৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫
সিক্সটি ওয়ান মডেল হিন্দুস্থান অ্যামব্যাসাডার-মার্ক টু। ফোর ডোর। থারটিন হানড্রেড নাইনটি নাইন সিসি বা ফোরটিন হর্স পাওয়ার। স্টিয়ারিং গিয়ার। ওয়ান পিস ফ্রণ্ট সিট। ওয়াটার কুলড ইঞ্জিন।
ভারতের তৈরি এই বেঢপ সাইজের কালো গাড়িটার চারধারে এক চক্কোর ঘুরে দেখল রানা। মন্ত্রিত্ব লাভ করে বোধহয় মিত্রার মামাবাবু পেয়েছেন গাড়িটা সরকার থেকে। ছোট্ট হিন্দুস্থানী পতাকা উড়ছে সামনে বনেটের ওপর। রানা বুঝল ডায়ালের ওপর ‘৯০’ লেখা থাকলেও ‘৭৫’-এর এক ইঞ্চি বেশি যাবে না ঘণ্টায়। গ্যালনে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল যেতে পারে বড় জোর, যদি টিউনিং ঠিক থাকে। কার্টসি লাইটের বালবগুলো খুলে ড্যাশ বোর্ডে রেখে দিল রানা।
তৈরিই আছে রানা। ছোট্ট একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। দুটো ডেক্সেড্রিন ট্যাবলেট গিলে নিয়েছে আগেই। গিয়ে বসল ও গাড়ির পিছন সিটে। ড্রাইভিং সিটে মিত্রা সেন। সাড়ে সাতটা বাজছে রানার রিস্টওয়াচে। উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠেছে দোকানে দোকানে।
গাড়িয়াহাটা, লোয়ার সার্কুলার রোড, শেয়ালদা, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, শ্যামবাজার, বেলগাছিয়া, পাইকপাড়া হয়ে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে পড়ল ওরা। এরপর কামারহাটি, পানিহাটি, সোদপুর, খড়দহ হয়ে টিটাগড়। একটি কথাও হলো না ওদের মধ্যে সারাটা রাস্তায়।
টিটাগড় ছাড়িয়ে আরও আধমাইল গিয়ে স্পিড কমাল মিত্রা। বাঁয়ে মস্ত এরিয়া জুড়ে উঁচু পাঁচিল দেখা গেল আবছা মত। নাগরদোলায় নীচে নামবার সময়ে বা প্লেনে এয়ার-পকেটে পড়লে যেমন লাগে তেমনি হঠাৎ শূন্যতা অনুভব করল রানা পাকস্থলীর মধ্যে। এই সেই নিষিদ্ধ এলাকা। বায়ে মোড় নিল গাড়ি।
প্রাচীরের বাইরে দু’ শ’ গজ জায়গা ছেড়ে কাঁটাতার দিয়ে সমস্ত এলাকাটা ঘেরা। হাই ভোল্টের ইলেকট্রিক কারেন্ট দিয়ে সেই বেড়াকে দুর্ভেদ্য করা হয়েছে। এ ছাড়াও কাঁটাতারের বাইরে প্রতি বিশ গজ অন্তর অন্তর রাইফেল হাতে প্রহরী দাঁড়ানো। ভিতরে ঢোকার একটাই মাত্র পথ। একটা সাদা-কালো। রঙ করা কাঠের দণ্ড দিয়ে আটকানো রয়েছে পথ। এটা চেক পোস্ট। দুই পাশে সেন্ট্রির ঘর। দুইজন প্রহরী গেটের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্টেনগান হাতে। মোটা দণ্ডের মাঝ বরাবর ঝোলানো একটা বড় সাইনবোর্ডে লেখা:
PROHIBITED AREA
No Entry Without Pass
সাঁ করে এসে গেটের সামনে থামল গাড়ি। ফ্ল্যাগ এবং নাম্বার প্লেট দেখে স্যালিউট ঠুকল দুই প্রহরী। রেল গেটের মত উঠে গেল পোস্টের এক মাথা ওপর দিকে। ঢুকে পড়ল গাড়ি সীমানার মধ্যে। শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গিয়েছিল রানার, আবার হেলান দিয়ে বসল।
খোয়া বিছানো রাস্তার উপর দিয়ে এগিয়ে গেল হিন্দুস্থান অ্যামব্যাসাডার। প্রায় দুশো গজ অন্ধকার পথ। তারপর উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আসল এলাকা। স্টেইনলেস স্টিলের শিট লাগানো লোহার গেট ভিতর থেকে বন্ধ। কলিং বেল টিপলে ছোট একটা ফোকর সৃষ্টি হবে স্টিল শিটে, সেখানে উদয় হবে প্রহরীর মুখ। দুই ধারের প্রহরী কক্ষের ফুটো থেকে চারটে মেশিনগান তৈরি থাকবে, যাতে কোনও অবস্থাতেই কেউ বিনা অনুমতিতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। এই গেটে মন্ত্রী হোক বা লাট সাহেব হোক, ছাড়পত্র দেখাতে হবে। উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে হবে এবং উপযুক্ত কারণ দর্শাতে হবে আগে থেকে কোনও সংবাদ না দিয়ে হঠাৎ আগমনের। টেলিফোনে জয়দ্রথের অনুমতি আসবে। তারপর খুললেও খুলতে পারে সুরক্ষিত প্রকাণ্ড গেট!
‘হেড-লাইট নিভিয়ে দাও, মিত্রা। গজ পঞ্চাশেক থাকতে বলল রানা। এবার ডান দিকে মাঠের মধ্য দিয়ে নিয়ে চলো গাড়ি।’
লাইট নিভিয়ে দিতেই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। পেছন ফিরে দেখল রানা কেউ লক্ষ্য করছে কি না। না। সেন্ট্রি দুজন পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিকে পিছন ফিরে। ডান দিকের মাঠে নেমে গেল গাড়ি। ঠিকমত গ্রিজ দেওয়া নেই, তাই ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট সাসপেনশন থেকে স্বাধীনভাবে নানান স্কেলে ক্যাঁচকুঁচ শব্দ উঠল অসমান জায়গায় চাকা পড়ায়।
একটা ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাশে দেয়াল ঘেঁষে থামল মিত্রা। ব্যাগটা আগেই ঝুলিয়ে নিয়েছিল কাঁধে, এবার একলাফে নেমে গেল রানা গাড়ি থেকে। মিত্রাও নামল। বিশফুট উঁচু দেয়াল। এ্যাপলিং-হুঁক লাগানো দড়িটা ছুঁড়ে দিল রানা দেয়ালের মাথায়। খটাং শব্দ করে আটকে গেল সেটা।
কাল ঠিক আটটার সময় আবার আসব আমি এখানে। দড়ি ফেলব ওধারে। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করব। যদি বেঁচে থাকো তবে এই জায়গাটায় ফিরে এসো কাজ শেষ হয়ে গেলে।
‘সেটা ঠিক হবে না, মিত্রা। আমি অন্য কোনও পথ বের করে নেব। তুমি আর এসো না।’
‘আমি আসব। গরজ আমার নিজের—আমার ভাবী সন্তানের। তুমি বারণ কোরো না, রানা।’
‘বেশ, এসো। আর এখন ফেরার পথে ওই গেটটায় কলিং বেল টিপে তোমার মামা এখানে এসেছিলেন কি না জিজ্ঞেস করে যেয়ো। তা হলে হঠাৎ আর এখানে আসার ব্যাপারে সন্দেহ করবে না কেউ। কাল আবার আসার পথও পরিষ্কার থাকবে।
শেষ চুম্বন দিয়ে তরতর করে রশি বেয়ে উঠে গেল মাসুদ রানা। দেয়ালের ওপর উঠে মুক্ত বাতাস লাগল ওর চোখে মুখে। একটা আলো এগিয়ে আসছিল ডান ধার থেকে। সার্চ লাইট। দেয়ালের ওপর দেহটা সাঁটিয়ে পড়ে থাকল রানা। পার হয়ে চলে গেল তীব্র আলোটা। সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল রানা ভিতরের দিকে। এখানে-ওখানে বাতি দেখা যাচ্ছে, কাঁকর বিছানো রাস্তাটা গেট দিয়ে সোজা ঢুকে কিছুদূর গিয়ে বাঁয়ে ঘুরেছে। এদিকটা অন্ধকার। নীচে কী আছে বোঝা গেল না ঠিক। বেশ অনেকটা দূরে পাকা দালান দেখা যাচ্ছে। রশিটা ভিতর দিকে এনে হুকটা উল্টো করে বসাল রানা। তারপর নেমে গেল ভিতরে।
শক্ত মাটিতে পা ঠেকতেই রশিটা ছুঁড়ে ওপারে পাঠিয়ে দিল রানা। আধ মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কান পেতে শুনল সে। দূরে চলে গেল গাড়ির মৃদু গুঞ্জন।
আবার একবার পাকস্থলীর মধ্যে সেই বিচিত্র অনুভূতি হলো। তা হলে সত্যিই ঢুকল ও জয়দ্রথের নিষিদ্ধ এলাকায়! সামনে পুরো একটা রাত। এর মধ্যেই সব দেখে-শুনে নিতে হবে। উঁচু টাওয়ার থেকে সার্চ লাইটের আলোটা সমস্ত এলাকা পরিক্রমণ করে আবার আসছে ফিরে। দেয়াল থেকে হাত দশেকের মধ্যেই একটা গাছ। ছুটে সেই গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল রানা। পার হয়ে গেল তীব্র আলো।
ব্যাগ থেকে বিনোকিউলারটা বের করল রানা। আমেরিকার উইভার কোম্পানির তৈরি। জার্মানীর আবিষ্কৃত স্নাইপারস্কোপের মত ইনফ্রারেড লেন্স লাগানো আছে এতে। রাতের অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখা যায় এই দুরবীন দিয়ে। চোখে লাগাতেই ধীরে ধীরে কালো অন্ধকার ফিকে হয়ে গেল। ফোকাসিং নবটা ঘুরিয়ে আরও পরিষ্কার করে নিল রানা দূরের গাঢ় অন্ধকারকে। চারদিকটা একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে।
বাম দিকে গেটের দুই ধারে সেন্ট্রিরুমে আলো জ্বলছে। কোনরকম অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য দেখা গেল না সেখানে। বোধহয় বিনা বাধায় বেরিয়ে যেতে পেরেছে মিত্রা।
কোথাও লুকাবার জায়গা দেখতে পেল না রানা। ডানদিকে দুই দেয়ালের কোণে একটা সেণ্টিঘর—গজ পঞ্চাশেক দূরেই। গেটের কাছে থরে থরে সাজানো মস্ত আকারের অসংখ্য চারকোণা বাক্সমত কী যেন দেখল রানা। সোজাসুজি তাকালেও সেই রকম কী যেন দেখা যাচ্ছে বহুদূরে। আশপাশে কোনও লোকজন দেখতে পেল না ও। এখানে-ওখানে অনেকগুলো গাছ আছে এলাকার মধ্যে কিন্তু একটা গাছেও পাতা নেই। ন্যাড়া ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে ছোট বড় হরেক রকমের গাছ। কদাকার লাগছে ওগুলোকে দেখতে।
হাঁটতে আরম্ভ করল রানা সোজা। পুরো এলাকা সম্পর্কে একটা ধারণা দরকার প্রথমেই। সোজা আধমাইল মত পশ্চিমে হেঁটে আবার একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল রানা। বিনোকিউলার চোখে লাগিয়ে দেখল প্রকাণ্ড একটা পাকা একতলা দালান দেখা যাচ্ছে। প্রায় সিকি মাইল মত লম্বা হবে। চওড়া কতটা তা বোঝা গেল না যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখান থেকে। ওখানেই আসল ব্যাপার চলছে বুঝতে পেরে সেদিকেই এগোল রানা। আলোকজ্জ্বল রাস্তাটা এক লাফে পার হয়ে এল। আশা করল কেউ দেখতে পায়নি। পুকুর ধার দিয়ে এসে দাঁড়াল সেই প্রকাণ্ড ঘরের পাশে। জায়গায় জায়গায় কাঁচ বসানো। শো-রুমের মত। ভিতরটা অন্ধকার। বিনোকিউলার চোখে তুলে দেখল রানা গোটা ঘর ফাঁকা। মেঝেটা বালির। যতদূর দেখা যায় কেবল বালি আর বালি। আর কিছু নেই ঘরের ভিতর। প্রায় দেড় শ’ গজ চওড়া ঘরটা।
কিছুই বুঝতে না পেরে রানা ভাবল, দেখা যাক ওপাশে কী আছে। এমন সময় চোখে পড়ল দু’জন সেন্ট্রি এগোচ্ছে এদিকে। চট করে আড়ালে সরে গেল রানা। ব্যাপার কী! দেখে ফেলেছে নাকি ওরা ওকে?
দেড় শ’ গজ পার হয়ে রানা দেখল হাত চারেক জায়গা ছেড়ে একই আকারের আরেকটা ঘর ওপাশে। এই ঘরটায় উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে। কাঁচ দিয়ে দেখা গেল এ ঘরেও বালির মেঝে। কাঁচটা গরম। ভেতরটায় হিটার বসানো। নাকি? হঠাৎ রানার চোখে পড়ল, অসংখ্য ছোট ছোট পোকা তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছে বালির ওপর। প্রকাণ্ড ঘরটায় একটি জন-প্রাণীর চিহ্ন নেই। ভূতুড়ে কারবার নাকি?
এই ঘরটাও পার হয়ে গেল রানা পেছন দিক থেকে। আরেকটা ঘর। এ ঘরটা প্রথম ঘরের মত অন্ধকার। কাঁচে হাত লাগতেই রানা বুঝল ঘরটা অস্বাভাবিক রকমের ঠাণ্ডা। ভিতরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আবার বিনোকিউলার তুলল রানা চোখে। ভিতরে চেয়েই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল ওর। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পঙ্গপালে ছেয়ে আছে সারাটা ঘর। নড়াচড়া করছে না কেউ—এখন ওদের গভীর রাত। উত্তেজিত হয়ে উঠল রানা। সর্বনাশ! তা হলে তো ডক্টর আলী আকবরের কথাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে! আর্টিফিশিয়াল উপায়ে ল্যাবরেটরিতে ব্রিড করছে এরা অসংখ্য পঙ্গপাল! ঘরের ভিতর মরুভূমির আবহাওয়া তৈরি করেছে এয়ারকুলার ও হিটার ব্যবহার করে।
চতুর্থ ঘরটায় দ্বিতীয় ঘরের মত উজ্জ্বল আলো। কাঁচে চোখ রেখেই শিউরে উঠল রানা। বালি দেখা যাচ্ছে না। মাটি থেকে চার ফুট উঁচু হয়ে সারা ঘরময় বিছিয়ে রয়েছে পঙ্গপাল। একটার ওপর আরেকটা, তার ওপর আরেকটা চড়ে। এগুলো আকারে বড়—পূর্ণ অ্যাডাল্ট। একটার গায়ে লেগে আছে আরেকটা। ডক্টর আকবরের ভাষায় ফেজ গ্রিগেরিয়া, লম্বা পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে একে অন্যকে। মারামারি চলছে নিজেদের মধ্যে। সবচাইতে নীচে যেগুলো আছে। তাদের কথা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে এল রানার। আপনাআপনি কয়েকবার গা-টা শিউরে উঠল তার এত পোকা দেখে। সিকি মাইল লম্বা, দেড় শ গজ চওড়া, চারফুট উঁচু। শুধু পঙ্গপাল আর পঙ্গপাল!
আবার এগোল। আরও একটা ঘর দেখা গেল একই আকারের। কিন্তু এর মধ্যে হরেক রকম যন্ত্রপাতি আর মানুষ দেখা গেল। বাতি জ্বলছে এই ঘরটায়। দুই পা পিছিয়ে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল রানা। বুঝল এটাই আসল ল্যাবরেটরি।
ঘরের মধ্যে পনেরো ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা বিশিষ্ট একটা তারের জাল ঘেরা খাঁচার ভিতর ঠাসাঠাসি করে ভরা পঙ্গপাল। মাটিতে শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে একটা ন্যাড়া গাছের আড়ালে উঠে দাঁড়াল রানা। পঙ্গপাল ভর্তি খাঁচাটার পঁচিশ গজ দূরে আরেকটা সেই সমান খালি খাঁচার মুখ খোলা। একজন পুরু কালো ফ্রেমের চশমা পরা লোক সেই খাঁচার পিছনে কী একটা জিনিস ডান হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ধুতিটা উড়ছে জোর বাতাসে। রানা বুঝল প্রবল বাতাস বইছে পঙ্গপাল ভরা খাঁচাটার দিকে। ধুতি পরা লোকটা বাম হাতে ইশারা করতেই পঙ্গপালের খাঁচার মুখ খুলে গেল। হুড়মুড় করে বেরুতে থাকল হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল। বাতাসের প্রতিকূলে উড়ে তিন মিনিটের মধ্যে সব গিয়ে ঢুকল খালি খাঁচাটার মধ্যে। মুখ বন্ধ হয়ে গেল সে খাঁচার। রানা ভাবল, নিশ্চয়ই মোলাসেস সেন্ট।
বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে পোকাগুলোকে। এই সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে দিনরাত নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে শ’ পাঁচেক একনিষ্ঠ লোক পূর্ব-পাকিস্তানের সর্বনাশ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। এদের দূরদর্শী পরিকল্পনার নিষ্ঠুর ভয়াবহতা চিন্তা করে রানার নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হলো এদের বুদ্ধি এবং শক্তির তুলনায়। ঠাণ্ডা মাথায় এরা কতখানি ভয়ঙ্কর এবং মারাত্মক বিদ্বেষপূর্ণ কাজে লিপ্ত হতে পারে, ভাবতে গিয়ে এদের প্রতি একটা প্রবল ঘৃণা অনুভব করল সে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে এরা নিজেদের হিংস্রতা চরিতার্থ করবার জন্যে।
বিভিন্ন রকম কাজ চলছে এই ল্যাবরেটরিতে। নানান রকম অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির একাংশ দেখতে পেল রানা। চট করে পঞ্চম ঘরটার দেয়ালের সাথে সেটে গেল ও হঠাৎ। একটা পায়ের শব্দ শোনা গেল না? এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝল, মনের ভুল। আরও কী আছে সব দেখতে হবে। আঁধারের মধ্যে দিয়ে দ্রুত হেঁটে দেড়শ’ গজ প্রস্থ পার হয়ে এল রানা। নাহ। আর ঘর নেই। পঞ্চমটাই শেষ। একটা উঁচু বালির ঢিপি। দূরে কয়েকটা সুদৃশ্য বাংলো। শক্তিশালী জেনারেটর চলছে কাছেই—পাশে পানি-ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য ফোয়ারা। তারপরই চোখ পড়ল রানার খাঁচাগুলোর ওপর। শত শত ১৫×১৫×১৫ ফুট খাঁচা সাজিয়ে রাখা আছে পঞ্চম ঘরটার গা ঘেঁষে লম্বালম্বি ভাবে। প্রত্যেকটা খাঁচায় ঠাসাঠাসি করে ভরা একগাদা পঙ্গপাল।
রানা ভাবল, ডক্টর আলী আকবরের দেয়া ম্যাটারিজিয়াম সলিউশনটা এখনই ছড়াতে আরম্ভ করে দেবে, না আগে সবটা এলাকা দেখে নেবে? গোটা পশ্চিম দিকটা বাকি রয়ে গেছে। আগে সবটা দেখে নেয়াই ভাল। রাত আরেকটু হোক। হাতঘড়ির দিকে চাইল রানা। সাড়ে দশটা বাজে। দু’ঘণ্টা পার হয়ে গেছে কখন টেরই পায়নি ও। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল ওর খুব। কিন্তু উপায় নেই এখন।
হঠাৎ মাথার ওপর ঘর ঘর শব্দ শুনে চমকে উঠল রানা। ওভারহেড ক্রেন। আড়ালে সরে দাঁড়াল সে। লোহার তারের মাথায় লাগানো হুক নেমে এসে একটা খাঁচা শূন্যে তুলে নিল। রানাকে দেখতে পায়নি ক্রেন চালক। আলো পড়তেই রানা দেখল খাঁচার ওপর একটা টিনের পাতে ইংরেজিতে লেখা যশোহর। তা হলে এই খাঁচা চলল যশোর বর্ডারে। ক্রেনটা চলে যেতেই বিনোকিউলার চোখে তুলল রানা। দেখল যতগুলো দেখা যায় সবগুলোর উপরই লেখা আছে যশোহর। সবশেষের খাঁচাটা একটু বাঁকা হয়েছিল—সেটাতেও পড়ল রানা, যশোহর।
তা হলে! প্রত্যেকটা জেলার জন্যে এতগুলো করে পঙ্গপাল যাচ্ছে। অন্যান্য জেলার খাঁচা কি গন্তব্যস্থলে রওনা হয়েছে? ওভার-হেড ক্রেনটাকে অনুসরণ করবে ভেবে এক পা এগিয়েছে, অমনি পিছন থেকে আওয়াজ এল, ‘খবরদার! মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও।’
ঘুরে দাঁড়িয়েই গুলি করল রানা। সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল থেকে আওয়াজ হলো, দুপ! ছিটকে লোকটার হাতের সাব-মেশিনগানটা পড়ে গেল মাটিতে। তারই ওপর আছড়ে পড়ল লোকটা। রানা বুঝল, একটু আগে দেখা দুজন প্রহরীর একজন হবে। দেখে ফেলেছিল ওকে নিশ্চয়ই। সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দ্বিতীয়জন।
‘পাকাড় লিয়া?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘হাঁ,’ রানা উত্তর দিল।
কিন্তু গলার স্বরেই চিনে ফেলল সে, তা ছাড়া পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে রানার হাতে সাব-মেশিনগানটা নেই। মুহূর্ত মাত্র সময় না দিয়ে দ্বিতীয়বার গুলি করল রানা। এই লোকটাও হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনে, টু শব্দটি না করে। নিজের শার্ট প্যান্টের ওপর প্রথমে প্রহরীর কাপড়চোপড় পরে নিল রানা। তারপর দুটো মৃতদেহ আর একটা সাব-মেশিনগান বালি চাপা দিয়ে দিল। ততক্ষণে আরও একটা খাঁচা তুলে নিতে ফিরে এল ওভার-হেড ক্রেন। চুপচাপ মাটিতে পড়ে রইল ও।
ওটা চলে যেতেই দ্রুত কাজ সারার তাগিদ অনুভব করল রানা। এই দুজন প্রহরীর অনুপস্থিতি টের পেতে বেশি সময় লাগবে না এদের। তার মধ্যেই চেষ্টা করতে হবে এখান থেকে বেরোবার। ব্যাগ থেকে প্রেগান ফিট করা সলিউশনের কৌটো বের করে পকেটে রাখল রানা। তারপর সাব-মেশিনগানটা তুলে নিল হাতে। ইছাপুর গান অ্যাণ্ড শেল ফ্যাক্টরির তৈরি পয়েন্ট থ্রী-এইট ক্যালিবারের গান। বিশ রাউণ্ডের ম্যাগাজিন। চমৎকার হালকা যন্ত্রটা।
খাঁচাগুলোর পাশ দিয়ে খোয়া বিছানো রাস্তায় গিয়ে উঠল রানা। তারপর এগোল ক্রেনটা যেদিকে গেছে সেদিকে আলোকিত রাস্তার ওপর দিয়ে বুক ফুলিয়ে। কিছুদূর পেছনে একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ পেল সে। হেডলাইট জ্বলে উঠল। দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করল রানার—কিন্তু পালাতে গেলেই সন্দেহ হবে। টিপ টিপ করে জোর হার্টবিট আরম্ভ হয়ে গেল রানার। পিছন ফিরে চাইল না ও। পাশ কাটিয়ে চলে গেল জিপ। কোনও রকম সন্দেহ করেনি ওকে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন।
রাস্তা দিয়ে চলতে বাম দিকে চেয়ে দেখল রানা হাজার হাজার খাঁচা ভর্তি পঙ্গপাল থরে থরে সাজানো। সিলেট-কুমিল্লা-চিটাগাং লেখা খাঁচাও দেখল রানা। কী বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছে জয়দ্রথ মৈত্র, ভাবতেই বুকের ভিতরটা হিম হয়ে আসে ওর। দেখল, ওভার-হেড ক্রেনটা তখন ফিরছে গেটের কাছ থেকে। ওদিকেও আছে নাকি? ডান দিকে মোড় ঘুরল রানা। গেটের কাছেই রাস্তার দুইপাশে অসংখ্য খাঁচা জমা করা। প্রথমে এখানে ঢুকে রানা ওগুলোকে বাক্স মনে করেছিল!
পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রে-গানটা বের করে প্রত্যেকটা খাঁচায় একটু করে সলিউশন স্প্রে করল রানা। ওষুধের নামটা জানে সে, কিন্তু কেন পঙ্গপালের কারবার দেখলে এটা ছড়াতে বলেছেন ডক্টর আকবর তা জানে না রানা। ভদ্রলোকের ব্যস্ততার কারণে সেটা আর জানা হয়নি। রানা ভেবেছিল ছড়ালেই বুঝি মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে এই কোটি কোটি পঙ্গপাল। কিন্তু কই, কিছুই তো হলো না। দেখার মত কিছু ঘটল না। নিরাশ হলো ও। নষ্ট হয়ে যায়নি তো ওষুধ?
দৃঢ় পদক্ষেপে ফিরে এল ও রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকের খাঁচার সামনে। পথে মোড়ের ওপর সেন্ট্রি পোস্টটা খালি দেখে বুঝতে পারল এই চেক পোস্ট থেকে দুজন প্রহরী ওকে অনুসরণ করেছিল। আলোকিত রাস্তাটা পার হবার সময় হয়তো রানাকে দেখে ফেলেছিল ওরা।
বেশ অনেকক্ষণ সময় লাগল পশ্চিম দিকের খাঁচাগুলোয় স্প্রে করতে। তারপর এগিয়ে গিয়ে আবার সেই প্রথম ঘরটার সামনে দাঁড়াল রানা। দরজা তালা বন্ধ। এদিক দিয়ে চেষ্টা করে লাভ নেই। পাশাপাশি দুই ঘরের মাঝখান দিয়ে এগোল সে। পনেরো গজ গিয়েই কাঁচের জানালা পেল। মেশিনগানের মাথা দিয়ে এক ঘায়ে খানিকটা কাঁচ ভেঙে ফেলল সে। অল্প খানিকটা সলিউশন স্প্রে করে দ্বিতীয় ঘরটায়ও তাই করল। তারপর বেরিয়ে এল রাস্তায়; আবার ঢুকল তৃতীয় এবং চতুর্থ ঘরের মাঝের রাস্তা দিয়ে, সেখানে কাজ সারল; কিন্তু পঞ্চম ঘরটায় কিছুই করতে পারল না সে। পূর্ণোদ্যমে কাজ চলেছে সেখানে। যশোহর লেখা খাঁচার গোটা পনেরোতে দেয়ার পরই শেষ হয়ে গেল সলিউশন। রানার কাজও শেষ। আর কিছুই করার নেই ওর। ফেলে দিল স্প্রে-গানটা ড্রেনের মধ্যে।
করবার নেই কেন? ঊরুতে বাঁধা চামড়ার খাপের ভিতর থেকে ছুরি বের করে এক বর্গ ফুট আন্দাজ কাটতে আরম্ভ করল ও তারের জাল। রাতের বেলা ওরা কিছুই টের পাবে না। এরাও বেশ চুপচাপ বসে থাকবে খাঁচার মধ্যে। ডক্টর আলী আকবরের কথাটা মনে পড়ল। রাত হলো কি কাত হলো। রাতে নড়াচড়া করবে না ওরা, কিন্তু সকাল হলেই ফুরফুর করে সব বেরোবে খাঁচা থেকে। পশ্চিমবাংলার ওপর দিয়ে এগোবে ওরা সমস্ত সবুজ মুছে দিতে দিতে। একটা অদ্ভুত আনন্দ শিহরণ অনুভব করল রানা। শত্রুর অস্ত্র তাদেরই বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবার মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি আছে।
গোটা পাঁচেক খাঁচা আর কাটতে পারল না রানা। খটাং করে দরজা খুলে গেল ল্যাবরেটরির। এক ঝলক আলো এসে পড়ল খাঁচাগুলোর ওপর। একটা খাঁচার আড়ালে সরে গিয়ে রানা দেখল চারজন লোক বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। চলে গেল তারা হিন্দীতে কথা বলতে বলতে মাঠের মধ্য দিয়ে বাংলোগুলোর দিকে। খোলাই থাকল দরজাটা। আলোর মধ্যে আর কাজ করা সম্ভব নয়, ছুরিটা যথাস্থানে গুঁজে রেখে সাব-মেশিনগানটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এল ও রাস্তায়। পঞ্চম ঘরের বৈজ্ঞানিকরা শিশি-বোতল-টেস্ট-টিউব আর নানান রকম যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্তই থাকল। হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের সেই খালি চেক পোস্টের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। ক্রিংক্রিং করে ফোন বাজছে। রিসিভার তুলে নিল কানে। একদমে অনেকক্ষণ বকাবকি করল কোনও উপরওয়ালা।
‘যতসব গেঁয়ো চাষাভুষো নিয়ে পড়েছি আমি। এতক্ষণ ধরে রিং হচ্ছে, কানের মধ্যে কি তুলো খুঁজে রেখেছ, না ডিউটি ফেলে ঘুমোচ্ছিলে?’ বকুনি থামল একটু।
‘কাছেই পেচ্ছাব করতে গিয়েছিলাম।’ রানা উত্তর দিল।
‘আর তোমার সঙ্গের ভূতটা?’
‘ওকে দেব টেলিফোন?’
‘না। আমি জিজ্ঞেস করছি দুজনে কি একসঙ্গে গেছিলে জল তৈরি করতে? তোমাদের নামে আমি রিপোর্ট করব, তা জানো? এক্ষুণি অ্যালার্ম সাইরেন বাজাতে যাচ্ছিলাম।’
‘সরি, স্যর।’ উত্তর দিল রানা।
‘স্যর? স্যর বলছ কেন!’
লোকটার কণ্ঠে সন্দেহ ফুটে উঠল। রানা বুঝল স্যর বলা উচিত হয়নি।
‘ভুল হয়ে গেছে।’
‘তোমার নম্বর কত?’ পরিষ্কার সোজা প্রশ্ন।
‘সেভেন্টি-নাইন, সিপি।’ কাঁধের ওপর পিতলের নম্বর দেখে বলল রানা।
খসখস করে কাগজপত্র ঘাঁটার আওয়াজ এল মৃদু। চেক করল বোধহয় অফিসার ডিউটি-রুটিন। একটু থেমে আবার বলল, তৈরি থেকো, এরিয়ার মধ্যে লোক ঢুকেছে বলে সন্দেহ হচ্ছে। সজাগ দৃষ্টি রাখবে চারদিকে।’ রিসিভার ছেড়ে দিল অফিসার।
‘রাত তখন দেড়টা।’
ব্যাগ থেকে কয়েকটা স্যাণ্ডউইচ বের করে খেয়ে নিল রানা উইস্কি দিয়ে গিলে। তারপর সিগারেট ধরাল একটা। তৃপ্তির সঙ্গে কয়েকটা টান দিয়ে ভাবল ব্যাটারা টের পেল কী করে? নাকি এই টেলিফোনের কথোপকথনেই বুঝে ফেলেছে?
এই চেক পোস্টটা ত্যাগ করা উচিত। এইভাবে বেশিক্ষণ আর আত্মগোপন করে থাকতে পারবে না সে। মিত্রা যদি আসে তো সেই আগামীকাল রাত আটটায়। কিন্তু এখন যত শিগগির সম্ভব এই এলাকা ছেড়ে বেরোনো দরকার। অন্যভাবে বেরোবার চেষ্টা করে দেখতে হবে।
ঠিক এমনি সময়ে কাঠের চেক-পোস্টের বাইরে মৃদু একটা খস খস আওয়াজ পেল রানা। মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল ওর কান। এত আলো কেন? বুঝল, দেরী হয়ে গেছে অনেক। একটা সার্চ লাইট স্থির হয়ে আছে এই সেন্ট্রিপোস্টের ওপর। সাব-মেশিনগানের ওপর হাত পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বেজে উঠল আবার। রিসিভারটা কানে তুলে শুনল রানা, পরিষ্কার বাংলায় একজন বলছে, ‘আমি জয়দ্রথ মৈত্র বলছি। বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই, মি, মাসুদ রানা। বিশটা মেশিনগান ধরা আছে আপনার দিকে। কথা না শুনলে এক সেকেণ্ডে শেষ হয়ে যাবেন।’
কথাটা বিশ্বাস করল রানা। কণ্ঠস্বরটাও চিনতে পারল অক্লেশে।
‘মেশিনগান আর পিস্তলটা ডেস্কের ওপর রেখে দয়া করে খালিহাতে বেরিয়ে আসুন বাইরে ভদ্রলোকের মত।’
চিন্তা করছে রানা। তা হলে ধরা পড়ল ও! ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে ভাল করেই জানা আছে রানার। এখনই বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণত্যাগ করবে, না অপেক্ষা করবে সুযোগের? জামার বোতামটা ছিঁড়ে খেয়ে নেবে?
সার্চ লাইটটা সরে গিয়ে অন্ধকার মাঠের ওপর ঘুরে এল একবার। সেই আলোয় রানা দেখল বিশজন সৈন্য মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে চেয়ে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে সাব-মেশিনগান। রানা স্থির করল, কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরবে না, অপেক্ষা করবে ও সুযোগের।
‘অলরাইট, বাস্টার্ড!’ বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা।
‘বেরিয়ে এসো, বাপ। সময় নষ্ট করে লাভ আচে কিচু?’
খুব কাছেই পেছন থেকে মোলায়েম কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বেপরোয়া রানা বেরিয়ে এল বাইরে। খপ করে দুপাশ থেকে দুজন ধরল রানার হাত। তৃতীয়জন এবার পিছন থেকে এসে পিস্তলটা বের করে নিল রানার ওয়েস্ট-ব্যাণ্ড থেকে। অন্ধকার থেকে এগিয়ে এল মেশিনগান-ধারীর দল। ইতিমধ্যে রানার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাধা হয়ে গেছে। দড়াম করে এক লাথি মারল আর্মি লেফটেন্যান্ট রানার পেছন দিকে। দুই পা সামনে এগিয়ে গেল রানা সেই ধাক্কায়।
একটা সুদৃশ্য বাংলোর সামনে নিয়ে যাওয়া হলো রানাকে।
‘আসুন, আসুন! আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, মি. মাসুদ রানা! জানতাম আপনি বাঘের বাচ্চা—পালিয়ে যাবার লোক নন। কলকাতায় পেলাম না, কিন্তু জানতাম এখানে আপনার দেখা পাবই।’ হলুদ বীভৎস চোখ মেলে রানার দিকে চেয়ে রয়েছে জয়দ্রথ মৈত্র। ওর মুখে এই প্রথম হাসি দেখল রানা। হাসতে গিয়ে টান লাগতেই জিভ দিয়ে মুখের দুই কোণের ঘা ভিজিয়ে নিল লোকটা। কেশ-বিহীন প্রকাণ্ড মাথাটার তিন ফুট উঁচুতে উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে। আলোটা চকচকে মাথায় প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে রানার।
কিন্তু আশা করেছিলাম বাইরেই ধরা পড়বেন—ভেতরে ঢোকার আগেই।
পেছন ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করল জয়দ্রথ মৈত্র। পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই পিছনে রয়ে গেল। ওয়েটিংরুমের মধ্য দিয়ে একটা বিরাট কনফারেন্স হলে নিয়ে যাওয়া হলো রানাকে। প্রকাণ্ড একটা পাক-ভারতের ম্যাপ ঝুলছে একধারের পুরোটা দেয়াল জুড়ে। মোটা লোহার শিক দিয়ে ঘেরা ঘরের একটা অংশ। চাবি দিয়ে গেটটা খুলে দিল জয়দ্রথ মৈত্র। দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে ভাল করে সার্চ করা হলো রানার সারা দেহ। উরুতে বাধা খাপ থেকে ছোরাটা বের করে নেয়া হলো।
‘পিস্তলটা কোথায়?’
‘এই যে,’ রানার ওয়ালথার এগিয়ে দিল লেফটেন্যান্ট।
সাইলেন্সর খুলে ফেলল জয়দ্রথ মৈত্র। স্লাইড টেনে ছটা গুলি বের করে ফেলল মাটিতে। ব্যারেলের গোড়ায় চেম্বারের কাছে বুড়ো আঙুলের নখ রেখে পরীক্ষা করে দেখল গুলি ছোঁড়া হয়েছে কি না। নলের ভিতরে পাউডারের দাগ দেখে মাথা নাড়ল সে।
‘লাশ দুটো কোথায়?’ দপ করে জ্বলে উঠল জয়দ্রথের চোখ।
লেফটেন্যান্ট তখন নিচু হয়ে মাটি থেকে গুলিগুলো তুলছিল। রানা দেখল এই সুযোগ। রেঞ্জের মধ্যে আসতেই হঠাৎ প্রাণপণে ঝেড়ে এক লাথি লাগাল ওর চিবুকের নীচের নরম মাংস লক্ষ্য করে। এমন ঘটনার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। স্টিলের ডোল বসানো জুতো সোজা গিয়ে লাগল লক্ষ্যস্থলে। একটা বিকট আওয়াজ করে দুই হাত শূন্যে তুলে চিত হয়ে পড়ল লোকটা মেঝেতে। খুঁটে তোলা গুলিগুলো ছিটকে গেল চারদিকে। নাক মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। শিরা ছিঁড়ে গেছে। আধ মিনিট ছটফট করে জয়দ্রথের চোখের সামনে স্থির হয়ে গেল দেহটা।
লাল হয়ে গেল জয়দ্রথের ফর্সা মুখ। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করল সে। এবার এক ঝটকায় হতভম্ব প্রহরীদের কাছ থেকে ছুটে এল রানা। হাত দুটো তেমনি পেছনে বাঁধা। এক লাফে জয়দ্রথের কাছে চলে এল সে। তলপেট লক্ষ্য করে প্রচণ্ড একটা লাথি চালাল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জয়দ্রথ। চট করে এক পা পিছিয়ে ধরে ফেলল রানার পা।
রানার কানে গেল, পিছনের কাউকে জয়দ্রথ বলল, ‘খবরদার, গুলি করো না!’ তারপরই ধাই করে একটা রাইফেলের বাট এসে পড়ল ওর মাথার উপর। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মাসুদ রানা।
ঠিক সেই সময় পাশের একটা দরজা দিয়ে স্লিপিং গাউন পরিহিতা স্যালি ডেভন ঢুকল এসে ঘরে। এক মুহূর্ত অবাক হয়ে রানাকে দেখল সে।
‘এখন যাও, স্যালি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি আমি।’
বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেল স্যালি পাশের ঘরে। শক্ত করে রানার পা বেঁধে ফেলা হলো। জয়দ্রথের ইঙ্গিতে লেফটেন্যান্টের মৃতদেহ উঠিয়ে নিয়ে গেল দুইজনে। বাকি দুজন রানার পা ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে এল জ্ঞানহীন দেহটা লোহার গরাদ দেয়া হাজত ঘরটার মধ্যে। তালা লাগিয়ে দিল জয়দ্রথ লোহার গেটে। হাতের ইঙ্গিতে ওদের চলে যেতে বলে টেবিলের ওপর কয়েকটা কাগজ ঘাটল কিছুক্ষণ। একটা টেলিফোন করল কোথাও। তারপর বাতি নিভিয়ে দিয়ে চলে গেল পাশের ঘরে।
ঘণ্টাখানেক পর জ্ঞান ফিরে পেল রানা। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। চোখ মেলে দেখল চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কোথায় আছে বুঝতে পারল না ও। পিঠের তলায় হাতটা বেকায়দায় পড়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেহ কাত করে চাপ মুক্ত করল রানা শক্ত করে বাঁধা হাত দুটো। আবার রক্ত চলাচল শুরু হওয়ায় ঝিঁঝি ধরে গেল ডান হাতে। বিকারগ্রস্তের মত অনেক আজেবাজে চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকল ওর মাথার মধ্যে। একই কথা বারবার ফিরে আসে—চেষ্টা করেও তাড়াতে পারে না রানা। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ও।
অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল রানার। চোখ বন্ধ করেই শুনল পাশের ঘরে খবর হচ্ছে রেডিওতে। হঠাৎ ভয়ঙ্কর রকম চমকে উঠল রানা। মুহূর্তে ঘুমের রেশ কেটে গেল তার। যুদ্ধ! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে ভরসা হলো না।
‘এ খবর প্রচারিত হচ্ছে রেডিও পাকিস্তান থেকে। আজ ভোর সাড়ে তিনটায় লাহোরের আটারি-ওয়াগা ও বার্কি সেক্টরে কোনও রকম যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতিরেকেই সাম্রাজ্যবাদী ভারতের হীন আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। অতর্কিত আক্রমণ করে ভারতীয় সৈন্য লাহোর সেক্টরে পাকিস্তানের মূল ভূ-খণ্ডের তিন মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান স্থল বাহিনীর বীর জোয়ানরা বিপুল বিক্রমে শত্রু সৈন্যকে প্রতিহত করছেন। এই মাত্র খবর পাওয়া গেছে–ভারতীয় বিমান বাহিনী ওয়াজিরাবাদে দণ্ডায়মান একটি যাত্রীবাহী রেলগাড়ির ওপর বোমা বর্ষণ করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিমান চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত রাখা হয়েছে। জাতির উদ্দেশ্যে আজ প্রেসিডেন্ট যে জরুরী বেতার ভাষণ দান করেছেন তার বাংলা তর্জমা প্রচার করা হবে পূর্ব পাকিস্তান সময় বিকেল চারটায়।
ব্যাপার কী? যুদ্ধ লেগে গেল? লাহোর আক্রমণ করেছে হিন্দুস্থান!
খবরের বিশেষ বিশেষ অংশগুলো আবার পড়ে শোনানো হলো। মন দিয়ে শুনল রানা। এখন পর্যন্ত পাকিস্তান বিমান বাহিনী আটটি ভারতীয় বিমান ধ্বংস করে দিয়েছে; স্থল বাহিনীর গুলিতে ভূপাতিত হয়েছে আরও তিনটি! খবরের পরই ভেসে এল রানার প্রিয় কণ্ঠশিল্পীর বলিষ্ঠ কণ্ঠ:
রক্তে লিখেছি জন্মভূমির নাম…
সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল রানার। স্থল, বিমান ও নৌ বাহিনীর বন্ধু বান্ধবদের ছবি ফুটে উঠল ওর চোখের সামনে। সমগ্র পাকিস্তানে আজ যুদ্ধ চাঞ্চল্য আর ও কিনা পড়ে রয়েছে নিরুপায় বন্দি অবস্থায়।
এমনি সময় জয়দ্রথ এসে ঢুকল ঘরে। একটা সরু দড়ি ধরে টান দিতেই সারা ঘরে উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠল।
‘ঘুম ভেঙেছে তা হলে? খবরটা শুনলেন? অবাক লাগছে না?’
পরম পরিতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল জয়দ্রথের মুখে। টেবিলের ওধারের চেয়ারটায় বসল সে। দুবার হাতে তালি দিতেই দু’জন সিপাই ঢুকল ঘরে। তালা খুলে রানাকে নিয়ে এসে বসানো হলো একটা বিশেষ ভাবে তৈরি লোহার চেয়ারে। মেঝেতে লেফটেন্যান্টের রক্তের দাগ কালচে হয়ে লেগে আছে এখনও। চেয়ারের সঙ্গেই ফিট করা চামড়ার বেল্ট দিয়ে প্রথমে রানার বুক, পেট এবং আলাদা আলাদা করে দুই উরু বাঁধা হলো শক্ত করে; তারপর পায়ের বাঁধন খুলে পা দুটো চেয়ারের দুই পায়ার সাথে বাঁধা হলো। এবার হাতের বাঁধন খুলে কনুই আর কব্জি বেঁধে ফেলা হলো চেয়ারের হাতলের সঙ্গে। একবিন্দু নড়াচড়ার ক্ষমতা রইল না ওর। জয়দ্রথের ইশারায় বেরিয়ে গেল সিপাই দু’জন ঘর থেকে।
‘আজ আমার বড় আনন্দের দিন, মি. মাসুদ রানা। আজ আমাদের ডি-ডে। দুই-দুইটা বছর কঠোর পরিশ্রম করবার পর আজ আমরা সাফল্য অর্জন করতে চলেছি। তাই অন্যান্য সবাই পৌঁছবার আগেই আপনার সঙ্গে দুটো রসালাপ করবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।’
একটু নড়েচড়ে আরাম করে বসল জয়দ্রথ।
‘ওই যে চেয়ারটায় বসে আছেন, ওটাকে আমরা বলি ‘প্যানিক চেয়ার’। কারও কাছ থেকে তথ্য বের করতে হলে ওটা ব্যবহার করি আমি। আমার নিজের আবিষ্কার। অনেক রকম কাজ হয় ওতে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমাদের দেশের উচ্চমার্গের কয়েকজন ভদ্রলোক এসে পৌঁছবেন এখানে। স্টেনোগ্রাফারও আসবে দুইজন। তাদের সামনে আপনার কাছ থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য বের করে নেয়া হবে নানান কৌশলে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন কয়েকটা ইলেকট্রিক তার গিয়ে ঢুকেছে চেয়ারটার ভিতর। বারোটা বোম আছে আমার হাতের কাছে—একেকটাতে একেক ফল, সময়মত টের পাবেন সব। এখন আমার অতিথিরা এসে পৌঁছবার আগেই আপনাকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল করে নিতে চাই।’
এক টিপ নস্যি নিল জয়দ্রথ মৈত্র।
‘গত দুই বছর ধরে আমরা একটা মহাপ্রস্তুতি নিয়েছি পাকিস্তানকে পঙ্গু, নির্জীব, মেরুদণ্ডহীন এক জাতিতে পরিণত করবার জন্য। তার প্রথম অংশ আপনি রেডিয়োতে শুনেছেন। এগারো ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য আজ পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে প্রস্তুত। আখনুর থেকে রাজস্থান পর্যন্ত ভারতীয় পদাতিক, পার্বত্য অশ্বারোহী, সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ বাহিনী আজ আক্রমণোদ্যত। কেবল লাহোরেই দুই ডিভিশন সৈন্য আজ ঢুকে পড়েছে পাকিস্তানের ভেতর। ফিফটিনথ আর সেভেনথ পদাতিক ডিভিশন। আর টোয়েনটি থার্ড পার্বত্য ডিভিশন রিজার্ভ রাখা হয়েছে, প্রয়োজন হলে লাগানো হবে। এ ছাড়া কাছেই অমৃতসরে আরও এক ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়েছে। দুই দিক আক্রমণ করা হয়েছে—আটারি-ওয়াগা এবং বার্কিলাহোর। এই ভয়ঙ্কর আক্রমণ প্রতিহত করবার ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের নেই। এ ছাড়া এয়ারফোর্স তো রয়েছেই সাহায্যের জন্য। আমাদের Mig 21, Gnat, Hunter, Canberra, Vampire ছাতু করে দেবে পাকিস্তানের দুর্বল Sabre F-86, B-57 এবং F-104। সারা পৃথিবী জানে আজ সন্ধ্যায় আমাদের সেনাপতি লাহোর ফোর্টে বসে চা খাবেন। আগামীকাল লাহোর দখলকারী বাহিনী গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে কাসুর থেকে অগ্রসরমান বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবে। লাহোরের পর শিয়ালকোট। চুরমার হয়ে যাবে পাকিস্তানীদের মনোবল। সর্বত্র দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। মাত্র দশদিন লাগবে আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানকে পদানত করতে। এমনই আঘাত হানব—যেন আগামী দুশো বছরেও সে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। সে ভার গ্রহণ করেছেন আমাদের সেনাপতি। আর আপনাদের পূর্ব পাকিস্তানের ভার পড়েছিল এই আমার ওপর।
বুকের ওপর বুড়ো আঙুল ঠেকাল জয়দ্রথ মৈত্র।
‘আমি ভেবে দেখলাম এই নদী নালার দেশে সৈন্য বাহিনী পাঠিয়ে খুব সুবিধে হবে না। ট্যাঙ্ক যাবে নরম মাটিতে বসে। তা ছাড়া আমাদের সামরিক শক্তির পূর্ণ প্রয়োগ হওয়া দরকার পশ্চিম পাকিস্তানে। তাই এক নতুন উপায় উদ্ভাবন করলাম। পঙ্গপাল দিয়ে ধ্বংস করে দেব পূর্ব-পাকিস্তান। সীমান্ত বরাবর খুলনা-যশোহর-কুষ্টিয়া-রাজশাহী-দিনাজপুর-সিলেট-কুমিল্লা-চিটাগাং, চারদিক থেকে কোটি কোটি পঙ্গপাল ছাড়া হচ্ছে। মাঝরাত থেকেই স্পেশাল ট্রেনে করে রওনা হয়ে গেছে সব পঙ্গপাল গন্তব্যস্থলে। দশ দিনের মধ্যে ধু-ধু করবে আপনাদের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা পূর্ব-পাকিস্তান—সবুজের লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না কোথাও! ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ লাগবে। না খেতে পেয়ে মারা যাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। বাইরে থেকে সাহায্য পাবে না কোনও, বাধ্য হয়ে আমাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইবে তখন। হাহাকার পড়ে যাবে সারা দেশ জুড়ে। আমরা তখন দয়া পরবশ হয়ে অনায়াসে দখল করে নেব পূর্ব-পাকিস্তান। বাধা দেয়ার লোক থাকবে না আর।’
নির্বিকার ভাবে শুনছিল মাসুদ রানা। এবার বলল, ‘আর চুপচাপ তাই দেখবে পৃথিবী। গাঁজা মারার জায়গা পাওনি, শালা।’
জয়দ্রথ একটা বোতাম স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গেই আর্তনাদ করে উঠল রানা তীব্র একটা বিদ্যুৎ ঝটকা খেয়ে।
‘কেউ অশোভন কথা বললে এই বোতামটা সাধারণত টিপি আমি। বারো রকম কৌশলের এটা একটা। আশা করি ভবিষ্যতে আর অভদ্র ভাষা ব্যবহার করবেন না। যাক, যা বলছিলাম… পৃথিবীতে দুর্বলের স্থান নেই। ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা দেশ যা করে সেটাই ন্যায়। তবে হ্যাঁ, প্রতিবাদ হবে, বড় বড় কনফারেন্স হবে, অনেক যুক্তিতর্কের ঢেউ উঠবে—পড়বে, বৃহৎ শক্তিবর্গ বৈঠকের পর বৈঠক বসাবে, আলোচনা চলবে দিনের পর দিন। শেষকালে ছাড়ব আমরা পাকিস্তান। গড়িমসি করে যাচ্ছি—যাব করতে করতে চার-পাঁচ বছর পার হয়ে যাবে। শুষে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেব আমরা পাকিস্তানকে। প্রাণটা কেবল দুর্বলভাবে ধুকপুক করবে—আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। জন্মের পর থেকেই আপনারা যে অবিরাম উদ্বেগের মধ্যে রেখেছেন আমাদেরকে, তাতে সমূলে বিনাশ করা ছাড়া আর কোনও পথই ছিল না আমাদের।
একটু থেমে একটিপ নস্যি নিল জয়দ্রথ মৈত্র। পাশেই রাখা একটা ছোট্ট দামি অলওয়েভ ট্রানজিস্টার রেডিয়ো খুলে দিল। প্রেসিডেন্টের ভাষণের অনুবাদ প্রচার করা হচ্ছে।
ভারতের কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত দশ কোটি পাকিস্তানী বিশ্রাম গ্রহণ করবে না। ভারত এখনও বুঝতে পারছে না কোন জাতির বিরুদ্ধে সে মাথা তুলেছে।
একটু বিদ্রুপের হাসি হেসে বন্ধ করে দিল জয়দ্রথ রেডিয়োটা।
‘আমার দায়িত্ব ছিল মস্ত বড়, মি. মাসুদ রানা। বহু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমার পঙ্গপাল বাহিনী তৈরি করতে হয়েছে। কত শত কঠিন সমস্যা এসে উপস্থিত হয়েছে। ওই যে চারটে ব্রিডিং রুম দেখেছেন—সবগুলোয় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। মরুভূমির আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছে সেখানে। লো হিউমিডিটি, হাই টেম্পারেচার—আর রাতে শীতল। বছরে ছয়বার ডিম পাড়িয়েছি ওদের দিয়ে। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চারবার দিনকে রাত করেছি, রাতকে দিন। এক মাসের জায়গায় এক সপ্তায় পূর্ণ বয়স্ক পঙ্গপাল তৈরি করেছি। স্ত্রী পঙ্গপাল বালুর নীচে দুশো করে ডিম পেড়েছে। ডিম থেকে পিউপা, তার থেকে লারভা এবং সবশেষে অ্যাডাল্ট। বিশেষ প্রক্রিয়ায় দশ দিনের মধ্যেই ডিম পাড়াবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে নতুন জেনারেশন। চিন্তা করে দেখুন, নইলে সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তান ছেয়ে ফেলা সম্ভব হত না এত অল্প সময়ের মধ্যে। আমার বম্বে লোকাস্ট, অর্থাৎ Accridium Succinctum আবার চলে হাওয়ার অনুকূলে। যে সময়টাতে ছাড়তে চাই সে সময় হাওয়া বয় দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে। সিলেট-কুমিল্লা-চিটাগাং-এর জন্যে চিন্তা নেই, কিন্তু আপনাদের পশ্চিম সীমান্তে ছাড়লে সব চলে আসবে আমাদের নিজেদেরই দেশে। তাই এদের স্পেশাল ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। Molasses—’
‘ওসব আমাদের জানা আছে। আপনাদের কার্যকলাপ সবই আমাদের নখদর্পণে। ওই গন্ধ ছড়িয়ে পঙ্গপালগুষ্টি হাওয়ার প্রতিকূলে নেয়ার চেষ্টা করছেন আপনারা।
‘হ্যাঁ। আজ সকালেই আমাদের সব কটা বোমা ফেটে সীমান্ত জুড়ে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে।’
রানা কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে আবার আরম্ভ করল জয়দ্রথ মৈত্র।
‘আপনাদের পিসিআই-চিফ সেগুলো তুলে অকেজো করে ফেলবার জন্যে লোক লাগিয়েছে, এই তো বলতে চাচ্ছেন? সব আমরা জানি। তাই সকাল বেলা প্লেনে করে নতুন একদফা গন্ধ ছড়ানো হয়েছে। দুপুরে চারটে Mig-21যাবে আবার একদফা এক্সট্রাক্ট ছড়াতে। কয়দিক সামলাবে রাহাত খান? ও হচ্ছে গরু খেকো নেড়ে মুসলমান। বুদ্ধির খেলায় আমার কাছে ওতো একটি তৃতীয় শ্রেণীর গর্দভ।’
আবার একবার খুলল জয়দ্রথ রেডিয়োটা। শেষ হয়ে এসেছে প্রেসিডেন্টের বাণী।
‘—কঠোরতম আঘাত হানার জন্য আপনারা তৈরি হোন। এগিয়ে যান, এবং শত্রুর মোকাবেলা করুন। আল্লাহ আপনাদের সঙ্গে রয়েছেন। শয়তানের ধ্বংস অনিবার্য। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।’
পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল। বন্ধ করে দিল জয়দ্রথ রেডিয়োটা বিতৃষ্ণার সঙ্গে।
‘পঙ্গপালের আপনারা কী দেখেছেন? ১৯৬২ সালে করাচির ওপর দিয়ে যে ছোট্ট দলটা উড়ে গিয়েছিল তার ফলেই সারাদিন সূর্যের মুখ দেখতে পায়নি করাচিবাসী। ওটা ছিল মাত্র ৯৫ মাইল লম্বা, ৮ মাইল চওড়া আর উচ্চতা ছিল আধ মাইল। আর এখানে আমি প্রত্যেক জেলার জন্যে ছাড়ছি এর পাঁচগুণ বড় এক একটা করে দল। দুঃখ, শুধু এই, আমার ইচ্ছেমত ছাড়তে পারলাম না। সেনাপতি তৈরি হতে সময় নিয়ে নিলেন একটু বেশি। আর মাস দুই আগে ছাড়তে পারলে অতুলনীয় ক্ষতি করতে পারতাম।’
একবার মুখের দুই কোণ ভিজিয়ে নিল সে। দেখল রানা ঝিমোচ্ছে—ওর কথা শুনছে না। একটা বোতাম টিপল সে। গরম হয়ে উঠেছে চেয়ারটা। অবাক হয়ে রানা দেখল জয়দ্রথ হাসছে। লাল হয়ে উঠেছে চেহারাটা। ধোয়া বেরোতে আরম্ভ করল রানার কাপড় থেকে—আগুন ধরে যাচ্ছে। আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল রানা। সুইচটা অফ করে দিল জয়দ্রথ।
‘ইচ্ছে করলে অসম্ভব ঠাণ্ডাও করা যায় অন্য এক বোতাম টিপে। যাক, যা বলছিলাম। অনেক বাধা বিপত্তি। একবার তো একটা ফাংগাস রোগ ধরে তিন দিনে শেষ হয়ে গেল সব পঙ্গপাল। অত্যন্ত সংক্রামক রোগ। ম্যাটারিজিয়াম থেকে, হয়…’
‘কী বললেন?’ চমকে তাকাল রানা জয়দ্রথের মুখের দিকে।
‘ম্যাটারিজিয়াম। কেন, নামটা শুনেছেন নাকি?’
হঠাৎ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রানার মুখ। বত্রিশ পাটি দাঁত বের হয়ে গেল ওর। অবাক হয়ে বক্তৃতা বন্ধ করল জয়দ্রথ মৈত্র।
‘হাসছেন যে?’
‘আনন্দ চেপে রাখতে পারছি না, তাই।’
‘হঠাৎ এত আনন্দের কারণ?’
‘আমার দেশকে আমি রক্ষা করেছি—তাই মরলেও আজ আমার দুঃখ নেই।’
জয়দ্রথ ভাবল হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি ব্যাটার? অতিরিক্ত নার্ভাস হলে এমন হয় অনেক সময়। কিন্তু হাসিটা তো বিকারগ্রস্তের হাসি বলে মনে হচ্ছে না!
‘ফাংগাস রোগের কথা বললেন না? ম্যাটারিজিয়াম? আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ওই রোগটা বয়ে এনেছি আমি দেশ থেকে। প্রত্যেকটা খাঁচায় ওই সলিউশন স্প্রে করেছি আমি গত রাতে; কিন্তু জানতাম না কী ক্ষতি হবে আপনাদের। এখন বুঝলাম। কালকের মধ্যে সমস্ত পঙ্গপাল মরে ভূত হয়ে যাবে। আপনার এত পরিশ্রম করেও শেষ কালে হেরে গেলেন, মৈত্র মশাই।’
মুখটা হাঁ হয়ে গেছিল জয়দ্রথের, নিজের অজান্তেই নস্যির কৌটাটা তুলে নিল টেবিল থেকে। ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে একটা ঢোক গিলল সে।
‘অসম্ভব!’
‘খুবই সম্ভব। আপনার পঞ্চম ল্যাবরেটরির পাশে যেখানে যশোহর লেখা খাঁচাগুলো ছিল কাল রাতে… ওইখানে ড্রেনের মধ্যে খোঁজ করলে পাবেন, খালি কৌটোটা পড়ে আছে। তুলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ওইখানে এসেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সলিউশন। তাই বাকি খাঁচাগুলোর জাল আমি ছুরি দিয়ে কেটে ফাঁক করে দিয়েছি। জালগুলোও ওখানেই পাবেন। একটু বেলা উঠলেই খাঁচা থেকে বেরিয়ে গেছে ওরা সব—মিথ্যে কথা নয়, খোঁজ নিয়ে দেখুন, এতক্ষণে পশ্চিম বাংলার ক্ষেত খামার চষে বেড়াচ্ছে ওগুলো।
জয়দ্রথ বুঝল মিথ্যে কথা বলছে না রানা। সমস্ত মুখ কুঁচকে গেল ওর। ধক ধক জ্বলে উঠল হলুদ লম্বাটে চোখ জোড়া। শেষ কালে এই সামান্য লোকের কাছে পরাজয় হলো জয়দ্রথের? একটা সাধারণ পাকিস্তানী স্পাই এসে শেষ করে দিল তার এত দিনের সাধনা, এত পরিশ্রম! একজন লোক পাঠিয়ে দিল জয়দ্রথ কৌটোটা নিয়ে ল্যাবরেটরিতে দেবার জন্য? ল্যাবরেটরিতেও ফোন করে কয়েকটা নির্দেশ দিল সে।
জয়ের উল্লাসে রানা বলে চলল, ‘আর, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের রাহাত খান সম্পর্কে সতর্ক হয়ে মন্তব্য করবেন। আমার হাত খোলা থাকলে চড়িয়ে আপনার দাঁত কয়টা ফেলে দিতাম ওই অশোভন উক্তির জন্যে।’
আবার বোতামে হাত দিতে যাচ্ছিল জয়দ্রথ মৈত্র, কিন্তু টেলিফোন বেজে উঠতেই সেদিকে হাত বাড়াল। রিসিভার কানে তুলে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল জয়দ্রথ মৈত্রের।
‘কী বললে? খবর এসেছে খাঁচা খালি? (কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনল) না, এখন আর কোনও ইনসেক্টিসাইড দিয়েই ফেরানো যাবে না। যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে।… কোথায় বললে? বারাসত? (মাথা নাড়ল হতাশ ভাবে) এতগুলো লোক কেউ লক্ষ্য করল না এত খাঁচা সব কাটা?…না, ওখানে জানিয়ে কী হবে?…কী বললে? প্রধানমন্ত্রী? ওদিক আমি সামলাব। আমি আসছি এক্ষুণি।’
রানার প্রতি তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি হেনে উঠে দাঁড়াল জয়দ্রথ মৈত্র। তেমনি মুচকি মুচকি হাসছে রানা। বলল, ‘হেরে গেলেন মৈত্র মশাই। এবং পশ্চিম পাকিস্তানেও লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসতে হবে আপনাদের সেনাপতিকে বেত খাওয়া কুকুরের মত। আমাদের সামরিক শক্তি আপনাদের ভুল ভাঙিয়ে দেবে অল্পদিনেই।’
‘আমি আসছি! তারপর তোমার উপযুক্ত ব্যবস্থা করছি, বদমাশ।’
একটা সুইচ টিপে দিয়ে নিশিতে পাওয়া লোকের মত দিশেহারা পা ফেলে বেরিয়ে গেল জয়দ্রথ মৈত্র।
খুব নিচু ভোল্টে অত্যন্ত হাই অ্যাম্পিয়ারের কারেন্ট চালু হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল রানা। দশ মিনিট পর পর ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে ওর। আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে ভাঙা ভাঙা ভাবে চিন্তা করছে ও অনেক কথা। মাঝে মাঝে চেষ্টা করছে বাঁধন খুলতে—শেষে হাল ছেড়ে দিল। এ বাঁধন খুলবার নয়। বাজে কয়টা এখন? জয়দ্রথ ফিরবে কখন? কখন, আরম্ভ হবে জয়দ্রথের আসল নির্যাতন? তাড়াতাড়ি করছে না কেন? যা ঘটার ঘটে যাক না। এমনি অশ্চিয়তার মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করা যায় না।
মাথার ওপর দিয়ে কত যে জেট গেল ঝাঁকে ঝাঁকে তার ইয়ত্তা নেই। রানা ভাবল, এ এক অদ্ভুত নির্যাতন বের করেছে তো জয়দ্রথ। যখন ও ঘুমাতে চাইছে, তখন কে যেন জাগিয়ে দিচ্ছে ওকে…আবার জেগে থাকবার চেষ্টা সত্ত্বেও কে যেন ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। আর কিছুক্ষণ থাকলে পাগল হয়ে যাবে ও। ঘুমটা যতবার ভাঙছে দুঃস্বপ্ন দেখে ভাঙছে। টপ টপ করে ঘাম ঝরছে সর্বাঙ্গ থেকে।
একটা ছায়া কেঁপে উঠল ঘরের ভেতর। চমকে ঘাড় ফেরাল রানা। স্যালি ডেভন। প্রথমেই পা টিপে টিপে বোতামগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল রানা—সুইচ অফ করে দিতেই ঘুমের রেশটা গেল ছুটে। চটপট রানার বাঁধন খুলতে আরম্ভ করল এবার স্যালি। হাতের বাঁধন আগে খুলল, তারপর পায়ের। বিস্মিত রানা নিজেই তাড়াতাড়ি গলা, বুক এবং পেটের বেল্টগুলো খুলে ফেলল। আধ মিনিটের মধ্যেই বাঁধন মুক্ত রানা উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে।
‘আপনি কোত্থেকে?’ রানা জিজ্ঞেস করল।
জয়দ্রথের সঙ্গে আছি ব্যাঙ্কক যাবার আগের কটা দিন। ক্যাথির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি। ‘আপনার ঋণ আমরা কোনদিনই শোধ করতে পারব না। আমার বোন ভুল করেছিল–ওকে ক্ষমা করতে পারবেন না, মি. রানা?’
‘ওসব পরে হবে, স্যালি। এখন বাজে কয়টা?’
‘সাড়ে সাতটা।’
‘ক’জন সশস্ত্র লোক আছে এ বাড়িতে?’
‘আট দশ জন। কিন্তু সম্পূর্ণ এরিয়ার অর্ধেক প্রহরীকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে আজ।’
‘আমার পিস্তলটা কোথায় জানেন?’
‘না।’
‘প্রহরীদের চোখে না পড়ে এ বাড়ি থেকে বেরোবার কোনও পথ আছে?’
‘তা ঠিক বলতে পারব না। গতকালই প্রথম এসেছি আমি এখানে।’
‘জয়দ্রথ কখন আসবে বলে গেছে কিছু?’
স্যালিকে আর জবাব দিতে হলো না। একটা জিপ জোরে ব্রেক কষে স্কিড করে থামল গাড়ি-বারান্দায়। স্যালিকে, পাশের ঘরে যাবার জন্যে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে ইঙ্গিত করল রানা। দ্রুত চোখ বুলাল ও ঘরের চারধারে। অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় এমন একটা জিনিসও চোখে পড়ল না ওর। টেবিলের ওপর থেকে দুটো কাঁচের পেপার-ওয়েট তুলে নিল হাতে। কয়জন লোক আসছে কে জানে! দেয়ালের গায়ে সেঁটে দাঁড়াল রানা দরজা থেকে চার হাত দূরে। পায়ের শব্দ শুনে রানা আন্দাজ করল দুজন লোক এগিয়ে আসছে এই ঘরের দিকে।
কথা বলতে বলতে ঢুকল জয়দ্রথ মৈত্র। পিছন পিছন এল কোমরে রিভলভার ঝোলানো একজন উচ্চ পদস্থ মিলিটারি অফিসার।
‘হোয়্যার ইজ দ্য সোয়াইন!’ জিজ্ঞেস করল অফিসার।
প্যানিক চেয়ারটা খালি দেখেই আঁতকে উঠল জয়দ্রথ। ধাই করে একটা ভারী পেপার-ওয়েট গিয়ে লাগল মিলিটারি অফিসারের নাক বরাবর। নাকে হাত দিয়ে বসে পড়ল প্রকাণ্ড চেহারার লোকটা, তারপর লুটিয়ে পড়ল মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে। দ্বিতীয় ঢিল ছুঁড়ল রানা জয়দ্রথের মাথা লক্ষ্য করে। দ্রুত মাথা সরিয়ে নিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিল রানাকে জয়দ্রথ। সোজা ওপাশের দেয়ালে লেগে চৌচির হয়ে গেল কাঁচের পেপার-ওয়েট।
বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা জয়দ্রথের উপর। কিন্তু নাকে-মুখে দমাদম কয়েকটা ঘুসি খেয়ে থমকে দাঁড়াল ও। শক্তিতে কিছু কম হলেও অত্যন্ত দ্রুত হাত-পা চালাতে পারে জয়দ্রথ মৈত্র। সেই সঙ্গে বুদ্ধিও। পিছন ফিরেই দৌড় দিল জয়দ্রথ। রানাও ছুটল পিছনে। অফিসারের কোমর থেকে রিভলভার নিতে গেলে হারিয়ে ফেলবে জয়দ্রথকে, তাই খালি হাতেই। চিৎকার করে লোক ডাকছে জয়দ্রথ। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে পেছন দিকের বারান্দায় পড়ল—তারপর ড্রইংরুমের পাশ দিয়ে ছুটল সে। যাবার সময় ড্রইংরুমের দরজায় লাগানো একটা কলিং বেল টিপে দিল একবার। পেছন থেকে ধাওয়া করে প্রায় ধরে ফেলবে রানা এমন সময় হঠাৎ রুখে দাঁড়াল জয়দ্রথ মৈত্র। হাতে উদ্যত ছুরি।
সময়মত সাবধান না হলে ঢুকে যেত ছুরিটা রানার বুকে। ওর হাত ধরে ফেলল রানা, তারপর যুযুৎসুর এক প্যাঁচে দড়াম করে আছড়ে ফেলল মাটিতে। জোরে মাথাটা ঠুকে গেল মেঝেতে। কিন্তু ছুরিটা ছাড়ল না সে হাত থেকে। প্রচণ্ড ওজনের গোটা দুই লাথি লাগাল রানা জয়দ্রথের পাঁজরের ওপর। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল ওর দেহটা। বিলিয়ার্ড বলের মত চকচকে গোল মাথায় একটা লাথি মারতেই বড় সাইজের সুপারির মত ফুলে উঠল জায়গাটা।
এমন সময় বুটের আওয়াজ পাওয়া গেল। দৌড়ে এদিকে আসছে কয়েকজন লোক। চিৎকার করবার চেষ্টা করল জয়দ্ৰথ, কিন্তু ভাঙা একটা কর্কশ শব্দ বেরোল ওর মুখ থেকে। মৃত্যুর বিভীষিকা ওর চোখে-মুখে। আরেকটা লাথি মারল রানা ওর মাথায়। সাময়িক ভাবে জ্ঞান হারাল জয়দ্রথ। এবার জয়দ্রথের একটা হাত ধরে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে পড়ল রানা। ডাইনিং রুম।
এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দ। বুকের ওপর চেপে বসে গলা টিপে ধরল রানা জয়দ্রথের। হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেল জয়দ্রথ। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে হলুদ চোখ দুটো। তখনও ছুরিটা ধরা আছে ওর হাতে। চেষ্টা করল ও একবার। ডান হাতটা ওঠাল দুর্বল ভাবে। রানার পিঠে বসাবার চেষ্টা করল ছুরি। খোঁচা খেয়েই গলা থেকে একটা হাত সরিয়ে কেড়ে নিল রানা ছুরিটা। এবার পা দুটো মাটিতে আছড়ে প্রহরীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করল জয়দ্রথ। রানা দেখল এভাবে এর পিছনে সময় নষ্ট করা যায় না, ধরা পড়ে যাবে। নিষ্ঠুর ভাবে ছোরা চালাল ও। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত। ছিটকে এসে লাগল রানার চোখে মুখে। মাথাটা এক দিকে হেলে পড়ল জয়দ্রথের। ফাঁক হয়ে আছে গলা। কলকল করে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে মেঝেতে।
ছুরি হাতে প্রস্তুত থাকল রানা। কিন্তু না। ডাইনিংরুমটা ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল ওরা সামনে। পর্দার নীচ দিয়ে ওদের বুট দেখতে পেল রানা। জনা ছয়েক হবে।
এবার ধীর পায়ে পেছনের দিকে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। অন্ধকার হয়ে গেছে বাইরেটা। যদি এখান থেকে বেরোতে না পারে তবে যতগুলোকে সম্ভব শেষ করে তারপর মৃত্যুবরণ করবে ও। হঠাৎ পঞ্চাশ গজ দূরে বালির ঢিবিটার কথা মনে পড়ল ওর। মৃতদেহ দুটোর সঙ্গে সাব-মেশিনগানটার কথাও মনে এল। এতক্ষণ পর্যন্ত ওগুলো যথাস্থানে আছে কি না কে জানে? আবার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল করিডোরে। দরজা খুলে বাড়িটার পেছন দিকে বেরিয়ে এল রানা। সার্চ লাইটের আলোটা একবার ঘুরে যেতেই দৌড় দিল ও। পাওয়ার জেনারেটারের পাশ দিয়ে সামনের আলোকিত খোলা মাঠে পড়ল এবার। এক ছুটে চলে এল বালির ঢিবিটার কাছে।
আছে। টান দিয়ে সাব-মেশিনগানটা বের করে বালি ঝেড়ে নিল রানা। একজন মৃত প্রহরীর কব্জি পর্যন্ত হাত বেরিয়ে পড়ল বালির ভিতর থেকে। রওনা হতে গিয়েও থেমে দাঁড়াল রানা, টেনে বের করল ও মৃতদেহটাকে। দুটো এক্সটা ম্যাগাজিন টান দিয়ে বের করে নিল মৃত প্রহরীর কোমরের বেল্ট থেকে।
ছয়জন প্রহরী রাইফেল হাতে জয়দ্রথের বাংলোর পেছন দিয়ে বেরিয়ে এল। জয়দ্রথের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে নিশ্চয়ই, তাই বেরিয়ে এসেছে পেছনের খোলা দরজা দিয়ে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ট্রিগার টিপল রানা। বিকট চিৎকার করে আছড়ে পড়ল মাটিতে সব ক’জন। এবার ছুটল রানা ল্যাবরেটরি ঘরগুলোর পেছন দিয়ে সোজা উত্তর দিকে। কিন্তু এক নম্বর ঘরটার পেছনে পৌঁছতেই আকাশ কাঁপিয়ে বেজে উঠল সাইরেন। এলাকার সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে বিপদ-সঙ্কেত দিয়ে। চারদিকে খবর হয়ে গেছে। গেট থেকে আট দশজন ছুটল সোজা রাস্তা ধরে জয়দ্রথের বাড়ির উদ্দেশে। সেন্ট্রি-ব্যারাক থেকে হুড়মুড় করে বেরোচ্ছে ইউনিফর্মবিহীন সশস্ত্র প্রহরী দলে দলে। পাগল হয়ে খুঁজছে রানাকে সার্চ লাইটের আলো। এক ছুটে পুকুর ধারে চলে এল রানা। তারপর আরেক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে উঠল কয়েকটা মেশিনগান এবং রাইফেল। আশপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল গুলিগুলো। সার্চ লাইটটা রানার ওপর এসে স্থির হয়ে গেছে। প্রথমেই গুলি করে সার্চ লাইটটা নিভিয়ে দিল রানা, তারপর শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে কোনাকুনি এগোল ইউক্যালিপ্টাস গাছের দিকে। হৈ-হৈ করে এগিয়ে আসছে একদল। আবার গুলি করল রানা। চিৎকার করে কয়েকজন পড়ে গেল মাটিতে, বাকি ক’জন শুয়ে পড়ল সটান। বিশগুলির ম্যাগাজিন শেষ হয়ে গেছে, ওটা ফেলে দিয়ে আরেকটা ম্যাগাজিন ভরল রানা। তারপর অন্ধকার মাঠের ওপর দিয়ে প্রাণপণে বুকে হেঁটে এগিয়ে চলল সামনে। ঘাসবিহীন শুকনো মাটিতে ঘষা লেগে ছড়ে গেল দুই কনুই ও হাঁটুর চামড়া। আরও লোক আসছে এগিয়ে। রানাকে দেখতে পাচ্ছে না ওরা। ক্রমেই আরও অন্ধকারে সরে যাচ্ছে ও। কিন্তু পেছনে আলোকিত রাস্তা থাকায় রানা দেখতে পাচ্ছে প্রহরীদেরকে পরিষ্কার। আর একটু ডাইনে সরে গেল রানা। আরও বেশ খানিকটা দূরে আছে দেয়ালটা। গুলি এসে বিঁধছে আশপাশে। খাবলা খাবলা মাটি লাফিয়ে উঠছে আধ হাত।
সাইরেন, গোলমাল ও গালিগালাচের শব্দে হতচকিত হয়ে উত্তর-পূর্ব কোণের গার্ড পোস্ট থেকে বেরিয়ে এল দুজন। কয়েক পা এগিয়ে ধরাশায়ী হলো দুজনেই নিজের পক্ষের সাব-মেশিনগানের গুলিতে। ব্যারাকের লোকগুলোও এতক্ষণে এসে যোগ দিয়েছে। ‘ঠা-ঠা-ঠা-ঠা-ঠা’ মেশিনগান চলছে–দুই হাত থর থর করে কাঁপছে, সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে টাশ করে উঠেছে রাইফেলের গুলি। রীতিমত রণাঙ্গন হয়ে গেছে যেন।
হত্যা করতে হবে। যতগুলোকে পারা যায় হত্যা করতে হবে। খুন চেপে গেছে রানার মাথায়। আবার গর্জে উঠল রানার মেশিনগান। গরম হয়ে উঠল ব্যারেলটা। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ল কয়েকজন। এগিয়ে চলল রানা বুকে হেঁটে। পিছন পিছন মিলিটারি সেন্ট্রিরাও এগোচ্ছে বুকে হেঁটে। খালি ম্যাগাজিন ফেলে দিয়ে শেষ ম্যাগাজিনটা ভরে নিল রানা দুই সেকেণ্ড থেমে। দেয়ালের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে এবার রানা। মোটা গাছটার আড়ালে উঠে দাঁড়াল।
এমনি সময় ‘বুম’ করে একটা বোমা ফাটল আকাশে। আলোকিত হয়ে গেল চারদিক। জ্বলন্ত ম্যাগনেশিয়ামের তীব্র আলো ছোট্ট একখানা প্যারাশুটে ভর করে ধীরে নামছে নীচে। রাতকে দিন বানিয়ে দিল সেই আলো। পরিষ্কার দেখতে পেল রানা বেশ কাছেই দ্রুত বুকে হেঁটে জনাদশেক প্রহরী এগিয়ে আসছে রাইফেল হাতে। আর একটু হলে ধরে ফেলত ওকে। নির্বিচারে গুলি চালাল রানা উঁচু থেকে। বঁড়শি বাধিয়ে ডাঙায় ভোলা চিতল মাছের মত লাফাতে থাকল কয়েকজন। নরক হয়ে গেল জায়গাটা। রক্ত, ধোয়া, করডাইটের গন্ধ, আর সেই সঙ্গে যন্ত্রণাকাতর আহত প্রহরীর ভয়াবহ চিৎকার।
অপর পক্ষ থেকেও কয়েকটা মেশিনগান ও রাইফেল গর্জে উঠল। অনেকগুলো এসে লাগল গাছে, বাকিগুলো গিয়ে বিঁধল দেয়ালে। আবার গুলি চালাল রানা। কয়েকটা বেরিয়েই শেষ হয়ে গেল গুলি, ধক করে উঠল রানার বুকের ভেতরটা। আর রক্ষে নেই। টের পেলেই এগিয়ে আসবে ওরা নির্ভয়ে। কুকুরের মত গুলি করে মারবে ওকে। দেয়ালের দিকে চাইল রানা। কই, মিত্রা তো এল না? রশি ফেলবে বলেছিল, কোথায়? হয়তো আজ ঢুকতেই পারেনি মিত্রা। কিংবা হয়তো এসে পৌঁছায়নি এখনও। আটটা কি বেজেছে?
আবার না-ও তো আসতে পারে মিত্রা! রানার বন্দি হবার খবর যদি ওর কানে গিয়ে থাকে তা হলে হয়ত আসার প্রয়োজনই বোধ করেনি সে। শির শির করে একটা ভয়ের ঠাণ্ডা শিহরণ ওর মেরুদণ্ড বেয়ে উঠে এল উপরে। আর রক্ষে নেই।
মিত্রার ওপর নির্ভর না করে সোজা গেটের দিকে যাওয়াই বোধহয় উচিত ছিল। এক্ষুণি ওরা টের পেয়ে যাবে রানার হাতে আর গুলি নেই। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওরা আর অবিরাম গুলিবর্ষণ করছে। প্যারাসুটে চড়ে ম্যাগনেশিয়ামের আলো নেমে এসেছে অনেক নীচে। পুকুরের মধ্যে পড়েই দপ করে নিভে গেল আলো। অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। গুলি বন্ধ করল সিপাইরা।
ঠিক এমনি সময়ে পেছনে সড়াৎ করে একটা শব্দে চমকে উঠল রানা। মিত্রা না তো? লাফিয়ে উঠল রানার হৃৎপিণ্ড। ছুটে গিয়ে দেয়াল হাতড়াতে আরম্ভ করল ও পাগলের মত। সত্যিই, রশি এসে পড়েছে দেয়াল ডিঙিয়ে। দ্রুত উঠতে আরম্ভ করল রানা রশি বেয়ে।
মাঝ বরাবর উঠতেই ‘বুম’ করে আরেকটা শব্দ এল কানে। দিনের মত আলোকিত হয়ে গেল আবার চারদিক। দেখে ফেলেছে এবার ওরা রানাকে। হৈ হৈ করে এগিয়ে এল ওরা, কয়েকটা গুলি বিঁধল এসে আশপাশের দেয়ালে। ছিটকে ইটের গুঁড়ো লাগল রানার চোখে-মুখে। আবার কয়েক রাউণ্ড গুলি এল ছুটে।
ইউক্যালিপ্টাসের মিষ্টি গন্ধ এল নাকে। লাফিয়ে এদিকে পড়ল রানা দেয়াল থেকে। নামল বটে, কিন্তু নেমে আর উঠতে পারল না। অসম্ভব চোট লেগেছে পায়ে। ছুটে এসে ধরল ওকে মিত্রা। বহু কষ্টে টেনে নিয়ে গেল গাড়ির কাছে। পেছনের দরজা খুলে সাহায্য করল ওকে ভেতরে ঢুকতে।
কোনও মতে আছড়ে পাছড়ে উঠল রানা সিটের ওপর।
‘খানিকটা উইস্কি দেব? সঙ্গে আছে।’
‘শিগগির গাড়ি ছাড়ো, মিতা।’ হাঁটুতে হাত বুলাচ্ছে রানা।
গাড়ি ছেড়ে দিল মিত্রা।
প্রহরী দুজন অবাক হয়ে চেয়ে আছে, এদিকে এত গোলাগুলি, চিৎকার এবং সাইরেনের আওয়াজ শুনে। ম্যাগনেশিয়াম ফ্লেয়ার দেখে টের পেয়েছে ওরা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটছে ভিতরে। দূর থেকেই হাত তুলল ওরা। এই অবস্থায় গাড়ি ছেড়ে দিতে পারে না ওরা।
ড্যাশবোর্ড থেকে একটা পিস্তল বের করে রানার হাতে গুঁজে দিল মিত্রা। পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের ‘রণবীর’ পিস্তল। ভারতের তৈরি।
লুটিয়ে পড়ল দুই প্রহরী কাঁকর বিছানো রাস্তার ওপর পেট চেপে ধরে। মিত্রা নেমে গিয়ে সাদা-কালো পেইন্ট করা ভারী পোস্টটা তুলে দিল। তারপর ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ছুটল হিন্দুস্থান অ্যামব্যাসাডার ফুল স্পিডে।