।। আটচল্লিশ।।

স্যালি হিগিনস নিচে আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। ছোটবাবুকে সবাই মিলে ডাকাডাকি করছে। ছোটবাবু দরজা খুলছে না। দরজা ভাঙার আগে সবাই এই যেমন ডেবিড, এনজিন সারেঙ বন্ধু জব্বার বার বার বলেছে, ছোট দরজা খোল। তোর কি হয়েছে! এভাবে তুই শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়লি! ছোটবাবু কোনো জবাব দিচ্ছে না। স্যালি হিগিনস এক মুহূর্ত এখন সময় নষ্ট করতে পারেন না। এনজিন-সারেঙকে শেষ পর্যন্ত দরজায় পাহারা রেখে ওপরে উঠে গেছেন। সব অফিসারদের ডেকে পাঠিয়েছেন। সবাই এলে তিনি সাদা কাগজে পেনসিলে প্রথম বড় বড় তিনটে দাগ কেটে ফেললেন। যেহেতু সব চাৰ্ট, ওসেনোগ্রাফি সংক্রান্ত বই, লগ-বুক সেকসটান, চার্ট-রুমে থাকত অর্থাৎ জাহাজ চালাবার পক্ষে যা কিছু প্রয়োজনীয় সব এখন সমুদ্রগর্ভে—তিনি কিছুমাত্র বিচলিত বোধ না করে খুব সহজভাবে দাগ কেটে জাহাজের অবস্থান মোটামুটি নির্ণয়ের চেষ্টা করার সময় বললেন, আপনারা বুঝতে পারছেন আমরা লয়ালটি দ্বীপের কাছাকাছি কোথাও আছি। জাহাজটা সম্ভবত স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। এবং সম্ভবত দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতে জাহাজ ড্রিফটিং হচ্ছে। সামোয়া থেকে পোর্ট-মেলবোর্ণের দূরত্ব ধরুন প্রায় দু’হাজার তিনশ বিশ মাইলের মতো। জাহাজ প্রায় দশ দিন রান করেছে। সুতরাং অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে প্রায় বারোশো মাইলের দূরত্বে রয়েছি ধরে নিতে পারি। ঝড়ে যদি সাউথ-ইস্ট-ইস্টে কিছু এগিয়ে যাই দূরত্ব ধরে নিতে পারি সামান্য বেড়ে গেছে। আপনারা কি বলেন?

চিফ-মেট বলল—স্যার, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

—কিছু না বুঝলে এ সময় চিফ-মেট আমাদের চলবে না। যখন আমরা বুঝতে পারছি জাহাজ থেকে নেমে পড়া বোকামি হবে—তুমি ডেবিড কি বুঝছ! সহসা কথা শেষ না করে তিনি ডেবিডকে প্রশ্ন করলেন।

ডেবিড বলল—মাথা স্যার ঠিক নেই। মাথায় কিছু আসছে না।

স্যালি হিগনস বললেন—মানুষকে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি শক্ত থাকতে হয়। আচ্ছা ছোটবাবুটা কি! ওকে আমি ভেবেছিলাম এ সময়ে আমাদের বেশি কাজে আসবে। থার্ড, তুমি সব দেখছ ত?

থার্ড-মেট ঝুঁকে বলল—হ্যাঁ। শেষে বলতে চাইলেন হারামজাদা তুমি তবে জানতে সব।

স্যালি হিগিনস দরজার বাইরে একবার ঝুঁকে কি দেখলেন, অর্থাৎ জাহাজে কাজকর্ম ঠিক হচ্ছে কিনা। কারণ এ-সময়ে কাজকামে জড়িয়ে না রাখলে সবার অবস্থা ছোটবাবুর মতো হয়ে যাবে।

তখন ডেক-কশপ বড় বড় সব রঙের টব খালি করে দিচ্ছিল আর মাঝে মাঝে ইনসে আল্লা বলছিল। কাজ করতে করতে সে সোজা ডেকে উঠে নামাজের ভঙ্গীতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। স্যালি হিগিনস ওপর থেকে চিৎকার করে উঠলেন, হাই। কি হচ্ছে? কাজ কাজ। ঈশ্বরকে ডাকার অনেক সময় পাবে। স্টুয়ার্ডকে ডাকো ডেবিড

স্টুয়ার্ড এলে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন—সব বের করে দিচ্ছ তো?

স্টুয়ার্ড সালাম জানিয়ে বলল—হ্যাঁ স্যার। হ্যাম মটন বিফ টার্কি যা কিছু স্টক আছে সব তুলে দিয়েছি ওপরে।

হিগিনস বললেন—ক্যাবেজ কতটা আছে?

—স্যার স্টক বুকটা নিয়ে আসছি।

—ননসেন্স! ভয়। আরে এখন তোমাকে আমি স্টক মেলাতে বলছি না। যা কিছু খাবার আছে এক ফোঁটা নষ্ট হলে জাহাজ থেকে ফেলে দেব বললাম।

—ক্যাবেজ কি হবে স্যার?

—তুলে দাও ওপরে, কেটে সব শুকোতে দাও। তখন তিন-নম্বর মিস্ত্রি ছুটে এল। বলল – চারটা জায়গা করেছি। হয়ে যাবে মনে হয়।

—কোথায় কোথায় করেছ?

—দু’টো ফোর-মাস্টের দু’পাশে আর দু’টো মেন-মাস্টের দু’পাশে।

—বাড়াতে পারছ না?

—আর সব তো কাঠের স্যার। ড্রামে আগুন জ্বললে কাঠের ডেক পুড়ে যেতে পারে।

—বোর্ট-ডেকে বয়-কেবিনের পাশে একটা জায়গা করতে পার।

একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছে মতো বলল—তা স্যার ঠিক বলেছেন। ভাণ্ডারীদের বল যা বিফ আর মটন আছে যতটা পারে যেন বয়েল করে ফেলে। বরফ-ঘরে তোমার কিছু রাখা আর ঠিক হবে না। পচে যাবে সব। তারপর স্টুয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন—এক টুকরো খাবার নষ্ট হলে তুমি মারা পড়বে স্টুয়ার্ড। এখন তুমি যেতে পার। তারপর তিনি চিফ-মেটকে বললেন—তবে এটা আমরা বুজতে পারছি স্রোতের মুখে জাহাজ ঘুরে না গেলে কোনো দ্বীপ-টিপ ঠিক পেয়ে যাব। আর মনে হচ্ছে ঠিক কোনো জাহাজের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে! শুধু ভয়, আমরা স্রোতের মুখে পড়ে না যাই। স্রোতটা যদি সাউথ-ইস্ট-ইস্টে তুলে নিয়ে যায় ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন বলতে হবে। চারপাশে অজস্র দ্বীপ-টিপ পেয়ে যাব। পাঁচ-সাতশ মাইলের ভেতরই পেয়ে যেতে পারি। চিফ-মেট কাপ্তানের কথার বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে পারছে না। বললে যেন শোনাতো, আপনার কি মাথা খারাপ স্যার। সমুদ্রে পাঁচ-সাতশ মাইল চাট্টিখানি কথা। শুনে তো মনে হয় পাশেই একটা দ্বীপ রয়েছে। আমরা দ্বীপে যেন একেবারে নেমে যাচ্ছি। কিন্তু বুড়োর মুখের ওপর কথা বলার সাহস তার নেই। সন্তান-সন্ততিদের মুখ স্ত্রীর মুখ ভেসে উঠলে ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে যাচ্ছে, অথচ কথাবার্তায় কিছু হয়নি মতো থাকতে হচ্ছে। সে বলল—তা স্যার পেয়ে যাব মনে হচ্ছে।

—সুতরাং খুব ঘাবড়ে যাবে না। আরে জাহাজ তো সিউল-ব্যাংক। তোমাদের বলছি—ভীষণ বিশ্বস্ত জাহাজ। এতগুলো জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করবে মনে হয় না।

তারপর তিনি ফের বললেন—যদি ধরো নিরক্ষস্রোতের ঘূর্ণিতে পড়ে যাই তবে আমরা ঠিক কারমাদা দ্বীপের পাশ দিয়ে যাব। ওটা একটা অবশ্য আশার কথা। আর একটা কথা মনে রেখ, স্রোত কখনও ঠিক থাকে না। আমরা এমন সব চোরাস্রোতে পড়ে যেতে পারি যে দেখবে হয়তো জাহাজ যেখানে যাবার ঠিক সেখানেই চলে যাচ্ছে।

ডেবিডের দাঁত শক্ত হয়ে যাচ্ছে। পাগল! পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে। সব আজগুবি কথাবার্তা স্রোতে আর জাহাজ কতটা ঠেলে নেবে। জাহাজ তো প্রায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেমন কাঠের গুড়ি ভেসে থাকে তেমনি ভেসে আছে। একটু নড়ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। চিফ-মেট আপনিই বা কেন সব কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছেন। বলতে পারছেন না বোট দিয়ে দিন আমরা নেমে যাই। অন্তত আর কিছু না হোক বোটে আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পারব।

স্যালি হিগিনস ফের উপুড় হয়ে পড়লেন তিনটে দাগের ওপর। মানচিত্র তৈরি করে ফেলেছেন। মে-জুন মাসে কোথায় কোন সমুদ্রে কি স্রোত কি আবহাওয়া কোথায় উচ্চচাপ কোথায় নিম্নচাপ এবং বাতাসের প্রভাবে জাহাজ কতটা কোনদিকে ভেসে যেতে পারে মোটামুটি তার একটা হিসেব দিয়ে বললেন, যদি জাহাজ আমাদের স্রোতের মুখে পড়ে সোজা দক্ষিণে চলতে তাকে তবে নিউজিল্যাণ্ডের উপকূল পেয়ে যেতে পারি। ওটা ধরুন প্রায় আঠারশ মাইলের মতো হবে।

বেজন্মার বাচ্চা হিসাব শেখাচ্ছে। ডেবিড চিৎকার করে উঠতে চাইল। তারপরই মনে হল একজন যথার্থ নাবিকের পক্ষে এত সহজে ভেঙে পড়া ঠিক না! দুর্বল মানুষের মতো সে ব্যবহার করতে পারে না। ছোটবাবু এখনই তুমি এত ভেঙে পড়লে! আর মা বাবা বুঝি আমাদের নেই, দেশে আমাদের কেউ নেই! কেবল তুমি নিজের কথা ভেবে দরজা বন্ধ করে বসে আছ!

স্যালি হিগিনস বললেন, যদি কোনো কারণে জাহাজের গতি সাউথ অথবা সাউথ-সাউথ-ইস্টে ঘুরে যায় তবে ভাববার কথা এবং যেন মুখে এসে গেছিল, জাহাজ তবে নির্ঘাত সাউথ-ইস্ট থেকে ক্রমে ইস্ট-সাউথ-ইস্টে উঠতে উঠতে একেবারে সোজা পূবমুখে ছুটতে থাকবে। তখন আমরা পাঁচ হাজার মাইলের আগে কোন ভূখণ্ড পাব না। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে জাহাজ যেতে যেতে আমরা মরে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাব। তিনি একেবারে অন্য কথায় চলে এলেন, চিফ দেখবে কেউ যেন বসে থাকতে না পায়। বসে থাকলেই শয়তানের বাসা হয়ে যাবে।

চিফ বলল, সে দেখছি স্যার।

এবং সবাই নেমে গেল নিচে। বোট-ডেক ধরে হাঁটার সময়, ডেবিড, চিফ মেটকে বলল, কি বুঝছেন স্যার।

—বুড়ো নিজেই একটা শয়তানের বাসা। ওর ভরসায় থাকলে সবাই মারা পড়ব। আমাদের গোপনে বসার দরকার। এবং চারপাশে সমুদ্রে নীলাভ জল আর অন্তহীন দিগন্ত দেখে সবাই কেমন হাহাকার করে উঠল। ডেকে উঠে এলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসছে। সমুদ্র কি ভয়ঙ্কর কি যে শূন্যতা নিয়ে গ্রাস করার মতো উদ্যত হয়ে আছে। এই মহাশূন্যের ভেতর ওরা না জানি কত দিন ভেসে বেড়াবে। একটা কথা আর কেউ বলতে পারছে না। সূর্য মাথার ওপর উঠে আসছে। আপন মহিমায় তেমনি কিরণ দিচ্ছে। কি শান্ত জলরাশি! সব মাছের ঝাঁক বড় চক্রাকারে ভেসে আসছে। যেন জাহাজটাতে মাংসের গন্ধ পেয়ে গেছে সমুদ্রের অতিকায় সব প্রাণীরা। সব ধেয়ে আসছে। কে বলবে মধ্যরাতে জাহাজটা ঝড়ে তার সব সামর্থ্য হারিয়েছে। মধ্যরাতে সমুদ্র শেষবারের মতো তাদের পঙ্গু করে দিয়ে গেছে। সমুদ্রের শান্ত জলরাশি দেখলে এখন বিশ্বাস করা যায় না তার কোনো দুঃখ অথবা ক্রোধ আছে। বরং দুরন্ত বালিকার মতো ভারী মিষ্টি হাসি হাসছে। ছোট ছোট ঢেউ-এর ভেতর এমন সব সমুদ্রের দুরন্তপানা এবং উজ্জ্বল রোদ নীলাভ জলে বর্ষার ফড়িঙের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।

.

তখন কাপ্তান-বয় বলল, আপনি জানেন না সাব!

—না তো!

—ওপরে থাকেন শুনতে পাননি!

বনি বলল, সত্যি ভাবতে পারিনি। ছোটবাবু এমন করবে আমি কি করে ভাবব। সে তাড়াতাড়ি প্রায় সবটা কফি একবারে গিলে ফেলার মতো খেয়ে ফেলল। পায়ে স্লিপার গলিয়ে সে ছুটে নেমে গেল। কেবিনে গোপনে লুকিয়ে আয়নায় মুখ দেখে বুঝেছিল কিছু নখের আঁচড় ওর মুখে স্পষ্ট। বাইরে বের হতে সংকোচ ছিল তার। এখন সে সব ভুলে নিচে নেমে গেল। এনজিন-সারেঙ দাঁড়িয়ে আছেন। সে তখনও কত কথা বলে যাচ্ছিল। একটা কথা বুঝতে পারছে না বনি। বনি ফিফিস্ গলায় ডাকল, সারেঙ! সারেঙ-সাব কাছে গেলে বলল, ও কি বলছে?

—তা তো জানি না সাব। কি বলছে জানি না তো! মাইজলা মালোম ডেবিড বলল, ছেলে হাউ হাউ করে কাঁদছে। কোথায় কাঁদছে! আমি তো এসে দেখছি ভেতরটাতে কেউ রা করছে না। কখন কাঁদল! কত ডেকেছি, বলছে কেবল, আপনি যান চাচা আমার কিছু হয়নি। কিছু হয়নি তো দরজা বন্ধ করে আছিস কেন! দরজা খোল। দেখি ভয়ে চোখমুখের কি অবস্থা! আরে বাপু নসিব তো পালটাতে পারবি না। বার বার বলেছিলাম সাব, ছেলে ভেবে দেখ যাবি কিনা! ভাঙা জাহাজ, পুরোনো, কত দুৰ্ঘটনা ঘটতে পারে—কথা শুনল না। জেদ। জেদ ধরে চলে এল জাহাজে। আর আমার কি দুর্মতি হল সাব, যদি না নিয়ে আসতাম ঘরের ছেলে ঘরে থাকত আমাকে কলঙ্কের ভাগী হতে হত না।

এসব কথা ছোটবাবু শুনছিল ভেতর থেকে। ওর চোখে জল চলে আসছে। চাচা কার সঙ্গে এতসব কথা বলছে। বরং জ্বালা এই যেমন সে ভেবেছিল তার পরিবারের আশ্চর্য এক পরিমণ্ডলের ভেতর সে মানুষ। তার বাবা মা, পাগল জ্যাঠামশাই, ঈশম অথবা ফতিমা এবং দুর্গাপূজার সময় অমলা কমলা অথবা সেই যে বনের ভেতর কখনও হারিয়ে যাওয়া, পাগল জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে গিয়ে কখনও সোনালী বালির নদীর চরে, কখনও হাতীতে চড়ে সে আর জ্যাঠামশাই, পৃথিবী আর আকাশ তখন কত বড় হয়ে যেত তার কাছে। কিংবা সেই অর্জুন গাছে সে যে লিখে রেখেছিল জ্যাঠামশাই আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি। তার নিরুদ্দিষ্ট জ্যাঠামশাইর জন্য সে অর্জুন গাছে একটা বার্তা রেখে এসেছিল —সব অধিকার থেকে সহসা মনে হয়েছিল সে বঞ্চিত। একজন হত্যাকারী মানুষের জন্য যেন ওরা আর তার নয়। ছোটবাবু ভারী অসহায় বোধ করেছিল। সে কেঁদেছিল। আর যা হয় ভেতরে সেই দাহ—বনি যেন তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বলছে—ছোটবাবু তুমি খুনী আসামী। তোমার আর কোনো পরিচয় নেই।

সারেঙ-সাব তখনও অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। দেখুন সাব আপনি যদি পারেন। আপনাকে তো ভয় পায়। আমাকে তো আর ভয় পায় না। আমাকে মানবেই বা কেন। কত বললাম ছেলে ঘাবড়ে যাবি না। আল্লা মুবারক। ওর ওপরে তো কিছু নাইরে। তাই বলে ভয়ে মাথা খারাপ করে ফেললি! লোকে হাসাহাসি করবে না! লোকে হাসাহাসি করলে আমার সম্মান থাকে কোথায়! তুই তো কিছু বুঝলি না ছেলে, সবাই মুখে রক্ত তুলে খাটছে তুই এখন বসে থাকতে পারছিস ছেলে!

ছোটবাবু আর পারছে না। সে বসেছিল দু’হাতে মুখ ঢেকে। এত কথা কার সঙ্গে বলছে চাচা! সে হঠাৎ টেনে দরজা খুলে বলল, কি হয়েছে আপনার কেবল সেই থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছেন! সারেঙ- সাব বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করলেন না। সরল হাসি মুখে ফুটে উঠল। বললেন, ছোটসাব পর্যন্ত এসে গেছে। তুই চল ছেলে, ডেকে চল। সবার সঙ্গে থাকলে মন ভাল থাকবে। আমার সোনা, লক্ষ্মী মানিক চল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটবাবুর ফের বুক বেয়ে কান্না উথলে উঠল। সে সোনা ছিল, জাহাজে ছোটবাবু হয়ে গেল। এখন সে ম্যান হয়ে গেছে। সারেঙ-সাব পাশে দাঁড়িয়ে তখন বলছেন, ছেলে তোর কি হয়েছে? এভাবে ছেলে-মানুষের মতো কাঁদছিস কেন? আমরা সবাই দেখবি বাড়ি ফিরে যেতে পারব। ছেলে আল্লার কাছে আমার এত গুণাহ জমা নেই, সমুদ্রে তোকে আমার হারাতে হবে।

ছোটবাবু বলল আপনি যান চাচা আমি যাচ্ছি। ছোটবাবু বনির দিকে তাকাল না। ছোটবাবু ফের বলল, আপনি ভাববেন না চাচা। আমার কিছু হয়েছে ভাববেন না। বাড়ির কথা মনে পড়ে গেছিল। কেন যে মাথাটা গোলমাল হয়ে গেল বুঝলাম না। সারেঙ-সাব পিছিলে চলে গেলে ছোটবাবু খুব শক্ত হতে চাইল ভেতরে। সে বনির দিকে তাকাল না পর্যন্ত। বনি পাশে বালকেডে হেলান দিয়ে আছে। সে ছোটবাবুর দিকে মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। ছোটবাবুর পিঠ ঘাড় লম্বা চুল দেখতে পাচ্ছে। আর কিছু না। একবারও তাকে মুখ ঘুরিয়ে দেখছে না ছোটবাবু। সে ভাবল, ডাকবে, ছোটবাবু তোমার কি হয়েছে! কিন্তু ছোট আবার বেশি সাহসী, ছোটবাবু যেন এক্ষুনি দরজা লক করে ডেকে বের হয়ে যাবে। যারা ড্রামে কয়লার বড় বড় উনুন তৈরি করছে, যারা কাঠের ঠেকা তৈরি করছে এবং যারা এখন প্রায় আস্ত গরু অথবা ষাঁড়ের শুয়োরের হতে পারে ভেতরে লোহার শিক ঢুকিয়ে প্রাচীন বন্য মানুষের মতো ডেকে আগুন জ্বেলে ভেড়া গরু হাঁস মুরগী রোস্ট করার ব্যবস্থা করছে, অর্থাৎ এখন সব মাংস পুড়িয়ে গুদামজাত করে রাখা, কতদিন এ-জাহাজ নিখোঁজ হয়ে থাকবে কেউ জানে না।—ছোটবাবুও জানে না, ছোটবাবু যাচ্ছে সে-সবে হাত লাগাতে। সকালে সে একটা সিন ক্রিয়েট করেছিল ভাবতেই সে আর যেন সঙ্কোচে পায়ে জোর পেল না।

ছোটবাবু চলে যাচ্ছিল ভেতরে। বনি ছোটবাবুর হাতে হাত বাড়িয়ে দিল। ছোটবাবু তাকাচ্ছে না। ছোটবাবু এক পা ভেতরে রেখেছে, আর এক পা বাইরে। বনি ওর ডান হাত ছুঁয়ে রেখেছে। কিছুতেই হাতটা আর টেনে নিতে পারল না। সে কেমন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বনি হাত ছেড়ে না দিলে ক্ষমতা নেই সে এখন কেবিনের ভেতর ঢুকে যায়। এত সে দুর্বল হয়ে যায় কি করে! কোথায় সেই আশ্চর্য রহস্যময়তা। ডেকে ভীষণ মাংসপোড়া গন্ধ উঠছে। ডেকে আগুনের ভেতর সব শিকে গেঁথে মাংস পোড়ানো হচ্ছে। গরু শুয়োর ভেড়া হাঁস মুরগী। পাঁচটা লোহার পিপের ভেতর আগুন জ্বলছে আর লোহার শিকে গোঁজা প্রায় আস্ত ঠ্যাং শিক-কাবাবের মতো রোস্ট হচ্ছে সব। আর তখন ছোট-বাবুর হাত সামান্য ছুয়ে আছে বনি। কি আশ্চর্য অধিকার। কিছু বলছে না। কোনো কথা বলছে না। কোনো আবদার অথবা অভিমান নেই। তুমি যেখানে আছ ছোটবাবু আমিও সেখানে আছি। যা কিছু পাপ সব আমার তোমার। তুমি একা কেঁদে পাপ থেকে রেহাই চাইবে সে হবে না ছোটবাবু। আমরা দু’জনে মিলে সব পাপের অধিকার বহন করব। সামান্য হাত ছুঁয়ে রেখে রনি এতবড় কথা বলে ফেললে ছোটবাবু এই প্রথম বনিকে টেনে ভেতরে নিয়ে প্রথম বুকে জড়িয়ে নিল। বলল, বনি মাই লিটল্ বনি। মাই ডার্লিং। আলিঙ্গনে অলিঙ্গনে একেবারে পাগল করে দিল। চুমো খেতে খেতে কোথায় কিভাবে যে জীবনের সব আকাঙ্খা ফুটে ওঠে ছোটবাবু জানে না।

সহসা বনি চিৎকার করে উঠল, ছোটবাবু প্লিজ দরজাটা বন্ধ করে দাও।

ছোটবাবু অবাক। দরজা খোলা ছিল। সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে যেই না ফিরে এল একেবারে আলাদা মানুষ। কেমন এক বিস্ময় অথবা বলা যেতে পারে সংকোচ—সে এটা কি করতে যাচ্ছিল! বনি তো তার কেউ নয়। সে আর্চির মতো কি সব করতে যাচ্ছিল! অমানুষ হয়ে গেলে তার আর অহঙ্কার বলতে কিছু থাকে না। সে বনির পাশে চুপচাপ বসে পড়ে বলল, বনি সত্যি আমার মাথার ঠিক নেই। তুমি রাগ কর না। তারপর সে বের হয়ে গেল। বনির সমস্ত চোখে উদগত অশ্রু। ছোটবাবু তুমি আমাকে কতভাবে অপমান করবে। তুমি আমাকে ছোটবাবু কি ভাবো…। আমার কি কোনো দাম নেই। আমি এতই খারাপ…?

ছোটবাবু বাইরে এসে অবাক। ওকে আসতে দেখে জব্বার লাফিয়ে প্রায় চলে আসছে। সারেঙ- সাব আসছে। বন্ধু এবং কেউ কেউ যাদের কাজ এখন আগুনে মাংস ঝলসে ফেলা এবং যারা হাতে ধারালো ছুরি রেখেছে, যখন তখন খুশিমাফিক ঝলসানো মাংস সামান্য কেটে মুখে ফেলে দিচ্ছে, সব ফেলে তারা চলে আসছে। বেশ একটা নতুন পরিবেশ জাহাজে। এবং সিউল ব্যাংক স্থির। সব রেশন জাহাজের সীজ করে ফেলেছে কাপ্তান। ক্রুদের জন্যে সামান্য রসদ বের করে দেওয়া হয়েছে। এই যে সব মাংস ঝলসে রাখা হচ্ছে, কারণ এভাবে মাংস ঝলসে না রাখলে বিকেল থেকেই জাহাজে দুর্গন্ধে টেকা যাবে না। দু- চারদিন সবাইকে কেবল মাংস খেয়ে থাকতে হবে পুরোপুরি। ভাণ্ডারীরা বড় বড় ডেকচিতে যতটা পারছে মাংস খণ্ড খণ্ড করে সেদ্ধ করছে। আর যা হয় ঐ প্রলোভনে পড়ে সমুদ্রের সব বড় বড় হাঙ্গর কি যে অতিকায় তারা জাহাজের চারপাশে জড়ো হয়েছে, সমুদ্রের অতলে নেমে যাচ্ছে, আবার মুখ ভাসিয়ে রেখেছে। ভারি মনোরম গন্ধ। কেউ কেউ জলে বড় বড় কাঠের বাড়ি মারছে হাঙ্গরের মাথায়। চারপাশের সমুদ্রে বীভৎস দৃশ্য। সব ঝাক বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীল রঙের পিঠ সাদা রংয়ের পেট। খুশীতে মাঝে মাঝে উল্টে গেলে অতিকায় সব মাছের চর্বির থলে দেখা যাচ্ছে পর্যন্ত। এবং ধারাল দাঁতের ঝিলিক দেখলে প্রাণে আর বিন্দুমাত্র সাহস থাকে না। জাহাজটাকে মনে হচ্ছে সেই হাজার বছর আগের পালতোলা জাহাজের মতো। কেবল সারা আকাশময় এখন ধুম উদগীরণ হচ্ছে প্রবলভাবে। আগুন জ্বলছে লেলিহান জিহ্বায়। তার ভেতরে সব মাংস ঝলসে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে মাংস প্রথমে গুদামজাত করে রাখা, দরকার মতো রোদে শুকিয়ে রাখা, তেলে চর্বিতে ভেজে রাখা, অন্য সব খাবার যা আশু নষ্ট হয়ে যাবার কথা যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, কাল থেকে ডেকে বাঁধাকপি ফুলকপি কেটে কেটে ত্রিপলে ছড়িয়ে দেওয়া হবে, সব শুকিয়ে যা কিছু খাবার আছে এখন কেবল গুদামজাত করে রাখা। স্যালি হিগিনসের বোধহয় মনে হয়েছে জাহাজে বেঁচে থাকতে হলে এটাই প্রাথমিক প্রচেষ্টা। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কেউ আবার সহজেই ঝলসানো মাংস সরিয়ে ফেলতে পারে এজন্য স্টুয়ার্ড যা যা দিচ্ছে আবার তা সঠিক ফেরত আসছে কিনা দেখে নিচ্ছে। কেউ কেউ যে চুরি করে এক দু’খণ্ড মাংস আলগা করে মুখে ফেলে দিচ্ছে—এরই মধ্যে দুটো একটা ঝলসানো ঠ্যাং অথবা মাংসপিণ্ড দেখে সে ঠিক ধরে ফেলেছে। এবং রিপোর্ট করলে স্যালি হিগিনস বলেছেন, কিছু খেতে দাও। একেবারে খেতে না দিলে চলবে কেন।

ছোটবাবুর কাছে প্রায় অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো ঘটনা। ফরোয়ার্ড ডেকে আছে চিফ-মেট, দু’জন ডেক- জাহাজি, তিনজন ফায়ারম্যান একজন কোল-বয়। চিফ-মেটের অধীনে দু’টো উনুন, ফোরমাস্টের দু’পাশে। তিন-নম্বর মিস্ত্রি কয়লা বাকেটে তুলে যোগান ঠিক রাখছে। বাংকারে আছে ছোট-টিণ্ডাল। দু’জন কোল- বয়। এবং উইণ্ড-সেলের নিচে একজন উইনচ চালিয়ে কয়লা বাংকার থেকে তুলে আনছে। যেখানে যত কয়লা লাগবে তার তদারকের ভার তিন-নম্বর মিস্ত্রির। ছোটবাবুর মনে হয়েছিল—যখন জাহাজ সমুদ্রে স্থির ভাসমান, সূর্যের মতো গনগনে আগুনে আকাশ দীপ্তিময় তখন শুধু খাওয়া আর বসে থাকা জাহাজে। দূরবীনে চোখ রাখা। আশ্চর্য সে-সবের কিছু নেই। কেউ দেখছে না কেন, কোথাও জাহাজ কিংবা দ্বীপটিপ যদি দূরে দেখা যায়। আর সে উল্টে দেখছে জাহাজের যা কিছু খাবার সব নিচ থেকে তুলে ডাইনিং হলে পাশের খালি কেবিনটায় সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। কার্পেন্টার জলের পরিমাণ কত দেখছে। কেউ একদণ্ড দাঁড়াতে পারছে না। অমানুষের মতো সবার চোখমুখে। জব্বার মেন মাস্টের নিচে আছে। এখানে দেখাশোনা করছে ডেবিড। সে ঠিক ঠিক লোহার রডটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে ঠ্যাং অথবা হৃৎপিণ্ড কলজে এবং যা কিছু সব ঝুলছে আগুনের ওপর টিপে টিপে দেখছে। চর্বিপোড়া গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে সবার। গরমে সবাই ঘামছে। চোখ লাল। কোমরে ফেটি বেঁধে নিয়েছে কেউ। মাথায় ফেটি। সবাই শ্মশানযাত্রীর মতো। যেন উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে হাত-পা শরীর। ছোটবাবুর মাথা গুলিয়ে উঠল।

—হেই ওখানে কেন? এস। হাত লাগাও।

ছোটবাবু কোনো রকমে বলল, যাচ্ছি।

এবং সে নেমেই জোরে একটা লোহার রড ঘুরিয়ে দিল। বোধ হয় চর্বির ভাগ বেশী, একটা বড় সাইজের ভেড়া প্রায় হাত-পা তার এখন লাল, ঘন সাদা আবার ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে যাবতীয় জমে থাকা বরফের রক্ত কণিকা, সব শুকিয়ে কাঠ কাঠ মাংস দিন মাস গেলে চিবিয়ে জীবনধারণ করতে হবে—সে কেমন সাহসী হয়ে গেল। একটা প্রেরণার মতো কাজ করছে বুড়ো মানুষটা। একবার খবরও নিচ্ছে না তার জাতক এ-জাহাজেই আছে, কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে একবার দেখছে না। সে বলল, ডেবিড তুমি বরং ঠাণ্ডায় গিয়ে বস। ডেবিড নড়ছে না। রোদে ডেক তেতে আছে এবং সঙ্গে এই আগুনের উত্তাপ প্রায় ফার্নেসে ঢুকে যাবার মতো। ডেবিড ছুরি দিয়ে সামান্য মাংস কেটে দিল, দেখ তো জিভে দিয়ে ঠিক মতো রোস্ট হয়েছে কিনা?

ছোটবাবুর বেশ খিদে পেয়েছে। ডাইনিং হলে আজও হয় তো নিয়মমাফিক খাওয়া হবে। বয়বাবুর্চিরা বড় বেশী এদিকে আসছে না, তবু সে একটু খেয়ে বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি দ্যাখো।

ডেবিড মাঝে মাঝে ছিঁড়ে খেয়েছে। খেতে ক’টা হবে অফিসারদের কেউ জানে না। এবং জাহাজে কখন খাবার সময় পার হয়ে গেছে—কারো বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। খাওয়া দাওয়ার কথা কারো মাথায় থাকছে না।

থার্ড-মেটকে নিয়ে তিনি ঘুরছেন জাহাজে। ডেবিডের ওখানে ছোটবাবুকে দেখে বললেন, ছোটবাবু তোমার জীবনটা খুব দামী না হে। আর এতগুলো জীবনের কোনো দাম নেই। ছোটবাবু সঙ্কোচে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। সে কি করে বলবে, স্যার আমাকে তেমন ছোট ভাববেন না। কিন্তু সে তো বলতে পারে না। সে তো বলতে পারে না, স্যার আর্চিকে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে মেরেছি। বিশ্বাস করুন স্যার আর্চিকে সামান্য ইঁদুরের মতো মনে হয়েছিল। মুখ বালিশে চেপে ধরার সময় মনে হয়েছিল সামান্য একটা জীব। ওকে সমুদ্রে ছুড়ে দেবার সময় মনে হয়েছিল বনি আর কোন অশুভ প্রভাবে পড়ে যাবে না। এত বড় একটা পাপ কাজের জন্য বিশ্বাস করুন আমার এতটুকু অনুশোচনা হয় নি। তখন হিগিনস বললেন, দাঁড়িয়ে থাকবে না। নিচে যাও। চার-নম্বরের কাছ থেকে কাজ বুঝে নাও গে।

সে যখন এনজিন-রুমে নেমে এল, অবাক, এত বড় এনজিনটা কিভাবে হাঁটু মুড়ে পড়ে আছে! সব এলোপাথাড়ি। কনডেনসার, সার্কুলেটিং পাম্প সব গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। বয়লারের গেজ, ফিল্টার বকস্ কোথায় সব ছিটকে বের হয়ে গেছে। এভাপরেটারটা শুধু অক্ষত আছে। সিঁড়ি সব ঝুলে আছে। খুব সন্তর্পণে নিচে নেমে আসতে হয়েছে। তেলের ড্রাম গড়িয়ে ওপরে তোলা হচ্ছে। সে ডাকল! এই এনজিন-কশপ চার নম্বর কোথায়?

আর্চি চলে যাওয়ায় এনজিন-কশপ খুব দমে গেছে। সে বলল, বয়লার-রুমে। টব কেটে সব লম্ফ বানাচ্ছে।

ছোটবাবুকে দেখে চার-নম্বর বলল, তুমি টবগুলো গোল করে কেটে ফেল। দু’টো টব ক্রোজনেস্টে বসিয়ে দিতে হবে। লম্ফের মতো জ্বলবে। যেন দূর থেকে রাতে কোনো জাহাজ সমুদ্রে আমাদের দেখতে পায়। লম্ফ দু’টো মাস্তুলে সারা রাত জ্বলবে। বাংকারে দু’টো লম্ফ আছে আর সারেঙের ঘরে একটা, কশপের কাছে গোটা তিনেক আছে। বুড়োর সব তাতেই তাড়াহুড়ো। বিকেলের ভেতর সব ওপরে তুলে নিয়ে যেতে হবে। এবং ছোটবাবু সামান্য ঘুরে গেলে বলল, ওদিকে যাবে না। সব আম্মা হয়ে গেছে। মাথায় পড়তে কতক্ষণ?

—কিভাবে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে!

—তাই। চার-নম্বর মাথায় সামান্য ফাইলটা ঘসে নিল অর্থাৎ সামান্য তেল লাগিয়ে নেবার মতো সব ভুলে সে ফের ফাইল করছে। কেমন বিড় বিড় করে বলল, জাহাজে সত্যি কিছু একটা অশুভ প্রভাব ছিল ছোটবাবু, যাবার সময় সব নিয়ে চলে গেল জাহাজের। বলেই সে ক্রস টানল। মুখ থম থম করছে চার-নম্বরের। সে বোধ হয় কেঁদে ফেলবে। অথবা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালে মানুষের যে অবস্থা হয় একজন ছন্নছাড়া মানুষের মতো মুখ চোখ—চার-নম্বর ঠিক তেমন হয়ে গেছে! হুঁসের মাথায় সে কাজ করছে না। সে মাঝে মাঝে বলছে, আমরা সবাই মরে যাব ছোটবাবু। আমরা কেউ বাঁচব না। মিরাল কিছু না ঘটে গেলে আমরা কেউ বাঁচতে পারি না।

ছোটবাবু কিছু বলল না। যত ভাবনা বনিকে নিয়ে। সে বুঝতেই পারে না বার বার তার চোখের সামনে কোনো হতাশা ফুটে উঠলে কেন দেখতে পায় বনি কাতর চোখে তাকিয়ে আছে। একটা নিমজ্জমান জাহাজে সে আছে। দেশের কত রকমের ছোট-বড় ছবি, যেমন অনায়াসে সে যে স্বপ্ন দেখেছিল মাথায় এংকারের টুপি সাদা নেভির পোশাক পরে সে ফিরে গেছে বাড়িতে, বাবা-মা রাতে দরজা খুলে লণ্ঠনের আলোতে একজন অপরিচিত সাহেব-সুবো মানুষ দেখে অবাক কে আপনি কাকে চান, তখন সে যেমন ভেবেছিল মা আমাকে তুমি চিনতে পারছ না, আমি সোনা। আমি তোমার মেজ ছেলে সোনা। তোমার নিখোঁজ সন্তান। আমি এত বদলে গেছি! মুখ দেখেও আমাকে চিনতে পারছ না? ছোট ছোট ভাই-বোনের মুখ, ওরা শীতের ভিতর কুঁকড়ে বসে আছে, সে তার দামী কম্বল দিয়ে ভেবেছিল, সংসারের সব শীত নিবারণ করবে, কিছুই আর বুঝি হয়ে উঠছে না—অথচ এখন কোনো তার দুঃখও নেই—কেবল বনির কথা ভাবলে হাহাকার করে ওঠে যেন বুকটা। সে বলল, বুড়ো মানুষটা যখন আছে তখন কোনও ভয় নেই।

চার-নম্বর রোগা মতো মানুষ। ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ। সে দেখেছে জাহাজে মানুষটা নিঃশব্দে কাজ করে গেছে। বন্দর এলে সে কাজের পর শুধু মাতাল হয়ে পড়ে থাকত। আর আশ্চর্য সে দেখে ভাবত সকালে চার-নম্বর অসুস্থ থাকবে, ডিউটিতে আসবে না, কিন্তু সেই মানুষ সকালে সরল সোজা আর কি তাজা শিস্ দিতে দিতে নেমে আসত নিচে যেন সে রাতে মাতাল না হলে গভীর ঘুমে ডুবে যেতে পারত না। গভীর ঘুম না হলে সে অসুস্থ হয়ে পড়ত। সেই মানুষটা পর্যন্ত ঘাবড়ে গেছে।

ছোটবাবু এত দিনে এই প্রথম বলল, কে আছে দেশে?

—দেশে আছে ছোটবাবু, সবার যা থাকে আমার তাই আছে। ছোট দু’টো বাচ্চা ফুটফুটে মেয়ে। বড়টা হাঁটতে পারে, ছোটটা মায়ের কোলে থেকে আমায় আদর জানিয়েছে। ভেবেছিলাম দেশে গিয়ে দেখব ছোটটাও হাঁটতে শিখে গেছে। ওদের দু’জনকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাব ভেবেছিলাম। বড় মেয়েটার খুব শখ হাতী বাঘ দেখার। কিছু বোধ হয় আর হয়ে উঠবে না। তাছাড়া যেন বলতে চাইল দু-চার দিনের ভেতরই সর্বত্র খবর ছড়িয়ে যাবে—সিউল-ব্যাংক জাহাজের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। একেবারে মাঝ-দরিয়ায় চুপ মেরে গেছে। তারপর যা হয়, পত্রিকায় ফলাও খবর জাহাজিদের ছবি ছেপে খবর, শেষে সব খবর কেমন মানুষের অগোচরে চলে যায়। আমাদের কথা ছোটবাবু কেউ আর মনে রাখবে না। ঘণ্টায় ঘণ্টায় যে জাহাজটা খবর পাঠিয়েছে ঝড়ের, সেই এখন অকুলে ভাসছে।

ছোটবাবু বলল, আমরা একটা এস-ও-এস পর্যন্ত পাঠাতে পারলাম না।

চার-নম্বর সতর্ক গলায় বলল, বুড়ো মানুষটার কোনো আপশোষ আছে সেজন্য। কেমন মজা পেয়ে গেছে। অন্য কাপ্তান হলে মার্কনি সাবের গলা টিপে ধরত। কোনো এস-ও-এস না পাঠিয়ে কেন স্টেশন লিভ করলে। কৈফিয়ত তলব করত। তারপর একটু থেমে বলল, কিচ্ছু করল না। বুঝলে,সব শয়তানটা জানত।

—জানত মানে?

—জানত না! না জানলে এত স্বাভাবিক কেউ থাকে? যেন মজা পেয়ে গেছে! জাহাজটা এখন আর কেউ স্ক্র্যাপ করতে পারছে না, জাহাজ নিয়ে সারা জীবন সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে পারবে।

ছোটবাবু বলল, ওর ছেলে জাহাজে আছে।

—আরে ওকি মানুষ আছে? ও তো সারা জীবন জাহাজ চালিয়ে চালিয়ে একটা অদ্ভুত জীব হয়ে গেছে। সিউল-ব্যাংক ছাড়া মাথায় তার আর কেউ নেই।

ছোটবাবু এ-নিয়ে কথা বলল না। আসলে মাথায় সবার এখন রক্ত উঠে যাচ্ছে। এবং এটা স্বাভাবিক। যত দিন যাবে ওটা বাড়বে। কাপ্তান তখন আর সত্যি মানুষ থাকবেন না। তিনি একটা আস্ত শয়তান হয়ে যাবেন সবার চোখে। আর যা মনে হল, যত দিন যাবে তত এই সব মানুষেরা ক্রমে অমানুষ হয়ে উঠবে। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার মুখে কেউ বুঝতেই পারেনি কি ভয়াবহ এই ভাসমান জাহাজে বেঁচে থাকা। দিন যাবে আর ক্রমে টের পাবে খাবার যত ফুরিয়ে আসবে তত টের পাবে, জল যত কমে আসবে টের পাবে। এখনও যে জাহাজে সবাই মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে সে কেবল তীরের আশায়। কোনো মিরাকলের আশায়।

ঠিক সন্ধ্যার সময় দু’টো মাস্তুলের ক্রোজ-নেস্টে লম্ফ জ্বালিয়ে দেওয়া হল। বেশ বড় টবের মুখে হাসিল পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসিল সলতের মতো কাজ করছে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলে যেন মশালের মতো আকাশে লম্ফ দু’টো জ্বলতে থাকল। টর্চ সহজে কেউ ব্যবহার করবে না। সব টর্চ এখন কাপ্তানের জিম্মায়। চীফ-মেট সব বোট থেকে টেনে নামিয়েছে। সিগন্যালিং লাইট, থ্রি শর্ট থ্রি লঙ, আলোর সিগন্যালিংয়ে দূরবর্তী উপকূলে অথবা জেলে-জাহাজে কিংবা কোনো কার্গো-শিপ যদি যায় তবে বুঝতে পারবে এস-ও-এস আসছে জাহাজ থেকে। যারা সারা দিনমান মাংস ঝলসে গুদামজাত করেছে তারা এখনও কাজ করছে। সব রোস্ট করতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছে। আধপোড়া হলেও যেন ক্ষতি নেই। দরকার মতো কাল আবার ঠিকমত ঝলসে নেয়া যাবে। এবং রাতে সেই গোল অগ্নিকুণ্ডের ভেতর মানুষের মুখ লাল আভায় ডুবে থাকল। স্যালি হিগিনস বুঝতে পারছেন জাহাজটা এখন এক দল ক্ষুধার্ত বন্য মানুষের হাতে পড়ে গেছে। অন্ধকার কেবিন থেকে তিনি সব দেখছেন। পোর্ট-হোল খোলা রেখে চারপাশে যা কিছু আছে প্রত্যেকটা পোর্ট-হোলে গিয়ে দাঁড়ালেই দেখতে পাচ্ছেন। দলে দলে এই সব বন্য মানুষেরা ভাগ হয়ে এখন আগুনের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছে। মনে হল সেই আগুনের ভেতর জামা খুলে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে কেউ। স্যালি হিগিনস এত ওপর থেকে ঠিক বুঝতে পারছেন না। কে সে? সবাই আগুনের চারপাশে হল্লা করছে। আর লোকটাকে চ্যাংদোলা করে ধরে আনছে। ওর প্যান্ট খুলে আগুনে পুড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। এই বন্য ইচ্ছে কোনো রকমে বেড়ে গেলে ওরা লোকটাকে আগুনে ফেলে দিয়েও তামাশা দেখতে পারে। তিনি আর বিন্দুমাত্র দেরি করলেন না। তিনি বোট-ডেকে বয়-কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই বিরাট এক পুরুষের মতো মুখ এবং চার-পাঁচ দিন দাড়ি না কামানোর জন্য সাদা দাড়ি ক্রমে বেড়ে যাচ্ছিল এবং তিনি সেই বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন—হাই। সঙ্গে সঙ্গে লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া হল। লোকটি একেবারে উলঙ্গ। সে পিছনের দিকে ছুটছে। বন্য লোকগুলো আর হাতে তালি বাজাতে পারল না। আগুনের আভায় তিনি প্রায় যেন জ্বলে উঠলেন। তাড়াতাড়ি ডেবিড লোহার রডে একটা নরম পাছার মাংস গেঁথে আবার দু’টো কাঠের ফাঁকে ঝুলিয়ে দিল। স্যালি হিগিনসের সেই কঠিন চেহারার সামনে আর একটুও বেয়াদপি করার ক্ষমতা তার নেই। সে বিনীত ভদ্র ভাল মানুষ হয়ে গেল। এবং বুঝতে পারছে এক্ষুনি ডেকে পাঠাবে তাকে। কারণ তিনি ফিরে যাচ্ছেন অন্ধকারে। বোট-ডেকের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন। সে ভয়ে আর একবার ফিরে তাকাতে পর্যন্ত পারল না। চোখ মুখে কয়লার ধোঁয়া এবং কালিতে ছোপ ছোপ দাগ, এবং মুখে হাতে পায়ে মনে হয় সে কত দিন যেন স্নান না করে আছে। সমুদ্রে ভয়ংকর ঝড় ছিল বলে এতদিন কেউ দাড়ি কামাবার সুযোগ পায় নি। ফলে সবার খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ডেবিডের থুতনির সামান্য লাল দাড়ির পাশে আগোছালো সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি কেমন তাকে আরও বেশী জংলী করে তুলেছে। বয়স মনে হয় বেড়ে গেছে। ছোট-টিণ্ডালকে নিয়ে এতটা মশকরা না করলেই যেন ভাল ছিল। ওর চারটা বিবি। চার-নম্বর বিবি লিটল গার্ল। বুড়ো বয়সে লিটল গার্ল নিয়ে কি সুখ এবং অদ্ভুত রকমের ঠাট্টা-তামাশা করার স্পৃহা কেন যে জেগে উঠল! সে বলেছিল, লিটিল গার্ল বুড়ো বয়সে সামলাও কি করে?

বাদশা মিঞা হেসেছিল দাঁত বার করে। যেন খুব মজার কথা। সে দাঁত সোনায় বাঁধিয়েছে বিবির জন্য, দাঁত বের করে হেসেছিল।

ডেবিড আগুন উসকে দিয়ে বলেছিল, তুমি কি মিঞা বিবিকে দাঁতে কামড়ে সুখ দাও। টিণ্ডাল আবার হেসেছিল। সাহেব তার বিবিকে নিয়ে বেশ তামাশা করছে যা হোক। সেও মজা পেয়ে গেছিল। বলেছিল, তা পাই।

—তাহলে বাদশা তোমার ওটা নেই

—আছে।

—না নেই।

—আছে সাব।

—তবে দ্যাখাও।

—তোবা তোবা। বাদশা দৌড়ে পালাতে চেয়েছিল।

আর সঙ্গে সঙ্গে সে বলেছিল দু’জন ফায়ারম্যানকে, সে বলেছিল দু’জন গ্রীজারকে, উস্‌কো পাকড়ো। আধা হিন্দী আধা বাংলায় সে যে দু’টো একটা কথা বলতে পারে ওদের মতো সে বলেছিল, পাকড়ো। বোলতা হ্যায় না। এবং সঙ্গে সঙ্গে ওরা চারজন ওকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এলে কি যে বন্য রসিকতায় সে উন্মাদ হয়ে গেছিল। টেনে জামা প্যান্ট একেবারে খুলে সব আগুনে ছুড়ে ফেলে তাকে উলঙ্গ করে বলেছিল, তোমার কিছু নেই মিঞা। ঝুট বাত বলতা হ্যায়। তুমি নিমকহারাম। অর্থাৎ বোধ হয় অমানুষ অথবা তোমার কিছু নেই শালা, তুমি নপুংসক, কেন লিটল গার্ল ঘরে এনেছ? দেব আগুনে ফেলে। দাঁতে কামড়ে মজা পাও তুমি। আগুনে ফেলে তোমার মজা বের করে দেব। এবং স্যালি হিগিনস পেছনে বোট-ডেকে না দাঁড়ালে তাকে সত্যি আগুনে ফেলে দিত কিনা জানে না।

তখন বনি ছুটে এসে বলল—তুমি এখন যাও ডেবিড। আমি এখানে আছি।

ডেবিড বলল, কোথায় যাব।

—তোমার ছুটি। এবারে তুমি বরং স্নান-টান করে পরিষ্কার হয়ে নাও। বাবা তোমাকে ছেড়ে দিতে বললেন।

ডেবিড কি করবে বুঝতে পারল না। এমন একটা অমানুষিক খাটুনি জ্যাকের মতো নাবালক পারবে কেন। আগুনের সামনে পাঁচ-দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। সে বলল–তুমি পারবে না জ্যাক।

—খুব পারব।

–একা কিছুতেই পারবে না।

—এরা তো আছে।

ডেবিড চলে যাচ্ছিল, তখন দেখল ছোটবাবু নেমে আসছে। মাথায় ফেটি বেঁধে নিয়েছে। সারা রাত ছোটবাবুর মাংস ঝলসে রাখার ডিউটি পড়েছে। আসলে ছোটবাবু করবে। জ্যাক মাঝে মাঝে এটা ওটা এগিয়ে দেবে। এবং ডেবিড চোখ তুলে ওপরে তাকাতেই দেখল অতিকায় দু’টো যেন মশাল জ্বলছে আকাশে। এতক্ষণ সে কিছু খেয়াল করেনি। মশালের প্রতিবিম্ব সমুদ্রে ভাসছে। এবং এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে প্রতিবিম্ব। সে বুঝতে পারল জাহাজ সকালে যেখানে ছিল এখনও ঠিক সেখানেই আছে। এতটুকু ভেসে যাচ্ছে না কোথাও। এবং আগুনের আভায় মশালের আলোতে সে লক্ষ্য করল চারপাশে সব সামুদ্রিক মাছ। বড় হাঙ্গর। অক্টোপাস উঠে এলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। এবং জাহাজটা যে এক সময় সব ধুর্ত মনস্টারদের আড্ডা হয়ে যাবে না কে জানে! সে ঘরে ঢুকেই গলায় আকণ্ঠ মদ ঢেলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকল। বুক গলা পুড়ে যাচ্ছে। আহা তবু কি আশ্চর্য আরাম। সে দেয়ালে মুখ লেপ্টে দিল।—এবি তুমি এখন কি করছ! সে ছেলেদের নাম ধরে ডাকতে থাকল, তোমরা সবাই কি করছ, কিছু করতে পারছো না। তারপর নেশার ঘোরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল, এবি আমাদের কি হবে। আমরা সবাই মরে যাব।

স্যালি হিগিনস অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। যারা সারাদিন আগুনের সামনে ছিল তাদের এখন ছুটি। অন্য দল কাজ করছে। এখনও যেন দুর্ঘটনার গুরুত্ব তেমনভাবে কেউ বুঝতে পারেনি। এটা হয়। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে না আসলে কতটা তারা বিপন্ন। বুঝতে সময় লেগে যায়। দিন যত যাবে তত সবাই মরিয়া হয়ে উঠবে। আফটার-পিকে এখন একজন জাহাজি চুপচাপ বসে আছে। ওর কাছে রয়েল সিগন্যালিং টর্চ। সে যদি কোনো জাহাজ দেখতে পায়। সে অন্ধকারে এখন ভীষণ সজাগ। দু’ঘণ্টা পর পর ডিউটি পাল্টে যাবে। এবং সকাল হলে তিনি পাহারায় রাখবেন জ্যাককে। জ্যাক, ডেবিড, চিফ-মেট, থার্ড-মেট পালা করে সতর্ক নজর রাখবে চারপাশে। ওরা দূরবীনে যদি কোনো জেলে জাহাজ অথবা কোনো মালবাহী জাহাজ দেখতে পায় দূরে। সবই দুরাশা। তবু যেন বিশ্বাস করতে ভাল লাগে সকাল হলেই দেখতে পাবেন কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ সমুদ্রের জল কেটে দ্রুত চলে আসছে। তখন তিনি অনায়াসে সবাইকে নিরাপদে ডাঙায় পৌঁছে দিতে পারবেন।

এবং তিনি এও জানেন আশা কুহকিনী ছাড়া তাঁদের বেঁচে থাকার আর কিছু অবলম্বন থাকবে না। মশাল দু’টো মাস্তুলে দপ দপ করে জ্বলছে। সামান্য হাওয়া পেলে আলোর শিখা লম্বা হয়ে যাচ্ছে এবং কেন জানি মনে হচ্ছে জাহাজ স্থির অনড়। মাস্তুলে অগ্নিশিখা কাঁপছে। জাহাজটা সেই আলোতে ভারী স্তব্ধ হয়ে আছে। সেই যেন সারা মাস কাল সে পিঠে ক্রস বহন করে চলেছে। যেতে যেতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। আর উঠতে পারছে না। সমুদ্রের অতল থেকে ভেসে উঠছে সব সামুদ্রিক মাছ। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। জলে মাছের শব্দ। ওরা বোধহয় জলে একটা আজব জীব ভাসতে দেখে অবাক হয়ে গেছে। কেমন ঠাণ্ডা মরা ভুতুড়ে জাহাজ ভুতুড়ে আলো জ্বালিয়ে বেশ স্থির। তবে কি জাহাজ কোনো স্রোতের মুখে পড়ে যায় নি! জল দেখে কিছুই স্থির করা যাচ্ছে না। আকাশের নক্ষত্র দেখে তিনি বুঝতে পারছেন না কিছু। প্রতিদিনের মতো একই নক্ষত্রমালা আকাশে দপদপ করে জ্বলছে। এবং মনে হচ্ছে আকাশের নিচে জাহাজের চারপাশে রয়েছে সেই পাখিটা। ধোঁয়া এবং আগুনের জন্য সে মাস্তুলে এসে বসতে পারছে না। সমুদ্রে ভেসে রয়েছে কোথাও। পাখিটা মাঝে মাঝে কক-কক করে ডাকছে। তার শব্দ ভেসে আসছে। আশ্চর্য পাখিটা সেই যে জাহাজের পেছন নিয়েছে, সেই যে কেবল উড়ছে তো উড়ছেই সমুদ্রে থেকে যাচ্ছে না, জীবনে তিনি কখনও এমন দেখেননি। অ্যালবাট্রস পাখিদের দীর্ঘদিন জাহাজের পেছনে উড়তে দেখেছেন। ডাঙা এলেই তাদের আর দেখা যেত না। আবার হয় তো আর এক জোড়া পাখি। কিন্তু লেডি অ্যালবাট্রস একা নিঃসঙ্গ যেন জাহাজটাতেই আছে তার প্রিয়জন। ছোটবাবুর পোষ মানা পাখিটা খাবারের লোভে বুঝি জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছে না। এবং কেন জানি এইসব বিপন্ন মানুষের সঙ্গে স্যালি হিগিনসের মনে হচ্ছে পাখিটাও ভারি বিপন্ন। তারা ডাঙায় ফিরে যেতে না পারলে পাখিটাও ফিরে যেতে পারবে না।

সকালে চিফ-মেট দুঃখে হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পেল না। এখন থেকে জাহাজে সবার দৈনিক রেশন কি পরিমাণে হবে ভাগ-বাঁটোয়ারার সময় প্রত্যেকের নাম এবং নিবাস লিখে রাখার মতো কাপ্তান পাখিটার নাম এবং নিবাস লিখে রাখলেন। সবার খাদ্যের গড়-তালিকা যেমন হওয়া দরকার ঠিক তেমনি পাখিটারও একটা খাদ্যতালিকা প্রস্তুত হয়ে গেল। চিফ-মেট অতি দুঃখে তালিকাটি দেখার সময় না হেসে পারল না।

স্যালি হিগিনস আড়চোখে চিফ-মেটের মুখ দেখে সামান্য বিরক্ত হলেন। মুখের ওপর তিনি তাকে কিছু বলতে পারলেন না। দূরবীন নিয়ে বোট-ডেকে নেমে গেলেন। তাঁকে সত্যি ভারি দুঃখী এবং অসহায় মনে হচ্ছিল।

চিফ-মেট সহসা তখন লাফিয়ে নেমে গেল পেছনে। বলল, স্যার দেখেছেন?

স্যালি হিগিনস মুখ তুলে দেখলেন চিফ-মেটকে। ভীষণ ঝুঁকে আছে। চিফ-মেট ঘামছে।

—কী হয়েছে?

—যীশুর মূর্তি দেয়ালে নেই।

—তুলে রেখেছি। চিফ বললেন, না ওটা ঝড়ের সময় পড়ে ভেঙে গেছে। ওটা শেষ।