৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫

‘ইওর অ্যাটেনশন, প্লিজ!’ প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজ অ্যানাউন্সেস দ্য ডিপারচার অভ ইটস জেট ক্লিপার রাউণ্ড দ্য ওয়ার্লর্ড সার্ভিস ফ্লাইট পিএ জিরো জিরো ওয়ান, টু রেঙ্গুন-ক্যালকাটা-কারাচী-বায়রুত-ইস্তাম্বুল-মিউনিখ-ফ্রাঙ্কফুর্ট-লণ্ডন-নিউ ইয়র্ক। প্যাসেঞ্জারস আর রিকোয়েস্টেড টু বোর্ড দ্য এয়ারক্রাফট। থ্যাঙ্ক ইয়ু।’

চড়া পর্দার তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠ বিশটা লাউড-স্পীকার থেকে ছড়িয়ে পড়ল সারাটা এয়ারপোর্টে।

বহু ছাপ-ছোপ দেয়া পাসপোর্টটা ফেরত পেয়ে প্যাসেঞ্জারস লাউঞ্জের দিকে এগোল রানা। প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ জন প্যাসেঞ্জার। রানা খেয়াল করল, একজন যাত্রী ওকে লক্ষ্য করছে সামনে ধরা খবরের কাগজের আড়াল থেকে, আড়চোখে। আনমনে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। লোকটার হাতে ধরা কাগজটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সে। তিন তারিখের একটা পূর্ব পাকিস্তানী কাগজ। রানার দুর্ঘটনার খবরটা পড়ছে লোকটা মনোযোগ দিয়ে। মাটিতে রাখা একটা অ্যাটাচি কেসের গায়ে লোকটার নাম পড়ল রানা—টি. আর. পট্টবর্ধন। নিশ্চয়ই ভারতীয়। টের পেয়ে গেল নাকি ওরা? ফ্লাইট ক্যান্সেল করে দেবে? সপ্তাহে তিনটে মাত্র ফ্লাইট—মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি। আজ না গেলে ছ’তারিখের আগে পৌঁছতে পারবে না টিটাগড়। কিন্তু টের পাবে কী করে? অসম্ভব। এটা বোধহয় দৈব-সংযোগ। গত রাতে তার ঘরে লোক ঢোকার কথাও মনে পড়ল রানার। গোড়াতেই গলদ হয়ে গেল না তো? এই অবস্থায় কোলকাতা যাওয়া কি নিরাপদ? ঘুরে দাঁড়াল চিন্তিত রানা। তারপর স্থির করল, এখন আর পিছিয়ে যাওয়া যায় না।

প্লেনে উঠবার সিঁড়িতে পা দিয়েই নিজের নাম, অর্থাৎ মি. থিরা শুনে থমকে দাঁড়াল রানা। দেখল ক্যাথি ডেভন আসছে পিছন থেকে দৌড়ে।

‘ওই পট্টবর্ধন থেকে সাবধান। ও কিছু একটা সন্দেহ করেছে। খুব সাবধান! এখন সব কথা বলবার সময় নেই।’ কাছে এসে নিচু গলায় কথাটা বলেই লোকটার দিকে ইঙ্গিত করল ক্যাথি। একটা রক্ত গোলাপের কুড়ি রানার কোটে লাগিয়ে দিল সে। তারপর বলল, ‘আজকের ফ্লাইটটা ক্যান্সেল করতে পারেন না?’

‘না, দেরী হয়ে যাবে। নেক্সট ফ্লাইট সাত তারিখে। অনেক দেরী হয়ে যাবে।’

রানা লক্ষ্য করল ভিতর ভিতর কেন জানি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আছে ক্যাথি।

‘আপনি গ্র্যাণ্ড হোটেলেই উঠছেন, না?’

‘খুব সম্ভব।’

‘ওই হোটেলেই আছে আমার বোন স্যালি ডেভন। আমার একটা চিঠি পৌঁছে দেবেন তাকে, দয়া করে?’

‘নিশ্চয়ই। আর মি. শ্রীসনানকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন। আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। গুডবাই।’

‘গুডবাই। ভায়া খণ্ডিওস।’

চিঠি নিয়েই রানা উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। রুমাল নাড়ল ক্যাথি। রানাও একটু হাত নেড়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। রানার ঠিক পেছনের সিটে এসে বসল টি. আর. পট্টবর্ধন। মাথায় একবোঝা দুশ্চিন্তা নিয়ে সিট বেল্ট বাঁধল মাসুদ রানা।

সুনীল সাগর পেরিয়ে একসময় এল রুপালী নদী-নালার দেশ শ্যামলবাংলা। নীচে সবুজ কার্পেট বিছানো! তারপর মহানগরী কলকাতা—ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, খেলনার মত ট্রাম বাস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, গড়ের মাঠ, মনুমেন্ট, হাওড়া ব্রিজের একাংশ।

ক্লিপার জেট নামল দমদম এয়ারপোর্টে। রানওয়ের ওপর দিয়ে ট্যাক্সিইং করে এসে একপাক ঘুরে দাঁড়াল প্রকাণ্ড প্লেনটা হ্যাঙার ও এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি জায়গায়। এয়ার কণ্ডিশন করা প্লেন থেকে বেরিয়েই অসম্ভব গরম লাগল রানার। রোদের মধ্যে এইটুকু পথ হেঁটে যেতেই ঘাম দেখা দিল কপালে। পিছন পিছন এল পট্টবর্ধন।

মস্ত লাউঞ্জে গিয়ে বসল সবাই। মাল নামবে, কাস্টমস চেকিং হবে—বেশ অনেকক্ষণের ব্যাপার। ফাইভ ফিফটি-ফাইভের টিন থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে নিল রানা। বেশিরভাগ প্যাসেঞ্জারই একবার জেন্টস লেখা ঘর থেকে ঘুরে এল। রানা গেল না। এবং রানাকে চোখের আড়াল করবে না বলে পট্টবর্ধনও বসে রইল পায়ের ওপর পা তুলে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল রানা।

বেশ খানিকক্ষণ পর ডাক এল প্যাসেঞ্জারদের কাস্টমস চেকিং রুমে যাবার জন্য। সবাই যে যার ছাতা, লাঠি আর ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়ল ছত্রভঙ্গ হয়ে। এবার রানা গিয়ে ঢুকল টয়লেটে। পরমুহূর্তেই এসে ঢুকল পট্টবর্ধন। বেচারা অনেকক্ষণ ধরে বোধহয় চেপে রেখেছিল। ভাবল, এই সুযোগে দুটো কাজই সেরে নিই। নজর রাখাও হবে, আর… ঢুকেই দেখল রানা দাঁড়িয়ে গেছে জায়গা মত। আর জায়গা নেই দাঁড়াবার। কিন্তু ল্যাট্রিনের দরজাটা খোলা। প্রস্রাব পায়খানার আলাদা বন্দোবস্ত। আর চাপতে না পেরে ঢুকে পড়ল সে একটা ল্যাট্রিনের মধ্যে।

এক মুহূর্ত দেরী না করে বাইরে থেকে বন্টু লাগিয়ে দিল রানা ল্যাট্রিনের। তারপর বেরিয়ে এল বাইরে। দেখল লাউঞ্জ খালি। বাইরের দরজাটাও বন্টু লাগিয়ে দিয়ে ভাবল জমাদার ব্যাটা তাড়াতাড়ি এসে না পড়লেই এ যাত্রা রক্ষা পাওয়া যায়। দুম দুম করে ল্যাট্রিনের দরজায় বাড়ি মারার শব্দ শুনল রানা কান পেতে! নাহ্। কেউ খেয়াল করবে না। ‘কাস্টমস’ লেখা দরজা দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঢুকল রানা এবার।

‘মি. চরোসা থিরা?’ কাস্টমস অফিসার চাইল রানার দিকে।

‘ইয়েস!’

রানার সুটকেসের ওপর লাগানো একটা লেবেল, ওর নামের নীচে ‘ম্যানেজিং ডিরেক্টর’ ও তার নীচে ‘আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল’ ইত্যাদি শব্দগুলো চোখে পড়ল অফিসারের। ব্যস, আর ঝামেলা হলো না। দুটো স্ট্যাম্প ছিঁড়ে সুটকেস এবং অ্যাটাচি কেসে লাগিয়ে দিল অফিসার। সাদা চক দিয়ে ক্রস এঁকে দিল দুটো।

‘উইশ ইয়ু হ্যাপি স্টে, স্যর।’

‘থ্যাঙ্ক ইয়ু।’

একটা পোর্টার তুলে নিল রানার সুটকেস মোটা বখশিশের লোভে। বিদেশি লোক, বেশি দেবে নিশ্চয়ই।

‘ট্যাক্সি, স্যর?’

মাথায় পাগড়ি আর হাতে বালা পরা লম্বা চওড়া শিখ ট্যাক্সি ড্রাইভার এসে দাঁড়াল যমদূতের মত। পোর্টারকে ড্রাইভারের সঙ্গে এগোবার জন্যে ইশারা করে রানা বলল, ‘কিপ দ্যাট অন দ্য ব্যাক সিট।’

পকেট থেকে দুটো একশো ডলারের নোট বের করে ভাঙিয়ে ইণ্ডিয়ান কারেন্সি নিল রানা দমদম এয়ারপোর্টের ব্যাঙ্ক থেকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়েই ভূত দেখার মত চমকে উঠল।

মিত্রা! ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনসের বিশেষ ড্রেস পরে একটা কাউন্টারের ওপাশে বসে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে মিত্রা সেন। মিত্রা কি ছেড়ে দিল সিক্রেট সার্ভিস? হঠাৎ এই বেশ কেন? ওর ওপর নজর রাখবার জন্যে এই ভোল নেয়নি তো!

নিজের অজান্তেই মুখটা অল্প একটু হাঁ হয়ে গেছে মিত্রার। খুব চেনা চেনা লাগছে ওর এই লোকটাকে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না কোথায় দেখেছে এর আগে। এই ফিগার, ঠিক এমনি ব্যাক ব্রাশ করা চুল, প্রশস্ত কপাল, ওই দৃষ্টি যেন তার অনেক চেনা। মাসুদ রানা! এ নিশ্চয়ই মাসুদ রানা!

এক মুহূর্তেই সামলে নিয়েছে রানা। না চিনবার ভান করে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল সে, কাটা ঘুরিয়ে রিস্ট-ওয়াচটা ইণ্ডিয়ান স্ট্যাণ্ডার্ড টাইমের সঙ্গে মিলিয়ে নিল। তারপর এগিয়ে গেল গাড়ি-বারান্দার দিকে। হাঁটার ভঙ্গিটা একটু বদলে নিল সে। পেছনে ফিরে চাইল না আর একটিবারও।

কিন্তু চাইলে দেখতে পেত এক অবর্ণনীয় খুশিতে ঝলমল করে উঠল মিত্রা সেনের মুখ। চিনতে পেরেছে সে। ওই দৃষ্টি ভুলবার নয়। তা হলে বেঁচে আছে! চোখ বন্ধ করে দুই হাত তুলে কপালে ঠেকাল সে তার অদৃষ্ট দেবতার উদ্দেশে। দুই ফোঁটা জল ঝরে পড়ল তিন তারিখের একটা পূর্ব-পাকিস্তানী খবরের কাগজের ওপর।

চিড়িয়ামোড়, গানফাউণ্ডি রোড, কাশীপুর রোড, ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড, শ্যামবাজার, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে এঁকে বেঁকে এসে শিখ ড্রাইভার থামল চৌরঙ্গীর এ্যাণ্ড হোটেলের সামনে। পিছনের সিটে বসে এতক্ষণে গোলাপের কুঁড়িটা পকেটে পুরেছে রানা, উল্টে পরেছে কোট, প্লেনের সব রকমের ট্যাগ ছিঁড়ে ফেলেছে সুটকেস আর অ্যাটাচি কেস থেকে, টান দিয়ে চরোসা থিরার লেবেল উঠিয়ে ফেলেছে বাক্সের ডালা থেকে। অন্য মানুষ হয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।

সুন্দরী রিসিপশনিস্টের প্রচুর প্লিজ এবং থ্যাঙ্ক ইউ-র পর লিফটে করে উঠে এল রানা তেতলার একটা চমৎকার ডাবল-বেড রুমে। খ্রিষ্টান নাম নিয়েছে ও এবার। মরিস রেমণ্ড। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। এয়ারকুলারটা অন করে দিয়ে ফাইভ-ফিফটি-ফাইভ টিনের ভিতর থেকে একটা ক্যাপস্টান বের করে ধরিয়ে নিল মাসুদ রানা। পোর্টারকে বখশিশ দিয়ে বিদায় করে দরজা লাগিয়ে একটা চেয়ারে এসে বসল। অতি দ্রুত চিন্তা করছে সে।

পট্টবর্ধন এতক্ষণে নিশ্চয়ই ছাড়া পেয়েছে। ধরা পড়ে গেছে রানা। তার থাই পাসপোর্টের আর কানাকড়ি মূল্যও নেই এখন। ও এখন একটা পাকিস্তানী স্পাই ছাড়া কিছুই নয়। এখানে যদি ধরা পড়ে তা হলে কোনও সাহায্য পাবে না ও স্বদেশ থেকে। সোজা অস্বীকার করবে পাকিস্তান ওর পরিচয়। জামার একটা বোতামে হাত বুলাল মাসুদ রানা। এই অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য পটাশিয়াম সায়ানাইড লুকোনো আছে বোতামটায়। সে তো অনেক পরের কথা। এখন কী করা যায়?

নিশ্চয়ই প্রত্যেকটি হোটেলে খোঁজ নেয়া হবে চরোসা থিরা বলে কেউ উঠেছে কি না। না পেলে সারা কলকাতার প্রত্যেকটি হোটেলে আজকে যত লোক উঠেছে তাদের সবাইকে পরীক্ষা করে দেখবে ওরা। রানার চেহারার বর্ণনা দেয়া হবে প্রত্যেকটি হোটেলে, থানায় এবং ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ-এ। রানার ফটোগ্রাফ পাঠানো হবে সব জায়গায়। শহরটা তছনছ করে খুজবে ওরা মাসুদ রানাকে। অবশ্য লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একটা মানুষকে খুঁজে বের করা অত সহজও নয়। কথাটা ভেবে একটু আশ্বস্ত বোধ করল ও।

কিন্তু ধরা পড়ল কী করে? কোনখানটায় ভুল করল সে? থাই ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ এখন ওর দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত দাগ মুছে ফেলল রানা কেমিক্যালস দিয়ে। চরোসা থিরার পাসপোর্ট, ভিজিটিং কার্ড, প্লেনের টিকেট, ইত্যাদি সবরকম চিহ্ন এক সঙ্গে জমা করে বাথরুমে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলল। এখন আর কোনও আবরণ থাকল না, নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে টিকে থাকতে হবে। ধরা পড়লে হয় বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণত্যাগ করবে, না হয় বোতাম তো আছেই। হঠাৎ মনে হলো, মিত্রা? এই অবস্থায় মিত্রা কোনও সাহায্য করবে?

‘ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনস? গুড আফটারনুন, ম্যাডাম। পুট মি টু এনকোয়ারি কাউন্টার, প্লিজ!’

‘জাস্ট হোল্ড আ মোমেন্ট, স্যর। এনকোয়ারি এনগেইজড।’

দশ সেকেণ্ড অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকল রানা রিসিভার কানে ধরে। তারপর খটাং করে ও-ধারের রিসিভার তুলল মিত্রা সেন। গড়গড় করে আউড়ে গেল গৎ।

‘ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনস, এয়ারপোর্ট এনকোয়্যারী। গুড আফটারনুন।’

‘চিনতে পারছ, মিত্রা?’

‘ধক করে উঠল মিত্রার বুকের ভিতরটা। সেই গলা! সত্যিই ও বেঁচে আছে! ভুল হয়নি তার।’

‘হ্যাঁ, পারছি।’

‘কেমন আছ?’

‘ভাল।’

‘আমার ঠিকানাটা বলব?’

‘না। এটা ওপেন লাইন।’

‘কোথায় দেখা হবে?’

‘পাঁচটায়। চিড়িয়াখানার সামনে।’

‘কেবল তুমি থাকবে, না আশপাশে তোমার বন্ধু-বান্ধবকেও আশা করব?’

‘অবিশ্বাস কোরো না।’

‘কারণ?’

‘পরে বলব। অনেক কথা আছে, সব বলব। রাখলাম।’ ছেড়ে দিল মিত্রা।

নীরব রিসিভারটা কান থেকে সরিয়ে একবার দেখল রানা, তারপর নামিয়ে রেখে সোজা ঘরে ফিরে গিয়ে লাঞ্চ অর্ডার দিল। মাটনটা বাদ রাখল অর্ডার থেকে সযত্নে। মাটন বলতে এরা বোঝে পাঁঠার মাংস—আর ওই গন্ধটা একদম বরদাস্ত করতে পারে না ও।

আবার চিন্তার ঘোড়দৌড় চলল রানার মাথার মধ্যে! কতক্ষণ? আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে ও? চব্বিশ ঘণ্টা? এর মধ্যেই হোটেল পরিবর্তন করতে হবে। প্ল্যান করে ফেলল ও কিভাবে এগোবে। কিভাবে ভুল নিশানা দিয়ে ওদের চোখে ধুলো দেবে। অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো রানা।

স্নান সেরে খেয়ে নিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল রানা দরজা বন্ধ করে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই পিস্তলটা পরীক্ষা করে নিল একবার। তারপর বালিশের পাশে পিস্তলটা রেখে ওটার বাটের ওপর ডান হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

রানা যখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে অনেকগুলো সরকারী ডিপার্টমেন্টে ইমার্জেন্সি অর্ডার এল। টেলিফোনের পর টেলিফোন চলতে থাকল সারা কলকাতা জুড়ে। মৌমাছির চাকে যেন ঢিল পড়েছে। অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠল এক শ্রেণীর কর্মচারী। ওয়ায়ারলেসে ইনফরমেশন গেল টিটাগড়। মাইক্রোবাস থেকে মোড়ে মোড়ে নামিয়ে দেয়া হলো এক এক জোড়া সন্ধানী চোখ—হাতে বি-টু সাইজের একটা করে ফটো।

ঠিক সাড়ে চারটায় পাক্কা বিলিতি পরিচ্ছদ পরে বেরিয়ে এল রানা ঘর থেকে। চেহারাটা সামান্য পরিবর্তন করে নিয়েছে সে। হাতে দামি সানগ্লাস।

লিফটের দিকে না গিয়ে করিডোর ধরে এগোল রানা সিঁড়ি ঘরের দিকে। বামপাশে মোড় ঘুরে দেখল একটা মেয়ে ঘরে তালা দিয়ে রওনা হলো সিঁড়ির দিকে। প্রথমেই রানার মনে হলো ক্যাথি এখানে কেন। পরমুহূর্তে বুঝতে পারল এ ক্যাথি নয়, তার বোন স্যালি ডেভন। ক্যাথির চাইতে দেখতে অবশ্য এ অনেক ভাল, তবে দু’বোনে মিল আছে চেহারায়। চিঠিটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। পকেট হাতড়ে পেয়ে গেল। ওটা বের করে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ও মেয়েটির দিকে।

‘আপনি বোধহয় মিস স্যালি ডেভন! তাই না?’

রানার দিকে চেয়েই অসম্ভব চমকে উঠল মেয়েটি। বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি স্যালি। আর আপনি?’

‘আমার নাম মরিস রেমণ্ড। সম্প্রতি ব্যাঙ্কক থেকে এসেছি। আপনার জন্যে চিঠি আছে।’ স্যালির চোখের দৃষ্টিটা একটু অদ্ভুত লাগল রানার।

‘কে দিয়েছে?’

‘আপনার বোন, ক্যাথি।

চিঠিটা প্রায় খাবলা দিয়ে কেড়ে নিল স্যালি রানার হাত থেকে। খাম ছিঁড়ে ওখানে দাঁড়িয়েই পড়তে আরম্ভ করল। থাই ভাষায় লেখা চিঠি। কিছুটা পড়ে রানার মুখের দিকে চাইল একবার। রানা চলে যাচ্ছিল পাশ কাটিয়ে। স্যালি ডাকল, ‘শুনুন।’

‘কিছু বলছেন?’

‘একটু অপেক্ষা করুন দয়া করে।’

আধাআধি পড়েই চিঠিটা ভাঁজ করে বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না, আমার ঘরে চলুন।’

ঘরে এসে বসল ওরা দুজন। চিঠি শেষ করে গভীর চিন্তামগ্ন মুখে চুপচাপ বসে থাকল স্যালি ডেভন। কপালে ভ্রুকুটি। হঠাৎ আনমনে বলল, ‘আমি একা এখন চেষ্টা করলে কী হবে? ভুল যা হবার তা তো হয়েই গেছে।’

‘কোনও দুঃসংবাদ?’ রানা জিজ্ঞেস করল।

‘না, দুঃসংবাদ আপনার জন্য। আপনার সামনে এখন ভয়ানক বিপদ, মি. মাসুদ রানা। হন্যে হয়ে খুঁজছে ওরা আপনাকে।’

‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘এই চিঠি পড়ে। আমার বোন আপনার সর্বনাশ করেছে, মি. রানা। টাকার বিনিময়ে ব্যাঙ্ককের ইণ্ডিয়ান সিক্রেট এজেন্টের কাছে আপনার আসল পরিচয় বিক্রি করেছে। কিন্তু সেই সন্ধাতেই আপনি আমাদের টাকার প্রয়োজন মিটিয়ে দিলেন চিরকালের মত। তার আগেই ও ভুল করে বসে আছে। আমাকে লিখছে আপনাকে সাহায্য করতে। কিন্তু আমি এখন একা কী করব…’

রানার মাথার মধ্যে আগুন ধরে গেল। ক্যাথি। ক্যাথি বিশ্বাসঘাতকতা করল? এই জন্যে ব্যাঙ্কক থেকে লোক লেগে গেছে ওর পিছনে। কেউ যেন রানার বুকে আমূল বসিয়ে দিয়েছে একটা ছুরি। ছাড়া যাবে না ওই পিশাচিনীকে। আরও কত লোকের সর্বনাশ করবে কে জানে! স্যালির শেষের কথাগুলো রানার কানের ভিতর ঢুকল না। উঠে দাঁড়াল সে। চট করে রানার হাত ধরল স্যালি।

‘আমার বোনকে ক্ষমা করতে হবে, মি. রানা। আপনার হাত ধরে ক্ষমা চাইছি আমি আমার বোনের হয়ে। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ও—আর কারও ক্ষতি করতে পারবে না কখনও। আত্মগ্লানিতে মরছে এখন। টাকার আমাদের কত প্রয়োজন ছিল আপনি বুঝতে পারবেন না, মি. রানা। কত যে কষ্ট করেছি আমরা…’ গলাটা ভেঙে এল। গাল বেয়ে জল নেমে এল দু’ফোঁটা। বিকৃত হয়ে গেল মুখটা কান্নায়।

টাকার প্রয়োজন, মনুষ্যত্ব, ন্যায়-নীতির মূল্যবোধ, আর মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার অধিকার, সব মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে গেল রানার মনের মধ্যে। ভদ্রভাবে হাতটা ছাড়িয়ে নিল স্যালির হাত থেকে। ভাবল কাউকে বিচার করবার অধিকার তার নেই। মানুষের হাজারো সমস্যার কতটুকুই বা ও জানে! বিচার করবে বিচারক। ও কেবল দেখে যাবে। চোখের জলে নিভে গেল ক্রোধের আগুন।

‘আপনি আমাকে দেখেই চমকে উঠেছিলেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আপনার ছবি দেখেছি আমি আমার এক বন্ধুর কাছে। এই মুহূর্তে সারা কলকাতাময় হাজারটা চোখ আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হোটেলে আজ রাতটা আপনি নিরাপদ। ভোর ছটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত যে মেয়েটি কাউন্টারে থাকে সে ছাড়া আর কেউ আপনার খবর দিতে পারবে না ওদের। তার মধ্যেই আমি ভেবে দেখি কোনও ব্যবস্থা করা যায় কি না।’

‘ধন্যবাদ। তার দরকার হবে না।’

বেরিয়ে এল রানা ওর ঘর থেকে। স্যালিও বেরোল পিছু পিছু। আঙুল দিয়ে স্যালিকে লিফটের দিকে যাবার নির্দেশ দিয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে চলে গেল রানা।

দেরী হয়ে গেছে। সানগ্লাসটা পরে নিয়ে হাতের ইশারায় একটা ট্যাক্সি ডাকল রানা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে।

‘আলীপুর। চিড়িয়াখানা।’

পিছনের সিটে বসে রানা ভাবছে, এইবার বোঝা গেল কী করে ওরা টের পেল তার সত্যিকার পরিচয়! এতক্ষণ কিছুতেই জটিল গ্রন্থিটা খুলতে পারছিল না ও। চারদিক থেকে আটঘাট বেঁধে নেমেছিল ও। হঠাৎ সব যেন ওলটপালট হয়ে গেল। খেলা মাত্র শুরু হয়েছে পন কে ফোর, পন কে ফোর, কিংস নাইট বিশপ থ্রি, কুইন্স নাইট বিশপ থ্রি, বিশপ নাইট ফাইভ, পন কুইন্স থ্রি—ব্যস, আড়াই বছরের বাচ্চা মেয়েটা এসে উল্টে দিল যেন দাবার বোর্ড।

ঠিক সোয়া পাঁচটায় পৌঁছল রানা চিড়িয়াখানার গেটের সামনে। মিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। দুটো টিকেট কেটে রেখেছিল সে। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিল রানা।

‘দেরী হয়ে গেল একটু, রানা লজ্জিত হলো।

‘দেরী কোথায়? পাকিস্তান স্ট্যাণ্ডার্ড টাইম অনুসারে পনেরো মিনিট আগেই পৌঁছেছ বরং। আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতাম, লোকে যে যাই ভাবুক না কেন।’

অনেক হাঁটল দুজন। হরেক রকম রঙ-বেরঙের পাখি, বানর, বাঘ-ভালুক সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, হিপোপটেমাস, গণ্ডার সব দেখে বসল গিয়ে ওরা নির্জন লেকের পারে পাথরের আসনে। লেকের ভিতর দ্বীপের মত জায়গাটায় লাল এবং কালো ঠোঁটের রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে অল্প জলে, আর থেকে থেকে শামুক তুলছে ডুব দিয়ে দিয়ে। এতক্ষণ দরকারী একটা কথাও হয়নি ওদের মধ্যে।

রানার বাঁ হাতটা তুলে নিয়ে কোলের ওপর রাখল মিত্রা।

‘অনেক কথা বলবে বলেছিলে, কই, একটা কথাও তো বলছ না?’ রানা জিজ্ঞেস করল।

‘কথাগুলো গুছিয়ে নিতে পারছি না।’

‘তুমি এয়ারলাইন্সে ঢুকলে কবে? আর ঢুকলেই যদি, এয়ার হোস্টেস হলে কেন?’

‘এয়ার হোস্টেস? গ্ল্যামারের লোভে সবকিছু বিকোনো আমার দ্বারা সম্ভব নয়। মামাকে ধরে জয়দ্রথের মুঠি থেকে বেরিয়েছি। নাচের স্কুলে মাস্টারি করতে পারতাম—আগেও ভরতনাট্যম আর কথক শেখাতাম আমি—কিন্তু এখন আমার পক্ষে নাচা উচিত হবে না বলে এই চাকরিটাই নিলাম।’

‘নাচা উচিত নয় কেন?’

‘সেই কথা বলতেই তোমাকে ডেকেছি, রানা। আমি প্রেগনেন্ট।’ মাথা নিচু করল মিত্রা।

‘বলো কী?’ বিস্মিত রানা মিত্রার মুখের দিকে চাইল।

‘হ্যাঁ। তোমার সন্তান।’

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। অদ্ভুত এক উত্তেজনা বোধ করল সে। বিচিত্র এক শিহরণ। মিত্রার দুই বাহু ধরল ও দুই হাতে।

‘সত্যি বলছ, মিত্রা! সত্যি বলছ?’

মৃদু হাসল মিত্রা।

‘খুশি হয়েছ?’

‘আমার কেমন লাগছে তা তোমাকে কিছুতেই বোঝাতে পারব না, মিত্রা। আমার সন্তান! চলো আজই বিয়ে করি আমরা। কিন্তু না, বিয়ে করা বোধহয় ঠিক হবে না। এক ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছি আমি। যে-কোনও মুহূর্তে মৃত্যু ঘটতে পারে আমার। তোমার তখন কী হবে! তুমি মহাচিন্তায় ফেললে দেখছি আমাকে!’

‘অত বিচলিত হচ্ছ কেন? বিয়ে তো আমাদের হয়েই গেছে। আর তোমার কপালেও যা হবার তা হবেই। ভবিতব্য। অদৃষ্ট তো নির্ধারিতই থাকে।’

‘এত কম সময়ের মধ্যে বুঝলে কী করে তুমি? মাত্র তো কদিন হলো!’

‘সব রকম লক্ষণ আরম্ভ হয়ে গেছে। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি আমি!’

অনেক জল্পনা-কল্পনা করল দুজন ভবিষ্যৎ নিয়ে। দুজন দুই দেশের, দুই জাতের মানুষ এক হয়ে গেল অদৃশ্য এক বন্ধনে। অন্য সময়ে কি কেউ কাউকে এত আপন ভাবতে পারত? অবাক হয়ে যায় রানা, মিত্রা দুজনেই।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। নিজের বিপজ্জনক অবস্থার কথা মিত্রাকে বলল রানা সব খুলে। বলল, আগামীকাল ভোরের ট্রেনে টিটাগড় যাচ্ছে ও। সব শুনল মিত্রা। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘যদি পারতাম, বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম তোমাকে। কিছুতেই যেতে দিতাম না টিটাগড়ে। ওই দেয়ালের ওপাশে আমি যাইনি কখনও, শুনেছি যে যায় সে আর ফেরে না কোনোদিন।‘

‘কী আছে ওখানে?’

‘জানি না! জয়দ্রথ মৈত্রের সবচাইতে বিশ্বস্ত এক-আধজন ছাড়া বাইরের আর কেউ জানে না। যারা জানে তাদের বাইরে আসতে দেয়া হয় না। আমরা সবাই জানতাম পূর্ব-পাকিস্তানের ওপর একটা চরম আঘাত হানবার জন্যে আমাদের ওই সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশন। কিন্তু কই, কিছুই তো হলো না, শেষ পর্যন্ত কোনমতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে বাঁচলাম আমরা। কী ছিল মৈত্র মশায়ের মনে, কতদূর সফল হলো সেই মিশন, তা তিনিই জানেন। আমি শুধু বলতে শুনেছি ওঁকে একবার-ওদিকের কাজ শেষ, এবার টিটাগড়ের প্রহরা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। অনেকগুলো অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটগানও ফিট করেছে ওরা এরিয়ার চারধারে।’ হঠাৎ থেমে বলল, ‘তুমি আমার যত আপনই হও না কেন, এসব কথা একজন পাকিস্তানী স্পাইকে বলতে আমার কী যে খারাপ লাগছে তা বোঝাতে পারব না। দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছি। অথচ তোমাকে না বললে বিপদে পড়বে তুমি।’

‘তোমাকে বাড়ি ফিরতে হবে ক’টার মধ্যে?’ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইল রানা।

‘আজ ফিরব না বলে দিয়েছি মামাকে। বলেছি বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি।’

‘কিন্তু আমার সঙ্গে যদি ধরা পড় তবে তো কঠিন শাস্তি হয়ে যাবে তোমার।’

‘হোক। শাস্তি হওয়াই তো দরকার আমার। মেরে তো আর ফেলতে পারবে না। সান্ত্বনা পাব-প্রায়শ্চিত্তও হলো, আর তোমাকে একা বিপদে ফেলে পালিয়েও গেলাম না!’

‘এসব কী আবোলতাবোল কথা বলছ তুমি?’

‘সে তুমি বুঝবে না। আমি যে একজন শত্রুপক্ষের স্পাইকে ভালবেসেছি! যে শপথ নিয়ে দেশের কাজে নেমেছিলাম, কোথায় গেল সে অগ্নি-শপথ? মাঝে মাঝেই ভাবছি, এ আমি অন্যায় করছি। নিজের স্বার্থে জয়দ্রথের বিরোধিতা করলাম, দেশের বিরোধিতা করলাম। এখন স্বামীর স্বার্থে, সন্তানের স্বার্থে আবার তাই করছি। সন্দেহ হচ্ছে, ভালবাসার মূল্যে কি জাতি-ধর্ম-দেশ-সমাজ সংসার সবকিছু বিকিয়ে দেয়া যায়, না উচিত? তা ছাড়া এটা ভালবাসা না একটা সাময়িক মোহ তা-ও তো বুঝতে পারিনি আজও। প্রেম যদি হবে, তো এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেন? অন্তর্দাহে জ্বলছি কেন অহরহ?’

‘এত ভাবলে তুমি ঠিক মরে যাবে, মিত্রা! তোমার দুর্বলতার কোনও সুযোগ নিতে আমি চাই না। তুমি বরং সরে যাও আমার পথ থেকে। যদি কখনও ইচ্ছে করে, এসো, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব। তুমি স্বেচ্ছায় এসেছিলে এগিয়ে, এখন যদি পিছিয়ে যাও তোমার দোষ দেব না আমি।’

‘তা জানি। চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই যেতে পারছি না পিছিয়ে। হু হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা।’

‘শোনো,মিত্রা। ব্যাপারটাকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে তো ইচ্ছে করলেই দেখতে পারো। তুমি তো আসলে তোমার দেশের কোনও ক্ষতি করছ না—প্রতিবেশী একটা দেশকে এক হীন চক্রান্ত থেকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করছ। আমরা তো তোমার দেশের কোনও ক্ষতি করতে যাচ্ছি না। তোমার দেশের কয়েকটা খারাপ লোক মিলে যদি শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশীকে অন্যায় ভাবে পর্যুদস্ত করতে চায়, তা হলে পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে সেটা বন্ধ করা তোমার কর্তব্য নয়? অন্যায় যা, তা অন্যায়ই। নিজের দেশ অন্যায় করলেও সেটা ন্যায় হয়ে যায় না। যাক, এসব কথা তোমার ভাল লাগবে না হয়তো। তবে ভেবে দেখতে চেষ্টা করো। হয়তো অন্তর্দাহ কমতে পারে।

ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়ল। আটটা বাজে। আজকের মত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চিড়িয়াখানা। বেরিয়ে এল ওরা।

ঠিক সোয়া আটটায় চিড়িয়াখানার গেটের পাশে একটা পাবলিক টেলিফোনে একটা বিশেষ নাম্বার ঘোরল রানা। খটাং করে তুলল কেউ রিসিভার, কিন্তু কথা বলল না। হিশ্‌শ্‌শ করে একটা একটানা শব্দ এল রানার কানে। আশপাশে কেউ নেই, তবু গলাটা যতদূর সম্ভব খাদে নামিয়ে রানা বলল, মাসুদ রানা ইন ডেঞ্জার। সীক্‌স্‌ প্রোটেকশন অ্যাণ্ড হেল্প।’ তাও কোনও উত্তর নেই। আবার বলল রানা, ‘আই রিপিট। মাসুদ রানা ইন ডেঞ্জার। সীক্‌স্‌ প্রোটেকশন অ্যাণ্ড হেল্প।’

রেকর্ড হয়ে গেল রানার বক্তব্য। নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার। মিত্রাকে নিয়ে সোজা হোটেলে ফিরে এল রানা। দুজনের কেউ লক্ষ্য করল না, ওরা লিফটে উঠতেই একজন লোক দ্রুতপায়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল।

ঘরে বসেই ওরা খেয়ে নিল সাত কোর্সের ইংলিশ ডিনার। স্যালির সঙ্গে কয়েকটা দরকারী কথা বলবার প্রয়োজন বোধ করল রানা। কিন্তু সে তো এখন নাচ-ঘরে চলে গেছে। ওখানেই দেখা করতে হবে ওর সঙ্গে। মিত্রা সেন ওসব নাচ দেখবে না বলে দিল পরিষ্কার। ওকে ঘরেই বসিয়ে ডান্সিং ফ্লোরের দিকে এগোল রানা। নাচের প্রথম সেশন আরম্ভ হচ্ছে তখন। টিকেট করে ঢুকে পড়ল ও ভিতরে। অনেক লোক জড়ো হয়েছে। দরজার কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসল রানা। বয় এসে দাঁড়াল পাশে। উইস্কি এবং সোডার অর্ডার দিয়ে চারধারে একবার চোখ বুলাল সে।

বারো শ’ বর্গফুট মত হবে চারকোণা ঘরটা। গোটা তিরিশেক টেবিল এলোমেলো ভাবে সাজানো। অনেক স্ত্রী-পুরুষ এসেছে জোড়ায় জোড়ায়। ছেলে-বুড়ো সব রকম মুখই দেখা যাচ্ছে। বিকৃত রুচির সমাবেশ। সবার সামনেই গ্লাস। গরম হয়ে নিচ্ছে সবাই নাচ আরম্ভ হবার আগে। একটা মুখও চিনতে পারল না দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। ভাবল মহানগরী কলকাতায় একজন লোককে খুঁজে বের করা কী এতই সোজা। স্যালির সাথে আরেকবার দেখা না করে টিটাগড়ের পথে রওনা হতে পারছে না রানা। নাচের বিরতিতে নিশ্চয়ই দেখা হবে।

একজন উঠে বঁড়াল ডান্সিং ফ্লোরের ওপর। একটা স্পট লাইট পড়ল তার মুখের ওপর-বাকি ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল।

‘আজকের অনুষ্ঠানই কলকাতায় মিস স্যালির শেষ অনুষ্ঠান। আপনারা যাঁরা আজ শেষবারের মত তাঁর নাচ দেখতে পাচ্ছেন তাঁদের ভাগ্যবানই বলব। আজ আবহ-সঙ্গীতে আছেন জোসেফ ফার্নান্দিজ।’

আরেকটা স্পট লাইট পড়ল ভায়োলিন, চেলো, ট্রাম্পেট, মারাক্কাস এবং ড্রাম বাদকের ছোট্ট একটি দলের ওপর। স্টেজের ডান পাশে গোল হয়ে বসেছে তারা বিচিত্র রঙচঙে কাপড় পরে। বৃদ্ধ গোয়ানিজ মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করল। ‘ডুম’ করে ড্রামের ওপর টোকা পড়ল একটা। মোলায়েম বাজনা এল কানে।

‘এবার শুরু হচ্ছে নাচ। মিস স্যালি ডেভন ফ্রম ব্যাঙ্কক।’

ঘোষকের মুখের ওপর যে স্পট লাইটটা ছিল সেটা নিভে গেল। স্টেজের মাঝখানে এবার স্পট লাইট পড়ল। কিছুই নেই সেখানে। আলোটা ধীরে ধীরে বেগুনী হয়ে গেল। যেন মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এল স্যালি ডেভন স্টেজের ওপর। ট্র্যাপ ডোরটা বন্ধ হয়ে গেল।

কালো নায়লনের নেটে ঢাকা স্যালির দেহ। পরিষ্কার দেখা গেল ভেলভেটের একটা ছোট্ট জাঙ্গিয়া এবং ব্রেসিয়ার ছাড়া কিছুই নেই স্যালির ফর্সা শরীরে। বাজনার তালে তালে সাপের মত দুলছে ওর দেহের ওপরের অংশ। উসখুস করে সোজা হয়ে বসল দর্শকবৃন্দ। রানা বড় একটা চুমুক দিল গ্লাসে।

নায়লনের নেটটা ছেড়ে দিল স্যালি গলার কাছে একটা বোতাম খুলে। এবার তালে তালে ফর্সা পেটটা ওঠা-নামা করতে থাকল, সেই সঙ্গে কোমর দুলছে অল্প অল্প। রানার মনে পড়ল টোকিয়োর হোটেলে স্ট্রিপটিজের কথা। একবার ভাবল এই নোংরামি দেখতে না ঢুকলেই পারত।

লয় বাড়ছে ধীরে ধীরে। ট্রাম্পেটের লম্বা টান রক্তের মধ্যে নেশা ধরিয়ে দিতে চায়। নাকটা একটু ফুলে গেছে স্যালির। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে একটু। পাঁচ মিনিট পর হঠাৎ একটানে বক্ষবন্ধনী খুলে দর্শকদের দিকে ছুঁড়ে দিল স্যালি। হৈ-হৈ করে উঠল দর্শকবৃন্দ। অশ্লীল একটা মন্তব্য করল কেউ অন্ধকার থেকে।

রানা বুঝল আর থাকা যাবে না। একটু পরেই খোলো খোলো, সব খুলে ফেলো। টেক ইট আউট, বেইবে—বলে চিৎকার আরম্ভ করবে উত্তেজিত দর্শকবৃন্দ। ধাপে ধাপে নামিয়ে নিয়ে যাবে স্যালি এদের নরকের দরজায়। ছিক ছিকছিক মারাক্কাসের শব্দে কান গরম হয়ে উঠেছে সবার। আশপাশের টেবিলে উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে সবাই। ক্লেদাক্ত নারকীয় পরিবেশ।

দ্রুততর হচ্ছে ড্রামের ছন্দ। এক্ষুণি তাণ্ডবলীলা আরম্ভ হয়ে যাবে এই ঘরের মধ্যে। মেঝেতে একটা বোতল আছড়ে ভাঙার শব্দ পাওয়া গেল। উঠি উঠি করেও উঠতে পারছিল না রানা। এবার এক ঢোকে গ্লাসটা খালি করে উঠে পড়বে ভাবল। ঠিক এমনি সময়ে একটা বজ্র কঠিন হাতের থাবা এসে পড়ল ওর কাঁধের উপর। চমকে উঠল রানা। এক মুহূর্তে বাস্তব জগতে ফিরে এল সে।

কানের কাছে মৃদুস্বরে বলল কেউ, ‘দিস ইজ নো এনিমি, ব্রাদার। দিস ইজ আ ফ্রেণ্ড।’