।। ছিচল্লিশ।।
ডেবিড তখন নেমে যাচ্ছিল সিঁড়ি ধরে। ওর ওয়াচ শেষ। সে ঘুমোবার আগে আকাশের সব নক্ষত্রমালা দেখবে। সকাল হবার আগে যে সব নক্ষত্র ওর চারপাশে দিগন্তে অথবা মাথার ওপর থাকে তাদের দেখে জাহাজের সাইট নেবে। এ-সব কাজের পর ওর আর কিছু করণীয় থাকে না। তার শুয়ে পড়ার কথা। সারারাত কাপ্তান ঘুমোন নি। কেবল ভায়োলিন বাজিয়েছেন। বুড়ো মাঝে মাঝে বেশ ধার্মিক মানুষ হয়ে যান। এবং এত ভাল ব্যবহার যে মনেই হয় না তখন তিনি তাদের ওপরআলা। তিনি যেন তাদের সবাইকে নিয়ে এক সংসারের মানুষ। তাদের জন্য বুড়ো মানুষটার ভাবনার অন্ত নেই। লগ- বুক জমা নেবার সময় বুড়ো মানুষটা একটা কথা বলেন নি। কোনোরকমে আপদ বিদায় করতে পারলে যেন বাঁচেন। উপাসনার মতো মনে হয়েছিল তাঁর চোখ মুখ। সারারাত তিনি ভায়োলিন বাজাবেন, এটা সে ওয়াচ বুঝে নেবার সময় টের পেয়েছিল। থার্ড-মেট বলেছে বুড়ো ভায়োলিনে স্পিরিচুয়ালস বাজাচ্ছে। শেষ সফরে বুড়ো মানুষটা বুঝি আর নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
তবু যা হয়ে থাকে, ব্রীজে পায়চারি করার সময় সমুদ্রে সে অনেকক্ষণ ঝুঁকে ছিল। পাশে চার্ট-রুম, তার পাশে কাপ্তানের কেবিন। কেবিনের দরজা বন্ধ। শুধু পোর্ট-হোল খোলা। খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল সব এবং এ-সব বাজনার ভেতর এক আশ্চর্য কাতর অভিমান অথবা বলা যায় জাহাজিদের দুঃখ থেকে থাকে। বাড়ির জন্য ওর মনটা ভার হয়ে উঠেছিল। কতকাল সে যেন এবিকে না দেখে আছে। মনে হয় অনেক অনেক বছর আগে, সে জাহাজে উঠে এসেছে, তার ছেলেমেয়েরা অনেক অনেক আগে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছে, এখন ফিরে গেলে সে তাদের বুঝি আর ঠিক ঠিক চিনতে পারবে না। তারা সবাই বড় হয়ে গেছে।
এ-সব কারণে সে সোজা নিচে নেমে যেতে পারে নি। বোট-ডেকে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকেছে। সমুদ্রে ঠাণ্ডা বাতাস। আর যা থাকে শুধু নক্ষত্র আকাশে দপদপ করে জ্বলছে। যেন কোনও অতিকায়, অলৌকিক সত্ত্বা সেই সব নক্ষত্রের আলো সকাল হয়ে যাচ্ছে বলে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে। ক্রমে এ- ভাবে আকাশ নক্ষত্রশূন্য করে দিয়ে তিনি সমুদ্রে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছেন। এবং ক্রমে এ-ভাবে চাঁদ ডুবে গেল। ক্রমে এনজিনের শব্দ ফানেলের ধোঁয়া আর দিনের আলো ফুটে উঠবে বলে দিগন্তের আকাশে সামান্য লাল আভা। দু’টো একটা পারপয়েজ মাছ জাহাজের খুব কাছাকাছি এসে আবার ডুবে গেছে। এবং মনে হল তখন বোটের ও-পাশে চুপচাপ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। একা। সে ডাকল, ছোটবাবু।
ছোটবাবু কোনো সাড়া দিল না।
সে উঠে বোটের ও-পাশে চলে গেল। বলল, তুমি এত সকালে!
ছোটবাবু বলল, ডেবিড তুমি কিছু বুঝতে পারছ?
ডেবিড একেবারে হাঁ। সে বলল, কি!
ছোটবাবু বলল, কিছু বুঝতে পারছ না?
ডেবিড বলল, না তো।
—তুমি টের পাচ্ছ না আর্চির ঘরে খুব লোকজন আসছে?
–কখন?
—রাতে। এনজিন-কশপ ডেক-সারেঙ তার দলবল।
ডেবিড বলল, ওরা কেন আসে রাতে!
ডেবিডকে কিছু বলা নিরর্থক। আসলে ছোটবাবু বুঝতে পারছে ডেবিড, জাহাজে সংগোপনে একটা বড়রকমের ষড়যন্ত্র গড়ে উঠছে টের পাচ্ছে না। সে সব খুলে বলতেও পারছে না। সে বলল, এলবা আবার ফিরে এসেছে।
–কোথায়?
–মেন-মাস্টে বসে রয়েছে।
ডেবিড দেখল সেই অতিকায় পাখিটা মাস্তুলের ওপর ঘুমোচ্ছে। সে বলল, ওকে জাগিয়ে দাও।
—থাক না। ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। সমুদ্রে যেটুকু সামান্য অন্ধকার ছিল, এখন আর তাও নেই। চারপাশের সমুদ্র বেশ শান্ত নিরীহ। এবং তখন ছোটবাবুর মনে হল, ঠিক নর্থ-ইস্ট-নর্থে একটা কালো অতিকায় পাহাড় সমুদ্রের বুক চিরে ক্রমান্বয়ে আকাশের গায়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। পরিচ্ছন্ন আকাশের নিচে একটা কালো পাহাড় সমুদ্রের অতলে ডুবে আছে, আর দিগন্তের লাল আভার নানাবর্ণের কিরণ সেই গম্বুজ অথবা মিনারের মতো জেগে-ওঠা পাহাড়টাকে ঝলসে দিচ্ছিল।
পাহাড়টা দেখতে দেখতে তার খেয়াল নেই কখন সূর্য সমুদ্রে জেগে গেছে। কখন এনজিন-কশপ তার দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাজের কথা নিচে, ওরা নিচে না নেমে সবাই জড়ো হচ্ছে বোট- ডেকে। ওরা খুব ভালো মানুষের মতো বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। আর্চি খুব দ্রুত সিঁড়ি ভাঙছে। স্যালি হিগিনসের দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁকছে—ডেনজার এহেড স্যার।
ডেবিড ছোটবাবুকে বলল, কি ব্যাপার! আর্চি চিৎকার করছে কেন!
ছোটবাবু এবার পেছনে তাকাল। দেখল একদল জাহাজি আর্চির পেছনে পেছনে যাচ্ছে। সে তাদের ভেতর এনজিন-সারেঙকে দেখতে পেল না। এবং অন্য অনেকের ভেতর সে পাঁচ নম্বর সাব, ডেক- সারেঙকে দেখতে পেল। ডেক-সারেঙ আর্চির সঙ্গে গোপনে কি সব পরামর্শ করছে তখনও। ছোটবাবু বুঝতে পারছে, শেষ কামড় আর্চি এবার বুঝি বসাতে চায়।
ছোটবাবু আর দেরি করল না। সোজা নেমে পিছিলের দিকে ছুটতে থাকল। গ্যালিতে ঢুকে ভাণ্ডারীকে বলল, চাচা সারেঙ-সাব কোথায়?
ভাণ্ডারী রুটি বেলছিল। সে ব্যালনা দিয়ে সামান্য পিঠ চুলকে বলল, নিচে।
নিচে খোঁজ করেন। ছোটবাবু নিচে নেমে অবাক। ওর ঘরে কেউ নেই। সারেঙ-সাব একা বাংকে বসে আছেন। সে ডাকল, চাচা!
সারেঙ-সাব মুখ তুলে বললেন, বোস। কি ব্যাপার!
—ওরা জাহাজে মাস্তার দিয়েছে কেন?
–লতিফ রাতে পরী দেখেছে। জাহাজে রাতে পরী ঘুরে বেড়ায়।
—মিথ্যে কথা। তুমি কখনও দেখেছ?
–আমি কি করে দেখব!
—কে কে দেখেছে? ছোটবাবুর সংশয়ে প্রায় দম আটকে আসছিল। সারেঙ-সাব কত সহজে কথাটা বললেন! সারেঙ-সাব জানেন না এতে কি সব সাংঘাতিক সত্যাসত্য লুকিয়ে আছে। ওর দু-হাতে চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে মাথার। বনি, বনি প্রায় সে তোতলাতে থাকল। সারেঙ-সাব ছোটবাবুকে এত বিচলিত কখনও দেখেননি। তিনি বললেন, কি হয়েছে! তুই এমন করছিস কেন! বিড়বিড় করে কি সব বলছিস! বোস না।
সে বলল, আর কে দেখেছে?
—আরও সব কে কে দেখেছে!
—কখন?
—যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, ডেকের ওপর লোকজন থাকে না তখন। পরীর মতো কেউ জাহাজে ঘুরে বেড়ায়। ইয়াসিন দেখেছে। এনজিন-কশপ বলছে, সেও দেখেছে। ভুতুড়ে জাহাজ। ওরা কেউ থাকবে না জাহাজে। নেমে যাবে বলছে। পোর্ট এলেই নেমে যাবে।
ছোটবাবু বলল, আপনি এ-সব বিশ্বাস করেন চাচা! এবং তার এখন বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বনি খুব ছেলেমানুষ চাচা, সে তো পাগলের মতো কখনও কখনও মেয়ের পোশাকে রাতে আমার কেবিনে নেমে আসে। সতর্ক থেকেও সে দু’এক রাতে লোকজনের সামনে পড়েছে তাই বলে পরী হতে যাবে কেন! সত্যি বলছি এটা ভুতুড়ে জাহাজ নয় চাচা। অথচ সে একটা কথাও বলতে পারল না। সে প্রায় এবার গোপনে চাচার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। বলল, সব বাজে কথা। সব মিথ্যে কথা।
—মিথ্যে নাও হতে পারে। আল্লার দুনিয়ায় জিন পরী থাকবে না সে কি করে হয়! তার জন্য ভয়ের কি আছে। বাড়িয়ালা তো মাঝে মাঝে পরী দেখতে পায়। কৈ তিনি তো ভয়ে জাহাজ থেকে নেমে যাচ্ছেন না।
—না না সব মিথ্যে কথা। সে প্রায় দু’হাত তুলে চিৎকার করতে থাকল। সব মিথ্যে কথা চাচা। জাহাজটার নামে অযথা দোষ চাপিয়ে সবাই নেমে যেতে চায়।
সারেঙ-সাব মুখে সামান্য সাদা পাতা ফেলে বললেন, তুই তো দেখেছিস। তুইও তো একবার রাতে কি দেখে পালিয়ে এসেছিলি।
—সব মনের ভুল চাচা। তারপর বলতে ইচ্ছে হল, সব আর্চির ষড়যন্ত্র। সে জ্যাককে ধরিয়ে দিতে চায়। কাপ্তানকে ছোট করতে চায়। কিন্তু সে কেবল ছটফট করতে থাকল। কিছুতেই সারেঙ-সাবকে বোঝাতে পারছে না—যদিও দেখে থাকে, সে বনি। জ্যাক রাতে মেয়ের পোশাকে জাহাজে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে। তারপর যা হয়, সব রাগ বনির ওপর। এবারে মর। আমি কিচ্ছু জানি না। সবার সামনে তোমাকে আর্চি উলঙ্গ করে ছাড়বে। তারপর মনে হল সে এ-সব কি ভাবছে! সে বলল, আমি যাচ্ছি। আপনি বসুন। ওরা মনে হয় সবাই মিলে কাপ্তানকে অপমান করতে চায়!
সে আর দেরি করল না। পিছিলে উঠেই সে দেখতে পাচ্ছে, বোট-ডেকে সিঁড়ির মুখে আর্চি হাত নেড়ে জাহাজিদের কি সব বক্তৃতা করছে। জাহাজে মৈত্রদা নেই। তার রাগ তখন মৈত্রদার ওপর। তুমি ভীষণ স্বার্থ পর দাদা। এমন একটা সময়ে আমি কি করি! বনি কোথায়! সে কেবিনের ভেতরে বোধহয়। ওর এখন বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু সে কি দেখছে! বনি দরজা খুলে ছুটে ওপরে উঠে যাচ্ছে কেন! প্রায় লাফ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে বোট-ডেকে উঠে গেল। ডাকল, জ্যাক তুমি এখানে কেন! কিন্তু কার কথা কে শোনে। জ্যাক আর্চিকে বলছে, কেন চেঁচাচ্ছেন। বাবা ঘুমোচ্ছে। কি হয়েছে আপনাদের। জ্যাকের চোখ জ্বলছে। সারারাত জেগে কাপ্তান বোধহয় তবে সত্যি এখন ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু কে কার কথা শুনছে! চেঁচামেচি জটলা, কেউ বলছে, পুড়িয়ে দাও সব। কেউ বলছে, আমরা দরকার হলে কাপ্তানকে জলে ফেলে দিতে পারি। চিফ-মেট, সেকেণ্ড মেট ডেবিড, রেডিও-অফিসার এবং অন্যসব অফিসার জাহাজের ব্রীজে উঠে এসেছে। ওরা বুঝতেই পারছে না এইসব জাহাজিরা এখন কি চায়। ওদের চোখ মুখ এমন ‘রক্তাক্ত কেন। চোখ জ্বলছে সবার। আর্চির কথাবার্তা ওরা একেবারে বশংবদের মতো শুনছে। যত শুনছে তত আর্চি জুস পেয়ে যাচ্ছে। আর তখনই ক্ষিপ্ত বাঘের মতো, কাপ্তান দরজা খুলে বের হয়ে এসেছেন। বলছেন চিৎকার করে—হাই! এই উল্লুকের বাচ্চা, চেঁচাচ্ছ কেন? কি হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে আর্চির গলা খাটো হয়ে গেল। আমতা আমতা করতে থাকল। আর্চি কি বলতে গেছে ফের এক ধমক। এবং সঙ্গে সঙ্গে আর্চি ঢোক গিলে যেন সব হজম করে নিল। যেন সে কত পবিত্ৰ ইচ্ছাতে জাহাজের এত ওপরে উঠে এসেছে। জাহাজের ভাল চায়, তার তো দায় নেই, তবু কাপ্তানের কথা ভেবে সে এতটা দায়িত্ব নিয়ে এখানে এসেছে। সে না এলে এরা সব জংলী নেটিভ ইণ্ডিয়ান অবিনয় আসামীরা এতক্ষণে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিত। এমন সব বললে, কাপ্তান নিস্পৃহ গলায় বললেন, কি হয়েছে! তোমাদের জন্য একটু ঘুমোতে পারলাম না।—এই আর্চি এই চিফমেট কি বলছে ওরা!
চিফ-মেট বলল, বুঝতে পারছি না স্যার।
—তবে আছ কি করতে? যত সব হতভাগার দল!
এবং কাপ্তানকে দেখে সবাই কিছুক্ষণ একেবারে চুপ মেরে গিয়েছিল। কোন কথা বলছে না। বাড়িআলা বলতে! ভেতরে ভয় ষোল আনা। এনজিন-কশপ তবু একপা এগিয়ে গিয়েছিল কিছু বলবে। আর তখনই চিফ-মেট তড়তড় করে নিচে নেমে একেবারে সারেঙের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, কি, কি বলছে ওরা?
এনজিন-সারেঙ হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছেন। এতটা হবে তিনি বুঝতে পারেননি। ওদের দৌড় আর্চি অথবা চিফ-মেট পর্যন্ত। কিন্তু তিনি ভাবতে পারেন নি একেবারে খোদ বাড়িআলার কেবিনে গিয়ে হামলা করবে। তিনি এক ধমক লাগালেন। বললেন, এনজিন-কশপ আমি কী মরে গেছি। তিনি আর্চির দিকে তাকাতেই বুঝলেন আর্চি ওর কথা একদম পছন্দ করছে না। আর্চিকে তিনি বলতে পারতেন, জী সাব, জাহাজে এনজিন-কশপ কে! আমি থাকতে সে আসে কেন! সে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছে কেন! কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন আর্চির মতলব ভাল না। কি বলবেন এনজিন-কশপকে মুহূর্তে গুলিয়ে ফেললেন।
আর্চি তখন বলল, স্যার এরা কি বলছে শুনুন।
কাপ্তান এখনও স্লিপিং গাউন পরে আছেন। প্রায় আলখেল্লার মতো দেখতে! সাদা চুল। চোখে তাড়াতাড়ি চশমা দিতে ভুলে গেছেন। নিচে যারা যারা দাঁড়িয়ে আছে সবাইকে তিনি ঠিক চিনতে পারছেন না। চিফ-মেট দাঁড়িয়ে আছে—কি সব বলছে। তিনি তার একবর্ণ শুনতে পাচ্ছেন না। জ্যাক একপাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। ডেবিড বিড়বিড় করে বকছিল, ছোটবাবু পরী, হোয়াট পরী!
এত দুঃখেও ডেবিডের কথায় ছোটবাবুর হাসি পাচ্ছিল। আর সে দেখছে তখন সেই অখণ্ড মেঘের পাহাড় এসে সুউচ্চ পর্বতমালার মতো সমুদ্রে বড় হয়ে যাচ্ছে। নর্থ-ইস্ট-নর্থে আর আকাশ দেখা যাচ্ছে না। এত বড় সুউচ্চ পর্বতমালা মনে হয় ক্রমে সমুদ্র আকাশ এবং ছোট্ট অসহায় জাহাজটাকে সহজেই ঢেকে দেবে। রেডিও-অফিসার কেন যে এখনও দাঁড়িয়ে আছে! অথবা এ জাহাজের নেভিগেটার ডেবিড, চিফ-মেট সবাই এখানে দাঁড়িয়ে এমন একটা বিদ্রোহের ভেতর চুপ মেরে গেছে কেন? সমুদ্রে এত বড় বড় সব পাহাড়শ্রেণী—কোথাও তার মাথা বরফে ঢাকা আবার কোথাও নীলবর্ণের সব পাইনের মতো গভীর অন্ধকার যেন একটা তাড়কা-রাক্ষসীর মতো আকাশের ওপর দিয়ে ভেসে আসছে। কেউ লক্ষ্যই করছে না ওটা কি। মেঘের এমন বর্ণমালা সে যেন ডাঙায় কোনদিন দেখেনি। প্রচণ্ড গরমে সমুদ্র মরুভূমির মতো তেতে উঠছে। আর চিফ-মেট তখন বলছে, পরী, হোয়াট পরী! পাঁচ-নম্বরকে বলতে যাবে, হোয়াট পরী তখন সাবাস নেবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে ডেক-সারেঙ। সে চেঁচিয়ে বলছে—ওম্যান–ঘোস্ট স্যার। ওম্যান-ঘোস্ট সিন। এভরি নাইট ওম্যান-ঘোস্ট ওয়াক। উই স স্যার। উই স।
ছোটবাবু সোজা দাঁড়িয়ে আছে। সে লক্ষ্য রাখছে জ্যাক তখন কোথায়। আর্চি জ্যাককে কিভাবে দেখছে। কাপ্তান ঝুঁকে আছেন নিচে। চিফ-মেট ওপরে উঠে গিয়ে না বললে তিনি বোধ হয় কিছু বুঝতে পারছেন না। তিনি কেবল মাঝে মাঝে আর্চির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেন। আর তিনি লক্ষ্য রাখছেন চিফ কতক্ষণে ওপরে উঠে আসবে। আর্চির কথা তিনি একদম শুনতে চাইছেন না। তিনি চিৎকার করে উঠলেন—হাই।
সঙ্গে সঙ্গে চিফ-মেট লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেল। বলল, ওম্যান ঘোস্ট।
সঙ্গে সঙ্গে স্যালি হিগিনসের মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এবং খুব সহজেই তিনি সেই ফ্যাকাশে মুখ লুকিয়ে ফেলার জন্য হা হা করে হেসে উঠলেন। দু’পাটি বাঁধান দাঁত নেই বলে হাসির শব্দ তেমন তীব্র হল না। তিনি তাড়াতাড়ি ঢুকে গেলেন কেবিনে এবং দাঁত আর চশমা পরে ফের ফিরে এসে বললেন, কি হয়েছে তাতে! আমিও তো দেখি। দুর্বল মুহূর্তে মানুষ এসব দেখে থাকে।
আর্চি বলল, স্যার আপনার দেখা ওদের দেখা তফাত আছে না!
কাপ্তান বললেন, আর্চি, তোমরা এখন যেতে পার।
আর্চি চিৎকার করে বলল, আপনারা যান। কিন্তু একজনও নড়ছে না দেখে বলল, কেউ যাচ্ছে না স্যার।
স্যালি হিগিনস ওপর থেকে ফের ঝুঁকে পড়লেন—হাই। ওদের যেতে বল।
স্যালি হিগিনস দু’জন সারেঙকে উদ্দেশ করে কথাটা বললেন।
ডেক-সারেঙ মাথা নিচু করে রাখল। যেন স্যালি হিগিনসের এক বর্ণ ইংরেজী সে বুঝতে পারছে না। এই যে ছোটবাবু সামনে কি চুপচাপ ভাল মানুষ। সারেঙ ফের বলল, আপনারা এখন কি করবেন ভেবে দেখুন। বাড়িআলা আপনাদের যেতে বলছেন।
ওরা একসঙ্গে হাত তুলে বলল, আমাদের কি হবে জেনে নিন।
স্যালি হিগিনস কেমন ভেতরে ভেতরে এই সব মানুষের জেদ দেখে মুষড়ে পড়েন। জ্যাককে হঠাৎ ধমকে উঠলেন, তোমার এখানে কি? যাও কেবিনে যাও।
আর্চি খুব খাটো গলায় সামান্য শিস দিচ্ছে। জ্যাক ফাঁপড়ে পড়ে গেল। জ্যাক নেমে গেলে সে খুব ভাল মানুষের মতো বলল, আপনারা কী! সামান্য পরী দেখে জাহাজ ছেড়ে পালাতে চাইছেন! ছি ছি!
ওরা বলল, হ্যাঁ সাব জাহাজ ভাল না। অনেক সয়েছি। মৈত্র মশায় পাগল হয়ে গেল। সমুদ্রে অগ্নিকান্ড, বিষাক্ত পাখিদের আক্রমণ, রাতে জাহাজে পরী ঘুরে বেড়ায়। আমাদের কপালে আর কি আছে জানি না। হুজুর এবারে আমরা ক্ষেমা চাই।
আর্চি চোখ ট্যারা করে বলল, জাহাজে মেয়েভূত কি করে থাকবে! আর একটা মেয়ে থাকলেও না হয় কথা ছিল। জাহাজে মেয়ে থাকবে কি করে? হুঁ। কার্গো-শিপ, কি বলেন স্যার। সে স্যালি হিগিনসের মুখের ওপর কথাটা বলে ভারি অন্যায় করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল, অ্যাবসার্ড। জাহাজে মেয়ে ভাবা যায় না। সে হা হা করে হেসে উঠল। জাহাজে মেয়ে ভাবা যায় না।
স্যালি হিগিনস কেমন সব সাহস হারিয়ে ফেলছেন। তিনি ফ্যাসফেসে গলায় আর্চিকে সমর্থন জানালেন। সত্যি কার্গো-শিপে মেয়ে ভাবা যায় না।
—তা হলে স্যার! এটা একটা কথা! ওরা বলবে আর আমরা বিশ্বাস করব। এরা জংলী অসভ্য অজ্ঞ, এদের ভুল ভেঙে দেয়া দরকার না স্যার।
স্যালি হিগিনস ভেতরে ভেতরে ছটফট করছেন। গুরুতর সব কথাবার্তা। আর্চি তার স্বপক্ষে কথা বলছে। আর্চির ওপর সংশয় এবং আর্চিকে তিনি উল্লুকের বাচ্চা বলে অসম্মান করেছেন! তিনি নিজের কাছে কৈফিয়ত দেবার মতো বললেন, আমার মাথার ঠিক নেই আর্চি। ওদের বুঝিয়ে তুমি বিদায় কর। যেন এটুকু বলে তিনি এবার ভেতরে ঢুকে যাবেন। এবং ফের ঘুমোবেন।
আর্চির বলার ইচ্ছে হল, বাঞ্চোত এবার তুমি বেশ ঘায়েল হয়েছ। তোমাকে নিয়ে আমি দ্যাখো না কি খেলাটা খেলছি, উল্লুকের বাচ্চা শয়তান তুমি। সব গোপন রেখেছ। তোমার বজ্জাতি বের করে দিচ্ছি। সে তারপর পরম পুরুষের মতো চোখ-মুখ করে রাখল কিছুক্ষণ। কিভাবে এখন এগোবে, সামান্য চোখ বুজে যেন ঠিক করে নিচ্ছে। সে তারপর খুব বিজ্ঞজনের মতো জাহাজিদের বলল, আপনারা এবার সবাই দেশে ফিরতে চাইছেন। আপনাদের এতদিন একনাগাড়ে সমুদ্র সফর আর ভাল লাগছে না। আপনারা মেয়েমানুষ দেখতে ভালবাসেন। সবসময়—যেমন যে কোনো কাজের সময় মাথায় একটা মেয়েমানুষের ছবি থাকে…তাকে নিয়ে আপনারা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন। কতরকমভাবে মেয়েমানুষ চিবিয়ে খেতে আপনাদের ইচ্ছে হয়। ভেতরে রহস্যময় জ্বালা। সমুদ্রের একঘেয়েমীতে মেয়েমানুষের প্রতি সবারই লোভ ভীষণ। জাহাজে যদি পেয়ে যাই—আহা সুস্বাদু খাবারের মতো, কাজেই মাঝে মাঝে চোখের ওপর ওদের ছায়া দেখবেন না তো একটা বুড়ো শয়তানের মুখ দেখবেন আপনারা! সে মাঝে মাঝে খারাপ কথায় এলে আর্চি আমাদের দিয়ে আরম্ভ করছে। সে বলছে এই যে আমরা কবে থেকে ভাবছি দেশে এবার হয়তো ফিরব অথচ জাহাজটা কিছুতেই মুখ ফেরাচ্ছে না, আমরা ভেতরে ভেতরে মরিয়া হয়ে উঠছি। জাহাজে আগুন লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে এটা খুব দোষের না। খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা নাবিক আমাদের একটা ইজ্জত আছে। আমরা খুশিমতো কিছু করতে পারি না। সে একটু থামল। একনাগাড়ে বলতে বলতে সে একবার দেখে নিল কে কোথায় আছে। জ্যাক কোথায়! জ্যাক নেই। কেবিনে নেমে গেছে। ওর দরজা খোলা। এবং সে বুঝতে পারছে জ্যাক নিচে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। ওপাশে দৈত্যটা দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করে রেখেছে। বয়লার স্যুট পরেছে বলে ওর শরীর আরো বেশি মজবুত দেখাচ্ছে। আর্চি ছোটবাবুর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। সে আরও ক্ষেপে গেল।—এই শয়তানের বাচ্চা তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে কেন! কাজ নেই! এটা তোমার বাবার জাহাজ, কাজ না করে ঘুরে বেড়াবে!
ছোটবাবু চোখ তুলে তাকাল। শয়তানের বাচ্চা সে ছাড়া আর কে হবে। আর্চি দুলে দুলে কথা বলছে। আর্চি যেন বাঘের মুখোশ পরে আছে। আর্চি ওপরে দাঁড়িয়ে রিঙের খেলা দেখাচ্ছে এখন। ছোটবাবু একটা কথা বলতে পারছে না। আর্চিকে এভাবে দেখলে ঠিক একটা জানোয়ার না ভেবে পারা যাচ্ছে না। কি অসীম ধূর্ত এবং একজন সাধারণ নাবিকের মতো স্যালি হিগিনস চিফ-মেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আর্চির মুখের ওপর কারো কথা বলার সাহস নেই। আর্চি তেমনি খাঁচায় পোরা বাঘের মতো দুলে দুলে একবার সামনে একবার পেছনে হেঁটে যাচ্ছে। ছোটবাবু এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মাথায় সেই ঘন্টা আবার বাজছে। সেই ঘন্টার শব্দ, যেন মাথার ভেতরে অজস্র বুদবুদ উঠছে শব্দের তরঙ্গে। আর তেমনি মাথার ওপর সেই মহাকায় রাশি রাশি মেঘ ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গাছের শেকড়ের মতো ফালা ফালা বিদ্যুতের ছটা আকাশের গায়ে ফুটে উঠে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। কড় কড় শব্দ—প্রায় বজ্রপাতের সামিল। সবাই সহসা সেই বজ্রপাতের শব্দে লক্ষ্য করল সমুদ্রে ভয়ংকর ঘন অন্ধকার। প্রায় যেন আকাশ আর সুমদ্র গভীর অন্ধকারে ক্রমে এক হয়ে যাচ্ছে। জাহাজের সব আলো আবার ডেকে জ্বালিয়ে দিতে হবে। দিনের এই মধ্যপ্রহরে এটা যে কি হয়ে যাচ্ছে—কেউ একদম পাত্তা দিচ্ছে না। আর্চি কি বলে শেষ করবে বক্তৃতাটা তার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। ছোটবাবু শেষ পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে পারল না। কারণ আর্চি প্রবল প্রতাপান্বিত মানুষ হয়ে যাচ্ছে ফের। যেমন জাহাজে উঠে আর্চিকে দেখলে ভয়ে সংশয়ে বুক গলা শুকিয়ে যেত এখনও তেমনি। ছোটবাবু সন্তর্পণে নেমে গেল উইনচে। উইনচে নেমে একটা বড় হাতুড়িতে দমাদম ঘা মারতে থাকল। সব ভেঙে চুরে সব মিথ্যা সব মিথ্যা বানানো স্যালি হিগিনস, আপনি কেন এত বড় একটা ট্রাপে পড়ে যাচ্ছেন, আর্টি কেন আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে—আপনি স্যালি হিগিনস বুঝতে পারছেন না আৰ্চি কি চায়! বনি তুমি, তুমি এর জন্য দায়ী। তোমাকে আমাদের জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ছাড়া আর বুঝি কোনো উপায় থাকবে না। আর তার কি যে হয়ে যায়—না না বনিকে কেন জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হবে! স্যালি হিগিনস আপনি আর্চির ট্র্যাপে পড়বেন না। আর্চি শেষে কি বলবে আমি জানি। আমি আমি বার বার এই আমির ভেতর হাঁটু মুড়ে কেমন একদল আমি তার মাথার ভেতর কেবল বুদবুদ তুলে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে।
তখনই আর্চি চিৎকার করে বলছে, ঐ দ্যাখুন স্যার—ঐ যে বসে আছে। দেখতে পাচ্ছেন ঐ দেখুন আবার সে ফিরে এসেছে। শয়তানটা সবকিছুর মূলে। ঐ শয়তান পাখিটা। আপনারা বিশ্বাস করুন যতদিন নচ্ছার পাখিটা ছিল না, জাহাজের সব ঠিক-ঠাক ছিল। পাখিটা উড়ে আসার পর থেকেই জাহাজটা শয়তানের পাল্লায় পড়ে গেছে। পাখিটা আসলে পাখি না স্যার। পাখিটা আমার ধারণা ক্যাপ্টেন লুকেনারের প্রেতাত্মা।
একটু থেমে আর্চি ফের বলল, – বুঝলেন স্যার—ডেনজার এহেড। ওর মতলব ভাল না। ওর জন্য আমাদের সামনে যত বিপদ। জাহাজিরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে—হওয়া স্বাভাবিক। এখন আমাদের এই সংস্কারকে না মেনে উপায় নেই। আমাদের কি করা উচিত বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। ওটাকে সরিয়ে দিতে না পারলে জাহাজের বিপদ কাটবে না। আমি বলছি স্যার আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি ওটা সরিয়ে দিতে পারলে আপনার জাহাজে কেউ আর পরী দেখবে না। কেউ আত্মহত্যা করবে না, বিষাক্ত পাখিদের আক্রমণ ঘটবে না, সমুদ্রে অগ্নিকান্ড দেখা যাবে না—সবাই ভাবছে পাখিটা এভাবে জাহাজের পেছন নিয়েছে কেন! আপনারা বলুন—কে আছেন বলতে পারেন, সে প্রায় কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে এবং এভাবে যেন গলা চিরে যাবে।
—আপনারা বলুন কে কবে দেখেছেন এভাবে একটা অ্যালবাট্রস দিন নেই রাত নেই মাসের পর মাস জাহাজের পেছনে উড়ে বেড়ায়। একে যদি আপনারা ভয়ে কিছু করতে সাহস না পান আমি আমি এতগুলো মানুষের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতে রাজী আছি।
এবং সঙ্গে সঙ্গে সব জাহাজিরা আর্চির শেষ কথা এবং কোনরকমে প্রায় সব কথার কিছু কিছু অর্থ ধরতে পেরে বুঝতে পেরেছে আর্চি তাদের শুভাশুভের জন্য আত্মত্যাগের বাসনা জানিয়েছে। সবাই প্রায় জয়ধ্বনি দেবার মতো থি চিয়ার্স ফর আর্চি এবং সেই শব্দমালার ভেতর যেন একটা কঠিন নিয়তি থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করছে বারবার। তারা এখন সবাই আর্চির জন্য সহজেই প্রাণ বিপন্ন করতে পারে।
আর্চি একটু দম নিয়ে বলল, তাহলে আপনারা যেতে পারেন। সবাই সঙ্গে সঙ্গে জটলা থেকে বের হয়ে আসছিল এবং ঠিক বোট-ডেক থেকে নেমে যাবে তখনই ফের চিৎকার, আমি শুধু হাতে লড়ব কি করে! এতো আর একটা সাধারণ পাখি নয়। দেখুন কেমন জুলজুল করে তাকাচ্ছে। দি ডেভিল। দি সী ডেভিল। লেট হার ডাই। সে হাত তুলে মেন-মাস্টের ওপর নিশ্চিন্তে বসে থাকা পাখিটার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার সময় খুব সতর্ক গলায় বলল, স্যার।
স্যালি হিগিনস আর্চির অশুভ মুখের দিকে তাকালেন।
আর্চি স্যালি হিগিনসের কাছে গিয়ে খুব নিচু গলায় বলল, —স্যার, জ্যাককে সাবধানে রাখবেন। খুব বেঁচে গেছে জ্যাক। ওরা জ্যাককে সন্দেহ করছিল। আপনি গোপনে একটা পাপ কাজ জাহাজে চালিয়ে যাচ্ছেন। সব ঘুরিয়ে দিলাম। বন্দুকটা দেবেন। ওটাকে না মেরে ফেললে হারামজাদারা স্বস্তি পাবে না। অল ইন্ডিয়ান ডগস লাইক টু কিল দ্য বার্ড। পাখিটাকে মেরে ফেললে যদি আপদ দূর হয় ক্ষতি কি স্যার। জাহাজ থেকে সংশয় যত সরিয়ে দিতে পারেন ততই মঙ্গল।
স্যালি হিগিনস, চিফ-মেট পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। স্যালি হিগিনস আর একটা কথা বলতে পারছেন না। তাঁর সত্তাসুদ্ধ টান দিয়েছে আর্চি। চিফ-মেট নিচে নেমে গেল। এমন হবে সে যেন জানত। বারবার সে বলেছে বনিকে রাখা ঠিক হবে না, সে বড় হয়ে যাচ্ছে। এবং আর্চির চোখে মুখে অতীব লোভ। আর্চি সেয়ানা অথচ খুব সৎ মানুষের মতো এখন ক্যাপ্টেনের সব যেন উপকার করে যাচ্ছে! আর্টিকে সাহস নেই আর তিনি ঘাঁটাতে পারেন। যেন ঘাঁটালেই আর্চি চিৎকার করে উঠবে, ইফ ইউ লোয়ার দ্য বোট, ইউ উইল গেট দিস হারপুন ইন ইউর বেলি। সুতরাং স্যালি হিগিনসকে আর্চি যা যা বলবে সব সুড়সুড় করে মেনে নিতে হবে। ঘাঁটালেই জ্যাকের ছদ্মবেশ খুলে দেবে আর্চি।
এখন স্যালি হিগিনস আর আর্চি। আর্চি দু’পায়ের ওপর ভর করে বেশ শক্ত চোখে মুখে দেখছে স্যালি হিগিনসকে। স্যালি হিগিনস দূরবর্তী আকাশে যেন কিছু দেখতে পাচ্ছেন। অজস্র বিদ্যুতের ছটা এবং স্তব্ধ সমুদ্র। প্রলয়ঙ্কর ঝড় ওঠার আগে সবকিছু মন্থর স্থির। বাতাস একটুকু বইছে না। জাহাজিরা সবাই কাজে লেগে গেছে ফের। অ্যালবাট্রস পাখিটা ঝড়ের পূর্বাভাস বোধহয় নাকে শুঁকে টের পাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে পাখা ছড়িয়ে উড়ে যাবে ভাবছিল আবার কি ভেবে ঠোঁট গুজে দিচ্ছে। আর্চি বন্দুক না নিয়ে নামবে না। ঘোর অন্ধকারে জাহাজ সমুদ্র মানুষজন সব ডুবে যাচ্ছে। গুমগুম শব্দ উঠছে সমুদ্রে। আর্চি সেই মৃদু গলায়, যেন কাক-পক্ষী টের না পায় একেবারে অনুগত মানুষের মতো বলল, স্যার ওরা বলছে জাহাজটা দোষ পেয়েছে। সেই এক কথা সবার মুখে। অশুভ প্রভাবে জাহাজ পড়ে গেছে। কে বা কারা যে ছড়িয়ে দিচ্ছে সব গুজব!
তিনি নিজে এক রকমভাবে এ-সব বিশ্বাস করতে ভালবাসেন, কিন্তু আর্চি এ-সব নিজের কাজে লাগাচ্ছে। অন্যসময় হলে পাছায় লাথি মেরে এখান থেকে নামিয়ে দিতেন—ইউ লোফার, হিপোক্র্যাট, দ্য আগলিয়েস্ট ক্রীচার…এখন তিনি যেন শুধু কোয়ার্টার-মাস্টারকে খবর পাঠাতে পারেন—জাহাজে হিবিং-লাইন বেঁধে দিতে বল, বোট-ডেকে টুইন-ডেকে যেখানে জাহাজিরা হেঁটে যায় হিবিং-লাইন বেঁধে দিতে বল। টানেল-পথ খুলে দিতে বল। ক্রমে যা বুঝতে পারছি ঝড় মহাপ্রলয়ের মতো নেমে আসছে সমুদ্রে। তিনি ডাকলেন, সেকেন্ড!
—ইয়েস স্যার।
—কাম ইন
আর্চি, স্যালি হিগিনসোর সঙ্গে কেবিনের ভেতর ঢুকে গেল।
তিনি একটা কথা বললেন না। লকারের দরজা খুলে ধরলেন। আর্চি একেবারে হামলে পড়ল বন্দুকটার ওপর। তারপর বের করে বাঁটে দু’টো থাপ্পড় মেরে ওর নল ট্রিগার সব দেখেশুনে যখন মনে হচ্ছে না নকল কিছু ধরিয়ে দিচ্ছেন না তখন সে ভাবল বেশ সহজেই এখন নেমে যাওয়া যায়। আর কথা বলার তেমন কিছু দরকারও নেই। আর তখনই কেন জানি মনে হল হাজার হোক জাহাজের সর্বময় কর্তা, দু’দন্ড দাঁড়িয়ে অভয় দিলে বুড়োটা সাহস পাবে। সে বলল, স্যার।
স্যালি হিগিনস কিছু খুঁজছেন মনে হচ্ছে।
সে আবার বলল, স্যার।
স্যালি হিগিনস বললেন, ক্যারি অন ম্যান।
সে বলল, স্যার, আমি বলেছি জ্যাককে খুব ছোটবেলা থেকে দেখছি। জ্যাক জ্যাক। কোনো সংশয় থাকা ঠিক না।
স্যালি হিগিনস বললেন, ওরা বিশ্বাস করে!
—হ্যাঁ স্যার। ওরা ভয় পেয়েছে বড়-টিন্ডালের আত্মহত্যায়। পাগল হয়ে গেছিল তো! স্যালি হিগিনস আবার কিছু খুঁজছেন। তিনি চাইছেন ধূর্ত লোকটা এটা নিয়ে এক্ষুনি বের হয়ে যাক। পোর্ট-মেলবোর্ণ পর্যন্ত ওর হাতে থাকা ছাড়া উপায় নেই। গোপন পাপ কাজ, গোপনে জাহাজে মেয়ে তুলে আনা! নিজের ওপর তিনি সব বিশ্বাস এ-ভাবে হারিয়ে ফেলছেন কেন? কেন বারবার মনে হচ্ছে এই গোপনীয়তা তাঁকে এক কঠিন শাস্তির ভেতর ফেলে দিয়েছে। জাহাজ স্ক্র্যাপ করার কথা ওঠার সময় দু’ দু’বার যেভাবে সব সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে ওর বেলায় কি সে ঘটনা আরও বীভৎস আকার নেবে! এই যে বন্দুকটা হাতে নিয়ে আর্চি লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল, নিচে নেমে সে কি এক্ষুনি প্ৰথম পাখিটা পরে ছোটবাবু এবং পরে সে নিজে, চিফ-মেট সবাইকে হত্যা করে জাহাজে সে আর…আর….পাইরেট ক্যাপ্টেন লুকেনারের মতো পাইরেট…জলদস্যু… সে আর…। তিনি চিৎকার করে উঠলেন—বনি বনি।
বনি তখন প্রায় মূর্ছা যাবার মতো, সে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল আর্চি খুব আয়াসে নেমে আসছে সিঁড়ি ধরে। হাতে বন্দুক। যেন সে শিকারে যাচ্ছে। চোখে মুখে ভারী উদাসীনতা। তাকে দেখেও যেন চিনতে পারছে না। এবং তখনই ছোটবাবুর অসহায় মুখ, ছোটবাবু কোথায়, সে ছোটবাবুর কাছে ছুটে যাবে ভাবছিল। দাঁড়িয়ে থাকলে সে মুর্ছা যাবে আর ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হল বাবা তাকে ডাকছেন। সে ভেতরে গেলে দেখল, বাবা উদ্ভ্রান্তের মতো লকার থেকে টেনে নামাচ্ছেন।—সব পোশাক, বই ডায়েরি যা কিছু তাঁর প্রিয় সব ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন নিচে। আর বলছেন, কোথায় রাখলাম বনি।
বনির মাথার ঠিক নেই। কতদূরে গেছে সে শয়তানটা! বাবার এ-সব ছুঁড়ে ফেলার চেয়ে বাবা কেন বন্দুকটা দিতে গেল জানা বেশি দরকার।—কেন কেন বাবা তুমি ওটা হাতছাড়া করলে, পারলে বনি আঁচড়ে খামচে বাবার পোশাক ছিঁড়ে ফেলবে। স্যালি হিগিনস মেয়ের আচরণে এতটুকু ক্ষুব্ধ হতে পারলেন না। কি খুঁজছিলেন ভুলে গেলেন। বনির মাথায় মুখ রেখে বললেন, নিয়ে গেল। আমাকে ভয় দেখিয়ে নিয়ে গেল। আর বনি তখন বলছিল, না না না, এটা বাবা আমি নিয়ে আসব। আমি নিয়ে আসব বাবা। যা হবার হবে বলে সে প্রায় বাবাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল, তারপর নিচে নেমে গেল।
আর্চির সামনে দু’হাত তুলে বনি বলল, আৰ্চি।
স্যালি হিগিনস পেছনে পেছনে ছুটে গেলেন। ধরে আনতে হবে। তিনি নিচে নেমে অত দ্রুত ছুটতে পারবেন কেন! বনি আর্চির সঙ্গে বোধহয় ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে। কিন্তু নিচে নেমে অবাক। আর্চির বন্দুকটা জ্যাকের হাতে।
আর্চি বলল, ছেলেমানুষ। চাইল দিয়ে দিলাম স্যার। থাক ওর কেবিনে। জেদি ছেলে তো। বুঝিয়ে ঠিক আমি নেব। আপনাকে ভাবতে হবে না। সামান্য বন্ধুত্ব স্যার। সব ঠিক হয়ে যাবে।
স্যালি হিগিনস বললেন, জ্যাক তুমি ভারি অন্যায় করেছ।
জ্যাক একটা কথা বলল না। সে দৌড়ে বন্দুকটা লকারে রেখে আবার বের হলে দেখল বাবা ওপরে উঠে যাচ্ছেন। ওর সঙ্গে একটা কথা বলছেন না। আর্চি দাঁড়িয়ে আছে। আর্চি শিস দিচ্ছে। আর্চির কাছে যেতে সে আর সাহস পেল না। সে কোথায় যাবে এখন বুঝতে পারছিল না। বাবার কি হারিয়েছে, বাবার কাজে সাহায্য করলে সব রাগ বাবার পড়ে যাবে।
তখনই আর্চি ডাকল, জ্যাক।
জ্যাক থমকে দাঁড়ল।
—জ্যাক, বন্দুকটা খুব যত্ন করে রাখবে। কখন আবার দরকার হবে। দরকার মতো চেয়ে নেব। কাউকে দেবে না কিন্তু। তোমার কাছে রাখবে।
জ্যাক বলল, আচ্ছা।
আর্চি পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, আলবাট্রস পাখিটাকে তুমি খুব ভালবাসো?
জ্যাক বলল, হ্যাঁ।
—কিন্তু পাখিটাকে তো সরিয়ে দিতেই হবে। জাহাজিরা তা না হলে ক্ষেপে যাবে। জাহাজে মারদাঙ্গা আরম্ভ হলে কেউ তো রক্ষা পাবে না জ্যাক।
জ্যাক হাঁটতে থাকল।
আর্চি বলল, জ্যাক আকাশটা কী ভীষণ কালো হয়ে উঠেছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে কড়কড় করে বজ্রপাতের শব্দ। ওরা দু’জনই সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে গেল। আর্চি এত কাছে এই প্রথম জ্যাকের—চুলের গন্ধ পর্যন্ত নাকে আসছে। নেশার মতো, পোশাক খুলে ফেললে মেয়েরা সব বড় নরম আর মসৃণ। ত্বকে আশ্চর্য প্রলোভন। হাতে এবং পায়ে অথবা জংঘায় সর্বত্র মেয়েটা ফুটে উঠছে। ফুটে উঠছে, পাপড়ি মেলে দিচ্ছে, পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বন্দুকটা সে যে-কোনো সময় নিয়ে নিতে পারবে। যেন অবুঝ মেয়ের মতো বন্দুকটা আগলে রাখছে জ্যাক। যাক আসল কাজটা তার হয়ে গেল। জ্যাকের কেবিনে ঢোকার একটা ছাড়পত্র রেখে দিল সে। যে-কোনো সময় সে সুযোগ পেলেই এখন জ্যাকের কেবিনে ঢুকে যেতে পারবে। এবং দুরন্ত ঘোড়ার মতো ফাঁকা মাঠ পেলেই ছুটবে। এখন শুধু সময় এবং সুযোগের প্রতীক্ষা। ভাল ভাল কথা, জ্যাকের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং যেন কত গভীর তার এই মমতাবোধ, জ্যাক আর জাহাজে একা নয়, সে পাশে থাকছে—এত সহজে এমন একটা সুযোগ চলে আসবে বুঝতে পারেনি। এখন স্বভাবে বেশ সে সজ্জন তার কোনো স্পৃহা নেই একেবারে সে জ্যাকের বশংবদ যেন জ্যাক বললে মাস্তুলের ডগায় উঠে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সে বলল, জ্যাক তুমি আমাকে ভয় পাও কেন বলত?
জ্যাক বলল, কোথায়?
—আমার কেবিনে তুমি আস না। নিজের কেবিন ছেড়ে কোথাও যাও না। সবার কেবিনে যাবে সবার সঙ্গে মেলামেশা দরকার। জাহাজে রাতে বের হতে নেই। যেন এখন আর্চি কথা বলছে না, ছোটবাবু কথা বলছে। গলার স্বরে কি কপট অভিনয়।
জ্যাক বলল, যাব।
—কখন জ্যাক?
—যাব। সময় হলেই যাব।
—এস। কোনো ভয় নেই। আরে আমি ত মানুষ। তুমি একজন সাধারণ মানুষকে ভয় পাবে কেন। মুখে দাগফাগ হয়েছে সব সেরে যাবে।
জ্যাক আর কোনও কথা বলল না। আর্চির সঙ্গে সে এবার ওপরে উঠে যেতে থাকল সিঁড়ি বেয়ে।
আর্চি দেখল তখন আকাশের ফালা ফালা সব সাদা কালো মেঘেরা দজ্জাল মেয়েমানুষের মতো ছটোছুটি করছে। আর যা হয়ে থাকে সমুদ্রে সেই গুমগুম আওয়াজ ক্রমে এগিয়ে আসছে। লেডি অ্যালবাট্রস ওর ভারী হাতের কাছে এখন। সে যে কোনো সময় তাকে বন্দুকে নামিয়ে আনতে পারে। এখন নামিয়ে না এনে ভালই করেছে। যেন নামিয়ে আনলেই স্যালি হিগিনস বলতেন বন্দুকটা আমার কেবিনে রেখে দেবে আর্চি। স্যালি হিগিনসের চেয়ে এই চপলমতি বালিকা অনেকটা তার স্বপক্ষে কাজ দেবে। সে যা চায়, দরজা খুলে বলবে জ্যাক শিগগির বন্দুকটা দাও। না দিলে লোয়ার দ্য বোট আই উইল গেট দিস হারপুন ইন ইউর বেলি।
তখনই জাহাজে সামাল সামাল রব উঠছে। চোং মুখে সারেং হেঁকে যাচ্ছে—দরিয়া ক্ষেপে গেছে মিঞারা। বুঝি কেয়ামতের দিন এসে গেছে। ডেক-ঠিন্ডাল তখন সব লম্বা হিবিং-লাইন ছুঁড়ে দিচ্ছে ডেকে। অন্ধকারে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
যে যার মতো এখন ডেক ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পোর্ট-হোল বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ঝড় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র ক্ষেপে গেল। অতিকায় সব ঢেউ ক্রমে জাহাজটাকে দোলনার মতো দোলাতে শুরু করে দিল। কখনও মনে হচ্ছে জাহাজটা দুলে দুলে সমুদ্রে মরণ নাচন নাচছে। কখনও ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে ডেকে। ডেক ভাসিয়ে দিয়ে সোঁ সোঁ শব্দে জলরাশি নিমেষে কোথায় উধাও হয়ে যাচ্ছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামছে। এলোমেলো বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব। দিনের বেলাতে আলো জ্বেলে ঘরে ঘরে যেখানে যা কিছু আলগা সব লকারে পুরে দেওয়া হচ্ছে। গ্যালির দরজা বন্ধ করে দিয়েছে ভান্ডারী। প্রপেলার মাঝে মাঝে জলের নিচ থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার ভেতর ডেকচি হাঁড়ি কড়াই হাতাখুন্তি সব ছিটকে কোথায় কোনটা চলে যাচ্ছে, এক হাতে সামলাতে পারছে না ভান্ডারী। চারপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আকাশটা ভীষণ ছোট হয়ে গেছে। যেন কালো বোরখায় ঢেকে দিয়েছে কেউ সমুদ্র। তার নিচে জাহাজটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। আর চরাত চরাত অজস্র কাঁচের জার ভেঙে যাবার মতো আকাশে বজ্রপাতের শব্দ। যে কোনো মুহূর্তে এখন জাহাজে আগুন লেগে যেতে পারে। স্যালি হিগিনস হাতের কাছে ঠিক তখনই পেয়ে গেলেন—তিনি পাতার পর পাতা উল্টে এক জায়গায় বড় বড় অক্ষরে দেখতে পেলেন—দাউ শ্যালট ফিয়ার দ্য লর্ড দাই গড অ্যান্ড শ্যা সার্ভ হিম ওনলি।
তারপর এক জায়গায় আরও বড় বড় অক্ষরে দেখতে পেলেন, যেন আকাশের বুকে বিদ্যুতের ছটায় কেউ লিখে দিয়ে যাচ্ছে—বি কনভারটেড টু মি, অ্যান্ড ইউ শ্যাল বি সেভড। মুহূর্তে শরীরের সব জড়তা, ভয় কেটে গেল। তিনি ঝড়ের ভেতর সিঁড়ি ভেঙে জাহাজের ওপরে উঠে যেতে থাকলেন। তাঁর এখন সবাইকে অভয় দেয়া দরকার। বিশেষ করে সিউল-ব্যাংককে। সিউল-ব্যাংক ঝড়ের সমুদ্রে এখন যে কোনো মুহূর্তে পথ হারিয়ে ফেলতে পারে।
লেডি-অ্যালবাট্রসের ভারী আনন্দ। ঝড়ের ভেতর পাখা ছেড়ে দিলে খুশিমতো সে আকাশের নক্ষত্রমালার কাছে যেন পৌঁছে যেতে পারবে। সে এবার পাখা মেলে দিল বাতাসে।
স্যালি হিগিনস মাংকি-আয়ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে তখন দেখছেন, প্রবল বেগে তরঙ্গমালা কালো অক্ষত প্রাচীরের মতো এগিয়ে আসছে। সাদা ফেনা। সমুদ্রে যেন বরফের পাহাড় জমে উঠছে আর ঝাপসা চারপাশ—কাঁচের ওপর বৃষ্টিপাতে তিনি সব ঝাপসা দেখতে পাচ্ছেন। জাহাজটা কাত হয়ে জলের নিচে ঢুকে যাচ্ছে মতো। আবার ভেসে ওঠে স্টারবোর্ড সাইডে হেলে যাচ্ছে। কখনও সেই অক্ষত কালো অন্ধকারের প্রাচীর ডেকের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। সব ফল্কা সব উইনচ মায় ডেরিকের মাথা পেরিয়ে সমুদ্র লক্ষ লক্ষ ক্ষেপা মোষের মতো ছুটে যাচ্ছে। তিনি দু’পা ফাঁক করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। প্রচন্ড ঝড়ের মুখে জাহাজটা পড়ে গেল। জাহাজে কে বনি, কে আর্চি, কে সেই লুকেনার সব তিনি ভুলে গেলেন। এখন জাহাজটাকে বন্দরে পৌঁছে দেওয়া ছাড়া পৃথিবীতে আর তাঁর কোনো যেন দায়িত্ব নেই। তিনি ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস। এস.এস.সিউল-ব্যাংক আন্ডার হিজ কম্যান্ড।