৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।

‘…লেটস গেট আউট।’

উঠে দাঁড়িয়েছিল রানা এক ঝটকায়। দেখল, কথাটা বলেই পেছন ফিরে দরজার দিকে এগোল ছায়ামূর্তিটা। রানাও বেরিয়ে এল লোকটার পিছু পিছু। দরজা দিয়ে বেরিয়ে আলোকোজ্জ্বল লাউঞ্জের দিকে না গিয়ে বারের পাশ দিয়ে অন্ধকার করিডোর ধরে এগোল লোকটা। একবারও চাইল না রানার দিকে ফিরে।

‘কে আপনি?’ এগিয়ে গিয়ে এক থাবা বসাল রানা লোকটার কাঁধে।

‘কোনও কথা নয়, জলদি বেরিয়ে আসুন আগে।’

অল্প কিছুদূর গিয়েই ছোট একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এল ওরা হোটেলের বামধারের সুইপার প্যাসেজে। রানা ভাবছে আর এগোনো ঠিক হবে কি না। খশ করে ম্যাচের কাঠি জ্বালল লোকটা। সেই আলোর সামনে একটা কাগজ ধরল। রানা পড়ল:

Lew Fu-Chung

01633

Chinese Secret Service

লাফিয়ে উঠল রানার হৃৎপিণ্ড। এরাও তা হলে চোখ-কান খোলা রেখেছে! ফুচুং-এর নাম ও শুনেছে বহুবার। কলকাতার চিফ এজেন্ট। কিন্তু তাকে বের করে আনল কেন ফুচুং?

কাগজটা পুড়িয়ে ফেলল ফু-চুং। জুতো দিয়ে মাড়িয়ে ছাইটা গুঁড়িয়ে দিয়ে ইশারায় এগোতে বলল রানাকে। কিচেনের পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে পার হয়ে এল ওরা। বিরিয়ানী, কালিয়া, কাবাব, চিকেন কারি, প্রন-কাটলেট, ফ্রায়েড এগ, কাঁচা পেঁয়াজ ইত্যাদি সবকিছুর গন্ধ মিলেমিশে একটা বোটকা গন্ধ এল নাকে। আরও কিছুদূর এগিয়ে মুখ খুলল লিউ ফু-চুং।

‘আপনার ঘর এখন সার্চ হচ্ছে।’

‘মিত্রা!’ দাঁড়িয়ে পড়ল রানা।

‘উনি এখন নিরাপদে আমাদের গাড়িতে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমি আর এগোচ্ছি না—এখান থেকেই আবার ব্যাক ডোর দিয়ে হোটেলে ফিরে যাব। ওদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করা দরকার। আপনি গলি দিয়ে বেরিয়ে বাঁ দিকে হাঁটতে থাকবেন। ঠিক পাঁচ শ’ গজ দূরে দেখবেন রাস্তার ওপাশে একটা কালো সুপার ভক্সহল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আপনি উঠে বসলেই আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবে ড্রাইভার। আমি বাসায় টেলিফোন করে সব ইন্ট্রাকশন দিয়ে দিয়েছি। কোনও অসুবিধা হবে না আপনাদের। গুড লাক।’

‘সময় মত সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’

উত্তর এল না কোনও। ততক্ষণে পিছন ফিরে কয়েক পা এগিয়ে গেছে ফুঁ চুং। দ্রুত মিলিয়ে গেল সে অন্ধকারে।

গ্র্যাণ্ড হোটেলের সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল সুপার ভক্সহল। হোটেলের দিকে এক নজর চেয়েই চমকে উঠল রানা। ঠিক লাউঞ্জে ঢুকবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জয়দ্রথ মৈত্র। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল ও এযাত্রা। আরও অনেক সাবধান হওয়া উচিত ছিল ওর। মনে মনে নিজেকে কষে গোটা কয়েক চাবুক লাগাল রানা নির্মমভাবে। শক্ৰব্যুহের মধ্যে বুদ্ধির ঘোড়া আরও দ্রুত ছোটাতে হবে। বারবার আর ভাগ্য ওকে সহায়তা করবে না।

ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখল রানা আগাগোড়া সবটা ব্যাপার। খ্যাপা কুকুর হয়ে খুঁজছে ওকে এই দেশের এক মহা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। কী করবে এখন ও? ফিরে যাবে পাকিস্তানে? সবকথা শুনে রাহাত খান নিশ্চয়ই ওকে দোষারোপ করতে পারবেন না। কিন্তু খুশিও হবেন না। পরাজয়কে রাহাত খান ঘৃণা করেন। যে কাজে এসেছিল সে কাজ শেষ না করে কোন্ মুখে গিয়ে দাঁড়াবে ও ওই অসমসাহসী তীক্ষ্ণধী বৃদ্ধের সামনে? আর একটু মাথা খাটালে নিশ্চয়ই কোনও পথ বেরোবে কার্যোদ্ধারের। যাই ঘটুক না কেন, পালিয়ে যেতে পারবে না ও—অসম্ভব। কিন্তু এগোবে কোন পথে? প্রতি পদেই ধরা পড়বার ভয়। প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে ঢুকবে কী করে পাঁচিলের ভিতর? কোনও বুদ্ধিই যে খেলছে না মাথায়। হেই, হ্যাট করে লেজে মোচড় দিয়েও নড়াতে পারছে না ও তার চিন্তার গরুর গাড়ি। ভাবনাটা দূর করে দিল রানা। মাঝে মাঝে এমন হয়–অনেক মাথা খাঁটিয়েও সমাধান পাওয়া যায় না। কিন্তু আপনিই একটা পথ বেরিয়ে যায় ঠিক প্রয়োজনের সময়ে।

মৃদু হেসে বাইরে চেয়ে রইল ও। দ্রুত অপসৃয়মাণ বাড়ি-ঘর দোকান-পাট আর লাল-নীল নিয়ন সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল ওরা পার্ক স্ট্রিট ধরে। আমীর আলী এভিনিউ ছাড়িয়ে গড়িয়াহাটায় পড়ল সুপার ভক্সহল।

‘অত ভেবো না। আমি তোমাকে সাহায্য করব, রানা।’

চমকে উঠল গভীর চিন্তামগ্ন রানা। মিত্রার উপস্থিতি ও প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। নিজের অজান্তেই ডুবে গিয়েছিল চিন্তায়।

‘না,’ মিত্রার কাঁধে হাত রাখল রানা। ‘তোমার অন্তর্দাহ বাড়িয়ে লাভ কী?’

‘আর কোনও দ্বন্দ্ব নেই আমার। তোমার এই বিপদের সময় আমি কিছুতেই চুপচাপ বসে থাকতে পারব না। আমি বুদ্ধি বের করে ফেলেছি।’ আরও কাছে সরে এল মিত্রা।

‘কী বুদ্ধি, মিত্রা?’

‘কাল সকালে তোমার যাওয়া হবে না টিটাগড়। আমি নিয়ে যাব তোমাকে সন্ধ্যায়। কোনও কথাই যখন শুনবে না, ঢুকবেই যখন তুমি ওই প্রাচীরের ভেতর, তখন যাতে ঢোকার আগেই ধরা না পড়ো তার ব্যবস্থা আমি করব।’

‘তোমার সঙ্গে আমি গেলে তো!’

‘কেন? যাবে না কেন?’

‘তোমার কোনও বিপদ হোক এটা আমি চাই না। তা ছাড়া তোমার শরীর ভাল না—কোনও রকম ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না এই অবস্থায়।’

‘কিচ্ছু ঝুঁকি নেই। আমার মামার গাড়িতে যাবে। গাড়ির সামনে ফ্লাগ দেখলে কেউ ঠেকাতে সাহস পাবে না।’

‘তুমি চাইলেই ওঁর গাড়ি পাবে? ওঁর নিজের কোনও দরকার থাকতে পারে না?’

‘উনি সন্ধ্যের পরই জপে বসেন। অরবিন্দ ঘোষের চেলা। আজীবন ব্রহ্মচারী। স্বদেশী আন্দোলনের একজন পাণ্ডা ছিলেন। আমি ওঁর একমাত্র আদরের ভাগ্নি। ওসব তুমি ভেবো না, গাড়ি পাব।’

বালিগঞ্জে একটা ছোট্ট একতলা বাড়ির গাড়ি-বারান্দায় এসে থামল ওরা। রানার ঘড়িতে বাজে রাত এগারোটা। একজন চীনা মহিলা দরজা খুলে দিয়ে হেসে অভ্যর্থনা জানাল ওদের। সোনা বাঁধানো একটা দাঁত। মাথা ঝুঁকিয়ে হাতের ইশারায় রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল ভিতরে। মোজাইক করা সুন্দর ঝকঝকে তকতকে একটা বেড রুমে ওদের বসিয়ে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে। একটু পরেই রানার সুটকেস এবং অ্যাটাচি কেসটা এনে রাখল ড্রাইভার এক কোণে।

‘এ কোন মুলুকে এলাম রে, বাবা। সবই তো চীনা দেখছি!’ বাথরুমের দিকে এগোল মিত্রা।

রানা ভাবছে, পিসিআই-এর পাত্তা নেই কেন? কী হলো? আর চাইনীজ সিক্রেট সার্ভিসই বা এত খবর জানল কোত্থেকে? এখানে একই সঙ্গে কাজ করছে নাকি দুই দেশ?

মিনিট পনেরো পর ফুচুং এসে ঢুকল ঘরে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বলিষ্ঠ দেহ। চেহারা অনেকটা বাঙালির মত। পরিষ্কার বাংলা বলে।

‘ভাগ্যিস সময়মত মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, মি. রানা। আর একটু দেরী হলেই কাজ হয়েছিল আর কী। কিন্তু আপনাকে স্পট করল কী করে ওরা? তুমুল কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেছে দেখলাম? আর আপনিই বা টের পেলেন কী করে যে ধরা পড়ে যাচ্ছেন?’

সমস্ত ঘটনা ভেঙে বলল রানা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা খবর পেলেন কী করে?’

‘ওহ-হো! আপনি বুঝি জানেন না? গতরাতে আপনাদের পিসিআই এজেন্ট মোহাম্মদ আলী ধরা পড়ে গেছে দলবল সহ। এখন সে আইএসএস-এর টরচার চেম্বারে। আমরা আপনাদের চিফের সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছিলাম আজ। তাঁর কাছেই আপনার আগমন সম্পর্কে জানতে পারি–টেলিফোন নাম্বারটাও ন’টার দিকে আপনার মেসেজ পেয়েই আমি ছুটেছিলাম, গ্র্যাণ্ড হোটেলে। পিসিআই-এর কাজ এখন আমরা টেক-আপ করেছি। যতদিন অন্য কেউ না আসবে ততদিন আমাকেই চালিয়ে নিতে হবে।’

‘হোটেলের অবস্থা কী রকম দেখলেন?’

‘কী আবার? একটু অবাক হয়ে গেছে ওরা, কিন্তু মোটামুটি নিশ্চিন্ত আছে, ধরা আপনাকে যাবেই। ‘H’ তো এখন সেই ডান্সারের সঙ্গে খুব মৌজে আছে। জড়াজড়ি করে ঢুকল দুজন রুমের মধ্যে—দরজা লাগিয়ে দিল, আমি বেচারা আর কী করি, ফিরে এলাম।’

রানা বুঝল এই বন্ধুটির কাছেই স্যালি ডেভন ওর ছবি দেখেছে। তাই এক নজরেই চিনতে পেরেছিল আজ বিকেলে। জয়দ্রথের সঙ্গে স্যালি! হাসি পেল রানার।

‘যাক, এখন আপনার প্ল্যান কী?’ জিজ্ঞেস করল ফু-চুং।

‘কাল যাচ্ছি টিটাগড়।’

‘এত ঘটনার পরেও। নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবেন। কোনও লাভ নেই গিয়ে। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি চারপাশ। অ্যাবসলিউটলি ইনভালনারেবল! না সূচক মাথা নাড়ল ফুচুং ঠোঁট উল্টে। অবশ্য আপনার কাজ, আপনি যা ভাল বুঝবেন করবেন। তবে আমার মনে হয়…’ কথাটা আর শেষ করল না সে। মিত্রার দিকে চোখ পড়তেই লজ্জিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। আপনাদের বিশ্রাম দরকার। আর বিরক্ত করব না। কাল দেখা হবে। এখান থেকে ইচ্ছে করলেই কাল আপনি আপনার চিফের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমাকে বললেই ব্যবস্থা করে দেব। আচ্ছা, আসি। শুভরাত্রি।’

রানা বসেছে বিছানার উপর। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মিত্রা এসে রানার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল।

‘আচ্ছা, এই চীনা ভদ্রলোক আমাকে কী মনে করলেন বল তো। এমন লজ্জা করছিল। ভাবছিলাম, অন্তত শালীনতার খাতিরে আমার আজ বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত ছিল এখানে না থেকে। কিন্তু কিছুতেই নড়তে পারলাম না।’

‘কেন পারলে না?’ হেসে জিজ্ঞেস করল রানা।

‘বোঝ না? রানার মাথাটা চেপে ধরল সে বুকের মধ্যে। কেউ কি বলতে পারে এ আমার শেষ রাত নয়? তুমি আমাকে বেহায়া বানিয়ে দিয়েছ, রানা।’

একটা মস্ত ডাবল বেড স্প্রিং-এর খাট নীল বেড কাভারে ঢাকা। নীচে দামি নীল চাদর।

‘ওঠো দেখি, এটা তুলে ভাঁজ করে রাখি।’

বাক্স থেকে স্লিপিং গাউনটা বের করে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল রানা। বেড কাভার ভাঁজ করে আলনায় রাখল মিত্রা। শাড়িটার ভাঁজ নষ্ট করলে চলবে না, খুলে সেটাও রাখল আলনার উপর। ব্লাউজ না খুলেই ভিতর থেকে হুক খুলে টান দিয়ে বের করে আনল ব্রেসিয়ার। তারপর ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে ইয়ার্ডলি ট্যালকম পাউডারের কৌটোটা তুলে নিয়ে অকৃপণভাবে ছড়াল সারা গায়ে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা কর্কশ পুরুষালী হাত গায়ে এসে পড়তেই চমকে উঠল মিত্রা।

‘অ্যাই, ফাজি। কখন পা টিপে এসে দাঁড়িয়েছ পেছনে, টেরই পাইনি। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম একেবারে।’

সারা অঙ্গে পাউডার মাখিয়ে দিল রানা। বোতাম খুলে গেল ব্লাউজের। চোখ বুজল মিত্রা। মুখে চাপা দুষ্টামির হাসি। আঙুল ধরে নিয়ে গেল সে রানাকে বিছানার ধারে। বলল, ‘বড় বেহায়া মনে হচ্ছে আমাকে, না?’ মুখটা রক্তিম হয়ে উঠল ওর।

কোনও উত্তর না দিয়ে টেনে নিল ওকে রানা। ব্যবধান রইল না আর। শক্তিশালী দুই বাহুর মধ্যে এলিয়ে পড়ল মিত্রা সেন।

‘কোনও দ্বিধা নেই তো, মিতা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘না।’