সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
কর্নেল সমগ্র
ফাঁদ
এ সমুদ্রে অ্যাল্বাট্রস পাখি নেই। তবু একটা রেস্তোঁরা-কাম-বারের নাম অ্যাল্বাট্রস। ভারতের পূর্ব-উপকূলে এমন চমৎকার মিষ্টি স্বভাবের টাউনশিপই বা কটা আছে? সমুদ্রও এখানে বেশ শান্ত। মার্চের দক্ষিণবায়ু দুপুরেরর দিকে দাপাদাপি করলেও বিকেলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঢেউগুলো খুব আড়ষ্ট হয়ে বালির বীচে শুয়ে পড়তে চাইছে। আমার জুতোর তলা একটুখানি ভিজে যাচ্ছিল। এটাই আমাকে সমুদ্রস্নানের আনন্দ দিল। আমার বৃদ্ধ সঙ্গী বলেন, অনেকের অনেকরকম আতঙ্ক থাকে। যেমন বেড়ালের জলাতঙ্ক। জানি, উনি আমাকেই ঠাট্টা করেন। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সমুদ্র যতই শান্ত হোক, সমুদ্র হচ্ছে সমুদ্রই। তার জল লোনা, বিশ্রী রকমের স্বাদ তার। আত্মহত্যার দরকার না হলে কখনও আমি সমুদ্রে নামব না।
যতক্ষণ বীচে জলের ধার ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে বেড়ালুম, আড়চোখে লক্ষ্য করে গেলুম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার টুপি খুলে অ্যাল্বাট্রসের লনে বসে আছেন। তাঁর টাকের ওপর নারকেল গাছের ছায়ার ফাঁক দিয়ে রোদের চিরুনি চলছে—অবশ্য বৃথাই। উনি খুবই আলাপী, সদালাপী এবং গায়েপড়া—তা সত্ত্বেও এখনও কোনও আগন্তুক ওঁর পাশে বসে নেই। এতদিন বাদে ওঁকে দারুণ একলা দেখাচ্ছিল। আমার মায়া জাগছিল।
পিছনে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য নেমে গেলে সমুদ্রে এতক্ষণে রঙের খেলা শুরু হলো। এই দৃশ্যের বর্ণনা ভাষায় দেওয়া যায় না, ছবি এঁকে খানিকটা যা অনুসরণ করা যায়। আমি না লেখক, না ছবি আঁকিয়ে নিতান্ত সাংবাদিক। এই ব্যাপারটার রিপোর্টাজ লিখতে হলে আমার চাকরি রাখা কঠিনই হতো। আমি রিপোর্টার। আমার চিফ বলেন, জয়ন্তের মেটিরিয়াল থাকে—কলম থাকে না এবং এটাই হচ্ছে ট্রাজেডি।
মিনিট পাঁচেক ওই রঙের খেলা দেখে চোখ ব্যথা করতে থাকল। তখন ঘুরে দাঁড়ালুম এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য উপকূলনগরীকে রহস্যময় অন্ধকারে ডুবে থাকতে দেখলুম। চোখ পিটপিট করে সেই অন্ধকারকে তাড়াতে চাইছি, এমন সময় পাশ থেকে কে বলে উঠল—কিছু মনে করবেন না, আপনি কি বাঙালী?
বাঙালী ব্যারাম আমারও একটু-আধটু আছে। তবে সেজন্য নয়, যাঁর প্রশ্ন তিনি এক মহিলা। এটাই আমাকে অসাধারণ ভব্য করে তুলল। রঙচমকানো চোখের অস্বচ্ছতায় একটা শাড়িপরা মূর্তি ভেসে উঠল। বললুম— আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি……
—নমস্কার। আমি……আমি কলকাতা থেকে এসেছি। আমি একটু বিপদে পড়েছি—একটু সাহায্য পেতে পারি কি?
চোখের স্বচ্ছতা তখনও ফেরে নি। তাই মুহূর্তে মাথায় এল, নির্ঘাৎ কিছু ভিক্ষেটিক্ষে চাইবার ব্যাপার ঘটছে। তক্ষুণি গম্ভীর হয়ে বললুম—বিপদ! কী বিপদ?
—আমার স্বামীকে দুপুর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না।
হাসি চেপে বললুম—খুঁজে পাচ্ছেন না? আপনার স্বামীকে? তার মানে?……
—হ্যাঁ। আমরা এখানে এসেছি গতকাল সন্ধ্যায়। তারপরেই এমন কতকগুলো ব্যাপার ঘটল, খুব ভয় পেয়ে গেলুম। উনি অবশ্য গ্রাহ্য করলেন না। আজ দুপুরে খাওয়ার পর উনি আসছি বলে বেরিয়ে গেলেন। তখন প্রায় একটা বাজে। এখন পাঁচটা। দেরি দেখে সম্ভবপর সব জায়গায় খুঁজলুম, কিন্তু কোন খোঁজ পেলুম না। আমার বড় ভয় হচ্ছে……
বলেই ভদ্রমহিলা যেন কান্নার আবেগ সামলাতে থেমে গেলেন। ততক্ষণে আমার চোখ থেকে রঙের ভেলকি ফুরিয়ে গেছে। দৃষ্টি স্পষ্ট হয়েছে। দেখলুম, মহিলার বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হতেই পারে না, মোটামুটি ফর্সা রঙ, হাল্কা গড়ন কিন্তু চেহারা মন্দ না, চোখ দুটো টানাটানা এবং দুটো শক্তিশালী ভুরুর প্রশ্রয়ে একটু প্রগলভও বটে। বড়লোকের বউ বলে মনে হলো না। আবার গরীব বা নিম্নমধ্যবিত্তও নয়। ব্যক্তিত্ব আছে এবং তাই তাঁর বিবরণে কোনও ফাঁকি থাকতে পারে না।
রহস্যের গন্ধে চঞ্চল হয়ে উঠলুম। আড়চোখে দূরে অ্যাল্বাট্রসের লনে কর্নেলকে দেখে নিলুম। উনি যেন চোখ বুজে ঝিমুচ্ছেন।
বললুম—খুব অদ্ভুত ব্যাপার তো! কিন্তু আপনার স্বামী তো মাত্র চার ঘণ্টা আগে বেরিয়েছেন—কোথাও নিশ্চয় কোনও জরুরী কাজে আটকে পড়েছেন। এতে ভাববার কারণ আছে বলে তো মনে হয় না। আরও কিছুক্ষণ দেখুন না—নিশ্চয় ফিরে আসবেন। আর…ইয়ে, আপনার স্বামীর নামটা জানতে পারি?
—পুলকেশ মৈত্র। আমি তৃণা মৈত্র।
—আমি জয়ন্ত চৌধুরী।…একটু ইতস্তত করে কেন কে জানে বলে ফেললুম— আপনি প্রখ্যাত দৈনিক সত্যসেবকের নাম নিশ্চয় জানেন। আমি ওই কাগজের রিপোর্টার।
শুনে তৃণা মৈত্র উজ্জ্বল মুখে বলল—আপনি রিপোর্টার? জয়ন্তবাবু, প্লীজ, এ বিপদে আমাকে সাহায্য করুন একটু। এখানে এসে একজনও বাঙালী দেখতে পেলুম না। তাই বিশ্বাস করে কাউকেও কথাটা বলতে পারিনি। হঠাৎ দূর থেকে আপনাকে দেখে কেন যেন মনে হলো…
বাধা দিয়ে বললুম—আপনার স্বামীর বিপদ হয়েছে, একথা ভাবছেন কেন? তৃণা বলল—ভাবতে বাধ্য হচ্ছি জয়ন্তবাবু। বললুম না, গতকাল সন্ধ্যা থেকে এমন কতকগুলো ব্যাপার ঘটল যাতে খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলুম। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কোনও বিপদ ঘটবে। ওকে বারবার বললুম, চলো—আমরা ফিরে যাই। ও শুনল না।
—আপনারা কি এই প্রথম নীলাপুরমে এলেন? উঠেছেন কোথায়?
—হ্যাঁ। এই প্রথম। আমরা উঠেছি সি ভিউ হোটেলে।
—কোন বিশেষ কাজে, নাকি বেড়াতে?
—বেড়াতে।…বলে তৃণা ব্যস্ততার ভাব দেখাল। — জয়ন্তবাবু, আপনাকে আমি সবই বলব। এখন ওকে খুঁজে বের করতে আমায় একটু সাহায্য করুন।
চিন্তিত মুখে বললুম—তাহলে একটা কাজ করা যেতে পারে। থানায় যাওয়া যাক। কী বলেন? পুলিশকে সবটা জানানো দরকার। তারপর…
তৃণা বাধা দিয়ে বলল—না। প্লীজ! পুলিশকে আগেভাগে সব জানাতে গেলে অনেক গোলমালে পড়ে যাব।
—কিন্তু পুলিশের সাহায্য ছাড়া আমরা কতটুকু কী করতে পারি বলুন? আমিও তো এখানে নতুন এসেছি।
তৃণা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল—নীলাপুরম জায়গাটা তো ছোট্ট। আমি একা খুঁজে বেড়াতে সাহস পাচ্ছি না। পেতুম—যদি কাল রাতে ওই ব্যাপারগুলো না ঘটত! আপনি আমার সঙ্গে থাকলে আমার একটুও ভয় করবে না। প্লীজ, জয়ন্তবাবু!
এ একটা বিচিত্র ব্যাপার সন্দেহ নেই। একলা হলে নিশ্চয় এমন সহজ শান্ত স্বরে কথা বলতে পারতুম না। উদ্বেগে অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে পড়তুম। কিন্তু হাতে আমার তুরুপের তাস আছে—রহস্যভেদী বৃদ্ধ বন্ধু। ওঁর সঙ্গেই বেড়াতে এসেছি নীলাপুরমে। অমন ধুরন্ধর সাহসী প্রাজ্ঞের ব্যাকগ্রাউণ্ডে থেকে আমি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারি।
কিন্তু উনি আপাতত বাইরে থাকুন। দৈনিক সত্যসেবকের প্রখ্যাত ও দুদে রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরী কি এত নাবালক যে এক ভদ্রমহিলার হারানো স্বামীর খোঁজে বেরিয়ে পড়তে পারবে না? অবশ্য, এমনও হতে পারে যে পথেই পুলকেশ মৈত্রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ব্যাপারটা চুকেও গেল।
পা বাড়িয়ে পর মুহূর্তে একটু আড়ষ্ট হলুম। কী ঘটেছিল গতরাতে? এক্ষুণি পথে যেতে যেতে নিশ্চয় জেনে নেব। সেটা কতটা বিপজ্জনক হবে কে জানে! যদি সত্যি সত্যি তেমন কিছু হয়, তাহলে পরিণামে কর্নেলকে ডাকতেই হবে।
বীচের উপরে পাথরের চাঙড়! তার উপরে বাঁধ। বাঁধের পরে একটা পাহাড়ের ঢালু গায়ে ‘অ্যাল্বাট্রস।’ তার পাশ দিয়ে একফালি পিচের পথ পাহাড়ের কাঁধ বরাবর এগিয়ে ওদিকে নেমে গেছে বড় রাস্তায়। পিচের সরু পথের দুধারে বড় বড় পাথর আর ঝোপঝাড়। সাবধানে ডানদিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলুম। কর্নেল আমাকে দেখতে পেলেন বলে মনে হল না। যতক্ষণ পাহাড়টা না পেরোলুম দুজনে কোনও কথা হলো না। বড় রাস্তার দুধারে সমতল জমিতে টাউনশিপ ও ছোট্ট বাজার। সেখানে পা দিয়ে মুখ খুললুম— দেখুন মিসেস মৈত্র, সবার আগে আমাদের একটা প্ল্যান করে নেওয়া দরকার। খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার কোনও মানে হয় না। মিঃ মৈত্রের কি এখানে পরিচিত কেউ আছে? মানে—ওঁর মুখে তেমন কিছু কি শুনেছিলেন?
তৃণা মাথা নেড়ে বলল না।
—তাহলে খুঁজবটা কী ভাবে?
তৃণার মুখটা করুণ দেখাল। সে বলল— চলুন না, ওইসব লোককে জিগ্যেস করে দেখি। কারো না কারো সঙ্গে নিশ্চয় দেখা হয়েছে ওর। ছোট্ট জায়গা। বাঙালী তো নেই-ই।
হাসি পেল। হাসিটা চেপে বললুম—আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে উনি এতক্ষণ হোটেলে ফিরেছেন! চলুন না— হোটেলে আপনাদের রুমটা আগে দেখে আসি।
তৃণা একটু চঞ্চল হলো। বলল—ঠিক বলেছেন! আমার মাথা ঘুরছে—সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কিচ্ছু ভাবতে পারছিনে। চলুন, চলুন! কথাটা সত্যি আমার মাথায় আসেনি।
সে ব্যস্ত হয়ে বড় রাস্তা ধরে এগোল। ‘সী ভিউ’ হোটেল পাহাড়ের উত্তর দিকে । ‘অ্যাল্বাট্রস’ পূর্বে। ‘অ্যাল্বাট্রস’ থেকে ওখানে যাওয়ার পথ নেই, যদিও বাড়ির মাথা নজরে পড়ে। আমরা অবশ্য উঠেছি সরকারী ডাক বাংলোয়। সেটা সমুদ্রের ধারে আরও খানিকটা উত্তরে সমতল জমির ওপর। তার পিছনে সরকারী জঙ্গল আছে।
বাজারের মাঝামাঝি গিয়ে ডানদিকে, অর্থাৎ পূর্বে ঘুরে আগেরটার মতো সরু পিচের পথে উঠলুম। কিছু দূরে চড়াই ভেঙে উঠতে হলো। এখানে ওখানে সুদৃশ্য কিছু বাড়ি আছে। মাঝেমাঝে গাড়ি আসছে যাচ্ছে। লোকজনের ভিড় আছে। বীচের দিকে চলেছে বা ফিরে আসছে। বছরের এসময়টা সমুদ্র-বিলাসীদের ভিড় থাকে এখানে।
সী ভিউয়ের লাউঞ্জে ঢুকে তৃণা হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল রিসেপশনিস্ট মহিলাকে—গুড ইভনিং মিস আয়ার। আমার স্বামী মিঃ মৈত্র ফিরেছেন?
গোমড়ামুখী দক্ষিণভারতীয় কৃষ্ণাঙ্গী ঘাড় নাড়ল মাত্র। তারপর কি-বোর্ড থেকে চাবিটা দিলো। তৃণা চাবি নিয়ে ব্যস্তভাবে পা ফেলল। কার্পেটমোড়া সিঁড়ি। দোতালায় তের নম্বর ঘরের দরজার সামনে সে একটু দাঁড়াল। হতাশভাবে মাথাটা দোলাল। মুখে ঘামের বিন্দু লক্ষ্য করলুম। নিঃশব্দে আমার দিকে তাকাল একবার। যেন বলল—দেখলেন তো ও ফেরেনি।
দরজা বাইরে থেকে বন্ধ আছে। অতএব ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কী যেন ভাবল তৃণা। অস্ফুটস্বরে বলল—এক মিনিটের জন্যে আসবেন? সমস্ত ব্যাকগ্রাউণ্ডটা আপনাকে আগে বলা দরকার।
সে দরজা খুলল। ঢুকে আবার বলল— আসুন!
ভিতরে ঢুকে তাজ্জব বনে গেলুম। সী ভিউ হোটেলের খ্যাতির কথা জানা ছিল। কিন্তু এই ছোট্ট নীলাপুরমের সমুদ্রতীরে কখনও পাঁচতারা মার্কা বড় হোটেলের ব্যবস্থা আশা করিনি। মৈত্র দম্পতির এই সুইটের মাঝে সবটা নকশি কার্পেটে মোড়া এবং জুতো কয়েক ইঞ্চি দেবে যায়। ড্রয়িং রুম আর বেডরুম নিয়ে রীতিমতো অ্যাপার্টমেন্ট। দেয়ালে দেশী-বিদেশী আর্ট, কোণায় কোণায় অপূর্ব সব ফুলদানি এবং দামী আসবাবপত্র। আমার এই ভাবটা আঁচ করেই হয়তো তৃণা বলল—আমার স্বামী একটু বিলাসী-প্রকৃতির মানুষ। আপনি বসুন না প্লীজ।
সে পুবের ব্যালকনির দিকে দরজা খুলে দিতেই সারা সমুদ্র ভেসে উঠল। কাছাকাছি একটা সোফায় বসে পড়লুম। সেই সময় হঠাৎ মনে হল, এখনই যদি মিঃ মৈত্র ফিরে আসেন, তৃণার উদ্বেগ ঘুচবে—কিন্তু আমি পড়ে যাব অস্বস্তিতে। কোনও স্বামীই এই অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে অচেনা পুরুষকে দেখে খুশি হবে না। বিশেষ করে ঘরে যখন আর কেউ নেই এবং দরজাটা বন্ধ।
তাই, এই সান্নিধ্য যতই ভাল লাগুক—কিংবা পরিবেশ যত প্রীতিপদ হোক, শীগগির কেটে পড়া উচিত। বললুম—যাক্ গে। এবার সংক্ষেপে বলুন তো গতরাতে কী হয়েছে?
তৃণার কপালে ভাঁজ দেখা দিলো। তাকে অবশ্য চঞ্চল দেখাচ্ছিল বরাবর। সে বলল—হ্যাঁ, বলছি। গত সন্ধ্যায় আমরা এখানে এসে উঠলুম। ঘরেই ডিনার সার্ভ করার ব্যবস্থা আছে—সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু ও বলল—নিচের ডাইনিং হলে যাবে। চেনাজানা কেউ আছে নাকি দেখবে। ওর স্বভাবই এ রকম। সব সময় হুল্লোড় পছন্দ করে। ড্রিংক করার অভ্যেসও আছে।
তৃণা এই কথাগুলো বলার সময় পুবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল। নীচে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমে আবার বেমক্কা ঢেউয়ের মতো উঁচু হয়ে গেছে। ওই অংশটা পাথরের চাতালের মতো। তার নীচে খাড়া দেয়াল, দেয়াল ছুঁয়ে বালির বীচ। সে কথা থামিয়ে হঠাৎ সেদিকে কী যেন দেখতে থাকল।
হেসে বললুম— কী? মিঃ মৈত্রকে দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়?
তৃণার মুখে কিন্তু অন্য ভাব। কেমন ভয়ার্ত চাহনি। ঠোঁট কাঁপছে মনে হল। সে ঘুরে চাপাস্বরে বলল—সেই লোকটা। বাইনোকুলার চোখে দিয়ে এদিকে কী দেখছিল। এইমাত্র সরে গেল।
চমকে উঠেছিলুম। বললুম— কে? কোন লোকটা?
তারপর ব্যালকনিতে গিয়ে বাইনোকুলারওয়ালা কোন বদমাশকে দেখব বলে উঠতেই তৃণা সেদিককার দরজা বন্ধ করে দিলো। কাঁপতে কাঁপতে বলল— না, না! আমার বড্ড ভয় করছে। আপনাকে মিঃ মৈত্র ভেবে যদি গুলি ছুঁড়ে বসে!
উত্তেজিত হয়ে বললুম—কেন গুলি ছুঁড়বে? ব্যাপারটা কি?
তৃণা বলল—বলছি, সব বলছি। আপনি বসুন প্লীজ। একটু…একটু স্থির হতে দিন!
তার চেহারা লক্ষ্য করে ঘাবড়ে গেলুম। সে কাঁপছে, মুখটা সাদা হয়ে গেছে। টলতে টলতে সোফার কাছে এসে দাঁড়ালে বললুম—মিসেস মৈত্র! আপনি একটুও ভয় পাবেন না, অন্তত আমি থাকতে ভয় পাবার কিছু নেই। আপনি বসুন। বসে সব বলুন।
তৃণা বসল না। ভয়ার্ত মুখে আমার দিকে তাকাল শুধু।
বললুম—আপনি নিশ্চিত্ত থাকতে পারেন। কারণ, শুধু আমি নই—আমার সঙ্গে নীলাপুরমে যিনি এসেছেন, তাঁর নাম আপনি শুনে থাকবেন— কর্নেল নীলাদ্রি সরকার—প্রখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার।
তৃণা বলে উঠল—তার মানে, গোয়েন্দা?
—হ্যাঁ। অ্যাল্বাট্রসের লনে নিশ্চয় কোনও টাকমাথা বুড়ো ভদ্রলোককে দেখে থাকবেন! মুখে সাদা দাড়ি আছে। ইউরোপীয়ান বলে ভুল হতে পারে কিন্তু।
—যেন দেখেছিলুম!…হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখেছি।
—উনিই আমার ফ্রেণ্ড ফিলসফার অ্যাণ্ড গাইড বলতে পারেন। আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই। এক্ষুণি ওঁকে আমি খবর দিতে পারি। দেব?
তৃণা একটু ভেবে বলল—দেখুন, আমার মনে হচ্ছে—ব্যাপারটা নিয়ে এত শীগগির হইচই করলে নিশ্চয় আমাদের কোনও ক্ষতি হবে। আপনি আগে সবটা শুনুন। তারপর যদি মনে হয়, তাঁকে জানানো দরকার—জানাব।
—বেশ, বলুন।
তৃণা নড়ে উঠল হঠাৎ। করুণ ধরনের হাসল।—ওই দেখুন! আমি কী ভীষণ অভদ্র! আমার ঘরে গেস্ট—আর আমি সব ভদ্রতা ভুলে বসেছি! এক মিনিট!
বলে সে কোণার টেবিল থেকে ফোনটা তুলল। তারপর আমার দিকে ঘুরল। মুখটা আবার ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।
একটু বিস্মিত হয়ে বললুম—কী ব্যাপার?
ফোনটা রেখে সে ব্যস্তভাবে বলল—আশ্চর্য তো! ফোনটা ডেড।
—ডেড?
—হ্যাঁ। এক মিনিট…আমি দেখছি করিডরে বেয়ারারা কেউ আছে নাকি!
সে দরজার দিকে যাচ্ছে দেখে বললুম—কলিং বেল নেই?
—তাই তো! সরি! …বলে তৃণা কাছেই দেয়ালে সুইচ টিপল।
কোনও শব্দ শোনা গেল না। আরও কয়েকবার টিপল, তবুও না। সে আমার দিকে ফ্যাকাশে মুখে তাকাল। আমি ততক্ষণে বেশ ঘাবড়ে গেছি। বললুম—আশ্চর্য তো! আচ্ছা দেখছি!
উঠে আলোর সুইচ টিপলুম। জ্বলল না। সেই সময় চোখে পড়ল সুইটে এয়ার- কনডিশানের ব্যবস্থা আছে। হস্তদন্ত হয়ে যন্ত্রটার চাবি ঘোরাতে শুরু করলুম। কোনও সাড়া নেই। তখন ঘুরে বললুম—লোডশেডিং চলছে না তো?
তারপর দেখলুম তৃণা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
বাইরে রোদ মুছে গেছে ততক্ষণে। ঘরের ভিতরটা ধূসর হয়ে উঠেছে। ব্যালকনির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে তৃণার অপেক্ষা করতে থাকলুম। একটা রহস্যময় ঘটনার মধ্যে এসে পড়েছি, তাতে কোনও ভুল নেই। মনে মনে কর্নেলের উদ্দেশে বললুম—ওহে বৃদ্ধ ঘুঘু, তুমি সব সময় আমাকে অতি বুদ্ধিমান বলে ঠাট্টা করো। আমি গোয়েন্দা হলে নাকি বিস্তর ওলট-পালট কাণ্ড ঘটবে! হুঁ—এবার তুমি বসে-বসে দেখবে, গোয়েন্দা হবার এবং রহস্যের পর্দা ফাঁস করবার মতো বুদ্ধি জয়ন্তের ঘিলুতে প্রচুর পরিমাণেই আছে। মাননীয় গোয়েন্দামহোদয়! অপেক্ষা করো এবং দেখ!
কিন্তু তৃণা ফিরছে না। পাঁচ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করেও তার কোনও পাত্তা নেই। তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি শুরু করলুম। সেই সময় একটা আইডিয়া মাথায় এল। এখন তো তদন্তের চমৎকার সুযোগ হাতে পাওয়া গেছে! এই দম্পতির ব্যাকগ্রাউণ্ডটা জানার মতো কোনও জিনিস কি সুইটে নেই?
যেমন কথাটা মাথায় আসা, অমনি বেডরুমে ঢুকে পড়লুম। চমৎকার আধুনিক উপকরণে সাজানো ঘর। সঙ্গে টয়লেট। তার দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। আলো খুব কম। কিন্তু ওই ফাঁকে স্পষ্ট একজোড়া জুতো-পরা পা দেখতে পেলুম। পাদুটো মেঝেয় শুয়ে থাকা মানুষের।
বুকের মধ্যে রক্ত শিসিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। এক লাফে এগিয়ে দরজাটা পুরো ফাঁক করতেই, যা দেখলুম, তাতে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল।
স্যুটপরা এক ভদ্রলোক চিত হয়ে পড়ে আছেন। কপালে দুটো রক্তাক্ত ক্ষত। একপাশে একটা রিভলভার পড়ে আছে।
ওটা মৃতদেহ তাতে কোনও ভুল নেই। প্রথমে ঝোঁকের বশে রিভলভারটা তুলে নিলুম। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম সেটার দিকে। কেন এমন করলুম, জানি না।…
অ্যাল্বাট্রসের লনে বেঞ্চে বসে শেষ বেলায় দরদর করে ঘামছি আর কর্নেল আমাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। যন্ত্রের মতো জবাব দিচ্ছি। গোড়ায় উনি হাসছিলেন। ক্রমশ দেখলুম, ওঁর হাসিটা মিলিয়ে গেল। গম্ভীর মুখে বললেন—তাহলে রিভলভার তুমি হাতে নিয়েছিলে?
—হ্যাঁ।
—কেন?
—এমনি। হঠাৎ যেন পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হল।
—বোকার মতো কাজ করেছ ডার্লিং।
—সে তো এখন বেশ বুঝতে পারছি।
—আসার সময় করিডরে কেউ তোমাকে বেরিয়ে আসতে দেখেনি?
—সম্ভবত না।
—সম্ভবত কেন?
—তখন তো আমি ভীষণ ভয় পেয়ে পালিয়ে আসছি। খুঁটিয়ে দেখার মতো মনের অবস্থা ছিল না।
—সিঁড়িতে কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে?
—হ্যাঁ। একজন বেয়ারার সঙ্গে। সে চায়ের ট্রে নিয়ে উঠছিল। আমার সঙ্গে তার একটু ধাক্কা লাগে।
কর্নেল আরও গম্ভীর হয়ে বললেন—রিসেপশনে মিসেস মৈত্রের সঙ্গে হয়নি বলছ। রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে ওঁর কথা জিজ্ঞেস করেছিলে?
—না। তখন আমার মনের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন।
কর্নেল আপনমনে মাথা দোলালেন। তারপর বলেলেন—খুব বোকার মতো কাজ করেছ, জয়ন্ত। তুমি এমন বোকামি করবে, তা ভাবাই যায় না। পারিপার্শ্বিক এভিডেন্সে তোমাকেই খুনী সাব্যস্ত করা এখন খুবই সহজ।
শিউরে উঠে বললুম—সর্বনাশ!
—রিভলভারে তোমার আঙুলের ছাপ রয়েছে। কাজেই জজসাহেব তোমাকে অনায়াসে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারেন।
এই অব্দি শুনেই আঁতকে উঠে বললুম—ওরে বাবা! তাই তো!
কর্নেল এবার উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়িয়ে বললেন – দেখা যাক কী করতে পারি!
দুজনে অ্যাল্বাট্রসের লাউঞ্জে ঢুকে সোজা রিসেপশনে গেলুম। তারপর কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। আমি উদ্বিগ্ন মুখে কাচের দেয়ালের বাইরে সমুদ্র দেখতে থাকলুম। হঠাৎ চোখে পড়ল, বাঁদিকে দূরে সমুদ্রের খাড়ির উপর পাথরের চাতালে কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখে বাইনোকুলার। সমুদ্রের দিকে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে সে কী যেন দেখছে। তৃণা যাকে সী ভিউ থেকে দেখেছিল, নিশ্চয় ওই লোকটা সেই। ওখানেই তো পাহাড়ের পিঠে সী ভিউ হোটেলটা রয়েছে—এখান থেকে যদিও সেটা দেখা যাচ্ছে না। তৃণা বলেছিল— লোকটা গুলি ছুঁড়তে পারে। কিন্তু তৃণাই বা হঠাৎ উধাও হলো কেন?…
কর্নেলের ডাকে সংবিত ফিরল। চাপাস্বরে বললুম—কর্নেল। এই দেখুন সেই লোকটা!
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন— জয়ন্ত, থাক্। আর গোয়েন্দাগিরি, করতে যেও না। কেউ বাইনোকুলার দিয়ে কী দেখছে, তাতে আপাতত তোমার কিছু সুবিধে হবে না। এখন চলো, আমরা সী ভিউতে যাই। পুলিশ অফিসাররা এখনই সেখানে এসে পড়বেন।
ইতস্তত করে বললুম—কিন্তু আমার যাওয়া কি ঠিক হবে?
—হ্যাঁ। তোমার গ্রেফতার হবার সম্ভাবনাটা তো আছেই।
বুক টিপটিপ করতে থাকল। বললুম—তাহলে আমি বরং ঘরে গিয়ে থাকি।
—মোটেও না।…বলে কর্নেল আমার ডানহাতের কবজি চেপে ধরলেন এবং বলির পাঁঠার মতো আমাকে টানতে টানতে বেরোলেন।
আগের রাস্তা দিয়ে ঘুরে আমরা সী ভিউ পৌঁছলুম। কিন্তু এখন সেখানে অন্য দৃশ্য। ছোটখাটো একটা ভিড় জমে আছে। ভিড়টা চাপাগলায় কী সব আলোচনা করছে। মাদ্রাজী রিসেপশনিস্ট মিস আয়ার শুকনো মুখে ফোন ধরে কার সঙ্গে কথা বলছে। বেয়ারারা সিঁড়িতে হন্তদন্ত হয়ে উঠছে আর নামছে। কর্নেল মিস আয়ারকে কিছু বলার জন্যে ঠোঁট ফাঁক করছেন, এমন সময় একজন বেয়ারা আমার দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল—এই লোকটা! এই লোকটা! মিস আয়ারও আমাকে দেখেই বলে উঠল—মাই গড! এই তো সেই লোক!
অমনি বেয়ারার দল তুমুল হইচই করে আমাকে ঘিরে ফেলল। দারোয়ানকেও দেখলুম এগিয়ে আসতে। আমি বিকট চেঁচিয়ে বললুম—আমি নই, আমি নই!
ভিড়সুদ্ধ পাল্টা চেঁচালো—পাকড়ো! পাকড়ো! শালা খুনীকো পাকড়ো!
ভয়ে চোখ বুজে ফেললুম। মুখের সামনে অনেকগুলো হাতের মুঠো নড়ছিল। প্রচণ্ড মার আমাকে দেবেই—এই ভয়েই চোখ বুজে ফেললুম। অমনি শুনি কর্নেল তাঁর সামরিক গর্জনে সী ভিউকে যেন ফাটিয়ে দুভাগ করে ফেললেন—খবর্দার! যে যেখানে আছেন, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। যা করার, পুলিশকে করতে দিন।
মারমুখী ভিড়টা হকচকিয়ে গেল। তারপর দেখি, লন থেকে কয়েকজন পুলিশ অফিসার আর কনেস্টবল হন হন করে এগিয়ে আসছে। একজন অফিসার কর্নেলের সামনে এসেই হাত বাড়ালেন—হ্যাল্লো ওল্ড বস! এবারও দেখছি, আসামাত্র খুন খারাপি করে ফেলেছেন!
কর্নেল একটু হেসে করমর্দন করে বললেন—হ্যাঁ, মিঃ বেঙ্কটেশ! এই আমার ভাগ্য। যেখানে যাই, সেখানেই এক ইটার্নাল মার্ডারার আড়াল থেকে একটা ডেডবড়ি সামনে ফেলে দিয়ে তামাশা করে।
বেঙ্কটেশ বললেন—তাই বটে! চলুন, দেখি।…
বেয়ারারা আগে আগে উঠতে থাকল। তিনজন পুলিশ অফিসার, কর্নেল আর আমি তৃণা মৈত্রদের ঘরে চললুম। নীচে দুজন অফিসার আর কনেস্টবলরা রয়ে গেল। আর কাউকেও উঠতে দেওয়া হলো না।
সেই ভয়ঙ্কর ঘরে ঢুকতেই আমার দম আটকে এল। তবে একদিক থেকে আশ্বস্ত বোধ করছিলুম যে বেয়ারাদের করিডরে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্যে এখনও খুব ছটফট করছে নিশ্চয়। ভাগ্যিস, কর্নেল সঙ্গে আছেন।
বাথরুমে লাশটা তেমনি পড়ে আছে। কিন্তু এবার নতুন দৃশ্য চোখে পড়ল। লাশের ওপর মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে আছে সেই তৃণা মৈত্র। বেঙ্কটেশ ঝুঁকে ওর নাড়ি দেখে নিয়ে বললেন—শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মিঃ আচারিয়া! আপনি দেখুন—ডাক্তার এলেন নাকি।
একজন অফিসার তক্ষুণি চলে গেলেন। কর্নেল ও বেঙ্কটেশ তৃণাকে সাবধানে তুলে সংলগ্ন বেডরুমের খাটে শুইয়ে দিলেন। কর্নেল বললেন—জয়ন্ত। ওই গ্লাসে জল ঢালো।
কর্নেলের হুকুম তামিল করছি, সেই সময় বাথরুমে বেঙ্কটেশের কথা শুনে চমকে উঠলুম।—কী আশ্চর্য। এটা দেখছি একটা খেলনা রিভলভার।
কর্নেল বললেন— টয় রিভলভার? মাই গুডনেস!
—হ্যাঁ, কর্নেল সরকার।
—ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো।…বলে কর্নেল আমার হাত থেকে জলের গ্লাস নিয়ে তৃণার মুখে জলের ঝাপটা দিলেন।
একটু পরেই তৃণা চোখ খুলল। অস্বাভাবিক লাল চোখ। নিষ্পলক তাকিয়ে সে কর্নেলকে দেখল। তারপর আমাকে দেখেই আর্তনাদ করে উঠল—ওই, ওই লোকটা ওকে খুন করেছে। পুলিশ! পুলিশ!
আঁতকে উঠে বললুম—ছি ছি! কী সব যা-তা বলছেন। আপনিই তো আমাকে……
বেঙ্কটেশ ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়েছেন। কর্নেল চোখ টিপে আমাকে থামতে ইশারা করলে আমি থেমে গেছি। তৃণা দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদতে থাকল। কান্নার মধ্যে যা বলছে, তা একটু একটু বুঝতে পারছি। এখনও কেন আমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, এই অভিযোগ করছে সে। এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলুম, কিন্তু এবার রাগ এসে সাহস বাড়াল। মনে মনে বললুম— শয়ত্বানী, এ সবই তোমার ষড়যন্ত্র। নিজের স্বামীকে এভাবে খুন করিয়ে কারও কাঁধে চাপাবার মতলব করেছিলে। সেই মতলবে তুমি সী বীচে গিয়ে উপযুক্ত লোক খুঁজছিলে। আমিও বোকার মতো তোমার ফাঁদে ধরা দিতে এসেছিলুম। রোস, তোমার মজা দেখাচ্ছি। কর্নেল বললেন—মিঃ বেঙ্কটেশ, একটু পরেই ব্যাকগ্রাউণ্ডটা আপনাকে জানাব । আপাতত আপনি আপনার কর্তব্য করতে থাকুন।……
সী ভিউয়ের গ্রাউণ্ড ফ্লোরে রিসেপশনের পিছনে ম্যানেজারের ঘর। ম্যানেজার ভদ্রলোক বাইরে গিয়েছিলেন। এসে সব দেখে শুনে অনবরত ঠক ঠক করে কাঁপছেন। ওঁর ঘরেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমার স্টেটমেন্ট ও জেরাপর্ব চুকে যাবার পর তৃণা মৈত্রকে ডাকা হলো। তখন সাড়ে ছটা। বাইরে সমুদ্র অন্ধকারে গর্জন করছে। হোটেলের সবগুলো আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তৃণা আস্তে আস্তে মিস আয়ারের কাঁধে হাত রেখে ঘরে ঢুকল। মিস আয়ার চলে গেলে বেঙ্কটেশ বললেন—বসুন মিসেস মৈত্র। খুব দুঃখিত আমি—আপনার মনের অবস্থা জেনেও আপনাকে বিব্রত করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কর্তব্য। তাই ক্ষমা করবেন।
তৃণা বসে বলল—বলুন, কী জানতে চান?
—আপনারা কবে এসেছেন এখানে?
—সে তো হোটেলের রেজিস্টারে পাবেন। গতকাল সন্ধ্যা ছটা নাগাদ।
—আপনি জয়ন্তবাবুকে বলেছিলেন, আপনার আসার পর কী সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। কী ঘটনা?
তৃণা একটু ভেবে নিল যেন। তারপর বলল—কাল রাতে দুবার আমাদের দরজায় কে নক করেছিল। উনি দুবারই দরজা খুললেন, কিন্তু কাকেও দেখতে পেলেন না। প্রথমবার রাত ন’টায়, দ্বিতীয়বার সাড়ে দশটায়। আজ সকালে ব্যালকনিতে দুজনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ আমার চোখে পড়ল একটা লোক খাড়ির উপরে পাথরের চাতাল থেকে বন্দুক তাক করছে। উনিই দেখতে পেলেন । অমনি আমাকে টেনে বসে পড়লেন। সেই অবস্থায় গুঁড়ি মেরে আমরা ঘরে ঢুকলুম। উনি ভীষণ কাঁপছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করেও কোনও জবাব পেলুম না।
—বেশ। তারপর? আর কী ঘটনা ঘটল, বলুন।
—নীচের ডাইনিংয়ে আজ দুজনে লাঞ্চ খেতে এসেছি, একজন বয় ওঁর হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিল। লাউঞ্জে কে একজন তাকে নাকি দিয়েছে চিঠিটা! চিঠি পড়ে ওঁর মুখ শুকিয়ে গেল যেন। জিজ্ঞেস করলুম—কিন্তু এবারও কোনও জবাব দিলেন না। শুধু বললেন—পরে সব বলব। তারপর খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলেন। লাউঞ্জে গিয়ে দেখলুম—সত্যি, এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মিঃ মৈত্র আমাকে ঘরে যেতে বলে ওই ভদ্রলোকের কাছে গেলেন। আমি আমার স্বামীর কোনও ব্যাপারে কখনও কৌতূহল প্রকাশ করিনি। কিন্তু এবার খুব উদ্বিগ্ন বোধ করছিলুম। আধঘণ্টা পরে উনি ফিরলেন। তারপর বললেন—একটু কাজে বাইরে যাচ্ছি। শীগ্গির ফিরব। ভেবো না। তখন প্রায় দুটো। পাঁচটা পর্যন্ত যখন ফিরলেন না, তখন উদ্বিগ্ন হয়ে বেরিয়ে পড়লুম। তারপর ওই ভদ্রলোক —জয়ন্তবাবুর সঙ্গে দেখা হলো।…
বেঙ্কটেশ হাত তুলে বললেন—এবার, আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন। জয়ন্তবাবুকে ঘরে বসিয়ে রেখে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
তৃণা মুখ তুলে নিষ্পলক তাকাল। বলল—আমাদের রুমের ইলেকট্রিক কানেকশান কাটা দেখে নীচে বলতে এসেছিলুম। কিন্তু লাউঞ্জে নেমেই চোখে পড়ল, সেই পাথরের চাতালে সকালের বন্দুকঅলা লোকটা আর কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চেহারা অবিকল মিঃ মৈত্রের মতো—পোশাক একই রকম। বেশ খানিকটা দূর বলে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল না। তাই তক্ষুণি দৌড়ে সেদিকে গেলুম। কিন্তু আমি যেতে যেতে ওরা পাথরের আড়ালে চলে গেল। তখন কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে হোটেলে ফিরে এলুম। এসেই দেখি…
সে দুহাতে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠল। বেঙ্কটেশ বললেন—প্লীজ মিসেস মৈত্র। আমাদের আরও অনেক কিছু জানবার আছে। আপনার স্বামীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে আপনার সাহায্য খুবই দরকার।
তৃণা ভেজা চোখ তুলে বলল— বলুন, আর কী জানতে চান?
—আপনার স্বামীর পেশা কী ছিল?
—স্থায়ী কিছু ছিল না। খুব খেয়ালী মানুষ। নানারকম ট্রেডিং এজেন্সি নিয়ে থাকতেন। সম্প্রতি নতুন কোনও ব্যবসা করা কথা ভাবছিলেন।
এবার কর্নেল বললেন—মিসেস মৈত্র, আপনার স্বামী নীলাপুরমে কেন এলেন, আপনি নিশ্চয় জানেন।
তৃণা ঘাড় নাড়ল।—জানি না। আমি কখনও ওকে প্রশ্ন করতুম না। এটা আমার স্বভাবও বটে—তাছাড়া প্রশ্ন করলেই উনি বলতেন— পরে বলব ’খন। এবার হঠাৎ নীলাপুরমে আসবেন বললেন, তখন আমি কোনও প্রশ্ন করিনি।
—আপনার স্বামীর কি কোনও শত্রু ছিল জানেন?
—না। থাকলেও আমাকে বলেননি।
—আপনার স্বামীর নিশ্চয় বন্ধুবান্ধব ছিলেন?
—হ্যাঁ, তা ছিলেন বই কি। তবে উনি খুব ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। আড্ডা দিতে ভালবাসতেন।
—খুব ঘনিষ্ঠ এমন কারও-কারও নাম নিশ্চয় বলতে পারবেন?
—পুরো নাম আমি বলতে পারব না। যেমন এক ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আমাদের কলকাতার বাসায় আসতেন। অবনীবাবু নাম। আরেকজন আসতেন— তাঁর নাম মিঃ রক্ষিত।
—আপনারা কোন ট্রেনে এসেছেন হাওড়া থেকে?
তৃণা একবার ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল—কেন?
—এমনি জিজ্ঞেস করছি।
—হাওড়া থেকে ডিরেক্ট আসা যায় না কোনও ট্রেনে।
—সরি! বলে কর্নেল একটু হাসলেন।— বিন্ধ্যাচল অব্দি আসা যায়। বিন্ধ্যাচলে কখন নেমেছিলেন?
—গতকাল তিনটে পাঁচ-টাচ হবে।
—আপনার স্বামীর সঙ্গে কারও দেখা হয়েছিল ওখানে?
তৃণা নড়ে উঠল।—হ্যাঁ, হ্যাঁ। হয়েছিল। আমি ভুলে গেছি বলতে—মানে, ওই খাড়ির উপরকার চাতালে যে লোকটাকে দেখেছি, তারই সঙ্গে। বিন্ধ্যাচল স্টেশনে ওকে দেখেই উনি এগিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন—তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আসছি। পনের কুড়ি মিনিট লোকটার সঙ্গে কথা বলে ফিরে এলেন। তখন ওঁকে কেমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।
কর্নেল শুধু বললেন—আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই। মিঃ বেঙ্কটেশ, ইউ প্রসিড।
বেঙ্কটেশ ঘড়ি দেখে বললেন—মিসেস মৈত্র, আপাতত এই। আপনি ওখানে গিয়ে বসুন। মিঃ আচারিয়া, এবার ডাকুন বয় রণদীপকে।
রণদীপ বয়সে তরুণ। ঘরে ঢুকে সেলাম করার পরই তার চোখ গেল আমার দিকে। অমনি ওর ঠোঁটে বাঁকা হাসি উঠল। নির্ঘাৎ ও ব্যাটা আমাকে তখন বেরিয়ে আসতে দেখেছিল ঘর থেকে। সে দাঁড়িয়ে রইল। বেঙ্কটেশ তাকে বসতে বললেও সে বসল না। তখন একটু হেসে বেঙ্কটেশ বললেন—তুমি রণদীপ সিং?
—জী হাঁ।
—কতদিন সী ভিউতে এসেছ?
—তা বছর খানেক হয়ে গেল স্যার।
—গতকাল তোমার ডিউটি ছিল কখন?
—ছটা থেকে রাত একটা।
—ওই সময়ের মধ্যে মিঃ মৈত্র ছাড়া নতুন কেউ এসেছিলেন হেটেলে?
—দুজন সাহেব এসেছিলেন, ওনারা এখনও আছেন। তবে রেজিস্টার দেখলেই সব মালুম হবে, স্যার।
—ঠিক বলেছ। আচ্ছা রণদীপ, ওই সময়ের মধ্যে মিঃ মৈত্রের ঘরে—মানে তের নম্বর ঘরে কাউকেও নক করতে বা ঢুকতে দেখেছিলে?
—না স্যার। আমি তো হরদম করিডরেই ঘুরি।
—আজ কখন ডিউটি তোমার?
—দুপুর দুটো থেকে রাত নটা অব্দি আছে, স্যার।
—এই সময়ের মধ্যে কাউকে তের নম্বরে…
বাধা দিয়ে রণদীপ আমার দিকে আঙুল তুলল।—ওই যে স্যার…
—না। উনি ছাড়া আর কেউ ঢোকেনি?
—ঢুকেছিলেন। কিন্তু…
ওকে থামতে দেখে কর্নেল ঝুঁকে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন—যিনি ঢুকেছিলেন, তাকে আর নিশ্চয় বেরোতে দেখনি? তাই না?
রণদীপের ঠোঁট কাঁপছে। সে কী বলেত চায়, অথচ পারছে না—খুব অবাক আর হতভম্ব যেন।
কর্নেল বললেন—এবং যাকে ঢুকতে দেখেছিলে, তারই লাশ বাথরুমে দেখা গেল। তাই তো রণদীপ?
রণদীপ লাফিয়ে উঠল—হ্যাঁ স্যার। তাই বটে স্যার। এতক্ষণে সেটা খেয়াল হয়নি স্যার!
ঘরে সবাই নড়ে উঠেছিল—তারপর ভীষণ স্তব্ধতা। কর্নেল শুধু বললেন—মাই গুডনেস!
তারপর শুনলুম তৃণা মৈত্র চিৎকার করে উঠল—মিথ্যা! একেবারে মিথ্যা! যে খুন হয়েছে, সেই আমার স্বামী!
তারপর দেখলুম সে অজ্ঞান হয়ে কোণার সোফা থেকে মেঝেয় পড়ে গেল। কর্নেল আমাকে ডেকে বললেন—এস জয়ন্ত। বাইরে যাই। মিঃ বেঙ্কটেশ, দরকার হলে রিং করবেন—কিংবা আসতেও পারেন। ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম। অ্যাল্বাট্রস—রুম নম্বর থ্রি। অ রিভোয়া!
রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন—জয়ন্ত, কী ভাবছ?
—ভাবছি, লাশটা তবে পুলকেশ মৈত্রের নয়?
—না। তৃণার স্বামীর নয়।
—কিন্তু এর মানেটা কী?
—মানে এখনও বোঝা যাচ্ছে না। মাথাটা পরিষ্কার করা দরকার। তাই ডার্লি, চলো—আমরা একবার ওই খাড়ির উপর পাথরের চাতালে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। জায়গাটা ভারি চমৎকার।
একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। বললুম—বন্দুক আর বাইনোকুলারধারী কারো পাল্লায় পড়ব না তো?
কর্নেল হেসে বললেন—তোমার দৃষ্টিবিভ্রম নয় তো জয়ন্ত?
—মোটেও না। স্পষ্ট দেখেছি একজন নীল শার্ট পরা লোক চোখে বাইনোকুলার রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য, তার হাতে বন্দুক দেখিনি।
পাহাড়ের ঢালুতে নামতে গিয়ে হঠাৎ কর্নেল বললেন—বরং তার আগে একবার ওই দি সোয়ান নামে হোটেলটা থেকে ঘুরে আসি।
——হঠাৎ ওখানে কেন?
—নিছক বিয়ার খেতে। বিয়ার মদ নয়। অন্তত এ বেলা খাওয়া যাক।
দুজনে সোজা এগিয়ে সেই খাড়ির খানিকটা উত্তরে দি সোয়ান নামে ছোট্ট হোটেলের দিকে এগোলুম।
হোটেলটা বাংলোবাড়ির মতো। লাউঞ্জে তেমন ভিড় নেই। একপাশে বার। বারে ঢুকে দেখলুম যা ভিড় তা এখানেই। নীল আলোয় মৌমাছির মতো একঝাঁক মাতাল গুঞ্জন করছে। চাপা সুরে বিলিতি অর্কেস্ট্রা বাজছে। আমরা খালি টেবিল খুঁজতে খুঁজতে কোণায় চলে গেলুম। একটা টেবিলে একজন লোক একা বসে আছে। টেবিলের গ্লাসে রঙিন মদ। কর্নেল ভদ্রতা করে বললেন—বসতে পারি?
লোকটা ঘাড় নাড়ল মাত্র। তারপর গেলাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিল।
আমরা বসে পড়লুম। ওয়েটার আমাদের পেছন পেছন এসে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল বিয়ার দিতে বললেন। এই সময় আমার চোখে পড়ল তৃতীয় চেয়ারের ওই লোকটার কোমরের কাছে একটা বাইনোকুলার ঝুলছে। অমনি শিউরে উঠে কর্নেলের ঊরুতে চিমটি কাটলুম। কর্নেল কিন্তু গ্রাহ্যই করলেন না। নির্বিকারভাবে দাড়িতে হাত বুলোতে থাকলেন। তখন আমি লোকটাকে আরও ভাল করে লক্ষ্য করতে থাকলুম। দূর থেকে কম আলোয় দেখেছি, ভুল হতেও পারে। কিন্তু এর পোশাকও স্পষ্ট বলে দিচ্ছে পাথরের চাতালে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিই বটে। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে ওর। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা। মুখের চামড়ায় পোড়খাওয়া ভাব আছে। খাড়া নাক আর চৌকো চোয়াল দেখে সহজেই বোঝা যায় লোকটা ডানপিটে না হয়ে পারে না।
বিয়ার এসে গেল। কর্নেল বোতল থেকে গ্লাসে খানিকটা বিয়ার ঢেলে বললেন—জয়ন্ত নিশ্চয়ই এই নিরামিষ পানীয়ে সন্তুষ্ট হবে না?
কর্নেল আমার চিমটিতে সাড়া দেননি বলে ক্ষুব্ধ ছিলুম। তাই গম্ভীর হয়ে মাথাটা দোলালুম মাত্র—তার মানে হ্যাঁ এবং না দুই-ই হতে পারে। কর্নেল একটু হেসে গ্লাসটা তুলে ‘চিয়ার্স’ বলে চুমুক দিলেন।
এই সময় তৃতীয় চেয়ারের লোকটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর বেরিয়ে গেল। তখন ব্যস্ত হয়ে চাপা গলায় বললুম—যাঃ। চলে গেল যে!
কর্নেল গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন—কে গেল, ডার্লিং?
ক্ষেপে গিয়ে বললুম—ন্যাকামি করবেন না। সেই বাইনোকুলারঅলা লোকটা এতক্ষণ দিব্যি আপনার সামনে জলজ্যান্ত বসে রইল—আমি চিমটি কাটলুম, অথচ গ্রাহ্য করলেন না।
কর্নেল একটু হেসে বললেন—তুমি কি ভাবছ বাইনোকুলার সঙ্গে থাকলেই তাকে খুনী বলে সন্দেহ করতে হবে।
—নিশ্চয়। ওই লোকটাই তো তখন খাড়ির ধারে দাঁড়িয়ে…
কর্নেল হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বললেন—চুপ। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে চোখের তারা ঘুরিয়ে ওঁর ডান-দিকটা নির্দেশ করলেন। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ওই টেবিলে তিনজন লোক বসে আছে। দুজন সর্দারজী, অন্য একজন ধুতিপাঞ্জাবি পরা বাঙালী ভদ্রলোক। বাঙালী ভদ্রলোকটি যে সর্দারজীদের সঙ্গে আসেননি, তা দেখামাত্র বোঝা যায়। উনি আপনমনে একটা পেন দিয়ে একটুকরো কাগজে কাটাকুটি করছেন। পাশের গ্লাসে মদ। মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝলুম, প্রচণ্ড নেশা হয়ে গেছে। কাগজের টুকরোটা বারেরই বিল মনে হলো। তার উপরে যেভাবে কলম চালাচ্ছেন, বাঙালী যে জাত কেরানী তা নির্দ্বিধায় প্রমাণ করা যায়। আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না।
হাসি শুনেই ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন। দেখি, উনিও গদগদ হয়ে হাসছেন। মাতালের এমন হাসি আমার পরিচিত। আমি ওঁর কাজে সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা দোলালুম। ভদ্রলোক শুধু মাতাল নন, রসিকও বটে। আমনি দ্বিগুণ উৎসাহে কলম চালনা শুরু করলেন এবং মাঝেমাঝে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এমন মজা পেলে ছাড়তে ইচ্ছে করে না।
ব্যাপারটা সর্দারজীদের চোখে পড়ল এতক্ষণে। একজন ভুরু কুঁচকে অস্পষ্ট কিছু বলল। মুখে বিরক্তির চিহ্ন।
হঠাৎ কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।—আমি একবার বেরুচ্ছি, জয়ন্ত। তুমি আমার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করো। বার দশটা অব্দি খোলা। আমি সড়ে নটার মধ্যেই ফিরব।
আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলেন উনি। আমার ক্ষোভ হলো ওঁর ওপর। কিন্তু কী আর করা যাবে? ওঁর কথামতো না চললে উনিও বড্ড বিরক্ত হবেন। বিশেষ করে খুনখারাপির তদন্তের ব্যাপারে উনি তখন অন্যমানুষ। তাই বসে থাকতে হলো।
এই অবস্থায় ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব না জমিয়ে উপায় নেই। নিঃসঙ্কোচে বললুম—চলে আসুন না এখানে!
ভদ্রলোক যেন সেটাই চাইছিলেন। টলতে টলতে কলম কাগজ আর গেলাস নিয়ে আমাদের টেবিলে এলেন। তারপর নমস্কার করে বললেন—বাঁচলুম। আমার নাম পরিতোষ কারফর্মা। টালিগঞ্জে কাঠগোলা আছে। মশাই যে বাঙালী, তা আঁচ করেছিলুম। কিন্তু বুঝলেন? ওই দুই সর্দারজীর ভয়ে টেবিল ছেড়ে উঠতে পারছিলুম না।
—কেন বলুন তো?
—ওদের আমি মশাই ভীষণ ভয় করি। টেবিল থেকে উঠলেই যদি মেরে বসে!
হো হো করে হেসে উঠলুম। বলুলম—একা এসেছেন নীলাপুরমে?
পরিতোষবাবু বললেন—হ্যাঁ। আমি মশাই ব্যাচেলার মানুষ। দোকা-টোকা ভালবাসিনে। আপনি?
—আমিও তাই।
বাচ্চা ছেলের মতো হি হি হেসে পরিতোষবাবু বললেন—খুব ভাল। খুব ভাল! খবর্দার স্ত্রীলোকের ছায়া মাড়াবেন না। মাড়িয়েছেন না মরেছেন। তা ব্রাদারের নামধাম?
পরিচয় দিতেই লাফিয়ে উঠে বললেন—ওরে বাবা কী আনন্দ, কী আনন্দ। তারপর হাস্যকরভঙ্গিতে শিস দিয়ে বেয়ারাকে ডাকলেন। আমার আপত্তি সত্ত্বেও হুইস্কির অর্ডার দিলেন। বললেন—আপনার মতো সঙ্গী যখন পেয়ে গেছি, আজ মশাই বারসুদ্ধু শুষে খাব।
বলুলম—উঠেছেন কোথায়?
পরিতোষবাবু ছাদ দেখিয়ে বললেন— মাথার ওপরে। এই ‘সোয়ানেই’। আপনি?
—অ্যাল্বাট্রসে।
—খুব ভাল, খুব ভাল।…বলে একটু ঝুঁকে চোখ নাচিয়ে জিগ্যেস করলেন— ওই বুড়ো সায়েবটি কে? এখানে এসেই আলাপ হয়েছে বুঝি? আমেরিকান নয় তো? দেখবেন ব্রাদার— সি. আই. এ. ঘুরঘুর করছে সবখানে। খুব সাবধান। দেশের কোনও কথা ফাঁস করবেন না। আপনারা জার্নালিস্ট। আপনারা দেশের সব গুহ্যখবর রাখেন কি না। তাই বলছি।…
বাধা দিয়ে বললুম— না, না। উনি ভারতীয়। শুধু ভারতীয় নয়, বাঙালী।
পরিতোষবাবুর চোখের ঢেলা বেরিয়ে গেল।—অ্যাঁ? উনি বাঙালী? ওরে বাবা! কী আনন্দ! কী আনন্দ! ওয়েটার। ইধার আও!
এই আনন্দে আবার হুইস্কি এসে গেল। এমন আমুদে লোক খুব কমই দেখেছি। মেজাজ ভাল হয়ে গেল ক্রমশ। বিয়ারের পর দু পেগ হুইস্কি পেটে পড়ার ফলে নেশাও ধরে যাচ্ছিল। এর পর কীভাবে সময় কেটেছে, বলা কঠিন। যখন কর্নেল ফিরে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, তখন আমার চোখে নানারঙের খেলা ভাসছে।…
রাত কীভাবে কেটেছে, মনে নেই। সকালে উঠে দেখি পাশের বেড়ে কর্নেল নেই। মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। তাই স্নান করলুম। বয় এসে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট সেরে সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গেলুম। সকালের শান্ত সমুদ্র রোদে ঝকমক করছে। সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কর্নেল এসে গেলেন।—হ্যাল্লো ডার্লিং! উঠে পড়েছ দেখছি!
একটু হেসে বললুম—-মদে আমার তেমন নেশা হয় না কর্নেল!
—তাই বটে! কর্নেল মৃদু হেসে বললেন। আশা করি, তাহলে গতরাতে কীসব ঘটেছে তোমার সামনে—সব মনে আছে?
—নিশ্চয় আছে।
—বলে যাও, ডার্লিং।
—পরিতোষবাবু আর আমি জমিয়ে খাচ্ছিলুম। তখন আপনি এলেন। তারপর আমরা দুজনে অ্যাল্বাট্রসে চলে এলুম।
কর্নেল আবার হেসে উঠলেন।
—হাসছেন যে?
—হাসছি। কারণ, গতরাতে তোমার প্রচণ্ড নেশা হয়েছিল।
—প্রমাণ অনেক। তোমাকে নিয়ে সাইকেল রিকশো করে ফিরে আসছি, পথে ঝোপঝাড় আর পাথরের আড়াল থেকে একটা লোক রিভলভার থেকে গুলি ছুঁড়ল। আমাদের সৌভাগ্য, রিকশোটা জোরে যাচ্ছিল তাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।
আঁতকে উঠে বললুম—সর্বনাশ!
কর্নেল বললেন—যাই হোক, আমি তৈরি ছিলাম। পাল্টা গুলি ছুঁড়ে ওর রিভলভারটা ফেলে দিলুম। হাত চেপে ধরে সে পালালো। তখন রিকশাঅলাকে বললুম তোমাকে পৌঁছে দিতে। আর আমি সেই রিভলভারটা খুঁজে নিয়ে মিঃ বেঙ্কটেশের কাছে গেলুম। ফোরেন্সিক টেস্টে নিশ্চয় ধরা পড়ছে—ওটাই মার্ডার উয়েপন।
—এত কাণ্ড! অথচ কিচ্ছু টের পাইনি!
—পাবে কীভাবে? পরিতোষবাবু তোমাকে মাতাল করে দিতেই চেয়েছিলেন যে!
—কেন? ওঁর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
—তুমি মদে বেহুঁশ থাকলে ফেরার পথে আমাকে একা খতম করাটা খুব সহজ হবে ভেবেছিলেন।
—কর্নেল, খুলে বলুন।
কর্নেল পা ছড়িয়ে বসে বললেন—জয়ন্ত, এই কেসটা ইন্সিওরেন্স-ঘটিত।
—বুঝলুম না।
—পুলকেশ মৈত্রের তিনটে ইন্সিওরেন্স করা আছে তিন দেড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার। সে মরলে টাকাটা তৃণা পায়। অতএব পুলকেশ ঠিক করেছিল, সে মরবে। আত্মহত্যার কেসে আজকাল ইন্সিওরেন্স অনেক ঝামেলা করে। কিন্তু কোথাও বেড়াতে গিয়ে খুন হলে ঝামেলা নেই। পুলকেশ ও তৃণা ঠিক করল যে নীলাপুরমে গিয়ে পুলকেশ খুন হবে। হলোও। তার মানে স্ত্রী যদি কোনও ডেড বডিকে স্বামীর বলে চালায়, অসুবিধে নেই। এবার তৃণাকে বাকিটা করতে হবে। ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে ইন্সিওরেন্সে স্বামীর টাকা ক্লেম করবে। টাকা পেয়ে যাবে। তখন পুলকেশ অজ্ঞাতবাস বেরিয়ে তৃণার সঙ্গে কোনও নতুন এলাকায় পাড়ি জমাবে। আবার সে অন্য নামে ইন্সিওর করবে। আবার খুন হবে। আবার তৃণা টাকা ক্লেম করবে—তখন সেও অবশ্য আর তৃণা নয়, অন্য নাম তাকেও নিতে হয়েছে। এটা হলো ওদের তিন নম্বর কেস। এর আগে পুলকেশ আর তৃণা ছিল অরুণ আর মাধবী।
তার আগের নাম ছিল পরিমল আর কেতকী। প্রত্যেকবারই তৃণার নির্বোধ প্রেমিকরা খুন হয়।
—বাঃ! বেড়ে বুদ্ধি তো! কিন্তু এবারকার ডেড বডিটা কার?
—তৃণার আরেক নির্বোধ প্রেমিক অবনী রায়ের। হাওড়াতে পুলকেশ একটা মারাত্মক ভুল করে। এ ভুল সব বুদ্ধিমান শয়তানের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। না হলে তাদের ধরা যেত না। পুলকেশ তিনটি বার্থ রিজার্ভ করেছিল একই শিপে। কিন্তু এখানে পৌঁছে সে অবনীকে নিয়ে যায় দি সোয়ানে। ওখানে অবনীর নামে কিন্তু রুম বুক করা নেই। আছে পরিতোষ কারফর্মার নামে। পুলকেশ অবনীকে বলেছিল—ওর এক বন্ধু পরিতোষ কারফর্মার নামে দি সোয়ানে একটা ডাবল রুম বুক করা আছে। পরিতোষ হঠাৎ অন্য কাজে আটকে গেছে। তাই আসছে না। অতএব ওই রুমে সে থাকতে পারে। কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু পরিতোষ তো একজন চাই। তা না হলে দি সোয়ান অবনীকে থাকতে দেবে কেন? অতএব পুলকেশ অবনীকে বলে—সে নিজেই বরং পরিতোষ হয়ে পরিচয় দেবে। রসিদ তো তার কাছেই আছে। এতে ব্যাপারটা দাঁড়াল বেশ মজার। পুলকেশ ধুতি-পাঞ্জাবি পরে খাঁটি বাঙালী বেশে পরিতোষ নামে দি সোয়ানে অবনীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটায়। আবার সী ভিউতে সাহেব সেজে পুলকেশ নামে স্ত্রীর কাছেও থাকে। অবনী নির্বোধ এবং তৃণার প্রেমে অন্ধ না হলে ফাঁদটা টের পেত। দি সোয়ানে তদন্ত করার পর ব্যাপারটা আমরা টের পেয়ে গেলুম।
—পুলকেশকে অ্যারেস্ট করতে পেরেছে তো পুলিশ?
—হুঁউ। গতরাতেই। দি সোয়ানে সেই ঘরটায় ব্যাটা শুয়ে কাতরাচ্ছিল। হাতে জখম। রুমাল বেঁধেও রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। বেসিনে ডেটলের ছড়াছড়ি। তাকে অবশ্য তক্ষুণি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।
—সব তো বুঝলুম। কিন্তু ওদের ব্যাকগ্রাউণ্ড এত শীগগির পেলেন কোথায়? কর্নেল অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন তৃণা সব কবুল করেছে।
একটু পরে বললুম—বাইনোকুলার চোখে রেখে খাড়ির ওপর যে লোকটা সী ভিউয়ের দিকে লক্ষ্য রেখেছিল, সে নিশ্চয় পুলকেশ। কিন্তু লক্ষ্য রাখত কেন?
তৃণার কাছে সংকেত পাবার জন্যে। গ্রিন সিগন্যাল পেলেই সে, কাছে যেত।…বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।— তবেই দেখ জয়ন্ত, তোমাকে বলেছিলুম—আমার খুনের কপাল। সত্যি ডার্লিং, কোথাও বেড়াতে গিয়ে আরামে কাটাব, তার উপায় নেই। দা ইটার্নাল মার্ডারার সবসময় আমাকে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে।…