সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
কর্নেল সমগ্র
প্রসঙ্গত
শুরুটা ছিল আকস্মিক এবং চটজলদি। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকের কথা। শ্রদ্ধেয় কবি মণীন্দ্র রায় তখন সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকার সম্পাদক। একদিন ডাক দিয়ে বললেন, শিগগির একটা উপন্যাস চাই। ধারাবাহিক বেরুবে। ফিরে গিয়েই লিখতে বসো।
তৎকালে রুজির ধান্দায় সাধ্যাতীত লিখে-লিখে মগজ খালি। অসহায় দৃষ্টে স্মৃতির দিকে তাকালাম। তারপর দেখতে পেলাম একটি মানুষকে।
মুখে সান্টা ক্লোসের মতো সাদা গোঁফদাড়ি। টকটকে ফর্সা রঙ। পরনে প্যান্টশার্ট। পিঠে আঁটা একটা কিটব্যাগ। বাইনোকুলারে দূরের কিছু দেখছিলেন। মুখ তুলতে গিয়ে টুপি খসে পড়ল এবং রোদে চকচক করে উঠল চওড়া টাক। টুপিটা কুড়িয়ে টাক ঢেকে এগিয়ে গেলেন একটা ধ্বংসস্তূপের কাছে। সেখানে ফুলে ভরা ঝোপ। গুঁড়ি মেরে হাঁটু ভাঁজ করে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ব্যাপারটা রহস্যজনক।
তবে ভেবেছিলাম সায়েব-ট্যুরিস্ট। কারণ ঘটনাস্থল লালবাগের (মুর্শিদাবাদ) প্রখ্যাত নবাবি প্রাসাদ হাজারদুয়ারি। ১৯৫৬ সালের শীতকাল। আনাচে-কানাচে ‘গাইড’-রা ওত পেতে থাকে। মওকা বুঝে একজন ‘গাইড’ তাঁকে ভুলভাল ইংরিজিতে ধ্বংসস্তূপটার ইতিহাস শোনাতে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি মুচকি হেসে সাদামাটা বাংলায় বলে উঠলেন, এই প্রজাপতিগুলো বড্ড সেয়ানা!
‘গাইড’ বেচারা হকচকিয়ে গেল। আমিও।
তো কেন জানি না মানুষটিকে ভুলতে পারিনি। এ-ও জানি না কেন তাঁকে অবসরপ্রাপ্ত কোন সামরিক অফিসার বলে মনে হয়েছিল।
উপন্যাস লিখতে গিয়ে অতবছর পরে আমার মধ্যে তাঁর ছায়া পড়ল! পটভূমি এক ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এসে গেল অন্ধকার বিশাল ঘরের মধ্যে সারবদ্ধ কবর। পাথরে বাঁধানো সব কবর। আসলে স্মৃতির ওপর স্মৃতির ছায়া। ষাটের দশকের শেষাশেষি দিল্লিতে আলাপ হয়েছিল এক সাংবাদিক এবং লেখকের সঙ্গে। ‘দরবেশ’ ছদ্মনামে তিনি লিখতেন। আলাপ থেকে বন্ধুতা। দুজনে মিলে টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম। কুতুবমিনার যাওয়ার পথে সফদরজঙ্গ বিমানঘাঁটির কাছে তিনি আমাকে সেই ভুতুড়ে গা-ছমছম করা কবরখানায় ঢুকিয়েছিলেন।
শুধু এটুকু মনে পড়ছে, একটা অন্ধকার কবর প্রাসাদের মধ্যে একটা টাটকা লাশ ফেলে রেখে সেই ফাদার ক্রিসমাসকে ঢুকিয়ে দুষ্টুমি করার মতলব ছিল। এবং লাশটা হবে কোনও এক যুবতীর।
কিন্তু তখনও জানতাম না আমি ‘Whodunit’-এর ফাঁদে পড়তে যাচ্ছি। কিছুটা এগিয়েই টের পেলাম। তারপর সম্পাদককে কাঁচুমাচু মুখে জানালাম কী সাংঘাতিক কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছি। তিনি বললেন, ঠিক আছে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও।
এভাবেই আমার প্রথম রহস্যউপন্যাস ‘ছায়া পড়ে’ ধারাবাহিক বেরিয়েছিল সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায়। ১৯৫৬ সালের শীতকালে মুর্শিদাবাদ শহরের খণ্ডহরে দেখা সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক হয়ে উঠেছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তাঁর সায়েবি হাবভাব বহুবছর ধরে আমার মনে একজন খ্রিস্টানের আদর্শ বহাল রেখেছিল। ক্রমশ আমার মনে হয়, তাঁর বিশেষ কোনও ধর্মপরিচয়ের দরকারটা কী? তিনি একজন প্রকৃতিবিদ এবং রহস্যভেদী, এই তো যথেষ্ট। ক্রমে ক্রমে বুঝেছিলাম, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে রহস্যভেদীর একজন সহকারী বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দরকার হয়, যাঁর মুখ দিয়ে কাহিনীটি বর্ণনার সুবিধা আছে। তাই আনলাম সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরিকে। কর্নেলের মতো চরিত্রের আর একটা বড় সমস্যা ছিল। সেটা অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থাসংক্রান্ত সমস্যা। কর্নেলের মতো চরিত্রের মধ্যে বিশেষ করে এটি নৈতিক এবং অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই সরকার এবং পুলিশের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে দিতে হল। বাস্তব অবস্থা যা-ই হোক, এই সম্পর্ক আমার কাছে একটি মডেল। আবার, রহস্যের জটকে আপাতদৃষ্টে জটিলতর করার জন্য পরবর্তীকালে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্ত কুমার হালদারের আবির্ভাব ঠেকাতে পারিনি, যিনি কে. কে হালদার ওরফে হালদারমশাই নামে পরিচিত। আসলে রহস্যের জট জটিলতর করতে গিয়ে এঁকে দিয়ে অদ্ভুত-অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে মজা পেয়েছি এবং উল্টে রহস্যের সব জটিলতা খুলেই গেছে। হালদারমশাই আমার রিলিফ।
সব রহস্যভেদীরই আচরণগত কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। কর্নেলের মধ্যে আমার আগোচরে সেগুলি এসে গেছে। কফি ও চুরুটের প্রতি মাত্রাধিক আসক্তি, স্নেহভাজনদের ডার্লিং বলা, বিচিত্র উদ্ভিদ নিয়ে বাগান করা, কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা এবং বিদেশি পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা, চোখ বুজে দাড়ি বা টাকে হাত বুলানো ইত্যাদি। আবার বলছি, আগে থেকে ভেবেচিন্তে তাঁকে তৈরি করিনি। কিন্তু তাঁর অতীত সামরিক জীবনকে কাজে লাগানোর সুবিধা পেয়েছি। তাই ছোটদের জন্য রহস্য-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার লিখতে গিয়েও কর্নেলকেই ব্যবহার করেছি। ছোটদের কাছে কর্নেলের আদর কত বেশি, তার প্রমাণ এখনও পাই। একবার একটি কাহিনীতে আমার নিজের ফোন নম্বর কর্নেলের করে দেওয়ার দুর্ভোগে এখনও মাঝে মাঝে ভুগি। হঠাৎ কচি গলায় ফোন আসে, কর্নেল আছেন? দারুণ রহস্য।…
হিতৈষী বন্ধুরা আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, কর্নেল তোমাকে ডোবাবে। সিরিয়াস সাহিত্য-টাহিত্য তোমার কাছে আর কেউ নেবে না।
কে জানে! আমার কাছে রহস্যকাহিনী আসলে তাস নিয়ে পেশেন্স খেলা। গাজোয়ারি তথাকথিত সিরিয়াস সাহিত্যরচনা একটা অপচেষ্টা। তার চেয়ে বরং স্রেফ বিনোদনদান নিরাপদ এবং এতে মগজ তাজা থাকে। জটিল একটা অঙ্ক কষে ফেলতে পারলে মগজে যেমন একটা তরতাজা ভাব এসে যায়। তাই বাঘা বাঘা পণ্ডিতজনেরা রহস্যকাহিনীর গোঁড়া ভক্ত। অবাক লাগে ভাবতে, তলস্তয়ের মতো বিরাট লেখকও সম্ভবত নিজের অজ্ঞাতসারে একটি রহস্যকাহিনী লিখে ফেলেছিলেন। তবে নিজেও বুঝি, রহস্যকাহিনী (যা প্রকৃতপক্ষে গোয়েন্দাকাহিনী) লেখাটা তত সোজা নয়।
এর সাফল্য নির্ভর করে বুদ্ধির প্রাচুর্যের ওপর। এ ব্যাপারে হৃদয় বা ভাবাবেগ একেবারে অপ্রাসঙ্গিক। অঙ্কের উপমা দিয়েছি। কিন্তু উপমা উপমাই। তা নিজে সত্য নয়, সত্যকে বোঝানোর একটা চেষ্টা মাত্র। রহস্যকাহিনীর মূল অপরাধী এবং তার অপরাধের চতুর পদ্ধতি বা Modus Operandi আগে থেকে লেখক ঠিক করে রেখে এগোলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। কারণ যে কোনও কাহিনীর মতো রহস্যকাহিনীরও নিজস্ব গতিপথ এবং লজিক আছে, যা লেখকের ইচ্ছানিরপেক্ষ। লেখককে অসহায় হয়ে সেই পথে এগিয়ে যেতে হয়। এর ফলে, অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, লেখক এবং রহস্যভেদী ‘whodunit’-এর গোলকধাঁধায় একাত্ম হয়ে ঘুরে বেড়ান। লেখকও গলদঘর্ম হয়ে সূত্র খোঁজেন। যুক্তি দিয়ে সূত্ৰলব্ধ তথ্যকে সাজানো ছাড়া উপায় থাকে না। সেই বিচারে রহস্যভেদী এবং লেখক মূলত একই ব্যক্তি।
সম্ভবত এই সমস্যার জন্যই ১৯২৮ সালে S. S. Van Dine নামে এক বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনীকার কুড়িটি নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন। সবগুলি নিয়ম কেউ যে মানতে চাননি, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। আমার মনে হয়েছে, অন্তত তাঁর একটি নিয়ম অংশত সর্বগ্রাহ্য : রহস্যভেদী নিজে কদাচ অপরাধী হবেন না। হওয়া উচিত নয়। হলে তাঁকে আর দ্বিতীয়বার রহস্যভেদী করা যায় না। এই মডেলটিই ক্লাসিক। কোনও লেখক প্রয়োজনবোধে একাধিক রহস্যভেদী চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন (যেমন আগাথা ক্রিস্টির এরকুলে পোয়ারো, মিস্ মার্পল, পার্কার পাইন)। কিন্তু তাঁদের একমাত্র কাজ অপরাধীকে সনাক্ত করা।
রহস্যকাহিনীতে সাফল্যের দাবি আমি কদাচ করি না এবং সেই অধিকারও আমার নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে আমি কিছুতেই ত্যাগ করতে পারব না। তিনি আমারই দ্বিতীয় সত্তা।
একটা কথা বলা উচিত। কর্নেল চরিত্রে আমি সতর্কভাবে সব জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত রহস্যভেদীর চরিত্রের ছায়া এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছি। তা সত্বেও কেউ যদি কারও ছায়া কখনও আবিষ্কার করে ফেলেন, সেটা নেহাত সমাপতন। আমি বিশ্বের সব রহস্যকাহিনী তো পড়িনি।
এতবছর ধরে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে নিয়ে যত ছোট-মাঝারি-বড় কাহিনী লিখেছি, তা ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে ছিল নানা জায়গায়। এতদিনে তা একত্র করে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন দে’জ পাবলিশিং-এর কর্ণধার স্নেহভাজন শ্রী সুধাংশু দে। এ একটা বড় রকমের ঝুঁকি। তবু তিনি দুঃসাহসী। তাঁর এই প্রকাশন সংস্থায় উন্মেষের কাল থেকেই বুড়ো বজ্জাতের মতো আমি তাঁর কাঁধে বসে আছি। দেখা যাক্।
এই সুযোগে ধন্যবাদ জানাই সেইসব চেনা-অচেনা পাঠকদের, যাঁরা এতদিন ধরে কর্নেলের তারিফ করেছেন এবং আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাঁরা এবার কর্নেলের সবকিছু ক্রিয়াকাণ্ড একই মঞ্চে অবলোকন এবং বিচারের সুযোগ পাবেন।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ