» » এক

বর্ণাকার

একটি সুন্দর সকাল।

বুড়ো রাত বিদায় নেবার আগে বৃষ্টি থেমে গেছে। তবু তার শেষ চিহ্নটুকু এখানে সেখানে ছড়ানো। চিকন ঘাসের ডগায় দু একটি পানির ফোঁটা সূর্যের সোনালি আভায় চিকচিক করছে।

চারপাশে রবিশস্যের ক্ষেত। হলদে ফুলে ভরা। তারপর এক পূর্ণ-যৌবনা নদী। ওপাড়ে তার কাশবন। এপাড়ে অসংখ্য খড়ের গাদা।

ছেলেটির বুকে মুখ রেখে, খড়ের কোলে দেহটা এলিয়ে দিয়ে, মেয়েটি ঘুমোচ্ছে। ওর মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। ঠোঁটের শেষ সীমানায় শুধু একটুখানি হাসি চিবুকের কাছে এসে হারিয়ে গেছে। ওর হাত ছেলেটির হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখা। দুজনে ঘুমোচ্ছে ওরা।

ছেলেটিও ঘুমিয়ে।

তার মুখে দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি। মনে হয় অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলো ওরা। চুলের প্রান্তে এখনো তার কিছু রেশ জড়ানো রয়েছে।

সহসা গাছের ডালে বুনো পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেলো। মটরশুটির ক্ষেত থেকে একটা সাদা ধবধবে খরগোশের বাচ্চা ছুটে পালিয়ে গেলো কাছের অরণ্যের দিকে।

খড়ের কোলে জেগে উঠলো অনেকগুলো পায়ের ঐক্যতান। সমতালে এগিয়ে এলো ওরা। যেখানে ছেলেটি আর মেয়েটি এই পৃথিবীর অনেক চড়াই উৎরাই আর অসংখ্য পথ মাড়িয়ে এসে অবশেষে এই স্নিগ্ধ সকালের সোনা-রোদে পরস্পরের কাছে অঙ্গীকার করে ছিলো।

ভালোবাসি।

বলেছিলো। এই রাত যদি চিরকালের মতো এমনি থাকে। এই রাত যদি আর কোনদিন ভোর না হয় আমি খুশি হব।

বলেছিলো। ওই যে দূরের তারাগুলো, যারা মিটিমিটি জ্বলছে তারা যদি হঠাৎ ভুল করে নিভে যেতো, তাহলে খুব ভালো হতো।

আমরা অন্ধকারে দুজনে দুজনকে দেখতাম।

বলেছিলো। হয়তো কিছুই বলে নি ওরা।

শুধু শুয়েছিলো।

আঠার জোড়া আইনের পা ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে এসে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়ালো ওদের।

ওরা তখনো ঘুমুচ্ছে।

তারপর।

আমার কোন জাত নেই।

মাংসল হাতজোড়া ভেজা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে বুড়ো আহমদ হোসেন বললো। আমার কোন জাত নেই। আমি না হিন্দু, না মুসলমান, না ইহুদি, না খৃষ্টান। আমার জাত তুলে কেউ ডেকেছে কি এক ঘুষিতে নাক ভেঙ্গে দেবো বলে দিলাম।

আশেপাশের টেবিলে যারা ছিলো তারা বিরক্তির সঙ্গে এক নজর তাকালো ওর দিকে।

ছোকরা গোছের একজন দূর থেকে চিৎকার করে বললো, বুড়ো ব্যাটার ভীমরতি হয়েছে। রোজ এক কথা। বলি এ পর্যন্ত কটা লোকের নাক ভেঙ্গেছো শুনি?

আহমদ হোসেনের কানে সে কথা পৌঁছলো না। কপালে জেগে ওঠা ঘামের ফোঁটাগুলো বাঁ হাতে মুছে নিয়ে সে আবার বলতে লাগলো। আমি কিছু জানি না। না জাত না ধর্ম। না তোমাদের আইন-কানুন। এর সবটুকুই ফাঁকি। চোখে ধুলো মেরে মানুষ ঠকানোর কারসাজি। শুনতে যদি ভালো না লাগে, নিষেধ করে দাও তোমাদের এই আস্তাকুঁড়ে আর আসবো না। এখানে চা খেতে না এলেও আমার দিন কাটবে।

আহা চটছেন কেন, আমি কি আপনাকে আসতে বারণ করেছি কোন দিন। না, করছি। চা-খানার মালিক নওশের আলী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।

কিন্তু, বুড়ো চুপ করলো না।

কাপ থেকে খানিকটা চা পিরিচে ঢেলে নিয়ে মুখের কাছে এনে আবার পিরিচটা নামিয়ে রাখলো সে। হয়েছে, ওসব মিষ্টি কথায় মন ভোলাতে চেও না। ছেলেটাকে যখন কুড়ি বছর ইকে দিলো তখন কোথায় ছিলে সব? পাঁচটা নয়, দশটা নয়, একটি মাত্র ছেলে আমার। কোর্ট শুদ্ধ লোক বললো, বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে, আর হাকিম কিনা সাজা দিয়ে দিলে আঁ।

পনের বছর আগে সাজা পাওয়া এবং একমাত্র ছেলের চিন্তায় আহমদ হোসেনের চোখজোড়া সজল হয়ে এলো। বার্ধক্যের চাপে কুঞ্চিত মাংসের বেষ্টনী ভেদ করে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো। বাদামি চায়ের ঈষৎ উষ্ণ লিকারে।

বুড়ো কাঁদছে।

শওকত তার চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো। ওর ইচ্ছে হলো এ মুহূর্তে একবার বুড়ো আহমদ হোসেনের পাশে বসতে। চায়ের কাপটা এক পাশে সরিয়ে দিয়ে দুটো কথা বলতে ওর সঙ্গে।

কিন্তু থাক।

যে কাঁদছে সে কাঁদুক। কান্নার সাগরে সান্ত্বনার সীমা খুঁজে নেবে বুড়ো আহমদ হোসেন।

শওকত জানে, এই দিন যখন শেষ হয়ে যাবে, যখন কালো বোরখায় ঢাকা রাত আসবে, তখন আর এমনি করে কাঁদবে না আহমদ হোসেন। তখন এই শহরের প্লাস্টার ঝরা সরু আঁকাবাঁকা গলিতে নামহীন অসংখ্য ছেলেমেয়ের জন্ম-মৃত্যুর হিসেব লিখে বেড়াবে সে।

কত হলো?

একান্ন লক্ষ বত্রিশ হাজার চুরানব্বই জন।

কোনো রাতে সহসা কোনো রাস্তার মোড়ে দেখা হয়ে গেলে বুক পকেট থেকে হিসেবের খাতাটা বের করে বলবে। একান্ন লক্ষ বত্রিশ হাজার চুরানব্বই জন ক্ষয়ে যাওয়া গুটিকয় কালচে দাঁতের ফাঁকে বিকৃত এক হাসির আমেজ ছড়িয়ে সে বলবে। যাবে একদিন। চলো না কাল রাতে।

না।

ভয় হচ্ছে বুঝি? ওখানে গেলে কেউ তোমাকে চিনে ফেলবে।

বদনামের ভয়, তাই না? কিন্তু কি জানো, ওখানে যারা যায় তারা কারো কথা মনে রাখে না! এটাই ও জায়গায় বিশেষত্ব। আজ পনেরো বছর ধরে দেখে আসছি। আগে আর যায়। বামুন কায়েখ বলো, আর মোল্লা মৌলভী বলো, সব বাটাকে চিনে রেখেছি। দিনের বেলা কোট-প্যান্ট পরে সাহেব সেজে অফিসে যায় আর যেই না সন্ধে হলো, অমনি বাবু মুখে রুমাল খুঁজে চট করে ঢুকে পড়ে গলিতে! বলে আবার হাসবে আহমদ হোসেন। একটা আধপোড়া বিড়িতে আগুন ধরিয়ে নিয়ে আবার সে শুরু করবে, এই শহরের নাম না জানা অসংখ্য দেহপসারিণীয় গল্প।

দিন যত যাচ্ছে পিঁপড়ের মতো বাড়ছে ওরা বুঝলে? বাদামতলীর নাম শুনলে তো নাক সিটকাও। আর এই যে নিওন বাতির শহর রমনা ভাবছো এটা একেবারে পিঁপড়ে শূন্য তাই না? খোদার কছম বলছি এখানকার পিঁপড়েগুলো আরো বেশি পাজী। শালার সাহেবের বাচ্চারা ওদের গা গার্ল বলে ডাকে। যেন, নাম পাল্টে দিলেই ধর্ম পাল্টে গেলো আর কি? বলে বিকট শব্দে হেসে উঠবে বুড়ো আহমদ হোসেন। তারপর হিসেবের খাতাটা বুক পকেটে রেখে দিয়ে আর কোন কথা নাবলৈ হঠাৎ সে আবার চলতে শুরু করবে। এক পথ থেকে আরেক পথ। অন্য পথের মোড়ে।

বুড়ো আহমদ হোসেন তখনো কাঁদছে।

চায়ের দাম চুকিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পরে বাইরে বেরিয়ে এলো শওকত।