সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
কর্নেল সমগ্র
এক
দ্য শার্কে একটি হামলা
বিকেলটা বেশ চমৎকার ছিল। সমুদ্রের লম্বা বিচে অজস্র লোক ভিড় করেছিল আজ। কদিন থেকে যা বৃষ্টি হচ্ছিল, তাতে কোনও ভ্রমণবিলাসী ঘর থেকে বেরোতে পারেনি। হঠাৎ আজ কিছুক্ষণের জন্য একটা বিকেল প্রচুল গোলাপি রোদ্দুর ছড়িয়ে খুশি করতে চাইল লোকগুলোকে। যারা বাইরে থেকে এসেছিল, প্রায় সকলেই চলে যাবার জন্যে তৈরি ছিল। কারণ বর্ষার মরসুম সত্যি সত্যি এসে গেছে এতদিনে। ভ্রমণ আর জমবার কথা নয়। কিন্তু যাবার আগের হঠাৎ পাওয়া এই সুন্দর উপহার–একটা শান্ত রোদ্দুরের বিকেল সবাই নিবিড়ভাবে ভোগ করতে চেয়েছিল। আর সমুদ্রকেও দেখাচ্ছিল প্রাচীন ব্রাহ্মণের মতো, ঢেউ-এর ফেনায় যার সাদা উত্তরীয় এবং উপবীত ঝকমক করে উঠছে ঐশ্বরিক পবিত্রতায়।
ধর্মভীরু মানুষেরা রোদ মিলিয়ে যেতে যেতে শেষবার সমুদ্র-প্রণাম সেরে নিল। দুর্বলেরা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে নুলিয়ার সাহায্যে স্নান থেকে স্বাস্থ্য নিয়ে এল। আর যারা চেয়েছিল শুধুমাত্র সৌন্দর্য, তারা বালির ওপর চেয়ারগুলোতে বসে সমুদ্রকে গিলে ফেলার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে ফিরে গেল। কিছু লোক এসেছিল শিশুসুলভ বিস্ময় নিয়ে, তারাও ক্লান্ত হয়ে কেউ কেউ। ডেরায় ফিরল।
সংখ্যায় ওইসব লোকই ছিল বেশি, কোনও উদ্দেশ্য ছাড়া যারা কোনওখানে পা বাড়াতে রাজি নয়। বাদবাকি সব নিষ্কমা ও বৈহিসেবীর দল–তাদের কাছে সমুদ্র বা পাহাড় অরণ্য, অথবা কোনও প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনের বস্তুত আলাদা মূল্য নেই, আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। তারা উদ্দেশ্যহীন। তারা জানে, বছরের কোন কোন সময় কোথাও যেতে হয়। তাই তারা যায় এবং ঘুরে আসে। হয়তো ঘর তাদের সময় বিশেষে চার দেয়াল থেকে চারটে, সিলিং ও মেঝে থেকে দুটো–মোটা ছটা দাঁত বের করে বলেই দরজা গলিয়ে পালায় কোথাও। তারা এই সমুদ্রতীরে এসে ঘুরতে হয় বলেই ঘুরেছে। হল্লা করা উচিত বলেই হল্লা করেছে। এবং কেউ কেউ শুনেছিল, বিচে বসে প্রকাশ্যে মদ্যপান করায় প্রচুর স্যাডিজম আছে, তারা তাই করল বটে কিন্তু সুখ কী টের পেল, বলা কঠিন। যেমন, শেষ মরসুমের সেরা আকর্ষণ তিনটি মেয়ে আর দুটি ছেলের দলটা। তাদের কেউ কেউ তো হড়হড় করে বমি করেই ফেলল। তারপর তারা বিধ্বস্ত ফুসফুস আর অস্পষ্ট চোখে সমুদ্রকে দেখেছে প্রচণ্ড ক্লান্তির প্রতীক–একঘেয়েমির যান্ত্রিক বিক্ষোভ।
দ্বিতীয় নমুনা, আর একটি পঞ্চরত্নের দল। তারা সঙ্গিনীছাড়া তরুণ। বেলেল্লামি করা তাদের পক্ষে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল–যেহেতু তাদের সঙ্গে কোনও মেয়ে নেই। তারা সমুদ্রকে আলাদা করে দেখেনি, বিচের নরমতা থেকে হাঁটার আনন্দ পায়নি, হঠাৎ এই খোলা বিকেলটার ভালবাসা টের পায়নি তারা কেবল বিশাল জালার গায়ে কয়েকটি পিঁপড়ের মতো ঘুরঘুর করছে এবং কুট কুট করে কামড়াতে চেয়েছে। বিস্তর মানুষকে তারা বিরক্ত করেছে। তারপর তিনটি মেয়ে ও দুটি ছেলের দলটাকে দেখতে পেয়ে শেষঅব্দি খানিকটা ঘুমো-ঘুষিও করেছে। পুলিশ দৌড়ে না এলে সে একটা দৃশ্য হত বটে! যেন বর্তমান সভ্যতাজোড়া স্যাডিজমের ঢেউ বিকেলের সমুদ্রতীরে বারবার হানা দিচ্ছিল।
তৃতীয় নমুনা, স্ন্যাকস-গারারা ইত্যাদি পোশাকপরা চারটি মেয়ে। সম্ভবত তারা এখানে এসেই প্রথম সিগারেট খেতে চেয়েছিল। চারজনের হালকা আঙুলে চারটে সিগারেট, বিচের চেয়ারে বসা সৌন্দর্যলিঙ্গু বুড়োমানুষটিকে বলেছে, দাদু, দেশলাই দিতে পারেন? বিস্ময়ের কথা, তিনি মৃদু হেসে এবং সপ্রতিভ আধুনিকতায় লাইটার এগিয়ে দিয়েছেন। তখন তারা দেখেছে, লোকটার হাতে জ্বলন্ত চুরুট রয়েছে এবং তাঁর পোশাক দস্তুরমতো বিলিতি। অমনি ধন্যবাদ বলে হাসতে হাসতে সরে গেছে তারা। কিন্তু দ্বিতীয় জায়গায় আরেক নিঃসঙ্গ বুড়োকে বেছে দেশলাই চাইলে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো। ভদ্রলোক মুখটা গম্ভীর করে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, নেই।তারা হেসে উঠল। এ বুড়োকে শায়েস্তা করা হয়েছে ভেবে অনেক খুঁজে আরেক বুড়োকে বের করল। ইনি কিন্তু মুচকি হেসে বললেন–দেশলাই কী হবে লক্ষ্মীমায়েরা?
সিগারেট খাবো।
মেয়েরা সিগারেট খায় নাকি? বলে পরক্ষণে মাথা দুলিয়েছেন।…হা ভুল। হচ্ছে। খায় বটে। আমাদের শহরে মনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারনীরা খায় বটে। তা লক্ষ্মীমায়েরা, তোমরা কোন মুনিসিপ্যালিটিতে কাজকম্মো করো, শুনি?
পাল্টা চোট খেয়ে ওরা চটে গেল।..বুড়ো হয়েছে, ভদ্রতা করে কথা বলতে জানেন না? যত সব সেকেলে ভূত! গেঁয়ো রাবিশ! কবে যে এগুলো যাবে সব!
এবং পরে কয়েক মিনিট শিক্ষাসভ্যতা নারীধর্ম ইত্যাদি নিয়ে একতরফা বিতর্ক–তারপর হঠাৎ চারটি ফ্যাশানভূতগ্রস্ত মেয়ের পক্ষে সেই পাঁচটি সঙ্গিনীলিঙ্গু ছেলের যোগদান, দেশলাই জ্বেলে প্রত্যেকের ঠোঁটের সিগারেট ধরিয়ে দেওয়া–তারপর বুড়ো অভিমানী কম্পিত চোখে দেখলেন, নজনের দলটা নটা সিগারেটের ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে চলতে শুরু করেছে। বুড়ো সখেদে বললেন, একেই কি বলে সভ্যতা? এবং বুড়ো শালিকের মতো ঘাড়ে রোঁ নিয়ে এক দত্তকুলোদ্ভব কবির কথা ভাবতে লাগলেন।
হ্যাঁ, অভাবিত বিকেলের সমুদ্রতটে হয়তো এসব ঘটনা ও দৃশ্যও সমুদ্রচাঞ্চল্যের অন্তর্গত। তারপর কিন্তু প্রকৃতি তেমনি বিস্ময়কর তৎপরতার সঙ্গে গুটিয়ে ফেলল ঝিলমিল গোলাপি রঙের পটচিত্র! সূর্য ডুবে যেতে-না-যেতে হু হু করে সমুদ্র থেকে উঠে এল চমরী গাইয়ের মতো মেঘ। এবং তারপর আবার শুরু হলো তুলকালাম বৃষ্টি। দেখতে দেখতে ফাঁকা হয়ে গেল বিচ। নুলিয়ারা ডাঙ্গার নৌকোর তলায় গুটিসুটি ঢুকে গেল। ফেরিওয়ালারা জিনিসপত্র গুটিয়ে শস্যকণাবাহী পোকাদের মতো দৌড়ে পালাতে লাগল। বেলুনওয়ালাদের হলো সমস্যা। চারজন কাবুলিওয়ালাও গুলিখাওয়া বাঘের মতো সি-বিচের একটা হোটেলে ডিগবাজি খেয়ে ঢুকল। বুড়ো, কাচ্চাবাচ্চা আর মেয়েরা ভিজে জবুথবু হয়ে যে-যার আখড়ায় ঢুকতে বেশ দেরি করে ফেলল। কেবল মাস্তানটাইপ কিছু ছেলেমেয়েকে দফায় দফায় দেখা গেল কাকের মতো দিব্যি ভিজতে ভিজতে উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-ওদিক চলেছে। নজনের দলটা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেছে ইতিমধ্যে। পাঁচজনের দলটা হোটেলে ফিরেছে সবার আগে। বিলিতি পোশাকপরা বুড়ো রেনকোট চাপিয়ে দিব্যি ধীরে-সুস্থে সবার শেষে গেল। তারপর সমুদ্রের ধারে শুধু বৃষ্টি আর ধূসরতা ছাড়া কিছু নেই।
একটু পরেই খুব তাড়াতাড়ি রাত এসে গেল। বৃষ্টির মধ্যে কুয়াশার মতো অপরিচ্ছন্নতায় বিচের বাতিগুলো জ্বলে উঠল। দ্য শার্ক বা হাঙর নামে একটেরে ঝাউবনের ধারে যে নির্জন ছোট্ট বার কাম-রেস্তোরাঁ রয়েছে, সেখানে ভিড় কম ছিল। মদ্যপিপাসুরা আজ বিকেলে সমুদ্রের ধারে বসে সুখ চেয়েছিল। তাছাড়া, কেন যেন আজ জমেইনি এখানকার আসর। কাউন্টারের ভদ্রলোক এক মাদ্রাজী। তিনিই মালিক। বিকেলে ভালো আবহাওয়া পেয়ে মোহনপুর চলে গেছেন– বউয়ের অসুখ নাকি। তিনজন ওয়েটার, কিচেনে দুজন রাঁধুনি, দুটো কিশোর বয় এবং কাউন্টারে রোগা হাড়জিরজিরে একজন বাঙালী কর্মচারী।
এ রেস্তোরাঁয় যারা দৌড়ে ঢুকেছিল, সাতটা অব্দি কেউ কেউ বিয়ার খেয়ে ভিজতে ভিজতে কেটে পড়ল। একজন অবশ্য হুইস্কি খেয়েছে পেগ তিনেক। সেও দুলতে দুলতে চলে গেল। এক মধ্যবয়সী দম্পতি ছিলেন। তারা লাইম দিয়ে জিন খেলেন এক পেগ করে তারপর রেনকোট চড়িয়ে বেরোলেন। রাত আটটাতেও বৃষ্টি চলেছে সমানে। এবং ঘরে তখন কোণার টেবিলে কেবল দুটি মেয়ে বসে রয়েছে। একজন স্ন্যাকসপরা, অন্যজন বেলবটম। বাইশ থেকে চব্বিশের মধ্যে বয়স। একজন মোটাসোটা, একটু বেঁটে, খুব পাতলা ঠোঁট আর একবার ভাজা বেগনীর মতো সরু নাক, ছোট্ট কপাল–উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলা যায় এবং তার মাথায় ববছাঁট চুল–সে স্ন্যাকস পরেছে ক্রিমরঙা। গায়ে তাঁতের ফিকে হলুদ হাফ পাঞ্জাবি–তাতে বাটিকের কালো ছাপ, কবিজিতে চওড়া কালো বেল্টের মোটা ঘড়ি। তার পায়ে সরু দু ফিতের হালকা স্লিপার।
বেলবটপরা মেয়েটির গায়ে শুধু ধবধবে সাদা গলা-আঁটো হাফ স্পোর্টিং গেঞ্জি, তার বুকে ব্রেসিয়ার নেই, তা স্পষ্ট। তার মুখটা একটু লম্বাটে–গালের দিকটা ডিমালো, চিবুক তিনকোণা কিন্তু প্রশস্ত, বেমক্কা পুরু ঠোঁট ঠোঁটের কোণায় উদ্দেশ্যহীন হাসির আভাস আছে। তার ভোলা বলিষ্ঠ বাহু দুটো টর্চের নতুন ব্যাটারি থেকে উৎসারিত জোরাল দুটি আলোর মতো। তারও কবজিতে মোটা ঘড়ি এবং একই ব্যাণ্ড। তার পায়ে পেতলের চওড়া বকলেস দেওয়া চটি। তার গায়ের রঙ বেশ ফরসা। হঠাৎ দেখলে অবাঙালী মনে হতে পারে। তার কপাল অশোভন ভাবে চওড়া এবং ঘন কালো ভুরু পাপড়ি, ডাগর চোখ, কালো একরাশ চুল কাঁধ থেকে কয়েক ইঞ্চি নেমে গেছে। কীরকম পুরুষালি চেহারা যেন। হঠাৎ দেখলে কিম্পুরুষ মনে হয়।
হাফ-পেগ জিন নিয়ে তারা রাত আটটা অব্দি হাঙর-এর মধ্যে বসে রয়েছে। তার জন্য অবশ্য এই দুঃসময়ে হাঙরওয়ালাদের কোনও বিরক্তি নেই বরং উপভোগ্য দ্রব্য, এই ক্লান্তিকর বৃষ্টির রাতে দুটি উঁচুদরের যুবতী! তাদের শরীরে বিবিধ আয়োজন এবং ধনী গৃহস্থের বিয়েবাড়ির দরজার সামনে দিয়ে যাবার সময় নিম্নবিত্ত যেমন একবার তাকিয়ে দেখে যায়, তেমনি করে ঘুরঘুর করে যাচ্ছে। রাঁধুনি, ওয়েটারদ্বয়–এমন কি বয় দুজনও।
মেয়ে দুটি কি বৃষ্টির দরুন উদ্বিগ্ন? তা কিন্তু কারো মনে হচ্ছিল না। ডেরায় ফিরে যাবার কোনও তাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না তাদের মধ্যে। বরং যেন কী নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় সময় কাটানো আলস্যে বৃষ্টিকে উপভোগ করছিল। চাপা গলায় কথা বলছিল পরস্পর। এদিকে ক্রমশ রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাবার নির্দিষ্ট সময় এগিয়ে আসছিল। আজ মালিক নেই, তুমুল বৃষ্টি আর নির্জনতা, তাই কাউন্টারের রোগা কর্মচারীটি হাই তুলে বারবার ঘড়ি দেখছিল। তার ইচ্ছে, নটার বেশি অপেক্ষা করা আজ অসম্ভব। মালিক আসবেন না। তাঁর স্কুটার না থেকে পুরোপুরি গাড়ি থাকলে অবশ্য অন্য কথা ছিল। তাই হঠাৎ দেখা গেল সে চাপা গলায় ওয়েটারদের কী সব বলে সাড়ে আটটাতেই অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে গেল–দরজার কাছে ছাতা খুলল, তারপর বৃষ্টি ও কালো রাতের মধ্যে ডুব দিল।
তার পনের মিনিট পরে বেরোল দুজন ওয়েটার–আর তাদের ছাতার তলায় একজন করে ক্ষুদে বয়। আরও পাঁচটা মিনিট লম্বা পায়ে চলে গেল রাঁধুনি দুজনও একইভাবে বেরোল। তারা মেয়ে দুটোর দিকে একবার যথারীতি তাকিয়েও গেল।
এখন রইল শুধু সবচেয়ে শক্তিমান, লম্বাচওড়া গড়নের লোক তার নাম নব। নব হাঙরে রাতে একমাত্র পাহারাদার। বোঝা যায়, সেই মালিকের একমাত্র বিশ্বস্ত ও প্রশ্রয় পাওয়া কর্মী। কারণ ক্যাশবাক্সটা সে লম্বা মোটা হাতে অবহেলায় তুলে লোহার আলমারিতে ঢোকাল। চাবির গোছাটা উর্দির তলায় গাপ করল। তারপর ক্যাশ কাউন্টারে বসে মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে রইল। তার তাকানোর মধ্যে বিস্ময় বিরক্তি কিংবা প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই। বোঝা যায়, এই ধরনের জীবনে সে কোনও আকস্মিকতা আশা করে নাবস্তুত সব আকস্মিকতাই তার কাছে নিয়ম। এবং সেজন্যেই সে ফাঁক পেলেই বলে, এই হচ্ছে হাঙরের কানুন।
হ্যাঁ, যে-কোনও সময় কোনও আবেগবান, ভাবপ্রবণ কিংবা খামখেয়ালী খদ্দের এসে হানা দিতে পারে। দেয়ও। রাত বারোটা অব্দি তাই খুলে রাখার নিয়ম আছে দ্য শার্কের দরজা। অনেক সময় এসে পড়তে পারেন পুলিশ অফিসারদেরও কেউ। বঙ্গোপসাগরের উত্তর পশ্চিম তীরবর্তী এই উপনগরীটিতে প্রচুর রহস্যময় ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকে জানে, নব পুলিশের একজন টাউট। এবং পুলিশ সচরাচর গভীর রাতেই আসে এখানে।
রাত নটা বাজলে এতক্ষণে মেয়ে দুটি আরও দুট হাফ-জিনের অর্ডার দিল। নব অর্ডার সার্ভ করে ফের কাউন্টারে মাছের চোখ নিয়ে বসল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখনও শোনা যাচ্ছে। সমুদ্রের গর্জন কাঁপয়ে দিচ্ছে মানুষের সচেতন ইন্দ্রিয়গুলোকে। এই উপকুলে এমনিতেই সমুদ্র খুব রাফ যাকে বলে–তাতে এই দুর্যোগে তার ভয়ঙ্কর আওয়াজ অনভিজ্ঞদের অস্বস্তিতে অস্থির করে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ঠিক দরজার সামনে ঢেউ এসে ভেঙে গেল। তিনজনের কেউ তাকিয়ে দেখে না।…
একটু পরেই দরজার বাইরে একটা ভিজে মানুষের মূর্তি দেখা গেল। দরজায় এসে দুটো হাত দুদিকে রেখে মাথা গলিয়ে দিল সে। মেয়ে দুটি অমনি অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠল। বড়বড় চোখে তাকাল তার দিকে। দুজোড়া চোখে প্রচণ্ড আতঙ্ক ম্লান আলোয় ঝলমল করে উঠল।
নবও নড়ে উঠেছিল। সে সিংহের মতো গ্রীবা ঘুরিয়ে দেখছিল আগন্তুককে।
কারণ, আগন্তুকের মুখে একটা কালো মুখোশ।..
সে এক লাফে ভিতরে এসে গেল। পরক্ষণে তার হাতে ঝলসে উঠল একটা ছোরা। অমনি স্ন্যাকসপরা মেয়েটি জন্তুর মতো অব্যক্ত একটা আর্তনাদ করে কোণের দিকে ছিটকে গেল। অসমাপ্ত গ্লাসগুলো উল্টে ঝনঝন শব্দে নিচে পড়ে ভাঙল। বেলবটমপরা মেয়েটি যেন হতবুদ্ধি হয়ে বসেছিল। আততায়ী ছোরাটা নিয়ে এক পা এগোতেই সে মুখে আঙুল পুরে গোঁ গোঁ করে উঠলতারপর কাউন্টারের দিকে দৌড়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার সামনে আততায়ী-তাই কিচেনের দরজার দিকে এগোল।
তাও পারল না। আততায়ী এক লাফে সেদিকে এগোলে মেয়েটি কোণে তার সঙ্গিনীর কাছে চলে গেল। দুজনেই ভীষণ কাঁপছিল।
বড়জোর কয়েকটা সেকেণ্ডের মধ্যে এগুলো ঘটল।
তখন দেখা গেল নব আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার মুখে সংশয়। প্রস্তুতির অভাব তখনও স্পষ্ট। আগন্তুকের হাতে ছোরা রয়েছে।
দ্য শার্কের সাত বছরের জীবনে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। মারামারি বিস্তর হয়েছে কিন্তু হঠাৎ এমন দুর্যোগের রাতে নির্জন পরিবেশে মুখোশপরা কোনও লোক ছোরা হাতে ঢোকেনি। নব তাই হয়তো হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল।
আট-দশ সেকেণ্ডের মধ্যে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। আততায়ী ছোরাটা তুলে জড়সড় বোবায়ধরা মেয়ে দুটির দিকে এগোতেই বেলবটমপরা ফরসা মেয়েটি ছিটকে সদর দরজার কাছে চলে গেছে এবং তারপর তাকে বাইরে অদৃশ্য হতে দেখা গেল।
তারপর ভয়ঙ্কর কানামাছি খেলা চলল স্ন্যাকসপরা বেঁটে মেয়েটি ও আততায়ীর মধ্যে। মেয়েটি বোবায়ধরা গলায় গোঁ গোঁ করতে করতে এদিক-ওদিক লাফ দিচ্ছে। টেবিল-চেয়ার ইত্যাদি লণ্ডভণ্ড হচ্ছে। নব সেইসময় একহাতে চেয়ার তুলে অন্যহাতে একটা বড় বোতল তাক করল। সে খুব অবহেলায় ব্যাপারটা দেখছিল।
আর সেই মুহূর্তেই দ্বিতীয় মেয়েটিও ছিটকে সদর দরজা গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল এবং অদৃশ্য হলো। নবর বোতলটা লাগল দরজার পাশে। প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে গেল। আততায়ী তখন দরজায়। পরক্ষণে নব দ্রুত একটা সোডার বোতল তুলে। মারল। বোতলটা বাইরে বৃষ্টির মধ্যে মোটাসোটা বাচ্চার মত ধপ্ করে পড়ল মাত্ৰ-ফাটল না। লন মতো আছে ওখানটায়-ঘাস আর ফুলের গাছ রয়েছে। ঘাস আর ফুলের গাছের মধ্যে বেহেড মাতালের মতো ঘাড় গুঁজে পড়ে রইল বোতলটা।
তখন নব দুহাতে চোখ মুছল। মঞ্চে কেউ নেই।
দুঃস্বপ্ন দেখছিল না তো?
মোটেও না। রেস্তোরাঁর ভিতর জলজ্যান্ত ওল্টানো টেবিল-চেয়ার, ভাঙা কাচের গ্লাসগুলো, ছত্রাকার ছাইদানি ইত্যাদি-মেঝের কারপেট ভিজে গেছে ইতস্তত, একটা বোতল থেকে তখনও বগবগ করে জল পড়ছে। দরজার কাছে অজস্র কাচের .. টুকরো। একদিকের পর্দা ছিঁড়ে বেমক্কা ঝুলছে।
নব প্রথমে এক লাফে দরজায় এসে বাইরে তাকাল। কেউ কোথাও নেই। বাতিগুলি বৃষ্টির ঝাপটায় ম্লান-বিচের দিকে যেন কুয়াশার পর্দা ঝুলছে। ডাইনে বাঁয়ে উপকূলের সমান্তরাল অপ্রশস্ত রাস্তা নির্জন। ফুলগাছ কিংবা অন্যান্য সব বড় গাছগুলো বৃষ্টির মধ্যে ছটফট করছে, যেন পায়ে বাঁধা সব জন্তু-জানোয়ার।
সে দরজা ভাল করে এঁটে দিল। ডানপাশের কোনও বাড়ি বলতে বালিয়াড়িটার পিছনে কোস্টের সবচেয়ে কস্টলি হোটেল সী ভিউ। অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ হেঁটে যেতে হয় এখান থেকে। বাঁ পাশে একটা লম্বা ঝাউবন পেরিয়ে অন্তত একশো গজ দূরত্বে এক ধনী মানুষের বাংলোবাড়ি। পিছনে দেড়শো গজ পোভড়া জায়গায় কাটাতারের বেড়া এবং সরকারের লোহালক্কড়ের পাহাড়, তার পিছনে ত্রিশ গজ দূরে অবজারভেটরি। তারপর বড় রাস্তা এবং ছড়ানো-ছিটানো বসতি এলাকা, বাজার এবং সরকারী কোয়ার্টার। তারও পিছনে সরকার-লালিত অরণ্য অঞ্চল এবং কয়েকটি টিলা বা হিলক-শ্রেণীর ক্ষুদে পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় কোথাও বাংলো, কোথাও আশ্রম আর মন্দির রয়েছে।
এই ভূগোল ও প্রকৃতি-পরিবেশ ঝটপট মনে ভাসল নবর। সে খুব ক্লান্ত বোধ করল। বৃষ্টি ছাড়বার কোনও লক্ষণ নেই। সমুদ্র গর্জাচ্ছে। কোনও পুলিশ অফিসারও তো আজ আসছে না এমন রাতে! হাঙরে কোনও ফোন নেই। বড়ো হোটেলগুলোয় আছে। কিন্তু বাইরে বেরোনো অসম্ভব।
মেয়ে দুটি গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল হাঙরে। হাফ-পেগ জিন নিয়ে দুঘন্টা কাটিয়ে গিয়েছিল। কেমন গম্ভীর টাইপ মেয়ে যেন কম কথা বলে। কলকাতা থেকে এসেছে, সেটা বোঝাই যায়। কোথায় উঠেছে ওরা? আর, আচমকা ওই মূর্তির উদয় হলো, তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল…কোনও মানে হয় না। এ একটা স্বপ্নই!
একটু পরে সে সিগারেট ধরাল। তারপর ধীরে সুস্থে ঘরটা সামলাতে ব্যস্ত হলো। কাচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে টেবিলে রাখল। তারপর মেয়ে দুটি যেখানে বসেছিল, সেখানে গেল। চেয়ারগুলো ঠিকঠাক করার সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ল কিছু কাগজের টুকরো পড়ে রয়েছে কুচিকুচি এবং দলা পাকানো। দলা পাকানো কাগজটা সে অকারণ অন্যমনস্কতায় খুলল। একটা বড় কাগজের অংশ–কিন্তু ছাপানো নয়, হাতের লেখা। সে আদৌ লেখপড়া জানে না।
নবর মনে পড়ল, এই কাগজটা বেঁটে মেয়েটির হাত থেকে নিয়ে ফরসা মেয়েটি পড়ছিল বটে। দ্বিতীয়বার সার্ভ করার সময় নব দেখেছিল, বেঁটে মেয়েটি কোলে হাত দুটো রেখেছে এবং আনমনে একটা কাগজ কুটিকুটি করেছে।
কাগজগুলো সে ফেলল না। পকেটে রাখল। নব পুলিশের ইনফরমার। তার কী করা উচিত, সে জানে।…