সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
কর্নেল সমগ্র
সোনার ডমরু
এক
ডমরুনাথ নেপাল সীমান্তে একটি প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র। কিন্তু জনসমাগম বছরে সেই একবার-বৈশাখ মাসে বাবা ডমরুনাথের পুজো উপলক্ষে। বাকি এগারো মাস খাঁ খাঁ নিঃঝুম অবস্থা। আড়াইহাজার ফুট পাহাড়ের মাথায় বাবার মন্দির। ঘোরালো একফালি রাস্তা পাহাড় ঘুরে ঘুরে এগিয়ে গেছে ওপরে। মোটরগাড়ি নিয়েও অনায়াসে ওঠা যায়।
ছোট্ট একটা বাজার এবং বস্তী রয়েছে ডমরু পাহাড়ের পাদদেশে। সেখান দিয়েই গেছে নেপালগামী একটা পিচের সড়ক।
অক্টোবরের এক বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় আমি আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ভাড়া করা জিপ থেকে নামলুম। যে বাংলোয় আমরা উঠব, সেটা খুব কাছেই একটা টিলার ওপর। জিপের ড্রাইভার বুষ্টু সিং এবং তার ছোকরা অ্যাসিস্টান্ট হরিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি মতো আমাদের অল্পস্বল্প মালপত্তর সেখানে পৌঁছে দিল। ওরা যত ভিজল, আমরা তত ভিজলুম না। কারণ আমাদের গায়ে বর্ষাতি চাপানো। কিন্তু বাংলোর বারান্দায় উঠেই আমার বন্ধুটি ভীষণ কাশতে শুরু করলেন।
চৌকিদার বদ্রীনাথ বয়সে প্রৌঢ়। পেটাই শরীর। বেঁটে, এবং মুখের গড়ন কিঞ্চিৎ বর্তুলাকার। তাকে অমায়িক ও আমুদে লোক বলে মনে হলো। সে আমার সঙ্গী ভদ্রলোকের কাশি দেখে কেন কে জানে হাসি চাপছিল। একটু পরে অনুমান করলুম সম্ভবত কাশির শব্দটাই তার হাসির কারণ।
হাসি আমারও পাচ্ছিল। কারণ, এযাবৎকাল এই খ্যাতনামা গোয়েন্দা এবং প্রকৃতিবিদ বৃদ্ধলোকটির এমন দুরবস্থা কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। কাশতে কাশতে উনি যেভাবে ঝুঁকে পড়ছিলেন ভয় হচ্ছিল, দম আটকে বেঘোরে মারা না পড়েন। কিন্তু কাশি থামার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর দুচোখে সেই সুপরিচিত উজ্জ্বল হাসি ছলছল করে উঠছিল। এ হাসি প্রতিফলনের দরুণ দ্বিগুণ উজ্জ্বল-জলে আলোর ছটা পড়লে যা হয়। ওঁর চোখে কাশি জনিত জল ছিল।
অক্টোবরেই উচ্চতার দরুন এ তল্লাটে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। তার ওপর এই বৃষ্টি। শূন্য ফায়ারপ্লেসের দিকে চেয়ে আমি একটা মতলব ভঁজছি টের পেয়ে উনি বললেন, দরকার হবে না ডার্লিং! বরং তুমি বদ্রীকে বলল, ঝটপট কফিটা নিয়ে আসুক। আর শোনো, আমার কিটব্যাগ খুলে ডানদিকে খোপ থেকে ক্ষুদে শিশিটা বের করো।
বদ্রীর উদ্দেশ্যে হাঁক মেরে জলদি কফি করতে বলার পর কিটব্যাগ খুলে। শিশিটা এনে দিলুম। টেবিলের পাশে পা ছড়িয়ে আরাম কেদারায় বসে উনি শিশি থেকে লালরঙের কয়েকটা গুলি বের করলেন। মুখে ফেলে চুষতে থাকলেন।
জিজ্ঞেস করলুম, হাই ওল্ড ম্যান! বস্তুটি কি তানসেন গুলি?
টাকওলা প্রকাণ্ড মাথাটি দোলালেন মাত্র। তারপর অভ্যাসমতো সাদা দাড়িগুলোতে আঙুল বোলাতে থাকলেন। আমি বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকলুম।
বৃষ্টিঝরা অন্ধকার রাতে ডমরুনাথকে রহস্যময় দেখাচ্ছিল। একটু নীচে ওই বস্তী ও বাজারে সামান্য কয়েকটা আলো আবছা ঝিকমিক করছে। শুনেছি, তিনমাইল দূরের হাইড্রো-ইলেকট্রিক সেন্টার থেকে এখানে বিদ্যুৎ আসে। আসার কারণ বাবা ডমরু ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সেই সুবাদে এই বাংলোও বিদ্যুৎ লাভে বঞ্চিত হয়নি।
এই সময় হঠাৎ কানে এল পাশের বদ্ধ ঘর থেকে কাদের কথাবার্তা চলেছে। আড়িপাতা স্বভাব আমার নয়। কিন্তু ওই কথাবার্তা স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। তার চেয়ে বড় কথা, একটি কণ্ঠ মহিলার।
অনেক সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও অন্যদের আলোচ্য কানে এসে ঢোকে এবং কিছু করার থাকে না–নেহাত শুনে যাওয়া ছাড়া। বদ্রীর কফি করতে মিনিট সাতেক লাগল। তার মধ্যে আমি অনেকগুলো কথা শুনে ফেললুম।
কিছুক্ষণ পরে কফি খাচ্ছি, গোয়েন্দাপ্রবর মাঝেমাঝে অদ্ভুত শব্দে কেশে উঠছেন–বদ্রী এসে জিজ্ঞেস করল, সায়েবরা সঙ্গে রাতের খাবারদাবার এনেছেন, নাকি তাকে খানার বন্দোবস্ত করতে হবে?
আমরা কিছু আনিনি এবং তাকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে, শুনে সে চলে যাচ্ছিল। আমি ডাকলুম, বদ্রী, শোনো।
বদ্রী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
বললুম– পাশের ঘরে কারা এসেছেন মনে হলো?
হ্যাঁ স্যার। ওনারাভি বাঙালী আছেন। কলকাতা থেকে আজ সকালে এসেছেন।
স্বামী স্ত্রী?
বদ্রী কেমন হাসল শুধু।
স্বামী-স্ত্রী নয়?
বদ্রী ফের হেসে বলল, নয়–তা তো বলিনি স্যার!
বেড়াতে এসেছেন বুঝি?
তাছাড়া আর কেন এখন ডমরুনাথে লোকে আসবে? আপনারাও তো এসেছেন। বলে বদ্রী রহস্যময় হেসে চলে গেল।
বৃদ্ধ গোয়েন্দা এবার আরেক দফা কেসে আস্তে বললেন, তোমায় রীতিমতো উত্তেজিত মনে হচ্ছে ডার্লিং। তবে একটা কথা বলি শোনো। নরনারীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো অভদ্রতা। সুতরাং আশা করি আজ রাতে যদি তেমন কিছু ঘটেও–তুমি যেন ব্যস্ত হয়ো না!
আমি একটু অবাক হয়ে বললুম– এর অর্থ?
অতি সরল। বলে উনি কফির সঙ্গে সেই লাল গুলিও ফের মুখে চালান করলেন।
সিগারেট ধরিয়ে হাসতে হাসতে বললুম– আপনি কি গণক, না অন্তর্যামী? কারা ও-ঘরে এসেছে, আমরা এখনও তাদের চাক্ষুষ পর্যন্ত করিনি। অথচ আপনি দৈববাণী করছেন যে, আজ রাতে কিছু ঘটতে পারে।
বৃদ্ধ চোখ বুজে গুলি চুষতে থাকলেন। হাঁটুর ওপর কফির পেয়ালা। পেয়ালার ভাপ নিচ্ছেন হাতে এবং সেই হাত মাঝে মাঝে গালে ও কম্ফোর্টার সরিয়ে গলায় বুলোচ্ছেন।
ডাকলুম, কর্নেল!
বলো জয়ন্ত! ঐ দৈববাণীর কারণ কী?
কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন। বললেন, তোমার উত্তেজিত চেহারা দেখে যা মনে এল, বলেছি ডার্লিং!
ভ্যাট! আমার চেহারায় কিছু নেই।
গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, যখন তুমি বারান্দায় গেলে, তখন তোমার চেহারায় প্রশান্তি ছিল। যখন তুমি ঘরে ঢুকলে, তখন তোমার চেহারায় রীতিমতো উত্তেজনা ছিল। তারপর তুমি বদ্রীকে জেরা করতে শুরু করলে। সব মিলিয়ে আমার মনে হলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি ও-ঘরে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আড়ি পেতেছিলে! নিশ্চয় তেমন কিছু কানে এসেছিল তোমার–যাতে…
বাধা দিয়ে হাসতে হাসতে বললুম– হার মানছি। কিন্তু হে বৃদ্ধ ঘুঘুমশাই। ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি বড্ড গোলমেলে। আমি অকারণে উত্তেজিত হইনি!
কর্নেল চোখ বুজে বললনে, বলে যাও ডার্লিং! আমি সবকিছুতেই আগ্রহী।
চাপা গলায় বললুম– ওঁরা ভীষণ ঝগড়াঝাটি করছিলেন। কারণটা বোঝা গেল না। ভদ্রলোক বলছিলেন, তুমি নিজেই এ জন্যে দায়ী, এ সব কথা আগে জানলে কিছুতেই আমি আসতুম না এখানে। ভদ্রমহিলা বলছিলেন, ন্যাকামি কোরো না! তুমি জেনেশুনেই এসেছ। তুমি কী তা এতদিনে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি। তারপর শুনি, ভদ্রলোক ক্ষেপে গেছেন যেন। বললেন এখনই আমি চলে যাচ্ছি। থাকো তুমি একা! বিশ্বাসঘাতিনী মেয়ে কোথাকার! তারপর ভদ্রমহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
হুঁ। ইন্টারেস্টিং। তারপর?
তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ ছিল না। চলে এলুম।
কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, বদ্রীও কী যেন আঁচ করেছে মনে হলো। কেমন হাসছিল।
এই সময় কড় কড় কড়াৎ করে মেঘ ডাকল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে বাতাসের শোঁ শোঁ শোনা গেল। জানলাগুলো বন্ধই ছিল। দরজার পর্দা দুলে উঠল। তখন দরজা বন্ধ করে দিলুম।
কর্নেল বললেন, সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ করে ঝরছিল। তখনই বুঝেছিলুম, রাতের দিকে অবস্থা যোরালো হবে। জয়ন্ত তরাই অঞ্চলের পাহাড়ে ঝড়বৃষ্টির রাত বড় রোমাঞ্চকর। ওই শোনন, বাবা ডমরুনাথ ডমরু বাজিয়ে এবার বেজায় রকমের একটা নাচ জুড়বেন। খাসা!
বাইরে বাতাসটা বাড়তে থাকল। তার সঙ্গে মুহুর্মুহু বজ্রপাত এবং মেঘের গর্জন শুরু হলে বাংলো কাঁপতে থাকল। বললুম– সর্বনাশ! সেবার এ তল্লাটে এসে সাতদিন আটকে গিয়েছিলুম মনে পড়ছে কর্নেল? ধস ছেড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবারও তাই হবে নাকি?
হলেও অবাক হব না। কর্নেল নিরাসক্তভাবে বললেন।
তবে স্বস্তির কারণ, ওঁর কাশিটা কমেছে। আমি পা ছড়িয়ে আরাম পাওয়ার চেষ্টায় সিগারেট ধরালুম। কিন্তু মনের ভেতর পাশের ঘরের সেই তর্কাতর্কি সারাক্ষণ প্রতিধ্বনি করে চলেছে। একটা যুক্তিসঙ্গত ঘটনা দাঁড় করার চেষ্টা করছি। কিন্তু দাঁড়াচ্ছে না। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাকে কিসের জন্য দায়ী করেছে? কী জানতে পারলে এখানে আসতেন না? আর ভদ্রমহিলাই বা কেন বলছেন, জেনেশুনেই এসেছ তুমি! ব্যাপারটা কী হতে পারে?
এতকাল ধরে গোয়েন্দার সঙ্গগুণে সবতাতে কৌতূহলী হওয়ার স্বভাব আমাকে পেয়ে বসেছে। ঝোঁকের মাথায় উঠে দাঁড়ালুম। কর্নেল চোখ বুজে শরীর এলিয়ে বসে আছেন। বর্ষাতিটা গায়ে চড়িয়ে দরজার দিকে এগোলে বললেন, বেরিয়ো না জয়ন্ত। ঝড়ে উড়ে যাবে। তাছাড়া কৌতূহল জিনিসটা অনেক সময় অকারণ বিপদে ফেলে। চুপ করে বসো।
কথা কানে নিলুম না। দরজা খুলতেই ভেজা পর্দা গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। কর্নেল বিরক্ত হয়ে ফের বললেন, তুমি দেখছি কেলেংকারি না বাধিয়ে ছাড়বে না জয়ন্ত! লক্ষ্য করেছ কি, আমার স্বরভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ? যে ঠাণ্ডা বাতাসটা এইমাত্র ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে, আজ রাতে সে আমার গলার বারোটা বাজাবে। দরজা বন্ধ করো শীগগির!
দরজা বন্ধ করার মুখে আবছা একটা চিৎকার কানে এল যেন। ভুল হতেও পারে। কিন্তু গা শিউরে উঠেছিল। দরজা বন্ধ করে বললুম– কে চেঁচাল, শুনতে পেলেন?
কর্নেল ওভারকোটের কলার আরও তুলে মাথার দুপাশটা ঢেকে বললেন, না।
আমার ধারণা পাশের ঘরে একটা কিছু..।
কথা কেড়ে বৃদ্ধ গোয়েন্দা বললেন, শুনেছি ডমরু পাহাড়ে ঝড়ের রাতে অনেক বিদঘুটে চিৎকার শোনা যায়। ভূতপ্রেত থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাবা। ডমরুনাথ স্বয়ং মহাদেব কি না!
ক্ষুব্ধমুখে চুপচাপ বসে রইলুম। বাইরে ঝড়বৃষ্টি তুমুল চলতে থাকল। বজ্রপাত এবং মেঘের গর্জনে পৃথিবী কাঁপতে থাকল।
কতক্ষণ পরে বদ্রীর সাড়া এল দরজার বাইরে। দরজা খুললে সে ট্রে ভর্তি চাপাটি আর আলুর দম নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঝড়টা কমেছে। কিন্তু ছিটেফোঁটা বৃষ্টি সমানে ঝরছে। বদ্রী বলল, তাহলে আপনারা খেয়ে নিন স্যার। দরকার হলে ঘণ্টার বোতাম টিপবেন।
বললুম– পাশের ঘরের ওঁদের খাওয়া-দাওয়ার কী হচ্ছে বদ্রী?
বদ্রী চোখ নাচিয়ে বলল, ক্যা মালুম! ওনারা রাতে কিছু খাবেন না বলেছেন।
দরজা বন্ধ আছে দেখলে?
জী হাঁ।
বদ্রী চলে যাচ্ছিল, ডাকলুম–শোনো।
বলুন স্যার!
কিছুক্ষণ আগে কে চেঁচিয়ে উঠল মনে হলো। শুনছ?
বদ্রী হাসল।…..ও কিছু না স্যার। ঝড়ের রাতে এমন আজব শব্দ হয়। শুনতে নেই।
সে চলে গেলে কর্নেল উঠলেন। বললেন, জয়ন্ত! তুমি কি ভাবছ, ডমরুনাথে এসে তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কিছু লোভনীয় রসদ সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে?
হাসতে হাসতে বললুম– আপনার গলা বেশ ভেঙে গেছে কর্নেল!
আরও ভাঙবে। সকালে হয়তো আর কথাও বলতে পারব না। কর্নেল টেবিলে ট্রের দিকে ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে বললেন। হুম! তাই আগে থেকে বলে রাখি, অকারণ পাশের ঘরে নাক গলিও না। বিপদে পড়বে। এবং সে বিপদে বৃদ্ধের সাহায্য পাবার আশা বৃথা। কারণ তার প্রচণ্ড কাশিজনিত স্বরভঙ্গ আসন্ন। গলার স্বর না। থাকলে গোয়েন্দাগিরিতে কোনও সুফল ফলে না।
কোনও কথা বললুম– না। কিন্তু বিপদে পড়ার কথা কেন বলছে কর্নেল, একথা ভেবেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। তাছাড়া স্বরভঙ্গের সঙ্গে গোয়েন্দাগিরির বৈরীভাবের কারণ কী, তাও বুঝলুম না।