লম্বা দেহ। ছিপছিপে শরীর। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বাতাসের ভার সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু কাছে এসে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শুকনো শরীরের মাংসপেশীগুলো অত্যন্ত সবল এবং সজীব। ময়লা রঙের চামড়ার গায়ে সংবা লোমের অরণ্য। হাতে-পায়ে, বুকে এবং কণ্ঠনালীর সীমানা পর্যন্ত সে অরণ্যের বিস্তৃতি। রুক্ষ হাতের তালু। খসখসে। অগুনিত রেখায় ভরী। চোখজোড়া বড় বড়। মণির রঙ বাদামি। কিন্তু তার মধ্যে কোন মাধুর্য নেই। আছে এক তীক্ষ্ণ তীব্র জ্বালা! মণির চারপাশে যে সাদা অংশটুকু রয়েছে তার মাঝে ছিটেফোঁটা লাল ছড়ানো। কখনো সেটা বাড়ে। কখনো কমে। চোখের খুব কাছাকাছি ভ্রূ-জোড়ার অবস্থিতি। মোটা। মিশকালো। ধনুর মতো বাঁকা কিন্তু লম্বায় ছোট চলতে চলতে হঠাৎ যেন থেমে গেছে ওটা। সহসা দেখলে মনে হয়, সারা মুখে কোথাও কোন লাবণ্য নেই। কিন্তু সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে যাচাই করলে ধীরে ধীরে একটা অজ্ঞ সৌন্দর্য ধরা পড়ে। যার সঙ্গে আর কারো তুলনা করা যেতে পারে না। মাঝারি নাক। মাংসল। আর ঠিক নাকের মাঝখানটায় একটা কাটা দাগ। চওড়া কপাল বয়সের সঙ্গে তাল রেখে সামনের অনেকখানি চুল ঝরে পড়ায় সেটাকে আরো প্রশস্ত দেখায়। মুখের গড়নটা ডিম্বাকৃক্তি পুরু ঠোঁট জামের মুতো কালো। তেমনি মসৃণ আর তেলতেলে। যখন ও হাসে, তখন মুক্তোর মতো দাঁতগুলো ঝলমল করে উঠে। চিবুকের হাড়জোড় সুস্পষ্টভাবে উঁচু আর তার নিচের অংশটুকু হঠাৎ যেন একটা খাদের মধ্যে নেমে গেছে। খাদের শেষ প্রান্তে একটা বড় তিল। মার্থাভরা একরাশ ঘন চুল। অমসৃণ এবং অনাদৃত। রাস্তায় বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকালো শওকত? একখানা যাত্রীবাহী বিমান প্রচণ্ড শব্দ করে উড়ে চলেছে পোতাশ্রয়ের দিকে। এক্ষুণি নামবে। তার মা বিলীন হয়ে যাওয়ার আগেই কে যেন পাশ থেকে ডাকলো। বাড়ি যাবেন নাকি?
শওকত চেয়ে দেখলো, মার্থা গ্রাহাম!
মার্থা একটা রিক্সায় বসে। শওকতকে দেখে ওটা ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়েছে সে। ওর হাতে একটা পাউরুটি আর ছোট একটা চায়ের পাকেট।
মার্থা ডাকলো, ব্যাপার কি, এই রাস্তার ওপরে একঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাসায় যাবেন শা, আসুন।
শওকত সহসা হেসে উঠলো। আশ্চর্য!
কি?
মনে হচ্ছে আমাকে বাসায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে রোজ আপনি এখানে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
লজ্জায় মার্থার কালো মুখখানা বেগুনি হয়ে গেলো। কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো, আমিও কিন্তু এর উল্টোটি বলতে পারতাম। কিন্তু বলবো না। তাহলে আপনি রাগ করবেন। মার্থার গলার স্বরে কোথায় যেন এক টুকরো ব্যথা ঈষৎ উঁকি দিয়ে গেলো।
শওকত ততক্ষণে উঠে বসেছে রিক্সায়।
গলির মোড়ে কামারের দোকানের সামনে কয়েকটা লম্বা টুলের ওপরে যারা হাত-পা ছড়িয়ে বসেছিলো, তারা দেখলো। আজও একখানা রিক্সা থেকে নামলো আধা আর শওকত।
আড়চোখে একবার ওদের দিকে তাকালো শওকত। ওরা দেখছে। ইশারায় দেখাচ্ছে অন্যদের। যাক, ভালোই হলো। আজ রাতটার জন্যেও কিছু মুখরোচক খোরাক পেলো ওরা। তাসের আড়া কথার কাকলিতে ভরে উঠবে। উষ্ণ চায়ের লিকার আর নয়া পয়সায় কেলা নোনতা বিস্কিটের সঙ্গে জমবে ভালো। মার্থা গ্রাহামকে নিয়ে অনেক রাত পর্যন্তু গল্প করবে ওরা।
কিন্তু কেন? আমি তো ওদের সাতপাঁচে থাকিনে? আমি তো সেই সকালে কাজে বেরিয়ে যাই, আবার রাতে ফিরি। আমি তো কাউকে নিয়ে মার্থা ঘামাইনে! কারো পাকা ধানে মই দেইনে। তবু কেন ওরা আমাকে নিয়ে অত হল্লা করে?
বলতে গিয়ে ওর নিকৃষ্ট কালো চোখের মণি জোড়ায় দুফোঁটা পানি ছলছল করে উঠেছিলো। সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে শওকতের দিকে তাকিয়েছিলো মার্থা গ্রাহাম।
সহসা কোন উত্তর দিতে পারে নি শওকত। ওর শুধু বুড়ো আহমদ হোসেনের কথা বার বার মনে পড়ছিলো। মার্থা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে একদিন বলেছিলো, ওটা একটা রোগ। ওটাও এক রকমের ক্ষুধা, বুঝলে? আজ পনেরো বছর ধরে এই শহরের অলিতে গলিতে পইপই করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ওদের খুব ভালো করে চেনা আছে আমার। বাদামতলীর ঘাট বলো, ছক্কু মিয়ার চা-খানা কিম্বা খান সাহেবের কাফে হংকং বলল আর তোমাদের ওই বিলেতি ঢঙের যত দিশি ক্লাব সব ব্যাটার ধর্ম এক, বুঝলে। সবাই এক রোগে ভুগছে, এক ক্ষুধায় জ্বলছে। শোন, কাছে এসো, কানে কানে একটা মোক্ষম কথা বলে রাখি তোমায়, বয়সকালে কাজে দেবে। শোন, কোনদিন যদি কোনখানে কোন ছেলে কিম্বা বুড়োকে দেখো কোন মেয়ের নামে বদনাম রটাচ্ছে, তাহলে জানবে এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন কিন্তু রয়েছে। বলতে গিয়ে বিকট শব্দে হেসে উঠেছিলো বুড়ো আহমদ হোসেন। দাড়ির জঙ্গলে আঙুলের চিরুনি বুলিয়ে নিয়ে পরক্ষণে আবার বলেছিলো। সেই ছেলে কিম্বা বুড়ো বুঝলে? তারা যদি কোনদিন একান্ত নিরালায় সে মেয়েটিকে হঠাৎ কাছে পেয়ে যায়, তাহলে কিন্তু জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে তার পায়ের গোড়ালি জোড়ায় ব্যথা ধরিয়ে দেবে। গুলতানী নয় বাবা, নিজ চোখে দেখা সব। এই শহরের কোন্ বুড়ো কোন্ মেয়েকে নিয়ে কোন রেস্তোরাঁয় যায় আর কোন মাঠে হাওয়া খায়, সব জানা আছে আমার। বলতে গিয়ে একরাশ থুথু ছিটিয়েছে আহমদ হোসেন।
মার্থাকে নিয়ে রিক্সা থেকে নামলো শওকত। পকেটে হাত দিতে যেতে মার্থা থামিয়ে দিয়ে বললো। দাঁড়ান, আমি দিচ্ছি।
বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছোট্ট ব্যাগটা থেকে কয়েক আনা খুচরা পয়সা বের করলো মার্থা। সামনের লাল রকটার ওপরে একটা কুষ্ঠ রোগী কবে এসে ঠাঁই নিয়েছে কেউ জানে না। হাত পায়ের নখগুলো তার ঝরে গেছে অনেক আগে। সারা গায়ে দগদগে ঘা। চোয়াল। জোড়া ফুটো হয়ে সরে গেছে ভেতরে। আর সেই ছিদ্র বেয়ে লাবাস্রোত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। কাঁধে। বুকে। উরুতে। চারপাশে অসংখ্য মাছির বাসা। ভনভন করে উড়ছে। বসছে। আবার উড়ছে।
রিক্সা বিদায় দিয়ে মার্থা আর শওকত ভেতরে এলো। দেড় হাত চওড়া অপরিসর বারান্দার মুখে কে যেন একটা কয়লার চুলো জ্বালিয়ে রেখেছে। তার ধুয়োয় চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। স্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ওদের। সহসা দুজন মহিলা দুপাশের করিডোর থেকে বেরিয়ে চিৎকার করতে করতে উঠোনের দিকে এগিয়ে গেলো।
আরে, মেরে ফেললো তো।
ক্যায়া হুঁয়া?
কি অইছে আঁ?
মার, মার। মার না।
আরে ছাড়, ছেড়ে দে বলছি, নইলে মেরে হাড্ডি মাংস গুঁড়ো করে দেবো বলে দিলাম।
আরে আয়ি বড়ি মারনে ওয়ালী।
ত্রিকোণ উঠোনোর মাঝখানে মহিলারা প্রচণ্ড কলহে মেতে উঠেছে। এ ওর চুল ধরে টানছে। এ ওর পিঠের ওপর একটানা কিল-ঘুষি মারছে।
দুটো নেড়ি কুত্তা ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে বার বার লাফাচ্ছে আর ঘেউ ঘেউ করছে।
মাওলানা সাহেব বারান্দায় নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ থামিয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন। জাহান্নামে যাবে সব। হাবিয়া দোজখে যাবে।
এর চেয়ে বড় দোজখ আর কোথাও আছে নাকি? কে যেন জবাব দিলো জটলার ভেতর থেকে। বাইরের এই হট্টগোল শুনে মাওলানা সাহেবের তৃতীয় স্ত্রী পর্দার আড়াল থেকে মুখ বের করে তাকিয়েছিলো। সেদিকে চোখ পড়তে মাওলানা সাহেব গর্জে উঠলেন। তু ক্যায়া দেখতি হ্যায় আঁ? আন্দার যা।
মেয়েটি সভয়ে পর্দার নিচে আত্মগোপন করলো। উঠোনের কোলাহল চরমে উঠেছে।
মার্থা এক নজর তাকালো শওকতের দিকে। তারপর আরো দুটো সরু করিডোর পেরিয়ে আরো অনেক দরজা পেছনে ফেলে ঘরে এসে ভেতর থেকে খিল এঁটে দিলো সে।
শওকত এগিয়ে গেলো সিঁড়ির দিকে।
জায়গাটা একেবারে অন্ধকার। আলো থেকে এলে পাশের মানুষটাকেও ভালো করে দেখা যায় না। পকেট থেকে একটা দিয়াশলাই বের করে জ্বালালো সে, আর তার আলোতে যেন ভূত দেখলো শওকত। সিঁড়ির নিচে জড়ো করে রাখা একগাদা আবর্জনার মাঝখানে জুয়াড়িদের একজন লোক খলিল মিস্ত্রীর বউকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রয়েছে। অভাবিত আলোর স্পর্শে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো ওরা। তারপর ছুটে পালিয়ে গেলো দুজন দুদিকে।
বুড়ো আহমদ হোসেন আজ এখানে থাকলে হয়তো পকেট থেকে হিসেবের খাতাটা বের করে তাতে আরো একটা নাম যোগ করতো আর বলতো এ আর এমন কি দেখলে ভায়া। শোন, এক সাহেবের গল্প বলি। ব্যাটা দিশি সাহেব। বিলিতি নয়। সেই সাত বছর আগের কথা বলছি, তখন পঞ্চাশের ঘরে বয়স ছিলো ওর। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। তাদের ঘরে নাতি-পুতিও হয়েছে। একদিন এক স্বদেশী মদের দোকানে বিদেশী মদ খেতে খেতে ব্যাটা বললে, দেখো আহমেদ, আমরা কি রোজ এক রেস্তোরাঁয় বসে খানা খাই? মোটেই না। আজ কাফে হংকংয়ে। কাল লা-শানীতে। পার কসবায়। রোজ মুখের স্বাদ পাল্টাচ্ছে। খাবারের ঘ্রাণ বদলে যাচ্ছে। সেখানেই তো আনন্দ। তুমি কি মনে করো মানুষ কি চিরকাল এক রকম খাবার খেয়ে সুখে থাকতে পারে?
এখানে এসে একবার থামবে বুড়ো আহমদ হোসেন। বার্ধক্যের চাপে কুঞ্চিত চোখজোড়া আরো ছোট করে এনে, দাঁড়িয়ে অরণ্যে এক বন্য হাসি ছড়িয়ে সে আবার বলবে। ওর কথার গূঢ় অর্থ কিছু বুঝলে? আরে ভায়া, চোর যে চুরি করে, তারও একটা দর্শন আছে। খুনি যে খুন করে সেও জানে বিনা কারণে সে খুন করে নি। হাতের কাঠিটা মাটিতে পড়ে যেতে আবার অন্ধকার ঘনিয়ে এলো চারপাশে। আর আলো জ্বালতে সাহস পেলো না শওকত। দিয়াশলাইটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলো সে। বারান্দায় পাটি পেতে বসে আজমল আলীর বুড়ো মা নাতি-পুতিদের ডালিম কুমারের গল্প বলছে।
তারপর ডালিম কুমার সাদা ধবধবে একটা ঘোড়ায় চড়ে, ছুটছে তো, ছুটছে তো ছুটছে। হঠাৎ সামনে পড়লো একটা বিরাট নদী। আর তার মধ্যে ইয়া বড় বড় ঢেউ। দেখে তো ডালিম কুমার মহাভাবনায় পড়ে গেলো।
আরো দুটো সরু বারান্দা পেছনে ফেলে নিজের ঘরে এসে ঢুকলো শওকত। তারপর একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ্ করে বসে পড়লো।