সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
কর্নেল সমগ্র
খোকন গেছে মাছ ধরতে
সেদিন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আমাকে দেখেই বলে উঠলেন–জয়ন্ত কখনওকি ছিপে মাছ ধরেছ?
সবে ওঁর ইলিয়ট রোডের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িংরুমের ভেতর পা বাড়িয়েছি, বেমক্কা এই প্রশ্ন। অবশ্য ওঁর নানারকম অদ্ভুত-অদ্ভুত বাতিক আছে জানি, কিন্তু ওঁর মতো ছটফটে মানুষ ছিপ হাতে ফাতনার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে বসে থাকবেন–এটা বিশ্বাস করা কঠিন। যাই হোক্ ধীরে সুস্থে বসার পর বললুম–আজ কি তাহলে কোথাও ছিপ ফেলার আয়োজন করেছেন কর্নেল?
কর্নেল হাসতে হাসতে ছড়া বলে উঠলেন :
খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে,
ছিপ নিয়ে গেছে কোলাব্যাং
মাছ নিয়ে গেছে চিলে।…
অবাক হয়ে বললুম–আপনি এ ছড়া কোথায় শিখলেন? আপনি তো বাংলা পাঠশালায় পড়েননি।
কর্নেল এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বললেন–ছড়াটা কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট! অপূর্ব! ভাবা যায় না! বেচারা খোকন বড় সাধে মাছ ধরতে বসেছে। এদিকে কি না দুষ্ট কোলাব্যাংটা তার ছিপখানাই নিয়ে পালাল? ওদিকে কোত্থেকে এক ব্যাটা চিল এসে…ভাবা যায় না! ভাবা যায় না!
কর্নেল ছড়ায় বর্ণিত দৃশ্য যেন চোখ বুজে দেখতে দেখতে খুব মুগ্ধ হয়ে তারিফ করতে থাকলেন এবং সেই সঙ্গে ওঁর প্রাণখোলা হাসি। ওঁর পরিচারক ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে থ।
কর্নেলের মধ্যে খোকাটেভাব আছে, বরাবর দেখেছি। কিন্তু আজ সকালে আমাকে জরুরি তলব দিয়ে ডেকে এনে নিতান্ত মাছ ধরার প্রোগ্রাম শোনাবেন ভাবিনি। আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার এবং কর্নেল এক ধুরন্ধর প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার-সোজা কথায় গোয়েন্দাও। আশা ছিল, গুরুতর একটা ক্রাইম স্টোরি পেয়ে যাব। দৈনিক সত্যসেবকের আগামীদিনের প্রথম পাতাটা পাঠকদের মাত করে ফেলবে! কিন্তু এ যে দেখছি, নিতান্ত মাছধরার বদখেয়াল নিয়ে উনি বসে আছেন! আমার মতো ব্যস্ত রিপোর্টারের একটা দিনের দাম খুব চড়া। আমি হতাশ হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলুম।
হঠাৎ কর্নেল কোণের দিকে ঘুরে বললেন–মিঃ রায়, আলাপ করিয়ে দিই। এই আমার সেই প্রিয়তম তরুণ বন্ধু জয়ন্তার কথা আপনাকে বলছিলুম।
এতক্ষণ কোণের দিকে তাকাইনি। এবার দেখি, খবরের কাগজের আড়ালে এক সুদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক উজ্জ্বল ফর্সা রঙ, পরনে নেভিরু আঁটো পাতলুন এবং গায়ে টকটকে লাল স্পোর্টিং গেঞ্জি, ঠোঁটে আটকানো পাইপ, মুখ বের করলেন। ভদ্রলোকের কাঁচাপাকা গোঁফে কর্নেলের মতো একটা সামরিক জীবনের গন্ধ মেলে। উনি কাগজ ভাঁজ করে রেখে তখুনি আমাকে নমস্কার করলেন। আমিও।
কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, উনি মেজর ইন্দ্রনাথ রায়। আমার সামরিক জীবনের বিশেষ স্নেহভাজন বন্ধু। সম্প্রতি রিটায়ার করছেন। এঁর জীবন খুব রোমাঞ্চকর, জয়ন্ত। সিক্সটি-টুতে চীনারা নেফাবর্ডারে এঁকে ধরে নিয়ে যায়। জঘন্য অত্যাচার করে। তারপর…
ইন্দ্রনাথ হাত তুলে হাসতে হাসতে বললেন–এনা কর্নেল! আমি আপনার মতো যোদ্ধা ছিলুম নাসুযোগও পাইনি। তাই অত কিছু বলারও নেই।
কর্নেল আপত্তি গ্রাহ্য না করে বললেন–তাছাড়াও এঁর একটা অভিজাত সামাজিক পরিচয় আছে, জয়ন্ত। ইনি মহিমানগরের প্রখ্যাত রাজপরিবারের সন্তান। মধ্যপ্রদেশের নানা জায়গায় এঁদের অনেকগুলো খনি ছিল। একটা বাদে সবই এখন রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে।
ইন্দ্রনাথ বললেন– ও একটা ডেড মাইন বলতে পারেন অবশ্য। ছেড়ে দিয়েছি আমরা।
কর্নেল প্রশ্ন করলেন–কিসের খনি যেন?
–সীসের। সাত বছর আগে ওটা পোড়া হয়ে গেছে। আর কিছু মেলেনি।
–খনিমুখগুলো তাহলে নিশ্চয় সিল করে দিয়েছেন?
না কর্নেল। সিল করার সুযোগ পাইনি। মানে….একটু ইতস্তত করে ইন্দ্রনাথ মৃদু হেসে ফের বললেন–আমার অবশ্য কোনওরকম কুসংস্কার নেই। আপনি তা ভালই জানেন। কিন্তু আমার কাকা জগদীপ রায় হঠাৎ রহস্যজনকভাবে মারা পড়েন–ওঁর ডেড বডি খনির একটা সুড়ঙ্গে পড়ে ছিল–তারপর কাকিমা জেদ ধরলেন, খনিমুখ যেমন আছে তেমনি পড়ে থাক–তোমরা কেউ ওখানে যাবে না। কারণ কাকা নাকি খনিমুখগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায়, তা ঠিক করতেই গিয়েছিলেন ওখানে। আর, আপনি তো জানেন, কাকিমাই আমাদের ফ্যামিলির একমাত্র গার্জেন– কাকার অবর্তমানে। আমাদের ছেলেবেলা থেকে উনিই মানুষ করেছেন। ওঁর কথা আমাদের দু-ভাইয়ের কাছে ঈশ্বরের আদেশ। তাই আমরা আর ওদিকে মাড়াইনি।
কর্নেল বললেন–আপনার কাকিমার কী ধারণা হয়েছিল বলতে পারেন?
ইন্দ্রনাথকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললেন–একটু খুলে না বললে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন না। কাকা ছিলেন খেয়ালি মানুষ। মাছ ধরার বাতিক ছিল প্রচণ্ড। সীসের খনিটা রয়েছে তিনদিকে তিনটে পাহাড়ের মধ্যিখানে, একটি উপত্যকায়। খনির পেছনে আছে একটা হ্রদ। আসলে ওটা একটা নদীর বাঁকের মুখে, ন্যাচারাল ওয়াটার ড্যাম। পরে মুখটা চড়া পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হ্রদটা খুব গম্ভীর হওয়ার জন্য জল কখনও মরে না। আমরা খনিটা ছেড়ে আসার পর নদীতে একবার প্রচণ্ড বন্যা হয়। তখন হ্রদেও জল ঢুকে পড়ে এবং সেই জল খনির মধ্যেও ঢুকে যায়। কিছু কিছু খনিমুখ এর ফলেই আপনা-আপনি ধস নেমে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল তিনটে খনিমুখ, একটু উঁচু জায়গায়। কাকা প্রতিবার অক্টোবরে ওখানে গিয়ে তার বাংলোয় কাটাতেন। বরাবরকার অভ্যাস। জায়গাটার সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, হ্রদে মাছ ধরার নেশা ছিল ওঁর। পাঁচবছর আগের অক্টোবরে কাকিমাকে নিয়ে উনি ওখানে যান। সেবারই খনিমুখ তিনটে বন্ধ করে আসার উদ্দেশ্য ছিল। সঙ্গে একজন ইঞ্জিনিয়ারও নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর কী হলো, ফোরটিনথ অক্টোবর সারা বিকেল মাছ ধরার পর ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে বলেন–আপনি বাংলোয় চলুন, আমি একটু পরে যাচ্ছি। তারপর অনেক রাত হলো, কিন্তু ফিরলেন না। তখন খোঁজাখুজি পড়ে গেল। হ্রদে স্থানীয় কয়েকজন আদিবাসী জেলে রাতে মাছ ধরতে এসেছিল। তাদের সঙ্গে দেখা হলে জানাল সায়েবকে তারা খোলা খনিমুখের কাছে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালাতে দেখেছে। রাত তখন একটা। জেলেদের কথা শুনে…
কর্নেল বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-জেলেরা তো লেকে ছিল। কীভাবে জানল, উনিই আপনার কাকা?
ইন্দ্রনাথ বললেন নির্জন জায়গা। তাছাড়া ওখানে ভূত আছে বলে স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস। সব পোডড়া খনি কেন্দ্র করেই ভুতুড়ে গালগল্প গড়ে ওঠে। এখানেও তাই হয়েছিল। যাইহোক, এই জেলে তিনজন ছিল খুব সাহসী। বয়সে যুবক। টর্চের আলো দেখে ওরা পরস্পর তর্ক জুড়ে দেয় যে ওটা ভূত কিংবা ভূত নয়। তাছাড়া হ্রদটায় প্রচুর মাছ–অথচ ভূতের ভয়ে গরীব জেলেরা মাছ ধরতে ভয় পায়–পাছে ভূতের অভিশাপ লাগে। কিন্তু এই তিনটি সাহসী তরুণ আদিবাসী সে রাতে জেদ করেই এসেছিল। হারাতেই এসে এবং মাছ ধরে ওরা প্রমাণ করে দেবে যে ওখানে ভূতপ্রেত কিংবা অভিশাপ ব্যাপারটা মিথ্যে।
কর্নেল বললেন-তারপর?
–ওরা আলো লক্ষ্য করে ওখানে যায়। দূর থেকেই চেঁচিয়ে বলে–কে ওখানে? তখন কাকার সাড়া পায়। কাকা ওদের সুপরিচিত। ফলে, ওরা কাছে না গিয়ে হ্রদে নিজের কাজে ফিরে যায়। যাই হোক, এই সূত্র ধরে সেই খনিমুখ তিনটের কাছে যাওয়া হলো। তারপর একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে কাকার লাশ পাওয়া গেল। কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই শ্বাসরোধ করেও মারা হয়নি। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে বলা হলো–হার্টফেল করে মারা পড়েছেন। অথচ কাকার স্বাস্থ্য ছিল খুবই ভাল।
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর কর্নেল বললেন–কিন্তু আপনার কাকিমা খনিমুখ বন্ধ করতে নিষেধ করেন বলছিলেন। কেন–সেটা স্পষ্ট বুঝলুম না মিঃ রায়!
ইন্দ্রনাথ আনমনে মাথা নেড়ে বললেন কাকিমাও স্পষ্ট কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন–ওগুলো যেমন আছে, তেমনি থাক। আমার ছোট ভাই সৌমেন্দু ডাক্তার। ও এখন জব্বলপুরে সরকারী হাসপাতালের চার্জে আছে। কোনও কুসংস্কার নেই। ও জেদ ধরেছিল কাকিমার কাছে। কিন্তু কাকিমা শুধু বলেছিলেন–খনিতে এক সাধু আছেন তিনি নাকি অদৃশ্যও হতে পারেন। সেই সাধু নির্জনে তপস্যা করার জন্য খনির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন কবে। জবরদখল–যাকে বলে! …কথাটা বলে ইন্দ্রনাথ হো হো করে হেসে উঠলেন।
আমরাও হাসলুম। কর্নেল বললেন–সাধুকে কেউ দেখেছে কখনও?
ইন্দ্রনাথ বললেন–না। আমার ধারণা, কাকিমার নিছক বিশ্বাস। তবে কেন এমন আজগুবি ধারণা হলো, তাও উনি বলেননি। বলবেনও না। খনিমুখ বন্ধ করলে সাধু নাকি রেগে যাবেন।
ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি নিয়ে এল। আমরা কিছুক্ষণ কফি খেলুম চুপচাপ। তারপর কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন–খুব ইন্টারেস্টিং!
ইন্দ্রনাথ বললেন–তবে কর্নেল, ওই ভূতুড়ে রহস্য ফাঁস করার জন্যে আমি নিশ্চয় আপনার কাছে আসিনি। আমি এসেছি, স্রেফ মাছ ধরার প্রস্তাব নিয়ে। অবশ্য, আপনারই কাছে প্রস্তাব আনার কারণ যদি জানতে চান, তাহলে বলবকাকার মৃত্যুর পর থেকে প্রতিবছরই এই সময় আমার চিরিমিরি এলাকার ওই হ্রদে যেতে ইচ্ছে করে–অন্তত স্রেফ ছিপে মাছ ধরার জন্যে। অথচ বুঝতেই পারছেন, ওই ট্র্যাজিক ঘটনার ফলে একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। দ্বিধা এসে সামনে দাঁড়ায়। একা যেতে শেষ অব্দি সাহস পাইনে। ওদিকে কাকিমা জানতে পারলেও বাধা দেবেন। তাই অবশেষে আপনাকে নিয়ে যাবার প্ল্যান মাথায় এসে গেল। আপনারও মাছ। ধরার হবি ছিল এক সময়–দেখেছি।
কর্নেল মাথা দুলিয়ে বললেন–ছিল! এখন সেটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মিঃ রায়। কিন্তু একটা কথা–আপনার কাকিমা আপনাকে বাধা দেবেন না?
ইন্দ্রনাথ বললেন–নিশ্চয় দেবেন। কিন্তু আমি এবার যেভাবে হোক, যাবই কর্নেল। জায়গাটা এত সুন্দর, এত নির্জন, ভাবা যায় না। আমার স্মৃতি আমাকে উত্যক্ত করে মারছে। কাকিমাকে গোপন করেই যাব।
কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন–জয়ন্ত! আশা করি, ইতিমধ্যে তুমি ঞ্চল হয়ে উঠেছ! মনশ্চক্ষে চিরিমিরি হ্রদের অপূর্ব সৌন্দর্য এবং রুপোলি মৎস্য অবলোকন করছ!
ইন্দ্রনাথ বললেন–তাহলে দুজন নয় কর্নেল, তিনজন মিলে যাব। জয়ম্বাবুকেও আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
কর্নেল হেসে বললেন রাইট, রাইট। তারপর অস্ফুটস্বরে বাচ্চা ছেলের মতো সেই ছড়াটা আওড়াতে থাকলেন :
খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে,…
চিরিমিরি পাহাড়ের বাংলোটির নাম ‘দা সোয়ান’। দূর থেকে ধূসর এই পুরনো বাংলোটিকে সত্যি একটা রাজহাঁসের মতো দেখায়–যেন মাঝে মাঝে রাজহাঁসটা জ্যোৎস্নারাতে হ্রদে সাঁতার কেটেও যায়। বাংলোর গেট থেকে একফালি সরু পথ ঘুরে ঘুরে হ্রদে নেমেছে। যেখানে নেমেছে, সেখানে কয়েক ধাপ পাথর বাঁধানো আছে ঘাটের মতো। পথের দুধারে গাছপালা ঝোপঝাড় আছে। পথটাও এবড়োখেবড়ো অব্যবহৃত হয়ে রয়েছে অনেক বছর। ফাটলে ঘাস বা আগাছা গজিয়েছে। আমরা দুপুর নাগাদ তিনজনে পৌঁছুলে কেয়ারটেকার রঘুবীর সিং তক্ষুনি কয়েকজন আদিবাসী লাগিয়ে সব সাফ করার ব্যবস্থা করল। ঘাটের পাথরগুলোয় শ্যাওলা জমে ছিল। তাও সাফ করা হলো। লাঞ্চের আগে কর্নেল স্বভাবমতো চারপাশটা দেখতে বেরিয়ে গেলেন–সঙ্গে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা নিতেও ভুললেন না। আমাকে ডাকলেন না দেখে অভিমান হলো–অবশ্য ডাকলেও যেতুম না, সারাদিন সারারাত ট্রেনজার্নির পর তখন খুব ক্লান্ত আমি। বিছানায় গড়াচ্ছি। কর্নেলকে ইন্দ্রনাথ সাবধান করে দিলেন এলাকার জঙ্গলে বুনো হাতি আছে অজস্র। বাঘ ভালুকও কম নেই। কর্নেল ঘাড় নাড়লেন মাত্র।
বাংলোর ঘরগুলো এসেই দেখা হয়েছে। পাঁচঘানা ঘর আছে। একটা কিচেন কাম-ডাইনিং-প্লাস ড্রয়িং রুম, একটা বাথরুম-প্রিভি, বাকি তিনটে শোবার ঘর। থাকার ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি নেই। ইন্দ্রনাথ খবর পাঠিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। দান সিং নামে ওঁদের পুরনো রাঁধুনিও অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। এবার সে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে কাজে লেগে গেল। আমাদের সঙ্গে তিনখানা হাল্কা মজবুত বিলিতি ছিপ, চার এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র রয়েছে। ইন্দ্রনাথ আমাকে ছিপ ফেলার ঘাট দেখতে ডাকলেন একবার। কিন্তু আমার ক্লান্তি লক্ষ্য করে শেষে একজন লোক সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন।
একটু পরে বারান্দায় গিয়ে চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে থাকলুম। হ্রদটা বিশাল। সামনে উত্তরে রয়েছে সেটা। পশ্চিমে মোটামুটি সমতল জায়গায় ওঁদের পোড়ো খনি–এখন জঙ্গল গজিয়ে গেছে। পুবে এবং উত্তরে যতদূর চোখ যায়, শুধু জল। দিগন্তরেখায় কিছু নীল পাহাড়। উত্তরেও পাহাড়–সেগুলো কাছে বলে মনে হলো। বাংলোটা রয়েছে পাহাড়ের গায়ে–এটা হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ-ঘেঁষা। রঘুবীর এসে সব দেখাল। বাংলোর পিছনে আরেকটা রাস্তা আছে–সেটা চলে গেছে খনিতে। বাংলা থেকে সিকি কিলোমিটার দূরে রাস্তাটা দুভাগ হয়েছে ডাইনে চলে গেছে খনির দিকে। বাঁয়ে গিয়ে মিলেছে একটা ঢালু বড় সড়কে মাইল পাঁচেক দূরে। ওই পথেই আমরা টাঙ্গায় চেপে এসেছি। সড়কটা নদী পেরিয়ে পুবে বরটুঙ্গা স্টেশন হয়ে জব্বলপুরের দিকে চলে গেছে।
রঘুবীর বলল কী ছিল জায়গাটা, কী হয়ে গেল! কত লোকজন– কত আওয়াজ–সবসময় গমগম করত। আমি স্যার, সেই এসেছিলুম রায়সায়েবের সঙ্গে পাঁচ সাল আগে। উনি তো মারা গেলেন। তারপর আমিও চলে গেলুম। আমার মনে বড় কষ্ট হত স্যার। কিন্তু ওনারা ছাড়বেন না। বাংলোর জিম্মাদারি করতে হবে। তো আমার ছেলেই এখানে এসে মাঝে মাঝে দেখাশোনা করে যেত। খুব সাসহী ছেলে স্যার! আমার তো এ বয়সে এই ভূতের আড্ডায় থাকার সাহসই ছিল না। লেকিন দেখুন, আমার ছেলের একচুল ক্ষতি হয়নি। ভূতও নাকি দেখা দেয়নি। তবে…
ও থামলে জিগ্যেস করলুম–তবে?
–ছেলে বলত, খনির ওদিকে আলো জ্বলতে দেখেছে। ওর ধারণা ওসব আলো জেলেদের। রাতে মাছ ধরতে আসে জেলেরা।
–আচ্ছা রঘুবীর, রায়সাহেব মারা যাবার সময় তো তুমি এখানে ছিলে?
জী হুজুর।
–তুমি কি মনে করো উনি হার্টফেল করেই মারা যান?
রঘু গম্ভীর হয়ে বলল–জী হাঁ। আচানক কিছু আজগুবি দেখলে তো হার্টফেল করবেই! আমার মালুম, রায়সাহেব সেই সাধুকে দেখতে পেয়েছিলেন। সাধুর রাগ হয়েছিল। কেন? না–খনির গর্ত বন্ধ করে দেবেন রায়সাহেব। সাধুর ভয়ঙ্কর চেহারা দেখেই মারা যান উনি।
–তাহলে বলছ, খনির মধ্যে কৈানও সাধু ছিলেন? তাকে কেউ দেখেছিল নাকি?
–জী হ্যাঁ। মাইজি দেখেছিলেন।
–তুমি?
রঘুবীর একটু চুপ করে থেকে বলল–স্যার, বিশ্বাস করেন তো বলি। আমি একদিন সন্ধ্যাবেলায় এক পলকের জন্যে দেখেছিলুম। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। তারপর–আর নেই! বিলকুল হাওয়া।
বল কী রঘুবীর!
হ্যাঁ স্যার। দেখামাত্র গর্তে সেঁধিয়ে গেলেন। মনে মনে হেসে সিগারেট ধরালুম। রঘুবীর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে চলে গেল। একটু পরে শুনি বাংলোর পিছন দিকে গাড়ির আওয়াজ হচ্ছে। ব্যাপারটা দেখার জন্য লন ঘুরে পিছনে যেতেই দেখলুম, একটা জিপ থেকে আমার বয়সী একজন যুবক নামল–চোখে সানগ্লাস, পিঠে বন্দুক। তারপর নামলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। কর্নেলের বয়সী। তবে কর্নেলের মতো টাক বা দাড়ি নেই। শেষে নামলেন এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা। পোশাক দেখেই চমকে উঠলুম। বাঙালী বিধবা। তাহলে কি হঠাৎ ইন্দ্রনাথের সেই কাকিমা এসে পড়লেন? সর্বনাশ!
কিন্তু এই অভিশপ্ত মাটিতে হঠাৎ উনি নিজেই এসে পড়লেন এবং সদলবলে– কেন?
ততক্ষণে রঘুবীর দৌড়ে হাজির হয়েছে। তার হাবভাব দেখে স্পষ্ট জানা গেল, যা ভেবেছি, তাই। বৃদ্ধা বেশ শক্ত সমর্থ মনে হলো। আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন–আপনাকে তো চিনলুম না বাবা?
রঘুবীর বলল-মাইজী, ওনারা এসেছেন কলকাতা থেকে। ইন্দর সাহেবের সঙ্গে। লেকে মাছ ধরবেন।
ইন্দ্র! ইন্দ্র এসেছে? বৃদ্ধার মুখে খুবই বিস্ময় ফুটে উঠল।
–জী হাঁ। এই তো দো-তিনঘণ্টা আগে এসেছেন। ঔর এক কর্নেল সাহেব এসেছেন।
বৃদ্ধা গম্ভীর মুখে দলবল সহ বাংলোয় উঠলেন। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগল। ভুতুড়ে বাংলোর সব রোমান্স মাঠে মারা যাবে। বেশি হইচই করা যাবে না। মেপে জুপে চলাফেরা করতে হবে। ইন্দ্রনাথের মুখে ওঁদের গার্জেন এই ভদ্রমহিলার যে ব্যক্তিত্বের আঁচ পেয়েছিলুম, বাস্তবে মনে হচ্ছে তার চেয়েও কড়া কিছু। আশঙ্কাও হলো, ইন্দ্রনাথ ওঁর বিনা অনুমতিতে এবং অজ্ঞাতসারে আমাদের নিয়ে এখানে এসেছেন–এই নিয়ে কোনও মনান্তর দেখা দেবে না তো?
অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে গেট পেরিয়ে রাস্তায় গেলুম। তারপর আরও কিছু এগিয়ে যেতেই আচমকা পাশের একটা ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এলেন কর্নেল। টুপিতে মাকড়সার জাল, জামায় কাঁটা আটকে আছে এবং শুকনো পাতা লেগে রয়েছে। আমাকে দেখে যেন একটু অপ্রস্তুত হলেন। বললেন–এই যে জয়ন্ত!
বললুম–বন্য জন্তুর মতো ঝোপ জঙ্গলে ঢুঁ মেরে বেড়াচ্ছেন। ওদিকে দেখুন গে, ধুন্ধুমার শুরু হয়েছে এতক্ষণ। ইন্দ্রনাথের সেই কাকিমা ভদ্রমহিলা দলবল নিয়ে। এসে পড়েছেন!
কর্নেল হাত তুলে বললেন–দেখেছি। এত নার্ভাস হয়ে পড়ার কিছু নেই। এবার চুপচাপ একটা জমাট নাটক দেখতে থাকো। আনন্দ পাবে–আই অ্যাসিওর ইউ, ডার্লিং!
নাটক মানে?
কর্নেল টুপি খুলে টাক চুলকে বললেন–হ্যাঁ জয়ন্ত। সম্ভবত একটা রোমাঞ্চকর নাটকের শেষ অঙ্কের পর্দা উঠল এবং আমরা কিছু না জেনে তার মধ্যে এসে। পড়েছি।
বিস্মিত হয়ে বললুম–কর্নেল! প্লীজ-অন্ধকারে রাখবেন না!
কর্নেল সস্নেহে আমার একটা হাত ধরে বললেন–ধৈর্য ধরো, জয়ন্ত। সম্ভবত আমাদের দুজনেই এখন একটা সুবিশাল ধৈর্যের মধ্যে সময় কাটাতে হবে। আই জাস্ট স্মেল ইট।
লাঞ্চ খেতে তিনটে বেজে গেল। আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, ইন্দ্রনাথের ঠাণ্ডা ধরনের নির্লিপ্ত আচরণ সত্ত্বেও তার কাকিমা সর্বেশ্বরীদেবী আমাদের বিশেষ করে কর্নেলের প্রতি খুব ভদ্রতা দেখালেন। কিন্তু একটু বিসদৃশ মনে হলো দুই ভায়ের পরস্পর আচরণ। ইন্দ্রনাথ ও সৌমেন্দু পরস্পর বাক্যালাপ পর্যন্ত করলেন না। সর্বেশ্বরীর সঙ্গের ভদ্রলোক সেই ইঞ্জিনিয়ার এবং খনি-বিশারদ, যিনি জগদীপের মৃত্যুর সময় এখানে ছিলেন এবং খনিমুখ বন্ধ করার উপায় বাতলাতে এসেছিলেন। সেই বৃদ্ধের নাম অনন্তরাম শর্মা। মহীশূরের লোক। জগদীপের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন।
কর্নেলের যা স্বভাব, এই তিনজন নবাগতের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুলতে দেরি হলো না। লাঞ্চের টেবিলে কর্নেলের অনুরোধে সর্বেশ্বরীও বসলেন। কিন্তু তিনি নিরামিষ খান। আলাদা ব্যবস্থাও ছিল। নিঃসঙ্কোচে খেলেন এবং তাঁর স্বামীর কার্যকলাপ সম্পর্কে গল্পও করলেন। মনে হলো, ভদ্রমহিলার প্রভুত্ব করার ক্ষমতা অসাধারণ এবং রীতিমতো শিক্ষাদীক্ষা আছে।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ইন্দ্রনাথ তিনটে ছিপ নিয়ে চলে গেলেন হ্রদের দিকে। আমাদের দুজনকে ডেকেও গেলেন। কর্নেল বললেন–খাওয়ার পর আধঘণ্টা জিরিয়ে নেওয়া আমার অভ্যাস, মিস্টার রায়। আপনি চলুন। আমরা দুজনে যাচ্ছি।
বুঝলাম, আমাকেও কর্নেলের সঙ্গে জিরিয়ে নিতে হবে।
সৌমেন্দুকে দেখলুম লনে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। বারান্দার চেয়ারে আমরা চারজন বসে আছি-কর্নেল, সর্বেশ্বরী, মিঃ শর্মা আর আমি। সর্বেশ্বরী বলছিলেন–তা বুঝলেন কর্নেল? স্বপ্ন দেখার পর তো আমি অস্থির হয়ে উঠলুম। তখনই টেলি করে দিলুম মিঃ শর্মাকে। সৌমেন্দুকেও খবর দিলুম মিঃ শর্মাকে নিয়ে সে যেন অপেক্ষা করে। তারপর…
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–একটা ছোট্ট প্রশ্ন মিসেস রায়। জাস্ট একটা কৌতূহল। ইন্দ্রনাথকে আপনি কথাটা নিশ্চয় জানাননি?
সর্বেশ্বরী গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেন–দেখুন কর্নেল সরকার, ব্যাপারটা অবশ্য পারিবারিক এবং প্রাইভেট অ্যাফেয়ার। কিন্তু আপনাকে বলতে সংকোচের কারণ দেখি না। ইন্দ্রনাথকেই প্রথমে কথাটা বললুম–। কিন্তু ও বরাবর অবিশ্বাসী-নাস্তিক। ও উড়িয়ে দিল। বলল–একটা পোডড়া খনির গর্ত বুজিয়ে ফেলতে একগাদা টাকা খরচা হবে। এর কোনও জাস্টিফিকেশন নেই। ইন্দ্রনাথ গোঁ ধরে বসে রইল। তখন আর কী করি বলুন! প্রত্যক্ষ স্বপ্নে দেখলুম, উনি বলছেন পিট তিনটে শীগগির বন্ধ করে দাও। সাধুবাবা চলে গেছেন!
কর্নেল মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন-রাইট, রাইট মিসেস রায়। মিঃ শর্মাকে জিজ্ঞেস করছি। মিঃ শর্মা কীভবে পিট বন্ধ করবেন, নিশ্চয় প্ল্যান করেই এসেছেন?
শর্মা বললেন–অবশ্যই। সঙ্গে ডিনামাইট নিয়ে এসেছি। কোনও অসুবিধে হবে না। এখন আগে একবার গিয়ে জায়গাটা দেখতে হবে কী অবস্থায় আছে। পাঁচ বছর আগে যেমন দেখেছি, তেমন না থাকতেও পারে। কারণ, বুঝতেই পারছেন–প্রকৃতি সবসময় নিজের কাজ করে যাচ্ছে। ওলট-পালট ঘটাচ্ছে।…বলে শর্মা হাসতে থাকলেন।
কর্নেল ফের মাথা দুলিয়ে বললেন রাইট, রাইট!
শর্মা একটু ঝুঁকে বললেন–কিছু যদি মনে করেন কর্নেল, তাহলে আপনিও আমার সঙ্গে যেতে পারেন। সার্ভে এবং ডিনামাইট রাখার ব্যাপারে আপনার মতো অভিজ্ঞ একজন সমরকুশলী থাকা খুবই সঙ্গত। এ ধরনের কাজকর্ম সমর বিভাগের লোকেরা নিশ্চয় করে থাকেন।
কর্নেল তক্ষুণি আমন্ত্রণটা নিলেন। আমার দিকে ঘুরে বললেন জয়ন্ত, তাহলে তুমি ছিপ ফেলতে যাও। আমি মিঃ শর্মার সঙ্গে যাই।…
সর্বেশ্বরী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আপনারা ঘুরে আসুন। ততক্ষণ আমি বিশ্রাম করে নিই।
সবেশ্বরী ঘরে ঢুকলেন। কর্নেল ও মিঃ শর্মা বেরিয়ে গেলেন। আমি লেকের দিকে পা বাড়ালুম। লন পেরিয়ে যাবার সময় সৌম্যেন্দু হঠাৎ আমাকে ডাকলেন– জয়ন্তবাবু, শুনুন!
কাছে গেলুম। বললুম–আপনি গেলেন না যে?
সৌম্যেন্দু সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন–আপনারা কি সত্যি নিছক মাছ ধরতেই এসেছেন?
চমকে উঠে বললুম–নিশ্চয়ই। আপনার অবিশ্বাসের কারণ বুঝলুম না সৌমেন্দুবাবু। দুঃখিত।
সৌম্যেন্দু আমার অনুযোগ গ্রাহ্য না করে প্রশ্ন করলেন–আপনি কি সত্যি রিপোর্টার?
অপমানিত বোধ করলুম। পকেট থেকে আমার আইডেন্টিটি কার্ড (ফটো সমেত) বের করে ওঁর সামনে ধরে বললুম–আপনার কি এটা জাল মনে হচ্ছে?
সৌম্যেন্দু, আশ্চর্য, আইডেন্টিটি কার্ডটা আমার হাত থেকে নিলেন এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টে পরীক্ষা করার পর ফিরিয়ে দিয়ে একটু হাসলেন–জয়ন্তবাবু, আমার এই সংশয়কে ক্ষমা করবেন। আপনাকে খোলাখুলিই বলছি, দাদার প্রতি আমার এতটুকু বিশ্বাস নেই।
–কেন সৌমেন্দুবাবু?
ওঁর এখানে আসার মধ্যে অবশ্যই কোনও মতলব আছে। কিন্তু শুধু বুঝতে পারছি না–আপনাদের কেন উনি আনলেন? বিশেষ করে ওই কর্নেল ভদ্রলোকের নাম আমার শোনা আছে–উনি একজন শখের গোয়েন্দা–তাই না?
–ঠিক তা নয়। তবে ওঁর রহস্যসম্পর্কে আগ্রহ আছে। তবে একটা পোড়ো খনির মুখ বন্ধ করার মধ্যে কী রহস্য থাকতে পারে, সত্যি আমি বুঝতে পারছি না সৌম্যেন্দুবাবু।
–পারে বইকি।…বলে সৌম্যেন্দু কেমন হাসলেন। তারপর চাপা গলায় ফের বললেন–আমার বরাবর ধারণা, ওই খনির সুড়ঙ্গে কোথাও গুপ্তধন লুকোনো আছে।
বলেন কী মশাই!
-হ্যাঁ জয়ন্তবাবু। এই আমার বরাবরকার অনুমান। কিন্তু কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, ওখানে কে গুপ্তধন পুঁতে রাখতে গেল? কখন পুঁতল?
আমি হতভম্ভ হয়ে গেছি কথাটা শুনে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ সৌম্যেন্দু বললেন–চলুন, আপনার ওই কর্নেল সায়েব তো ছিপ নিয়ে বসবেন না। অতএব আমি ওঁর ছিপটা নিয়ে মাছ ধরতে বসব। কিন্তু একটা কথা–আমি ছিপটা দাদার কাছে গিয়ে আনতে পারব না। আমি দূরে দাঁড়াব। আপনি এনে দেবেন। দাদার কাছে জেনে নেবেন কিন্তু, কোন ঘাটে কর্নেলের বসার কথা ছিল। সে ঘটেই আমি বসব।…
লেকের এই দক্ষিণ ধারটা পাহাড় থেকে ঢালু বা গড়ানে অবস্থায় জলে নেমে গেছে। অজস্র ঝোপঝাড় ও পাথর আছে এখানে। বাঁদিকে অর্থাৎ পশ্চিমে সেই পাথর বাঁধানো ঘাটে কর্নেলের বসার কথা। সেখানেই সৌম্যেন্দু বসলেন। আমি বসলুম তার আন্দাজ তিরিশ গজ দূরে ঝোপের মধ্যে থেকে একটা পাথর জলঅব্দি নেমে গেছে, তার ওপর। আমি সৌম্যেন্দুর ছিপের ডগাটা শুধু দেখতে পাচ্ছিলুম। আর, ইন্দ্রনাথ বসেছেন আমার ডাইনে আন্দাজ চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে। সেখানেও এমনি পাথর আছে। কিন্তু আমি ইন্দ্রনাথের ছিপটা দেখতে পাচ্ছিলুম না। ওই ঘাটটা সম্পূর্ণ আড়ালে পড়ে গেছে।…
হ্রদের জল এখন মোটামুটি শান্ত। আমার পিছন থেকে বাতাস বইছে বলে আমার ঘাটের জলটা কাচের মতো নিভাজ আর স্বচ্ছ দেখাচ্ছিল। পশ্চিমের উপত্যকায় সেই ভুতুড়ে খনি অঞ্চল–বেশ কঁকা খানিকটা জায়গা। ঝোপঝাড় অবশ্য আছে। কিন্তু কোনও পাহাড় না থাকায় সূর্যের আলো এসে হ্রদের জলকে গোলাপি আলোয় রাঙিয়ে তুলছিল। ছিপে বসতে যে একাগ্রতার দরকার, এখন তা আর আমার নেই। মাথায় সৌম্যেন্দুর গুপ্তধন কথাটা ভেসে আসছে। বারবার পশ্চিমের ওই উপত্যকার দিকেই তাকাচ্ছি। ফাতনা স্থির হয়ে ভেসে আছে। হ্রদে প্রচুর মাছ আছে শুনেছিলাম, কিন্তু একবারও ফানা নড়তে দেখলুম না। চারে মাছ এলে বুজকুড়ি ফুটবে জলে। তারও কোনও লক্ষণ নেই। বসে থেকে বিরক্তি ধরে গেল। অনেকগুলো সিগারেট খেয়ে ফেললুম। বারকতক ছিপ তুলে টোপও দেখলুম। মাছে ঠোকর দেয়নি। ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। হ্রদের জলের গোলাপি রঙ ঘিরে ধূসর কুয়াশা জেগে উঠছে। দূরের পাহাড়গুলো কালো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। যে সব পাখি হ্রদের আকাশে ওড়াউড়ি করছিল, এতক্ষণে তারা পাহাড়-জঙ্গল লক্ষ্য করে ডানা মেলছে। হঠাৎ আমার ছিপের সুতোয় টান পড়ল এবং হুইলের ঘরঘর শব্দ শোনা গেল। ছিপটা চেপে ধরে, দেখি সুতো প্রচণ্ড বেগে জলের তলায় ছুটছে। নির্ঘাৎ কোনও প্রকাণ্ড মাছ বঁড়শি গিলেই গেঁথে গেছে, আমাকে খ্যাচ মারার সুযোগও দেয়নি।
ছিপের ডগা বেঁকে যাচ্ছিল। সামলাতে না পেরে উঠে দাঁড়ালুম। একটু পরেই মাছটা স্থির হলো। তখন সুতো গুটোতে শুরু করলুম। মাছটা অন্তত কিলো দশকের কম হবে না। কাছাকাছি আসার পর মাছটা এক লাফ দিয়ে ডাইনে ঘুরল। তারপর পাড়ের সমান্তরালে জল ভেঙে দৌড় দিল। পাড়ের কাছাকাছি বলে এসব জায়গায় অজস্র পাথর জলের ভিতরে এবং উপরে ঘাপটি পেতে রয়েছে। ভয় হলো, নির্ঘাৎ এবার মাছটা কোনও পাথরের খাঁজে ঢুকে যাবে এবং আমার সুতোটা ছিঁড়ে ফেলবে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলুম ইন্দ্রনাথবাবু! ইন্দ্রনাথবাবু!
চেঁচানোর উদ্দেশ্য, মাছটা ওঁর ঘাটের দিকেই যাচ্ছে। উনি যদি এখন কোনওভাবে ওঁর বঁড়শিতে বা সুতোয় ওটাকে আটকাতে পারেন, মাছটা হাতছাড়া হবার সুযোগ পাবে না।
আমার ডাকের পর মনে হলো উনি সাড়া দিলেন–সেটা আমার শোনারও ভুল হতে পারে। কারণ, ঠিক তখনই যা ভয় করেছিলুম–তাই হলো। সুতোটা ঢিলে হয়ে নেতিয়ে গেল। গুটিয়ে আনার পর দেখি, ফাতনাসুদ্ধ ছিঁড়ে মাছটা সম্ভবত পাথরের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ফাতনাটা খুঁজলুম। আলো কমে গেছে। এখান থেকে দেখা গেল না। তখন আরও ভাল করে দেখার জন্য ইন্দ্রনাথের ঘাটের। কাছে গেলুম।
ঝোপ ঠেলে গিয়ে দেখি, ইন্দ্রনাথ পাথরে পা ঝুলিয়ে বসে দোলাচ্ছেন। ছিপটা তুলে পাশে রেখেছেন। জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। ব্যাপার কী?
আমার পায়ের শব্দে ঘুরে তাকালেন। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। আসুন, আসুন জয়ন্তবাবু। আপনারও দেখছি আমার অবস্থা হয়েছে। লেকের মাছগুলো খুব শক্তিমান। বরাবর এই কাণ্ডটি ঘটে বলে এবার বিলিতি কোম্পানির সুতো আনলুমতাও টিকল না।
বললুম–ডাকছিলুম, শোনেননি?
ইন্দ্রনাথ বললেন—হুঁ শুনেছি। কিন্তু তখন সাড়া দেবার ফুরসত কোথায়? চলুন–আলো কমে গেছে। আজ আর আশা নেই। কাল সকাল থেকে ফের বসা যাবে।
দুজনে পাশাপাশি ঢালু বেয়ে ওঠা শুরু করলুম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন-সৌম্য অবশ্য আমাদের মতো আনাড়ি নয়। আমি জানি জব্বলপুর থেকে গাড়ি করে এসে ও মাছ ধরে। বিলক্ষণ অভ্যাস আছে। এজন্যেই সম্ভবত জব্বলপুর ছেড়ে যেতে চায় না।
বললুম–দেখে আসব নাকি?
–থাক। ও একটু গোঁয়ার প্রকৃতির ছেলে। ডিসটার্ব করলে খুশি হবে না। আসুন, আমরা বাংলোয় গিয়ে আরামে কফি খাব।…..
বাংলোয় গিয়ে দেখি, সর্বেশ্বরী বারান্দায় বসে রয়েছেন। রঘুবীরের সঙ্গে কথা বলছেন। ভাসুরপোকে একবার দেখে বললেন–মাছ হলো না? ইন্দ্রনাথ জবাবে একটু হাসলেন মাত্র। তারপর আমরা বারান্দার উত্তরদিকে একটু তফাতে বসলুম। ইন্দ্রনাথ রঘুবীরকে বলে দিলেনকফি খাব।
একটু পরে কফি খেতে খেতে কর্নেল ও শর্মার গলার আওয়াজ পেলুম। তখনও অন্ধকার ঘন হয়নি। গোধূলিকাল বলা যায়। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলুম কর্নেল ও শর্মা ঘাটের দিক থেকেই আসছেন। কিন্তু তাঁদের আসার মধ্যে কেমন ব্যস্ততা ছিল। খোলা বারান্দায় আমাদের দেখতে পেয়েই কর্নেল চেঁচিয়ে বললেন ইন্দ্রনাথবাবু! সৌমেন্দুবাবু ফিরেছেন?
ইন্দ্ৰনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বললেনা। ও এখনও ঘাটে আছে।
কর্নেল অমনি ঘুরলেন এবং হাস্যকর ভঙ্গিতে দৌড়ে, যেদিক থেকে আসছিলেন–অর্থাৎ সেই পাথরের ধাপবন্দী ঘাটটার দিকেই চলে গেলেন। শর্মা দাঁড়িয়ে ওঁর চলে যাওয়া দেখছিলেন। ইন্দ্রনাথ ও আমি বারান্দা থেকে তক্ষুনি ওঁর কাছে চলে গেলুম।
ইন্দ্রনাথ বললেন ব্যাপার কি মিঃ শর্মা?
শর্মার যেন এতক্ষণে সংবিত ফিরল। ইন্দ্রনাথ! ঘাটে সৌমেন্দু নেই– ছিপটা জলে পড়ে আছে। আর…আশ্চর্য ঘাটের পাথরে একটুখানি রক্ত। আমরা ভাবলুম, মাছের রক্ত। কিন্তু… ।
কথা শেষ করার আগেই কর্নেলের ডাক এল ইন্দ্রনাথ! মিঃ শর্মা! চলে আসুন।
সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখি ঘাটের ওপর দিকে ঝোপে কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন। ঝোপে ঢুকে আমার মাথা ঘুরে গেল। শরীর অবশ হয়ে উঠল। ইন্দ্রনাথ ভাঙা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন-সৌম্য!
সৌমেনের বুকে একটা ছোরা বিধে রয়েছে। বিঁধে আছে বলেই বিশেষ রক্ত পড়েনি। চিত হয়ে ঘাসের ওপর পড়ে আছেন উনি। চোখদুটো খোলা। মুখে বিকৃত ভাব। মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেল, কর্নেলের মুখে শোনা সেই ছড়াটা :
খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে,
ছিপ নিয়ে গেছে কোলাব্যাং
মাছ নিয়ে গেছে চিলে।…
বিন্দিয়া নামে পাঁচ মাইল দূরে একটা ছোট শহর আছে। সেখানেই থানা। ইন্দ্রনাথ সেই গাড়িটা চালিয়ে থানায় গিয়েছিলেন। ফিরলেন সাতটা নাগাদ। সঙ্গে একদল পুলিশ। অফিসার-ইন-চার্জের নাম মিঃ লাল। ভদ্রলোক খুব রাগী মানুষ। এসেই প্রথমে চোখ পড়ল রঘুবীর আর রাঁধুনী বেচারার দিকে। ধমক দিয়ে বললেন এই ব্যাটারাই খুন করেছে! শুনে ওরা ঠকঠক করে কাঁপতে ঈশ্বর-রামজী-হনুমান গণেশ তাবত দেব-দেবতার কিরিয়া খেতে থাকল। বেগতিক দেখে কর্নেল তার পরিচয়পত্রটি বের করলেন। সম্প্রতি এটি তিনি ভারত সরকারের কাছে লাভ করেছেন। এটি এতদিন ছিল না বলে তাকে নানান অসুবিধায় পড়তে হচ্ছিল। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার পরামর্শে যোগাড় করতে হয়েছে।
পরিচয়পত্র দেখে মিঃ লাল একটু সংযত হলেন। কিন্তু ঠোঁটে বাঁকা হাসিটা থেকে গেল। বললেন–আপনার সাহায্য পেলে খুশি হব নিশ্চয়। কিন্তু কর্নেল সরকার এ হলো মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল। যত সব খুনে ডাকাতের আড্ডা। কথায় কথায় ওরা খুন খারাবি করে। আশা করি, খবরের কাগজ পড়ে তা আপনি বিলক্ষণ অবগত আছে। এই লোকদুটোর চেহারা দেখেই বুঝেছি এরা ঘোড়েল ক্রিমিনাল। রেকর্ড খুঁজলে নিশ্চয় সব বেরোবে। যাক্ গে, এখন আমাদের রুটিনওয়ার্কে নামতে হবে।
টর্চের আলোয় সরজমিন তদন্ত শুরু হলো। লাশটা সেখানেই পড়ে ছিল। লাশের কাছে একটা হেরিকেন রেখে সর্বেশ্বরী, মিঃ শৰ্মা, এবং আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলুম। কর্নেল বাংলোয় (লাশটা থেকে পঞ্চাশ গজ ওপরে) রঘুবীর ও রাঁধুনীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তারপর লাশের কাছে এলেন।
মিঃ লাল টর্চের আলো পেলে লাশ পরীক্ষা করতে করতে বললেন–মনে হচ্ছে ঘাটে মাছ ধরার সময় খুনী ছুরি মেরেছে। তারপর লাশটা টেনে এখানে এনেছে। আপনি কী বলেন কর্নেল সরকার?
কর্নেল একটু কেসে বললেন–ঠিক তাই বটে। কিছু রক্ত পড়ে আছে।
অমনি মিঃ লাল ও দুজন কনস্টেবল রক্ত খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-জয়ন্ত, যদি অসুস্থ বোধ করো, বাংলোয় গিয়ে বিশ্রাম করো।
অসুস্থ বোধ করা স্বাভাবিক। কিন্তু মনে হলো, কর্নেল আমাকে কোনও গূঢ় আদেশ দিচ্ছেন। অতএব ভালছেলের মতো আমি বাংলোয় চলে গেলুম।
বাংলোর বারান্দায় একটা কাঁচটকা ল্যাম্প রয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ। বারান্দায় দুজন রাইফেলধারী সেপাই বসে রয়েছে। তারা আমার দিকে তাকাল মাত্র। তারপর চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকল। আমি ঘরে ঢুকলাম। মোমবাতি দেখেছিলুম দিনে। দেশলাই জ্বেলে একটা ধরালাম। তারপর খাটে বসে পড়লুম।
এ ঘরে একটা বড় বিলাতি খাট আছে তাতে কর্নেল ও আমার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। অন্যপাশে একটা ক্যাম্পখাট পাতা হয়েছে ইন্দ্রনাথের জন্যে। হঠাৎ চোখে পড়ল ওই খাটটার তলায় দলাপাকানো একটা কাগজ পড়ে রয়েছে। অন্যসময় হলে কিছুই ভাবতুম না। কিন্তু সদ্য খুন হয়েছে এবং কর্নেলের মতো রহস্যভেদী আছেন। সঙ্গগুণে এসব ক্ষেত্রে আমার মধ্যে গোয়েন্দা পোকা অর্থাৎ টিকটিকিটা খুব ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অতএব তক্ষুনি কাগজটা কুড়িয়ে এনে খুলে ফেললুম। খুব পুরনো কাগজ। কোণায় ছাপানো সনতারিখ দেখেই বুঝলুম, এটা কারো ডায়েরির ছেঁড়া পাতা। তারিখটা হচ্ছে ১৭ আগস্ট ১৯৬৮ রবিবার। পাতার নিচের দিকটা ছেঁড়া। তাতে শুধু লেখা রয়েছে ইংরেজিতে: ‘C2’। খুব বড় হরফে কালো কালিতে কেউ লিখেছে। কালি পরীক্ষা করে মনে হলো খুব পুরনো।
ধুরন্ধর গোয়েন্দার শিষ্য আমি। তাই কাগজটা পকেটে রেখে দিলুম। গুরুদেবকে দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেব। এবং এরপর স্বভাবত আমার মাথায় তদন্তের পোকাটা আরও চঞ্চল হয়ে উঠল। তখন ইন্দ্রনাথের বিছানা হাতড়াতে ব্যস্ত হলুম। আমার তদন্ত ব্যর্থ হলো। তেমন সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। তলায় ওঁর একটা স্যুটকেস রয়েছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলুম, সেটা ভোলা। তখন সাবধানে খুলে ফেললুম। কয়েকটা প্যান্টশার্ট আর দুটো হুইস্কির বোতল ছাড়া আর কিছু নেই। এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ হতেই ঝটপট সরে এলুম।
দরজায় দেখা দিলেন সর্বেশ্বরী। ব্যস্ত হয়ে বললুম–আসুন, আসুন মা।
সর্বেশ্বরী ঢুকে ইন্দ্রনাথের খাটে বসে পড়লেন। সন্ধ্যা থেকেই দেখছি, উনি স্তব্ধ এবং যেন নির্বিকার কিংবা যেন ভীষণ-বিমূঢ়। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন শুধু, এক ফোঁটা চোখের জল পড়তে দেখিনি। এখন চুপচাপ বসে সেই শক খাওয়া নির্বিকার চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভয় হলো, উনি পাগল হয়ে। যাননি তো এই আকস্মিক আঘাতে? একটু অস্বস্তি হলো। বললুম–কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেল বলুন তো! কী বলে যে আপনাকে সান্ত্বনা দেব, ভেবে পাচ্ছি না! সৌমেন্দুবাবু…
বাধা দিয়ে সর্বেশ্বরী মুখ খুললেন এবার।–এ আমি জানতুম, বাবা জয়ন্ত।
অবাক হয়ে বললুম–জানতেন?
–হ্যাঁ। ওই অভিশপ্ত খনি কাকেও রেহাই দেবে না। কোনও-না-কোনও ভাবে রায়বংশের সবাইকে শেষ করবে। বলবে, কেউ ছুরি মেরেছে সৌমেন্দুকে। হ্যাঁ– মেরেছে। কিন্তু যে মেরেছে, সে নিজেও জানে না কেন ওকে ছুরি মারল।…দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের শোকমবেগ যেন:দমন করলেন সর্বেশ্বরী। ফের বললেন–আমি যা জানি তোমরা কেউ তো, তা জানো না, বাবা জয়ন্ত। বললে বিশ্বাস করবে না।:ওই অভিশপ্ত জায়গাটা কেনার কথাবার্তা চলতে চলতেই আমার ভাসুর আর বড় জা হঠাৎ মারা গেলেন–একমাস আগে-পরে। আমি বাধা দিলুম। তাই কেনা হয়নি। কিন্তু আমার স্বামী না জানিয়ে উনিশ বছর পরে কখন কিনে বসলেন। শর্মা ওর বন্ধু। শর্মাই নাকি কবে সার্ভে করে দেখেছিলেন, ওখানে মাটির তলায় অনেক সীসে আছে। তারপর তো খনির কাজ শুরু হলো। আমার কপাল ভাঙল।…
উনি চুপ করলে বললুম–আপনারা খনি শুরু করার আগে জায়গাটা তাহলে এমনি পড়ে ছিল?
মাথা দোলালেন সর্বেশ্বরী। তারপর বললেন–পড়ে ছিল ঠিকই। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকেই গুজব রটেছিল যে ওখানে সীসের খনি আছে।
কিন্তু তাহলে ওই উনিশ বছর ধরে কেউ খনির কাজ করেনি কেন?
–ওখানে এক সাধু থাকতেন। তিনিই বরাবর ভূপালের নবাবকে ধরে কাকেও ইজারা নিতে দিতেন না। উনিশ বছর পরে হঠাৎ সাধু অদৃশ্য হলেন। তখন আর আমার স্বামীর পক্ষে কেনার বাধা রইল না। নবাবের এক উত্তরাধিকারীর কাছে সস্তায় কিনে ফেললেন। তখন দেশীয় রাজাদের সম্পত্তি সরকার দখল করতে শুরু করেছেন। তাই বেগতিক দেখে ওরা বেচে দিলেন। কিন্তু বাবা, তোমরা তো একালের ছেলে কিছু বিশ্বাস করো না। সাধু কিন্তু বরাবর অদৃশ্য হয়ে ওখানে বাস করতেন। এতদিনও করেছিলেন। কদিন আগে এক রাতে আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন–বেটি, চলে যাচ্ছি। খনির মুখ বন্ধ করে দে এবার।
–সাধুকে আপনি কি দেখেছেন কখনও? মানে–স্বপ্নের কথা বলছি না।
–হ্যাঁ। একবার প্রত্যক্ষ দেখেছিলুম। খানিকটা দূর থেকে। টকটকে ফর্সা রঙ-লাল জটা, দাড়ি গোঁফও লাল। একেবারে উলঙ্গ বলা যায়। চোখ দুটো নীল–হৃঙ্খল্ করছে। আমার চোখে চোখ পড়ামাত্র একটু হেসে অদৃশ্য হলেন।
লাল জটা, দাড়ি, গোঁফ। চোখ নীল। টকটকে ফর্সা রং। মনে মনে হাসলুম। অলৌকিক পুরুষ যখন, তখন ভারতবাসীর আদর্শ চেহারা যা, অর্থাৎ একেবারে সায়েবদের মতোই হবেন বই কি। প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনে থেকে আমাদের চোখে যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তা সায়েবদের ওপর আরোপ করার অভ্যাস হয়েছে।
দুজনেই চুপ করে আছি। এক সময় সর্বেশ্বরী হঠাৎ নড়ে উঠলেন। চাপা গলায় বললেন ইন্দ্র আমার কথা শুনছে না। তুমি দেখে নিও, ওরও কী ঘটে। আমার কী?
বলে উনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর যেমন এসেছিলেন, বেরিয়ে গেলেন। ওপাশে ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। হয়তো অন্ধকারেই শুয়ে পড়লেন বিছানায়। আমি ওঁর কথাগুলো ভাবতে থাকলুম। তারপর মনে পড়ল কাগজটার কথা। C লেখা আছে। কোনও সংকেত বাক্য কি? কাগজটা কার? কে অমন করে ফেলে দিয়েছে?
এই সময় কর্নেলদের সাড়া পাওয়া গেল। ওঁরা সবাই বারান্দায় এলে বেরিয়ে গেলুম। মিঃ লাল চেয়ারে বসে বললেন–লাশটা আর ওভাবে ফেলে রাখার মানে হয় না। কী বলেন কর্নেল সরকার? আমাদের যা দেখাশোনার ছিল, হয়ে গেছে। এবার একটা খাটিয়া নিয়ে গিয়ে ওটা আনা যাক্।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন মিঃ লাল।
–তাহলে ইন্দ্রনাথবাবু, আপনি প্লীজ সেই ব্যবস্থাই করুন। কাল সকালের আগে অ্যাম্বুলেন্স আসার কোনও চান্স নেই। তারপর বডি মর্গে যাক্। এবার আমরা আরও কিছু জরুরী কাজকর্ম সেরে নিই।
ইন্দ্রনাথ রঘুবীর ও রাঁধুনীকে ডেকে বাংলো থেকে একটা ক্যাম্প খাট বের করলেন। লাশের কাছে দুজন সেপাই রেখে এসেছেন মিঃ লাল। বয়ে আনতে কোনও অসুবিধা হবে না। দারোগাবাবু একটা ফাইল খুলে পেন্সিল চালনা শুরু করলেন। কর্নেল আমার হাত ধরে বললেন–চলো জয়ন্ত, আমরা একটু জিরিয়ে নিই। আজ আর ডিনার খাবার বিন্দুমাত্র আশা রেখ না। কেমন?
ঘরে ঢুকে আমাদের খাটে বসলুম দুজনে। তারপর সেই কাগজ দিলুম ওঁকে এবং সংক্ষেপে সর্বেশ্বরীর কথাগুলোও জানালুম। কাগজটা পরীক্ষা করার পর কর্নেল পকেটে ঢোকালেন। চাপা গলায় বললেন–জয়ন্ত, আমি যা অনুমান করেছিলুম, তা যে ভুল নয়–তার প্রমাণ পেলুম।
বললুম–কী অনুমান করেছিলেন, কর্নেল?
কর্নেল আমার কথার জবাব না দিয়ে হাতের টর্চটা জ্বেলে মেঝেয় আলো ফেললেন। তারপর ইন্দ্রনাথের খাটের কাছে গিয়ে হাঁটু দুমড়ে বসলেন। বললেন জয়ন্ত, দেখে যাও।
কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখি, পাথরের মেঝেয় কয়েকটা দুইঞ্চি-দেড়ইঞ্চি এবং একইঞ্চি দাগ। দাগটা কালো। বললুম–ও কিসের দাগ?
মনে হচ্ছে জুতোর গোড়ালির, কিম্বা ডগার। দেখ জয়ন্ত, আমরা বিকেলে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ এ ঘরে ঢুকেছিল। সে বাইরে থেকেই এসেছিল।…বলেই কর্নেল আরেক জায়গায় আলো ফেলে অস্ফুট স্বরে বললেন–মাই গুডনেস!
দেখি ওখানেও একই রকম দাগ। কিন্তু এই দাগগুলো সবুজ রঙের। বললুম– কর্নেল, নিশ্চয় তাহলে এসব জুতোর দাগ নয়। অন্য কিছু।
না জয়ন্ত! এবার বুঝলুম, দুজন এসেছিল এই ঘরে। একজন এসেছিল ঘাট থেকে। ঘাটের ধাপে শ্যাওলা আছে। সবুজ দাগ তারই। কিন্তু কালো দাগ কার জুতোর? এখানে কালো মাটি আছে একমাত্র খনির ওখানে। খনিতে তো আমি আর মিঃ শর্মা এই দুজনে গিয়েছিলুম। কিন্তু, আমরা কেউ এ ঘরে আসিনি। অতএব অন্য কেউ এসেছিল। সে কে?
কর্নেল, তখন বাংলোয় রঘুবীর, রাঁধুনী আর সর্বেশ্বরী ছিলেন। তাদের জিগ্যেস করা যায়।
করব। তবে এটা ঠিক, ওরা কেউ এ ঘরে এলেও এই দাগগুলোর জন্য ওরা দায়ী নয়। কারণ, দাগগুলো পুরুষ মানুষের জুতোর। এবং ওই তিনজনের মধ্যে রঘুবীর আর রাঁধুনী জুতো পরে না। সর্বেশ্বরী স্লিপার পরেন। এ দাগ স্লিপারেরও নয়। স্লিপারের দাগ আরও ছোট হওয়া উচিত।
–তাই মনে হচ্ছে।
কর্নেল চিন্তিতমুখে উঠে এসে ফের খাটে বসলেন। তারপর বললেন– ইন্দ্রনাথবাবুকে বলেছিলুম-জব্বলপুরে একটা টেলি পাঠাতে। ওখানে সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টরকে আমার নামে টেলি করা হয়েছে। সম্ভবত ওঁরা কেউ এসে পড়বেন আজ রাত্রে, অথবা সকালে। বলাবাহুল্য মিঃ লাল চটে যাবেন। কিন্তু উপায় কী? এই হত্যাকাণ্ড খুব সহজ ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না জয়ন্ত। এর পিছনে একটা জটিল রহস্য আছে যেন।
হঠাৎ সৌমেন্দুর কথাটা মনে পড়ে গেল। কর্নেলকে সেটা জানালুম। শুনে উনি ঘন ঘন মাথা নাড়তে থাকলেন। তারপর বললেন–গুপ্তধন সত্যি করে থাক, বা নাই থাক–একটা গুজবের ব্যাপার নিশ্চয় আছে, তা প্রথমেই অনুমান করেছিলুম। জয়ন্ত, গুপ্তধনের গুজবের মতো ভয়ঙ্কর সর্বনেশে আর কিছু নেই।
কর্নেল! কাগজের ওই সংকেতটা গুপ্তধনের ঠিকানা নয় তো?
কর্নেল হেসে ফেললেন।–তোমার অনুমানে যুক্তি থাকতেও পারে। কিন্তু ডার্লিং, তাহলে ওটা অমন তাচ্ছিল্য করে কেউ ফেলে দেবে কেন?
ফেলে দিয়েছে। কারণ, সে ভেবেছে একটা বাজে কাগজ।
কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার যুক্তিতে সারবত্তা উঁকি দিচ্ছে। খুব খুশি হলুম, জয়ন্ত।
উনি চুরুট ধরিয়ে কী ভাবতে থাকলেন। একটু পরে বললুম–থাগে। আপনি আর ডঃ শর্মা খনিতে কী করছিলেন অতক্ষণ? হঠাৎ ঘাটের দিকেই বা গেলেন কেন? কোন পথে গেলেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–খনিটা দেখে মনে হলো, সত্যি ভূতের আড্ডা। খানাখন্দ প্রচুর। তত ঝোপঝাড়। বারোটা পিট ছিল। তিনটে বাদে সব বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনটের মধ্যে একটা ধস নেমে প্রায় বুজে গেছে। দুটো পিট এখনও খোলা। কিন্তু জঙ্গল গজিয়েছে। ভেতরে ঢোকার কথা ভাবা যায় না। শর্মা তো ভেবেই পেলেন না কোথায় ডিনামাইট বসাবেন। ও দুটোর কাছে কোনও পাথর নেই–তাছাড়া মুখগুলোর চারপাশে গভীর খাদ, জলে ভর্তি। মুখের কাছে যথেষ্ট মাটিও নেই যে ডিনামাইট চার্জ করলে ধস ছাড়বে। এক হতে পারে, সুড়ঙ্গের ওপর গর্ত খুঁড়ে ডিনামাইট বসানো। কিন্তু সুড়ঙ্গ কোন পথে কী ভাবে মাটির তলায় গেছে, না জানলে তো কিছুই করা সম্ভব নয়। ওপর থেকে বুঝবে কী করে?
সুড়ঙ্গে ঢোকা যায় না?
–যায়। কিন্তু তখন যথেষ্ট আলো নেই। তাছাড়া ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস থাকতে পারে। না পরীক্ষা করে ঢোকা যায় না। অবশ্য, আমরা দুজনে সুড়ঙ্গের অন্য মুখ আছে কি না খুব তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। পাইনি। শর্মার তো পরিচিত জায়গা। উনি কোনও মুখ দেখেননি। এবারও দেখতে পাননি।
অন্যমুখ ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না কর্নেল।
কর্নেল ব্যাখ্যা করে বললেন–পোড়ো খনির সুড়ঙ্গে জীবজন্তুরা বাসা বাঁধে। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণেও কোনও জায়গায় ফাটল দেখা যায়। জীবজন্তুদের স্বভাব হচ্ছে, ঢোকার মুখ পেলেই সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারে বেরিয়ে যাবার একটা মুখ খোঁজে। না থাকলে নখের আঁচড়ে গর্ত করে সেটা বানিয়ে নেয়। সজারু ইত্যাদি কয়েক রকম গর্তবাসী প্রাণীর এ অভ্যেস আছে। আমরা ওখানে অজস্র সজারুর কাটা পড়ে থাকতে দেখেছি বলেই অন্যমুখ খুঁজছিলুম। কিন্তু তেমন কিছু দেখলুম না। হয়তো ছোট্ট ফোকর থাকতে পারে–তা দিয়ে মানুষ ঢোকা বা বেরুনো অসম্ভব।
বাইরে লাশটা এসেছে। আমরা বেরিয়ে গেলুম। চাদরে ঢাকা লাশটা বারান্দায় খাটিয়াতে রাখা হচ্ছিল। সর্বেশ্বরী তখনও ঘরের ভেতরে আছেন। ভেতরে অন্ধকার। শর্মা দারোগাবাবুর সামনে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। সম্ভবত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন এতক্ষণ।
কর্নেল গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। ইন্দ্রনাথ এদিকের ঘরে এসে ঢুকলেন। আমি একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর ইন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলতে ফিরে এলুম। ঘরে ঢুকে দেখি, ইন্দ্রনাথ ব্যস্তভাবে বিছানা হাতড়াচ্ছেন। বললুম–কী খুঁজছেন?
ইন্দ্রনাথ কোনও জবাব না দিয়ে স্যুটকেসটা টানলেন। তারপর বলে উঠলেন—হুঁ। যা ভেবেছিলুম, তাই!
কী মিঃ রায়?
ইন্দ্রনাথ গম্ভীর মুখে উঠে তার খাটে বসলেন। বললেন–নিশ্চয় সৌম্যের কাজ। আমি যখন ঘাটে ছিলুম, ও এসে স্যুটকেসের তলা ভেঙেছিল। এ ছাড়া আর কে ভাঙবে?
-কেন বলুন তো ইন্দ্রনাথবাবু!
ইন্দ্রনাথের মুখটা লাল হয়ে উঠল। নিজেকে সংযত করে আস্তে আস্তে বললেন–ওর মাথায় একটা অদ্ভুত বোকামি ঢুকে পড়েছিল। ও ভাবত, খনিতে কোনও গুপ্তধন আছে এবং তার সন্ধান আমার হাতে আছে। বরাবর সুযোগ পেলেই আমার জিনিসপত্র হাতড়ানো অভ্যাস ছিল ওর।
ওঁকে সেই কাগজের কথাটা বলার জন্যে খুব ইচ্ছে সত্ত্বেও চেপে গেলুম। কিন্তু আমার মাথায় টিকটিকির উৎপাত। তাই কৌশলে প্রশ্ন করলুম-কিছু খোওয়া গেছে দেখলেন, মিঃ রায়?
ইন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়েই জবাব দিলেন–হ্যাঁ। কলকাতায় বড়শি কেনার সময় দোকানদার আমাকে একটুকরো কাগজের মোড়কে সেটা জড়িয়ে দিয়েছিল। এখানে এসে মোড়কটা খুলে দেখি, ওটা একটা ডাইরি বইয়ের ছেঁড়াপাতা। লেখা ছিল C? ইংরেজি হরফে। কিন্তু তারিখটা দেখে অবাক হয়েছিলুম। ১৯৬৮ সালের ১৭ আগস্ট, রবিবার। ওইদিনই কাকা মারা যান। এটা নিছক দৈবাৎ যোগাযোগ ছাড়া কিছু নয়। তবু মনটা একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ওটা বালিশের তলায় এমনি-এমনি রেখে দিয়েছিলুম। সেটা এখন আর পাচ্ছি না।
এবার আর না বলে পারলুম না যে ওটা দলাপাকানো অবস্থায় আমিই পেয়েছি এবং কর্নেলকে দিয়েছি। শুনে ইন্দ্রনাথ হতাশভাবে মাথাটা দোলালেন। বললেন– বেশ বুঝতে পারছি। সৌম্যই ওটা হাতড়ে বের করেছিল। তারপর মাথামুণ্ডু বুঝতে পেরে ফেলে দিয়েছিল দলা পাকিয়ে। হয়তো ভেবেছিল, Cকথাটা মুখস্থ রাখা যখন সোজা, তখন কেন চুরি করি দাদার কাছ থেকে?
কিন্তু যেভাবে ছিল, সেভাবেই রাখতে পারত?
সৌম্যের স্বভাব এই। সহজে রেগে যেত। অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনা নিয়ে থাকত। খুব খেয়ালী ছেলে ও। ভেবে কোনও কাজ করা ওর স্বভাবে ছিল না।
হঠাৎ কর্নেল ঢুকে বললেন ইন্দ্রনাথবাবু, রঘুবীর আর রাঁধুনী লোকটাকেই মিঃ লাল আসামী হিসেবে চালান দিচ্ছেন। আমার কোনও কথা কানে তুললেন না।
ইন্দ্রনাথ উত্তেজিতভাবে বললেন–সে কী! কেন?
রাঁধুনীই বিপদটা ডেকে আনল। সৌম্যেন্দুকে যে ছুরিটা মারা হয়েছে, সেটা নাকি কিচেনেরই ছুরি। বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া একবার নাকি রঘুবীর বিকেলে কিচেনে ঢুকে ছুরিটার খোঁজ করেছিল।
ইন্দ্রনাথ বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল আমার পাশে বসে বললেন–তোমাদের আলোচনার শেষাংশ আমি শুনে নিয়েছি, জয়ন্ত। না–এ জন্যে লজ্জা পাবার কিছু নেই। তুমি মুখটা অমন হাঁড়ি করো না। এবার একটা অদ্ভুত ব্যাপার শোনো। বঁড়শি একটা মোড়কে ছিল, তা সত্যি। কিন্তু সেই ওরিজিন্যাল মোড়ক বদলে এখানে আসার পর কেউ দ্বিতীয় মোড়কটা পাচার করে। ওরিজিন্যালটা আমি এইমাত্র কুড়িয়ে পেয়েছি বারান্দার নিচে। এই দেখ।
মোড়কটা দাদহাজার বিজ্ঞাপনের কাগজ। দেখে নিয়ে বললুম–মোড়ক বদলানোর উদ্দেশ্য কী?
ইন্দ্রনাথকে সম্ভবত উত্যক্ত করা।
বুঝলুম না।
–সি স্কোয়ার কথাটা এবং ওই তারিখ সম্ভবত ইন্দ্রনাথের ওপর কেমন প্রভাব সৃষ্টি করে কেউ দেখতে চেয়েছিল। বলা বাহুল্য, ইন্দ্রনাথ কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন বই কি।
-কিন্তু কে সে?
–যে ছুরি চুরি করেছে এবং সৌম্যেন্দুকে হত্যা করেছে। সে ছাড়া নিশ্চয় আর কউ নয়। এবং যে দু-ধরনের দাগ মেঝেয় আছে, তার মধ্যে সবুজ দাগ যদি ৗম্যেন্দুর জুতোর হয়, কালো দাগ নিশ্চয় সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির জুতো থেকে য়েছে।
কর্নেলের এই কথায় রহস্যের জট আরও পাকিয়ে গেল। আমি গুম হয়ে রইলুম। এমন অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের পাল্লায় কখনও পড়িনি।..
ডিনার খাওয়া হবে না জানতুন। বিস্কুট আপেল আর কফি খেয়ে শুয়ে পরলুম। আমরা। মিঃ লালের সবুর সইছিল না। আসামী দুজনকে নিজের জীপে তিনজন কনস্টেবলের সঙ্গে চালান দিলেন সেই রাত্রেই। দুজন কনস্টেবল লাশের কাছে। পাহারায় রাখলেন এবং ডাইনিং টেবিলে বিছানা করে আরামে নাক ডাকাতে থাকলেন। ডাইনিংয়ের ওপাশে দুটো রুমের একটায় সর্বেশ্বরী, অন্যটায় শর্মা শুতে গেলেন। এ পাশের রুমে আমি, কর্নেল ও ইন্দ্ৰনাথ শুয়ে পড়লুম। বারান্দায় সেই ল্যাম্পটা জ্বলতে থাকল। বেচারা কনস্টেবল দুজনের জন্য আমার দুঃখ হচ্ছিল। কিন্তু মিঃ লালের কাছে ডিউটি ইজ ডিউটি।
শুয়ে জঙ্গলে রাতচরা জানোয়ারের ডাক শুনতে পাচ্ছিলুম মাঝে মাঝে। ঘুম আসছিল না। পাশে কর্নেলের কিন্তু দিব্যি নাক ডাকছে। জানালার পর্দার ফাঁকে তারা দেখা যাচ্ছে। তারপর একসময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে গেছি, কে জানে!
হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙে গেল। জেগে ওঠার পর টের পেলুম বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু গাছপালা থেকে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আমার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইয়ের আলোয় কোণার দিকে ইন্দ্রনাথকে দেখার চেষ্টা করলুম। দেখতে পেলুম না। ওঁর বিছানা খালি। তখন মাথার কাছ থেকে টর্চটা নিয়ে সাবধানে জ্বাললুম। ইন্দ্রনাথ নেই। বাথরুমে ঢুকেছে কি? কিন্তু বাথরুমের দরজা বাইরে থেকেই বন্ধ। তখন ঘরের দরজায় আলো ফেললুম। দরজার ছিটকিনি খোলা কপাট দুটো ঠেস দেওয়া রয়েছে। তার মানে ইন্দ্রনাথ বেরিয়েছেন।
আলো নিভিয়ে কর্নেলের গায়ে হাত রাখলুম। অমনি আমার হাতটা চেপে ধরে ফিসফিস করে বললেন–চুপচাপ শুয়ে থাকো।
তাহলে কর্নেল জেগে আছেন! নিশ্চয় সব লক্ষ্য করছেন কখন থেকে। উত্তেজনায় অধীর হয়ে শুয়ে রইলুম।
প্রায় দুঘণ্টা কেটে গেল। সময় যে আসলে এত দীর্ঘ, তা এই প্রথম জানলুম। তারপর দরজাটা নিঃশব্দে ফাঁক হলো, বাইরের আলো এল একটুখানি। দেখলুম ইন্দ্রনাথ ঢুকছে। খালি গা, পরনে শুধু আণ্ডারওয়্যার, পায়ে কেডস। ওঁর হাতে যা দেখলুম, তাতে গা শিউরে উঠল। একটা রিভলভার।
ইন্দ্রনাথ নিঃশব্দে দরজাটা এঁটে দিলেন। তারপর অন্ধকারে কীভাবে জুতো খুলে শুলেন, টের পেলুম না। একটু পরেই শুনি ওঁর নাক ডাকছে। তখন খুব হাসি পেল। কর্নেলকে খুঁচিয়ে দিলুম। কর্নেলও শুনি এবার নাক ডাকাচ্ছেন। অদ্ভুত লোক তো!
এইসময় আবার বৃষ্টি এল। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে আমার ঘুমের সম্পর্ক নিশ্চয় নিবিড়। ফলে আবার চোখের পাতা খুঁজে এল।
কী একটা স্বপ্ন দেখছিলুম, হঠাৎ স্বপ্নটা ছিঁড়ে এবং ঘুমটাকে বরবাদ করে কোথাও কোনও জন্তু গর্জে উঠল যেন। জাগার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলুম ইন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং আলো জ্বেলেছেন। আমাকে জাগতে দেখে বললেন–আসুন তো জয়ন্তবাবু, পাশের ঘরে কী গণ্ডগোল হচ্ছে মনে হলো।
কিছু একটা হচ্ছে তা ঠিকই। ধস্তাধস্তির এবং চাপা গর্জনের আওয়াজ। ঘুরে দেখি কর্নেল নেই বিছানায়। বেরিয়ে গেছেন। আমিও বেরোলুম। বারান্দায় যেতেই ডাইনিং থেকে মিঃ লালের চিৎকার শুনলুম–হ্যাণ্ডস আপ!
বারান্দায় যে সেপাই লাশের পাশে ঘাড় গুঁজে একটা কম্বলে পড়ে ছিল, তারা আচমকা জেগে রাইফেল বাগিয়ে ধরল। মিঃ লাল ফের চেঁচালেন বুধন সিং! সূরযলাল! মেরা টারচ খো গ্যয়া। জলদি বাত্তি লে আও!
কয়েক সেকেণ্ডে এসব ঘটে গেল। বারান্দা থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে সেপাইরা ডাইনিংয়ে ঢুকল। আমরাও ঢুকলুম। ঢুকে হাঁ করে তাকালুম। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য।
কর্নেল দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন–দুহাত মাথার ওপরে তোলা। রাতের জামা ছিঁড়ে ফর্দাফাই। ঝুলছে কোমরের নিচে অব্দি। মুখে অপ্রস্তুত হাসি।
তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মিঃ লাল রিভলভার তুলে শাসাচ্ছেন। আর কোনও কথা শুনব না। দেখেই আঁচ করেছিলুম, এ ব্যাটা নিশ্চয় একজন এক নম্বর চারশো বিশ। আমার চোখ এড়িয়ে যাবে? কত খুনী জোচ্চোর দেখলুম অ্যাদ্দিন!
খুব রাগ হলো আমার। বললুম–দেখুন মিঃ লাল, আপনি ভুল করছেন। উনি বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ওঁর পরিচয়পত্র আপনি দেখেছেন। ওঁকে এভাবে অপমান করাটা আপনার মোটেও উচিত হচ্ছে না। এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে কিন্তু!
মিঃ লাল তুমুল গর্জন করে বললেন–ইউ শাট আপ! আপনাকেও আমি ও ব্যাটার সহযোগী বলে গ্রেপ্তার করব।
ইতিমধ্যে দুপাশের দুটো দরজা খুলে সর্বেশ্বরী এবং মিঃ শর্মা বেরিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকাচ্ছেন। ইন্দ্রনাথ বললেন মিঃ লাল, ব্যাপারটা কী হয়েছে বলুন তো?
মিঃ লাল হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন–মশাই, আমার এক চোখ ঘুমোয়, অন্য চোখ জাগে। কপাট ফাঁক করে ও ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়েছি কী মাল! : ভাবলুম কী করে দেখা যাক। ও করল কী, একটা ক্ষুদে টর্চের সাহায্যে দেয়াল হাতড়ানো শুরু করল। তারপর দেখি, ওই দেয়াল আলমারিটার একটা ড্রয়ার টানাটানি করছে। তারপর ড্রয়ার খুলে ফেলল দেখলুম। কী একটা বের করল। তখন আমি নেমে পা টিপে টিপে টেবিলের পিছনে গেলুম। যেই বাছাধন আসা, অমনি জাপটে ধরলুম। ভুল করে টর্চটা হাতে নিইনি। যাই হোক, ব্যাটার গায়ে অসুরের বল। জুডোর প্যাঁচে আমাকে ছিটকে ফেলে দিলে। আমি ওর জামা খামচে ধরেছিলুম। ওই দেখুন না। তারপর উঠে এক লাফে বিছানায় গিয়ে রিভলভার হাতে নিলুম।….
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–আপনি ভুল করছেন মিঃ লাল। আমি আপনাকে ফেলে দিইনি। বরং আপনিই আমাকে….
শাট আপ! গর্জালেন মিঃ লাল।
সর্বেশ্বরীকে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখলুম। মিঃ শর্মা এগিয়ে এসে বললেন–ড্রয়ার থেকে উনি কী বের করেছেন, সেটা এবার সার্চ করা উচিত মিঃ লাল। জয়দীপ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তার ড্রয়ারে উনি কেন রাতদুপুরে হাত ভরতে গেলেন জানা দরকার।
মিঃ লাল এগিয়ে কর্নেলের রাতের পাজামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কালো বাঁধানো নোটবই কিংবা ডায়রি বের করে নিলেন। মিঃ শর্মা এবং ইন্দ্রনাথ দুজনে একই সঙ্গে হাত বাড়িয়ে বললেন–দেখি, দেখি ওটা কী?
মিঃ লাল হয়তো ওঁদের একজনের হাতে দিয়েই ফেলতেন বইটা। কিন্তু : কর্নেল এক লাফে সরে এসে বাধা দিলেন।খবরদার মিঃ লাল! এই ডায়রি ওঁদের হাতে দেবেন না। এটা একটা ভেরি ইমপরট্যান্ট ডকুমেন্ট!
মিঃ লাল রিভলভার তুলে বললেন হ্যাঁণ্ডস্ আপ। নয়তো গুলি ছুঁড়ব!
অমনি কর্নেল দুহাত তুলে দাঁড়ালেন। আমি হাসব না কাদব ভেবে পেলুম না। ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কর্নেল ফের বললেন–মিঃ লাল, প্লীজ! ওই ডায়রি সরকারের সম্পত্তি। কারো হাতে দিলে আপনিই বিপদে পড়বেন। আর দু-এক ঘণ্টার মধ্যে ডিটেকটিভ ডিপার্টের অফিসাররা এসে পড়বেন জব্বলপুর থেকে। ততক্ষণ আপনার অপেক্ষা করা কর্তব্য।
মিঃ লাল অমনি ভড়কে গিয়ে বললেন–ডিটেকটিভ ডিপার্টের লোক আসবে? তার মানে?
ইন্দ্রনাথ বললেন–হ্যাঁ। আমি টেলিফোন করে এসেছি কর্নেলের কথায়।
মুখ বিকৃত করে মিঃ লাল বললেন–ভাল করেছেন! এবার দেখুন মশা মারতে কামান দেগে কী অবস্থা হয়। সব জড়িয়ে পড়বেন মাইণ্ড দ্যাট! একজন জোচ্চোরের কথায় আপনি……
বাধা দিয়ে বললুম–মিঃ লাল, আবার আপনি অন্যায় করছেন। ওঁকে এসব কদর্য কথা বলার জন্যে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে।
এবার মিঃ লাল আর গর্জালেন না। গম্ভীর মুখে বললেন–আপনিও ভাববেন যে জার্নালিস্ট বলে আপনি বেঁচে যাবেন। ইয়েস–লেট দেম কাম। কিন্তু ততক্ষণ এই লোকটা আর আপনি দুজনেই এই ঘরে বসে থাকুন। ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট।
কর্নেল আমাকে চোখ টিপলেন। হাসি টিপে বললুম–বেশ। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন, উনি বুড়োমানুষ ওভাবে হাত তুলে কতক্ষণ থাকবেন?
মিঃ লাল ধমক দিয়ে বললেন–হ্যাণ্ডস ডাউন।
ঘরের ভেতর বসে নিঃশব্দে আমরা ভোরের প্রতীক্ষা করতে থাকলুম। তখন রাত চারটে বেয়াল্লিশ। বৃষ্টি সমানে পড়ছে।……
ভোরেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। মিঃ লাল টেবিলের বাতির সামনে সেই কালো নোটবই পড়ছিলেন আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে ঘুরে তাকাচ্ছিলেন। দুজন সেপাই দরজায় বন্দুক বাগিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। কিন্তু অবাক লাগল, শর্মা এবং ইন্দ্রনাথ ও ঘর ছেড়ে শুতে যাননি। দুটি লুব্ধ জন্তুর মতো মিঃ লালের নোটবইটার দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে থাকলেন। আমরা দুজন তো মিঃ লালের বন্দী, তাই ঘর ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে না। বেচারা কর্নেলের জন্য দুঃখ হচ্ছিল। ওঁর হাতির বরাত, এমন মশা বনে যেতে কখনও দেখিনি! চালে ভুল করেই এই দুর্দশায় পড়েছেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মিঃ লালের খপ্পরে এভাবে পড়ে যাবেন, ভাবেননি। ভাবছিলুম, কর্নেলকে যথেষ্ট বকে দেব। নির্ঘাৎ এবার ওঁকে বাহাওরে ভীমরতি ধরেছে! এভাবে সেখানে যা খুশি করে ফেলে নিজেও বিপদে পড়বেন– আমাকেও ফেলবেন। কোনও মানে হয় না!
কিন্তু ওঁর মুখটা নির্বিকার। মিটিমিটি হাসছেন আর হাসছেন। কী লোক রে বাবা!
সবে পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, মিঃ লালের পড়া শেষ হলো। নোট বইটা বুজিয়ে কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। বললেন, বোঝা গেল শ্রীমান চারশো বিশের আগমনের উদ্দেশ্য। ইন্দ্রনাথবাবু, মিঃ শর্মা! আপনাদের সাক্ষ্যের ওপর সব নির্ভর করছে–মাইণ্ড দ্যাট।
ইন্দ্রনাথ বললেন–মিঃ লাল, কী লেখা আছে ওতে বলবেন কি?
মিঃ লাল কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল বাধা দিলেন। মিঃ লাল, আবার। আপনাকে, আমি সতর্ক করে দিচ্ছি। ওই ডায়রি বইটা সৌম্যেন্দুর হত্যকাণ্ডের ব্যাপারে একটা মূল্যবান দলিল।
মিঃ লালের ঠোঁট ফাঁক হলো, কিন্তু কথা বেরুবার আগেই দরজা খুলে ফের সর্বেশ্বরী বেরুলেন। মনে হলো, বৃদ্ধা এতক্ষণ ঘুমোননি। জেগেই ছিলেন। বললেন– মিঃ লাল, ওই ডায়রিটার কথা আমি জানতুম। ওটা আমার স্বামীর ডায়রি। ওতে কী আছে, তা আমার স্বামী অবশ্য কখনও জানাননি–জানতেও চাইনি। এখন মনে হচ্ছে, ওর মধ্যে এমন কিছু আছে–যার জন্য সৌম্যেন্দুর প্রাণ দিতে হলো। ওটা কি আমাকে একবার দেখতে দেবেন?
মিঃ লাল কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাজড়িত স্বরে বললেন কিন্তু এটা এখন আদালতের একজিবিট হবার যোগ্য। তাই আপনাকে দেখানো যাবে কি?
কর্নেল বললেন–ওঁকে একবার পড়তে দিতে আমার আপত্তি নেই। কারণ উনিই এই হত্যাকাণ্ডের মামলার প্রধান সাক্ষী হবেন।
–আপনি থামুন! বলে মিঃ লাল সর্বেশ্বরীর দিকে ঘুরলেন। মিসেস রায়, এটা আমার হাতেই থাকবে। আপনি এখানে এসে পড়ে দেখুন।
সর্বেশ্বরী এগিয়ে গিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। মিঃ লাল ডায়রিটা খুলে ধরলেন। কয়েক পাতা পড়ার পর সর্বেশ্বরীর মুখে অদ্ভুত ভাবান্তর লক্ষ্য করলুম। মনে হলো, উনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। আমরা সবাই চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
পড়া শেষ হলে সর্বেশ্বরী কর্নেলের দিকে ঘুরে বললেন-কর্নেল সরকার! আপনি কীভাবে এটার খোঁজ পেলেন বলবেন কি?
কর্নেল বললেন-বলতে আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে দয়া করে আমার প্রশ্নের জবাব দিন। এই সংকেতটি কি আপনার পরিচিত?
সর্বেশ্বরী ভুরু কুঁচকে বললেন—হ্যাঁ। কেন?
–এর অর্থ কি আপনি জানতেন?
না। কারণ, আমার স্বামী এর অর্থ আমাকে জানাননি। তিনি বেশ কয়েকদিন আমাকে বলেছিলেন–যদি আমি হঠাৎ মারা পড়ি, তুমি C? এই কথাটা মনে রাখবে এবং সৌম্যেন্দুকে জানাবে। ওর সব কথাই ওই রকম হেঁয়ালিতে ভরা থাকত। ভাবতুম ড্রিঙ্কস-এর ঘোরে আবোল তাবোল বকছেন।
–সৌম্যেন্দুকে আপনি জানিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ। ওর মৃত্যুর পর জানিয়েছিলুম। সৌম্যেন্দু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল-কাকামশাইয়ের পাগলামি!
কর্নেল ইন্দ্রনাথকে জিগ্যেস করলেন–আপনি এর আগে C? কথাটা শুনেছিলেন?
ইন্দ্রনাথ গম্ভীরমুখে বললেন না। এখানে আসার পর বঁড়শির মোড়কে লেখা দেখেছিলুম।
কর্নেল সর্বেশ্বরীকে বললেন–মিসেস রায়, লুকোবার কারণ নেই। এবার বলুন তো, আপনিই ইন্দ্রনাথ বাবুর বড়শির মোড়ক বদলে C? লেখা ডায়রির একটা পাতা ও ঘরে রেখেছিলেন কি না?
সর্বেশ্বরী মুখ নামিয়ে জবাব দিলেন–হ্যাঁ। আমার স্বামী যেদিন মারা যান, সেদিনই আনমনে কথাটা অন্য একটা ডায়রির পাতায় আমি লিখেছিলুম। ইন্দ্রনাথ এবার এখানে আসার পর আমার সন্দেহ হলো যে নিশ্চয় একটা কিছু ঘটতে চলেছে–যার কোনও কিছু আমি জানি না। তাই ওই পাতাটা ওর নজরে এনে দেখতে চেয়েছিলুম, ও কী করে।
ইন্দ্ৰনাথ শুকনো হেসে বললেন–অবাক হয়েছিলুম তারিখটা দেখে। কিন্তু ওই কথাটার মানে কী, আমি তো জানতুম না। এখনও জানি না।
কর্নেল মিঃ শর্মার দিকে ঘুরে বললেন–আপনি কিছু জানতেন?
শর্মা অন্যমনস্ক ছিলেন যেন। চমকে উঠে মাথা দোলালেন। ওদিকে মিঃ লাল এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন। এবার হাত নেড়ে বললেন–খুব হয়েছে। এটা আদালত নয় এবং ওই লোকটা সরকারী কৌসুলী নয়। সে অধিকার আমি ওকে দিইনি।
সেই সময় বাইরে জিপের গর্জন শোনা গেল। তখন সূর্যের হাল্কা আলো এসে লন পেরিয়ে বারান্দা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকছে। দুটো জিপ দেখা গেল লনে। তারপর ক’জন পুলিশ অফিসার এবং দুজন সিভিলিয়ানের পোশাক পরা ভদ্রলোক জিপ থেকে নেমে বারান্দায় উঠলেন। একজন ঢুকতে ঢুকতে বললেন কই? কোথায় আমাদের মাননীয় কর্নেল সাহেব?…ও হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো!
আমি অবাক হলুম না। মিঃ লাল ভীষণ অবাক হলেন নিশ্চয়। কর্নেলের হাত ধরে সেই ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন–একি কর্নেল সরকার! আপনার এ অবস্থা কেন?
কর্নেল স্মিত হেসে বললেন–ও কিছু না মিঃ আচারিয়া! ও কিছু না! আপনি কেমন আছেন? ইস! দীর্ঘ ছ-সাত মাস পরে দেখা। তাই না?
মিঃ আচারিয়া তখনও অবাক। আমি এবার মিঃ লালের কীর্তি ফাঁস করতে যাচ্ছি, টের পেয়েই কর্নেল আমার হাত ধরে বললেন–মিঃ আচারিয়া, আগে আলাপ করিয়ে দিই আমার এই তরুণ বন্ধুর সঙ্গে। জয়ন্ত চৌধুরী কলকাতার প্রখ্যাত সংবাদপত্র দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার। জয়ন্ত, ইনি আমার এক বন্ধু ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ চন্দ্রমোহন আচারিয়া।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মিঃ লাল ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছেন এবং সূর্যোদয়ই দেখছেন হয়তো।
হঠাৎ সর্বেশ্বরী বলে উঠলেন–আপনারা বসুন, প্লীজ। আমি আপনাদের কফির ব্যবস্থা করি। কেউ কিছু বলার আগেই বৃদ্ধা কিচেনের দিকে চলে গেলেন।…
ডায়রিতে কী লেখা ছিল, পরে জেনেছিলুম। কিন্তু ঘটনা আগাগোড়া সাজানোর খাতিরে সেটা এখানেই দেওয়া হলো। সংক্ষিপ্তভাবেই বলছি :
জগদীপ রায় একবার বোম্বাইয়ের এক পানশালায় হিগিনস নামে একজন প্রাক্তন ব্রিটিশ যোদ্ধার সঙ্গে পরিচিত হন। হিগিনস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেফটন্যান্ট মেজর ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার পরও তিনি এদেশে থেকে যান। এবং অবসর নেন। হিগিনস বেজায় মদ খেতেন। সেই পানশালায় জগদীপের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় তখন ওঁর প্রচণ্ড মাতাল অবস্থা। তখন জগদীপ ওঁকে ওঁর বাসায় পৌঁছে দিতে যান। হিগিনস ব্যাচেলার ছিলেন। যাইহোক, গাড়িতে নিয়ে যাবার সময় এবং বাসায় গিয়ে নেশার ঘোরে এমন কিছু কথা বলেন, জগদীপের তাক লেগে যায়।
হিগিনস যুদ্ধের সময় মধ্যপ্রদেশের এই এলাকার এক রাজপ্রাসাদে ছিলেন। বলাবাহুল্য বাড়িটি এক দেশীয় রাজার এবং তা ব্রিটিশ সরকার সেনানিবাস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দখল করে নেন। সেই বাড়িতে যেভাবেই হোক, হিগিনস এবং তিনজন সহযোদ্ধা মিলে একটি বাক্স পেয়ে যান। বাক্সে সোনাদানা হীরে জহরত ছিল বোঝাই হয়ে। এই গুপ্তধন পাওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয়। সবার চোখ এড়িয়ে এগুলো ভাগাভাগি করা কঠিন। কারণ সেনানিবাসে সব সময় ভিড়। তাছাড়া কাকে কোন মুহূর্তে কোথায় পাঠানো হবে, ঠিক নেই। ধনসম্পদের ভাগ নিয়ে রাখবেন কোথায়? চার বন্ধু মিলে এই চিরিমিরি জঙ্গলে এসে লেকের পশ্চিম উপত্যকায়–যেখানে পরে সীসের খনি খোঁড়া হয়, সেখানে। পুঁতে রাখেন। কথা রইল–যুদ্ধ শেষ হলে ওটা ভাগাভাগি করে নেওয়া হবে। ঘটনাচক্রে বর্মা ফ্রন্টে হিগিনস বাদে সবাই মারা পড়েন। হিগিনস ফিরে এসে গুপ্তধনের খোঁজ করেন। কিন্তু তিনবছরের মধ্যে এক ভূমিকম্পে উপত্যকার মাটি ওলটপালট হয়ে গেছে। ফলে হিগিনস খুঁজে বাক্সটা বের করতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসকরা চলে গেলেন। কিন্তু বাধ্য হয়ে হিগিনসকে থাকতে হলো। এখন তাঁর একমাত্র কাজ, বারবার চিরিমিরি উপত্যকায় যাওয়া এবং অনুসন্ধান।
গুপ্তধনের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড নেশাধরানো লোভ আছে। জগদীপ সেই লোভে পড়ে গেলেন এবং গোপনে একা তল্লাস শুরু করলেন। কিন্তু বারবার ওখানে শিকার কিংবা ছিপে মাছধরার অজুহাত কাঁহাতক দেখানো যায়। বিশেষ করে ক্রমাগত সপ্তাহ কিংবা মাসও লেগে যেতে পারে। অতএব উনি ফন্দি আঁটলেন। অনন্তরাম শর্মা ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং খনি ইঞ্জিনিয়ার। ওই উপত্যকায় কোনও খনিজ সম্পদ থাকা সম্ভব বলে মনে হয়েছিল জগদীপের। ওঁর ভাগ্য ভাল শর্মা মাটি পরীক্ষা করে জানালেন, তলায় সীসের খনি আছে। জগদীপ ভূপালের নবাবের কাছে বন্দোবস্ত নিলেন জায়গাটার। খনির কাজ শুরু হলো। কিন্তু সেই গুপ্তধনের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না।…….
এরপর জগদীপের নিজের ভাষায় ডায়রির শেষাংশ তুলে দিচ্ছি। তারিখ ১৬ আগস্ট। অর্থাৎ ওঁর মৃত্যুর আগের দিন।
..আজ আমি জীবনের এক ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলুম। শেষ তিনটি পিট সাবধানতার জন্য বুজিয়ে দেওয়া দরকার। তাই শর্মাকে নিয়ে বেরিয়েছিলুম। শর্মা কিছুক্ষণ পরীক্ষার পর মাছ ধরতে গেল লেকে। আমি বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এতগুলো বছর আমার বৃথা চলে গেল। এবার ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে এই উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
….আনমনে বড় সুড়ঙ্গের কাছে যেই গেছি, হঠাৎ দেখি এক আজব মূর্তি। প্রথমে চিনতে পারিনি–পরক্ষণে চিনলুম। হিগিনস! কিন্তু এ কী মূর্তি তার! মাথায় একরাশ চুল, মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল, পরনে মাত্র একটা ঘেঁড়া হাফপ্যান্ট হাতে বড়বড় নখ, সারা গা নোংরা–খালি পা–সে আমাকে দেখামাত্র অমানুষিকভাবে হেসে উঠল। ও নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছে! শিউরে উঠলুম ওর পরিণতি দেখে। তাহলে কি একদিন আমারও ওই পরিণতি ঘটবে?
….হঠাৎ হিগিনস জন্তুর মতো গর্জন করে আমাকে তেড়ে এল। পকেট থেকে। পিস্তল বের করে ছুঁড়লুম। গুলি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো। হিগিনস অমনি ঘুরে সুড়ঙ্গে গিয়ে ঢুকল। আমার মধ্যে তখন খুনের নেশা জেগেছে। সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লুম। আন্দাজে গুলি ছুঁড়লুম পাগলের মতো। মনে হলো হিগিনস হাসছে কোথায়। কানের ভুল হতেও পারে।…
….ঠিক করেছি, হিগিনসকে শেষ করতেই হবে। আগামীকাল টর্চ নিয়ে ওই সুড়ঙ্গে ঢুকব। ওকে খুঁজে বের করে হত্যা করব। ও আমার লোভের জন্য দায়ী। ও আমার জীবনের সুখশান্তি নষ্ট করার মূলে। আজ আমার চোখে শুধু হীরেপান্না জহরতের ঝলমলানি। এ কী অদ্ভুত অভিশাপ! খেতে ঘুমোতে সবসময় ওই গুপ্তধন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঘুমোতে পারিনে–খাওয়া ফেলে উঠে পড়ি। আমার জীবনীশক্তি দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শয়তান হিগিনসই এর জন্যে দায়ী….
বেশ বোঝা যায়, ১৭ আগস্ট হিগনসকে হত্যার উদ্দেশ্যে জগদীপ সুড়ঙ্গে ঢোকেন এবং সম্ভবত হার্টফেল করে মারা পড়েন। ওই মানসিক অবস্থায় এটা স্বাভাবিক ছিল।
সেই সঙ্গে বোঝা গেল সর্বেশ্বরী যে সাধুর কথা বলেন, সে কে। কিন্তু হিগিনস কি এখনও বেঁচে আছেন এবং সুড়ঙ্গে থেকে অভিশপ্ত গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছেন?
আর C2 কথার অর্থ কি, কর্নেল আমাকে জানিয়েছে। ওটা দুর্বোধ্য কিছু নয়। ক্যাবিনেট নম্বর টু। ডাইনিংয়ের দেয়াল আলমারির দুনম্বর খোপ। কর্নেল নিছক অনুমানের ভিত্তিতে কাজে নেমেছিলেন এবং অনুমানটা মিথ্যে হয়নি।
আচারিয়া কর্নেলের দুর্দশার কথা শুনে হেসে খুন। ততক্ষণে মিঃ লাল পুরোপুরি বদলে গেছে এবং কর্নেলের উদ্দেশ্যে বারবার বলছেন–খুব দুঃখিত। কিন্তু স্যার, আমার কর্তব্যজ্ঞানই এ জন্যে দায়ী। কর্নেল মিঃ লালের একটা হাত সস্নেহে টেনে নিয়ে তার উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস এবং দক্ষতার প্রশংসা করার পর দেখা গেল, দুজনে পাশাপাশি হাঁটছেন, বসছেন। কর্নেলের এ সব ব্যাপারে জুড়ি নেই। সব অপ্রীতিকর স্মৃতি ঘুচিয়ে দিতে তিনি পটু। অতএব, আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছি।
কর্নেল এবং পুলিশ অফিসাররা সবাই ঘাট ঘুরে খনি উপত্যকায় চলে গেলেন। রাতে ভাল ঘুম হয়নি–তাই আমার ক্লান্তি লাগছিল। ভাবলুম ওঁরা তদন্ত করুন– আমি একটু গড়িয়ে নিই।
গড়াচ্ছি, হঠাৎ কানে এল সর্বেশ্বরী ও ইন্দ্রনাথ পাশের ডাইনিংয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন। উঠে বারান্দায় গেলুম। তখন অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। একটু পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। সেপাইরা এবং অ্যাম্বুলেন্সকর্মীরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিঃ শর্মাকে দেখতে পেলুম না কোথাও। অথচ উনি কর্নেলদের সঙ্গেও যাননি। শরীর খারাপ বলে নিজের ঘরে ঢুকেছিলেন। সেই ঘরের দরজা খোলা এবং বিছানা শূন্য দেখা যাচ্ছে। বারান্দা থেকে ডাইনিংয়ের দরজা দিয়ে সেটা আমার চোখে পড়ছিল।
সর্বেশ্বরী তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ইন্দ্রনাথ একটু তফাতে। আমি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকলুম।
সর্বেশ্বরী। তুমি দেব-দেবতা ভগবান–যার নামই নাও, আমি ও কথা বিশ্বাস করি না।
ইন্দ্রনাথ। আপনার বিশ্বাস করা না করায় আমার কিছু যায় আসে না।
সর্বেশ্বরী। হ্যাঁ, তা তো বটেই। এখন ওকথা বলবে বইকি! মানুষ হয়ে গেছ এখন তো আর আমার কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু জেনে রেখো, আমার একটি পয়সাও তুমি আশা কোরো না।
ইন্দ্র। নিশ্চয় করি না। আপনার সম্পত্তি যা খুশি করুন, আমি কিছু বলতে চাইনে। কিন্তু দোহাই আপনার, ওই মিথ্যে বদনাম দেবেন না।
সর্বেশ্বরী। একশো বার দেব। সাধুবাবা স্বয়ং আমাকে বলে গেলেন। ফাইলটা তুমিই হাতিয়েছ।
ইন্দ্র। (বিকৃত হেসে) সাধুবাবা! আপনার ওসব গাঁজাখুরি ব্যাপারে আমার কোনওদিন বিশ্বাস ছিল না–এখনও নেই।
সর্বেশ্বরী। (ক্ষেপে গিয়ে) আমি এ ঘর থেকে তোমার পায়ের শব্দ পেয়েছিলুম কাল বিকেলে। উঠে এসে দেখি, তুমি ঝোপের মধ্যে চলে যাচ্ছ।
ইন্দ্র। আপনি পায়ের শব্দ বুঝতে পারেন?
সর্বেশ্বরী। নিশ্চয় পারি!
ইন্দ্র। তাহলে শুনুন, যাকে দেখেছিলেন সে সৌম্য। আমি তাকে ফলো করে এসেছিলুম। ঝোপের আড়াল থেকে দেখলুম–সে এঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার হাতে কী একটা ছিল দূর থেকে বুঝতে পারলুম না।
সর্বেশ্বরী। আমি বিশ্বাস করি না।
ইন্দ্র। আপনার পা ছুঁয়ে বলব?
সর্বেশ্বরী। না–আমার পায়ে হাত দেবে না। নিজের ছোট ভাইকে খুন করেছে যে, তাকে ……. ।
ইন্দ্র। (আর্তস্বরে) কাকিমা! ওকে আমি খুন করিনি।
সর্বেশ্বরী। নিশ্চয় করেছ! যদি তোমার ওই কথাটা সত্যি হয় যে ফাইলটা সৌম্য নিয়ে যাচ্ছিল, তাহলে ওটা হাতাতে তুমিই খুন করেছ।
ইন্দ্র। (ভাঙা স্বরে) না না! ফাইলে কী ছিল আমি এখনও জানি না!
সর্বেশ্বরী। তুমি ন্যাকা!
এইসময় দূরে কোথাও গুলির শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠলাম। ফের। কয়েকবার শব্দ হতেই একটা হুলুস্থুল পড়ে গেল। সিপাইরা দৌড়ে ঘাটের দিকে গেল। ইন্দ্রনাথও বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখেই জিগ্যেস করলেন কী হলো জয়ন্তবাবু?
মাথা নেড়ে দৌড়ে গেলুম ঘাটের দিকে। গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলুম। লেকের জলে অনন্তরাম শর্মা গলাঅব্দি ডুবে রয়েছেন-দুহাত ওপরে তোলা। সবাই হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিঃ আচারিয়া চিৎকার করছেন–উঠে আসুন। বলছি। এক মিনিটের মধ্যে উঠে না এলে আবার গুলি ছুঁড়ব।
শর্মা আর্তনাদ করে বললেন–উঠছি। দোহাই! গুলি ছুড়বেন না। উনি এবার দুহাত তুলে ঘাটের দিকে আসতে থাকলেন। কর্নেল একটু দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। কাছে গিয়ে বললুম–এই নাটকের অর্থ কী কর্নেল?
কর্নেল বললেন–তুমি এখনও নাবালক, জয়ন্ত! বুঝতে পারছ না কিছু?
কী সর্বনাশ! শৰ্মাই কি সৌম্যেন্দুকে খুন করেছেন?
–হ্যাঁ।
–সে কী! কেন?
–হিগিনসের একটা ফাইল হাতাতে। চলো, বাংলোয় গিয়ে সব বলছি।
তবে শেষপর্যন্ত লেকের জলে সত্যিই মাছ ধরা হলো। তাই না? বলে কর্নেল সহাস্যে সেই ছড়াটা আওড়ালেন; ‘খোকন গেছে মাছ ধরতে…..’
ফাইলটার কথা একটু আগে সর্বেশ্বরী ও ইন্দ্রনাথের ঝগড়ার মধ্যে শুনেছি। বাংলোয় ফিরে বাকিটা শুনলুম বিশদ ব্যাখ্যা সহ। সর্বেশ্বরীও সব ফাঁস করে দিলেন।
হিগিনসই সর্বেশ্বরীর সাধুবাবা। কদিন আগে কলকাতা গিয়ে সর্বেশ্বরীকে একটা ছোট ফাইল দিয়ে আসেন। ইন্দ্রনাথ ব্যাপারটা টের পান। কিন্তু এর রহস্যটা কী জানতেন না। তাই কর্নেলের শরণাপন্ন হন। আশ্চর্য, কর্নেল আমাকেও কিছু খুলে বলেননি। যাই হোক, হিগিনস দেশে ফিরে গেছেন। গুপ্তধনের মায়া ত্যাগ করেই গেছেন। ওঁর ফাইলে উপত্যকার একটা ম্যাপ ছিল–১৯৪৩ সালের ম্যাপ। ম্যাপে গুপ্তধনের অবস্থান চিহ্নিত ছিল। কিন্তু ১৯৪৬-এর ভূমিকম্পে সব ওলটপালট হয়ে যায়। তাই হিগিনস বছরের পর বছরখোঁজাখুঁজি করেও পাত্তা পাননি। তাছাড়া বোঝাই যায়, ওঁর ক্রমশ মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছিল। তা না হলে হয়তো বের করা। অসম্ভবও হত না। জগদীপ তখন ফাইলটা পেলে নিশ্চয় হদিশ করতে পারতেন। এখন সর্বেশ্বরীর ভুল হলো–ফাইলের কথাটা শর্মাকে জানানো। শর্মা তক্কেতক্কে ছিলেন। সর্বেশ্বরী এখানে আসার পর ফাইলটা সতর্কতা হিসাবে সৌম্যেন্দুর বিছানার তলায় রেখে দেন। কারণ, শর্মার মতিগতির ওপর ক্রমশ তার সন্দেহ জাগছিল।
কর্নেল ও শর্মা চলে যাবার পর সর্বেশ্বরী রঘুবীরকে দিয়ে সৌম্যেন্দুকে ডাকতে পাঠান। সৌম্যেন্দু আসতে দেরি করে। সম্ভবত মাছে টোপ খাচ্ছিল তখন। সে একটু পরে এলে সর্বেশ্বরী তাকে বলেন, বিছানার তলায় যেটা আছে–সেটা সে যেন সাবধানে লুকিয়ে রাখে। কারণ, ওটা একটা দামী দলিল।
সৌম্যেন্দু দলিলের ফাইলটা নিয়ে চলে যায়, সে ঘাটে বসে পড়ে দেখার কথা ভেবেছিল। ওদিকে কর্নেল ও শর্মা গর্তগুলোর অন্যমুখ খুঁজছেন। ওই সময় এক ফকে কর্নেলের অজানতে শর্মা ফাইল চুরি করতে চলে আসেন। অভাবিত সুযোগ। সর্বেশ্বরী তখন একা আছেন। দরকার হলে তাকেও খুন করে ওটা হাতাবে। কিন্তু সৌম্যেন্দুর দুর্ভাগ্য, ঘাটে তখন ফাইলটা পড়ছে। শর্মা আগেই কিচেনের ছুরিটা হাতিয়েছিলেন। তাই দিয়ে সৌম্যেন্দুকে খুন করেন। ফাইলটা কেড়ে নেন। জঙ্গলে পাথর চাপা দিয়ে রেখে ভালমানুষের মতো কর্নেলের সামনে আবির্ভূত হন।
ইন্দ্রনাথ তার একটু আগে সৌম্যেন্দুকে বাংলোয় যেতে দেখে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু ফাইলটা যে সৌম্যেন্দু নিয়ে আসছে, বুঝতে পারেননি। নিজের ঘরে ঢুকে দেখে আসেন সৌম্যেন্দু বরাবরকার মতো তার জিনিসপত্র হাতড়াচ্ছে কি না। তার শ্যাওলাভরা জুতোর দাগ আমরা ঘরের মেঝেয় দেখেছি। কালো দাগগুলো শর্মার। শৰ্মা সৌম্যেন্দুকে খুন করার পর ওঘরে একবার ঢোকেন। কারণ, সর্বেশ্বরীর মোড়ক বদলানোটা তারই পরামর্শে। ইন্দ্রনাথের রি-অ্যাকশন জানা। যখন দেখলেন, ইন্দ্রনাথের নজরে মোড়কটা এসেছে এবং সযত্নে রাখা আছে উনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ওটা দলা পাকিয়ে ফেলে দেন। তখন খুন করার পর ওঁর বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। ফাইলটাও লুকোতে হবে। কিন্তু নিজের ঘরে গেলে সর্বেশ্বরীর চোখে পড়বে। তাই তক্ষুনি বেরিয়ে উপত্যকার দিকে চলে যান। ওদিকে কর্নেলও তার দেরিতে সন্দিগ্ধ হতে পারেন।
ইন্দ্রনাথ কিন্তু বারবার ঘাট থেকে উঠে বাংলোর দিকটা দেখছিলেন। অর্থাৎ লক্ষ্য রেখেছিলেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, শৰ্মা চলে যাচ্ছেন। যদি ইন্দ্রনাথ সৌম্যেন্দুর ঘাট হয়ে যেতেন, তাহলে হয়তো পাশের ঝোপে লাশ পড়ত। কিন্তু সৌম্যেন্দুর চোখে পড়ার ভয়ে তিনি আরও ওপর দিয়ে শর্মাকে অনুসরণ করেন। উঁচু থেকে দেখতে পান, শর্মা কী একটা পাথরের তলায় পুঁতে রাখছেন। গতরাতে সেটা খুঁজতেই গিয়েছিলেন। পান নি।
আজ সকালে অবশ্য ফাইলটা কর্নেলরা উদ্ধার করেছেন। কিন্তু ম্যাপটা নেই। ওটা শর্মার পকেটস্থ হয়েছিল। কাজেই লেকের জলে ভিজে দুমড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কালি ধেবড়ে গেছে। অতএব গুপ্তধন মানুষের চোখের আড়ালেই থেকে গেল।…..