সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কর্নেল সমগ্র

পরগাছা : প্রথম স্তর

কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটারের একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। নাটকের নাম পরগাছা।

পরগাছার প্রতি আমার খেয়ালি প্রকৃতিবিদ বন্ধুর আসক্তিকে প্রায় পাগলামি বলা চলে। এই বৃদ্ধ বয়সেও বিরল প্রজাতির পরগাছার খোঁজে দুর্গম বনজঙ্গল পাহাড়ে হন্যে হয়ে ঘোরা ওঁর স্বভাব। কিন্তু এক্ষেত্রে ওঁর সেই প্রিয় উদ্ভিদটি তো নিছক একটি নাটকের নাম! নামটিই কি ওঁকে টেনেছিল?

প্রশ্নটি অবশ্য নাটক দেখে বেরিয়ে আসার পর তুলেছিলাম। তবে তার আগে নাটকটির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে বলা উচিত।

মঞ্চের মাঝখানে একটি ক্ষয়াখর্বুটে গাছ, যার অল্প কিছু বিবর্ণ পাতা বোঁটায় টিকে আছে মাত্র। গাছটার তলায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে একটা আধপাগলা লোক। সে মাঝে মাঝে বেসুরো গলায় অদ্ভুত কী সব গান গায়। মঞ্চের ডানদিকে কয়েকটি কুঁড়েঘরের অংশ দেখে বোঝা যায় একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের লোকের জীবনের সঙ্গে গাছটার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কাজকর্মের শেষে তারা গাছটার তলায় এসে ভিড় জমায়। আড্ডা দেয়। রসিকতা করে। আধপাগলা লোকটাকে নিয়েও তাদের হাসি-তামাশা চলে।

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। হঠাৎ একদিন গ্রামের লোকের তুমুল কৌতুক আর হাসিতে অতিষ্ঠ সেই আধপাগলা বুড়ো চেরা গলায় ঘোষণা করে, সাবধান! এ গাছই তোদের জীবন। এর একটি করে পাতা তোদের একেক জনের জীবনের পরমায়ু। একটি করে পাতা ঝরবে। তোরা একজন করে মারা পড়বি।

অবিশ্বাসের হা হা হা হা অট্টহাসির মধ্যে দেখা যায় একটা পাতা খসে পড়ল এবং আচম্বিতে একটা লোক বুক চেপে ধরে আর্তনাদ করে পড়ে গেল।

এবার নাটকের গতি হয়ে উঠল জোরালো। প্রথমে সন্দেহ এবং দ্বিধা, তারপর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল প্রচণ্ড আতঙ্ক। আবার একটা পাতা খসে পড়ে। একটা মৃত্যু আসে। বিভীষিকার প্রতীক হতে থাকে জীর্ণ প্রাচীন সেই গাছ। একটার পর একটা পাতা ঝরে যায়। একের পর এক জীবনের পতন ঘটে। আধপাগলী লোকটা বারবার গলায় ঘোষণা করে, সাবধান! সাবধান!

রাগী যুবকরা কুড়ুল হাতে ছুটে আসে। আধপাগলা লোকটা বলে, খবর্দার! গাছটা কেটে ফেললে একসঙ্গে তোরা সবাই মারা পড়বি।

যুবতীরা ঘটে জল নিয়ে এস বলে, তাহলে আমরা একে বাঁচিয়ে তুলি। তারা গাছের গোড়ায় জল ঢালে। গাছটিকে ঘিরে তারা নেচেনেচে গান গায়। আধপাগলা লোকটা বলে, ভুল! ভুল! তোদের জলে গাছটায় নতুন পাতা গজাবে, আর তোদের। গর্ভে আসবে সন্তান। কিন্তু তারাও বাঁচবে না। পাতা ঝরবে। তারা মরবে।

তা হলে উপায়?

এবার নাটকের ক্লাইম্যাক্স। লোকটা আঙুল তুলে বলে, ওই দ্যাখ সবাই। গাছের ডালে একটা বিষাক্ত পরগাছা গজিয়ে আছে। গাছের সব রস শুষে নিয়ে ডাগর হয়ে ফুল ফোঁটাচ্ছে। ওই পরগাছা ওপড়াতে হবে। তবেই তোরা বাঁচবি।

যাই হোক, আরও কয়েকটি মৃত্যু এবং প্রবল হাঙ্গামার পর পরগাছাটা ওপড়ানো হলো। হাততালির মধ্যে নাটকও শেষ হলো। পাশের এক দর্শককে বলতে শুনলাম, সর্বহারা শোষিতশ্রেণী এবং পরগাছারূপী শোষক শ্রেণীর সংগ্রাম হে কালীপদ! বুঝলে তো?

কালীপদ কী বলল শুনতে পেলাম না। কর্নেল আমার কাঁধে হাত রেখে ভিড় ঠেলে আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন। ওঁর মুখটা রীতিমতো গম্ভীর।

অক্টোবর মাসের রাত সাড়ে আটটায় টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সবে। গাড়িতে উঠে কর্নেল চুরুট ধরালেন। স্টার্ট দিয়ে বললাম, বোগাস! একেবারে প্রচারধর্মী। তবে নাচগান অভিনয় দিয়ে জমিয়েছে বেশ।

কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, হঁ, নাটক মানে তো তাই। কিন্তু আমার অবাক লাগছে। পরগাছা আপনার প্রিয়, তা জানি। তাই বলে পরগাছা নামের রদ্দি তত্ত্বে ঠাসা নাটক দেখতে আপনার এত উৎসাহ রহস্যময়।

কর্নেল তেমনই গম্ভীরমুখে বললেন, রহস্যময় বলতেও পারো। তবে বিষয়টি সত্যি সিরিয়াস।

অবাক হয়ে বললাম, তার মানে?

নাটকটার অন্য একটা মাত্রা আছে। আমার প্রাজ্ঞ বন্ধু হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, ওই মাত্রাটা অত্যন্ত বাস্তব এবং সত্যি ভয়ঙ্কর। বিষাক্ত পরগাছা! হ্যাঁ, জয়ন্ত। কোনও কোনও পরগাছায় লাক্ষা জাতীয় কীটের জীবাণু থাকে। আমি দেখেছি, লাক্ষার লোভে ওই অর্কিড জাতীয় পরগাছা এনে বিশাল গাছের ডালে আটকে দেওয়া হয়। কালক্রমে গাছটা শুকিয়ে মারা পড়ে। শুধু তা-ই নয়, ক্রমশ পাশের গাছগুলোতেও সেই বিষাক্ত অর্কিড় ছড়িয়ে পড়ে। কী ভাবে বলি। একটা অর্কিডের ফুলের রেণু থেকে প্রায় ৪৭ লক্ষ বীজকণিকা বাতাসে ছড়িয়ে যায়। গাছ থেকে গাছে এভাবে অর্কিড ছড়ায়। তো আমি দেখেছি, এক অসাধু লাক্ষা ব্যবসায়ী লাক্ষার লোভে একটা রাস্তার ধারে অসংখ্য গাছ ওই বিষাক্ত অর্কিডের সাহায্যে মেরে ফেলেছে। লাক্ষাটা তার লাভ। শুকনো গাছগুলো কাঠের ব্যবসায়ীর লাভ। তুমি যদি তোমার খবরের কাগজের কাজে কখনও মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থেকে সড়ক ধরে কান্দি যাও, লক্ষ্য কোরো সারবন্দি গাছের কঙ্কাল …

এক্সকিউজ মি।

চমকে উঠে বাঁদিকে তাকালাম। আমাদের গাড়ি থিয়েটার রোডে পৌঁছে একটা রাস্তার মোড়ে ঈষৎ জ্যামের দরুন থেমে গিয়েছিল। বৃষ্টিটা বেড়ে গেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এক সিক্তবসনা যুবতী কর্নেলের কাছে ঝুঁকে কথাটি উচ্চারণ করেছিল। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন, বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য।

একটাও ট্যাক্সি পাচ্ছি না। ভিজে যাচ্ছি কিন্তু সেজন্যও না। যুবতীর কণ্ঠস্বরে ছটফটানি ছিল এবং সে বারবার ভয়-পাওয়া চোখে ফুটপাতের দিকে তাকাচ্ছিল। প্লিজ যদি আমাকে একটু লিফট দেন। দুটো মস্তান মতো লোক আমার পিছু নিয়েছে।

কর্নেল ঘুরে পেছনকার দরজার লক খুলে দিলেন। যুবতীটি তক্ষুণি গাড়িতে ঢুকে পড়ল। বুঝলাম, কর্নেলের সৌম্যকান্তি এবং ঋষিসুলভ দাড়িই তাকে সাহায্যপ্রার্থিনী করেছে। না হলে এমন অবস্থায় কোনও অচেনা লোকের গাড়িতে কোনও একলা যুবতী এভাবে ঢুকে পড়ত না।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যেতে চান?

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে।

অসুবিধে হবে না। আমরা এলিয়ট রোডে যাচ্ছি। জয়ন্ত, সামনের মোড়ে ঘুরে পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে যাওয়া যাবে। কী বলো?

মনে মনে বিরক্ত হলেও বললাম, ঠিক আছে।

জ্যাম ততক্ষণে ছেড়ে গেছে। কর্নেল আবার অর্কিড নিয়ে পড়লেন। আমার মন ব্যাকসিটে। মেয়েটি মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে এবং কথাবার্তাও যেটুকু শুনলাম, মার্জিত উচ্চারণ–ভদ্ৰপরিবারের বলেই মনে হচ্ছে। স্বভাবত আগ্রহ ছিল, কী তার নাম, কোথায় একা গিয়েছিল এবং কী ভাবে দুটো লোক তার পিছু নিল। কিন্তু আমার বাতিকগ্রস্ত বন্ধুটি কোনও প্রশ্ন করার সুযোগই দিলেন না। পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকে বললাম, কোথায় নামবেন বলবেন।

বেশি দূরে নয়। বলে সে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল। কিন্তু ফ্রি স্কুল স্ট্রিট প্রায় অন্ধকার। বড় দোকানপাট আজ রবিবারে বন্ধ। শুধু পান-সিগারেটের দোকানে মোম জ্বলছে। লোডশেডিং এবং ঝিরঝিরে বৃষ্টি।

কিছুক্ষণ পরে সে বলে উঠল, এখানে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে শুধু অসংখ্য ধন্যবাদ বলে অন্ধকারে বাঁদিকের ফুটপাতে অদৃশ্য হলো।

কর্নেল বললেন, তা হলে দেখ জয়ন্ত, যা বলছিলাম–

ঠিকই বলছিলেন। জীবনের সর্বত্র নাটক। রাস্তাঘাটেও নাটক। হাসতে হাসতে এলাম। জানি না এটা একই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক কিনা বলে গাড়ি ডাইনে ঘুরিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকলাম। দূরে আলোকিত বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছিল।

ডার্লিং?

ঝটপট বললাম, প্লিজ কর্নেল। আর কখনও ডার্লিং বলবেন না। আপনার ডার্লিং শুনে আমাদের কাগজের জনৈক সমালোচক বেজায় খাপ্পা হয়ে গেছেন। তা ছাড়া আপনি কথায় কথায় বড্ড বেশি ইংরেজি বলেন। এও নাকি ওঁর পক্ষে বিরক্তিকর।

কর্নেল কান করলেন না আমার কথায়। বললেন, ডার্লিং! অর্কিড বা পরগাছা গাছপালার জগতে যেমন, মানুষের জীবনেও তেমনই স্বাভাবিক একটা জিনিস। আসলে মানুষের সভ্যতার একটা অদ্ভুত লক্ষণও কিন্তু এই অর্কিড জাতীয় পরজীবী সম্প্রদায়। হয়তো বা আমরা প্রত্যেকেই কোনও-না-কোনও সময় অর্কিডের ভূমিকা নিয়ে বেঁচে থাকি।

আহ্ কর্নেল! দার্শনিক তত্ত্ব থাক। ওই মেয়েটি সম্পর্কে কী মনে হলো, বলুন।

ওকেও তুমি অর্কিড বলতে পারে।

কী মুশকিল! আপনার মাথায় অর্কিডের ভূত ঢুকে গেছে দেখছি।

জয়ন্ত! মেয়েটি পরজীবী শ্রেণীর।

তার মানে?

আমরা একজন কলগার্লকে লিফট দিলাম।

গাড়ির গতি কমিয়ে বললাম, বলেন কী!

যে বাড়িতে ও ঢুকে গেল, সেই বাড়িতে কিছুদিন আগেই পুলিশ হানা দিয়েছিল। তুমি সাংবাদিক। তোমার মনে পড়া উচিত, এক ডজন কলগার্লকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিল। ওদের কেউ কেউ নার্কোটিকসের কারবার করত। সেদিনকার খবর।

একটু হেসে বললাম, বাড়িটা আপনার চেনা দেখছি।

কর্নেল এতক্ষণে হাসলেন। শুধু বাড়িটা নয়, মালিকও আমার চেনা। ভদ্রলোক একজন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান। হ্যারি ওলসন নাম। গোবেচারা নিরীহ মানুষ। বয়স প্রায় আশির ওপরে। আসলে কলগার্ল বা নার্কোটিকসের ব্যাপারটা ওঁর এক্তিয়ারের বাইরে। তো যা বলছিলাম–সেই অর্কিড, বিষাক্ত অর্কিড শরীরে গজিয়েছে হ্যারি ওলসনেরও। ফলে তার অবস্থা কল্পনা করো।

কল্পনা করছি এখন সবখানে সবকিছুই অর্কিডে ঢাকা। আমার ভয় হচ্ছে কর্নেল, শেষে আপনি না আপনার প্রিয় ষষ্ঠীচরণকেও অর্কিড ভেবে বসেন। তা হলে কিন্তু এই বৃষ্টির রাতে কফির আশা বৃথা।

কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। লক্ষ্য করলাম, আবার চোখ বুজে হেলান দিয়েছেন। দাঁতে কামড়ানো জ্বলন্ত চুরুট।

কিছুক্ষণ পরে এলিয়ট রোডে কর্নেলের সানি ভিলার প্রাঙ্গণে ঢুকে গাড়ি পোর্টিকোর তলায় দাঁড় করালাম। আমার আর সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় ওঠার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কর্নেল আমাকে যেতে দিলেন না। অগত্যা গাড়ি পার্ক করে রেখে ওঁর সঙ্গ ধরতে হলো।

ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে চাপাস্বরে বলল, এক বুড়োবাবু এয়েছেন। বললাম, বাবামশাই বেইরেছেন। ফিরতে রাত্তির হবে। উনি বললেন, যত রাত্তির হোক, রোয়েট করব। তা–

তিনি কি রোয়েট করছেন?

আজ্ঞে। ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, জোর করে ঢুকে বললেন, আমি তোমার বাবামশাইয়ের বন্ধু।

কর্নেল তার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, শীগগির কফি।

ছোট্ট ওয়েটিং রুম পেরিয়ে ড্রয়িংরুমের পর্দা তুলে ঢুকে উনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাল্লো রায়সায়েব?

ঢুকে দেখি, প্রায় কর্নেলের বয়সী এবং তাঁর মতোই দশাসই চেহারার এক ভদ্রলোক সোফায় বসে আছেন। কিন্তু তাকে কেন কর্নেল রায়সায়েব বলে সম্ভাষণ করলেন বোঝা গেল না। ভদ্রলোকের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। পাশে একটা কাপড়ের ব্যাগ। চেহারায় অবশ্য বনেদী আভিজাত্যের ছাপ আছে। দেখনসই পাকা গোঁফ এবং চুলও সাদা। তবে কর্নেলের মতো টাক নেই।

ভদ্রলোক বললেন, বিকেলে হাওড়া পৌঁছেছি। স্টেশন থেকে ফোনে লাইন পেলাম না। তার ওপর আজকাল আপনাদের কলকাতার কী অবস্থা হয়েছে! ট্যাক্সি, পেতে সে এক হাঙ্গামা। সারা রাস্তা জ্যাম। ব্যস। তারপর শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। অবশেষে যদি বা এসে পৌঁছুলাম, শুনি আপনি নেই।

কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন। ইনি অমরেন্দ্র সিংহরায়। জয়ন্ত, তুমি কি কখনও রাঙাটুলি গেছ? ধানবাদ খনি এরিয়া থেকে সামান্য দূরে এক অসাধারণ জায়গা। শহর বলতে পারো, আবার গ্রামও বলতে পারো। টিলাপাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা আর নদী–তো রায়সায়েব! এর নাম আমার কাছে শুনে থাকবেন। জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।

আমরা নমস্কার বিনিময় করলাম। অমরেন্দ্র বললেন, নামটা শুনে থাকব। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল জয়ন্তবাবু। আপনি কাগজের লোক! নিশ্চয় বটুক চোধুরীকে চিনতেন। আমাদের এলাকার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বটুক চৌধুরী। হঠাৎ রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই নিয়ে কত তোলপাড়। পরে ওর বডি পাওয়া যায় ড্যামের জলে।

বললাম, নাহ্। চিনি না তাকে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, চৌধুরীসায়েবের ভূত কি এখনও রায়সায়েবের পিছু ছাড়েনি?

অমরেন্দ্র অমনই গম্ভীর হয়ে গেলেন। চাপাস্বরে বললেন, এবারকার ব্যাপারটা একবারে অন্যরকম। গত বছর তো আপনি গিয়ে রহস্যটা ফাঁস করলেন। যোগেনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু এবার উড়ো চিঠি নয়। আপনি ভূত বললেন–কতকটা তা-ই।

যেমন?

প্রায় প্রতি রাত্রেই এটা হচ্ছে। অদ্ভুত সব শব্দ। বুঝলেন? হলঘরের কাঠের সিঁড়িতে, কখনও ছাদে, আবার কখনও দোতলায় আমার ঘরের বারান্দায় হাঁটাচলার শব্দ। ফিসফিস কথাবার্তা। অমরেন্দ্র সিংহরায়ের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। অথচ দেখুন, আলশেসিয়ানটা ছাড়া থাকে। সে-হারামজাদার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। তাই প্রথমে ভেবেছিলাম, যোগেনের মতো বেচুও আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। বেচুকে রাত্রে ঘরে তালা আটকে রাখলাম। কিন্তু তবু সেই ভুতুড়ে কারবার। টর্চ বন্দুক নিয়ে বেরোই। সুনন্দা, সতু আমার সঙ্গে থাকে। ছাদে উঠে দেখি কেউ নেই। তারপর গত পরশু রাত্রে নিচের হলঘরে আর্তনাদ শুনলাম। সুনন্দা, সতু, বেচু সবাই। শুনেছিল। আলো জ্বালাই থাকে সারারাত্রি। কিন্ত সেরাত্রে তখন লোডশেডিং ছিল। হলঘরে সবাই দেখলাম কেউ নেই, কিন্তু কার্পেটে খানিকটা রক্ত পড়ে আছে।

কুকুরটা তখন কোথায় ছিল।

বাইরে। সতু হলঘরের দরজা খুলতেই লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকল।

অবাক হয়ে শুনছিলাম। বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু কর্নেল তুষো মুখে শুনছেন এবং গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে পারলাম না, রক্ত না রঙ, পরীক্ষা করা হয়েছে?

অমরেন্দ্র সিংহরায় হাসবার চেষ্টা করে বললেন, জয়ন্তবাবু! রক্ত আর রঙের তফাত বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে। তা ছাড়া সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা হলো, কুকুরটাকে আবার বাইরে বের করে দিয়ে হলঘরের দরজা আটকে আমরা সিঁড়িতে উঠে যাচ্ছি, বেচু মানে আমাদের বাড়ির সারভ্যান্ট চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ} ও নিচের একটা ঘরে থাকে। সতু টর্চের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। বেচু বলল, ওই দেখুন। একটা কালো বেড়াল রক্ত খাচ্ছে। সত্যি তা-ই! তাড়া করতেই বেড়ালটা বেচুর ঘরে ঢুকল। সেখানে তাড়া খেয়ে খোলা জানালা গলিয়ে পালাল।

বললাম, তবু কুকুরটার কোনও সাড়া পেলেন না?

নাহ।

ষষ্ঠী ট্রে-তে কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল এতক্ষণে। বাইরে বৃষ্টিটা সমানে ঝরছে। ভূতের গল্প শোনার মতো পরিবেশ বলা চলে। ভদ্রলোকের মুখ দেখে বুঝতেই পারছিলাম না উনি বানিয়ে বলছেন কিংবা তিলকে তাল করছেন, নাকি সত্যিই এই ভূতুড়ে রহস্য ফাঁস করার জন্য আমার এই প্রখ্যাত রহস্যভেদী বৃদ্ধ বন্ধুর কাছে ছুটে এসেছেন?

কর্নেল বললেন, কফি খান রায়সায়েব। কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে।

কফিতে চুমুক দিয়ে অমরেন্দ্র বললেন, গতরাত্রে তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু ভোরবেলা আমার ঘরের দরজা খুলে দেখি, একটা দলাপাকানো কাগজ পড়ে আছে। যা অবস্থা চলেছে, স্বভাবত কৌতূহল জাগল। কাগজটার ভাঁজ ঠিকঠাক করে দেখলাম কী সব ইংরেজিতে লেখা আছে। একবর্ণ বুঝলাম না সুনন্দা আর সতুকে দেখালাম। ওরাও বুঝতে পারল না। তখন তিনজনে মিলে ঠিক করলাম, আবার আপনার শরণাপন্ন হওয়া দরকার। এই দেখুন।

অমরেন্দ্র পাঞ্জাবির ভেতরপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিলেন। কাগজটার অবস্থা দেখে বোঝা গেল, ওটা সত্যি দলপাকানো ছিল। টেনে ঠিকঠাক করা হয়েছে। কর্নেল ভাঁজ খুলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতশ কাচ বের করলেন। পড়ার পর শুধু বললেন, হুঁ। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

অমরেন্দ্র বললেন, যোগেনের হাতের লেখা নয়, এটুকু আমি বুঝতে পেরেছি। আপনিই সেবার যোগেনের হাতের লেখা সনাক্ত করেছিলেন।

কর্নেল সায় দিলেন। বললাম, দেখতে পারি? কর্নেল কাগজটা আমাকে দিলেন। লাল ডটপেনে লেখা আছে :

CHAICHICHINGFANK

বার কতক পড়ার পর বললাম, দেখুন, আমার মনে হচ্ছে এতে লেখা আছে চাই চিচিং ফাঁক।

কর্নেল হাসলেন। হুঁ, ঠিক ধরেছ। চাই চিচিং ফাঁক।

অমরেন্দ্র হাসলেন না। রুষ্ট মুখে বললেন, সেটাই তো অদ্ভুত। আমার বোনপো সতুও তা-ই পড়ল। কিন্তু মানেটা কী এর? আরব্য উপন্যাসের আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্পে চিচিং ফাঁক বললে নাকি লুঠের মালরাখা ঘরের দরজা খুলে যেত। আমি আলিবাবা না চোরদের সর্দার?

কর্নেল সকৌতুকে বললেন, তা ছাড়া আপনি আলিবাবার ভাই কাশেমও নন। কক্ষনো নই। সমস্তটাই দুর্বোধ্য আমার কাছে। অমরেন্দ্র কফিতে চুমুক দিয়ে ফের বললেন, আপনি বলছিলেন বটুক চৌধুরীর ভূত আমার পিছু ছাড়েনি। আপনি জ্ঞানী মানুষ। ঠিক ধরেছেন। বটুকের লাশ সন্দেহ করে ড্যামের জলে পাওয়া বডিটা পুলিশ ওর চেলাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। ঘটা করে দাহও করেছিল ওরা। কিন্তু আমার সন্দেহ, বটুক মারা পড়েনি। কোনও কারণে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। গতবার আমার কর্মচারী যোগেনকে দিয়ে সে-ই আড়াল থেকে অদ্ভুত সব উড়ো চিঠি লিখত। এখন নিশ্চয় কোনও তান্ত্রিক সাধুর সাহায্যে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। কেন তা আপনিই বিশদ জানেন।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, এ যুগে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যাপারটাই হয়তো এমন যে পরস্পরের প্রতি রাগ মরে গিয়েও পড়ে না।

হাসি চেপে বললাম, আমাদের নিউজ ব্যুরোর চিফ নগেনদা রাজনৈতিক রাগ বলে একটা টার্ম ব্যবহার করেন।

অমরেন্দ্র কফির পেয়ালা শেষ করে বললেন, কিন্তু আমি তো কবে রাজনীতি থেকে সরে এসেছি। গত ভোটে আমি তো বটুকের সুবিধে করে দিতেই শেষ মুহূর্তে নমিনেশন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাম। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আমার পোষাল না। বটুকের অবশ্য অন্য ব্যাপার। এরিয়ার মাফিয়া ডন ওর হাতে ছিল। যাইহোক, কর্নেল! প্লিজ বটুকের ভূতের হাত থেকে আমাকে বাঁচান।

বলে রায়সায়েব উঠে দাঁড়ালেন। একটা ফোন করব। অলরেডি আপনার অসাক্ষাতে একটা করেছি–আপনার ওই লোকটিকে বলেই করেছি অবশ্য। হেমেনকে খবর দিয়ে গাড়ি পাঠাতে বলেছিলাম। দশটা বাজতে চলল। এখনও গাড়ি এল না। অদ্ভুত ছেলে তো।

কর্নেল বললেন, রাস্তায় জল জমে গেছে হয়তো। আপনি ফোন করুন।

অমরেন্দ্র রিং করে সাড়া পেলেন। বউমা নাকি? আমি বলছি–হ্যাঁ। হেমেন– আচ্ছা। ঠিক আছে। ফোন রেখে বললেন, বেরিয়েছে এক ঘণ্টা আগে। আপনি ঠিকই বলেছেন। রাস্তায় জল জমে নিশ্চয় কোথাও আটকে গেছে। বৃষ্টি থেমেছে মনে হচ্ছে। আমি বরং আর অপেক্ষা না করে বাসে বা মিনিবাসে চলে যাই। আপনাকে সব জানালাম। আমি কালই দুপুরের ট্রেনে ফিরে যাব। আপনি কবে যাচ্ছেন বলুন?

কর্নেল বললেন, চেষ্টা করব শীগগির যেতে। রাঙাটুলির ওদিকে জঙ্গলে একরকম অর্কিড দেখেছিলাম। তখন তত মনোযোগ দিইনি। সম্প্রতি একটা বইয়ে ওই অর্কিডের ছবি দেখলাম। আশ্চর্য ব্যাপার। এই অর্কিড–

প্লিজ কর্নেল! অর্কিড পরে হবে। সঙ্গে তোক দেব। যত খুশি কালেক্ট করবেন। আগে বটুকের ভূতটাকে শায়েস্তা করুন। অমরেন্দ্র সিংহরায় আমার দিকে ঘুরে নমস্কার করলেন। জয়ন্তবাবুকেও আমন্ত্রণ রইল। আচ্ছা, চলি।

ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন কর্নেলের রায়সাহেব। কর্নেল সেই কাগজটা আর আতশ কাচ টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন। এতক্ষণে হাসির সুযোগ পেলাম। হাসতে হাসতে বলালম, আপনার বরাতে সব অদ্ভুত মক্কেল জোটে। এই রহস্যটাও কম অদ্ভুত নয়। চিচিং ফাঁক রহস্য।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ব্যাপারটা সম্ভবত হাস্যকর নয়, ডার্লিং। রাঙাটুলিতে গেলে তুমি খানিকটা আঁচ করতে পারবে। বটুক চৌধুরী রায়সায়েবের শ্যালক। হেমেনের কথা শুনলে একটু আগে। হেমেন্দ্র ওঁর একমাত্র ছেলে এবং একজন মস্ত ব্যবসায়ী। আমদানী রফতানির কারবার আছে। যতটা জানি, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না। রায়সায়েবের কাছে থাকেন ওঁর একমাত্র মেয়ে সুনন্দা। ভদ্রমহিলা বিধবা। সতুর কথা শুনেছসত্যকাম। সুনন্দা দেবীর ছেলে। মাইনিং এঞ্জিনিয়ার। দাদামশাই তাকে মানুষ করেছেন। যাইহোক, রাত বাড়ছে। তোমাকে সল্ট লেকে ফিরতে হবে। ইস্টার্ন বাইপাস ধরে যাও।

উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, হেমেনবাবু কোথায় থাকেন?

বেহালায়। কাজেই তোমাকে কখনই বলা যেত না রায়সায়েবকে একটা লিফট দাও।

হাসলাম। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মেয়েটির মতো কোনও মেয়ে হলে আমি বেহালা কেন, কাকদ্বীপে পৌঁছে দিয়ে আসতে রাজী।

কর্নেল জিভ কেটে বললেন, আশ্চর্য জয়ন্ত তুমি একজন কলগার্লকে ভুলতে পারোনি দেখছি।

আমার কিন্তু ওকে মোটেই কলগার্ল বলে মনে হয়নি। আপনি সম্ভবত ভুল করছেন। মেয়েটি সত্যি ভয় পেয়ে আমাদের গাড়ির কাছে ছুটে এসেছিল। ওর কথাবার্তা, তা ছাড়া চুপচাপ বসে থাকা–সব মিলিয়ে একজন বিপন্ন মেয়েরই হাবভাব লক্ষ্য করেছি।

কথাগুলো জোর দিয়ে বললাম। শোনার পর কর্নেল একটু হাসলেন। বিপন্ন হতেই পারে। কলগার্লদের জীবন তো সবসময় বিপন্ন।….

কর্নেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্ক সার্কাস হয়ে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে যেতে যেতে সারাপথ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মেয়েটির কথাই ভাবছিলাম। এ যাবৎ কখনও রাস্তাঘাটে দিনে বা রাতে কোনও একলা, মেয়েকে গাড়িতে লিফট দেওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়নি, যদিও গপ্পে এসব অনেক পড়েছি। সৌভাগ্য মানে, গল্পে এসব ক্ষেত্রে প্রেমের সুযোগ এসে যায়। দুর্ভাগ্য মানে, অনেক সময় নাকি লিফট দিতে গিয়ে সাংঘাতিক ব্ল্যাকমেলের পাল্লায় পড়তে হয়।

কিন্তু মেয়েটিকে কর্নেল কলগার্ল বলে সনাক্ত করেছে, এমন কি বাড়িটাও চেনেন। এজন্যই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। গাড়ির আলোয় কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওর যে মুখ দেখেছি সেই মুখে সৌন্দর্য ও বিপন্নতার ছাপ ছিল। সুন্দরী মেয়েরা কেন নষ্ট হয়ে যায়, এ ধরনের সামাজিক-নৈতিক প্রশ্নও আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল।

গাড়ি গ্যারাজে ঢুকিয়ে পেছনের জানালার কাচ তুলছিলাম। সেই সময় গ্যারাজের আলোর ছটায় চোখে পড়ল ব্যাকসিটে একটা ছোট্ট পার্স পড়ে আছে। একটু চমকে উঠেছিলাম দেখামাত্র। পার্সটা তুলে নিলাম। আমার হাত কাঁপছিল এ কথা অস্বীকার করছি না। পার্সটা নিশ্চয়ই সে ইচ্ছে করে ফেলে যায়নি। মানসিক চাঞ্চল্য, আর বৃষ্টিও এই ভুলের কারণ হতে পারে।

বাদামি রঙের হাল্কা পার্সটা নিয়ে আমার দোতলার ফ্ল্যাটে ঢুকলাম, তখন আমার অন্য প্রচণ্ড উত্তেজনা টগবগ করছিল। মেয়েদের পার্স আমার কাছে সবসময় কৌতূহলের বস্তু। সেই কৌতূহলে রোমান্টিকতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে উত্তেজনাই আমাকে ক্রমশ নার্ভাস করল।

পার্স খুলতেই প্রথমে চোখে পড়ল একটা নেমকার্ড। তারপর তিনটে চাবির একটা রিং। কিছু খুচরো পয়সা। পার্সের ভেতরে একপাশের খোঁদলে, শ দেড়েক টাকার নোট। অন্যপাশের খোঁদলে খুদে আয়না, লিপস্টিক, এইসব টুকিটাকি প্রসাধনী।

জিনিসগুলো টেবিলে রাখছিলাম। আমার এই কাজটা অশালীন বলা চলে। কিন্তু অস্বস্তিকর উত্তেজনাটা আমাকে ভূতগ্রস্ত করেছিল। আরও খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তলার দিকে ইঞ্চি তিনেক লম্বা জিপ। জিপ টেনে খুলে দেখি, ভেতরে একটা পুরনো হলদেটে কাগজের চিরকুট। তাতে লেখা আছে :

TL-2. R-3. L-1. R-4

পরপর কয়েকটা সিগারেট টানার পর প্রথমেই মাথায় এল, পার্সে চাবি থাকায় মেয়েটি তার ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারছে না।

এত রাতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে গিয়ে পার্স ফেরত দিতে আমার আপত্তি ছিল না, কিন্তু কর্নেলের মুখে ওই বাড়ির কথা শোনার পর সেটা সম্ভব নয়।

নেমকার্ডটা তুলে নিলাম। পুরনো কার্ড। ওতে একজন অ্যাডভোকেটের নামঠিকানা ছাপানো আছে। অলক সেনগুপ্ত। ঠিকানা শ্যামবাজার এলাকারই কোনও গলির। মেয়েটি কি কখনও কোনও মামলায় ফেঁসেছিল? কর্নেল বলছিলেন, সম্প্রতি ওই বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়ে কলগার্লদের গ্রেফতার করেছিল। এই মেয়েটি যদি কলগার্ল হয়, সে গ্রেফতার হয়ে থাকলেও ছাড়া পেয়েছে। তার আইনজীবীর কার্ড হতেও পারে। কার্ডটা জরাজীর্ণ হওয়ায় অনেক ব্যাখ্যা সম্ভব। তবে এ নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর মানে হয় না।

রাঙাটুলির রায়সায়েবের সেই চিচিং ফাঁক চিরকুটের মতো এই অদ্ভুত চিরকুটটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দায় বরং বৃদ্ধ রহস্যভেদীর ওপর চাপানো যেতে পারে। আপাতত আমার দুশ্চিন্তা, মেয়েটি তার ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারছে না। আমার এখন কী করা উচিত।

অতএব অগতির গতি আমার ফ্রেন্ড-ফিলসফার-গাইডকেই রিং করলাম। কয়েকবার চেষ্টার পর সাড়া পেলাম। সংক্ষেপে ব্যাপারটা বললাম। কর্নেল বললেন, ওর ফ্ল্যাট খুলে দেওয়ার লোক ওবাড়িতে আছে। তুমি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুম না এলে পালের ভেড়া গুনতে শুরু করবে। পুরনো এবং অব্যর্থ ওষুধ। আর শোনো, তুমি পার্স ফেরত দিতে যেও না। আমাকে সকালে দিয়ে যেও। আমিই দিয়ে আসব। তোমারও আমার সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করবে। ঠিক আছে। যাবে। গুড নাইট!…

পালের ভেড়া গোনার চেষ্টা করিনি। ঘুম না এলে আমার অভ্যাস দুর্বোধ্য বিষয়ের বই পড়া এবং বোঝবার চেষ্টা করা। এই চেষ্টা থেকেই ঘুম অনিবার্যভাবে এসে যায়। তবে এদিন ঘুম ভেঙেছিল প্রায় নটায়। তাড়াহুড়ো করে ব্রেকফাস্ট সেরে কর্নেলের বাড়ি পৌঁছুতে সাড়ে নটা বেজে গেল।

আকাশ ঝকঝকে নীল। রাস্তাঘাট শুকনো। বৃষ্টির পর বাতাসে শেষ শরতের স্বাভাবিক স্নিগ্ধতা ফিরে এসেছে। কর্নেল পার্সটা হাতে নিয়ে ঠিক এভাবেই মার্জিত ভাষায় কিছুক্ষণ ঋতুবন্দনা করে গেলেন। কলকাতায় যদিও সঠিক ঋতু পরিবর্তন টের পেতে সময় লাগে, কর্নেলের ছাদের বাগানে দাঁড়ালে নাকি কিছু লক্ষণ থেকে অবস্থা আঁচ করা যায়। কাজেই রাঙাটুলি আজ ভোরবেলা থেকেই তাঁকে খুব টানছে।

চুপচাপ সিগারেট টানছিলাম। বিরক্ত হয়ে বললাম, পার্সটা খুলে দেখবেন না কি?

কর্নেল হঠাৎ চাপাস্বরে বলে উঠলেন, চেপে যাও ডার্লিং! ভুলে যাও গতরাতে কোনও মেয়েকে লিফট দিয়েছ। এক মিনিট। পার্সটা আমি লুকিয়ে রেখে আসি।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কর্নেল পার্সটা সত্যি পাশের ঘরে কোথাও রেখে এলেন। ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, কফি খাও। নার্ভ চাঙ্গা করো। তারপর বলছি।

কিছু বুঝছি না। আপনার সবসময় শুধু হেঁয়ালি।

এই সময় ফোন বাজল। কর্নেল সাড়া দিয়ে বললেন, হালদারমশাই নাকি?…. বলেন কী! আপনার কাছে গিয়েছিল? আপনি সিওর? ….. বুঝেছি। …হাঁ চলে আসুন। জয়ন্ত এখানে আছে। …… হ্যাঁ, ঠিক আছে। রাখছি। চলে আসুন।

বললাম, প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভদ্রলোক নিশ্চয় কোনও কেস হাতে পেয়েছেন? কর্নেল হাসলেন। পেয়েছিলেন। কিন্তু পা বাড়িয়ে পুলিশের ধমক খেয়ে হটে আসেন। এখন সেই পুলিশই ওঁকে সাধছে। একটু অপেক্ষা করো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রিয় গোয়েন্দা ভদ্রলোক পুলিশের গাড়িতেই এসে পড়বেন।

প্লিজ কর্নেল। আর হেঁয়ালি করবেন না।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, গত রাতে সেই কলগার্ল চন্দ্রিকা রায় খুন হয়েছে।

প্রচণ্ড চমকে উঠলাম। সে কী! কোথায়? কী ভাবে?

নিজের ফ্ল্যাটের ভেতরে। কর্নেল নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন। ভোর ছটায় হ্যারি ওলসন ফোন করে আমাকে জানান, চারতলার ফ্ল্যাটে একটি মেয়ে খুন হয়েছে। সেজন্য পুলিশ তাঁর ওপর ঝামেলা করছে। আমি যেন ওঁকে সাহায্য করতে ছুটে যাই।

আপনি গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আমার জানার ইচ্ছে ছিল গতরাতের সেই মেয়েটিই কিনা। যদি সে না হয়, তা হলে আমার কিছু করার নেই। তো গিয়ে দেখি, সে-ই। মুখটা মনে ছিল। তুমি তো জানো, মানুষের মুখ সম্পর্কে আমার নিজস্ব কিছু তত্ত্ব আছে। চন্দ্রিকা রায়ের মুখে বিপন্নতা লেখা ছিল। কিন্তু সেটা এতদুর গড়াবে ভাবতে পারিনি।

ওর ফ্ল্যাটের চাবি তো পার্সে।

নো পার্স। চেপে যাও।

ফ্ল্যাটে ঢুকল কী করে চন্দ্রিকা?

যে ভাবেই হোক, ঢুকেছিল। তারপর খুনী ওকে জবাই করেছে। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই জবাই। কর্নেল তেমনই নির্বিকার মুখে বললেন। তোমাকে বলেছিলাম, কলগার্লদের জীবন সবসময়ই বিপন্ন। কেন বিপন্ন সেটা একটু চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশের বক্তব্য অবশ্য একটু অন্যরকম। চন্দ্রিকাকে খুন করা হয়েছে ডাকাতির উদ্দেশ্যে। আজকাল নাকি ফ্ল্যাটে ডাকাতি এবং খুন যে ভাবে হচ্ছে, সেভাবেই। কারণ ওলসনের বাড়ির কলগার্লদের গার্জেন ডিস্কোর কাছে চন্দ্রিকা ছিল এক দুর্মূল্য সম্পদ।

ডিস্কো কে?

এখনও তাকে দেখিনি। জানি না কে সে। জানতেও চাই না। ডিস্কো ইজ ডিস্কো। দ্যাটস অল।

চন্দ্রিকার পার্সের ভেতর শেই কাগজটা—

নো পার্স! কর্নেলের চোখে ভর্ৎসনা ফুটে উঠল। কথাটা বলে উঠে গেলেন জানালার কাছে। পর্দা তুলে উঁকি দিয়ে নিচের রাস্তা দেখতে থাকলেন।

কিছুক্ষণ পরে সরে এসে ইজিচেয়ারে বসলেন কর্নেল। সহাস্যে বললেন, পুলিশের জিপে হালদারমশাই আসছেন। ভাবা যায়? চিন্তা করো ডার্লিং! ভদ্রলোক নিজেই চৌত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। রিটায়ার করে ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। অথচ পুলিশ ওঁকে সহ্য করতে পারে না এবং উনিও পুলিশকে সহ্য করতে পারেন না। সম্পর্কটা প্রায় সাপে-নেউলে বলা চলে। অথচ এতদিন পরে এই একটা ঘটনায় সাপ-নেউলের চমৎকার গলাগলি। দেখা যাক, এই গলাগালি থেকে চন্দ্রিকা হত্যার কোনও সূত্র বেরিয়ে আসে নাকি!

ঘণ্টা বাজলে ষষ্ঠীচরণ গিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার নস্যির কৌটো হাতে হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর পিছনে এক পুলিশ অফিসার। হালদারমশাই ধপাস করে বসে এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, গুপ্তসায়েবরে জিগান, কী কইছিলাম?

পুলিশ অফিসার গম্ভীরমুখে বললেন, কর্নেলসায়েব কি ডি সি ডি ডি লাহিড়িসায়েবের ফোন পেয়েছেন?

কর্নেল বললেন, অরিজিৎ বলছিল, আপনি যোগাযোগ করবেন। জয়ন্ত, আলাপ করিয়ে দিই। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ অশোক গুপ্ত। আমার স্নেহভাজন বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসবেক পত্রিকার সাংবাদিক।

অশোক গুপ্ত নমস্কার করে বললেন, কাগজে নামটা দেখেছি। একটা অনুরোধ জয়ন্তবাবু। যদি কাগজে কিছু লেখেন, এমন কিছু লিখবেন না যাতে আমাদের তদন্তে ব্যাঘাত ঘটে।

বললাম, কিছুই লিখব না। আমাদের কাগজের ক্রাইম-রিপোর্টার আছে। সে আপনাদের ভার্সানই লেখে। কাজেই যা লেখার সে-ই লিখবে। …

আবার একদফা কফি এল। হালদারমশাইয়ের জন্য তিন ভাগ দুধ মেশানো কফি আনতে ষষ্ঠী ভোলেনি। চুমুক দিয়ে হালদারমশাই সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস! এবার অশোকবাবু কইবেন, নাকি আমি স্টার্ট করব? কর্নেলস্যার কী কন?

কর্নেল বললেন, আপনারটা আগে শুনে নিই।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মিশ্র ভাষায় যা শুরু করলেন, তার সারমর্ম এই:

হালদারমশাই মাঝে মাঝে কাগজে তাঁর এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেন। গত সপ্তাহে দিয়েছিলেন। কদিন আগে চন্দ্রিকা রায় তাঁর অফিসে গিয়েছিল। তাকে নাকি প্রায়ই একটা অচেনা লোক টেলিফোন করে জ্বালাতন করছে। কী একটা অদ্ভুত কথা বলছে, যার মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। আগের দিন চন্দ্রিকা নিউ মার্কেটে গিয়েছিল। ভিড়ের ভেতরে কেউ তাকে ফিসফিস করে একই কথা বলে ওঠে। কে বলল, চন্দ্রিকা খুঁজে পায়নি। কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়ে চলে আসে। হালদারমশাই চন্দ্রিকার কেসটি যথারীতি গুরুত্বসহকারে হাতে নেন। চন্দ্রিকার বাসস্থানের কাছে অর্থাৎ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওই বাড়ির সামনে ফুটপাতে পুরো একটা দিন ওত পেতে থাকেন এবং নিজস্ব গোয়েন্দা-পদ্ধতিতে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, বাড়িটা কলগার্লদের খাঁটি। চন্দ্রিকাও একজন কলগার্ল। তবে সেটা কোনও ব্যাপার নয়। চন্দ্রিকা তাঁর ক্লায়েন্ট।

উল্লেখ করা দরকার, হালদারমশাই কেস পেলে যা করেন, অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধরেই ওত পাততে গিয়েছিলেন। ভবঘুরে ফুটপাতবাসীর ছদ্মবেশ। গত পরশু শুক্রবার বিকেলে ফের যান উনি। সেই সময় সেজেগুঁজে চন্দ্রিকা বেরুচ্ছিল। তার পিছু নেন। চন্দ্রিকা পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। হালদারমশাই ভেবেছিলেন, সে খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একটা সাদা গাড়ি এসে থামে এবং চন্দ্রিকা তাতে চাপে। ভবঘুরে টাইপ নোংরা পোশাকপরা লোককে কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারই নেবে না। কাজেই গাড়ির নাম্বার টুকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় গোয়েন্দাকে। পরদিন শনিবার মোটর ভেহিকলস ডিপার্টমেন্টে চেনা লোকের সাহায্যে গাড়ির মালিকের নাম-ঠিকানা যোগাড় করেন। তারপর সেই ঠিকানায় চলে যান। গিয়েই একটু অবাক হন।

এ পর্যন্ত শুনেই কর্নেল হঠাৎ বলে উঠলেন, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বাড়ি?

হালদারমশাই চমকানো গলায় বললেন, অ্যাঁ? আপনি জানেন?

সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি। গতকাল সন্ধ্যায় তাঁরই নাটক পরগাছা দেখতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে জয়ন্তকে নিয়ে গিয়েছিলাম? চন্দ্রিকা গ্রাম্য যুবতীদের দলে অভিনয় করছিল।

আমি কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমিও হালদারমশাইয়ের মতো বলে উঠলাম, অ্যাঁ!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ। যাই হোক, তারপর কী হলো বলুন হালদারমশাই?

ঝটপট বললাম, কিন্তু থিয়েটার শেষ হওয়ার পর আমরা আসছিলাম গাড়িতে। অতদুরে থিয়েটার রোডের ওই মোড়ে মেয়েটি কী করে অত শীগগির এসে পড়ল?

কর্নেল একই ভঙ্গিতে বললেন, তোমাকে বরাবর বলেছি জয়ন্ত! তোমার পেশার লোকেদের জন্য একটা জিনিস খুব জরুরি। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ–সবসময়, সবকিছুর প্রতি। তুমি লক্ষ্য করোনি, নাটকে নাচতে নাচতে একটি মেয়ের চুলে গাছের একটা পাতা পড়ল আর সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে বেরিয়ে গেল। নাটকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম একটি মেয়ের মৃত্যু। তার মুখটা মনে ছিল। কাজেই তার আগেই চলে আসায় অস্বাভাবিক কিছু নেই।

তা হলে আপনি ওকে চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু গাড়িতে আসার সময় চুপচাপ রইলেন। পরে আমাকে বললেন না কিছু। কেন?

বলেছিলাম।

কলগার্ল মনে হচ্ছে বলেছিলেন শুধু।

পুলিশের গোয়েন্দা বললেন, হাতে সময় কম কর্নেলসায়েব! আমাকে উঠতে হবে। ডি সি ডি ডি সায়েব আমাকে বলেছে–

তাঁকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, জাস্ট আ মিনিট! হালদারমশাইয়ের কথা আগে শুনে নিই।

হালদারমশাই দুঃখিত মুখে বললেন, অহন আর কী কমু কর্নেলস্যার? ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি কইলেন, কী চাই? যেই ওনারে কইছি, কাইল আপনি কলগার্লেরে গাড়িতে উঠাইয়া লইয়া কই গেলেন জানতে চাই–আই অ্যাম এ প্রাইভেট ডিটেকটিভ, অমনি উনি দরজা আটকাইয়া পুলিশে ফোন করলেন। পুলিশ আইয়া আমারে ধমক দিয়া–ওঃ! ক্কী কারবার! কিছুতেই বুঝবে না। যত কই, কেসটা শোনেন–তত ধমক দেয়, শাট আপ! আর কক্ষনো ঝামেলা করবেন না।

অশোকবাবু একটু হেসে বললেন, আসলে মিঃ হালদারের অ্যাপ্রোচে গণ্ডগোল ছিল। তাই থেকে একটু ভুল বোঝাবুঝি আর কী! চন্দ্রিকা মার্ডারের পর ওর ফ্ল্যাটে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে মিঃ হালদারের কার্ড পেয়ে আমরা অবাক হয়েছিলাম। তারপর ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।

হালদারমশাই বললেন, হঃ! একখান কার্ড দিছিলাম অরে। ভেরি স্যাড!

কর্নেল বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুকে কি জানানো হয়েছে খবরটা?

অশোকবাবু বললেন, ফোনে আমরা জানিয়েছি। মিঃ হালদারের কাছে ব্যাপারটা শোনার পর জানাতে হলো। তারপর লাহিড়িসায়েব আমাদের থানায় রিং করে খোঁজ নিলেন। তখন বুঝলাম, ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে ওঁর জানাশোনা আছে। আমাদের ফোন পেয়েই ভদ্রলোক ডি সি ডি ড-কে অ্যাপোচ করেছেন সম্ভবত। যাই হোক, ডি সি ডি ডি আপনার কাছে আসতে বললেন। এখন মনে হচ্ছে, আপনি ব্যাকগ্রাউন্ডটা মোটামুটি জানেন।

শুধু এটুকু জানি, ইন্দ্রজিৎবাবুকে কিছুদিন আগে কেউ ফোনে হুমকি দিয়েছিল, ঐ স্কুল স্ট্রিটের ওলসন হাউসের ছায়া মাড়ালে তাঁর বিপদ ঘটবে। স্বভাবত উনি অরিজিৎ লাহিড়িকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। তখন অরিজিৎ ওঁকে আমার নাম ঠিকানা দেন।

শুনলাম আপনি গিয়েছিলেন ওবাড়িতে। ডেডবডি দেখে এসেছেন।

হ্যাঁ। আপনাদের অফিসারদের ধারণা স্রেফ ডাকাতি এবং খুন।

ঠিক তা-ই মনে হয়েছিল আপাতদৃষ্টে। অশোকবাবু হাসলেন। কিন্তু এবার আর তা মনে হচ্ছে না। ডি সি ডি ডি সায়েব বললেন, আপনার সঙ্গে যেন যোগাযোগ রেখে চলি।

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, কতকগুলো ঘটনা এ মুহূর্তে আমাদের নানা আছে, যেগুলোর মধ্যে কোনও স্পষ্ট যোগসূত্র নেই। ঠিক আছে মিঃ গুপ্ত! আপনি প্রয়োজন হলে পরে যোগাযোগ করবেন। আমার ফোন নাম্বার আপনার নিশ্চয় জানা?

হ্যাঁ। লাহিড়িসায়েব দিয়েছেন।

একটা কথা। ডিস্কো কে আপনি জানেন?

অশোকবাবু গুম হয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, লোকটি কে আমি অন্তত জানি না। তবে কানাঘুষো শুনেছি, হি ইজ আ বিগ গাই। ওপরতলায় প্রচণ্ড প্রভাব আছে, এটুকু বুঝতে পারি।

কিন্তু সম্প্রতি ওলসন হাউসে আপনারা হানা দিয়েছিলেন?

পুলিশের গোয়েন্দা মুচকি হেসে বললেন, জাস্ট আ শো বিজনেস বলতে পারেন। এগুলো আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের মাঝে মাঝে করতে হয়। আচ্ছা, আমি চলি।….

অশোক গুপ্ত চলে যাওয়ার পর হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, সব ফ্যাক্ট আমি পুলিশেরে দেই নাই কর্নেলস্যার। আপনারে দিমু। আগে দিলেই ভাল করতাম। মাইয়াডা তা হলে হয়তো মারা পড়ত না। ব্যাড লাক।

কর্নেল বললেন, আপনি এখনও খুব উত্তেজিত হালদারমশাই! আমার মনে, আগে উত্তেজনাটা কাটিয়ে ওঠা দরকার।

ক্যান? প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভুরু কুঁচকে তাকালেন।

কর্নেল হাসলেন। আপনার ভাষা। লক্ষ্য করেছি, উত্তেজনার সময় আপনি স্টান্ডার্ড বাংলায় কথা বলেন না।

হালদারমশাই বিব্রতভাবে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, হঃ। ঠিক কইছেন—সরি। ইউ আর রাইট কর্নেলস্যার। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। মেয়েটিকে বাঁচাতে পারলাম না। অশোকবাবুকে অত করে বললাম, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওই বাড়িটা হয়েই কর্নেল স্যারের কাছে যাওয়া যাক। উনি বললেন, ও-বাড়িতে গিয়ে আর লাভ নেই। বডি চালান গেছে। তবে বর্ণনা শুনলাম, হরিবল! গলা কাটছে। ওঃ!

হালদারমশাই চোখ বুঝে শিউরে ওঠার ভঙ্গি করলেন। কর্নেল বললেন, কী ফ্যাক্ট দিতে চেয়েছেন বলছিলেন হালদারমশাই।

হঃ! চোখ খুলে কে কে হালদার চাপা স্বরে বললেন, চন্দ্রিকা রায় কইছিল, যে লোকটা তারে টেলিফোন করে, সম্ভবত সে একজন চীনাম্যান। নিউ মার্কেটে ভিড়ের মধ্যেও চন্দ্রিকার মনে হয়েছিল লোকটা চীনাম্যান। না কর্নেল স্যার। চন্দ্রিকা তারে দ্যাখে নাই। কথা শুনিয়াই–

কর্নেল ওঁর কথার ওপর বলে উঠলেন,! তার মানে, লোকটার যে সব কথা অদ্ভুত মনে হয়েছিল চন্দ্রিকার, সেটা কী চীনা ভাষার মতো?

হঃ! হালদারমশাই সোজা হয়ে বসলেন। কতকটা তা-ই মনে হয়েছিল চন্দ্রিকার।

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, চাই চিচিং ফাঁক নয় তো?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ নড়ে উঠলেন। কী কইলেন? কী কইলেন?

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললাম, চাই চিচিং ফাঁক কথাটা কেউ আচমকা বলে উঠলে চীনে ভাষা মনে হতেও পারে, কর্নেল!

হালদারমশাই বারকতক বিড়বিড় করে কথাটা আওড়ে খি-খি করে একচোট হাসলেন। তারপর একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, চন্দ্রিকা কইছিল চ্যাংচুংচিংচাঁ করে কী যেন বলে লোকটা। তো জয়ন্তবাবু কী কইলেন য্যান? চিচিং ফাঁক? ফের খি খি করে হাসতে লাগলেন উনি।

কর্নেল হাসছিলেন না। গম্ভীরমুখে বললেন, আর কোনও ফ্যাক্ট আছে কি আপনার হাতে?

হালদারমশাই গম্ভীর হয়ে চাপাস্বরে বললেন, চন্দ্রিকা কইছিল, সে একটা অফিসে চাকরি করে। পরে জানলাম, এটা মিথ্যা কথা। তবে আমারে একটা অ্যাড্রেস দিছিল। যদি হঠাৎ তার কোনও বিপদ হয় হয়, সেই অ্যাড্রেসে আমারে যোগাযোগ করতে হইব। করুম এবার। তার আগে অ্যাড্রেসটা দেখাই।

প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট নোটবই বের করে উনি পাতাটা খুঁজে বের করলেন। তারপর কর্নেলকে দিলেন নোটবইটা। আমি কর্নেলের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ঠিকানাটা দেখে খুব অবাক হয়ে গেলাম।

ঠিকানাটা রাঙাটুলির!

নামটা আমার অপরিচিত। হরনাথ সিংহ। তবে ঠিকানা দেখেই আমি উত্তেজিতভাবে বলে উঠলাম, কর্নেল! চিচিং ফাঁক রহস্যের সঙ্গে চন্দ্রিকার খুনের একটা লিংক পাওয়া যাচ্ছে যেন?

কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। হালদারমশাইকে নোটবইটা ফেরত দিয়ে বললেন, আপনি রাঙাটুলি যাবেন তাহলে?

হালদারমশাই বললেন, হঃ! আই মাস্ট গো। আমার ক্লায়েন্ট। টাকা খাইছি তার থনে। দিস ইজ মাই মর‍্যাল ডিউটি কর্নেলস্যার!

ফি দিয়েছিল চন্দ্রিকা? কত?

ফাইভ হান্ড্রেড।

বলেন কী!

হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ক্যান? আমার মিনিমাম ফি কর্নেলস্যার। তবে আমি অরে ইনসিস্ট করি নাই। নিজেই জিগাইল ফিয়ের কথা। দিয়াও দিল।

আপনার হাতে আর কোনও ফ্যাক্ট আছে হালদারমশাই?

মাথা জোরে নেড়ে হালদারমশাই বললেন, নাহ। কিন্তু একটা কথা। আপনি অশোকবাবুরে ডিস্কোর কথা জিগাইলেন। হু ইজ দ্যাট ম্যান কর্নেল স্যার?

জানি না। তার নাম শুনেছি। সে-ই নাকি ওলসন হাউসের কলগার্লদের গার্জেন।

ডিস্কো। গোয়েন্দা ভদ্রলোক আবার একচোট হাসলেন। তারপর আর একটিপ নস্যি নিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, আমার নেক্সট আইটেম ডিস্কো।

কর্নেল বললেন, সাবধান হালদারমশাই! ডিস্কোকে আপনার লিস্টে রাখবেন না। বরং আপাতত আপনি রাঙাটুলির কোনও হরনাথ সিংহকে নিয়েই থাকুন।

হালদারমশাই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অভ্যাসমতো যাই গিয়া বলে হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন।

বললাম, একটা কথা মাথায় ঢুকছে না। ডিস্কোর মতো লোক যার গার্ডেন, সে কেন প্রাইভেট ডিটেকটিভের সাহায্য নিতে গিয়েছিল?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সেটা আমারও মাথায় ঢুকছে না জয়ন্ত!

বলে উনি পাশের ঘরে চলে গেলেন। একটু পরে পোশাক বদলে কাঁধে একটা কিটব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন। চলো জয়ন্ত! হালদারমশাইয়ের কথা শোনার পর আবার একবার ওলসন হাউসে যাওয়ার দরকার বোধ করছি। এক মিনিট! ইন্দ্রজিৎবাবুকে ফোনে পাই নাকি দেখি।

কর্নেল ফোন ডায়াল করে সাড়া পেয়ে বললেন, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলতে চাই।…বেরিয়েছেন? কখন? … কিছু বলে যাননি? …ঠিক আছে। ফিরলে বলবেন কর্নেল সরকার ফোন করেছিলেন….

গাড়িতে যেতে যেতে বললাম, চন্দ্রিকার পার্সটা আপনি খুলে দেখলেন না। ওর ভেতর একটুকরো কাগজে কোড ল্যাংগুয়েজে কী সব লেখা আছে। ফোনে আপনাকে বলেছিলাম।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, পার্সটা নিয়েই যাচ্ছি।

সে কি?

ও নিয়ে চিন্তা কোরো না ডার্লিং। মেয়েদের পার্স সম্পর্কে বেশি চিন্তা করা ঠিক নয়।

বিরক্ত হলেও কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ পরে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে একটা বাড়ির সামনে কর্নেলের নির্দেশে গাড়ি থামালাম। বাড়ির সামনে একটা পুলিশভ্যান দাঁড়িয়েছিল। বাড়ির দরজাটা পাশের একটা সংকীর্ণ গলির দিকে। সামনের অংশটায় কয়েকটা দোকান। সেগুলো এখন খুলে গেছে। টিভি ইলেকট্রনিক গ্যাজেট এবং পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান, টেলারিং শপ ইত্যাদি।

গলিতে ঢুকলে বাড়ির দরজা থেকে এক পুলিশ অফিসার এসে কর্নেলকে অভ্যর্থনা জানালেন। সহাস্যে বললেন, আপনি চলে যাওয়ার পরই বডি মর্গে চলে গেছে।

কর্নেল বললেন, আর একবার চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটটা আমি দেখতে চাই মিঃ দাশ।

অবশ্যই। আসুন। পুলিশ অফিসার বাড়ি ঢুকে সামনে সিঁড়ির মুখে একটু থেমে চাপাস্বরে ফের বললেন, লাহিড়িসায়েব রেডিও মেসেজে জানতে চাইছিলেন, ওঁকে আপনি আবার আসবেন বলছেন, এসেছিলেন নাকি।

বাড়ির সামনে একটুখানি লন মতো। সেখানে যথেচ্ছ দিশি-বিদেশি ফুলের গাছ এবং পাতাবাহার জঙ্গল করে ফেলেছে। বাঁদিকে নিচের তলার ঘরের জানালা থেকে একজন বুড়োসায়েব ফিসফিসিয়ে ডাকলেন, কর্নেল সরকার।

কর্নেল তাকে বললেন, প্লিজ ওয়েট আ বিট মিঃ ওলসন।

বাট দিস ইজ আর্জেন্ট, য়ু নো?

ওক্যে! ওকে! জাস্ট ওয়েট আ বিট।

বাড়ির বাইরের চেহারা জীর্ণ। কিন্তু সিঁড়িতে উঠতে উঠতে টের পাচ্ছিলাম ভেতরটা সুন্দর সাজানো-গোছানো। নেহাত কলগার্লদের ডেরা বলা হলেও এটা যে আসলে অভিজাত পতিতালয় তাতে কোনও ভুল নেই। তবে এ-ও ঠিক, সব ফ্লোরের ফ্ল্যাটগুলোর দরজা বন্ধ। সুনসান স্তব্ধতা ঘিরে আছে। চারতলায় দুটো ফ্ল্যাট এবং একপাশে ফাঁকা ছাদ অজস্র ফুলের টবে সাজানো।

দুজন কনস্টেবল বেতের চেয়ারে বসেছিল। উঠে দাঁড়াল আমাদের দেখে। পুলিশ অফিসার পকেট থেকে চাবি বের করে একটা ফ্ল্যাটের তালা খুলে দিলেন। লক্ষ্য করলাম, হাঁসকলে আরেকটা তালা ঝুলছে। ওটাই তাহলে ফ্ল্যাটের নিজস্ব তালা। এই বাড়তি তালাটা নিশ্চয় পুলিশের।

পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি আবার আসবেন বলে ফ্ল্যাটের সবকিছু অ্যাজ ইট ইজ রাখা হয়েছে।

থ্যাংস্। বলে কর্নেল ঢুকলেন।

এটা ড্রয়িং রুম বলা চলে। কিন্তু আসবাবপত্র ওলটপালট ছত্রখান। কারা যেন প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি মারামারি করেছে এ ঘরে। ওল্টানো সেন্টার টেবিলের পাশে কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। একটা মদের বোতল কার্পেটের ওপর গড়াগড়ি খেতে খেতে দেয়ালের কোণায় আটকে গেছে।

বেডরুমের পর্দা ফর্দাফাই। কর্নেলের সঙ্গে ঢুকে শিউরে উঠলাম। মেঝের কাপের্ট এবং বিছানা রক্তে মাখামাখি। তবে এ ঘরেও একই ধস্তাধস্তি ওলটপালট হয়েছে।

কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন, কী বুঝছ বলো?

ধস্তাধস্তি মারামারির পর খুনটা হয়েছে?

হা চন্দ্রিকা যথাসাধ্য লড়েছিল এটুকু বলা চলে। বসার ঘরের কার্পেটে রক্তের ছিটে আছে। সেটা সম্ভবত খুনীর হাতের রক্ত। সে কিছু তন্নতন্ন খুঁজেছে খুন করার পরে।

পার্সের—

কর্নেল দ্রুত বললেন, এ ঘরে কোনও পার্স পাওয়া যায়নি জয়ন্ত।

ওঁর চোখের ভঙ্গিতে বুঝলাম, পার্স সম্পর্কে আমাকে চুপচাপ থাকতেই হবে। বললাম, পাশের ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না? তার তো টের পাওয়া উচিত।

পুলিশ অফিসার বললেন, কেটি বলে একজন অ্যাংলো মেয়ে থাকত। সে কদিন আগে বোম্বেতে তার মায়ের কাছে চলে গেছে। আমরা চেক করেছি। একটা টেলিগ্রাম পাওয়া গেছে, মায়ের অসুখ। চাবি দিয়ে গেছে ওঁর কাছে।

কর্নেল ঘরের ভেতর এখানে ওখানে হুমড়ি খেয়ে বসে, কখনও দাঁড়িয়ে কী সব পরীক্ষা করছিলেন, তা উনিই জানেম। বললাম, কিন্তু ধস্তাধস্তির শব্দ নিচের ফ্ল্যাটের লোকেদের টের পাওয়া উচিত।

পুলিশ অফিসার মুচকি হেসে বললেন, এ বাড়িতে কোন ঘরে কী হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বুঝতেই পারছেন, বাড়িতে কারা থাকে। সারাদিন মদের ফোয়ারা ছোটে। আর হুল্লোড়।

কর্নেল বললেন, বেরুনো যাক এবার। নতুন কিছু দেখার মতো নেই মিঃ দাশ। আপনি দরজায় তালা এঁটে দিন। আমরা মিঃ ওলসনের ঘরে একটু আড্ডা দিয়ে চলে যাব। আপনি আপনার ডিউটি করুন।

নীচে ওলসন কর্নেলের অপেক্ষা করছিলেন। কর্নেল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওলসন আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর জানালায় উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে গদিআঁটা পুরনো একটা চেয়ারে ধপাস করে বসলেন। ওঁর চোখে উত্তেজনা জ্বলজ্বল করছিল। ফিসফিসিয়ে ইংরেজিতে বললেন, কর্নেল সরকার! আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগে মনে পড়ল কথাটা। তবে ফোনে বলতেও ভরসা পাইনি। বলা যায় না, আমার ফোন ট্যাপ করা আছে কি না।

এবার স্বচ্ছন্দে বলুন মিঃ ওলসন।

আপনাকে বলেছি, চন্দ্রিকা ওর পার্স কোথায় হারিয়ে আমার কাছে ওর ফ্ল্যাটের তালা খোলার জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিল। আমি ওকে বললাম, তুমি ডিস্কোসায়েবকে ফোন করো। তার কাছে সব ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। বলেছিলাম তো?

বলেছিলেন।

তখন আমার এখান থেকে চন্দ্রিকা ডিস্কো শয়তানটাকে ফোন করেছিল।

এ-ও বলেছে আমাকে।

ওলসন ঝুঁকে এলেন কর্নেলের দিকে। যেটা বলতে ভুলেছি, বলছি। ডিস্কোর ফোন নাম্বার আমি এতকাল জানতাম না। আমার বাড়ির কোনও খানকিই আমাকে সেটা জানাতে চায় না। চন্দ্রিকাও না। কিন্তু চন্দ্রিকা যখন ফোনে ডায়াল করছিল, নাম্বারগুলো– আমি দেখে নিয়েছিলাম। ভুলে যাব বলে একটু পরেই তা লিখে রেখেছিলাম। এখন নাম্বারটা আপনাকে দিতে পারি।

বলে হ্যারি ওলসন পকেট থেকে একটা চিরকুট দিলেন কর্নেলকে। কর্নেল সেটা দেখে পকেটে ভরলেন। তারপর বললেন, ডিস্কোকে আপনি কখনও দেখেননি বলছিলেন। তো–

হ্যাঁ। ওর লোকেদের দেখেছি। নচ্ছার গুণ্ডা তারা।

তো তারপর চন্দ্রিকা ওপরে চলে যায়, বলেছিলেন।

ঠিক। তারপর আর কিছু জানি না। ওলসন বিমর্ষ মুখে বললেন। কিন্তু ডিস্কো হারামজাদা চন্দ্রিকাকে যার হাত দিয়ে চাবি পাঠিয়েছিল, সেই খুন করেনি তো?

খুনের কী মোটিভ থাকতে পারে তার?

ওলসন একটু ভেবে বললেন, এমনও হতে পারে ডিস্কোশয়তানটার হুকুমেই সে চন্দ্রিকাকে খুন করে গেছে। সম্ভবত চন্দ্রিকা ওকে ব্ল্যাকমেল শুরু করেছিল।

এ কথা কেন আপনার মনে হচ্ছে মিঃ ওলসন?

ওলসন আবার একটু ভেবে নিয়ে বললেন, চন্দ্রিকা শুধু নয়, অন্য মেয়েরাও আমার ঘরে ফোন করতে আসে। অনেক সময় তারা ফোনে ডিস্কোর সঙ্গেও কথা বলেছে। আবার কখনও ডিস্কো আমাকে ফোন করে বলেছে, আমি ডিস্কো বলছি। অমুককে ডেকে দাও। লোকটার গলা আমার চেনা হয়ে গেছে। খুব ভদ্র, মার্জিত কণ্ঠস্বর। মনে হবে যেন কোনো অমায়িক সজ্জন ভদ্রলোক।

আপনি এসব কথা আগেও বলেছেন আমাকে।

হ্যাঁ। ওলসন ভারি শ্বাস ছাড়লেন। ইদানিং চন্দ্রিকা যে কণ্ঠস্বরে ডিস্কোর সঙ্গে কথা বলত, আমার মনে হতো মেয়েটা ওকে হুমকি দিচ্ছে। গতকাল রাত্রেও যে ভাবে চাবি হারানোর কথা বলে শীগগির ডুপ্লিকেট চাবি পাঠাতে বলছিল, আমার মনে হচ্ছিল যেন ধমকাচ্ছে। আমার এটা কিন্তু অবাক লেগেছে। চন্দ্রিকার আগের কণ্ঠস্বর এবং ইদানিংকার কণ্ঠস্বর এক ছিল না কর্নেল সরকার।

কর্নেল একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন, সম্ভবত আপনার কথা ঠিক। কিন্তু ডিস্কো কী এতই বোকা যে সে চন্দ্রিকাকে তার ঘরে খুন করতে লোক পাঠাবে? ইচ্ছে করলে সে বাইরে যে-কোনও জায়গায় চন্দ্রিকাকে খতম করতে পারত।

ওলসন শুধু বললেন, তা ঠিক।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলি মিঃ ওলসন। আশা করি, আর পুলিশ আপনাকে জেরা করছে না?

ওলসন হাসবার চেষ্টা করে বললেন, নাহ্। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। কে

উ ফোন করে চন্দ্রিকা সম্পর্কে খবর নিয়েছিল কি মিঃ ওলসন?

ওলসন নড়ে উঠলেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটু আগে কে ফোন করে জিজ্ঞেস করছিল, চন্দ্রিকা খুন হয়েছে সত্যি কি না?

নাম বলেনি?

নাহ। ওর কোনও প্রেমিক হবে। এ বাড়ির খানকিদের প্রেমিকরাও এই ফোনে ওদের খবর নেয়। নরকে পড়ে আছি কর্নেল সরকার। আমার মৃত্যু যত শীগগির হয়, বেঁচে যাই। এ বয়সে যাবই বা কোথায়?

কর্নেল হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, দুঃখিত মিঃ ওলসন। ভুলে গিয়েছিলাম। কোনও প্রশ্ন করবেন না এখন। চন্দ্রিকার হারানো পার্সটা আমি উদ্ধার করেছি। এটা আপনি রাখুন। ডিস্কো ফোন করলে তাকে এটার কথা জানাবেন। এটা ফেরত নিতে বলবেন। তারপর ওর লোকের হাতে দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমার কথা বলবেন না যেন।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কর্নেল তার কিটব্যাগ থেকে পার্সটা বের করে ওলসনের হাতে গুঁজে দিলেন। চাপাস্বরে ফের বললেন, পুলিশকেও জানাবেন না যেন। আপনার নিরাপত্তার জন্যই বলছি।…..

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, পার্সটার ভেতরে সেই অদ্ভুত চিরকুটটা–

কর্নেল হাসলেন। ওটা আমি বের করে রেখেছি, ডার্লিং! এই দেখ।

চিরকুটটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল আমার। বললাম, এটা কিসের কোড বলে মনে হচ্ছে আপনার?

এখনও কিছু ভাবিনি এ সম্পর্কে।

চন্দ্রিকা রায়ের সঙ্গে রাঙাটুলির সম্পর্ক আছে। এ ব্যাপারে কী ভাবছেন বলতে আপত্তি আছে?

কর্নেল বললেন, শুরুতেই রহস্য এত বেশি জট পাকালেই সমস্যা। বোধবুদ্ধি ঘুলিয়ে যাবে। কাজেই একটা করে সূত্র ধরে এগোনোই ভাল। হুঁ, তুমি সঠিক রাস্তা দিয়েই চলেছ। আমার ঘরে না বসলে আমার মাথা খোলে না।

সানি ভিলার তিনতলার ড্রয়িং রুমে ঢুকেই কর্নেল টেলিফোন তুললেন। ডায়াল করে সাড়া এলে বললেন, মিঃ ডিস্কো?….সে কী! রং নাম্বার?…জাস্ট আ মিনিট। জাস্ট আ মিনিট! রাঙাটুলির হরনাথ সিংহ এই নাম্বারটা আমাকে দিয়ে বলেছেন… বলেছেন, চন্দ্রিকা রায়ের কলকাতার গার্জেনকে এই নাম্বারে পাওয়া যাবে।…বুঝতে পারছেন না? আপনার নামটা প্লিজ…সরি মিঃ ডিস্কো…ডিস্কো নন আপনি? কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিও তো…না, না। আমি পুলিশ নই।…রং নাম্বার? সত্যি বলছেন? ঠিক আছে। তা হলে ছাড়ছি। কিন্তু হরনাথবাবু, ইন্দ্রজিৎবাবু দুজনেই তো…হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভুল হতেই পারে। ধন্যবাদ। রাখছি। তবে আমার নাম্বারটা নিয়ে রাখুন প্লিজ।…।

কর্নেল নাম্বার বলে ফোন রেখে হাসতে হাসতে বললেন, ডিস্কোই বটে। কথাগুলো শুনতেও চায়। কিন্তু রং নাম্বার বলতে ছাড়ছে না। যাক্ গে, বোতাম টিপে দিলাম। খেলাটা শুরু হয়ে যাক।

বললাম, একটা ব্যাপার ভাবতে আমার খারাপ লাগছে।

কী সেটা?

চন্দ্রিকা আমাদের গাড়িতে পার্সটা ফেলে না গেলে হয়তো খুন হতো না। নিশ্চয় বাইরের লোককে দরজা খুলত না। কিংবা ডিস্কোর লোকের পাল্লায় পড়ত না।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, সে কী করত বলা কঠিন জয়ন্ত! কিন্তু আপাতদৃষ্টে ওলসনের ধারণার ফেসভ্যালু আছে। তার মানে, ডিস্কো ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় পাঠিয়েছিল। যার হাতে পাঠিয়েছিল, তার খোঁজ যতক্ষণ না পাচ্ছি কীভাবে চন্দ্রিকা খুন হয়েছে বলা যাবে না। শুধু একটা বিষয় স্পষ্ট। খুনী চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটে ঢুকে চন্দ্রিকার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেছে। এটা চন্দ্রিকার আত্মরক্ষার লড়াই ছাড়া কিছু নয়। তবে খুন করার পর সে চন্দ্রিকার আসবাবপত্র তন্নতন্ন খুঁজেছে। সবখানে রক্তের ছাপ সেটা বলে দিচ্ছে।

এই চিরকুটটাই খুঁজেছে সম্ভবত।

সম্ভবত। বলে কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে আঁচড় কাটতে থাকলেন।

কর্নেল! একটা ভাইটাল প্রশ্নে আপনি মন দিচ্ছেন না এখনও।

বলো!

কী এমন ঘটেছিল যে আমাদের গাড়িতে পার্স ফেলে গিয়েছিল চন্দ্রিকা? এমন একটা ভুল কী করে হতে পারে? হ্যাঁ, মানসিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত আপনি দিয়েছেন। কাজেই–

কর্নেল চোখ খুলে বললেন, সে বলছিল, পথে দুটো মস্তান ওর পেছনে লেগেছে।

তারা যারাই হোক, নিশ্চয় জানত চন্দ্রিকার পার্সে ওই চিরকুটটা আছে।

কর্নেল হাসলেন। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে লাভ নেই, ডার্লিং। আপাতত আমি ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি এবং ডিস্কোর দিকে তাকিয়ে আছি। সূত্র তাদেরই কাছে আছে। ওয়েট অ্যান্ড সি।…

এ বেলা কর্নেল আমাকে বাড়ি ফিরতে দিলেন না। তাঁর সঙ্গেই লাঞ্চ খেতে হলো। তার কথামতো আমার কাগজের অফিসে জানিয়ে দিতে হলো, একটা মার্ডারকেসের রোমাঞ্চকর এবং এক্সক্লসিভ স্টোরির পেছনে লড়ে যাচ্ছি। কাজেই অফিসে যেতে দেরি হতে পারে।

লাঞ্চের পর সোফায় লম্বা হয়ে গড়াচ্ছিলাম। কর্নেল একটা অর্কিডসংক্রান্ত বইয়ে বুঁদ হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পরে ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী এসে বলল, বাবামশাই! এক ভদ্রলোক এয়েছেন।

কর্নেল বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বললেন, নিয়ে আয়।

যিনি এলেন, তাঁর বয়স চল্লিশের মধ্যেই। পরনে আলিগড়ি চুস্ত পাঞ্জাবি। একমাথা ঝাকড়া চুল। সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারায় বিপর্যস্ত ভাব। তাকে দেখে কর্নেল বলে উঠলেন, আসুন ইন্দ্রজিৎবাবু! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। সাড়ে তিনটে অব্দি দেখে বেরোতাম এক জায়গায়।

ইনিই সেই ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি? পরগাছা নাটকের পরিচালক? তারপরই মনে পড়ে গেল, মঞ্চের গাছের তলায় আধপাগলা লোকটির চরিত্রে এঁকেই তো দেখেছিলাম।

কর্নেল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। একটু চুপ করে থাকার পর ইন্দ্রজিৎবাবুআস্তে বললেন, আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে কর্নেল সরকার। খালি মনে হচ্ছে, আমারই বুদ্ধির দোষে চন্দ্রিকা মারা পড়ল। আপনাকে আমি আগে যদি সব কথা খুলে বলতাম।

কী কথা ইন্দ্রজিৎবাবু?

গতকাল সন্ধ্যায় আপনাকে আমার নাটক দেখার আমন্ত্রণ করেছিলাম। এর উদ্দেশ্য ছিল। চন্দ্রিকা বলেছিল, আমার দলে শয়তান ডিস্কোর চর ঢুকেছে। কিন্তু চন্দ্রিকা জানত না কে সেই চর। তাই ওকে আপনার কথা বলেছিলাম। আপনার চেহারার বিবরণও দিয়েছিলাম। তখন ও বলল, ওদের বাড়িতে ওলসনসায়েবের কাছে আপনি যান। তার মানে, আপনাকে সে চেনে। তবে আপনাকে শুধু কর্নেলসায়েব বলেই চেনে। যাই হোক, গতরাতে ভাবলাম, থিয়েটার শেষ হলে আপনি গ্রিনরুমে আসবেন। কিন্তু এলেন না।

যাইনি আপনার স্বার্থে। আপনিও বলেছিলেন, প্রকাশ্যে আপনার সঙ্গে যেন না মিশি।

হ্যাঁ। তবু ভেবেছিলাম, আরও সব আমন্ত্রিত মানুষের ভিড়ে আপনিও আসবেন।

ঠিক আছে। তারপর কী হয়েছিল বলুন। সেটাই আমার জানা দরকার।

আশ্চর্য ব্যাপার। থিয়েটার শেষ হওয়ার পর চন্দ্রিকাকে আর খুঁজে পেলাম না। গেস্টদের সঙ্গে গ্রিনরুমে কথাবার্তা না বলে তখনই বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দেখি, চন্দ্রিকা সবে একটা ট্যাক্সিতে চাপছে। দৌড়ে গিয়ে বললাম, কী ব্যাপার? চলে যাচ্ছ যে? চন্দ্রিকা বলল, কর্নেলসায়েবের গাড়ি ফলো করছি। তুমি চিন্তা করো না। ওঁকে আমার এখনই মিট করা দরকার। বুঝলাম, প্রকাশ্যে আপনার সঙ্গে মিট করতে সেও যায়নি।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, এখন বুঝতে পারছি, সে ট্যাক্সি নিয়ে আমাদের গাড়ির পেছনে আসছিল। তারপর থিয়েটার রোডের একটা মোড়ে সম্ভবত যামে আমাদের গাড়ি হারিয়ে ফেলে। তখন ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে আমাদের খুঁজতে শুরু করে। হ্যাঁ ইন্দ্রজিৎবাবু! সে আমাকে খুঁজেও পেয়েছিল। সে লিফট চাইল। তখন বৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া তার পেছনে নাকি দুটো মস্তান লেগেছে।

মস্তান লাগার ব্যাপারটা হয়তো ঠিক নয়। আসলে সে আপনার সঙ্গে কথা বলতেই চেয়েছিল।

কিন্তু কিছুই বলেনি চন্দ্রিকা। আলাপ করার কোনও হাবভাব তার মধ্যে লক্ষ্য করিনি। বরং তাকে খুব বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল।

ইন্দ্রজিৎবাবু অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য তো!

আরও আশ্চর্য, সে তার পার্স গাড়িতে ফেলে ওলসন হাউসে ঢুকে গিয়েছিল। তখনও অবশ্য জোর বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু পার্সটা–কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটু পরে ফের বললেন, হ্যাঁ। আসলে সে আমার জিম্মায় পার্সটা রাখতে চেয়েছিল।

পার্স? ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি চমকে উঠে আবার বললেন, পার্স?

হ্যাঁ। ছোট্ট একটা পার্স। পার্সে ওর ফ্ল্যাটের চাবি ছিল। আরও চাবি ছিল দুটো। ফ্ল্যাটের চাবির ডুপ্লিকেট সে ডিস্কোর কাছে পাবে জানত। অন্য চাবি দুটোর ডুপ্লিকেট তার ফ্ল্যাটে থাকা উচিত। কাজেই চাবি খোয়া গেলেও তার অসুবিধা ছিল না।

তা হলে পার্সে এমন কী ছিল যে সেটা আপনার জিম্মায় রাখতে চেয়েছিল?

কর্নেল চোখ খুলে বললেন, আপনি বুদ্ধিমান ইন্দ্রজিৎবাবু।

পার্সটা আপনি হাতড়ে দেখেছেন নিশ্চয়?

দেখেছি।

কিছু সন্দেহজনক জিনিস নেই ওটার মধ্যে?

কর্নেল হাসলেন। সন্দেহজনক? নাহ্। কিছু টাকা, একজন, উঁকিলের একটা কার্ড, আর–

আর কী?

চাবি।

প্লিজ পার্সটা একটু দেখাবেন?

ওটা ওলসনসায়েবকে দিয়েছি। ডিস্কোকে উনি ফেরত দেবেন।

ইন্দ্রজিৎবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। একটু পরে বললেন, পার্সটা হাতছাড়া করা ঠিক হয়নি আপনার।

কেন বলুন তো?

ওটার মধ্যে এমন কিছু সন্দেহজনক জিনিস থাকতে পারে, যা আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। কারণ আপনারই মতে, পার্সটা আপনার জিম্মায় রাখাই চন্দ্রিকার উদ্দেশ্য ছিল। তার ওই একটাই অর্থ হয়।

আবার বলছি, আপনি বুদ্ধিমান ইন্দ্রজিৎবাবু।

আমি বললাম, কিন্তু স্টেজে অভিনয়ের সময় চন্দ্রিকা পার্স কারুর কাছে রেখেছিল নিশ্চয়?

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, ছোট্ট একটা পার্স সে পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেও অভিনয় করতে পারে স্টেজে। তা-ই না ইন্দ্রজিৎবাবু?

ইন্দ্রজিৎবাবুসায় দিলেন। তারপর লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার দ্বিতীয় ভুল, ডিস্কো ফোনে আমাকে চন্দ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতেই হুমকি দিত, সেই কথাটা খুলে আপনাকে বলিনি। শুধু বলেছিলাম, ওলসন হাউসে যেতে কেউ মকি দিচ্ছে। আমার জানানো উচিত ছিল, চন্দ্রিকার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক। জনাইনি।

আপনার গ্রুপে অভিনয় করে একজন কলগার্ল। আপনি এটুকু অবশ্য বলেছিলেন।

ইন্দ্রজিৎবাবু আস্তে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু বলিনি–আসলে লজ্জাবশতই বলতে পারিনি, চন্দ্রিকা অভিজাত ঘরের মেয়ে। নিজের স্বামীকে খুন করে প্রাণ বাঁচানোর জন্যই শয়তান ডিস্কোর আশ্রয় নিয়েছিল। কর্নেল সরকার! চন্দ্রিকা লাংঘাতিক মেয়ে ছিল, এটা যেমন সত্য, তেমনি এ-ও সত্য, তার স্বামী রথীন চৌধুরীও ছিল একজন নরপিশাচ। হৃদয়হীন, স্বার্থপর, বর্বর। চন্দ্রিকাকে রথীনই প্রথম পাপের পথে ঠেলে দেয়। তার জীবনের এই শোচনীয় পরিণতির জন্য সে-ই দায়ী।

ডিস্কো কে?

ইন্দ্রজিৎবাবু তাকালেন। দৃষ্টিটা ক্রুর মনে হলো। বললেন, জানি না। আপনি এবার তাকে খুঁজে বের করুন। আমি নিজের হাতে তাকে শাস্তি দেব।

চন্দ্রিকা তার কোনও পরিচয় দেয়নি?

না। কারণ চন্দ্রিকা কখনও তাকে দেখেনি। ডিস্কো আড়ালে থেকে সব চালায়।

আপনি হরনাথ সিংহকে চেনেন?

হ-র-না-থ সিংহ? ইন্দ্রজিৎবাবু আস্তে উচ্চারণ করলেন কথাটা।

হ্যাঁ। রাঙাটুলির হরনাথ সিংহ।

মাই গুডনেস! নড়ে বসলেন ইন্দ্রজিৎবাবু। চন্দ্রিকার স্বামী ছিল রাঙাটুলির লোক। চন্দ্রিকাঁদের বাড়িও তো সেখানে। চন্দ্রিকা আমাকে বলেছিল।

চন্দ্রিকার সঙ্গে কোথায় কী করে আপনার পরিচয় হয়েছিল?

পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে। মুনলাইট বার। বারের একজন অ্যাংলো ওয়েটার চ্যাংকো আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। ওই বারে কলগার্লরা যায়। তো প্রথম আলাপেই চন্দ্রিকা থিয়েটারে অভিনয়ের সুযোগ দিতে অনুরোধ করেছিল।

কর্নেল ষষ্ঠীচরণকে ডেকে কফি আনতে বললেন। তারপর বললেন, হরনাথ সিংহের কথা চন্দ্রিকা আপনাকে বলেনি কখনও। মনে করে দেখুন।

নাহ। মনে পড়ছে না।

একটু পরে কর্নেল বললেন, চন্দ্রিকার পার্সে অ্যাডভোকেটের কার্ড পাওয়ার অর্থ বোঝা গেল সম্ভবত। মার্ডার চার্জ ছিল চন্দ্রিকার নামে।

হ্যাঁ। সে প্রায় বছর সাত-আট আগের কেস। তবে ডিস্কো প্রভাবশালী লোক। কেস থেকে তাকে বাঁচায়।

ডিস্কোর সঙ্গে চন্দ্রিকার কীভাবে পরিচয় হয় আপনি জানেন?

জানি না। চন্দ্রিকা খুলে কিছু বলেনি।

আপনি কি জানেন, চন্দ্রিকা ইদানিং ডিস্কোকে ব্ল্যাকমেল করত কি না?

বলেনি আমাকে। ওই যে বললাম, ওর হাত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল।

এই সময় ফোন বাজল। কর্নেলের ইশারায় ফোন তুলে সাড়া দিলাম। কোনও মেয়ে জানতে চাইছে, ফোনের নাম্বার এই কি না। বললাম, হ্যাঁ। বলুন, কাকে চাই?

জবাব এল, এখানে কথা বলুন। তারপর পুরুষকণ্ঠে কেউ বলল, হ্যালো!

কাকে চাই বলুন?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে।

কে বলছেন আপনি?

ডিস্কো।

ঝটপট ফোনের মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে কর্নেলকে বললাম, ডিস্কো।

কর্নেল ফোন নিয়ে বললেন, বলুন মিঃ ডিস্কো! …আমাকে চেনেন তাহলে? কিন্তু দুপুরে তখন তো…ও। পরে খোঁজ নিয়ে পরিচয় পেলেন? ধন্যবাদ।.বলেন কী! ওলসনসায়েব…ঠিক আছে। প্রাণের ভয়ে বুড়োমানুষ আমার নাম করেছেন। পার্স পেয়েছেন তো?..না, না। ধন্যবাদ দেওয়ার কী আছে?…..হ্যাঁ মিঃ ডিস্কো! চন্দ্রিকার খুনী আপনি নন।… নিশ্চয়! আই মাস্ট ফাইন্ড আউট…..জাস্ট আ মিনিট! কালরাত্রে আপনি কার হাত দিয়ে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি……ও মাই গড! সে কী! কোথায়?…ঠিক আছে। …হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!

বুঝলাম, লাইন কেটে গেল। কর্নেল ফোন রেখে গম্ভীর মুখে বললেন, যাই হোক, ডিস্কোর সঙ্গে এতক্ষণে যোগাযোগ হলো। তখন ফোনে ওর ডামি নাকি কথা বলেছিল। বুঝলে জয়ন্ত? অবশ্য এ-ও ডিস্কোর ডামি কি না বলা কঠিন। তবে অদ্ভুত ঘটনা, যে লোকটিকে দিয়ে ডিস্কো ডুপ্লিকেট চাবি পাঠিয়েছিল, তার ডেডবডি পাওয়া গেছে বেলেঘাটার কাছে ক্যানেলে। শট ডেড।

চমকে উঠে বললাম, তা হলে ওলসনসায়েবের ধারণাই পরোক্ষে সত্যি। যে চাবি এনেছিল, সেই…

ইন্দ্রজিৎবাবু ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, ফোনটা আমাকে দেওয়া উচিত ছিল কর্নেল সরকার।

ষষ্ঠী কফি নিয়ে এল। কর্নেল বললেন, কফি খান ইন্দ্রজিৎবাবু! উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই।

কফি খেতে খেতে ইন্দ্রজিৎবাবু বললেন, চন্দ্রিকার পার্সটা শয়তান ডিস্কোকে ফেরত দেওয়া ঠিক হয়নি। তারপর ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ ঘরে স্তব্ধতা ঘনিয়ে এল। কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়েছিলেন। ওই অবস্থায় কফিতে দিব্যি চুমুক দিচ্ছিলেন। ইন্দ্রজিৎবাবু কফি শেষ করে ঘড়ি দেখে বললেন, উঠি। আবার যোগাযোগ করব। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কর্নেল সরকার! আপনি ডিস্কোকে আমার মুখোমুখি দাঁড় লাতে পারলে আমি খুশি হব।

কর্নেল শুধু বললেন, দেখা যাক।

ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমার কেন যেন মনে হলো, ভদ্রলোক নিছক নাটকের লোক নন।…