আট

গণ্ডগোল শুনিয়া পাশের কামরার সহযাত্রী সাহেবরা প্লাটফর্মে নামিয়া দাঁড়াইল, এবং রুক্ষকণ্ঠে সমস্বরে প্রশ্ন করিল, What’s up? ভাবটা এই যে, সঙ্গীদের হইয়া তাহারা বিক্রম দেখাইতে প্রস্তুত।

বিপ্রদাস অদূরবর্তী গার্ডকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকিয়া কহিল, এই লোকগুলা খুব সম্ভব ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জার নয়, তোমার ডিউটি এদের সরিয়ে দেওয়া।

সে বেচারাও সাহেব, কিন্তু অত্যন্ত কাল-সাহেব। সুতরাং ডিউটি যাই হউক, ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। অনেকেই তামাশা দেখিতেছিল, সেই মাদ্রাজী রিলিভিং হ্যান্ডটিও দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে হাত নাড়িয়া নিকটে ডাকিয়া বিপ্রদাস পাঁচ টাকার একটা নোট দিয়া কহিল, আমার নাম আমার চাকরদের কাছে পাবে। তোমার কর্তাদের কাছে একটা তার করে দাও যে এই মাতাল ফিরিঙ্গীর দল জোর করে ফার্স্ট ক্লাসে উঠেছে, নামতে চায় না। আর এ-খবরটাও তাদের জানিয়ো যে গাড়ির গার্ড দাঁড়িয়ে মজা দেখলে, কিন্তু কোন সাহায্য করলে না।

গার্ড নিজের বিপদ বুঝিল। সাহসে ভর করিয়া সরিয়া আসিয়া বলিল, Don’t you see they are big people? তোমরা রেলওয়ে সারভ্যাণ্ট, রেলের পাশে যাচ্ছ—be careful!

কথাটা মাতালের পক্ষেও উপেক্ষণীয় নয়। অতএব তাহারা নামিয়া পাশের কামরায় গেল, কিন্তু ঠিক অহিংস মেজাজে গেল না। চাপাগলায় যাহা বলিয়া গেল তাহাতে মন বেশ নিশ্চিন্ত হয় না। সে যা হোক, পাঞ্জাবের ব্যারিস্টারসাহেব গার্ডকে ধন্যবাদ দিয়া কহিলেন, আপনি না থাকলে আজ হয়ত আমাদের যাওয়াই ঘটত না।

ও—নো। এ আমার ডিউটি।

গাড়ি ছাড়িবার ঘণ্টা পড়িল। বিপ্রদাস নামিবার উপক্রম করিয়া কহিল, আর বোধ হয় আমার সঙ্গে যাবার প্রয়োজন নেই। ওরা আর কিছু করবে না।

ব্যারিস্টার বলিলেন, সাহস করবে না। চাকরির ভয় আছে ত!

বন্দনা দরজা আগলাইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, না, সে হবে না। চাকরির ভয়টাই চরম guarantee নয়,—সঙ্গে আপনাকে যেতেই হবে।

বিপ্রদাস হাসিয়া কহিল, পুরুষ হলে বুঝতে এর চেয়ে বড় guarantee সংসারে নেই। কিন্তু আমি যে কিছু খেয়ে আসিনি।

খেয়ে আমিও ত আসিনি।

সে তোমার শখ। কিন্তু একটু পরেই আসবে হোটেলওয়ালা বড় স্টেশন, সেখানে ইচ্ছে হলেই খেতে পারবে।

বন্দনা কহিল, কিন্তু সে ইচ্ছে হবে না। উপোস করতে আমিও পারি।

বিপ্রদাস বলিল, পেরে কোন পক্ষেরই লাভ নেই,—আমি নেবে যাই। ব্যারিস্টারসাহেবকে কহিল, আপনি সঙ্গে রইলেন একটু দেখবেন। যদি আবশ্যক হয় ত—

বন্দনা কহিল, চেন টেনে গাড়ি থামাবেন? সে আমিও পারব। এই বলিয়া সে জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া বাড়ির চাকরদের বলিয়া দিল, তোমরা মাকে গিয়ে ব’লো যে, উনি সঙ্গে গেলেন। কাল কিংবা পরশু ফিরবেন।

ট্রেন ছাড়িয়া দিল।

বন্দনা কাছে আসিয়া বসিল, কহিল, আচ্ছা মুখুয্যেমশাই, আপনি ত একগুঁয়ে কম নয়!

কেন?

আপনি যে জোর করে আমাদের গাড়িতে তুললেন, কিন্তু ওরা ত ছিল মাতাল, যদি নেবে না গিয়ে একটা মারামারি বাধিয়ে দিত?

বিপ্রদাস কহিল, তা হলে ওদের চাকরি যেত।

বন্দনা বলিল, কিন্তু আমাদের কি যেত? দেহের অস্থিপঞ্জর। সেটা চাকরির চেয়ে তুচ্ছ বস্তু নয়।

বিপ্রদাস ও বন্দনা উভয়েই হাসিতে লাগিল, অন্য মহিলাটিও হঠাৎ একটুখানি হাসিয়া ঘাড় ফিরাইল, শুধু তাঁহার স্বামী পাঞ্জাবের নবীন ব্যারিস্টার মুখ গম্ভীর করিয়া রহিলেন।

বন্দনার পিতা এতক্ষণ বিশেষ মনোযোগ করেন নাই, আলোচনার শেষের দিকটা কানে যাইতেই সোজা হইয়া বসিয়া বলিলেন, না না, তামাশার কথা নয়, এ ব্যাপার ট্রেনে প্রায়ই ঘটে, খবরের কাগজে দেখতে পাওয়া যায়। তাই ত জোর-জবরদস্তির আমার ইচ্ছেই ছিল না,—রাত্রের ট্রেনে গেলেই সব দিকে সুবিধে হ’ত।

বন্দনা কহিল, রাত্রের ট্রেনেও যদি মাতাল সাহেব থাকত বাবা?

পিতা কহিলেন, তা কি আর সত্যিই হয় রে? তা হলে ত ভদ্রলোকদের যাতায়াতই বন্ধ করতে হয়। এই বলিয়া তিনি একটা মোটা চুরুট ধরাইতে প্রবৃত্ত হইলেন।

বন্দনা আস্তে আস্তে বলিল, মুখুয্যেমশাই, ভদ্রলোকের সংজ্ঞা নিয়ে যেন বাবাকে জেরা করবেন না।

বিপ্রদাস হাসিমুখে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। সে আমি বুঝেচি।

আচ্ছা মুখুয্যেমশাই, ছেলেবেলা গড়ের মাঠে সাহেবদের সঙ্গে কখনো মারামারি করেছেন? সত্যি বলবেন।

না, সে সৌভাগ্য কখনো ঘটেনি।

বন্দনা কহিল, লোকে বলে, দেশের লোকের কাছে আপনি একটা terror। শুনি, বাড়ির সবাই আপনাকে বাঘের মত ভয় করে। সত্যি?

কিন্তু শুনলে কার কাছে?

বন্দনা গলা খাট করিয়া বলিল, মেজদির কাছে।

কি বলেন তিনি?

বলেন, ভয়ে গায়ের রক্ত জল হয়ে যায়।

কিরকম জল! মাতাল সাহেব দেখলে আমাদের যেমন হয়,—তেমনি?

বন্দনা সহাস্যে মাথা নাড়িয়া বলিল, হাঁ, অনেকটা ঐরকম।

বিপ্রদাস কহিল, ওটা দরকার। নইলে মেয়েদের শাসনে রাখা যায় না। তোমার বিয়ে হলে বিদ্যেটা ভায়াকে শিখিয়ে দিয়ে আসব।

বন্দনা কহিল, দেবেন। কিন্তু সব বিদ্যে সকলের বেলায় খাটে না এও জানবেন। মেজদি বরাবরই ভালমানুষ, কিন্তু আমি হলে আমাকেই সকলের ভয় করে চলতে হ’ত।

বিপ্রদাস বলিল, অর্থাৎ ভয়ে বাড়িসুদ্ধ লোকের গায়ের রক্ত জল হয়ে যেত। খুব আশ্চর্যি নয়। কারণ, একটা বেলার মধ্যেই নমুনা যা দেখিয়ে এসেচ তাতে বিশ্বাস করতেই প্রবৃত্তি হয়। অন্ততঃ, মা সহজে ভুলতে পারবেন না।

বন্দনা মনে মনে একটুখানি উত্তেজিত হইয়া উঠিল, কহিল, আপনার মা কি করেছেন জানেন? আমি প্রণাম করিতে গেলুম,—তিনি পেছিয়ে সরে গেলেন।

বিপ্রদাস কিছুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করিল না, কহিল, আমার মায়ের ঐটুকুমাএই দেখে এলে, আর কিছু দেখবার সুযোগ পেলে না। পেলে বুঝতে এই নিয়ে রাগ করে না খেয়ে আসার মত ভুল কিছু নেই।

বন্দনা বলিল, মানুষের আত্মসম্ভ্রম বলে ত একটা জিনিস আছে।

বিপ্রদাস একটু হাসিয়া কহিল, আত্মসম্ভ্রমের ধারণা পেলে কোথা থেকে? ইস্কুল-কলেজের মোটা মোটা বই পড়ে ত? কিন্তু মা ত ইংরিজী জানেন না, বইও পড়েন নি। তাঁর জানার সঙ্গে তোমার ধারণা মিলবে কি করে?

বন্দনা বলিল, কিন্তু আমি শুধু নিজের ধারণা নিয়েই চলতে পারি।

বিপ্রদাস কহিল, পারলে অনেক ক্ষেত্রে ভুল হয়, যেমন আজ তোমার হয়েছে। বিদেশের বই থেকে যা শিখেচ তাকেই একান্ত বলে মেনে নিয়েচ বলেই এমনি করে চলে আসতে পারলে। নইলে পারতে না। গুরুজনকে অকারণে অসম্মান করতে বাধত। আত্মমর্যাদা আর আত্মাভিমানের তফাত বুঝতে।

বন্দনা তফাত না বুঝুক, এটা বুঝিল যে তাহার আজিকার আচরণটা বিপ্রদাসের অন্তরে লাগিয়াছে। তাহার জন্য নয়, মায়ের অসম্মানের জন্য।

মিনিট দুই-তিন চুপ করিয়া থাকিয়া বন্দনা হঠাৎ প্রশ্ন করিল, মায়ের মত আপনি নিজেও খুব গোঁড়া হিন্দু, না?

বিপ্রদাস কহিল, হাঁ।

তেমনি ছোঁয়াছুঁয়ির বাচ-বিচার করে চলেন?

চলি।

প্রণাম করতে গেলে তাঁর মতই দূরে সরে যান?

যাই। সময়-অসময়ের হিসেব আমাদের মেনে চলতে হয়।

আমার মেজদিদিকেও বোধ করি এমনি অন্ধ বানিয়ে তুলেছেন?

সে তোমার দিদিকেই জিজ্ঞেসা করো। তবে, পারিবারিক নিয়ম তাঁকেও মেনে চলতে হয়।

বন্দনা হাসিয়া বলিল, অর্থাৎ বাঘের ভয় না করে কারও চলবার জো নেই।

বিপ্রদাসও হাসিয়া বলিল, না, জো নেই। যেমন দিনের গাড়িতে বাঘের ভয় থাকলে মানুষকে রাত্রের গাড়িতে যেতে হয়। ওটা প্রাণধর্মের স্বাভাবিক নিয়ম।

বন্দনা বলিল, দিদি মেয়েমানুষ, সহজেই দুর্বল, তাঁর ওপর সব নিয়মই খাটান যায়, কিন্তু দ্বিজুবাবুও ত শুনি পারিবারিক নিয়ম মেনে চলেন না, সে সম্বন্ধে বাঘমশায়ের অভিমতটা কি?

প্রশ্নটা খোঁচা দিবার জন্যই বন্দনা করিয়াছিল এবং বিদ্ধ করিবে বলিয়াই সে আশা করিয়াছিল, কিন্তু বিপ্রদাসের মুখের পরে কোন চিহ্নই প্রকাশ পাইল না; তেমনই হাসিয়া বলিল, এ-সকল গূঢ় তথ্য অধিকারী ব্যতিরেকে প্রকাশ করা নিষেধ।

দ্বিজুবাবু নিজে জানতে পাবেন ত?

বিপ্রদাস ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সময় হলেই পাবে। সে জানে রক্তমাংসে বাঘের পক্ষপাতিত্ব নেই।

মুহূর্তকালের জন্য বন্দনার মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। ইহার পরে সে যে কি প্রশ্ন করিবে ভাবিয়া পাইল না।

এই পরিবর্তন বিপ্রদাসের তীক্ষ্ণদৃষ্টিকে এড়াইল না।

পিতা ডাকিলেন, বুড়ি, আমাকে একটু জল দাও ত মা।

বন্দনা উঠিয়া গিয়া পিতাকে কুঁজা হইতে জল দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল। পুনশ্চ দ্বিজদাসের কথা পাড়িতে তাহার ভয় করিল। অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়া কহিল, মেজদির শাশুড়ীর জন্যে নয়, কিন্তু আমার না খেয়ে আসায় মেজদি যদি দুঃখ পেয়ে থাকেন ত আমিও দুঃখ পাব। আমি সেই কথাই এখন ভাবচি।

বিপ্রদাস কহিল, মেজদি কষ্ট পাবেন সেইটে হ’লো বড়, আর আমার মা যে লজ্জা পাবেন, বেদনাবোধ করবেন সেটা হ’লো তুচ্ছ। তার মানে, মানুষে আসল জিনিসটি না জানলে কত উলটো চিন্তাই না করে!

বন্দনা কহিল, একে উল্টো চিন্তা বলচেন কেন? বরঞ্চ এই ত স্বাভাবিক।

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। তাহার ক্ষুণ্ণ মুখের চেহারা বন্দনার চোখে পড়িল।

বাহিরে অন্ধকার করিয়া আসিতেছিল, কিছুই দেখা যায় না, তথাপি জানালার বাহিরে চাহিয়া বন্দনা বহুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। অন্যদিন এই সময়ে ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছায়, কিন্তু আজ এখনো দু-তিন ঘণ্টা দেরি। সে মুখ ফিরাইয়া দেখিল, বিপ্রদাস পকেট হইতে একটা ছোট খাতা বাহির করিয়া কি-সব লিখিয়া যাইতেছে। জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা মুখুয্যেমশাই, একটা কথার জবাব দেবেন?

কি কথা?

আপনি বলছিলেন আমাদের আত্মসম্ভ্রমবোধ শুধু ইস্কুল-কলেজের বই-পড়া ধারণা। কিন্তু আপনার মা ত ইস্কুল-কলেজে পড়েন নি, তাঁর ধারণা কোথাকার শিক্ষা?

বিপ্রদাস বিস্মিত হইল, কিন্তু কিছু বলিল না।

বন্দনা কহিল, তাঁর সম্বন্ধে কৌতূহল আমি মন থেকে সরাতে পারচি নে। তিনি গুরুজন, আমি অস্বীকার করিনে, কিন্তু সংসারে সেই কথাটাই কি সকল কথার বড়?

বিপ্রদাস পূর্ববৎ স্থির হইয়া রহিল।

বন্দনা বলিতে লাগিল, আজ আমরা ছিলুম তাঁর বাড়িতে অনাহূত অতিথি। এ ত আমার বই-পড়া বিদেশের শিক্ষা নয়? তবুও এ-সব কিছুই নয়,—শুধু বয়সে ছোট বলেই কি আমারই অপমানটা আপনারা অগ্রাহ্য করবেন?

এখনও বিপ্রদাস কিছুই বলিল না,—তেমনি নীরবে রহিল।

বন্দনা কহিল, তবুও তাঁর কাছে আমি ক্ষমা চাইচি। আমার আচরণের জন্যে দিদি যেন না দুঃখ পান। একটু থামিয়া বলিল, আমার বাপ-মা বিলেত গিয়েছিলেন বলে মেমসাহেব ছাড়া তাঁকে আর কিছু তিনি ভাবতেই পারেন না। শুনেচি, এই জন্যেই নাকি আজও মেজদির গঞ্জনার পরিসমাপ্তি ঘটেনি। তাঁর ধারণার সঙ্গে আমার ধারণা মিলবে না, তবু তাঁকে বলবেন, আমি যাই হই, অপমানটা অপমান ছাড়া আর কিছু নয়। দিদির শাশুড়ী করলেও না। বলিতে বলিতে তাহার চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল।

বিপ্রদাস ধীরে ধীরে বলিল, কিন্তু তিনি ত তোমাকে অপমান করেন নি!

বন্দনা জোর দিয়া বলিল, নিশ্চয় করেছেন।

বিপ্রদাস তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না, কয়েক মুহূর্ত নীরবে থাকিয়া কহিল, না, অপমান তোমাকে মা করেন নি। কিন্তু তিনি নিজে ছাড়া এ কথা তোমাকে কেউ বোঝাতে পারবে না। তর্ক করে নয়, তাঁর কাছে থেকে এ কথা বুঝতে হবে।

বন্দনা জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল।

বিপ্রদাস বলিতে লাগিল, একদিন বাবার সঙ্গে মার ঝগড়া হয়। কারণটা তুচ্ছ, কিন্তু হয়ে দাঁড়াল মস্ত বড়। তোমাকে সকল কথা বলা চলে না, কিন্তু সেই দিন বুঝেছিলাম আমার এই লেখাপড়া-না-জানা মায়ের আত্মমর্যাদাবোধ কত গভীর।

বন্দনা সহসা ফিরিয়া দেখিল, অপরিসীম মাতৃগর্বে বিপ্রদাসের সমস্ত মুখ যেন উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সে কিছুই না বলিয়া জানালার বাহিরেই চাহিয়া রহিল।

বিপ্রদাস বলিতে লাগিল, অনেকদিন পরে কি একটা কথার সূত্রে একদিন এই কথাই মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম— মা, এত বড় আত্মমর্যাদাবোধ তুমি পেয়েছিলে কোথায়?

বন্দনা মুখ না ফিরাইয়াই কহিল, কি বললেন তিনি?

বিপ্রদাস কহিল, জান বোধ হয় মায়ের আমি আপন ছেলে নই। তাঁর নিজের দুটি ছেলেমেয়ে আছে—দ্বিজু আর কল্যাণী। মা বললেন, তোদের তিনটিকে একসঙ্গে এক বিছানায় যিনি মানুষ করে তোলবার ভার দিয়েছিলেন, তিনিই এ বিদ্যে আমাকে দান করেছিলেন বাবা, অন্য কেউ নয়। সেই দিন থেকেই জানি মায়ের এই গভীর আত্মসম্মানবোধই কাউকে একটা দিনের জন্যে জানতে দেয়নি, তিনি আমার জননী নন, বিমাতা। বুঝতে পার এর অর্থ?

ক্ষণকাল নীরবে থাকিয়া পুনরায় সে বলিতে লাগিল, অভিবাদনের উত্তরে কে কতটুকু হাত তুললে, কতটুকু সরে দাঁড়াল, নমস্কারের প্রতি-নমস্কারে কে কতখানি মাথা নোয়ালে, এই নিয়ে মর্যাদার লড়াই সকল দেশেই আছে, অহঙ্কারের নেশার খোরাক তোমাদের পাঠ্যপুস্তকের পাতায় পাতায় পাবে, কিন্তু মা না হয়েও পরের ছেলের মা হয়ে যেদিন মা আমাদের বৃহৎ পরিবারে প্রবেশ করলেন, সেদিন আশ্রিত আত্মীয়-পরিজনদের গলায় গলায় বিষের থলি যেন উপচে উঠল। কিন্তু যে বস্তু দিয়ে তিনি সমস্ত বিষ অমৃত করে তুললেন, সে গৃহকর্ত্রীর অভিমান নয়, সে গৃহিণীপনার জবরদস্তি নয়, সে মায়ের স্বকীয় মর্যাদা। সে এত উঁচু যে তাকে কেউ লঙ্ঘন করতে পারলে না। কিন্তু এ তত্ত্ব আছে শুধু আমাদের দেশে। বিদেশীরা এ খবর ত জানে না, তারা খবরের কাগজের খবর দেখে বলে এদের দাসী, বলে অন্তঃপুরে শেকল-পরা বাঁদী। বাইরে থেকে হয়ত তাই দেখায়—দোষ তাদের দিইনে, কিন্তু বাড়ির দাসদাসীরও সেবার নীচে অন্নপূর্ণার রাজ্যেশ্বরী মূর্তি তাদের যদিও বা না চোখে পড়ে, তোমাদেরও কি পড়বে না?

বন্দনা অভিভূত-চক্ষে বিপ্রদাসের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।

ব্যারিস্টারসাহেব অকস্মাৎ জোর গলায় বলিয়া উঠিলেন, ট্রেন এতক্ষণে হাওড়া প্লাটফর্মে ইন্‌ করলে।

বন্দনার পিতার বোধ করি তন্দ্রা আসিয়াছিল, চমকিয়া চাহিয়া কহিলেন, বাঁচা গেল।

বন্দনা মৃদুকণ্ঠে চুপি চুপি বলিল, আমার কলকাতায় নামতে আর যেন ভাল লাগচে না, মুখুয্যেমশাই। ইচ্ছে হচ্ছে আপনার মার কাছে ফিরে যাই। গিয়ে বলি, মা, আমি ভাল করিনি, আমাকে মার্জনা করুন।

বিপ্রদাস শুধু হাসিল, কিছু বলিল না।

স্টেশনে নামিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কোথায় যাবেন?

রায়সাহেব বলিলেন, গ্র্যান্ড হোটেলেই ত বরাবর উঠি, তাদের তার করেও দিয়েছি—ঐখানেই উঠব।

এই লোকটির সুমুখে গ্র্যান্ড হোটেলের কথায় বন্দনার কেমন যেন আজ লজ্জা করিতে লাগিল।

পাঞ্জাবের ব্যারিস্টারসাহেব গাড়ির অত্যন্ত লেট হওয়ার প্রতি নিরতিশয় ক্রোধ প্রকাশ করিয়া বার বার জানাইতে লাগিলেন তাঁহাকে বি. এন. লাইনে যাইতে হইবে,—অতএব ওয়েটিং রুম ব্যতীত আজ আর গত্যন্তর নাই।

বিপ্রদাস নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া আছে, রায়সাহেব নিজেও একটুখানি যেন লজ্জিত হইয়াই কহিলেন, কিন্তু বিপ্রদাস, তুমি—তুমিও বোধ হয় আমাদের সঙ্গে—

গ্র্যান্ড হোটেলে? বলিয়াই বিপ্রদাস হাসিয়া ফেলিল, কহিল, আমার জন্যে চিন্তা নেই। বৌবাজারে দ্বিজুর একটা বাড়ি আছে, প্রায়ই আসতে হয়, লোকজন সবই আছে—আচ্ছা, আজ সেইখানেই কেন সকলে চলুন না?

বন্দনা পুলকিত হইয়া উঠিল—চলুন, সবাই সেইখানেই যাব। তাহার মাথার উপর হইতে যেন একটা বোঝা নামিয়া গেল। আনন্দের প্রাবল্যে অপর দুই সহযাত্রীকে সে-ই সাদরে আহ্বান করিয়া সবাই মিলিয়া মোটরে গিয়া উঠিল।