» » ত্রিশূলে রক্তের দাগ

বর্ণাকার

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কর্নেল সমগ্র

ত্রিশূলে রক্তের দাগ

এক

সম্প্রতি চিৎপুর এলাকায় আন্তর্জাতিক চোরাচালানীচক্রের কার্যকলাপ ফাঁস হাওয়ার ঘটনা সব কাগজে বেরিয়েছিল। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার পক্ষ থেকে এর একটা ফলোআপ সংগ্রহের জন্যে বেরিয়ে ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। ঘিঞ্জি রাস্তা। বেলাও পড়ে এসেছিল। তার ওপর ঠিক এই সময়টাতেই লোডশেডিং। বিরক্ত হয়ে গাড়িতে বসে সিগারেট টানতে টানতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম, আর এই অব্যবস্থার জন্যে ট্রাফিক পুলিশদেরই দায়ী করছিলাম। লরি বা ট্রাকের প্রতি তাদের মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ যে অনেক সময় জ্যামবিভ্রাট বাধায়, তাতে কোনও ভুল নেই।

বাঁ পাশে বসে থাকার ফলে পরপর কয়েকটা হার্ডওয়্যার স্টোর্স, যাত্রা, থিয়েটারের পোশাকের দোকান, এবং তার মাঝখানে একটা বইয়ের দোকান চোখে পড়ল। আনন্দময়ী পুস্তক ভাণ্ডার। নিশ্চয় সুখ্যাত বটতলা প্রকাশনের ঐতিহ্যসম্পন্ন দোকান। সামনের শোকেসে যাত্রানাটক, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত, প্রভাস খণ্ড, বৃহৎ তন্ত্রসার ইত্যাদি টাইটেল সাজানো ছিল। আলো কম হলেও, আমার দৃষ্টিশক্তি মোটামুটি ভালই। তাছাড়া পঞ্জিকার পাতায় এমন বইয়ের বিজ্ঞাপন আমাকে আকৃষ্ট করে। এইসব দোকান যেন এক রহস্যময় পৃথিবীর তথ্যে ভরা। বশীকরণতন্ত্র ডাকিনীতন্ত্র, ভোজবিদ্যা কামাখ্যাতন্ত্র…এক আশ্চর্য অন্ধকার মায়ালোকের দিকে অঙ্গুলিসঙ্কেত করে যেন।

হঠাৎ হকচকিয়ে গেলাম। এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ আনন্দময়ী পুস্তক ভাণ্ডার থেকে বেরোলেন। তার হাতে লাল মলাটের একটা বই। তার মাথায় ধুসর টুপি, মুখের সাদা দাড়ি, এবং বাঁ হাতে একটা বিদঘুটে গড়নের যষ্ঠি। ফুটপাতে নেমেই তিনি কয়েক পা এগিয়ে অন্য একটা দোকানে ঢুকলেন। এ দোকানটার সাইন বোর্ডে লেখা আছে : আর দাশ অ্যাণ্ড কোং। যাত্রা-থিয়েটারের যাবতীয় পোশাক, স্টেজ, সিন সুলভে ভাড়া পাওয়া যায়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

হ্যাল্লো ওল্ড ডাভ বলে অভ্যাসমতো চেঁচিয়ে ডাকার কথা স্রেফ ভুলে গিয়েছিলাম, কারণ এই ধুরন্ধর বৃদ্ধকে এখানে দেখতে পাওয়ার কথা কল্পনাও করিনি। গতকাল উনি ফোনে জানিয়েছিলেন, এক জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সঙ্গে নেপাল রওনা হচ্ছেন–আমার সঙ্গদান সম্ভব কি না। বলা নিষ্প্রয়োজন, এ আমন্ত্রণ একটা ছুতোনাতা করে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। নেপাল যত সুন্দর দেশ হোক দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির অর্কিডের তল্লাসে পাহাড়-জঙ্গলে টো টো করে ঘোরা আমার ধাতে সইবে না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে কোনও কারণে হোক, ওঁর নেপাল যাওয়া হয় নি।

হয়নি কিন্তু এই এবেলায় চিৎপুরে কী করছেন? বটতলার বই কেনারই বা উদ্দেশ্য কী? আর যাত্রা-থিয়েটারের পোশাকের দোকানেই বা কেন ঢুকলেন? রহস্যের গন্ধ পেলাম। ভাবলাম, নেমে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু সেই মুহূর্তে ট্রাফিকজট কোনও যাদুবলে খুলে গেল। আমাদের গাড়ির বাঁ দিকে ইতিমধ্যে কয়েকটা রিকশো, ঠেলা, টেম্পো ঢুকে পড়েছিল। জট ছাড়লে স্বভাবত হল্লা আর যানবাহনের গর্জনও প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। আমার ডাক উনি শুনতে পেতেন না।

অফিসে গিয়ে ব্যাপরটা ভাবছিলাম। আর দাশ অ্যাণ্ড কোম্পানির দোকানে ঢুকে , কি ছদ্মবেশ ধরার জিনিসপত্র কিনছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? কিছু কি ঘটেছে, কোথাও? নাকি সম্প্রতি ফঁস-হয়ে-যাওয়া আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্রের সঙ্গে ওঁর এই কাজকর্মের কোনও সংস্রব আছে?

রাত আটটায় অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা ইলিয়ট রোডে সানি লজ নামে বিশাল বাড়িটির তিনতলায় হানা দিলাম। দরজা খুলে ষষ্ঠীচরণ জনান্তিকে জানাল, বাবুমশাই আসনে বসে জপ করছেন। অবাক হয়ে ভেতরের ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি, কতকটা তাই বটে। আমার বৃদ্ধ বন্ধু ডিভানে আসন করে বসে সেই বটতলার লাল মলাটের বইটি পড়ছেন। ঠোঁটদুটো কাঁপছে। তার মানে, উচ্চারণ করেই পড়ছেন। আমার সাড়া পেয়ে চোখ কটমটিয়ে হুংকৃত স্বরে বলে উঠলেন, ওঁং হ্রীং ক্রীং জয়ন্তং মারয়ঃ মারয়ঃ তাড়য়ঃ ফট ফট স্বাহা।

একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, সর্বনাশ! এ আবার কী?

কর্নেল হো হো করে হেসে ডিভান থেকে নেমে আমার হাতে বইটা খুঁজে দিলেন। লাল মলাটের ওপর সোনালী হরফে লেখা আছে ডাকিনীতন্ত্র। শ্রী হরিশরণ শর্মা তন্ত্ৰার্ণব সিদ্ধাচার্য কতৃক সংগৃহীত। পাতা উল্টে দেখি, ভূমিকায় বলা হয়েছে, এই গুপ্ত তন্ত্র আসামের কামরূপ অঞ্চলের পর্বত-অরণ্যে বহু বৎসর ভ্রমণ করিয়া সিদ্ধাই ডাকিনীগণের নিকট হইতে সংগৃহীত। তন্ত্ৰাৰ্ণব শ্রীহরিশরণ শর্মা মহাশয় বহুবার একচুলের জন্য বাঁচিয়া গিয়াছে। সাধক পাঠকবর্গের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করি যে বাৎসরাধিক কাল তাহাকে ডাকিনীগণ মন্ত্রবলে মেষশাবকে রূপান্তরিত করিয়াছিল। দেবী কামাখ্যার করুণায় তিনি মনুষ্যদেহ পুনঃপ্রাপ্ত হন।…

বললাম, এই গাঁজা কেনার জন্যে আজ বিকেলে চিৎপুরে আনন্দময়ী পুস্তক। ভাণ্ডারে ঢুকেছিলেন।

হুঁ–তুমি তোমাদের প্রেসমার্কা কালো গাড়িতে বসে লোলুপ দৃষ্টে শো-কেসের বইগুলি দেখছিলে বটে!

ঠিক ঠিক। তারপর আপনি আর দাশ অ্যাণ্ড কোংয়ের দোকানে ঢুকলেন ছদ্মবেশ কিনতে। কই, দেখি, কী কিনলেন?

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, আমি কি বুড়োবয়সে যাত্রাদলে নাম লেখাব ভাবছ?

যাত্রাদলে ঢুকলে পোশাক নিজেকে কিনতে হয় না। নিশ্চয় ছদ্মবেশ ধরার দরকার হয়েছে আপনার। তা এক কাজ করলেই তো পারেন। গোঁফদাড়ি সাফ, করে ফেললেই হল। কেউ আর প্রখ্যাত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে চিনতে পারবে না। অবশ্য মাথার টাকটি অতি প্রসিদ্ধ। কিন্তু তার জন্য টুপিই যথেষ্ট।

ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন, তুমি তো এ যাবৎ দেখেছ ডার্লিং, আমি কদাচ ছদ্মবেশ ধরি না। ছদ্মবেশ ব্যাপারটা বড় বাজে। ওর ভেতর প্রচুর পোকা থাকে। আসলে মাথার ভেতরকার কোমল সারপদার্থকে ঠিক মত কাজে লাগাতে পারলেই হল। চাই শুধু কিছু তথ্য-সঠিক, অকপট তথ্য। সত্যকে আবিষ্কারের জন্য আমি তাই ডিডাকটিভ পদ্ধতির পক্ষপাতী। আগে সিদ্ধান্ত পরে তথ্য সংগ্রহ নয়, আগে তথ্য সংগ্রহ পরে সিদ্ধান্ত।

বললাম, বেশ। আপনারই ডিডাকটিভ পদ্ধতি অনুসারে গতকাল থেকে এ পর্যন্ত আপনার ক্রিয়াকলাপের যে তথ্য পাচ্ছি, তা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে আপনার নেপালযাত্রা বরবাদ করার মতো একটি ঘটনা ঘটেছে এবং সেই ঘটনার সূত্রে আজ বিকেলে আপনাকে চিৎপুরে গিয়ে…।

হাত তুলে বাধা দিয়ে সহাস্যে গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, এনাফ জয়ন্ত, এনাফ। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছিযে তুমি কাগজের লোক হয়েও কাগজ পড় না।

ময়রার সন্দেশে রুচি থাকে না। কিন্তু কাগজে কী বেরিয়েছে? চিৎপুরের আন্তর্জাতিক চোরাচালানীচক্রের খবর তো? যতদূর জানি, লালবাজারের তরুণ গোয়েন্দাকর্তা আপনাকে এতে নাক গলাতে দেবেন না। কারণ, আপনি এসব ব্যাপারে যুক্ত হলে তার কৃতিত্ব প্রদর্শনের সুযোগ মিলবে না।

কর্নেল কফির পেয়ালা রেখে চুরুট ধরালেন। তারপর মৃদু হেসে চোখ নাচিয়ে বললেন, চলো ডার্লিং, আগামীকাল একবার ভৈরবগড় ঘুরে আসি।

ভৈরবগড়! নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস! মনে পড়ে গেছে। আসলে এসব খবর চোখের কোণা দিয়ে ছুঁয়ে দেখার মত। তাছাড়া দেশজুড়ে প্রতিদিন অসংখ্য খুনোখুনি হচ্ছে। কিন্তু ভৈরবগড়..কর্নেল! ভৈরবগড়ে গোটা দুতিন খুন হয়েছে তার জন্য নেপাল-যাত্রা পণ্ড করে আপনার চিৎপুরে যাত্রার তাৎপর্য মাথায় ঢুকছে না? মফস্বলে দলাদলি আজকাল বেড়ে গেছে। দলে দলে সংঘর্ষ আকছার হচ্ছে। কাজেই এ খুনোখুনিতে রহস্য কিসের?

কর্নেল বললেন, আছে। তুমি তৈরি থেক–আগামীকাল সকাল নটায় ট্রেন।