সংক্ষিপ্ত ব্লাউজের নিচে আড়াল-রাখা একজোড়া উদ্ধত যৌবন, নিচে তার ঘরে নাচের মহড়া দিচ্ছে। এখান থেকে তার ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছে শওকত।
মার্থা বললো, দেরি করছো কেন, ওঠো। তাড়াতাড়ি বাড়িটা দেখে আসি গিয়ে। আমাকে আবার দুটোর মধ্যে দোকানে যেতে হবে। এ বেলা ছুটি নিয়েছি। শওকতের শুকনো চুলের দিকে চোখ পড়তে বললো, মাথায় তেল দাও। ভালো করে চুলগুলো আঁচড়ে নাও। এমন ছন্নছড়ার মতো থাকো!
না। আর এই ছন্নছাড়া জীবন নয়। এবার নিজেকে গুছিয়ে নিতে চায় শওকত। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছে। জীবনের সহস্র সর্পিল পথের বাঁকে থেমেছে। দেখেছে। ঘুরেছে অনেক। আজ বড় ক্লান্ত সে।
ওরা অনেক টাকা ভাড়া চাইবে। শওকত ধীরে ধীরে বললো, কমপক্ষে দেড়শ টাকা।
মার্থা বললো, চলো না, একবার গিয়ে দেখি তো।
গত কয়েকদিন ধরে অনেক বাড়ি দেখেছে ওরা। অনেক অলিগলি ঘুরেছে। বাড়ি পছন্দ হলেও ভাড়ার অঙ্ক শুনে চুপসে গেছে মন।
বাবুবাজারের বাড়িটা পেলে মন্দ হতো না। শওকত চুলে তেল দিতে-দিতে বললো। ভাড়াটাও কম ছিলো।
কিন্তু অত টাকা আগাম দেবে কোত্থেকে? ওর দিকে চিরুনিটা বাড়িয়ে দিলো মার্থা। আমাদের তো আর একগাদা জমা-টাকা নেই। কথাটা বলে স্নান হাসলো সে। তাছাড়া বাড়ি ভাড়াতে সব টাকা খরচ হয়ে গেলে, খাওয়া-পরা চলবে কেমন করে। পরের কথাটা বলতে গিয়ে থামলো মার্থা। লজ্জায় মুখখানা রাঙা হলো ওর। আস্তে করে বললো, বিয়ের পর সংসারটা তো আর অমন ছোট থাকবে না। বাড়বে। বলে রাঙা মুখখানা অন্য দিকে সরিয়ে নিল সে।
শওকত মনে-মনে হিসেব করে দেখলো, সত্যিই তো। মাসে দেড়শ টাকা করে পায় মার্থা। একশ টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে গেলে আর থাকে কত। ভাবতে গিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হলো ওর। ও যদি একটা চাকরি পেতো।
আচ্ছা মার্থা, ও লোকটা তোমাকে কক্সবাজার নিয়ে যেতে চায় কেন?
কোন্ লোকটা।
ওই যে, যাকে আমার চাকরির কথা বলেছিলে।
ও, মার্থা সহসা গম্ভীর হয়ে গেলো। একটু পরে ম্লান হেসে বললো, কেন নিয়ে যেতে বোঝ না?
ওর চোখের দিকে চোখ পড়তে শওকত আর কোনো কথা বলতে পারলো না। মুখখানা রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেলো ওর।
মার্থা সেটা লক্ষ্য করে বললো, এতসব নিয়ে তুমি মার্থা ঘামিয়ো না তো! যা হবার হবে। চলো। চারপাশে সন্তর্পণে অকিয়ে ওর খুব কাছে এগিয়ে এসে মুহূর্তে ওকে একটু আদর করে দিয়ে আবার বললো, চলো।
শওকত বললো, যাই বলো বিয়ের পরে কিন্তু এ বাড়িতে থাকা চলবে না।
মার্থা বললো, ঠিক আছে। আমি তো অমত করিনি। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে আমি যাবো। আপাতত একটা বাড়ি খুঁজে তো বের করি। চলো।
সেলিনার ঘরের দরজাটা খোলা। ভেতরে এখনো নাচের মহড়া দিচ্ছে সে। কাঁচা হলুদ মাংস বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে ওর। নানা রঙের বুটি-আঁকা অপরিসর কামিজের নিচে যৌবনের ভাজগুলো থরেথরে সাজানো। তাকাবে-না তাকাবে-না করেও একবার তাকাতে হলো। তাড়াতাড়ি চোখজোড়া ফিরিয়ে নিলো সে। না, ওকে আর ভয় করবে না শওকত। মার্থা রয়েছে সঙ্গে। নতুন বাড়িতে গিয়ে মার্থাকে নিয়ে নতুন জীবনের ভিত পাতবে সে। না, আর ভয় করবে না।
ওরা রিকশা নিলো না। হেঁটে চললো।
মার্থা বললো, এই তো অল্প একটু পথ।
শওকত তার কথা শেষ করলো। হেঁটেই যাওয়া যাবে। শওকত জানে, কদিন থেকে বেশ হিসেবি হয়ে উঠেছে মার্থা। আটআনা পয়সা বাঁচতে পারলে মন্দ কী। কাজে আসবে।
এ পথে উদ্দেশ্যবিহীন বহু হেঁটেছে শওকত। মার্থাকে নিয়ে আজকের এই হেঁটে যাওয়ার সঙ্গে তাদের কোনো মিল নেই। এই শহরে কত লোক। কত বাড়ি। তারই এককোণে একটা বাসায় পোজে বেরিয়েছে ওরা। মার্থা আর শওকত।
শওকত আর মার্থা। একটা পছন্দমতো ঘর। কিছু আশা। কিছু স্বপ্ন। অনেক ভালোবাসা। আর হয়তো অশেষ দৈন্যে-ভরা একটুকরো সংসার। তাই হোক।
সামনের রাস্তা দিয়ে একটা লম্বা মিছিল যাচ্ছে। ছাত্ররা স্ট্রাইক করেছে। গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে শ্লোগান দিচ্ছে ওরা। হাতে হাতে অসংখ্য যান। প্লাকার্ড। মিছিলটা বেরিয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত থামালো না।
মার্থা আস্তে করে শুধালো, কী ভাবছে।
কত বললো, কিছু না।
মার্থা বললো, আমি কী ভাবছি বল তো।
শওকত চিন্তা করে নিয়ে বললো, তুমি। তুমি ভাবছো একটা বাড়ির কথা।
না। মোটেই না, মৃদু হেসে মার্থা নাড়লো মার্থা। আমি ভাবছি বাড়িটা পেলে কেমন করে সাজাবো তাই।
শওকত তাকিয়ে দেখলো মার্থার চোখে স্বপ্ন। আজকাল আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর লাগে ওকে।