।। তেতাল্লিশ।।
তখন সমুদ্রের পাড়ে পাড়ে সব সামোয়ান নর-নারীদের ভীড়। ওরা জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে দূরবর্তী পাহাড়ের মাথায় আগুন জ্বলতে দেখছে। অতি-উৎসাহী মানুষেরা বোট-ভাড়া করে পাহাড়টার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। কি করে যে একজন মানুষকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এবং পাহাড়ের চারপাশে ওদের দেখে ছোটবাবু অবাক-–বোটের সব মানুষেরা এসে হাত নাড়ছে নিচে। ওপরে ওরা উঠে আসতে চায়। দেখতে চায়।
ছোটবাবু না বললে যেন কেউ উঠতে পারছে না। সে বলল, আসুন। এবং ওদের কেউ কেউ মানুষের সেই আধ-পোড়া শরীর দেখে কেমন ঘাবড়ে গেল। ডেবিড খুব বেশি সময় কাছে থাকতে পারে নি। ও-পাশের ছোট একটা পাহাড়ের মাথায় সে শুয়ে আছে। ওর শরীর গোলাচ্ছে। ছোটবাবু ওকে ওদিকে রেখে এসেছে। কারণ মানুষের মাংসের সেই উৎকট পোড়া গন্ধে ছোটবাবুও ঠিক ছিল না। বন্ধু, অনিমেষ খুব সাহসী মানুষের মতো কাজ করে যাচ্ছে। ছোটবাবু মাঝে মাঝে আগুন কমে গেলে উসকে দিচ্ছে, কাঠ ফেলে দিচ্ছে। কাঠের নিচে আধ পোড়া শরীর ঢেকে দিয়ে সে সবসময় যতটা পারছে না দেখে থাকছে।
যারা এসেছিল বোট-ভাড়া করে, তারা কেউ বেশি বয়সের কেউ কম বয়সের। বেশ নিজেদের ভাষায় কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথায় বলে একসঙ্গে বেশি লোক উঠতে পারছে না। পাঁচ সাতজনের একটা দল উঠে আসছে, আবার ওরা নেমে গেলে আর একদল উঠে আসছে।
অনিমেষ বলল, বেটা বেশ মরে গিয়ে এখানে অমর হয়ে থাকল।
আসলে বোধহয় এই দ্বীপবাসীদের কাছে এটা একটা খবর—যেন দিন কাল মাস কেটে যাবে, বছরের পর বছর কেটে যাবে, তবু খবরটা ওরা বয়ে বেড়াবে আজীবন। বাংলাদেশের নাবিক বসন্তনিবাস এখানে সমুদ্রে ডুবে মরেছিল। ঐ যে দেখছ পাহাড়টা, সমুদ্র থেকে খাড়া উঠে গেছে, ঠিক আকাশের নিচে, তার মাথায় সারারাত আগুনটা জ্বলেছিল। একজন-মানুষের শরীর প্রায় সারারাত পাহাড়ের মাথা জ্বলেছিল—বড় দুঃসাহসিক ঘটনা।
সুতরাং প্রথমে মনে হয়েছিল একজন মানুষের শরীর আগুনে পোড়ালে দ্বীপবাসীরা সহজে মেনে নাও নিতে পারে। পরে মনে হয়েছে, যেন এই দ্বীপবাসীদের জীবনে এটা একটা নতুন রোমাঞ্চ। কারণ সমুদ্রের পাড়ে পাড়ে হাজার হাজার এখন মানুষ। জ্যোৎস্নায় দিগন্তে নক্ষত্রের মতো আগুনের সামান্য ফুলকি দেখছে। আগুনের সেই ফুলকি নিভে না গেলে ওরা বুঝি কেউ ঘরে ফিরবে না। একজন ঘরছাড়া মানুষের মৃত্যুতে ওরা বেদনা বোধ করছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোক প্রকাশ করছে। দেখে মনে হচ্ছে মেয়রকে ধরে হয়তো এ-বছরের বাজেটে পাহাড়ের মাথায় সামান্য একটা স্মৃতিসৌধের জন্য খরচ রাখবে, যেন আগামী বছরের জুন-জুলাইর ভেতর তার নির্মাণকার্য শেষ হয়ে যায়। এত সব মানুষ যখন বালিয়াড়িতে, সমুদ্রের ধারে ধারে এবং পাহাড়ী উপত্যকাতে দাঁড়িয়েছিল তখন একটা স্মৃতিসৌধ সামান্য ঘটনা। সেই সাদা জ্যোৎস্নায় ছায়া ছায়া সব মানুষের মিছিল। আর আগুন নিভে নিভে শেষ হয়ে আসছে।
চারপাশে সমুদ্র তেমনি ফুঁসছে। সমুদ্র পাহাড়টার চারপাশে মাথা কুটে মরছে। ওরা ডেবিডকে ডেকে নিয়ে এল। এখন সমুদ্র থেকে জল আনতে হবে। চিতা নিভিয়ে দিতে হবে। ছোটবাবু জল এনে চিতার ওপর ঢেলে দিল। বলল-–দাদা, তোমাকে এখানে রেখে গেলাম, সুখে থেকো।
অনিমেষ বলল, থাক শালা সুখে থাক।
বন্ধু বলল, তুমি তো থাকলে বড়-টিণ্ডাল। তোমার বৌকে আমরা ফিরে গিয়ে মুখ দেখাব কি করে!
ডেবিড জল ঢেলে দিল।
জব্বার এবং অন্য সবাই জল ঢেলে তারপর নেমে এল নিচে। সমুদ্রে ওরা ডুবে স্নান করল। তারপর ভেজা জামা-কাপড়ে বসে থাকল বোটে সবাই। কেউ একটা কথা বলছে না। আকাশে নক্ষত্রমালা তেমনি জেগে আছে। পাহাড়টা ক্রমে জ্যোৎস্নায় অস্পষ্ট হয়ে গেল। ক্রমে ওরা তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এবং জাহাজে আলো, মাস্তুলে তেমনি লম্ফ জ্বলছে। ওরা বোট ভিড়িয়ে ওপরে উঠে যেতে থাকল।
তখন গ্যাঙ-ওয়েতে কোয়ার্টার-মাস্টার বললে, আল্লা মুবারক।
ছোটবাবু বলল, আল্লা মোবারক।
কোয়ার্টার-মাস্টার হাত টেনে বলল, কাপ্তানের শরীর ভাল না।
–কি হয়েছে! ডেবিড শুনছ?
–কী!
–কাপ্তানের শরীর ভাল না।
কোয়ার্টার-মাস্টার বলল, ফিট, ফিটের ব্যামো।
ছোটবাবু এবং ডেবিড এক মুহূর্ত আর দেরি করল না। জব্বার আর বন্ধুকে বলল, তোরা যা। ভিজে জামা প্যান্ট পরে বেশিক্ষণ থাকিস না এবং ছোটবাবু নিজের কেবিনে এসে তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে নিল। পাশের কেবিনগুলো বন্ধ। সবাই ঘুমিয়ে আছে হয়তো। রাত গভীর,কোন সাড়া শব্দ নেই। সে ওপরে ওঠে বনির কেবিনে টোকা মারল। সাড়া শব্দ এখানেও কিছু নেই। বনির কাছে জানতে পারত কি হয়েছে। ও-পাশের পোর্ট-হোলে উঁকি মেরে দেখল, বনি কেবিনে নেই। সে এবার সিঁড়ি ধরে আরও ওপরে উঠতে থাকল। চার্ট-রুমের পাশে কাপ্তানের খাসকামরা। দরজা খোলা। ভেতরে আলো জ্বালা। সে উঁকি দিয়ে দেখল, পায়ের কাছে আর্চি বসে আছে। মাঝে চিফ-মেট। কাপ্তানের বাংক দেখা যাচ্ছে। কাপ্তানের শরীর চাদরে ঢাকা সে বুঝতে পারল। চিফ-মেট ছোটবাবুকে উঁকি দিতে দেখে বলল, কাম-ইন
—ছোটবাবু।
–কাম-ইন, কাম-ইন। যেন প্রাণ পেয়েছেন হাতে। এবং মুখে সরল বালকের মতো হাসি।
ছোটবাবু ভেতরে ঢুকলে বললেন, বোস। মুখ এত গোমড়া কেন। আরে, আমার কিছু হয়নি। বড়-টিণ্ডাল! ওটা একটা আহাম্মক। ওর জন্য কষ্ট পেয়ে লাভ নেই।
ছোটবাবু কখনও কাপ্তানের খাস-কামড়ায় আসে নি। একটা সবুজ রঙের আলো জ্বলছে। তিনি শুয়ে আছেন। বুক পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা। নকল দাঁতের দু’পাটি খোলা। খুব বুড়ো এবং শীর্ণকায় মনে হচ্ছে স্যালি হিগিনসকে। এবং কেন জানি মনে হল মানুষটা প্রাচীন মানুষের মতো ভীষ্মের শরশয্যায় যেন শুয়ে আছেন। সে পাশে বসে বলল, কেমন আছেন?
—খুব ভাল। জ্যাক তুমি শুতে যাও। কতক্ষণ এ-ভাবে বসে থাকবে।
এবং ছোটবাবু দেখল, জ্যাক মাথার কাছে বসে আছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না। অথবা সে যে কেবিনে এসেছে একেবারে যেন বুঝতে পারে নি, জ্যাক কি যে চুপচাপ এবং সেও কেন জানি আর একটা কথা বলতে পারল না। এমন একটা সুন্দর কেবিন, ঠিক মাথার কাছে যীশুর মূর্তি। নিচে ছোট্ট গোল টেবিল। ফুলদানিতে কিছু ফুল। হুকে জাহাজি টুপি ঝুলছে। লকার অতিকায়। দু’টো পোর্ট-হোল দু’দিকের দেয়ালে। তিনি বুকে দু-হাত প্রার্থনার মতো রেখেছেন। ছোটবাবুর কেমন ভাল লাগছে না। ডেবিড এখনও আসছে না কেন!
তখন স্যালি হিগিনস বললেন, বেশ সময় লেগে গেল তোমাদের।
ছোটবাবু বলল, হ্যাঁ সার। ডেবিড এখনও আসছে না কেন! সে দরজার দিকে বার বার তাকাচ্ছে।
হিগিনস বললেন, বড়-টিণ্ডালের বাড়িতে কে আছে?
—ওর স্ত্রী।
–আর কেউ নেই?
–আর কে আছে জানি না।
–কালই খবরটা পাঠিয়ে দিতে হবে। চিফ-মেট বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা তো আছি।
ডেবিড ঝড়ের মতো ঢুকে প্রথমে পালস্ দেখল কাপ্তানের। তারপর চোখ টেনে দেখল। দেখি জিভ। বের করুন। ছোটবাবু উঠে দাঁড়িয়েছে। ওরা দু’জন প্রায় এখন যেন সমবয়সী মানুষ। ওরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্যালি হিগিনসকে দেখছে। জ্যাক বসে রয়েছে মাথার কাছে। একটা কথা বলছে না। জ্যাকের পোশাক আরও ঢিলে-ঢালা। আর্চি আড়চোখে জ্যাককে দেখছে। এবং এ-কেবিনে সে যেন জ্যাককে দেখার জন্যই বসে রয়েছে। এই যে মেয়ে জ্যাক, এবং এই যে সুগন্ধ মেয়ের চারপাশে—কেমন এক কূট আকর্ষণ। সে সারারাত জেগে যেন বসে থাকতে পারবে। জ্যাক বসে থাকলে রাত জেগে বসে থাকতে এতটুকু কষ্ট হবে না তার।
ডেবিড বলল, আপনি ঘুমোন স্যার।
স্যালি হিগিনস বললেন, আমার ঘুম আসছে না ডেবিড।
–না ঘুমোলে তো চলবে না। এই জ্যাক, তুমি আর বসে থাকবে না। যাও। শুয়ে পড়ে গে। স্যার, সে চিফ-মেটের দিকে তাকাল।
চিফ-মেট বলল, যাচ্ছি।
ডেবিড এবার আর্চির দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার তোমার ঘুম পায় না? এস। সে প্রায় সবাইকে নিয়ে বাইরে বার হয়ে এল। একজন কোয়ার্টার-মাস্টার শুধু জেগে বসে থাকল বাইরে। আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। ওকে এ-ভাবে জাগিয়ে রাখা ঠিক হয় নি। পাল্সের বিটে সামান্য গণ্ডগোল এখনও আছে। ওরা বোট-ডেকে নেমে গেল। জ্যাক বলল, ফোনে কথা বলার সময় অজ্ঞান হয়ে যান। ডাক্তার বলে গেছেন, দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় এমন হয়েছে।
জ্যাক আবার বলল, বাবা ফোনে কথা বলতে বলতে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
–কার সঙ্গে কথা বলছিলেন? ডেবিড রেলিঙে দাঁড়িয়ে এমন বলল।
–বুঝতে পারলাম না। কেবল শেষে বলতে শোনলাম, আসবেন। তারপরই বসে পড়লেন। আর আমার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে থাকলেন।
বোধহয় মধ্যযামিনীতে ওরা এভাবে বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে বিচিত্র চিন্তাভাবনার ভেতর কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। জাহাজ সম্পর্কে নতুন কিছু কি খবর এসেছে। চিফ-মেট পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বয়সে প্রবীণ মানুষটি রাতের পোশাক পরে আছেন। মাথার ওপর সেই নিরবধিকালের আকাশ আর তার নক্ষত্রমালা। ওপরে কাপ্তান, জাহাজের সবচেয়ে দামী মানুষটা বুকের কাছে করজোড়ে হাত রেখে শুয়ে আছেন। বার বার জিজ্ঞাসা করেও ওরা ফোনে কি কথা হয়েছে জানতে পারে নি। এমন কি নতুন দুঃসংবাদ রয়েছে এই প্রাচীন জাহাজকে কেন্দ্র করে যার জন্য এমন প্রবীণ অভিজ্ঞ মানুষটা পর্যন্ত বিচলিত বোধ করছেন। ওরা কেউ আর কথা বলতে পারল না। নিঃশব্দে যে যার কেবিনের দিকে হাঁটতে থাকল!
সকালে যে যার মতো ঘুম থেকে উঠেছিল, যে যার মতো চা খেয়ে ডেকে উঠে এসেছিল। পাহাড়ের মাথায় সেই আগুনের শিখা আর নেই। সূর্য লাল বলের মতো পাহাড়ের মাথায় জেগে উঠেছে। এই সমুদ্র, দ্বীপের নারকোল গাছ, অথবা আভা গাছের জঙ্গল দেখতে দেখতে কে বলবে, গত রাতে ওরা ও-পাশের একটা পাহাড়ে একজন মানুষকে চিরদিনের মতো রেখে এসেছে। সকালের সব কাজ-কর্মের ভেতর বড়-টিণ্ডালের দু’টো একটা কথা এবং অথবা শোক-সন্তাপ, এবং এরই ভেতর ওরা কাজ করে যাচ্ছিল। ফল্কা থেকে ত্রিপল খুলে ফেলা হচ্ছে। কাঠ ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। ডেরিক টেনে তোলা হচ্ছে। মাল বোঝাই হবে বলে সবাই এক দণ্ড দাঁড়াতে পারছে না। বড় বড় সব টাগ-বোট এগিয়ে আসছে ক্রমশ। বড় বড় পিপে ভর্তি ফসফেট। এবং সামোয়ান মানুষেরা টাগ-বোট জাহাজের কাছে নিয়ে এসে হাঁকছে—হাড়িয়া।
আর এ-ভাবে যখন জাহাজে হাড়িয়া হাফিজ শব্দ, কাঠ ফেলার শব্দ, ঘর্ ঘর্ করে বড় বড় পিপে উঠে যাচ্ছে ডেরিকে, নিচে অনেক নিচে খাদের মতো জাহাজের তলায় নেমে যাচ্ছে পিপেগুলো—তখনই দেখা গেল একটা সাদা রংয়ের বোট জাহাজের দিকে ভেসে আসছে। দু’জন মানুষ একজন বেঁটে মতো, একজন লম্বা মতো, সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে বোটে। ওদের একজনের হিপ পকেটে ছোট্ট মতো একটা হাতুড়ি। জাহাজটা দেখেই, বেঁটে মতো মানুষটা হাওয়ার ওপর হাতুড়িটা দোলাচ্ছে।
আর সেই হাতুড়িটা দোলাতে দোলাতে লোকটা লাফ মেরে সিঁড়িতে উঠে এল। তারপর সিঁড়ি কাঁপিয়ে সে আরও ওপরে উঠে আসছে। পেছনে সেই লম্বা মতো মানুষ। ওরা দু’জন প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে জাহাজের সেই শেষ তলায় উঠে যাচ্ছে। গোলগাল মানুষটা, যেন প্রস্থে দৈর্ঘ্যে সমান—যার শরীর বেঢপ, যার মুখে স্মিত হাসি এবং হাসলে কান পর্যন্ত নড়তে থাকে, সে কেমন মাঝে মাঝে দুষ্টু ছেলের মতো বালকেডে হাতুড়ি ঠুকে দেয়ালে কান পেতে কি শুনছে। শুনতে শুনতে তখন সেই মানুষের চোখে মুখে কি অপার বিস্ময়। যেন সেই শব্দ লোহার অভ্যন্তরে ঢুকে নানারকমের খেলা প্রায় লুকোচুরি খেলার মতো অথবা হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনার মতো কান পেতে শুনছে শরীরে তার শিরা-উপশিরা কতটা ঠিক আছে।
এনজিন-সারেঙ বয়লার-রুম থেকে উঠে আসার সময় দেখলেন, অদ্ভুত দেখতে একটা লোক ফানেলের গুঁড়িতে উবু হয়ে আছে। সে ফানেলের পাশে উবু হয়ে কি দেখছে! তারপরই মনে হল উবু হয়ে দেখছে না, কান পেতে কি শুনছে! হাতুড়িতে দু’বার ঠুকেই কান পেতে বড় সন্তর্পণে শুনছে কিছু। চোখে মুখে দুষ্টু বালকের মতো হাসি। খুশীতে তার প্রাণ ভরে যাচ্ছে। হাতুড়িটা আনন্দে বাতাসে ছুঁড়ে আবার লুফে নিচ্ছে।
আর তখন লম্বা মতো মানুষটি হাতের ইশারায় ডাকল তাকে। বড় বেশি তোমার বাপু নেশা! জাহাজে উঠেই কাজকাম আরম্ভ করে দিয়েছ! এস দেখি জাহাজের বুড়ো কর্তা কি বলে! কাল ফোনে যা তেড়ে উঠেছিলেন, এখন হাতে হাতুড়ি দেখলে ঘাড় ধরে নামিয়ে দেবেন। দিতে পারেন।
—ভিতরে আসতে পারি?
চিফ-মেট বলল, কাকে চাই?
—ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস। বলে সে একটা লম্বা কাগজ চিফ-মেটের নাকের ডগায় তুলে ধরল।
লোকটার সাহস আছে! বলা কওয়া নেই একেবারে ব্রীজে উঠে এসেছে। কিন্তু কাগজটা পড়ে সে বুঝতে পারল—হেড অফিসের খোদ কর্তার লোক সুতরাং যা হয়ে থাকে, আদর আপ্যায়নের শেষ থাকে না। আপনারা বসুন। দেখছি। ক্যাপ্টেন কাল থেকে সামান্য অসুস্থ। দেখি–বলে সে সীল করা খাম হাতে নিয়ে ঢুকে গেল কাপ্তানের ঘরে। তিনি বেশ উঠে বসেছেন—এবং ফলের রস খাচ্ছেন। জ্যাক সব হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছে।
চিফ-মেট বলল, স্যার দু’জন লোক এসেছে। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
স্যালি হিগিনস গ্লাস রেখে দিলেন—তা হলে ওরা এসে গেছে! ফলের রস তখন মাত্র সামান্য খেয়েছেন।
জ্যাক বলল, তুমি খেয়ে নাও না বাবা! ওরা তো বসছে। ওরা তো চলে যাচ্ছে না।
চিফ-মেট বলল, স্যার ওদের ভেতরে নিয়ে আসব?
–না। ওদের চার্ট-রুমে বসতে বল, আমি যাচ্ছি।
–কিন্তু স্যার, আপনার এ-শরীরে যাওয়া কি ঠিক হবে!
–কিচ্ছু হবে না। ওদের বসতে বল।
জ্যাক বলল, বাবা
–কী!
–তুমি যাবে না। ওদের এখানে আসতে বলি।
স্যালি হিগিনস ডাকলেন, চিফ-মেট! সেই হাই করে ডাক। একেবারে আগের মতো স্বাভাবিক। এতটুকু বিচলিত বোধ করছেন না।
–আজ্ঞে কিছু বলছেন স্যার?
–আমার শরীর ভাল না, এ-সব আবার বল নি তো!
চিফ-মেটের চোখ মুখ শুকিয়ে গেল। সে তো আগেই বলে দিয়েছে। চিফ-মেট বলল, স্যার!
–তোমাদের কবে যে কাণ্ডজ্ঞান হবে! যাও। তিনি এবার বেশ সহজভাবে নেমে এলেন বাংক থেকে। যেন সেই যৌবনে ফিরে যাচ্ছেন। প্রথমে তিনি তাঁর দু’পাটি দাঁত মুখে পুরে দিলেন। একেবারে যুবকের মতো মুখ হয়ে গেল। তিনি তাঁর ইউনিফরম পরে নেবেন। কাপ্তান-বয় হাজির থাকল। বড় বড় পিপে সব ওপরে উঠে যাচ্ছে, নিচে নেমে যাচ্ছে। ছোটবাবু মাথায় টুপি পরে তেলের টব আর বালতি নিয়ে এক একটা উইনচের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছে, মাল ওঠা-নামা, অর্থাৎ গিয়ার, লিভার এবং সবকিছু ঠিক মতো চলছে কিনা দেখে আবার অন্য উইনচে ছুটে যাচ্ছে। দড়িদড়া বেয়ে উঠে যাচ্ছে সব মানুষ। কুলিরা সব হাঁকডাক করছে। ওরা হাত তুলে বলছে, হাড়িয়া, মাল নেমে যাচ্ছে। ওরা বলছে, হাফিজ, খালি পিপে উঠে ভেসে যাচ্ছে বাতাসে।
জ্যাক পরেছিল সাদা রঙের ট্রাউজার। হাঁটু পর্যন্ত গোটানো। মাথায় সেও টুপি পরেছে। এবং চারপাশে ফসফেটের গুঁড়ো, কুয়াশার মতো উড়ছে বলে সে একটা নিরিবিলি জায়গায়, অর্থাৎ ট্যাঙ্ক- টপে শরীর এলিয়ে দিয়ে সামনের রেলিঙে পা রেখে দূরের সমুদ্রে গভীর এক নীল নির্জনতা দেখতে পাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না বাবাকে লোকটা কি বলেছিল! যারা দেখা করতে আসছে তারা কি সেই লোক! বাবাকে সে দেখেছে, যখন ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েন তখন সব কিছু তাঁর বেশি ঠিকঠাক চাই। কারো তিনি তখন সামান্য ত্রুটি সহ্য করতে পারেন না। মার্জনা করা তো দূরের কথা। সে বুঝতে পারছিল, বাবা ভেতরে ঠিকঠাক নেই। সে দমে গেল খুব।
তখন স্যালি হিগিনস পুরোপুরি ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস। চকচকে সাদা জুতো, সাদা মোজা, সাদা প্যান্ট, সাদা হাফ-শার্ট, সোনালী স্ট্রাইপ কাঁধে চার চারটা। মাথায় এংকারের সোনালী ছবি আঁকা কাপ্তানের টুপি। ফিটফাট এবং খুবই রাশভারি মানুষ দেখাচ্ছিল তাঁকে। ভেতরে ঢুকলে ওরা দু’জন উঠে দাঁড়াল। পাশে চিফ-মেট আজ্ঞাবহনকারী মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
লম্বা মতো মানুষটি ঝুঁকে সামান্য হাত বাড়াল, নাম বলল।
বেঁটে মতো মানুষটি ঝুঁকে নাগাল পাচ্ছিল না কাপ্তানের হাত। পেট ভীষণ মোটা। টেবিলের ও পাশে পেটের চর্বি থকথক করছে। জামার ওপরে পেট ভেসে রয়েছে। মোটা বেল্ট। বেল্ট খুলে ফেললেই প্যাণ্ট হড় হড় করে পড়ে যাবে। স্যালি হিগিনস আরও বেশি ঝুঁকে হাত বাড়ালেন। বললেন, ইউ দেন মিস্টার ইয়াদু ওসাকা।
—ইয়েস ইয়েস ওসাকা। ইয়াদু ওসাকা।
—বসুন।
ওরা বসে পড়ল। তিনি বললেন, কফি।
চিফ-মেট মুখ বাড়াল দরজায়। কাপ্তান-বয় সোজা দাঁড়িয়ে আছে। সে হুকুমের প্রতীক্ষায় আছে।
–কফি।
স্যালি হিগিনস মাথা থেকে টুপি খুলে পাশের হুকে ঝুলিয়ে দিলেন। খুব সতর্ক চোখ মুখ। তিনি জানতেন, এরা কি বলবে। তিনি বললেন, কবে এসেছেন এখানে।
—সকালের ফ্লাইটে।
—মি. ফ্যাল কেমন আছেন?
—ভাল।
—তাঁর স্ত্রী।
—ভালো আছেন।
—তাহলে সবাই ভাল আছে। দেখি আপনাদের কাগজপত্র। মি. হ্যামিলটন আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি?
—না স্যার।
—মুখটা খুব চেনা চেনা।
মি. হ্যামিলটন ভীষণ লম্বা আর রোগা। দালাল লোকেরা দেখতে যেমন হয়ে থাকে—এবং পৃথিবীতে সব দালাল লোকদের মুখই বুঝি এমন হয়। মি. হ্যামিলটন বুঝি তাই খুব চেনা চেনা লাগছিল। ফাইল থেকে সীল করা খাম বের করে আলোতে দেখে ছিঁড়ে ফেললেন। এবং চিফ-মেটকে বললেন, তুমি আসতে পার। কাছাকাছি থাকবে। ডাকলে সাড়া দেবে।
তিনি খামের ভেতর থেকে লাল রঙের প্যাডে দেখলেন সেই সমনের নোটিস। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে তাঁর।
—তারপর ইয়াদু ওসাকা, জাহাজটা একবার দেখবেন বলছেন?
—ইয়েস স্যার। পুরানো জাহাজ। একটু বাজিয়ে নিতে হবে। বলেই সে তার হিপ পকেট থেকে ছোট্ট একটা হাতুড়ি বের করে প্রায় কানের ভেতর গুঁজে ফেলল। যেমন স্বর্ণকারদের হাতুড়ি পাতলা চকচকে এবং দামী ইস্পাতের তৈরি হয়ে থাকে অথচ ভারি মনোরম, কানের ভেতর পেনসিল গুঁজে রাখার মতো এমন একটা ভারি হাতুড়ি লোকটা অনায়াসে কানে গুঁজে রেখে দিল। সারাজীবন সে এ-কাজটাই করেছে। পুরানো জাহাজ কেনা-বেচার কাজ। জাহাজের ইস্পাত ঠুকে ঠুকে দেখে নেবে কতটা কি মাল আছে জাহাজে। কানে এখন লোকটা পেনসিল গুঁজে রাখার বদলে হাতুড়ি গুঁজে রাখে। কানের পাশে কড়া পড়ে গেছে। কানটা ভারী হয়ে গেছে।
স্যালি হিগিনস দেখলেন, কফি এসে গেছে। তিনি কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, জাহাজটা দেখে আপনাদের কিছু মনে হচ্ছে না!
—জাহাজটা তো স্যার অনেকদিন থেকেই দেখার ইচ্ছে ছিল। এত শুনেছি। এখন দেখে তো আর দশটা জাহাজের মতোই লাগছে। ইয়াদু ওসাকা ঢোক গিলল বলতে বলতে।
—তাই তো হওয়া উচিত।
মি. হ্যামিলটন বলল, মাঝখানে শুনলাম আপনাদের জাহাজের কোনো খবর নেই।
—মাঝে মাঝে থাকে না। খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন স্যালি হিগিনস। এত দিনের একটা বিশ্বাস এরা ভেঙে দিতে এসেছে?
—যাক ভালোয় ভালোয় শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন।
—ভারী বিশ্বাসী জাহাজ।
ইয়াদু ওসাকার শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। গলা পর্যন্ত টেবিলে ঢাকা। শুধু মুখটা দেখতে পাচ্ছেন স্যালি হিগিনস। হাঁড়ির মতো মুখ। চুল কালো। সজারুর কাঁটার মতো চুল খাড়া। সব সময় স্মিত হাসি। হাসলে দু’টো কান নড়তে থাকে। লোকটা কেন যে হাসছে। কান নড়তে থাকলে ভীষণ অস্বস্তি।। এবং মনে হচ্ছিল ইয়াদু ওসাকা একটা পিপে থেকে গলা বের করে কথা বলছে। কান মলে কান নাড়া বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
ওসাকা খুব গলে গেছে মতো বলল, ভারী ইচ্ছে ছিল, ঠিক ইচ্ছে না বরং স্বপ্ন বলতে পারেন, সিউল-ব্যাংক জাহাজ আমার হাত দিয়ে পাস্ হবে।
স্যালি হিগিনসের সত্যি ইচ্ছে হল কান ধরে বের করে দেবেন। কিন্তু তিনি দাঁত ঠেলে দিলেন ওপরে—বয়েস হয়েছে আমারও ইয়াদু ওসাকা। সত্যি মিথ্যা যা খুশি শুনে এটাকে স্ক্র্যাপ করার জন্য পাগল হয়ে গেছেন। তারপর কেমন জেদী বালকের মতো ভাবলেন, আসলে জাহাজকে ভয় তারও কম নয়। এতদিন তিনি তাকে বাগে রেখেছিলেন, জাহাজ এখন শেষ সফরে তাঁর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি বললেন, জাহাজ তো আপাতত জিলঙ যাচ্ছে।
—তা যাক। হ্যামিলটন বললেন। আপনাদের চুক্তি শেষ না হলে এটাকে ভাগাড়ে নিয়ে যাচ্ছি না। মি. ফ্যাল সব আমাদের বলেছেন।
স্যালি হিগিনস বললেন, যদি এর ভেতর কিছু হয়ে যায়!
—চুক্তিপত্র সে-ভাবেই করা আছে? একটু থেমে হ্যামিলটন চোখ বড় বড় করে বলল, কিছু হবে বলে কি আপনার মনে হচ্ছে?
—না না এমনি বললাম। সব কথাবার্তা খোলামেলা থাকা ভাল।
—আপনি তো শুনেছি জাহাজটাকে সব অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা করে আসছেন।
—এ-সব গল্পকথা। জাহাজ ঠিকই আছে। গুজব বলতে পারেন।
—আমরা তো জাহাজটা সম্পর্কে এত শুনেছি স্যার, উঠেই মনে হয়েছিল, আমাদেরও কিছু একটা হয়ে যাবে।
স্যাালি হিগিনস হা হা হেসে করে উঠলেন।
ইয়াদু ওসাকা মুখ ভার করে ফেলল। এই প্রথম হিগিনসকে দেখলেন, ইয়াদু ওসাকার মুখে কোন কথা নেই। বিমর্ষ। সেই বলল, আমরা তো শুনেছি ক্যাপ্টেন লুকেনার নিজের তদারকে জাহাজটা বানিয়েছিলেন।
—তা হয়তো হবে।
ওসাকা বলল, স্যার সব খবরাখবর নেবার জন্য হামবুর্গ কিছুদিন থেকে গেলাম। রেজিস্টার খাতা, সাল তারিখ, সব জাহাজের নাম ঘেঁটে দেখলাম কোথাও এর কোন রেকর্ডই নেই।
—আছে কোথাও। সব দেখা তো আপনার পক্ষে সম্ভব নয়!
—তা ঠিক বলেছেন স্যার। তবে হামবুর্গ শহরের বাইরে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। সে কেবল বলল, সিউল-ব্যাংক, জাহাজের নাম নয়। অন্য নাম ছিল জাহাজটার। ক্যাপ্টেন লুকেনারকে সে চিনত। কাউণ্ট পরিবারের ছেলে তিনি। বাবার নাম—কি যেন যাক গে ভুলে গেছি। তিনি শেষ পর্যন্ত আর ক্যাপ্টেন লুকেনার ছিলেন না। তাঁকে সী-ডেভিল বলা হত। সমুদ্রে একটা জাহাজ আর একটা মানুষ—অনেক কীর্তিকাহিনী আছে। সে একটা রোমহর্ষক ঘটনা স্যার। বলে ফ্যাক করে হাসতে গিয়ে কেমন চেপে গেল সব কথা।
স্যালি হিগিনস ছাড়বেন কেন! ক্যাাপ্টেন লুকেনার সম্পর্কে লোকটা কিছু খবর রাখে তবে! তিনি বললেন, জাহাজের কি নাম ছিল আপনি জানেন? ক্যাপ্টেন লুকেনার যে জাহাজটা চালাতেন তার নাম আপনার মনে আছে?
ওসাকা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। বসে থেকে সে স্যালি হিগিনসকে যেন ভালভাবে দেখতে পাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন লুকেনার কিংবদন্তীর মানুষ, আর এ-যেন আরও বড়। তাঁকে ভাল করে দেখতে না পেলে যেন ঠিক জমছে না। ওসাকা দাঁড়িয়ে বেশ স্বাভাবিক বোধ করছিল। স্যালি হিগিনস তাকে কি বলেছেন ভুলে গেছে। উল্টে সে বলল, জার্মান ইমপিরিয়াল সার্ভিসে তিনি লেফটেনান্ট কম্যাণ্ডার ছিলেন।
—ওর জাহাজটার নাম জানেন? স্যালি হিগিনস বিরক্ত মুখে কথাটা বললেন।
—হ্যাঁ স্যার। সেলার। কেউ বলে, সিজলার। কেউ বলেছে সিজালার! সঠিক কি হবে জানি না! হ্যাঁ স্যার বাপের নাম মনে পড়েছে—বাপের নাম গ্র্যাফ ফেলিকস্ ফন্ লুকেনার
স্যালি হিগিনস এবার কাগজপত্র দেখছেন। ওর দিকে তাকাচ্ছেন না। সে কি পরীক্ষা দিচ্ছে। সে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ওটা বাপের নাম না ছেলের নাম মনে নেই স্যার।
স্যালি হিগিনস কাগজপত্র একটা পেপার-ওয়েটে চাপা দিলেন। তারপর কেমন হাই তুলে বললেন, লুকেনার সম্পর্কে এত আপনার কৌতূহল কেন?
ওসাকা বলল, স্যার জাহাজটা সম্পর্কে কত কি শুনেছি, সত্যি যদি অশুভ প্রভাব থাকে—যদিও এ-সবে আমার বিশ্বাস নেই তবু কি হয় জানেন স্যার, মন তো মানুষের দুর্বল, দুর্বল মহুর্তে সবই সত্যি মনে হয়। সেজন্য কিছু কিছু খোঁজখবর নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। সবই পেয়েছিলাম—ওদের পারিবারিক মর্যাদা—ওর ঠাকুরদার বাপের খবর। সে একটা ইতিহাস। ওর ঠাকুরদার বাপ শুনেছি স্যার ঘোড়ার ঘাস কাটত।
হ্যামিলটন জানে ওসাকা খুব মজার লোক। স্যালি হিগিনস হেসে ফেলেছিলেন, কিন্তু লোকটা যদি জোরে হাসলে ঘাবড়ে যায়, তিনি সামান্য হাসলেন, হ্যামিলটন জোরে হাসল।
ওসাকা বলল, বিশ্বাস করুন, ঘোড়ার ঘাস কাটতে কাটাতে লোকটা অশ্বারোহী সৈন্য হয়ে গেল। নিজে সৈন্যদল গড়ে তুলল। তখন তো স্যার রাজারা সব ভাড়াটে সৈন্যদল রাখতেন। তখন ওর ঠাকুরদার বাপের বয়স বেশি হয় নি। তের বছরে ঘর ছেড়েছিল, ঘোড়ার ঘাস কাটার কাজ নিয়েছিল, তখন তো স্যার প্রুসিয়ান ওআর চলছে। প্রুসিয়ান আর্মিতে সে তার সৈন্যদল নিয়ে ভিড়ে গেল। এবং ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের আণ্ডারে একজন তখন সে জাঁদরেল জেনারেল। এক নিঃশ্বাসে এতটা বলে সে ভোঁস করে শ্বাস নিল।
হিগিনস বললেন, আপনি দেখছি অনেক খবর রাখেন!
—রাখব না স্যার! ওর ঠাকুরদার বাপের তো শেষ পর্যন্ত গিলোটিন হয়েছিল! বলে চোখ গোল করে ফেলল ওসাকা।
—গিলোটিন! যেন কত স্বাভাবিক কথা। স্যালি হিগিনস বললেন, শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন লুকেনারের কি হয়েছিল বলতে পারেন?
—সে তো ঘুরে ঘুরে জেনেছি অনেক। কিন্তু একটার সঙ্গে আর একটার কোন মিল নেই স্যার।
স্যালি হিগিনস বললেন, মিল পাওয়া খুব কঠিন।
ওসাকা বলল, স্যার এক গ্লাস জল খাব।
স্যালি হিগিনস জল আনতে বলে কাগজের ওপর সামান্য ঝুঁকে পড়লেন। দু’বার তিনবার করে কাটা ক’টা লাইন বার বার পড়লেন। –এখানে তো দেখছি আপনাদের বিক্রি-বাট্টা দর দাম সব কথাবার্তা শেষ। জাহাজ বেচে দিয়েছে তবে!
—হ্যাঁ স্যার।
—তবে আর দেখবেনটা কি!
হ্যামিলটন আমতা আমতা করতে থাকল।
ওসাকা বলল, এতদূর থেকে উড়ে এলাম স্যার, একবার ঘুরে সবটা দেখে যাব না! দেখে না গেলে ঘুম হবে! আপনার হত স্যার বলুন! তাছাড়া অনেক সইসাবুদ আছে। দেখিয়ে দেব, বলে সে প্রায় ঝুঁকে টেবিলের ওপর লাফ দিয়ে উঠে আসতে চাইল।
—তাছাড়া কোথায় কি কি আছে!
—ঠিক আছে আপনি বসুন।
ওসাকা ভালো ছেলের মতো বসে পা নাড়াতে থাকল।
হিগিনস বললেন, গিলোটিন হয়েছিল? ওসাকা খুব বিনীত ছাত্রের মতো আবার দাঁড়িয়ে গেল। সে মুখস্থ বলে যাবার মতো বলল, স্যার ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট মহা পাজি লোক ছিল। ওর ঠাকুরদার বাপ যুদ্ধ জয়ের পর পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে নিতে গেলে বললে, পাওনা-গণ্ডা কি, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছ, কিচ্ছু হবে না। রাগে দুঃখে সব তকমা রাজার পায়ে রেখে সোজা প্যারিসে। তখন স্যার ফরাসী বিপ্লব চলছে। বিপ্লবে যোগ দিয়ে ফেলল। বেশ রাজার বিরুদ্ধে লড়ছে। ভালই লড়ছিল। কাল হল সেই এক পাওনা-গণ্ডা নিয়ে। সে প্যারিসে ফিরে তার দাবির কথা বলল। তার সৈন্যদলের মাইনে বাকি পড়েছে কতদিন—না দিলে চলছে না। ওরা বলল, তোমার বাপু গিলোটিন। একজন লোককে টাকা পয়সা না দিয়ে গিলোটিন করা কত সহজ বলুন। বলে আবার ফ্যাক করে হেসে দিল।
স্যালি হিগিনস শুধু বললেন, খুব সহজ। তারপর দ্বিতীয় আর কোনো কথা না। শুধু বললেন, কোথায় কোথায় সই করতে হবে বলে দিন। সব কাগজপত্র পড়ার আর তাঁর ধৈর্য নেই। এখনই হয়তো তিনি হাই করে ফের চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেবেন।
ওসাকা ঢক ঢক করে সব জলটা খেয়ে ফেলল তখন। বলল, স্যার এখানে। বলে সে ঘুরে স্যালি হিগিনসের প্রায় ঘাড়ের কাছে চলে এল। হাতের চেটোতে মুখ মুছে একটা একটা করে পাতা উল্টে যেতে থাকল, আর স্যালি হিগিনস সই করে যাচ্ছেন। হাত কাঁপছিল সই করতে, বোধ হয় ভীষণ দুর্বল শরীর। একবারে মাংকি-আয়ল্যাণ্ডে উঠে গোটা জাহাজটা দেখার ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। তারপর ভেবেছেন কি হবে দেখে! একটা জীবন এ-ভাবে বাজি রেখেছিলেন একটা জাহাজের পেছনে, এখন তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ওসাকা, পুরানো জাহাজ সম্পর্কে খোঁজখবর করার তোমার বোধ হয় একটা নেশা আছে?
—তা আছে স্যার। পৃথিবীর সব প্রাচীন জাহাজ কবে কোথায় কিভাবে বিক্রি হয়েছে বলে দিতে পারি।
—তা যখন পার সিউল-ব্যাংক কত পুরোনো নিশ্চয়ই বলতে পারবে।
–পারি না।
—কেন?
—খোঁজখবর কেউ শেষ পর্যন্ত সঠিক দিতে পারে নি।
—তার মানে?
—মানে স্যার এও হয় ওও হয়।
স্যালি হিগিনস বললেন, তুমি বেশ মানুষ হে ওসাকা।
ওসাকা বলল, এখানে একটা সই বাদ যাচ্ছে স্যার। এত সব কথার ভেতরও ওসাকার হিসেব ঠিক আছে। ভুলে কিছু বাদ যাচ্ছে না।
স্যালি হিগিনস বললেন, তাহলে সিজলারকে কিনে নিয়ে যাচ্ছ ভাবছ?
—আমার তো মনে হয় তাই। তবে কি জানেন স্যার! এখন আর পাতা ওলটাচ্ছে না সে। পনের বিশ পাতার একটা ডীড। প্রতিটি পাতায় প্রতিটি অক্ষরের প্রতি ওসাকার নজর ঠিক আছে। চোখে মুখে যতটা বোকা বোকা, কাজে কর্মে, তার বিপরীত। বরং ওসাকা ভীষণ ধূর্ত স্বভাবের। সে বলল, সিজলারের সী-ডেভিলের কি হয়েছিল কেউ ঠিক বলতে পারেনি। কেউ বলেছে জাহাজটা ডুবে গেছে বাল্টিক সমুদ্রে। কেউ বলেছে, প্রথম মহাযুদ্ধে তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। ইংরেজদের হাতে জাহাজটা চলে যায়। আবার কেউ বলে থাকেন স্যার, জাহাজটা ডুবেও যায় নি, কেউ ধরেও নিয়ে যায় নি। তিনি নিজে জলদস্যু হবার জন্য মিথ্যা প্রচার করে সরে পড়েছেন। এখনও নাকি লুকেনারকে দেখা যায় কোনো নির্জন দ্বীপে। তিনি পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কেউ বলে থাকে তিনি কোনো কোনো বন্দরে পর্যন্ত মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে চলে আসেন। তাঁকে একা একা হাঁটতে দেখা যায়। সমুদ্রের পাড়ে পাড়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। মনে হয় তিনি আমাদের ভেতরই আছেন স্যার। এরা কখনও মরে যায় না। আমাদের ভেতরেই বেঁচে থাকে।
স্যালি হিগিনস এবার উঠে পড়লেন। তিনি যে নিজে গিলোটিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন কথাবার্তায় এতটুকু বোঝা যাচ্ছে না। সামান্য একটা ডীড সই করার মতো সব কাজ সেরে বললেন, তাহলে চলুন জাহাজটা আপনাদের দেখিয়ে দি। কোথায় কি আছে, রিপোর্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পাবেন। কিছু আবার এদিক ওদিক বিক্রি হয়ে গেলে আপনাদের সত্যি ক্ষতির কারণ ঘটবে।
—তা স্যার ঠিক।
স্যালি হিগিনস উঠে টুপি টেনে নিলেন। তারপর কিছু যেন ভাবছেন এমনভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথায় টুপি পরে নিলেন। পাছে ভেঙে পড়েন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন গত রাতের মতো—ঠিক না। বনি কাছে কোথাও নেই। থাকলে হয়তো সত্যি ভেঙে পড়তেন। অন্যমনস্ক থাকার জন্য বললেন, ফানেল আমরা পাল্টে ছি বছর পনের আগে। ওসাকা ফানেলে দু’বার হাতুড়িতে ঘা মেরে দেখল। স্যালি হিগিনসের কথার সত্যাসত্য যাচাই করে সে খুশী হল। সিঁড়ি ধরে ক্রমে বয়লার-রুমে—এই তিনটে বয়লার। বাঁ দিকে স্টার-বোর্ডে ঢুকে গেল ওরা। পাশে দু’টো জেনারেটর, রেসিপ্রোকেটিং এনজিনের কলকব্জা, কনডেনসার, পাম্প, পাইপের নাম এবং প্রপেলার স্যাফট, সব কাগজের সঙ্গে মিলিয়ে নিল ওসাকা। তারপর প্রপেলার স্যাফটের মাথায় চড়ে বসেছে ওসাকা। সে হাতুড়িতে ঘা মারছে, আর চোখে মুখে এক অতীব বিস্ময়। যেন ভেতরে শুধু স্টিল পোরা নেই, অন্য কিছু ধাতু, সোনাদানা নেইতো! স্যালি হিগিনসের এমনই মনে হতে থাকল। একটা কসাইর মতো চোখ মুখ ওসাকার। লোভে লালসায় চোখ মুখ অধীর। ওসাকা বলল, স্যার শুনতে পাচ্ছেন?
স্যালি হিগিনস বললেন, কী?
—আসুন। কান পেতে শুনুন। বলে সে হাতুড়ি দিয়ে ঠুং ঠুং করে ক’বার ঘা মারল।
স্যালি হিগিনস কান পেতে তেমন কিছু শুনতে পেলেন না।
—শুনতে পাচ্ছেন না আওয়াজটা অনেক দূরে পর্যন্ত স্যাফটের গা বেয়ে চলে যাচ্ছে। যেন এখানে আঘাত করলে সারা জাহাজটা কাঁপছে। সারা জাহাজটা ঝনঝন করে বাজছে। মিরাকল্, সামথিং মিরাকল্ স্যার সে বলতে পারত। কিন্তু খুবই বোকামীর কাজ হয়ে যাবে, পরে যদি জাহাজডুবির খবর দিয়ে বিক্রি-বাট্টার ডীড অচল করে দেয়। সে যে খুশীর চোটে কি সব করতে যাচ্ছিল! সে ঝুলে স্যাফট থেকে নেমে পড়বে ভাবল। নামার সময় মনে হচ্ছে, এত নিচে সে লাফিয়ে নামতে পারবে না। ধপাস করে পড়ে যেতে পারে। সে হেঁটে হেঁটে কিছুটা দুরে গেলে স্যাফট জয়েণ্টে নামার ধাপ পাবে। ততটা হেঁটে গেলে নেমে যেতে পারবে। কিন্তু সে হাতুড়ি দুলিয়ে ডাকল, মি. হ্যামিলটন আসুন। ওর কাঁধে এক হাত রেখে প্রায় শরীর বেয়ে নিচে এল ওসাকা। বলল, কেনাবেচাতে সামান্য লাভ লোকসান থাকে স্যার। এ নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। চলুন ওপরে ওঠা যাক।
স্যালি হিগিনস দেখলেন টানেলের দরজায় চিফ-মেট, ডেবিড, ছোটবাবু সবাই অপেক্ষা করছে।
এ-শরীর নিয়ে কি যে এত নামার দরকার নিচে, ওরা ভেবে পেল না! আর এ-দু’টো লোক সেই থেকে এত কি কথা বলছে! এত কি দেখছে! লোকটার হাতে সেই হাতুড়ি। কানে গুঁজে রাখছে ফের। ওরা স্যালি হিগিনসকে খুঁজতে এসেছে এখানে। শরীর ভাল না। কি যে করছেন!
স্যালি হিগিনস ওপরে উঠে বললেন, মি. ফ্যালকে আমার অভিবাদন থাকল। বলবেন, আমরা ভাল আছি।
ওসাকা বোটে উঠে হওয়ায় হাতুড়িটা দুলিয়ে বলল, বলব আপনারা ভাল আছেন। তারপর ওসাকা দেখল, সিউল-ব্যাংক জলে ভেসে আছে। যত দূরে বোট চলে যেতে থাকল তত জাহাজটা ক্রমে ছোট হবার পরিবর্তে চোখের ওপর বড় হয়ে যেতে থাকল। ভয়ে ওসাকার শরীরে কেমন জ্বর এসে গেল। মাথা ঘুরছে।