বিপ্রদাস

‘বিপ্রদাসে’র প্রথম দশ পরিচ্ছেদ ১৩৩৬ হতে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ‘বেণু’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পুনারায় ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন, চৈত্র; ১৩৪০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন এবং ১৩৪১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ, শ্রাবণ, ভাদ্র, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। মাঝে মাঝে কয়েক সংখ্যায় বাদ গেলেও ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ‘বিপ্রদাস’ উপন্যাসটি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হয়েছিল। অতঃপর, ১৩৪১ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে (১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৫) প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।

সেকালের দাঙ্গা-হাঙ্গামাপূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে বিপ্রদাসের কাহিনী। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিপুণ শিল্পীর মতো তৎকালীন সামাজিক অবস্থা, জমিদারী প্রথার বাস্তবতা এঁকেছেন বিপ্রদাস উপন্যাসে।

বিপ্রদাস, বলরামপুরের জমিদার দয়াময়ীর সৎ ছেলে। এই বিপ্রদাসকে কেন্দ্র করেই উপন্যাস। মাতৃভক্তি, ধর্মভক্তি, দায়িত্ব আর কর্তব্যনিষ্ঠা তার অসাধারণ। দয়াময়ীর বিরাট জমিদারী সে-ই সামলায়। আছে দয়াময়ীর আপন ছেলে দ্বিজুদাস। সারাক্ষণ প্রজাদের স্বার্থ নিয়ে মিছিল মিটিং করতে থাকে। মা ও দাদার অবাধ্য না হলেও বৌদিদির সে সবচেয়ে বড় ভক্ত। মা দাদা থেকেও সতী বৌদিদিকে সে বেশি মান্য করে। আরেক প্রধান চরিত্র আছে বন্দনা। সতীর পিসতুতো বোন বন্দনা। অপরদিকে দয়াময়ী যেন সাধারণ বাইরের দশজনের মধ্যে একজন।

প্রথম কিছুটা ভূমিকা শেষে কাহিনী শুরু হয় দয়াময়ীর বাড়িতে বন্দনার বেড়াতে যাওয়া নিয়ে। দয়াময়ী পরিবার গোড়া হিন্দু পরিবার। ছোঁয়াছুঁয়ি মেনে চলেন। তাই বন্দনা যখন তাকে প্রণাম করতে যায় তখন তিনি একটু সরে দাঁড়ান। ব্যাপারটা বন্দনার গায়ে লাগে, তারচেয়েও বেশি গায়ে লাগে যখন সে দেখে তার বাবাকে একলা খেতে দেওয়া হয়েছে। সে রাগ করে থাকার আমন্ত্রণ বাদ দিয়ে বিকেলের ট্রেনে চলে যেতে চায়। তারপর তাদের স্টেশনে গমন, ট্রেনে মাতালদের খপ্পরে পড়ে বিপ্রদাসের সাথে যাওয়া, কলকাতায় বিপ্রদাসের বাড়িতে উঠা, কথায় কথায় ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে বিপ্রদাসের প্রতি বন্দনার প্রচ্ছন্ন কটাক্ষ, মায়ের পক্ষে বিপ্রদাসের সাফাই, কলকাতার বাড়িতে বন্দনার সেবার বহর, বন্দনাকে দ্বিজদাসের বউ করার ইচ্ছা, অতিশয় আদর, সে ইচ্ছার ভাঙন। বিভিন্ন রাগ, অভিমান, দুর্ঘটনা, বিপ্রদাসের হঠাৎ অসুস্থ হওয়া, বন্দনার মনের পরিবর্তন, অসুস্থ বিপ্রদাসের অকুণ্ঠ সেবা, কাহিনীর শেষে বিপ্রদাসের সর্বস্বান্ত হওয়া, দ্বিজদাসের মায়ের মত বৌদিদির মৃত্যু, বন্দনার নিজের দেশে চলে যাওয়া, এবং পুনরায় বলরামপুরে ফিরে আসা। তারপর দয়াময়ী ও বিপ্রদাসের একসাথে কৈলাস ভ্রমণ ও দ্বিজদাসের সাথে বন্দনার শুভবিবাহ একই সাথে দুঃখভারাক্রান্ত আনন্দ দিয়ে কাহিনীর সমাপ্তি।

বরাবরের মতই শরৎচন্দ্র একজন অসাধারণ কথাসাহিত্যিক। তিনি যেভাবে ঘটনাক্রম তুলে ধরেন, মানুষের মনের অভিব্যক্তিগুলো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেন তাতে তার জুড়ি মেলা ভার। বিপ্রদাস তার লেখা আরেক অসাধারণ উপন্যাস।