না। আর চলে না। এভাবে আর আমি পারছি না মার্থা। শওকতের গলার স্বর ভারি হয়ে এলো। ভাবছি কোথাও চলে যাব।

কোথায়?

কোথায় জানি না। উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলো শওকত। কোন মফঃস্বল শহরে গেলে হয়তো কিছু জুটে যাবে।

মার্থা স্নান হাসলো। ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আস্তে করে বললো। অমন স্বার্থপরের মতো চিন্তা করো কেন?

এতে আবার স্বার্থপরের কি হলো? সুরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলো শওকত।

না, তেমন কিছু হয় নি। মুখখাঁনা জানালার দিকে নিয়ে বাইরে তাকালো মার্থা। জাহানারাদের ঘরটা ওখান থেকে দেখা যায়। সে রাতের ঘটনার পরে জাহানারাকে ঘরের ভেতরে বন্ধ করে রেখেছে ওর মা। একদিন এক মিনিটের জন্যেও মেয়েটাকে বাইরে বেরুতে দেয় নি।

ওকে চুপ থাকতে দেখে শওকত পেছন থেকে আবার বললো, স্বার্থপর কেন বললে?

মার্থা বাইরে তাকিয়ে থেকে বললো, বললাম তো এমনি। কেন, তোমার কি খুব লেগেছে? জানালার কাছ থেকে সরে এলো সে। ওর গলার স্বরে ঈষৎ ঝাজ।

শওকত বললো, তোমাকে বললে তোমারও লাগতো। ওর গলার স্বরে ঈষৎ গাম্ভীর্য। দুজনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো ওরা। নিচের নাচিয়ের দল জোরে গ্রামোফোন বাজাচ্ছে আর হল্লা করছে। মাঝে মাঝে কি যেন কৌতুকে শব্দ করে হেসে উঠছে ওরা।

সহসা, মার্থা বললো, ওরা বেশ আছে। বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠলো ওর।

শওকত নড়েচড়ে বসলো। মনে হলো যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। ছোট্ট করে বললো, হুঁ।

মার্থা জানালার পাশ থেকে মুখ ঘুরিয়ে একবার দেখলো তাকে, তারপর আবার বাইরে মুখখানা ফিরিয়ে নিলো সে। মোহসিন মোল্লার বউ তার ছমাসের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে আর কি একটা ছড়া কাটছে গুন্ গুন্ করে। সে দিকে চেয়ে থেকে মার্থা বললে, আমারো আর কিছু ভালো লাগছে না। ভাবছি কোথাও চলে যাবো।

যেতে ইচ্ছে হলে যাও না। আমি কি তোমাকে ধরে রেখেছি নাকি। আমাকে ওসব কথা শুনাচ্ছো কেন? শওকতের কণ্ঠস্বরে বিরক্তির আমেজ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ঘরময় পায়চারি শুরু করে দিলো সে। নাকি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো, তুমি চলে গেলে আমি খাবো কোথায়? চলব কেমন করে।

আমি কি সে কথা বলেছি তোমায়? শওকত নিজেও ভাবতে পারেনি মার্থা অত জোরে চিৎকার করে উঠবে। ওর চোখে দুফোঁটা পানি টলমল করছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। রাগে কিম্বা অভিমানে। দুনিয়াতে শুধু নিজের দিকটাকেই বড় করে দেখতে শিখেছো, অন্যের কথা একটুও ভাবো না।

বাইরে বারান্দায় দুএকজন উৎসাহী শ্রেতার ভিড় জমতে দেখে শওকত চাপা গলায় বললো, চিৎকার করছো কেন, আস্তে কথা বলা যায় না?

টপ করে একটা ফোঁটা মাটিতে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে মুখখানা ওর দিকে থেকে আড়াল করে নিলো মার্থা। হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো সে, তারপর অত্যন্ত মৃদুগলায় বললো, চলি। বলে আর সেখানে অপেক্ষা করলো না সে।

টেবিলের ওপরে রাখা হ্যারিকেনের হলদে সলতেটার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলো শওকত। নিচে কুকুর দুটো সেই কখন থেকে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। এখনো থামেনি। বারান্দায় যারা কান পেতে ছিলো, তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেছে ঘরে। বউ-মারা কেরানির বউটা মার খেয়ে কাঁদছে।

অস্থিরভাবে অনেকক্ষণ ঘরময় পায়চারি করলো শওকত। কিছুই ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে দুটো ইট খুলে নিয়ে কুকুর দুটোর মার্থা লক্ষ্য করে মেরে ওদের চিরদিনের জন্যে চুপ করিয়ে দিতে। কিম্বা, বউ-মারা কেরানির বউটির গলা টিপে ধরে বলতে, চুপ করো। না, তাও নয়। ইচ্ছে করছে বুড়ো আহমদ হোসেনের কাছে ছুটে গিয়ে বলতে, কোথায় নিয়ে যাবে বলছিলে আমায়। নিয়ে চলো। হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হ্যারিকেনটা তুলে নিলো শওকত। তারপর অকস্মাৎ ওটাকে মেঝের ওপরে ছুঁড়ে মারলো সে। ঝন্‌ ঝন্ শব্দে হ্যারিকেনের কাঁচটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।

শব্দটা বেশ ভালো লাগলো শওকতের।

চারপাশে গাঢ় অন্ধকার।

মনে হলো যেন সতের বছর আগে ফিরে গেছে শওকত–সারা কোলকাতা অন্ধকার ব্ল্যাক আউট। খিদিরপুরের ডকে একটা আলোও জ্বলছে না।

মাটির নিচে অন্ধকার সেন্টারের মধ্যে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে সে। শুধু সে নয়। আরো অনেকে। ছেলে বুড়ো মেয়ের গাদাগাদি। একটা প্লেনের শব্দ হলো। দুটো। তিনটে। অনেকগুলো প্লেন ঝাঁক বেঁধে উড়ে গেলো মার্থার ওপর দিয়ে। পর পর কয়েকটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গেলো ওর।

উপর থেকে কিছু মাটি ধসে পলো নিচে। গায়ের ওপরে। পাশের বুড়োটা চিৎকার করে উঠলো। ইয়া আল্লাহ।

একটা ছেলে একটা যুবতী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পড়ে আছে চুপচাপ, হয়তো শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে। একজন মা তার বাচ্চাটাকে সজোরে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখেছে। দাঁতে দাঁত লেগেছে। ওর একটা ছোট ছেলে সভয়ে তাকাচ্ছে চারদিকে।

বাইরে তখন জাপানিরা বোমা ফেলছে।

কতক্ষণ মনে নেই। অনেকক্ষণ হবে হয়তো। ধীরে ধীরে সব শান্ত হয়ে গেলো। একটি অস্থির নীরবতা। তারপর আবার সাইরে বেজে উঠলো। প্রথমে একটা। তারপর, অনেকগুলো একসঙ্গে।

মাটির গুহা থেকে একে-একে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। তখনো অন্ধকার। আর ধুঁয়ো। মাথায় লোহার টুপি পরা এ-আর-পির লোকগুলো ছুটোছুটি করছে চারপাশে। ওদের হাতে টর্চ, পায়ে বুটজুতো।

অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে পায়ের সঙ্গে কী যেন লাগছে ওর। ঝুঁকে পড়ে ভালো করে দেখলো শওকত। একটি মেয়ে। হ্যাঁ, ষােলো-সতেরো বছরের যে মেয়েটা সারাদিন ডকে ভিক্ষে করে বেড়াতো-সে। নরম বুকটা রক্তে ভিজে আরো নরম হয়ে গেছে। না। বেঁচে নেই? অনেকক্ষণ আগেই মরে গেছে।

শওকতের মনে হলো, বুক-উঁচু ধানক্ষেতের মাঝখানে শুয়ে-থাকা মেয়ে আমেনা। না আমেনা নয়, ভিখারিনি মেয়ে সকিনা।

সকিনাও নয়। মার্থা।

অন্ধকারে একটা দীর্ঘ ছায়ার মতো দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মার্থা।

মার্থা বললো, বেহায়ার মতো আবার এলাম। শওকতের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ইতস্তত চারপাশে তাকালো সে। বাতি কী হলো?

আমি নিভিয়ে দিয়েছি। আস্তে করে জবাব দিলো শওকত। ভেতরে এসো না, কাচে পা কাটবে। শেষের কথাটা বিশেষ জোরের সঙ্গে বললো সে।

মার্থা একবার মেঝের দিকে তাকালো। কিছু দেখতে পেলো না। তারপর মৃদু গলায় বললো ভতরে আমি আসবো না। ভয় নেই। তোমাকে একটা কথা জানাতে এসেছিলাম। কাল বিকেলে একবার দোকানে এসো। যে-লোকটাকে তোমার চাকরির কথা বলেছিলাম সে আসবে। ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো তোমার। কথাটা শেষ করে আর সেখানে দাঁড়ালো না মার্থা। উত্তরের অপেক্ষা করলো না। খোলা দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো সে।

না। মার্থাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছে।

কিছুই ভালো লাগছে না ওর।

রাত এখন কটা বাজে কে জানে। কুকুরগুলো এখন আর চিৎকার করছে না। বউ-মারা কেরানির বউ কান্না থামিয়ে চুপ করে আছে। হয়তো ঘুমুচ্ছে সে। কিম্বা মাতাল স্বামীর সেবা করছে। সারা বাড়িতে কেমন একটা ভয়াবহ নির্জনতা। যেন মানুষজন কেউ নেই।

হঠাৎ নিজেকে বড় একা মনে হলো ওর। মনে হলো এই অন্ধকার-ঘরে একা থাকতে ভয় লাগছে আজ। বন্ধ-দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো শওকত। সারাবাড়িতে গোরস্তানের নীরবতা আর কবরের মতো অন্ধকার। বাড়ির বিড়ালটাও আজ ঘুমুচ্ছে। একবারও তার ডাক শোনা যাচ্ছে না।

সিঁড়ির প্রত্যেকটা ধাপ গুণে গুণে নিচে নেমে এলো সে। সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছে। হাত দিয়ে পাশের দেয়ালটাকে একবার পরখ করে নিলো। ঠিক আছে। ধীরে ধীরে মার্থার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো শওকত।

আস্তে করে একটা টোকা দিলে দরজায়।

কোনো সাড়া নেই।

আরেকটা দিলো। এবার একটু জোরে।

ভেতরে নড়াচড়ার শব্দ হলো। কে! মার্থার গলার স্বর।

শওকত সঙ্গে সঙ্গে বললো, আমি মার্থা! আমি। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুলো না ওর। শুধু একটা মৃতি ক্ষীণ ধ্বনি বাতাসে ঈষৎ কাঁপন জাগিয়ে মিলিয়ে গেলো।

মার্থা তার ঘরে বাতি জ্বালালো।

দিয়াশলাই-এর কাঠির শব্দটাও কান পেতে শুনলো শওকত। ধীরে ধীরে ভেতর থেকে দরজাটা খুললো সে। হাতে ওর একটা মোমবাতি।

শওকতকে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো মার্থা। বিস্ময়ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলো সে। কিন্তু বলতে পারলো না। শওকত ওর হাতের মোমটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলো। তারপর মুহূর্তে মার্থাকে দু-হাতে বুকের মধ্যে টেনে নিলো সে। শক্ত কাঠের মতো একটা দেই। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো মার্থা পারলো না। ওর শুকনো ঠোঁটে একটা তীব্র চুম্বন এঁকে দিলো শওকত। আরেকটা। আরো একটা।

না। জোর করে এর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলো মার্থা। তারপর ছুটে গিয়ে বিছানায় পড়লো। বালিশে মুখ গুজে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। মার্থা কাঁদছে।

অসহায়ভাবে একবার বিছানার দিকে তাকালো শওকত। মার্থাকে এভাবে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি সে। কী করবে ভেবে পেলো না। একটু পরে শওকত অনুভব করলো ওর হাত-পা ভীষণভাবে কাঁপাচ্ছে। আর হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে ধুকধুক শব্দ করছে। হঠাৎ শওকতের মনে হলো মার্থার কাঁদার শব্দে যদি বাড়ির সবাই জেগে গিয়ে এদিকে আসে তাহলে? না। মার্থার এভাবে ডুকরে কান্নার কোনো কারণ খুঁজে পেলো না শওকত যেন কেউ মারা গেছে ওর। মার্থা বিলাপ করছে। শওকত সভয়ে তাকালো চারদিকে। তারপর ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।

অন্ধকার, একহাত দূরে কী আছে বোঝা যায় না। পুরো বাড়িটা তমিস্রায় ঢেকে আছে। একটা ইঁদুর কিচকিচ শব্দ তুলে পায়ের ওপর দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। ভয় থমকে দাঁড়ালো সে। নিজের নিশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়া পর শওকতের মনে হলো-আশেপাশের দেয়ালগুলো যেন দেখতে পাচ্ছে সে। এ দিকে আলো বাড়ছে। শওকত অবাক হলো, সিঁড়ির দিকে না গিয়ে পথ ভুল করে উঠানে চলে এসেছে সে। এবার রীতিমতো ভয় করতে লাগলো ওর। হাত-পাগুলো অস্বাভাবিকভাবে কাপছে। পথ হাতড়ে আবার সিঁড়ির দিকে ফিরে এলো শওকত

কোথায় একটা বাচ্চাছেলে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে গিয়ে ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কাঁদছে। মা ছড়া কেটে শান্ত করার চেষ্টা করছে তাকে। ঘরে ফিরে এসে দরজায় খিল এই দিলো কত। সারা গা বেয়ে ঘাম শুরছে ওর। যেন একটা প্রচণ্ড জ্বর এসে গায়ে এইমাত্র ছেড়ে গেলো। দূরজায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। গলার নিচে ধুকধুক শব্দটা কমেছে। শাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ওর। কললি থেকে এক গ্লাস পানি চলে ঢকঢক করে সবটা খেয়ে নিলো শওকত।

পরদি যখন ঘুম ভাঙলো, তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। আড়মোড়া দিয়ে পাশ ফিরে শুলো সে! চোখ খুললো। মেঝেতে অনেকগুলো কাঁচের টুকরো ছড়ান। দিনের আলোয় চিকচিক করছে। আবার চোখ বন্ধু করলো লওকত। সারাদেহে কী এক আলস্য। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। শুয়ে শুয়ে কাল রাতের কথা ভাবলো সে। আর তক্ষুণি মার্থার কথা মনে পড়লো ওর। মনে পড়লো রাতে ওর ঘরে যাওয়ার কথা। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো শওকত। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলো। দালানের মার্থার ওপর দিয়ে কড়া রোদ এলে পড়েছে উঠোনে। এত বেলা পর্যন্ত এর আগে কোনোদিন বিছানায় শুয়ে থাকেনি সে। মার্থা কি এসেছিলো সকালে? হয়তো এসেছিলো। ওর কোনো সাড়াশব্দ না-পেয়ে ফিরে গেছে। কিন্তু দরজায় ধাক্কা দিলে নিশ্চয় জেগে যেতো শওকত? না, মার্থা আসেনি। কাল রাতের সে ঘটনার পর হয়তো মনে মনে ওকে ঘৃণা করছে মার্থা।

মার্থা আর আসবে না।

ভাবতে গিয়ে বুকের নিচে একটা চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো সে।

নাচিয়ে দলের মেজো সেলিনা কলওলায়া চান করছে। একটা তোয়েলে দিয়ে মুখ রগড়াচ্ছে মেয়েটা। শূন্যদৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে রইলো শওকত। ওর দিকে চোখ পড়তে লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি নগ্ন পা-জোড়া ভেজা কাপড়ে ঢেকে দিলো সেলিনা। শওকতের কোনো ভাবন্তর হলো না। মেয়েটা আড়চোখে আবার তাকালো। মৃদু হাসলো সে।

বারান্দা থেকে সরে গ্লোবার ঘরে এলো শওকত। কি করবে বুঝতে পারচ্ছে না। খিধে পেয়েছে ভীষণ। কিছু খাওয়া দরকার। মগে করে পানি এনে বারান্দায় মুখ ধুতে বসলো সে।

আজমল আলীর ঘরের সামনে লোকজনের ভিড়। দেশের বাড়ি থেকে কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন এসেছে। হারুনের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে ওরা। না। জাহানারার সঙ্গে নয়। আজমল আলীর নিজের বোনঝির সঙ্গে। স্কুলে পড়ে মেয়েটা। বিষয়-সম্পত্তি আছে।

হাতমুখ মুছে কাপড় পালটালো শওকত। প্ৰরময় কাচের টুকরোগুলো এখনো ছড়িয়ে রয়েছে। শাক। জাহান্নামে যাক সব। বাইরে বেরুবার পথে ভাঙা হ্যারিকেনটাকে অকারণে একটা লাথি মেরে ঘরের কোণে সরিয়ে দিয়ে গেলো সে।

মার্থার ঘরের দরজায় একটা তালা ঝুলছে। ভোরে-ভোরে বেরিয়ে গেছে সে। জাহান্নামে যাক মার্থা। আপনমনে বিড়বিড় করে উঠলো শওকত।

বাহার যা রাহে ক্যায়া? পেছনে মিহি কষ্ঠের আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো সে।

নাচিয়ে দলের মেয়ে সেলিনা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একখানা তোয়ালে দিয়ে মার্থার চুল ঝাড়ছে। সামনে পড়ে থাকা একরাশ ঘন কালো কুস্তল পিঠের ওপর সরিয়ে দিয়ে মেয়েটি আবার বললো, বাহার যা রাহে কায়া।

শওকত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এ প্রশ্ন হঠাৎ কেন, বুঝতে পারলো না সে। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ! তামাটে চোখ। গাঢ় বাদামি ধর। মার্থার চেয়ে দেখতে অনেক বেশি সুন্দর সেলিনা। অনেক বেশি জীবন্ত।

কায়া দেখ রাঁহে। মুখ টিপে পরিমিত হাসালো মেয়েটি। আকারণে লজ্জায় রাঙা হয়ে তাড়াতাড়ি বুকের কাপড়টা টানতে গিয়ে আরো একটু সরিয়ে দিলো।

শওকত আস্থে করে বললো, কিছু না। বলে যাবার জন্যে পা বাড়ালো সে! কোথায় যাচ্ছেন বললেন না। এবার উর্দুতে নয়, বাংলায় প্রশ্ন করলো মেয়েটি।

শওকত ঘুড়ে দাঁড়িয়ে বললো, বাইরে যাচ্ছি, কাজে। কেন, কিছু বলবেন নাকি?

হ্যাঁ।

বলুন।

ভেতরে আসুন, বলছি। অপূর্ব ভঙ্গিতে জোড়া বাঁকালো মেয়েটি। ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি।

ইতস্তত করে ভেতরে এলে শওকত। আমার একটু তাড়া আছে। কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন।

বলছি। অমন অধীর হচ্ছেন কেন, বসুন। চুলগুলো ধীরে ধীরে খোঁপাবদ্ধ করলো মেয়েটি।

ছোট্ট ঘর। প্রায় শূন্য। একটা চৌকি। এলোমেলো বিছানা। তাকে কতকগুলো শিশি-বোতল জড়ো করার একটা ভাঙা আয়না। চিরুনি। কোণায় দড়ির ওপরে কতগুলো ময়লা কাপড়। পুরানো একটা ট্রাঙ্ক। চিত্রতারকাদের ছবিতে ভরা কয়েকটা ক্যালেঞ্জার।

কাল রাতে নিয়ে এসেছিলেন কেন? দেহটা ভেঙে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটি; সারা ও তার দুষ্টমি-ভরা হাসি।

শওকতের মাথায় যেন বাজ পড়লো। ইতস্তত করে বললো, তার মানে?

কাল রাতে নিচে এসেছিলেন কেন? প্রত্যেকটা কথার ওপর জোর দিয়ে টেনে-টেনে প্রশ্ন করলো মেয়েটি।

অবাক হয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো শওকত। তারপর দৃঢ় গলায় বললো, আপনি কি বলতে চান?

আমি কি বলতে চাই। অপূর্ব গ্ৰীবাভঙ্গি করলে সেলিনা। বাঁকা চোখে ওর দিকে একটু তাকিয়ে অকারণে রাঙা হলো সে। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠে বললো, আমি বলতে চাই কাল রাতে আপনি নিচে এসেছিলেন?

হ্যাঁ, এসেছিলাম।

মার্থার ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন।

হ্যাঁ, দাঁড়িয়েছিলাম।

ওর ঘরের দরজায় টোকা দিয়েছিলেন। দু-বার।

হ্যাঁ, দিয়েছিলাম।

মার্থার হাতে মোমবাতি ছিলো। ফুঁ দিয়ে সেটা নিভিয়ে দিয়েছিলেন।

শওকতের গলা দিয়ে আর কথা সরলো না। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো সে। একটা ডাইনি। একটা পিশাচ। শওকতের মানে হলো ওর কলজেটা গলার কাছে এসে আবার ধুকধুক শুরু করে দিয়েছি।

কি, চুপ করে গেলেন যে! বাদামি অধর-জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো সে। গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত স্বর বের করে বললো, জাহানারার মত ইচ্ছে করলে আপনাকে ধরিয়ে দিতে পারতাম। দিইনি, মায়া হয়েছিলো তাই।

শওকতের মনে হল ওর স্নায়ুগুলো যেন ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। পা-ক্রোড় ভীষণ ভারী হয়ে গেছে। নাড়তে পারছে না।

সেলিনা ওর হাতের তোয়ালেটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, নিন, বড় বেশি ঘামাচ্ছেন! মুছে নিন, আবার শক্ত করে হেসে উঠলো সে। আমি বাইরে বেরুবো। বসন, কাপড়টা পালটে নিই। বলে দরজার সামনে থেকে ঘরের কোণে যেখানে একটা দড়ির ওপরে অনেকগুলো ময়লা কাপড় ঝোলানো সেদিকে এগিয়ে গেলো সে। যেতে যেতে বললো, এদিকে তাকাবেন না কিন্তু।

শওকতের সবকিছু তাগোল পাকিয়ে গেছে। ভাবনার গ্রন্থিগুলো যেন সব ছিঁড়ে গেছে ওর। তবু ভাবতে চেষ্টা করলো সে। এখন কী করবে। পেছালে সেলিনার কাপড় পালটানোর খসখস শব্দ।

সহসা শওকত বললো, রাতে ঘুমোন না নাকি?

ঘুম। বিচিত্র এক ধ্বনি বেরুল মেয়েটির কণ্ঠে। ঘুম আমার আসে না।

কেন?

দরজায় খিল এঁটে ঘুমোতে পারি না বলে। সেলিনা আবার খিলখিল হেসে উঠলো। কাঁচা হলুদ মাংসের দেহটা হরিদ্রা শাড়িতে পেঁচিয়ে নিয়ে শওকতের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। আরো বসতে ইচ্ছে করছে বুঝি?

শওকত সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতে গিয়ে মার্থাটা ঝিমঝিম করে উঠলো ওর। করিডোরে কয়েকটা বাচ্চাছেলে মাটির পুতুল নিয়ে খেলা করছে বসে বসে। কলতলায় কতকগুলো এঁটো বাসন ছড়ানো, কয়েকটা কাক সেখানে খাবারের কণা খুঁজছে। কুকুরটা মাঝে মাঝে চিৎকার করে তাড়া দিচ্ছে ওদের। ছুটে যাচ্ছে কিন্তু ধরতে পারছে না। নিষ্ফল আক্রোশে শুধু লাফাচ্ছে।

আরো দুটো করিডোর পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। কুষ্ঠরোগীটা রকের উপর বসে বসে ঝিমুচ্ছে। চারপাশে ভনভন করছে মাছি।

না। লোকটা পচে গলে পড়বে। কিন্তু মরবে না।

শওকত আপন মনে বিড়বিড় করলো। সেলিনা ওর খুব কাছ ঘেঁষে হাঁটছে। ওর কাঁধটা এসে মাঝে মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে ওর গায়ে। শওকতের সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠলো। সহসা দৌড়ে গিয়ে একটা চলন্ত বাসের ওপরে উঠে পড়লো সে। পেছনে তাকালো না। তাকাবার সাহস হলো না ওর।

সংক্ষিপ্ত ব্লাউজের নিচে আড়াল-করে-রাখা একজোড়া উদ্ধত যৌবন ওকে পেছন থেকে ব্যঙ্গ করছে। করুক। সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা শূন্য সিটের ওপর বসে পড়লো শওকত। কিন্তু পেছনে তাকানোর লোভের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলো না। আড়চোখে দেখলো, হরিদ্রা শাড়ির আঁচল বাতাসে পতপত করে উড়ছে। স্তম্ভিত বিস্ময়ে বাসটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তেকে ধীরে ধীরে বাসার পথে ফিরে যাচ্ছে সেলিনা।

Leave a Reply