।। তেত্রিশ।।

তখন র‍্যাঁ রা লাঁ। ডিং ডিং।

তখন ছোটবাবুর চুল উড়ছে। আর জোরে জোরে গান গাইছে মাউরি যুবক। বেশ দ্রুতগতিতে খালি রাস্তা পেয়ে গাড়ি প্রায় সে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যাথারিন, ওর বুড়ো দাদু, মামা মামীরা বিদায় জানাতে কৌরি-পাইন গাছটা পর্যন্ত এসেছিল। ক্যাথারিনের মুখে ছিল ভীষণ বিষণ্ণতা। সে বলেছে আগামী রোববার আবার আসবে। সে ছোটবাবুকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে ওদের ডেয়ারিফার্ম, ওদের তৃণভূমি, ওদের গমের জমি, আপেলের বাগান আর আঙ্গুরের উপত্যকা

তখন র‍্যাঁ র‍্যা লাঁ। ডিং ডিং। মাউরি যুবক গাইছে। সুন্দর গান। হলুদ রঙের দামী গাড়ি, উজ্জ্বল কোঁকড়ানো চুল মাউরি যুবকের এবং সাদা উর্দি-পরা, একেবারে খুশীতে উপচে পড়ছে। সে এতগুলো বিদেশী মানুষকে বন্দরে পৌঁছে দিতে পারছে বলে ভীষণ খুশী। এবং সে জানে বুড়ো উড সাহেব ওদের সারাক্ষণ কি বলেছে। বলেছে আসলে এ-দেশটার যা কিছু বৈভব সব ইংরেজদের গড়া। এবং যা কিছু আজকের প্রাচুর্য সব আমরা না এলে হত না। আসলে খাবার নাম করে ধরে এনে এ-সব বলা ছাড়া আর কিছু কাজ নেই যেন মানুষটার। চার বছরের ওপর সে ওদের ফার্মে আছে। চিনতে বাকি নেই। কিন্তু সে গান গাইছে এবং পেছনে চারজন নাবিক ওরা বেশ হল্লা করছে। মাঝে মাঝে সুন্দর মতো মানুষটি ওদের থামতে বলছে। সে গান গাইছে, কারণ সেও কম যায় না। সে এতক্ষণ এই দেশের যা কিছু সৌন্দর্য অথবা প্রতিপত্তি বলা যায়—টাসম্যান না এলে যে কিছুই হত না অর্থাৎ তিনিই প্রথম পলিনেশীয় মানুষ যিনি জাহাজে চড়ে চলে এসেছিলেন এ-দেশে তারপর এমন সুন্দর দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো, দেশটি আবিষ্কার করে ফিরে গেলেন—সেই ডিং ডিং বাজনা, দলে দলে সমুদ্রে একেবারে জারি গান গেয়ে বৈঠা বেয়ে ওরা পাল খাটিয়ে চলে এসেছিল।

সে বেশ গর্বের সঙ্গে বলে যাচ্ছিল আসলে ওদের সবটাই পড়ে পাওয়া চোদ্দ গণ্ডা। বোঝলেন না স্যার, আমরা না এলে কোথায় থাকত এ-সব ফুটানি।

অনিমেষ বলছিল—তা ঠিক।

মৈত্র একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। অনিমেষ বন্ধু একটু খেলেই মাতলামি করতে ভালবাসে। ছোটবাবু চুপচাপ বসে রয়েছে। রাত এখন নটা বেজে সতেরো। জ্যোৎস্না এবার উঠবে। পূবের আকাশে কিছু পাইন গাছের ফাঁকে জ্যোৎস্না দিগন্তে ঝলমল করছিল।

খাবারের তালিকা ছিল বেশ লম্বা। যদিও ওরা কেউ খেয়ে খুব খুশী নয়। খেতে হয় খাওয়া। একেবারে অখাদ্য বানিয়ে রেখেছে সব। তবু ওরা খেয়ে ঢেকুর তুলেছে। খাবার শেষে সামান্য ড্রিংকস। কিন্তু যা হয় খেতে থাকলে কেবল খেতেই ইচ্ছে হয়। এত খাওয়ার পরও ওরা চার জন ভীষণ ভদ্র ছিল কথাবার্তায়। এমন কি যখন টলছিল আর জাতীয় সঙ্গীত গাইছিল সবাই তখনও কে বলবে ওরা জাহাজি। অনিমেষ বলেছিল, ধর, বলেই সে ষাঁড়ের মতো যেই না গাইলে, ধন ধাইন্যে আর তখনই মৈত্র হা হা করে উঠেছিল, অনিমেষ, ওটা ধন ধাইন্যে হবে না ধন-ধান্যে বল। আর যতবারই ধন ধান্যে অনিমেষের গলায় ধন ধাইন্যে হয়ে যায় ততবার হা হা করে হেসে দিয়েছিল বন্ধু আর মৈত্র। যদিও ক্যাথারিন অথবা ওর আত্মীয়েরা এর এক বিন্দু বুঝতে পারে নি, ওদের গান ওরা বেশ চেঁচিয়ে শেষ করেছে। ক্যাথারিন বড় একটা হলঘরে পিয়ানো বাজিয়েছিল। ওরা খালি গলায় গাইবে বলে তখন ক্যাথারিন পিয়ানোর ওপর ভর করে কেবল দেখছিল—ওরা চারজন দাঁড়িয়েছে। ওরা জনগণ গাইল না ওরা গাইল ধন ধান্যে পুস্পে ভরা কারণ এ-গানটাই বেশি শিখিয়েছে অমিয় ওরা কিছু ভাল না লাগলে গাইত জাহাজে এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।

তখন মাউরি যুবক গাড়িতে গাইছিল—রা র্যাঁ লাঁ। ডিং ডিং। সব দেশবাসীদেরই এক কথা এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।

মাউরি যুবক তখন সাঁ করে গাড়ি ঘুরিয়ে বলল, বুঝলেন না স্যার, যত রাস্তা-ঘাট এই ধরুন না সেন্ট্রাল রোড ধরে যদি আপনারা কখনও অকল্যাণ্ড থেকে ওয়েলিংটনে যান, দেখতে পাবেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য। রোতোঁরা কিন্তু পলিনেশিয়ান নাম। রেস্তোঁরার ভেতর দিয়ে চলে গেছে সেন্টাল রোড। ওয়েফোতো নদী পাবেন যেতে যেতে। দু’-পাশে দেখতে পাবেন সব সুন্দর সুন্দর গরম জলের প্রস্রবণ। রোতোঁরা হ্রদের মতো হ্রদ আর একটাও নেই পৃথিবীতে। জল বরফের পাতলা চাদরে ঢাকা। অথচ হ্রদের পাড়ে আপনি খালি পায়ে হাঁটতে পারবেন। ঠাণ্ডা নেই। এত বেশি উষ্ণতা। সুন্দর ইংরেজীতে লোকটা বলে যাচ্ছিল—রোতোঁরা ইজ দ্য সেন্টার অফ মাউরি লাইফ অ্যাণ্ড কালচার, উইথ এ মডেল ভিলেজ। সে তারপর বলল, আপনারা সেখানে গেলে মাউরি কনসার্ট শুনতে পেতেন। পারলে সে যেন এখন গাড়ি সেখানে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। এবং সেই ডিং ডিং বাজনা। সে এতসব ওদের হয়ে বলতে পারায় খুব খুশী। সে কেবল গুনগুন করে জ্যোৎস্না রাতে গান গাইছিল।

জ্যোৎস্না রাতে গান গাইতে সবারই ভাল লাগে। অনিমেষ বন্ধু যা খুশি গাইছিল। ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। শীত তেমন লাগছে না। দু’পাশের বাড়ি-ঘর উপত্যকা অথবা নির্জন বনভূমি ফেলে গাড়ি ক্রমে নিউপ্লিমাথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঠের পর মাঠ সব ফাঁকা জমিন। মাঝে মাঝে হাই-ওয়ে ধরে বাস ট্রাক যাচ্ছে, আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। কেবল চারপাশে পাইনের বনাঞ্চল। এবং তার ভেতর মরা চাঁদ কেমন শীতের জ্যোৎস্নায় স্থির হয়ে আছে দিগন্তে। ছোটবাবু কিছুই দেখছিল না। দেখতে ভাল লাগছিল না। মাথাটা বেশ ঝিম-ঝিম করছে। সে একপাশে মাথা কাত করে দিয়েছে। ক্যাথারিন যেন সারাক্ষণ ওকে কিছু বলতে চেয়েছিল। অথবা ওর সুন্দর রঙ এবং লাবণ্য শরীরে, কখনও চোখের তারায় সমুদ্রের নেশা। ছোটবাবুর কি যে ভাল লাগছিল। সেই তৃণভুমিতে ঘাসের ভেতর হারিয়ে গিয়ে ডেকেছিল, ছোটবাবু দ্যাখো কি সুন্দর ভেড়ার বাচ্চাটা। একটা সাদা ভেড়ার বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘাসের ভেতর থেকে ক্যাথারিন উঠে এসেছিল।

ক্যাথারিনকে ছেড়ে আসার সময় তার ভীষণ খারাপ লাগছিল। আগামী রবিবার সে আসবে। সাতটা দিন তার এখন ক্যাথারিনের কথা ভাবতে ভাবতে কেটে যাবে। সে বুঝতে পারছিল এ-ভাবে তার সব এখন নতুন নতুন কষ্ট তৈরি হবে মনে। ক্যাথারিনকে দেখার আগে সে এটা কখনও বুঝতে পারত না।

এবং ওপরে অর্থাৎ জাহাজে ওঠার সময় মনে হয়েছিল ভারী একাকী সে। তার মাকে সে এসময় অন্যদিন মনে করতে পারত। কিংবা কখনও ঘুম ভেঙে গেলে সে ভাবত, মা তার জেগে আছে হয়তো। আজ সে কিছুই মনে করতে পারছে না। বরং জাহাজের একঘেয়েমী কাজ ভীষণ বিরক্তিকর। আর্চি তাকে অযথা কষ্ট দিচ্ছে। জ্যাক আজ যা করেছে! সব মনে হতেই সে ভীষণ ব্যাজার করে ফেলল মুখ। সামান্য নেশা এবং নেশায় টলছে, এটা সে যেন কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। তবু ঠাণ্ডা বাতাসে এবং বেশ সময় পার হয়ে গেছে বলে এখন আর মাথা তেমন ভারি নয়। বরং এমন নেশাতে শুয়ে শুয়ে ক্যাথারিনকে ভাবতে তার ভাল লাগবে।

আর সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দু’বার চাবি ঘুরিয়ে অবাক। দরজা খুলছে না। সে হয়তো ছুটে ডেভিডকে চিৎকার করে ডাকত, দ্যাখো কে আমার কেবিন বন্ধ করে রেখেছে। এ-সব কি হচ্ছে! আমাকে জ্যাক কি ভাবে!

আর তখনই দরজা সামান্য খুলে গেল।

ছোটবাবু বুঝতে পারল নেশার জন্য এমন হয়েছে। চাবি ঘুরছিল না ঠিকমতো। চাবি সে ঠিকমতো লাগাতে পারে নি। শেষে চাবি ঠিকমতো ফের ঘুরিয়েছে বলেই হয়তো খুলে গেছে দরজা। ভেতরে ঢুকে

নিরিবিলি দরজা বন্ধ করার সময়ও লক্ষ্য করল না ওর কেবিনে সাদা গোলাপ গুচ্ছ। এবং সুন্দর বিছানাতে অলিভ পাতার গন্ধ। যে গন্ধটা নিজের শরীরে আছে অথবা ক্যাথারিনের পাশে পাশে হাঁটলে যে হালকা আতরের গন্ধ ছিল এখনও যেন তেমনি এক গন্ধ। আসলে বুঝি সেই সুন্দর স্বপ্নটা সে মনের ভেতরে ভাসতে দেখছে। যে-ভাবে স্বপ্ন দেখলে শরীর ক্রমে হাল্কা সৌরভে ভরে যায়, ভাল লাগে, বেশ এক ভেতরে ভেতরে স্বপ্নের খেলা অথবা লুকোচুরি বলা যায় নিজের সঙ্গে নিজের, সে ঘরে ঢুকে নিজের সঙ্গে নিজের খেলা আরম্ভ করে দেবে ভাবল—এবং তখনই মনে হল সাদা মসলিনের ভেতর কেউ নীহারিকাপুঞ্জ হয়ে আছে। যা সে ধরতে পারবে না, ছুঁতে পারবে না, কেবল চুপচাপ বসে দেখতে পাবে। পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে সে যেমন আগে সমুদ্রে নক্ষত্র দেখত আকাশে এও তেমনি। প্রায় সেই নীহারিকাপুঞ্জের মতো রহস্যময়ী।

সে চুপচাপ বসে তাকে দেখতে থাকল।

ওর ভালই লাগছিল। সে একটু নেশার ভেতর এমন দেখবে নাতো কি দেখবে! সেই সুন্দর নীহারিকাপুঞ্জ তেমনি পোর্ট-হোলে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

সে বলল, বেশ মনোহারিণী। তোমাকে আমি দেবী বলতে পারি। পোর্ট-হোলে মুখ রেখেছ কেন। একবার ফিরে দাঁড়াও। দেখি তোমাকে। বড় হতে হতে এমন একজনকেই চেয়েছি মেয়ে।

বেশ কুহেলিকা। ছুঁয়ে দেখবে নাকি। নড়ছে না। তালপাতার বাঁশির মতো তার তীক্ষ্ণ শরীর। বেশ লম্বা উঁচু সাদা জুতো মোজা, হাতে সাদা দস্তানা, নীলাভ চুলে গোলাপের কুঁড়ি, সাদা রিবন চুলে। মোমবাতির শিখার মতো জ্বলছে।

ছোটবাবু গলার টাই আলগা করতে থাকল। সে ভালভাবে দাঁড়াতে পারছে না অথবা সেই তৃণভূমিতে ছুটে ছুটে এখন হয়তো ক্লান্ত। বাংকের ওপর বসে টাই খুলে ফেলল। কোট খুলে প্যান্ট খুলে চুপচাপ ঘুমের পোশাক পরে ফেলল। মেয়েটা এখনও তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। সে বলল, এবারে, যাও। আমি ঘুমোব।

চোখেমুখে জল দিলে সব কেটে যেতে পারে। সে বাথরুমে ঢুকে চোখে ভাল করে জলের ঝাপটা দিল। ঘাড়ে জল থাবড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলতে চাইল। সে তো আজ খুব একটা বেশি খায় নি। সামান্য খেয়েই এমন ভুল দেখতে শুরু করেছে! জাহাজে নানারকম কিংবদন্তী আছে। সে ভাঙা জাহাজে আছে বলে সবকিছু মেনে নিয়েছে। সব ভৌতিক ব্যাপার অথবা কিংবদন্তীর মতো এই জাহাজ চলেছে তো চলেছেই। জাহাজ তার সবকিছু নিয়ে এইসব ভৌতিক ঘটনার ভেতর চলছে। সে এখন আর এ-সবে কিছুতেই ভয় পাবে না।

তবু সে দরজা খুলতে সাহস পাচ্ছে না। খুললেই আবার হয়তো দেখে ফেলবে, কোনো রহস্যময়ীর মুখ। বরং সে ভেতরেই দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ তার অন্তত নেশা ঠিকমতো না কেটে যাচ্ছে। এমন ভেবে একাকী গোপনে বাথরুমে পালিয়ে থাকছে। মাথা পরিষ্কার না হলে সব আজগুবি ছবি কেবল দেখতে পাবে কেবিনে।

তখন মৈত্র দেখল একটা চিঠি গড়াগড়ি খাচ্ছে ওর বাংকে। সে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়বে ভেবেছিল। এ-বন্দরে পৌঁছেই তার একটা চিঠি পাওয়ার কথা। শেফালীর চিঠি। কিন্তু একটাও চিঠি আসে নি। এমন কি সে পানামা ক্যানেলে ভেবেছিল চিঠি পাবে, নিউ অরলিনসে ভেবেছিল ঠিক চিঠি পাবে, ভিকটোরিয়া বন্দরে যদি একটা চিঠি আসত—চিঠি না এলে যা হয় অভিমান, চিঠি না এলে যা হয় যেন শেফালী তাকে ভুলে যাচ্ছে। শেফালীকে বুয়েনস আয়ার্স থেকে টাকা পাঠাতে পারে নি বলে সেই যে রাগ করে আর চিঠি দিল না আজও তেমনি। চিঠিটা পেয়েই সে লাফিয়ে উঠল। চিঠি। চিঠিতে চুমো খেল। কে দিয়েছে, কোথাকার চিঠি, সে একবারও ভেবে দেখল না। কারণ পৃথিবীতে এখন একমাত্র একটি মেয়েই তার কথা ভাবে। মাত্র একজন যুবতীর চোখে ঘুম থাকে না, সে না থাকলে যুবতী ভারি একাকী এবং একঘেয়েমীর ভেতর এই চিঠি লেখা শুধু—আর কিছুই না। চিঠিটা পেয়েই সে ছেলেমানুষের মতো কি করবে ভেবে পেল না। এমন একটা চিঠি এতক্ষণ অবহেলায় বাংকে পড়ে ছিল ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। সারেঙ-সাব ওর বাংকে চিঠি রেখে গেছেন। বিছানা ঠিকঠাক করে শুয়ে পড়ার সময় এমন একটা চিঠি! সে তাড়াতাড়ি চিঠিটা পড়তে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে গেল। আর তখনই কেমন গণ্ডগোল হয়ে যায়। চিঠির ঠিকানায় শেফালীর হাতের লেখা জ্বলজ্বল করছে না। অন্য হাতের লেখা। সে তাড়াতাড়ি খামের ভেতর থেকে চিঠি বের করে নিল। না ভেতরেও অন্য কেউ কিছু লিখেছে। সে আরও দ্রুত শিরোনামা পড়ে অবাক হয়ে গেল। পরম কল্যাণবরেষু—এবং পিসিমা তাকে চিঠি লিখেছে। চিঠির ভেতর ওর জাহাজ কবে ফিরছে কারণ শেফালী মাস দুই আগে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেছে এ-সব কথা—মৈত্র চিঠিটা পড়তে পড়তে কেমন পাথর হয়ে যাচ্ছিল। দিন-মাসের সে হিসাব ঠিক মেলাতে পারছে না। কেমন একটা গণ্ডগোলের ছবি গোটা চিঠিটাতে এবং সে হতবাক, এখন সে ভেবে পাচ্ছে না কিভাবে দিন-মাসের হিসেব করতে হয়। বার বার বোকার মতো কড় গুনে দেখছে সময়মতো সে তো শেফালীর কাছে ছিল না। শেফালীর ছলনা সে তবে ধরতে পারেনি।

জাহাজিদের ভাগ্যে এমন ঘটনা নতুন নয়। সে তবু বার বার কড় গুনে নিজের হিসেবের ভুল ধরার জন্য কেমন মরিয়া হয়ে উঠল।

এখন ফোকসালে কেউ নেই। এত রাত যে, বোধহয় অমিয় জাহাজে আর রাতে ফিরছেই না। অমিয় থাকলে তাকে বলা যেত, তোর অঙ্কে মাথা কেমন রে? আমার হিসেবটা মিলছে না। এত বার কড় গুনেও মেলাতে পারছি না। তুই দেখ তো মেলাতে পারিস কিনা।

তারপরই কেমন হুঁস ফিরে আসছে। সে কি ভাবছে সব! সে তো কাউকে হিসেবটার কথা বলতে পারবে না। সে কি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাবে। কারণ বলা তো যায় না, সে এখন থেকে সামনে কাউকে পেলেই হয়তো বলবে, দেখুন তো মশাই, সময়মতো তখন আমি বাড়ি ছিলাম কিনা। না তখন আমি সমুদ্রে, শেফালীর একা একা ভাল লাগছিল না বলে বিমলবাবুর সঙ্গে চুপি চুপি দেখা করেছিল, কথা বলেছিল, তারপর আর ভাবতে পারে না। কেমন পা টলতে থাকল। মাথা ঘুরতে থাকল। তার সামান্য অবলম্বন তাও ক্রমে মুছে যেতে থাকল।

বাথরুমে তখনও ছোটবাবু চুপচাপ। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে হবে শীতের রাস্তায় বিদেশ বন্দরে পথ হারিয়ে ফেলেছে। সকাল না হলে সে আর জাহাজে ফিরতে পারছে না।

অমিয় তখন হেঁটে ফিরছিল জাহাজে। মাউরি যুবতী তাকে কতরকমের স্বপ্নের কথা বলেছে! দূরগামী সমুদ্রের মানুষ অমিয়। মেয়েটা অমিয়কে সমুদ্রের বেলাভূমিতে আবিষ্কার করেছিল। এবং এইসব মেয়েরা সমুদ্র থেকে ঘুরে-আসা মানুষদের দেখলেই টের পায়—ওরা সমুদ্র-মানুষ। ওদের গায়ে সমুদ্রের গন্ধ লেগে থাকে। চোখে সমুদ্রের নেশা। ভাল করে চোখ তুলে দেখতে পর্যন্ত ভয় পায়।

এবং অমিয় বলেছিল, মেয়ে, আমার কাছে সাত রাজার ধন এক মানিক আছে। চল না কোনো দ্বীপে। আমরা একটা দ্বীপ কিনে ফেলতে পারব। আমার আর সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগছে না।

.

তখন বনি ক্রমে অস্থির হয়ে পড়ছে। তার ভেতর কি যে অধীরতা, সে কিভাবে ছোটবাবুর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বুঝতে পারছিল না। সে আশা করেছিল, ছোটবাবু তার পাশে এসে দাঁড়াবে, আদর করে ওকে বুকে টেনে নেবে—অথবা কখনও সে দু’হাত তুলে দিলে ছোটবাবু বুঝতে পারবে, সে বনি, সে মেয়ে। তার সব ছেলেমানুষী ছোটবাবু সহজেই ক্ষমা করে দেবে।

কিন্তু বাথরুমে যেন এখন কেউ নেই। জলের ঝাপটা কখন থেমে গেছে। ঝর ঝর করে জল পড়ার শব্দ পর্যন্ত হচ্ছে না। একেবারে চুপচাপ এবং দূরে সব পাহাড়ী উপত্যকাতে নক্ষত্রের মতো আলোগুলো ক্রমে নিভে আসছে। ক্রমে এই শহর বন্দর এবং সমুদ্র শীতের ঠাণ্ডায় নিঝুম। সে হাত পা নাড়ালে পোশাকের খসখস শব্দ পর্যন্ত টের পাচ্ছে।

আর মেজ-মিস্ত্রি তখন স্থির চোখে শুয়ে আছে। ওকে দেখলেই বোঝা যাবে গায়ে সৌরভ মেখে যে বালিকা বড় হচ্ছে জাহাজে তার জন্য চোখে ঘুম নেই। কি নরম মাংস, আর অস্থিমজ্জায় লোলুপতা। সে শুয়ে শুয়ে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ঠোঁট চাটছে।

.

ডেভিড জাহাজে ফেরে নি। সে ফিরবে না। বন্দরে থেকে গেছে। শীতের জ্যোৎস্নায় কোনো সবুজ মাঠে সে এবং এক যুবতী পাহাড়ের নিচে জড়াজড়ি করে রয়েছে। এমন উষ্ণতা সে আর কোথাও পাচ্ছে না। সমুদ্রের গর্জন তাদের মাঝে মাঝে ভীষণ চঞ্চল করে তুলছে।

আর নিচে এনজিন-রুমে মাত্র একজন ফায়ারম্যান—মাত্র একটা বয়লার চালু, এই জাহাজে আলো জ্বেলে সব উষ্ণতা রক্ষা করছে সে। সেই কিট কিট শব্দ ব্যালাস্ট পামপের। সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে মহাকায় যন্ত্রদানব। তার চার বড় লোহার থামের ওপর ঘোড়ার পিঠের মতো লম্বা সিলিণ্ডার। যেন সেই আবহমানকাল থেকে অহর্নিশ ছুটতে ছুটতে প্রাচীন অশ্বের মতো সে সহসা এখন স্থির। সমুদ্রে আবার কোথাও যুদ্ধ ঘোষণা না হলে সে আর ছুটছে না। সে এখন চুপচাপ কেবল বিশ্রাম নিচ্ছে, অথবা চোখ বুজে ঝিমুচ্ছে।

জেটিতে দাঁড়িয়ে এ-সব কিছুই বোঝা যাবে না। শুধু দেখা যাবে জাহাজ সিউল-ব্যাংক। সে কিনারায় লেগে রয়েছে। সমুদ্রের অতিকায় ঢেউ ভেঙ্গে সে এসে এখানে ভিড়েছে বোঝাই যায় না। তার আলো, ঘর, বাতি সবকিছু এত শান্ত আর এত নিরীহ

.

তখন ছোটবাবু দরজা খুলে বের হবে ভাবল। এ-ভাবে ভয়ে লুকিয়ে থাকা ঠিক না। সে সাহসী হতে চাইছে। সে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে পারত, সবাই এসে যখন দেখতে পেত, ভূতটুত কিছু নেই, তখন হাসি ঠাট্টা মশকরা, সে আর এ-জাহাজে জোকারের মতো কাজকর্ম করতে পারে না।

আর এ-ভাবে যা হয়, সে নিজেকে কাপুরুষ ভেবে ফেলল। সে সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে। যত সহ্য করছে তত সবাই তাকে পেয়ে বসেছে। সে বরং ভাবল, সকাল হলে, জ্যাকের জামা-প্যান্ট ঠিক ডেকে দাঁড়িয়ে যেমন দু’হাতে তার সবকিছু টেনে জ্যাক ফালা ফালা করে দিয়েছিল তেমনি, সে সব ফালা ফালা করে দেবে। কাপ্তানের কাছে নালিশ গেলে সে বলবে, সে অকপটে বলবে—স্যার আমার জামা-প্যান্ট দেখুন। আমি কি করেছি! আমাকে বার বার কতবার এ-ভাবে জ্যাক অসম্মান করবে!

দরজায় খুট করে শব্দ হতেই বনি মুখ ফেরাল।

ছোটবাবু দরজা খুলে আবার যেন ভূত দেখেছে। পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, আবার তুমি জ্যাক! এবং সেই ঘণ্টা-ধ্বনি মাথায়, যেন সীমাহীন অন্ধকারে এক অতিকায় ঘণ্টা নিরবধিকাল মাথার ভেতরে বেজে চলেছে। সে এ-ভাবে চোখে মুখে অন্ধকার দেখলে সহসা কেমন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে থাকল। জ্যাক যে আবার চাতুর্যে মনোহারিণী—এসব তার কাছে ভীষণ মূল্যহীন। জ্যাক যে থর থর কাঁপছে চোখে মুখে পৃথিবীর যাবতীয় সুষমা নিয়ে সে তার কিছুই লক্ষ্য করছে না। যেন দীর্ঘকালের অসম্মান অপমান মুহূর্তে দু’হাতে ওর সুন্দর গাউন ছিঁড়ে ফেলে দিলেই শেষ হয়ে যাবে।

জ্যাক বলল, আমি বনি, আমি মেয়ে। তুমি এটা কি করছ ছোটবাবু!

ছোটবাবু কিছু যেন শুনতে পাচ্ছে না। কেবল ঘণ্টা-ধ্বনি, চোখ জ্বলছে ছোটবাবুর। কাণ্ডজ্ঞানহীন যুবকের মতো ছোটবাবু দু’হাতে ওর সাদা মসলিনের গাউন চেপে ধরেছে। গলার কাছে ছোটবাবুর শক্ত দু’হাত। বনি ছোটবাবুর চোখ দেখে কাতর, সে বার বার বলছে, ছোটবাবু আমি মেয়ে। তুমি বিশ্বাস কর আমি মেয়ে।

আর ছোটবাবুর মাথায় তেমনি ঘণ্টা-ধ্বনি। সেই পাহাড়ের ওপর সে ঠিক জলদস্যুর মতো উঠে যাচ্ছে যেন। কোনো হুঁশ নেই। সে দেখতেও পাচ্ছে না ঠিক হাতের নিচে সেই অসংখ্য তরঙ্গ মালা সমুদ্রের, ছিঁড়ে দিলেই প্রলয়ঙ্কার ঘটনা ঘটে যাবে পৃথিবীতে। দু’হাতে পোশাকের ভেতর হাত চালিয়ে ক্রমে সে সুন্দর পোশাক ফালা ফালা করে দিতে গেলে—কি যে কাতর চোখ মুখ। বনি কিছুতেই ছোটবাবুর সঙ্গে পেরে উঠছে না। দু’হাতে সে তার পোশাক সামলাচ্ছে। আর সেই শক্ত হাতের ভেতর কখন যে নাভিমূলে, ছোঁড়া পোশাকের ভেতর নীলাভ বর্ণমালা অবিকল যুবতীর শরীর হয়ে গেল, ছোটবাবু বুঝতে পারছে না। মাথায় শিরা-উপশিরায় রক্তের চাপ, জোরে শ্বাস পড়ছে—সে পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো! চোখের সামনে সে এ-সব কি দেখছে! ছেঁড়া পাল খাটানো জাহাজের অভ্যন্তরে সাগরের তাজা মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে সবকিছু। জ্যাক নড়ছে না। যেন জ্যাকের আর কিছু করণীয় নেই। জ্যাক কোনরকমে দু’হাতে তার রত্নরাজি বিছানার চাদর টেনে শুধু ঢেকে ফেলল। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল।—ছোটবাবু, তুমি এত নিষ্ঠুর।

ছোটবাবু চিৎকার করে উঠল, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি জ্যাক। এ-সব আমি কি দেখছি! আমি কি দেখছি এ-সব!

বনি দেখছে ছোটবাবুর চোখে বিভ্রম। চোখে মুখে ভীষণ হতাশা। কেমন মায়া আবার বেড়ে যায়। বনির বলার ইচ্ছে হল, তুমি পাগল হয়ে যাও নি। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর ছোটবাবু। ঈশ্বরের দোহাই। তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দ্যাখো আমি বনি। আমি মেয়ে। আমার সবকিছুর ভেতর আমি বনি। তুমি ঠিকই দেখছো। সে এ-সব কিছুই বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেবল কাঁদছে। ছোটবাবু যদি সত্যি পাগল হয়ে যায়। ওর চোখের দিকে কিছুতেই তাকানো যাচ্ছে না। চোখে কেমন বিভীষিকা। ছোটবাবুর কি আবার সেই মাথার আঘাত অথবা মাথার ভেতর তার কিছু হচ্ছে! আঘাত ভীষণ প্রবল ছিল, জ্যাক বার বার প্রশ্ন করেও কোন সঠিক জবাব বাবার কাছ থেকে পায় নি। ছোটবাবুর চোখ এখন পাথরের মতো স্থির। বনি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

ছোটবাবুর পাথরের মতো মৃত চোখ দেখতে দেখতে নিজের লাঞ্ছনার কথা বনি একেবারে ভুলে গেল। ছোটবাবুকে এখন নিরাময় করে তুলতে না পারলে সে মরে যাবে। সে ওর ছেঁড়া পোশাকে কোনরকমে শরীর ঢেকে উঠে দাঁড়াল। ছোটবাবুর ঠিক বুকের কাছে মুখ রাখার মতো ধীরে ধীরে বলল, তুমি এস। সে যেন সেই চিরদিনের যুবতীদের মতো স্নেহের স্বরে ডেকে নিয়ে গেল ছোটবাবুকে। ফিসফিস গলায় বলল, আমি মেয়ে ছোটবাবু। তুমি বিশ্বাস কর আমি মেয়ে। আমি বনি। বাবা আমাকে ভয়ে ছেলে সাজিয়ে রেখেছে।

ছোটবাবু নড়ছে না। স্থির। অপলক। জ্যাককে সে দেখছে।

বনি বুঝতে পারছে এখনও বিভ্রম কাটে নি। সে বলল, ছোটবাবু, আর্চি জাহাজে উঠেই টের পেয়েছে, আমি মেয়ে। তোমাকে আমি ভালবাসি বলে ওর ভীষণ হিংসে। সে তোমাকে বারবার বিজে নামিয়ে কষ্ট দিচ্ছে।

আর এইসব কথাই তার মগজে বার বার ঘণ্টা-ধ্বনির মতো যেমন শব্দগুলো কখনও আর্চি আৰ্চি, ঘণ্টার শব্দ—আর্চি আর্চি, আবার কখনও বিল্জ বিল্জ, ঘণ্টার শব্দ—বিল্জ বিল্জ—এ-ভাবে সেই এক শব্দতরঙ্গ নিরবধিকাল ধরে বেজে বেজে তাকে কখন যেন আবার নিরাময় করে দেয়।

বনি বলল, তুমি পাগল হয়ে যাও নি। তুমি ভাল আছো।

ছোটবাবু বলল, তাহলে তুমি জ্যাক নও। তুমি বনি।

—আমি বনি ছোটবাবু। বলে, সে আবার তার বুকের ওপর থেকে দু’হাত বাতাসে ডানার মতো ভাসিয়ে দিল। চোখ মাটিতে রেখে সে যে মেয়ে তার প্রকাশ শরীরের সব চারুকলাতে তুলে ধরতে ধরতে কখন কিভাবে যে ছোটবাবুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজেও জানে না। ছোটবাবু অবোধ বালকের মতো যেন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে তখন। ওপারে ওর ঘুড়ি উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। সে কেবল সেই দূরন্ত বাতাসে ক্রমে দেখতে পাচ্ছিল, ঘুড়িটা অনেক দূরে, অনেক শস্যক্ষেত্র পার হয়ে চলে যাচ্ছে। যেন এই তার নিয়তি। কিছু আর করার নেই। এবারে সে বনিকে ভীষণ আবেগে জড়িয়ে ধরল। তারপর কি করতে হবে সে তো এখনও ভালো জানে না। সে ভীষণ ছটফট করতে থাকল।

বনি মুখ তুলে তাকিয়ে আছে।

ছোটবাবু বলল, আমি কি করব তারপর?

বনি বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল। ধীরে ধীরে বলল, আমিও ঠিক জানি না ছোটবাবু আমরা কি করব তারপর!