।। পয়ত্রিশ।।

তখন মৈত্ৰ-হাঁটছে। বেশ পা চালিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চারপাশের বাড়ি-ঘরের জানালা সব খুলে যাচ্ছিল। ছোট ছোট ছেলেরা-মেয়েরা দৌড়ে নেমে আসছে। চিৎকার করছে, বসন্তনিবাস। বসন্তনিবাস একটা কথা বলছে না। মাথায় সেই রাজার টুপি পরে সে হাঁটছে। পকেট থেকে একটা দু’টো দামী চকোলেট ছোটদের দিয়ে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে সব পার হয়ে চলে যাচ্ছে। কখনও ট্রামে, কখনও বাসে, এবং যখন যেখানে যেভাবে উঠে যাচ্ছে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে—মানুষটার পোশাক ভারি মনোরম। সে হেসে সবার সঙ্গে কথা বলছে—সবাইকে গুড আফটারনুন বলছে। বসন্তনিবাস মাথা নুয়ে কখনও সবাইকে অভিবাদন জানাচ্ছে। যেন সে এ-পোশাকে এখন এ-শহরের পার্কে অথবা যেখানে উইলো ঝোপ অথবা কৌরিপাইনের বনভূমি আছে হেঁটে সেখানে যাবে। আর চারপাশ থেকে সত্যি বুঝি প্রজাপতিরা উড়ে আসবে এবার। সমুদ্র থেকে পাখিরা।

সে আজ কোথাও থামছে না। কোথাও ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছুটছে না, অথবা সে যেন এখন হরেক রকম খাবারের ফেরিওয়ালাও নয়, সে বরং সোজা চলে যাবে ম্যাণ্ডেলাদের বাড়ি। জাহাজ ছাড়ার আগে একবার ম্যাণ্ডেলার মা’র সঙ্গে দেখা করা দরকার। কারণ সেই যুবতী মেয়ে জাহাজডুবির পর হাসতে পারে বিশ্বাস হয় না। ওয়াকা ঠিক মিথ্যে কথা বলেছে। সে নিজের চোখে না দেখে কখনও বিশ্বাস করতে পারবে না।

এবং তার মনে হচ্ছিল সেই ছোট্ট উপত্যকাতে উঠে গেলে ঠিক দেখতে পাবে, দু’টো উইলো গাছ, একটা সিলভার-ওক, সিলভার-ওকের নিচে ছোট্ট একটা ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা, ওকে দেখেই কুঁই কুঁই করতে থাকবে। আর তখন জানালা খুলে যাবে, ম্যাণ্ডেলা দু’হাত তুলে চিৎকার করবে—মা, বসন্তনিবাস! বসন্তনিবাস বলে সে ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরবে। আর তখন সেই ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা কেবল লাফাবে চারপাশে এবং ঠিক স্বপ্নে যেমন সে দেখেছিল ভারি চেনা মুখ, এলসা দ্য কেলির মতো দুঃখী মুখ ম্যাণ্ডেলার মা’র। মাথার ভেতর কেবল বারবার সেই স্বপ্নটা ঘুরে বেড়ায়। আসলে এটা স্বপ্ন কিনা সে বুঝতে পারে না। তার ভাবনায় এভাবে কিছু ইচ্ছে হয়তো কখনও স্বপ্নের মতো কাজ করে—তখন সে আর স্থির থাকতে পারে না। সেই ছোট্ট উপত্যকায় যেন কতকালের বিষাদ, সে ঠিক পৌঁছে গেলেই সব নিরাময় হয়ে যাবে। ম্যাণ্ডেলার মা হাসতে হাসতে বলবে, আপনি বুঝি বসন্তনিবাস। ম্যাণ্ডেলা এসে আপনার খুব গল্প করে। ঘুমোবার সময় আপনার কথা বলে ওকে ঘুম পাড়াতে হয়।

এভাবে জীবনটাকে ভাবতে ভীষণ ভাল লাগছিল মৈত্রের। সে আর মৈত্র থাকতে চাইছে না। শেফালী তার স্ত্রী ভাবতে ভাল লাগছে না, শেফালী বরং নষ্টচরিত্রের মেয়ে। বিশ্বাস রাখতে পারেনি। শঠতা বোধ হয় মৈত্রকে এভাবে পাগল করে দেয়। তার এখন যা ভাল লাগে, কোন পবিত্র নারী সুধাপারাবার এবং জাহাজডুবির পর সেই মুখ, কেবল যুবতীর মুখে বিষণ্ণতা থাকবে। নিজের মানুষ সুমদ্রে হারিয়ে গেলে কি আর থাকে। সে হাঁটছিল আর স্বপ্ন দেখছিল। ভাবছিল অথবা স্বপ্ন দেখছিল—দেখছিল অদ্ভুত সব দৃশ্য তার চোখের ওপর নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। শহরের পাহাড়ে পাহাড়ে অথবা উপত্যকায় কিছু নেই যেন, কেবল সেই সুন্দর উপত্যকাতে কেউ চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, সমুদ্রে কবে আবার বসন্তনিবাসের জাহাজ ভেসে আসবে।

মৈত্র স্বপ্নে দেখতে পায় সকাল হলেই ম্যাণ্ডেলা সমুদ্রের ধারে নেমে আসছে। ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা ওর পায়ে পায়ে ঘোরে তখন, মা তার জানালায় বসে থাকে। মা তার ক্রমে ভাল হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কোনো সকালে ম্যাণ্ডেলার হাত ধরে মা তার সমুদ্রে নেমে আসে। বড় করুণ চোখে তাকায়। তার কা’কে কি যেন ফিরিয়ে দেবার কথা। মায়ের চোখ দেখলে ম্যাণ্ডেলাও তা টের পায়।

বসন্তনিবাসের মনে হয়, ম্যাণ্ডেলার মা’কে সেই যে এক বাংলাদেশের নাবিক পালক দিয়ে গেল আর এল না। সাদা রঙের জাহাজ সমুদ্রে যেতে দেখলেই বুঝি মনে হয় তার মা’র, ওটা বুঝি বসন্তনিবাসের জাহাজ। সে আবার বুঝি এ বন্দরে আসছে। এ-ভাবে কখনও ভাবতে ভাল লাগে বসন্তনিবাসের।

আবার কখনও ভাবতে ভাল লাগে ম্যাণ্ডেলার মা সুন্দর একটা নীল রঙের গাউন পরে আছে। পায়ে সাদা রঙের জুতো। হাতে লাল রঙের দস্তানা। শীত নেই তবু যুবতী দস্তানা পরে বসে থাকতে ভালবাসে। দস্তানা পরে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু জাহাজটা বন্দরে ভিড়ছে না। ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। যুবতীকে তখন পাইন গাছের নিচে সাদা পুতুলের মতো ভাবতে ভাল লাগে বসন্তনিবাসের। আবার কখনও মনে হয় ভীষণ শীত। তুষারপাত হচ্ছে কেবল। শীতে বরফ জমেছে পাইনের পাতায়। গাছগুলো থেকে পাতা ঝরছে। নেড়া গাছে বুড়ো মানুষের সাদা দাড়ির মতো তুষারকণা ঝুলছে। ম্যাণ্ডেলার হাত ধরে মা তার ঘরে ফিরছে। জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে। শুধু সামান্য শার্শি খোলা থাকে অথবা বারবার তুষারপাতে জানালা আবছা হয়ে গেলে সাদা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে কাঁচ। ঝকঝকে কাঁচের ভেতর দিয়ে সমুদ্র দেখছে। যদি জাহাজটা আবার ফিরে আসে।

কোনো কোনো রাতে ওরা দেখতে পায় বুঝি গভীর সমুদ্রে একটা জাহাজ নোঙর ফেলে আছে। জাহাজটা কিনারায় ভিড়তে পারছে না। ভীষণ ঝড় সমুদ্রে। খুব ঝড় উঠলে ওরা আর জাহাজটাকে দেখতে পায় না। বুঝি বসন্তনিবাসের জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গেছে। বোধ হয় তখন ম্যাণ্ডেলার বুক কাঁপে। মা হাঁটু গেড়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তখন। বসন্তনিবাস হাঁটছিল আর এমন সব ভাবছিল যেতে যেতে।

সে ঠিক উপত্যকার নিচে এসে দেখল গোলাপের বাগান, বড় বড় গোলাপ। স্বপ্নের সেই সিলভার ওক-গাছটাও ঠিক আছে। ধূসর রঙের জানালা, ঝকঝক করছে জানালার কাঁচ। বাড়িটার পেছনে গভীর অন্ধকারের মতো দাঁড়িয়ে আছে রাশি রাশি পাইন, আর নীলবর্ণের পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে এবার প্রায় মই বেয়ে ওঠার মতো উপরে উঠে যাচ্ছে। এবং গলা বাড়িয়ে সে দেখতে পেল দরজা জানালা বন্ধ। ম্যাণ্ডেলা নেই। বাড়িটাতে কেউ নেই। ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা নেই। গাছটা আছে। এবং সে দেখতে পেল, সুদৃশ্য সব বেতের চেয়ার। যেন এইমাত্র কেউ বসে বসে এখানে অপেক্ষা করে চলে গেছে। সে তখন চিৎকার করে ডাকল, ম্যাণ্ডেলা। আমি বসন্তনিবাস। কেউ কোন সাড় দিচ্ছে না।

তারপর সে আবার চিৎকার করে ডাকল, আমি বসন্তনিবাস। আমার পালকটা ফিরিয়ে দেবে বলেছিলে, আমি ওটা নিতে এসেছি। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ভেবে পেল না এমন কেন বলছে, কিসের পালক! কার পালক! কি সে ফিরিয়ে নিতে চায়। স্বপ্নটার সঙ্গে সে জীবনের মিল এভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে কেন। এবং তখনই মনে হল দরজা খুলে এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ বের হয়ে আসছে। ওর চেহারা ভীষণ বন্য। চোখ দুটো জ্বলছে। ভেতরে যেন সে কি করছিল। বাধা পেয়ে রাগে চিৎকার করতে করতে বের হয়ে আসছে। আরে সেই ফেরিওয়ালা লোকটা! শহরে মাঝে মাঝে কিছুদিন থেকে দেখা যাচ্ছে। সে বলল, পালক! কিসের পালক? কি চাই তোমার?

বসন্তনিবাস বলল, ম্যাণ্ডেলা নেই?

—ম্যাণ্ডেলা মেলা দেখতে গেছে। মৈত্রের মনেই ছিল না এখানে এখন পাইন-ফ্যাস্টিভ্যাল আরম্ভ হয়ে গেছে। ছেলে-বুড়ো সবাই ছুটছে মেলায়। সে একা একা শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে বলল, আমাকে ম্যাণ্ডেলা দেখলে চিনতে পারত। আমার সঙ্গে ওর ভারী বন্ধুত্ব।

তখন লোকটা হা হা করে হাসছিল। এবং ঘরের ভেতর থেকে আবার আর এক ঝলক হাসি। দরজার বাইরে এসে দাঁড়াতেই বুঝল এই ম্যাণ্ডেলার মা। চুল সোনালী এবং স্বপ্নে দেখা মেয়েটির মতো নয়। চোখে ভীষণ জ্বালা। যেন বসন্তনিবাস এসে সব গোলমাল করে দিয়েছে। এমন একটা সময়ে কোথাকার উটকো একটা লোক সব তছনছ করে দিচ্ছে। সে তার এলোমেলো পোশাক ঠিক করতে করতে বলল, তুমি এখানে কি চাও?

—ম্যণ্ডেলাকে।

—ম্যাণ্ডেলা! বন্য লোকটা হাসতে হাসতে একেবারে সব উড়িয়ে দেবার মতো হাত নাড়ছিল। শরীরে তার সামান্য পোশাক। এটুকু না থাকলেও যেন কোন ক্ষতি ছিল না। জাহাজডুবিতে যে কেউ মারা গেছে এখানে, তার কোন চিহ্ন পেল না। বরং মনোরম বিকেলে ওরা সমুদ্র দেখতে দেখতে বোধ হয় বেঁচে থাকার নিরন্তর সুষমার কথা কেবল ভাবছিল। সে বলল, আচ্ছা ম্যাণ্ডেলাকে বলবেন আমি এসেছিলাম।

—বলব। বলেই ওরা ঘরে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল।

.

বনি তখন বলল, এস আমরা এখানে বসি।

ছোটবাবু বলল, বনি আমার সবকিছু, কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

বনি বিরাট একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে আছে। সে ছোটবাবুর দিকে সোজা তাকাতে পারছে না। সে তাকালেই যেন ছোটবাবু ওর ইচ্ছের কথা ধরে ফেলবে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ ছোটবাবু?

ছোটবাবু গাছের গুঁড়িতে কনুই রেখেছে। এত কাছে যে বনির চুলের ঘ্রাণ উঠে আসছে নাকে এবং সামান্য এলোমেলো হাওয়া উঠলে দু’টো-একটা চুল পর্যন্ত মুখে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তবু তার কি যে হয়, সে কেমন ভয়ে ভয়ে বলছে, বনি, তুমি যদি কোনোদিন আবার জ্যাক হয়ে যাও। যদি কোনোদিন দেখি সবটাই ভুল। সবটাই মরীচিকার মতো কিছু। তারপর যদি আর্চি……

বনি এবার ওর গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর যেমন এই পার্কে সব বড় বড় গাছের ভেতর জোড়ায় জোড়ায় সব ছুটে বেড়াচ্ছে কখনও বনভূমির ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তেমনি অদৃশ্য হয়ে যাবার ইচ্ছে হলে সে বলল, ছোটবাবু তোমার যে কি হয় মাঝে মাঝে। তুমি কেন এমন হয়ে যাও! আমাকে দেখলে গুটিয়ে যাও কেন? আমি কি করে বোঝাব আমি বনি! আর্চি! ফঃ!

ছোটবাবু দেখল বনির চোখ চিক চিক করছে। অথচ ছোটবাবু খুব সহজেই সবকিছু করে ফেলতে পারে না। তার নানাভাবে সব অভিজ্ঞতা জাহাজে গড়ে উঠছে কিন্তু নিজে তো জানে না, কতটা কি হলে শরীরের পবিত্রতা ঠিক থাকে। বারবার কাছাকাছি থাকলেই ভয় ছোটবাবুর—কখন কি অশালীন কিছু করে ফেলবে এবং মুখে সবসময় হতাশা জেগে থাকে। সে তখন প্রাণ খুলে হাসতে পারে না, প্রাণ খুলে ছুটতে পারে না। বনিকে দেখতে দেখতে কেবল তন্ময় হয়ে যায়। তখনই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে, জড়িয়ে চুমো খেতে ইচ্ছে হয়। এবং কাছাকাছি এ-ভাবে যখন জ্যাক ঠিক এসে যায়, ছোটবাবু একেবারে শক্ত কাঠ। যেন সে ছুঁয়ে দিলেই বনি, বনি থাকবে না। আবার জ্যাক হয়ে যাবে। দুরন্ত জ্যাক পাটাতনে লাফিয়ে নামবে এবং তেমনি পায়ে থাকবে হান্টার সু, এবং জল দস্যুদের পোশাক শরীরে। ঝড়ের সমুদ্রে ওকে আবার মাস্তুলের ডগায় তুলে দিয়ে সবাইকে ট্রাপিজের খেলা দেখাবে।

বনি বলল, এস।

ছোটবাবু বনির সঙ্গে হাঁটতে থাকল।

বনি বলল, কত বড় গাছ!

ছোটবাবু ওপরে গাছের শাখা-প্রশাখা দেখল।

বনি বলল, চল ওদিকটাতে।

ওরা দু’জনে ঘুরে ঘুরে পার্কটা দেখল। রঙ্গিন সব গাছপালা। সোনালী রোদ এবং হ্রদের জলে ছোট ছোট স্কিপ। স্কিপ ভাড়া করে যুবক-যুবতীরা লেগুনের মতো খাল বিল ধরে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিকাকোরা পার্কে বোধ হয় এভাবে অনেক সব ছোট ছোট স্কিপ বড় বড় গাছের ছায়ায় বেশ কিছু দূরে পাহাড়ের ঢালু চড়াইয়ে এখন লেগে রয়েছে। বনির খুব ইচ্ছে ছোটবাবু এভাবে ওকে নিয়ে কোনো নিরিবিলি জায়গায় চলে যাক। ছোটবাবুর শরীরে আছে এক আশ্চর্য ঘ্রাণ। পাশে পাশে হাঁটলে তার নেশা লেগে যায়। অথচ ছোটবাবু যেন বোঝে না কিছু, জানে না কিছু এবং বোধ হয় রঙিন জলে ডুব দিয়ে কিছু কুড়িয়ে আনতে তার ভারি ভয়। সে কিছুতেই ছোটবাবুর ভয় ভেঙে দিতে পারছে না।

বনি ডাকল, ছোটবাবু

ছোটবাবু তাকাল। ছোটবাবুর মুখ সহসা ভীষণ উজ্জ্বল দেখাল। সে বলল, বনি তুমি এত সুন্দর। একটু থেমে ধীরে ধীরে বলল, আমরা এভাবে নষ্ট হয়ে যাব!

বনির মুখ থমথম করছে। চারপাশে গাছপালা তেমনি আকাশ ছুঁয়ে দিতে চাইছে, পাতার ফাঁকে মনোরম রোদ, আর কোনো গভীর অরণ্যে যেন বাজনা বাজছে। পাতার কুটিরে সব সুন্দর সুন্দর যুবক-যুবতীরা বসে আছে, বিয়ার খাচ্ছে। ফুল ফল কাগজের রঙ্গিন পতাকার ভেতর ওরা কেউ হেঁটে যাচ্ছিল, অথবা কেউ ভারি কাছাকাছি। কিংবা দূরে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলে যাচ্ছে যুবক-যুবতীরা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। ছোটবাবু তখন দেখছিল, বনি সরু রাস্তা ধরে জোরে হেঁটে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে বনি জানে না।

আর ছোটবাবু পেছনে পেছনে নানাভাবে বোঝাচ্ছিল, এই কোথায় যাচ্ছ, এই বনি কি হচ্ছে, এই আমি তো বুঝে কিছু বলি নি, বনি, শোন। সে যত জোরে হাঁটছে বনি তার চেয়ে বেশি দ্রুত হাঁটছে। এবং বনির জমকালো পুরুষের পোশাকের ভেতর অথবা শরীরে ছোটবাবু বুঝতে পারছিল কঠিন কিছু খেলা করে বেড়াচ্ছে অথচ ছোটবাবুর এমন কেন যে হয়—যেন বনি ভারি মনোরম পবিত্র অকাঙ্খা, ছুঁয়ে দিলে বনি অপবিত্র হয়ে যাবে। সে এ-সব কারণে বোধহয় বনিকে কেবল বুঝিয়ে যাচ্ছিল—কারণ সে বুঝতে পারছে বনি আর একটা কথা বলবে না। সে এবার বনির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। বলল, সবাই দেখছে। দ্যাখো ওরা তোমার রাগ দেখে বোধহয় হাসাহাসি করছে।

বনি বলল, জাহাজে ফিরব।

ছোটবাবু বলল, এটা সে রাস্তা নয়।

—সে চিনে যাব।

—যেতে পারবে না।

—সে আমি বুঝব। ছাড়ো বলছি। তা না হলে ভাল হবে না।

ছোটবাবু হাত নামিয়ে দিল। বলল, ঠিক আছে, যাও। আর জাহাজে ফিরছি না।

বনি এবার তাকাল। তারপর বলল, তা হলে আমাকে কোথায় যেতে বলছ? একেবারে সমর্পণ করে দেবার মতো গলা বনির।

ছোটবাবু বলল, এস কিছু খাওয়া যাক।

বনি বলল, বাবা রাগ করবে।

—তুমি বসে থাকবে। আমি খাব। তুমি কোল্ড ড্রিংকস নেবে।

—আর কিছু না?

—না।

তখন ওয়াকা দেখতে পেল বসন্তনিবাস সমুদ্রের বালিয়াড়িতে হেঁটে যাচ্ছে। সে বসন্তনিবাসকে দেখেই ছুটতে থাকল। যত দূরেই যাক, বসন্তনিবাসকে সহজেই চেনা যায়। ওরা মেলা থেকে ফিরছিল। মাথায় ওরা সবাই পাইন পাতার টুপি পরেছে। ওরা রং-বেরংয়ের বেলুন হাতে ফিরছে। টুপু টিকি ওতাটুনু সবাই মিলে উৎসবের সাজে নেমে আসছে। বসন্তনিবাসকে দেখেই বাড়ি ফেরার কথা ওরা ভুলে গেছে। ওদের কেউ পাতার বাঁশি বাজাচ্ছিল, কেউ ফুলের মালা গলায় পরেছে। মেয়েরা সবুজ পোশাক পরেছে, ছেলেরা সাদা পোশাক। সূর্য তখন সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে। এক মায়াবী আলো এখন এই সুন্দর শহরের ওপর। বসন্তনিবাস সমুদ্রের জলে নেমে যাচ্ছে। পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছে তার।

ওয়াকা ডাকল, বসন্তনিবাস আমরা এসে গেছি।

বসন্তনিবাস একটা কথা বলল না। সে তেমনি হেঁটে যেতে থাকল।

ওয়াকা বলল, বসন্তনিবাস তোমার পালক পেলে?

বসন্তনিবাস বলল, না। ওয়াকা, কে যে ওটা নিয়ে গেল!

ততক্ষণে ওরা সবাই সেই সমুদ্রের বালিয়াড়িতে বসন্তনিবাসকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। উৎসবের দিন বলে, কেউ আজ এখানে রোদ পোহাতে আসে নি। শহরের সর্বত্র অথবা রাস্তায় অথবা বনের ভেতরে সবাই এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। মদ খাচ্ছে, বেলুন ওড়াচ্ছে, কাগজের রঙ্গিন মালার ভেতর সব মানুষেরা যেন ক’ দিনের জন্য তাদের হারানো পালক ফিরে পেয়েছে। জমকালো পোশাক পরে সবাই এখন পাতার বাঁশি বাজাচ্ছে।

বসন্তনিবাস বলল, আমাদের জাহাজ কাল ছেড়ে দিচ্ছে ওয়াকা।

—আবার কবে আসবে?

—জানি না ওয়াকা। আবার যখন আসব তখন হয়তো তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। তখন বড় হয়ে যাবে ওয়াকা।

ওয়াকা বলল, আমাদের সঙ্গে নাচবে?

বসন্তনিবাস বলল, কি নাচ?

—এই আমাদের নাচ। আমরা গান গাইব। তুমি পাতার বাঁশি বাজাবে। বলেই ওয়াকা একটা লম্বা প্রায় ক্ল্যারিওনেটের মতো একটা লম্বা পাতার বাঁশি ওর হাতে দিয়ে দিল। বলল, বাজাও।

বসন্তনিবাস বার বার ফুঁ দিয়েও কোন সুর বের করতে পারল না।

—এই দ্যাখো, বলে লম্বা পাতার বাঁশিতে ওয়াকা সুন্দর এক সুর তৈরী করে ফেলল। এবং সবাই তখন ঘুরে ঘুরে পা তুলে হাত তুলে নাচছে। মানুষটা কাল জাহাজে সমুদ্রে ভেসে যাবে, সেই প্রাচীনকালে, ভেলায় চড়ে যারা সমুদ্রে গিয়েছিল ঠিক তাদের মতো এখন বসন্তনিবাস। বসন্তনিবাস এ ক’ দিনে নিজের মানুষ হয়ে গিয়েছিল। বসন্তনিবাসকে ছেড়ে দিতে ওদের বোধ হয় কষ্ট হচ্ছিল। বসন্তনিবাসকে ঘিরে এই সব ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা তারপর নাচতে থাকল গাইতে থাকল। এবং সমুদ্র থেকে তখন বাতাস উঠে আসছে। তারা তেমনি নাচছে গাইছে, সর্বত্র এক দুঃখ অথবা বিষণ্ণতা—কি যেন মানুষের এক সময় হারিয়ে যায়, তারপর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বসন্তনিবাসকে তারা সমুদ্রের ধারে ধারে এভাবে নিয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলল।

যা হয়ে থাকে, এ-ভাবে মানুষজনের ভিড় বেড়ে যাচ্ছিল। সবাই দেখল পাইন-ফেস্টিভ্যালে বেশ সং বের করেছে ছেলে-ছোকরারা। দ্বিগুণ উৎসাহে তখন মৈত্র বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে। যেন সেই এক ব্যাণ্ড-মাস্টার—মঞ্চে দাঁড়িয়ে কখনও উঁচু লয়ে আবার কখনও একেবারে নুয়ে নানারকম স্বরের ভেতর মৈত্র নিজের সব জ্বালা ভুলে থাকতে চাইছে। শহরের মানুষেরা বুঝতেই পারছে না লোকটার একটা পালক ছিল সেটা তার অজ্ঞাতে কে চুরি করে নিয়েছে। সে যে এখন নেচে নেচে বাঁশি বাজাচ্ছে সেই হ্যামিলনের বাঁশিয়ালার মতো এবং সে যে ইচ্ছে করলে শহরের সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে সমুদ্রে নেমে যেতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সব পাহাড়ী উপত্যকাতে দরজা জানালা খুলে যাচ্ছে। ওরা কেউ কেউ আবার বসন্তনিবাসকে উদ্দেশ্য করে সিল্কের রুমাল উড়িয়ে দিচ্ছে। এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দলে দলে মিশে যাচ্ছিল।

তখনই ছোটবাবুর সেই শীতল কণ্ঠস্বর। ছোটবাবু মোড়ে এসে একটা ভীষণ জ্যামের ভেতর পড়ে গেছিল। বনি পাশে বসে রয়েছে। মৈত্রদাকে সে খুঁজছে গাড়ি নিয়ে। তখন সবাই হা হা করে হাঁকছিল, আসছে। সেই বিরাট মিছিল পাইন ফেস্টিভ্যালের সব ছেলে-ছোকরারা মেয়েরা এখন মিছিলে একে একে যোগদান করছে। সামনে ওয়াকা আর বসন্তনিবাস। ওরা দু’জনই বাঁশি বাজাচ্ছে। কখনও উঁচু লয়ে কখনও পেছন ফিরে আবার কখনও উপত্যকার দিকে মুখ তুলে। এবং সহসা যখন দেখতে পেল সে ঠিক ম্যাণ্ডেলাদের বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে, ওপরে ম্যাণ্ডেলা হাত নাড়ছে তখনই পাশ থেকে কেউ ডাকছিল, মৈত্রদা জাহাজে চল।

গাড়ির পাশে মিছিলটা চলে এসেছে। আর এমন সময়ে ওয়াকা ছোটবাবুকে গাড়ির ভেতর দেখতে পেল। বসন্তনিবাসকে ছোটবাবু কিছু যেন বলছে। কি বলছে ওয়াকা বুঝতে পারছে না। ছোটবাবু এবং বসন্তনিবাস দাঁড়িয়ে কথা বলছে বলে লম্বা মিছিলটা থেমে আছে। যারা ড্রাম, ব্যাগপাইপ অথবা বিউগল বাজাচ্ছিল অথবা যারা ম্যাণ্ডোলিন বাজাচ্ছে তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আবার কখন বসন্তনিবাস ব্যাণ্ড-মাস্টারের মতো প্রায় ঘুরে ঘুরে কখনও উটের মতো মুখটি তুলে বাঁশি বাজাবে। তেমনি সবার মাথায় রং-বেরংয়ের পাতার মুকুট, গায়ে কেউ কেউ পাতার অলঙ্কার পরেছে। আর রং-বেরংয়ের গ্যাস-বেলুন মাথার ওপর উড়ছে।

বসন্তনিবাস বলল, ওয়াকা আমি যাচ্ছি।

ওয়াকা বলল, মানে! চলে গেলে এত বড় মিছিলটাকে লিড্‌ করবে কে?

বসন্তনিবাসের যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কেন জানি ছোটবাবুর মুখের ওপর আর এখন কথা বলতে সে সাহস পায় না। দুষ্টু বালকের মতো সে এখন জাহাজে আছে। যেন অভিভাবকের মতো এই ছোটবাবু। সে ফাঁক পেলেই জাহাজ থেকে নেমে আসে। আর ছোটবাবু খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত জাহাজে নিয়ে যায়। শক্ত চেহারা আর তার নেই। ছোট ছোট এই বালক-বালিকাদের সঙ্গে থেকে থেকে কেমন সরল সহজ হয়ে গেছে।

তখন ওয়াকা বলল, স্যার আমরা ওকে জাহাজে পৌঁছে দেব। আপনি ওর জন্য ভাববেন না।

ছোটবাবু বলল, জাহাজ কিন্তু ওয়াকা কাল ছেড়ে দেবে।

ওয়াকা বলল, জানি। তারপরই ওয়াকা আবার হাঁটতে থাকল। ছাড়া পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে মৈত্রদা বাঁশি বাজাচ্ছে। স্বরটা আশ্চর্য মেলডিতে ভরা। মৈত্রদা এ-ভাবে কবে বাঁশি বাজাতে যে শিখল! বুয়েনস আয়ার্সে মানুষটা সার্কাসে সিংহের খেলা দেখাতো, এখানে ব্যাণ্ড-মাস্টার। মৈত্রদার পক্ষে সবই বুঝি সম্ভব। অথবা অন্তরেই থাকে আশ্চর্য এক সুর, মাঝে মাঝে তা আপনি বেজে ওঠে!

মিছিলটা চলে যেতে থাকল আর পেছনে পেছনে গাড়ি ট্রাম বাস ছোটবাবুর গাড়ি ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। বনি পাশে। এক সময় বনি বলল, এস না ছোটবাবু মিছিলের সঙ্গে হেঁটে চলি, বলে নেমে গেল গাড়ি থেকে। ছোটবাবুর হাত ধরে ঠিক এই শহরের বাসিন্দাদের মতো হেঁটে যেতে থাকল। এক সময় বনি বলল, বড়-টিণ্ডাল ভীষণ আমুদে লোক, না ছোটবাবু?

ছোটবাবু কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে শুধু বলল, হবে হয়তো। এবং তারা এ-ভাবে যেতে যেতে এক সময় সুন্দর একটা গীর্জার সামনে থেমে গেল। বনি চিৎকার করে বলল, দ্যাখো দ্যাখো ছোটবাবু কত সাদা ফুল। ওরা দেখল গীর্জায় উঠে যাবার দু’ধারে বড় বড় গাছে সব সাদা ফুল। এবং বর-কনে উঠে যাচ্ছে। ওদের দু’হাতে অজস্র ফুলের গুচ্ছ। সিঁড়ি ধরে সবাই উঠে যাচ্ছে। ছোটবাবু আর বনি রেলিঙে দাঁড়িয়ে আছে। বনি সেই সব গাছের ভেতরে উঁকি দিয়ে আর মাথা তুলছে না। যেন হামাগুড়ি দিয়ে সেও উঠে যাবে। সিঁড়িতে কি দেখতে দেখতে বুকে ক্রস টানছে বনি। ছোটবাবু ক্রস টানছে না বুকে। বনির বোধহয় বুকে ভয় গুড়গুড় করতে থাকে। সে নিজেই ছোটবাবুর বুকে ক্রস টেনে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

ছোটবাবু বারবার ডেকেও কোনো সাড়া পেল না। বনি মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে কোথাও ম্যাণ্ডোলিন বাজাচ্ছে কেউ। এবং মাইকে ঘোষণা হচ্ছিল আর ধর্মীয় সংগীত তখন গীর্জায়। জোনাকিরা সমস্ত গাছে গাছে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘাসের ভেতর কুয়াশা, বিন্দু বিন্দু শিশিরপাতের শব্দে জেগে আছে। বনি বলল, ছোটবাবু জাহাজে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। এস এখানে চুপচাপ বসে থাকি।

ছোটবাবু গীর্জার ঠিক সিঁড়ির নিচে ঘাসের ওপর বসে পড়ল। ওরও জাহাজে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। গাছে গাছে সাদা ফুল। জোনাকিরা উড়ছে। নক্ষত্রেরা এবার আকাশে ভেসে বেড়াতে থাকবে। পাইনের বনে সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস সব এলোমেলো করে দিচ্ছিল। তখন ছোটবাবু বলল, মাকে তোমার কথা জানিয়ে যদি একটা চিঠি দিতে পারতাম বনি। যেন আরও বলার ইচ্ছে ছিল তবে আজ আর কোন দুঃখ থাকত না। সে কিছুই আর বলল না। ঘাসের ওপর দু’হাত ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ওর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ওর হাই উঠছিল।

ওদের জাহাজে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। বনি কখনও ওর পিঠে পিঠ দিয়ে কখনও ঘুরে ঘুরে ঠিক সবুজ লতাপাতার মতো শরীর তার এ ভাবে বড় হয়ে যাচ্ছিল। অথচ জাহাজে উঠে সে একেবারে জ্যাক। পুরুষের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সে এখন সিঁড়ি ভাঙছে।

তারপর আবার সেই ড্যাং ড্যাং বাজনার মতো বাজনা। কেউ যেন মাস্তুলের ওপর দাঁড়িয়ে বিউগিল বাজাচ্ছে। জাহাজ বন্দর থেকে নেমে যাবার সময় এমনই মনে হয়। যেন সেই ক্রোজনেস্টে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ, গায়ে তার বিচিত্র পোশাক। দুরে সব পাইনের বনভূমি। আরও দূরে পাহাড়ের শীর্ষদেশ, বরফে রুপোলী কখনও সোনালী আবার কখনও আকাশের মতো গভীর নীল রঙ হয়ে যায়। অথবা সমুদ্রের তলদেশে যে সব ডলফিনের গায়ে থাকে বিচিত্র রঙ মনে হয় চারপাশে অথবা আকাশে তেমন রঙের ফোয়ারা। দেখতে দেখতে বড় বেশি তখন এই পৃথিবীকে ভালবাসতে ইচ্ছে হয়।

তখন জাহাজটা ডাঙার মায়া কাটিয়ে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে। আর তখন কে বলবে হাজার হাজার বেলুন, এটা অবশ্য আজগুবি গল্পের মতো শোনাবে কারণ বন্দরে সকাল থেকেই একটা শিশুদের মেলা অথবা মিছিল বলা যেতে পারে এসে জড়ো হয়েছিল। সব ওয়াকার কাণ্ড। তাদের প্রিয় বসন্তনিবাস চলে যাচ্ছে। জাহাজ আবার কবে আসবে কেউ জানে না। জাহাজটা শেষ পর্যন্ত ডাঙায় ফিরে যাবে কিনা, জাহাজিরা দেশে ফিরতে পারবে কিনা যখন কেউ কিছু বলতে পারছিল না তখন এইসব ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নানা রঙের বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছে। মাথায় তাদের পাতার টুপি এবং ব্যাণ্ড বাজাচ্ছিল। ওয়াকা দৌড়ে দৌড়ে সবার সবকিছু ঠিক-ঠাক করে দিচ্ছে তখন। মৈত্রদা ওপরে উঠে সবাইকে হাত নাড়ছিল।

স্যালি হিগিনস্, বনি, রেডিও-অফিসার এবং যাদের ওয়াচ ছিল না অর্থাৎ যাদের কাজকর্ম জাহাজ সমুদ্রে নেমে গেলে আরম্ভ হবে কেবল তারাই দেখছিল। যারা নিচে নেমে গেছে, বয়লারে আগুন দিচ্ছে তারা দেখতে পাচ্ছে না। অথবা যাদের কাজ ছিল দড়িদড়া তুলে ফেলা, ডেরিক নামিয়ে রাখা, ফল্কায় কাঠ ফেলে ত্রিপলে ঢেকে দেওয়া, তারা কাজ করতে করতে দেখছে। জাহাজটা ছেড়ে দিলে বেলুনগুলো ঠিক জাহাজের ওপরে উড়ে আসছে এবং ওরা জাহাজ নিয়ে যত সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে তত সেই সব শিশুর কোলাহল হাততালি অথবা ‘গুড-বাই বসন্তনিবাস’ ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসছে। আর কি আশ্চর্য সেই সব বেলুন ক্রমে জাহাজ ছাড়িয়ে আরও গভীর সমুদ্রে উড়ে গেল। তীরের মানুষেরা তাজ্জব। এমন ঘটনা ওরা জীবনেও দেখে নি। একটা জাহাজ, সাদা রঙের জাহাজ, নীল সমুদ্রে কেমন জল কেটে ক্রমে দিগন্তের দিকে ভেসে যাচ্ছে। পাহাড়ের উপত্যকায় অথবা শীর্ষদেশে যে-সব ঘর বাড়ি আছে—সব ঘর-বাড়ির জানালা খোলা। ছেলে যুবা বুড়ো বুড়িরা দেখতে পেল একটা সাদা রঙের জাহাজ, জাহাজের ওপর আকাশের গায়ে সব বিন্দু বিন্দু জলকণার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে অজস্র বেলুন এবং ক্রমে তা দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। প্রথমে জাহাজের মানুষ-জন তারপর জাহাজ তারপর ডেরিক মাস্তুল এবং আরও পরে শুধু ক্রোজ-নেস্ট দেখা যাচ্ছে।

ক্রমে এভাবে স্বপ্নের ভেতর থেকে আসা জাহাজটা আবার স্বপ্নের দেশে চলে যাচ্ছে। ওয়াকা টুপু টিকি এবং ম্যাণ্ডেলা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল। যতক্ষণ চোখের ওপর জাহাজটা ছিল ততক্ষণ নিবিড়ভাবে দেখছে। এই জাহাজে বসন্তবিনাস চলে গেল। জাহাজ ভাঙা পুরানো, জাহাজটা ঠিক আর দশটা জাহাজের মতো তারা ভাবতে পারে না। যেন এ-জাহাজ চিরদিনের চিরনতুন। এবং এমন জাহাজেই আবার কোনোদিন হয়তো বসন্তনিবাস এ বন্দরে চলে আসবে। ওরা এমন ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে গেল।

এখন আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু সময় পাওয়া যাচ্ছে। দুপুরের দিকে জাহাজ বন্দর ছেড়েছে। তীরের গাছপালা পাহাড় এখনও মেঘের মতো ঝুলে আছে। সমুদ্রে সামান্য পিচিং আছে বলে জাহাজ দুলছে। স্যালি হিগিনস রেলিঙে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছেন। জাহাজ সামোয়াতে যাচ্ছে। এ-বন্দরেও একজন নেমে গেল। বোধহয় ছোটবাবুর সেজন্য মন খারাপ। তাকে জাহাজ ছাড়ার সময় ওপরে দেখা যায় নি। তিনি দেখেছিলেন প্রথম থেকেই এরা তিনজন ছিল খুব কাছাকাছি। একই ফোকসালে ওরা থাকত। এখন তিনজন তিন রকমের। বড়-টিণ্ডলের মাথয় সামান্য গোলমাল। দেশে পাঠানো চলে। কিন্তু বড়- টিণ্ডাল কাজের সময় খুব দায়িত্বশীল আর এ ছাড়া এভাবে ক্রু নেমে গেল জাহাজ চলবে কি করে! এবং যা হয়ে থাকে, ক্রু নেমে গেলেই কিছু কাজকর্ম থেকে যায়। এজেণ্ট অফিসে খবর দেওয়া, স্থানীয় পুলিশ অফিসে খরব দেওয়া, এ-ছাড়া দায়িত্ব হিসেবে থেকে যায় ওর দেশবাড়িতে খবর পাঠানো। সকালটা নানা ঝামেলায় কেটেছে, রসদ দু’মাসের মতো নেওয়া হয়েছে। সকাল থেকে রসদ উঠছিল। বিফ, ভেড়ার মাংস, ডিম, মুরগী, লেটুস, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, চাল, ডাল, তেল, নুন, এবং নানা রকমের সস্ জেলি মাখন পাউরুটি এবং বরফ-ঘরে এখন সব বড় বড় আস্ত গরু ভেড়া মুরগী হুকে ঝুলছে। যেগুলো হালাল করা তাদের ভিন্ন নম্বর এবং আলাদা রাখা হয়েছে। জাহাজে অধিকাংশ মুসলমান ক্রু। তাদের জন্য এই সব আলাদাভাবে করা হয়ে থাকে। সব দিকে নজর তাঁর। এবং যদিও চীফ-মেটের কাজ এ-সব তবু তিনি নিজে ভাল করে বুঝে না নিতে পারলে স্বস্তি পান না।

এবং বন্দরের শেষ তিন-চারদিন তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেন। কোন কারণে যেন কোথাও ত্রুটি থেকে না যায়। সফর যত লম্বা হবে তত জাহাজিরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। এবং অধিকাংশ সময় যা দেখা যায় খাবার-দাবার নিয়েই এই সব জাহাজিরা প্রথম ঘোঁট পাকাবার চেষ্টা করে। সেজন্য তিনি রসদ নেবার সময় বেশি বেশি সব নিয়েছেন। বরফ-ঘরের কুলিং মেশিন যাতে খারাপ না হয়ে যায়, এবং যে কোন কারণে খাবারে পোকা লেগে যেতে পারে—তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখেশুনে নিশ্চিন্ত হয়েছেন এবং জাহাজের যতটা মেরামত দরকার সাধ্যমত যা করতে পেরেছেন করে নিয়েছেন। জাহাজের ধোয়া-মোছা হয়ে গেলে তিনি সব অফিসারদের নিয়ে হাল থেকে আরম্ভ করে, নোঙর ফেলার জিপসি ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিয়েছেন। কেবল এনজিন রুমের একটা জায়গা ভীষণ দুর্বল থেকে গেল। বয়লরের চক, বিশেষ করে মাঝখানের বয়লার চক সামান্য বসে গেছে মনে হচ্ছে, অবশ্য চোখে ঠিক ধরা যাচ্ছে না। তিনটে বয়লার একই লেভেলে থাকার কথা। মাঝখানের বয়লারটা যেন সামান্য নিচে বেশি ঝুঁকে আছে। অবশ্য সিউল-ব্যাংকের কোনো কিছুই এভাবে ভাল করে দেখলে ঠিকঠাক নেই। জাহাজ তবু যথানিয়মে চলছে। মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তায় মাথা ভার হয়ে গেলে তিনি এভাবেই ভেবে নিতে চান। এবং সব দুশ্চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দিতে চান।

ক্রমে জাহাজ চারপাশে সমুদ্র নিয়ে জেগে থাকলে তিনি একটা ডেক-চেয়ারে বসে পড়লেন। জাহাজে এই একটু দিনের আলো আর তারপর অন্ধকার সমুদ্রে। এখন কি সময়, কি তিথি, কতটায় সমুদ্রে জোয়ার আসবে এবং কখন কোন জলের নিচে কোন পাহাড় অথবা উপত্যকা মিলে যাবে তিনি সব জানেন বলে বাইবেলের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। সেই প্রাচীন নাবিক নোয়ার কথা মনে পড়ছে। একটা অতিকায় জাহাজে তিনি সব তুলে নিয়েছিলেন। এবং এ তিন-চারদিন যা ধকল গেছে তাতে নিজেকে সেই প্রাচীন নাবিকের অনুসরণকারী ভাবতে ভাল লাগছিল। এমন কি তিনি পালিয়ে এ জাহাজে এক জোড়া পুরুষ-: মণীও রেখেছেন। মহাপ্লাবনে পৃথিবীর সব ডুবে গেলেও সিউল-ব্যাংক সমুদ্রে ভেসে থাকবে—কখনও কখনও সিউল ব্যাঙ্ককে এভাবে ভাবতে ভীষণ ভাল লাগে তাঁর। তখনই দেখলেন জ্যাক ও-পাশের সমুদ্রে দূরবীনে কি দেখছে। দেখতে দেখতে উত্তেজিত গলায় কাকে ডাকছে।

তিনি রেলিঙে ঝুঁকে ডাকলেন, জ্যাক। জ্যাক মাথার ওপরে ব্রীজের উইংসে দেখল বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বাইবেল। জ্যাক কেমন অধীর গলায় বলল, বাবা দ্যাখো। দূরে দ্যাখো।

খালি চোখে তিনি সমুদ্রের দিগন্তে কিছু দেখতে পেলেন না। ঢেউ-এর সামান্য চড়াই-উৎরাই ভেঙে অনেক দূরে শুধু অনন্ত জলরাশি। তিনি বললেন, কিছু দেখা যাচ্ছে না।

সঙ্গে সঙ্গে জ্যাক দৌড়ে ওপরে উঠে গেল। বাবকে দূরবীনটা দিয়ে সোজা আবার নেমে গেল। সমুদ্রে সূর্যাস্তের সময় বলে জ্যাকের নীলাভ পোশাক ভারী উজ্জ্বল। খালি জাহাজ বলে সামান্য পিচিং- এ বেশ দুলছে। জ্যাক প্রায় টলতে টলতে এক সময় নেমে গেল এবং অদৃশ্য হয়ে গেল। এবং সে যখন ফিরে এল স্যালি হিগিনিস্ দেখলেন, ছোটবাবুকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে।

স্যালি হিগিনস্ মেয়ের এমন কাণ্ড যেন দেখতে পান নি, অথবা হয়তো মনে কখনও অভিমান, যে কোনো অত্যাশ্চর্য ঘটনা এখন কোনো যুবকের জন্য, বনি তার আর কেউ নয়, ক্রমে মেয়েটা দূরে সরে যাচ্ছে, তিনি দেখেও না দেখার ভান করে দূরবীনে মগ্ন হয়ে থাকলেন। এবং তখনই দেখলেন, অনন্ত জলরাশি ভেঙে সে আসছে। সেই পাখিটা।

স্যালি হিগিনস্ এবার দূরবীনটা জ্যাকের হাতে ফিরিয়ে দিলেন। চশমাটা ঠিকঠাক করে নেমে গেলেন নিচে। ওপরে ওরা দু’জন সমুদ্রে একটা পাখি খুঁজছে।

তখন ছোটবাবু বলল, লেডী-অ্যালবাট্রস আবার আসছে। ও ভেবেছে আমরা ওর পুরুষ-পাখিটাকে বন্দী করে রেখেছি।

জ্যক বলল, পাখিটার কথা ভুলেই গেছিলাম। আমাদের কথা কিন্তু পাখিটা মনে রেখেছে।

আর্চিও দেখল আবার সেই পাখিটা জাহাজের পেছনে আসছে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। আসলে পাখিটাকে দেখে, না বোট-ডেকে ছোটবাবু এবং জ্যাককে কাছাকাছি দেখে বোঝা গেল না। সে চিৎকার করতে করতে ছুটছে, দ্যাট ভেরি আলি বার্ডস ফ্লাইং এগেন্। সে যেন জাহাজের সব নাবিকদের সতর্ক করে দিচ্ছে—ডেনজার এহেড্‌। তোমরা বাছারা সবাই সাবধান হয়ে যাও। কাপ্তানের পোষা শয়তানটা আবার উড়ে আসছে। এবারে কি ঘটবে কেউ বলতে পারবে না।