৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫
রানার সুটকেস নিয়ে এসেছে মিত্রা গাড়িতে করে। কয়েক ঢোক উইস্কি গিলে নিল রানা। কিছুটা মালিশ করল দুই হাঁটুতে। খিদেতে জ্বলছে পেট। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। কিছুটা চাঙ্গা বোধ করল উইস্কির কল্যাণে। গাড়ি তখন বারাসতের পথে ছুটছে সত্তর মাইল স্পিডে। স্টিয়ারিং ধরে স্থির হয়ে বসে আছে মিত্রা সেন।
চলল ওরা বর্ডারের পথে। কিন্তু সেখানে পার হওয়া আরও কঠিন হবে। যুদ্ধ বেঁধে গেছে দুই দেশে, এখন দুই দিকের সীমান্ত প্রহরীরাই সদা সতর্ক। হিন্দুস্থান থেকে যদি বহু কষ্টে বেরোতে পারে তবে মারা পড়বে গিয়ে ইপিআরের গুলি খেয়ে। কী করা যায়? প্ল্যান চলছে রানার মাথায় আশি মাইল স্পিডে।
তা ছাড়া নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে সবাইকে ইনফরম করা হয়ে গেছে। টিটাগড় থেকে কলকাতার দিকে গেলে এতক্ষণে ধরা পড়ে যেত। ব্যারাকপুর সামরিক ঘাঁটি পার হয়ে আসতে পেরেছে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হলো রানা। বুদ্ধি বের করার সময় পাওয়া যাবে এখন। পথের মধ্যেই যে বাধা দেয়া হবে রানাকে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সহজে ছাড়া হবে না ওকে।
বারাসতে পৌঁছে বনগাঁ-যশোহরের রাস্তায় না গিয়ে সোজা পুবে টাকির রাস্তায় চলল ওরা। যশোহরের পথে দুই দেশের সীমান্ত প্রহরী অনেক বেশি তৎপর থাকবে। ওদিকে সুবিধে হবে না। তবে টাকি থেকে পাকিস্তানে ঢোকার তেমন কোনও ভাল পথ জানা নেই রানার।
পঁচাত্তরের কোঠায় উঠল মাইল মিটারের কাঁটা। কিন্তু নিশ্চয়ই দ্রুততর কোনও গাড়িতে অনুসরণ করবে ওরা। এ ছাড়াও বর্ডারের সৈন্যরা প্রস্তুত থাকবে রানার জন্য। হঠাৎ মৃদু হাসল রানা। প্ল্যান এঁটে ফেলেছে ও।
এতক্ষণে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে চারদিকে ভাল করে চাইল রানা। আকাশে কৃষ্ণা পঞ্চমীর ম্লান চাঁদ, ঘণ্টাখানেক হলো উঠেছে, পাশে সাদা মেঘের ভেলা। চারদিকে প্রেম-প্রেম রহস্য। খুশি হয়ে উঠল ওর মন।
মিত্রার ঘড়িতে বাজে রাত নটা। আর দশ মাইল পরই বশিরহাট। এতক্ষণেও কোথাও বাধা পেল না দেখে একটু অবাকই হলো রানা। দুই হাঁটুতে অনেকক্ষণ মালিশের পর বেশ খানিকটা সুস্থ বোধ করছে ও। মিত্রার পাশে গিয়ে বসল সিট ডিঙিয়ে। কাঁধের ওপর রাখল একটা হাত।
জোর বাতাসে উড়ছে মিত্রার খোলা চুল। মুখের এক পাশে পড়েছে চাঁদের আলো। মৃদু হাসল মিত্রা। কেঁপে উঠল যেন সারাটা আকাশ। রানা ভাবল ধন্য হলো ও। যে দেখেছে এমন হাসি তার জীবন সার্থক। দু’পাশের মাঠে পাকা আউস ধান দুলছে মৃদু বাতাসে। পৃথিবীটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রানার। ঠিক বোঝানো যায় না এই ভাল লাগাটাকে। বিচিত্র মানুষের জীবন। প্রতিপদে যার মৃত্যুর হাতছানি, সেই রানা জানে এই মায়াবী পৃথিবীর কী যাদু। বেঁচে থাকায় কত সুখ। হৃদয়টা উথলে উঠতে চাইল রানার এক অসীম কৃতজ্ঞতায়। কিন্তু কার প্রতি কৃতজ্ঞতা? খোদা? প্রকৃতি? নারী? বুঝতে পারে না রানা। প্রকৃতির মায়া, নারীর প্রেম, বন্ধুর বন্ধন, সব মিলিয়ে তীব্র একটা ভাল লাগা—এজন্যে কার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে রানা?
আবোল তাবোল ভাবছে ও।
‘জয়দ্রথ আমাদের সহজে ছাড়বে না, রানা,’ মিত্রা বলল।
‘জয়দ্রথকে শেষ করে এসেছি। কিন্তু ঠিকই বলেছ, টিটাগড়ের ব্যাপারটা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। সরাসরি ডিফেন্স মিনিস্টারের আণ্ডারে। সহজে ছাড়বে না ওরা।’
‘ভেতরে কী দেখলে?’
‘পঙ্গপাল।’
রাস্তাটা বাঁয়ে ঘুরেছে। চাঁদটা চলে গেছে পেছনে। হঠাৎ এক সঙ্গে চমকে উঠল মিত্রা ও রানা। সামনের রাস্তায় ছায়া পড়েছে একটা। এক মুহূর্তে বুঝল রানা ব্যাপারটা। চাপা উত্তেজনায় টান হয়ে গেল ওর পেশিগুলো।
‘ব্রেক করো! ব্রেক করো, মিত্রা!’ চিৎকার করে উঠল রানা।
পনেরো-বিশ গজ স্কিড করে থামল গাড়ি। হেড-লাইট অফ করে দিল মিত্রা।
‘শিগগির বেরিয়ে পড়ো গাড়ি থেকে!’ পিস্তলটা নিল রানা সঙ্গে। এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজা।
বেরোবার আগেই জ্বলে উঠল সার্চ লাইট। ওদের মাথার পঞ্চাশ গজ ওপরে এসে দাঁড়িয়েছে একখানা হেলিকপ্টার। বিশ্রী আওয়াজ হচ্ছে প্রকাণ্ড রোটর ব্লেড থেকে।
একলাফে বেরিয়ে মিত্রার হাত ধরল রানা। এই সম্ভাবনার কথা একবারও মাথায় আসেনি ওর। ছুটল ওরা মস্ত বটগাছটার দিকে। গজ পনেরো-বিশেক। যেতেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ হলো পেছনে। সাঁ করে একটা তপ্ত লোহার টুকরো এসে ঢুকল রানার বাম বাহুতে। দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। পড়ে যাচ্ছিল, মিত্রার কাঁধ ধরে সামলে নিল। অবশ হয়ে গেছে বাম হাত। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে গাড়িটায়। সার্চ লাইটটা আবার খুঁজে বের করল ওদের। এক চোখ মেলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে যেন অগ্নিবর্ষণ করছে ওদের ওপর। এগিয়ে আসছে এবার ওদের দিকে। আবার ছুটল ওরা। এক ঝাক গুলিবর্ষণ করল কো-পাইলট। কাঁধের কাছ থেকে এক খাবলা মাংস উড়ে গেল রানার। পড়ে গেল ও মাটিতে। আর অল্প বাকি আছে বটগাছ তলায় পৌঁছতে। বাঁচার তাগিদে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল রানা। এবার।
ঝিঁঝি ডাকছে চারপাশে। প্রকাণ্ড ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে বটগাছটা। ওর তলায় কিছুটা নিরাপদ বোধ করল রানা। গাছের গায়ে বিঁধে যাচ্ছে কো-পাইলটের গুলিগুলো; কোনও কোনওটা আবার ডালে পিছলে ‘বি’ শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। টেনে তুলে রানাকে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসাল মিত্রা। গুলি খাওয়া হাত থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। কাঁধের জখম থেকে রক্ত ঝরে ভিজে গেছে রানার শার্ট। হাতটা বেঁধে দিল মিত্রা শাড়ি ছিঁড়ে। কিন্তু তিন সেকেণ্ডের মধ্যেই কয়েক পরতা কাপড় ভেদ করে টপ টপ করে রক্ত ঝরতে থাকল। হঠাৎ বড় অসহায় এবং দুর্বল মনে হলো রানার নিজেকে। ও কী করবে? একটা গোটা দেশের বিরুদ্ধে কী করবে ও একা?
গুলি চালানো বন্ধ হয়েছে। অনেক নীচে নেমে এসেছে পঙ্গপালের মত দেখতে কুৎসিত যন্ত্র দানবটা। হঠাৎ ছোট কী একটা জিনিস টুপ করে পড়ল কয়েক হাত দূরে।
‘হ্যাণ্ড গ্রেনেড! মিত্রা! আড়ালে চলে যাও। কানে আঙুল দাও জলদি!’
রানাও সরে এল বটগাছের প্রকাণ্ড গুঁড়ির আড়ালে। প্রচণ্ড শব্দে ফাটল হ্যাণ্ড গ্রেনেড। থেমে গেল ঝিঁঝি পোকার ডাক। পাতার খানিকটা ফাঁকা অংশ দিয়ে দেখা গেল খোলা ককপিটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কো-পাইলট। ধীরে ধীরে নামছে হেলিকপ্টার রাস্তার ওপর। গুলি করল রানা পর পর দুবার। আবার পাতার আড়ালে চলে গেল হেলিকপ্টার। তিন সেকেণ্ড পরই ধপাস করে রাস্তার ওপর পড়ল কো-পাইলটের লাশটা।
ধীরে ধীরে নেমে এল হেলিকপ্টার পীচ ঢালা রাস্তার উপর। ওদের দেখতে পেয়ে হুইল এবং রোটর ব্রেক করে ককপিটের সামনে এসে দাঁড়াল পাইলট, হাতে মৃত কো-পাইলটের ব্রেন গান।
দুর্বলতায় হাত কাঁপছে রানার। পরপর চারটে গুলি করল ও পাইলটকে লক্ষ্য করে। কোন গুলিটা লাগল বোঝা গেল না। বোধহয় শেষটা, কিংবা তার আগেরটা হবে। ধনুষ্টঙ্কারের রোগীর মত বেঁকে গেল পাইলটের দেহ। ট্রিগারে। হাত পড়ে গেল—লক্ষ্যহীন ভাবে আকাশের দিকে পনেরো-বিশবার অগ্নিবর্ষণ করে স্তব্ধ হয়ে গেল ব্রেন গান। লুটিয়ে পড়ল পাইলট হেলিকপ্টারের মেঝেতে। একটা পা বেরিয়ে থাকল ককপিট থেকে।
রক্ত! প্রচুর রক্তক্ষরণে অবশ হয়ে গেছে রানার দেহ। জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ও ধীরে ধীরে। শত্রু এলাকার মধ্যে জ্ঞান হারালে চলবে না। সমস্ত মনোবল একত্র করবার চেষ্টা করল রানা, কিন্তু বুঝল ক্রমেই ঝিমিয়ে আসছে ওর স্নায়ুগুলো।
আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজনের হৈ-হল্লা শোনা যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে ওরা মশাল এবং লণ্ঠন হাতে করে। উপায় নেই। ধরা পড়ে যাচ্ছে ওরা। ছুটে গিয়ে গাড়ির ধ্বংস-তূপের মধ্যে থেকে রানার সুটকেসটা টেনে বের করল মিত্রা। ডালাটায় আগুন জ্বলছে এখনও। উইস্কির বোতলটা বের করে নিয়ে দিশেহারার মত ছুটে এল মিত্রা রানার কাছে। লোকজন তখন বেশ কাছে চলে এসেছে। সময় নেই। যে করেই হোক রানাকে সজ্ঞান রাখতে হবে।
কয়েক ঢোক উইস্কি খেয়ে উঠে বসল রানা। চারপাশের অবস্থাটা বুঝে নিয়ে বলল, ‘আমাকে একটু ধরো, মিতা। হেলিকপ্টারের কাছে নিয়ে চলো।’
ককপিটের দরজা খোলা। কিন্তু সিঁড়ি নেই। রানার পক্ষে ওখানে ওঠা সম্ভব নয়। মিত্রা ভাবল, হেলিকপ্টারের ভিতরে যখন উঠতে চাইছে, তখন নিশ্চয়ই কোনও গল্প বানিয়ে বলতে চায় রানা ওই গ্রামবাসীদের।
লাফিয়ে দু’হাতে ধরল মিত্রা ককপিটের নীচের অংশ। অনেক কসরত করে আঁচড়ে খামচে উঠে পড়ল ভেতরে। ওপরে উঠে সিঁড়ি নামিয়ে দিল নীচে। ধীরে ধীরে উঠে এল রানা সিঁড়ি বেয়ে হেলিকপ্টারের ভিতর। মিত্রা সাহায্য করল ওকে হাত ধরে। পাইলটের পা ভাঁজ করে ভিতরে নিয়ে এল রানা।
‘সিঁড়ি তুলে ফেল।’
সিঁড়ি তুলে ফেলল মিত্রা। ককপিটের দরজাও বন্ধ করে দিল রানার হাতের ইশারায়। ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল রানা।
‘আমার সিট বেল্টটা বেঁধে দাও তো, মিত্রা। তুমিও বসে পড়ো ওই সিটে।’
কথামত কাজ করল মিত্রা। তারপর অবাক হয়ে দেখল যন্ত্রপাতি নিয়ে টানাটানি আরম্ভ করেছে রানা।
রাডার পেডালগুলো পা দিয়ে ছুঁয়ে দেখে নিল রানা, তারপর রোটর ব্রেক ছেড়ে দিয়ে পিচ কন্ট্রোলের থ্রটল একটু ঘোরাল। প্রকাণ্ড পাখাটা ঘুরতে আরম্ভ করল। প্রথম কয়েক পাক ভয়ানক লাগল প্রকাণ্ড রোটরের ছায়াটা দেখতে। ধীরে ধীরে রোটর স্পিড ইণ্ডিকেটারের কাঁটা উঠতে থাকল ওপরে। টেইল রোটরের দিকে পেছন ফিরে একবার চাইল রানা। ইণ্ডিকেটারে যখন দেখা গেল স্পিড মিনিটে দুশো পাক, তখন হুইল ব্রেক ছেড়ে দিয়ে আস্তে পিচ লিভারটা ওপরে টেনে থ্রটল ঘোরাল ও আরও খানিকটা। কেঁপে উঠল হেলিকপ্টার। উড়ি উড়ি করেও যেন প্রকাণ্ড পতঙ্গটা মায়া কাটাতে পারছে না মাটির।
লণ্ঠন এবং মশাল হাতে নিয়ে বহু লোক জড়ো হয়ে গেছে রাস্তার দুই ধারে। ধুলো উড়ছে বলে নাকে কাপড় দিয়েছে বেশির ভাগ, কিন্তু স্পষ্ট উদ্বেগ দেখল রানা ওদের চোখে। রানা হাত নাড়ল ওদের দিকে। ওরাও ধন্য হয়ে গিয়ে হাত নাড়াতে থাকল।
আরও খানিকটা থ্রটল দিতেই প্রকাণ্ড পঙ্গপালটা শুন্যে উঠে গেল। তিনশ’ গজ ওপরে উঠে নীচে চেয়ে দেখল রানা একবার। তখনও হাত নাড়াচ্ছে সরল গ্রামবাসী। কয়েকজন ঘিরে দাঁড়িয়েছে রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহটাকে, আর কিছু লোক চলে গেছে গাড়ির ধ্বংস স্তূপের কাছে।
দুই হাঁটুর মাঝখানে জয়-স্টিকটা ঠেলে দিল রানা সামনে, সেই সঙ্গে দিল লেফট রাডার।
‘বর্ডার পেরোবে কী করে? অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান নিয়ে তৈরি হয়ে আছে দুই দিকের সীমান্ত প্রহরী!’ মিত্রার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
‘হিন্দুস্থান গার্ড কিছুই বলবে না। এটা ভারতীয় এয়ারফোর্সের মার্কা মারা হেলিকপ্টার। আর পাকিস্তান গুলি ছোঁড়ার আগে নামবার আদেশ দেবে। ভদ্রলোকের মত নেমে পড়ব, ভয় কী?’
আরও কয়েক ঢোক উইস্কি গিলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল রানা। হেড ফোনটা লাগিয়ে নিল কানে।
আর রানাকে ঘিরে স্বপ্নের জাল বুনে চলল মিত্রা সেন।