে ফুলে উঠছে।

আসলে মায়ের কথা ভেবে ছোটবাবুর কান্না পাচ্ছিল। সে উইনচের নিচে শুয়ে গোপনে মায়ের জন্য কাঁদছে।

রাত আটটায় ডাইনিং হলে খাবার সাজানো হচ্ছে। একে একে সবাই নেমে আসছে। ওভাল সাইজের টেবিল, ধবধবে সাদা চাদর বিছানো। টুপির মতো ন্যাপকিন সাজানো প্রত্যেক চেয়ারের সামনে। সুন্দর কারুকার্য করা দেয়াল। দেয়ালে বিখ্যাত সব কাপ্তানদের ছবি। নিচে নাম। ব্যাংকলাইনের সব দুর্দান্ত কাপ্তানদের বড় বড় ছবি। মাঝখানে হিগিনসের ছবি। আর চারপাশে আলোর ফুলঝুড়ি। বিচিত্র সব আলোর বাহার। খেতে বসলে রেকর্ড চালিয়ে দেওয়া হয় কোনো দিন। মিউজিক বাজতে থাকে। ওরা নিভৃতে খায়। অথবা দুটো-একটা পুরানো কিংবদন্তী। সমুদ্রগামী জাহাজে দূর অতীতে কত কি সব সংস্কার ছিল, সে সব কথাবার্তা কাপ্তান সারাজীবন ধরে যেন মুখস্থ করে রেখেছেন সব। জাহাজি ঐতিহ্য এভাবে খেতে বসে কথাবার্তায় ধরা পড়ে। ছোটবাবু খাবার সময় কথা বলে না। কেবল শুনে যায়।

অথচ সবাই এসে দেখল, ছোটবাবু আসেনি। জ্যাকের খাবার এখন ওর কেবিনে যাচ্ছে। সে নিচে খেতে আসছে না। ডাইনিং হলে সে খেতে একেবারেই পছন্দ করছে না। জ্যাক যেভাবে পারছে মেজ- মিস্ত্রি আর্চিকে এড়িয়ে থাকতে চাইছে।

তখন ডেবিড খুঁজে খুঁজে আবিষ্কার করল ছোট উইনচের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোটকে অহেতুক কাজ দিয়ে রাখে মেজ মিস্ত্রি। সে কিছু বলতে পারে না। ধীরে ধীরে ডাকল, এই ছোট। শিগগির ওঠ। তুমি ঘুমোচ্ছ!

ছোট উঠেই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি আবার স্প্যানার বসিয়ে দিতে গেল নাটের ডগায়! খুব অন্যায় করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি নিজেকে সংশোধন করার সময় বুঝতে পারল না, ডেবিড এসেছে ওকে ডাকতে। সবাই ডাইনিং হলে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। রাত আটটা বাজে।

এবং যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব সে ছুটে গেল। তাড়াতাড়ি তো সব হয়ে ওঠে না। যতটা পারল হাত-পা পরিষ্কার করে হলঘরে ঢুকে দেখল, আর্চি বিরক্ত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভীষণ কুণ্ঠার সঙ্গে বলল, আমার দেরি হয়ে গেছে। দুঃখিত।

ডেবিড বলল, এত কাজ করছ, খেয়াল নেই!

ছোটবাবু বুঝতে পারল, ডেবিড ওর দোষ ঢাকছে। সে কিছু আর বলতে পারল না।

ছোটবাবু মেনু দেখল। ক্রিম ম্যাভি লোসে, ফিলেটস্ অফ হেক, ম্যাকসিকান রোস্ট, রিবস্ অফ বিফ্, রোফোর্ট, বয়েল প্যোটাটোজ, ফ্রেনচ্ বিনস, চকোলেট, পুডিং চিজ, কফি।

ছোটবাবু সব খাবার খেতে পারে না। সে বেছে বেছে খায়। বয়েলড্ প্যোটাটোজ চাক চাক কেটে নিল। ফ্রেন্‌চ বিন্‌স খেল সবটা। রোস্ট খেতে ও পছন্দ করে। সবশেষে সে খেল পুডিং কফি। খাবার পরও মনে হল, সে খায়নি। একটু ঝালঝোল ভাত ডাল কি যে প্রিয় তার। সে খেয়ে উঠে গেল। সে যে ভালভাবে খেতে পারে না ডেবিড বুঝতে পারে। যে ছেলেটা শৈশব থেকে অথবা জন্মাবধি একভাবে মানুষ, তাকে হঠাৎ অন্য জীবনযাপনে ফেলে দিলে যা হয়, এবং প্রায়ই দেখা যায়, খাবার টেবিলে ছোটবাবুর কোনও উৎসাহ থাকে না। যখন সবাই স্যুপ অথবা অন্য খাবার হুস-হাস খায়, তখন নীরবে ছোটবাবু এটা-ওটা বেছে খায়। কিছুটা খেয়েই প্লেট সরিয়ে রাখে।

এখন ছোটবাবুর কাজ একটু ভাতের ব্যবস্থা করা। ভাত-ডাল হলেই হবে। একটা শুকনো লংকা পুড়িয়ে নিলেও তার অমৃতের মতো মনে হবে। এবং যেটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে ছোটবাবুর ভাত না খেতে পেলে ঘুম আসতে চায় না। ভাল ঘুমোতে না পারলে, বেশি খাটতে পারে না। ভাঙা জাহাজে সারা দিনমান এটা-ওটা মেরামত লেগেই আছে। সাধারণ মেরামতের কাজগুলো সে-ই করে থাকে। কিছু কাজ আছে যেমন, বাল্ব ঘুরছে না, গ্যাস-পাইপ কাজ করছে না, উইনচের প্যানিয়ান জ্যাম, সেগুলো সহজ সাধারণ কাজ বলে সেই করে ফেলে। যত সহজ ভাবা যায়, পরিশ্রমের দিক থেকে তত সহজ নয়। সে সেই সকাল থেকে সারা দিনমান প্রায় ডেকে, বোটডেকে ছুটে ছুটে কাজ করে থাকে বলে, সব সময় মনে হয় পেট ক্ষুধায় জ্বলছে। আর ফাঁকে যদি আফ্‌ট-পিকে চলে আসতে পারে, তবে তো কথাই নেই, একেবারে চোরের মতো ভান্ডারিজ্যাঠার গ্যালিতে ঢুকে, জ্যাঠা তাড়াতাড়ি, একটু আলু ভাজা, ব্যাস, সে গোগ্রাসে খেয়ে প্যান্টেই হাত মুছে লাফিয়ে আবার কখন কাজে যায়, অফিসাররা বুঝতেই পারে না, ছোটবাবু আড়ালে খালাসিদের খাবার খেয়ে এসেছে।

আর এভাবে খেতে পেলেই সে ভীষণ ছুটে ছুটে কাজ করতে পারে। খাটতে পারে বেশি। রাতে তাকে জেগে থাকতে হবে, যদি মৈত্রদা, অমিয়, মনু কেউ এদিকে আসে! সে এলি-ওয়ে ধরে হাঁটতে থাকল। কেউ আসছে না। ওরা হয়তো ভুলে গেছে, সে জেগে অছে দুটো ভাত খাবে বলে।

তখনই অনিমেষ এল। একটা ছোট কলাই-করা বাটিতে ভাত। একটু মাংসের ঝোল। ছোটবাবু ঢাকনা খুলে শুঁকে দেখল—আহা কি সুন্দর ঘ্রাণ। ওর জিভে জল চলে এসেছে। এবং কেবিনে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। সে যতক্ষণ ভাল করে স্নান না করবে, যতক্ষণ পরিপাটি করে না খাবে, এবং চোখ বুজে বুজে হাড় চিবোবে, ততক্ষণ সে জাহাজ ডুবে গেলেও কেবিন থেকে নড়বে না। উদ্বাস্তু জীবনের মতো ভাত-ডাল, ভেড়ার মাংস তার কাছে আবার ভীষণ মহার্ঘ হয়ে গেছে।

সে কেবিনে ঢুকেই বেল টিপল। মেস-রুম বয় এসে ওকে সেলাম জানালে বলল, পানি। মেসরুম-বয় বড় কাচের জারে জল, গ্লাস, সব সাদা লতাপাতা আঁকা দামী তোয়ালে দিয়ে ঢাকা, টিপয়ে রাখল। বয় আসার আগে লকারে সে ভেড়ার মাংস আর ভাত লুকিয়ে রেখেছে। জলটাও চেয়ে নিল। নুন সে বেশি করে ছোট্ট একটা কাচের বোতলে রেখে দিয়েছে। ও, কি যে ভাল লাগছে! সে চারপাশে ভেড়ার মাংসের ঝাল-ঝাল গন্ধ পাচ্ছে। যেন এই কেবিনে অন্য ঘ্রাণ, কারণ সকালে স্প্রে করে দিয়ে যায় দামী সুগন্ধ, সব উবে গিয়ে শুধু মাংসের ঘ্রাণ, সে শিস দিতে থাকল। স্নান করল সাবান মেখে। জলের যখন যে-রকম দরকার, হট্, কোল্ড, সে শীত না পড়া পর্যন্ত ঠান্ডা জলের ট্যাপ খুলে স্নান করে। আয়নায় ওর শরীর, ওর স্বাস্থ্য ক্রমে ভীষণ মজবুত হয়ে যাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়ানোর অদ্ভুত স্বভাব হয়ে গেছে। কারণ, সে সব খুলে হাতের মাস, পায়ের মাল বিচিত্র অঙ্গভঙ্গীতে দেখতে দেখতে ভাবে, তুমি কি ছিলে ছোটবাবু কি হয়ে গেলে! ক্রমে দৈত্যের মতো হয়ে যাচ্ছ।

কখনও কখনও এভাবে স্নান করার সময় ছোটবাবুর শরীর দেখার নেশায় পেয়ে যায়। সে খুব কম সময় খালি গায়ে থাকে আজকাল। গরমেও সে পাঞ্জাবী-পাজামা পরে থাকে। বোধহয় আর্টি জানে না, ছোটবাবু শুধু লম্বাই নয়, মজবুতও। আর্চিকে তুলে সে জোরে আছাড় মারলে গুঁড়ো হয়ে যাবে।

সে এ-সব অবশ্য বুঝতে দেয় না। তোয়ালে দিয়ে চুল, ঘাড়, পিঠ, পেট এবং জংঘার জল ধীরে ধীরে শুষে নিল। পিঠে বুকে প্রায় নীলবর্ণের বনরাজিনীলা। ধীরে ধীরে প্রায় অঙ্কুর উদগমের মতো, নরম, বিন্দু বিন্দু জলকণা শরীরে লেগে থাকলে, সুন্দরী তরুণীদের কথা মনে হয়, পৃথিবীর কোথাও, সেই রূপবতী বালিকা বড় হয়ে উঠছে। চুল শ্যাম্পু-করা তার। লতাপাতা আঁকা ফ্রক গায়ে—এবং কোথাও হয়তো পাহাড়ের চড়াইয়ে সে সবুজ উপত্যকা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। কেন জানি মেয়েটার তখন একা একা এমন সবুজ শস্যক্ষেত্র দেখতে ভাল লাগছে না। মা-বাবা-ভাই-বোন সব থাকতেও মনে হচ্ছে তার কি নেই। ছোটবাবু চোখ বুজে প্রায় খেয়ে যাচ্ছিল—আর এমন সব রঙীন এক পৃথিবী, যেন ইজেলে কেউ এসে ছবি এঁকে যাচ্ছে আর ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। জ্যাককে সে বলতে পারে এখন, জ্যাক, মাঝে মাঝে একজন ফ্রক-পরা মেয়েকে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করে। তোমার করে না!

ভাত খেলেই ছোটবাবু জাহাজে সুখী মানুষ হয়ে যায়। সে আর দুঃখী রাজপুত্র থাকে না। সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে।

সে শুয়ে শুয়ে কখনও এভাবে সুখী রাজপুত্রের মতো স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। জাহাজে ওঠার পর স্বপ্ন দেখলে—যা দেখত, কখনও সে হাতীতে চড়ে যাচ্ছে। একটা মরা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। পেছনে একটা কুকুর আসছে, হাতীর সামনে কেউ বসে রয়েছে, যেমন দীর্ঘকায় তিনি, তেমনি চওড়া, তাকে নিয়ে তিনি কোথায় যেন চলে যাচ্ছেন। আবার সে দেখতে পেত, নদীর চরে অনেক উঁচুতে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, কিংবদন্তীর মতো মানুষ তিনি, কখনও মনে হতো, আসলে তিনিই সেই মোজেস, বাইবেলে বর্ণিত মানুষ। তিনি, যতদূরে নৌকা নদীতে ভেসে যাচ্ছে, ততদূরে যেন হাত তুলে দিতে পারছেন। যত দূরে চলে যাচ্ছে নৌকা, তত হাত ওপরে উঠতে উঠতে আকাশ ছুঁয়ে দিতে চাইছে। তত গাছ-পালা, বন-উপবন, এবং নদীর বাঁক পেরিয়ে ছোটবাবু স্বপ্নে দেখত, হাতটা অনেক দূরে অনেক উঁচুতে ঝুলে আছে। জ্যাঠামশাই চিৎকার করে বলছেন, এবারে ফিরে যাও। আর আসতে হবে না। অনেকটা সারেঙ-চাচার মতো তাঁর মুখ, সেই মানুষ ছিল ওদের পরিবারের একান্ত মানুষ। স্বপ্নে সে তাঁকেও কতবার যে দেখেছে!

ভোর রাতের দিকে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে আজও ছোটবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। জেগে গিয়ে স্বপ্নটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছে না। আর কি যেন হয়ে গেল! শরীরে এক আশ্চর্য ঘ্রাণ আছে সে এই প্রথম টের পেল। সুন্দর শরীরে এসব নির্গত ধারা, শরীরের ভেতরে জেগে থাকে সে জানত না। আশ্চর্য উষ্ণতা সারা শরীরে রিন-রিন করে বাজছিল। তারপর মনে হয়, রঙের কোমল কণিকারা প্রায় ভূমিকম্পের মতো আলোড়ন তুলে বের হয়ে এসেছে। সে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে জংঘার পাশে এবং উরুর কাছাকাছি জাঙ্গিয়ার ভেতরে কি সব এলোমেলো ব্যাপার, প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার সামিল- সে উঠে বসে—কেমন অবোধ বালকের মতো কি করবে ভেবে পায় না। মৈত্রদাকে দেখেছে, দেখে সাহস জন্মেছে। অমিয়কে দেখেছে, দেখে বুঝতে পেরেছে সত্যিকারের পুরুষ মানুষ হয়ে গেলে এটা হয়। কিছুতেই তাকে বাধা দেওয়া যায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু ছোটবাবু ঠিক ঠিক মনে করতে পারছে না, কি দেখে স্বপ্নে সে প্রথম নষ্ট হয়ে গেল। যতদূর মনে করতে পারে, অস্পষ্ট কুয়াশার ভেতরে কোনো বালিকার মুখ সে দেখেছিল। সে দু’হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে আছে। স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করছে। বালিকার কথা ভাবতে তার ভাল লাগছে। এবং খুব নিবিষ্ট হলে বুঝতে পারে প্রথমে এই জাহাজ কেমন ভাঙা পালবিহীন, এবং জাহাজটা ওর পূর্ববঙ্গের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকাল, ধান গাছে কীট-পতঙ্গেরা উড়ছে। সে আর কাপ্তান লগি মারছেন। ঠিক গাদা-বোটের মতো অতিকায় জাহাজটাকে বর্ষার ধান-খেতের ওপর দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। ওর মা বাঁশঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাঠিমা জ্যাঠামশাই সবাই দাঁড়িয়ে আছেন। সে সেই পালবিহীন অতিকায় জাহাজ স্বপ্নে ঠেলতে ঠেলতে একটা খালের ভেতরে নিয়ে ফেললে, দুটো একটা ধান-পোকা, সোনা-পোকা এবং বর্ষায় কীটপতঙ্গ জাহাজের গলুইয়ে উঠে আসছে। আর কি হয়েছিল তখন, একটা সোনা-পোকা ধরতে গিয়েই কি যেন হয়ে গেল, আমারে দ্যান, আমারে দ্যান সেই বালিকার মুখ। ট্যাবার পুকুরপাড়ে জঙ্গলটা পর্যন্ত স্বপ্নে সে দেখে ফেলেছে। আর কি আশ্চর্য, দু-লাফে সোনা-পোকা নিয়ে সে দৌড়াচ্ছে। সেই আমারে দ্যান, আমারে দ্যান মেয়েটাও দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে কি যে হয়ে যায়, দৃশ্যাবলী পাল্টে যায়, সমুদ্রের ঢালু উপত্যকায় নেমে যাচ্ছে কেবল, কেবল গড়িয়ে সেই বালিকা আর সে পড়ে যাচ্ছে, আর তখনই স্বপ্নের ভেতর থেকে ফ্রক- পরা অন্য একটা মেয়ে উঠে আসছে। সাদা সার্টিনের ফ্রক, পায়ে স্কেটিং পরে একেবারে দ্রুতগতিতে ওকে লুফে নিয়ে চলে গেল। তারপর সেই সমুদ্রে তুষার-বৃষ্টি—সমুদ্রে তুষারপাত—রিন রিন করে বাজছে। নীল বরফের উপত্যকায়, তুষারপাতের ভেতরে সাদা পোশাকে মেয়েটা অনবরত ছোটবাবুকে নিয়ে নাচছে। ছুটছে। খেলছে। প্রায় মাতালের মতো পড়তে পড়তে ঠিক সোজা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আবার ঘুরে ঘুরে রিন রিন বাজনার মতো ধীরে, খুব ধীরে স্কেটিং করে যাচ্ছে। কখনও লাফিয়ে বরফের পাহাড় পার হয়ে, কখনও নীল জলের হ্রদ পার হয়ে সুন্দর একটা পাইন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গোপনে চুমো খাচ্ছে। ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে মনে করতে পারছে ছোটবাবু, ভূমিকম্পে সেই কোমল সাদা কণিকারা লাভার মতো ছুটতে ছুটতে বের হয়ে এসেছে।

কিন্তু ছোটবাবু বুঝতে পারছে না, সাদা সার্টিনের ফ্রক-পরা মেয়েটিকে কোথায় সে দেখেছে। চেনা, চেনা, খুবই চেনা মুখটা অথচ মেলাতে পারছে না। তারপরই সে ভয়ে গুটিয়ে গেল—সেই মেয়ে, সে মনে করতে পারছে, স্বপ্নে সেই মেয়ে সার্টিনের ফ্রক গায়ে পাইনের নিচে তাকে নষ্ট করে দিল। আর মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর স্বপ্নটা তার কাছে ভীষণ দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল। সে মুখ ব্যাজার করে উঠে গেল বাথরুমে। বাথরুম থেকে পোশাক পাল্টে, পোর্ট-হোল খুলে দিল।

তখনই সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা জাহাজে ঘটে গেছে। ছোটবাবু টেরও পায়নি। জ্যাক এসে ছোটবাবুর দরজায় মাথা কুটছে প্রায়।—শিগগির ছোটবাবু। শিগগির উপরে এস। সব আমাদের শেষ হয়ে গেল।

ছোটবাবু পাগলের মতো ছুটে গেল দরজায়। তারপর দরজা খুলে দিলে শুনল, জ্যাক বলছে, মিসেস স্প্যারো ডেড। আর কিছু বলতে পারছে না। চোখ প্রায় স্থির। ছোটবাবুকে অবাক হয়ে দেখছে। ছোটবাবুর শরীরে নতুন ঘ্রাণ। আর সঙ্গে সঙ্গে চোখের ওপর থেকে সমস্ত কুয়াশা সরে যাবার মতো চেঁচিয়ে বলে উঠল, মিসেস স্প্যারো ডেড। তারপর কেমন ধীরে ধীরে বলে গেল জ্যাক, লেডি এ্যালবাট্রস ছোঁ মেরে তুলে নিল, আমরা কিছু করতে পারলাম না ছোটবাবু। সে বালকেডে হেলান দিয়ে মৃতপ্রায় দাঁড়িয়ে থাকল। আর কিছু বলতে পারছে না।