এ বাড়িতে কত ভাড়াটে আছে কেউ বলতে পারবে না। কটা ঘর হিসেব করে দেখতে গেলে একটা লোক হয়তো একদিন ধরেও কোন খেই পাবে না। এক করিডোর দিয়ে ঘুরে ঘুরে বার বার সে ওই একই করিডোরে ফিরে আসবে। কিম্বা ঘর গুনতে গুনতে সে কোথায় গিয়ে হারিয়ে যাবে, আর ফিরে আসার পথ পাবে না।
অনেকের সঙ্গে এ কবছরে আলাপ হয়েছে শওকতের। কারো নাম জানে। কারো জানে না। কারো সঙ্গে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হলে স্মরণশক্তির বরাত ফ্লোরে হয়তো চেহারা দেখে চিনে ফেলে। এ বাড়ির ভাড়াটে। দু একটা কুশল সংবাদ বিনিময়। তারপর দুমাস নমাস আবার চার চক্ষুর মিলন হলো। তখন হয়তো চেনার চেষ্টা করেও বার বার ভুল হয়?
দুয়ারে পায়ের শব্দ হতে ঘুরে তাকালো শওকত। মার্থা গ্রাহাম ভেতরে দাঁড়িয়ে। হাতে ধরে রাখা পিরিচে এক টুকরো পাউরুটি।
ব্যাপার কি, অন্ধকারে বসে আছেন? মার্থা অবাক হলো। ঘরের কোণে রাখা হ্যারিকেনটা তুলে এনে শওকতের কাছ থেকে কাকি চেয়ে নিয়ে ঘরে আলো জ্বালালো মার্থা।
হারিকেনটা টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে বললো, রুটিটা খেয়ে নিন।
হাতমুখ ধুয়ে অনেকটা সজীব হয়ে এসেছে মার্থা। পায়ের রঙটা কালো তেলতেলে। টানা টানা একজোড়া চোখ, হাল্কা ছিমছাম দেহ। তাকালে মনেই হয় না যে ওর বয়স তিরিশের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে কালো মুখের ওপরে পাউডারের হাল্কা প্রলেপ বুলিয়েছে সে। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ লাল লিপিস্টিক। হাত কাটা একটা গাউন পরেছে মার্থা। সোনালি চুলগুলো কাঁধের দুপাশে ছড়ানো। প্লেট থেকে রুটির টুকরোটা ওর হাতে তুলে দিয়ে মার্থা আর বললো চাকুরির কোন খোঁজ পেলেন?
না।
সেই ওষুধের কোম্পানিতে যাওয়ার কথা ছিলো আজ দুপুরে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
ওরা কি বলো?
বললো, লোক নিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারলো না। শওকত এক দৃষ্টিতে হ্যারিকেনটার সলতেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মার্থা তার হাতের নখগুলো চেয়ে চেয়ে দেখলো। বাইরে বারান্দায় খুক করে শব্দ হতে সেদিকে ফিরে তাকালো মার্থা।
কয়েক জোড়া সন্ধানী দৃষ্টি জানালার পাশ থেকে অন্ধকারে আত্মগোপন করলো। হারিকেনের আলোয় দাঁড়ানো মার্থা মৃদু হাসলো। তারপর সামনে ঝুঁকে পড়ে চাপা স্বরে বললো। একটা কথা বলবো, কিছু মনে করবেন নাতো?
শওকত মুখ তুলে তাকালো এর দিকে, বলুন।
মার্থা ইতস্তত করে বললো। যতদিন চাকরি না পান, আমার ওখানে খাবেন। কি দরকার শুধু শুধু দুটো চুলো জ্বালিয়ে?
শওকত সহসা কোন জবাব দিতে পারলো না।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে মার্থা আবার বললো, আমি এখন চলি, দেরি হলে আবার রাতকানা লোকটা বেঁকিয়ে উঠবে। আপনি কি বাইরে বেরুবেন?
না, শওকত আস্তে করে জবাব দিলো।
একটু পরে শূন্য পিরিচটা হাতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মার্থা। বলে গেলো, ওই কথা রইলো কিন্তু। শেষে ভুলে যাবেন না।
ও চলে যাবার পর অনেকক্ষণ একঠায় বসে রইলো শওকত। মার্থাকে নিয়ে চিন্তে করলো। সেই কবে, কতদিন আগে আজ মনেও নেই। হয়তো সাত-আট বছর হবে। কিন্তু এগারো-বারো দেখতে তখন আরো অনেক সুন্দরী ছিলো মার্থা। রোজ সন্ধেবেলা বেকারিতে রুটি কিনতে আসতো। তখন থেকে ওকে চেনে শওকত। সেই সময় ওর সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়। মাঝে মাঝে মাকে সঙ্গে নিয়ে আসতো মার্থা। সে এক দজ্জাল শহিলা। মার্থা কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। বলে, না মায়ের মনটা ছিলো ভীষণ নরখ। আপনারা তাকে খুব কাছে থেকে দেখেন নি কিনা তাই চিনতে ভুল করেছেন। আসলে কি জানেন, আমার মায়ের জীবনটা বড় দুঃখ কেটেছে। ভরা যৌবনে, মানে সেই যুদ্ধের শেষের দিকে মা হঠাৎ বাবাকে ছেড়ে দিয়ে এক নিগ্রোকে বিয়ে করে বসলেন। আমার বয়স তখন বারোতে পড়ি পড়ি করছে। মা আমাকে ত্যাগ করলেন না। সঙ্গে নিয়ে রাখলেন। আর এই নিগ্রোটা, বুঝলেন? অদ্ভুত লোক ছিলো সে। মাকে ভীষণ ভালোবাসতো। দূর থেকে কতদিন আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হতো, মার বয়স বুঝি আমার চেয়েও কমে গেছে। মা ঘরময় ছুটোছুটি করতো। গলা ছেড়ে হাসভা। অকারণে বিছানায় গড়াগড়ি দিতো আর হঠাৎ কখনো কি খেয়াল হতো জানি না, দৌড়ে এসে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় সারা মুখ ভরে দিতো আমার। একদিন একটা মজার কাণ্ড ঘটেছিলো। এখনো বেশ স্পষ্ট মনে আছে আমার। সেদিন, জানি না কি একটা সুখবর ছিলো। আমি বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি, সেই নিগ্রোটা মাকে দুহাতে কোলে তুলে নিয়ে ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে। আমাকে দোরগোড়ায় দেখতে পেয়ে মা ভীষণ লজ্জা পেলো। চাপা স্বরে বললো, আহ কি করছো। ছেড়ে দাও? মার্থা দেখছে সব। আহ, ছাড়ো না! মার্থা।
নিগ্রোটার কিন্তু কোন ভাবান্তর হলো না। সে একবার শুধু ফিরে তাকালো আমায় দিকে, তারপর মাকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো। মা তার কোলের মধ্যে চটি করে বসে লজ্জায় রাঙা মুখখানা আমার থেকে আড়াল করে বললো, ছিঃ মেয়েটা কি ভাবছে বলতো।
নিগ্রোটা কিছু বলালো না। শুধু ভেতর থেকে দরাটা অঙ্ক করে দিলো।
তারপর।
কি আশ্চর্য। একদিন সকালে নিগ্রোটা তার কাজে বেরিয়ে গেলো। আর ফিরলো না।
একদিন। দুদিন এমনি করে একটি মাস, একটা বছর কেটে গেলো। যে গেলো সে আর এলো না। মা কান্নাকাটি করলেন। গির্জায় গিয়ে কতবার কত নামে যিশুকে ডাকলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। পরে একদিন শুনলাম, সেই নিগ্রোটা তার দেশে, তার ছেলেমেয়ে আর বৌয়ের কাছে ফিরে গেছে।
সেই থেকে মা যেন কেমন বদলে গেছেন। আর সব কিছুতেই আমাকে সন্দেহ করতে লাগলেন তিনি। আমি কোন ছেলের সঙ্গে একটু হেসে কথা বলতে গেলে তিনি ভীষণ রাগ করতেন। যেন আমি মস্ত বড় একটা অন্যায় কাজ করে ফেলছি এমনি একটা ভাব করতেন তিনি।
হ্যাঁ, তাই যেদিন ওর মা সঙ্গে আসতো, সেদিন একেবারে চুপটি করে থাকতো মার্থা। কারো সঙ্গে কথা বলতো না। কোনদিকে তাকাতো না। আর যেদিন সে একা আসতো, সেদিন ওকে দেখে অবাক হতো সবাই। হাসছে। কথা বলছে। গুনগুন করে গানের কলি ভজছে। আর দুষ্টুমিভরা দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক।
তারপর একদিন এক অক্সেন ওয়ালার ছেলে পিটার গোমেসের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলো ওর। ভিক্টোরিয়া পার্কে গির্জায় অনেক আত্মীয় পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে পিটারের হাতে বিয়ের আংটি পরিয়ে দিলো মার্থা গ্রাহাম।
তখন ওর চেহারায় অন্য এক জীবনের চমক এসেছে। স্বামীকে নিয়ে মার্কেটিংয়ে বেরোয় মার্থা। সিনেমায় যায়, রেস্তোরাঁয় খায়। রাতে বল নাচে।
কিছুদিনের মধ্যে বেশ মুটিয়ে গেলো মার্থা। তারপর অনেকদিন ওর কোন খোঁজ পায়নি শওকত মাঝে একবার শুনেছিলো, একটা মৃত সন্তান প্রসব করেছে সে। ঢাকা ছেড়ে চাটগয়ে আছে স্বামীর সঙ্গে।
এর মধ্যে একদিন বেকারিতে রুটি কিনতে এসে হু হু করে কেঁদে উঠলেন মার্থার মা। হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে রেখে বোকার মতো ওর দিকে চেয়েছিলো শওকত। মার্থা মারা গেছে।
আমার মেয়ে মার্থা, ও আর বেঁচে নেই। ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে চোখ মুছলেন তিনি। রুমাল ভিজে গেলো কিন্তু অর অবাঞ্ছিত বন্যা থামলো না।
হারিকেনের সলতেটা আরো কমিয়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো শওকত।
নিচের সেই কলহ এখন থেমে গেছে। যার যার ঘরে ফিরে গেছে ওরা। নেড়ি কুত্তা দুটো উঠোনের এক কোণে যেখানে কয়েক জন জুয়াড়ি তাসের আসর জমিয়ে বসেছে সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
একটা চোখ বন্ধ করে দিয়ে আরেক চোখের খুব কাছে এগিয়ে এনে সাবধানে তাস দেখছে খলিল মিস্ত্রী। কেউ যদি দেখে ফেলে সেই ভয়ে। সব কিছুতে অমনি সাবধানতা গ্রহণ করে সে। রোজ সকালে যখন কাজে বেরিয়ে যায় তখন বাইরে থেকে ঘরে তালা দিয়ে যায় খলিল মিস্ত্রী। বউ ভিতরে থাকে। রাতে বাইরে থেকে আসার সময় ঠোঙায় করে বউয়ের জন্যে সন্দেশ নিয়ে আসে খলিল। ওর চোখেমুখে আনন্দের চমক। তালা খুলে ঘরে ঢুকে বউকে অনেক আদর করে খলিল মিস্ত্রী। কাছে বসিয়ে সন্দেশ খাওয়ায়।
বুড়ো আহমদ হোসেন বলে, এটাও একটা রোগ, বুঝলে? এক রকমের ক্ষুধা। একজনকে অনন্তকাল ধরে একান্ত আপন করে পাওয়ার অশান্ত ক্ষুধা। ঈর্ষা থেকে এর জন্ম। ঈর্ষার এর মৃত্যু। এ ব্যাটারা কবিতা পড়ে না বলেই এদের এই অধঃগতি। মনে নেই সেই কবিতাটা? সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। আবার সেই হাসি। কালচে দাঁতের ফাঁকে হাসছে বুড়ো আহমদ হোসেন।
শওকত দেখলো, তিনটে তাসকে পরম যত্নে হাতের চেটোর মধ্যে আঁকড়ে ধরে খুঁটিয়ে দেখছে খলিল মিস্ত্রী। সে যদি জানতো, যে লোকটি তার পাশে বসে তাস খেলেছে; যার সঙ্গে দিনের পর দিন সে হাসি-ঠাট্টা আর কৌতৃকে মশগুল হয়ে পড়েছে, সে লোকটা আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে সিঁড়ির নিচে তার বউকে নিয়ে শুয়েছিলো। সে যদি জানতো, যে। তালা দিয়ে সে তার বউকে রোজ বন্ধ করে যায় তার আরেকটা চাবি এর মধ্যে তৈরি হয়ে। গেছে, তাহলে?
খলিল মিস্ত্রী এর কিছু জানে না। হয়তো কোনদিন জানবেও না। তার অজ্ঞানতা তাকে শান্তি দিক।
নিচে, থিয়েটার কোম্পানির ছেলেমেয়েরা গ্রামোফোনের রেকর্ড বাজিয়ে নাচের মহড়া দিচ্ছে। কয়েকটা ছেলে-বুড়ো-মেয়ে এসে জুটেছে সেখানে। মহড়া দেখছে। হাসছে। কথা বলছে।
বেশ আছে ওরা। শওকত ভাবলো।
বউ-মারা কেরানিটা উঠোন পেরিয়ে উপরে আসছে। রোজকার মতো আজও দেশি মদ গিলে এসেছে সে। পা টলছে। ঠোঁট নড়ছে। পরনের পাঞ্জাবিটা পানের পিকে ভরা। শওকতের গা ঘেঁষে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সে। এর পরের-অনুচ্ছেদটুকু অনায়াসে অনুমান করে নিতে পারে শওকত।
বউ-মারা কেরানিটা ধীরে ধীরে তার ঘরে ঢুকবে। কিছুক্ষণ কোন সাড়া পাওয়া যাবে। তারপর হঠাৎ তার রুগ্ন বউটির কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে। বালিশে মুখ চেপে কাঁদবে সে।
তাসের জুয়ো যেমনি চলছিলো, তেমনি চলবে।
নাচের মহড়া থামবে না।
মাওলানা সাহেব বারান্দায় বসে একমনে তছবি পড়ে যাবেন।
শুধু উঠোনে বসে থাকা নেড়ি কুত্তা দুটো উপরের দিকে ঘেউ ঘেউ করবে। আর বাইরের রকে বসা কুষ্ঠ রোগীটার দু চোয়ালের ছিদ্র দিয়ে একটানা লাভা ঝরবে।
নির্লিপ্ত রাত্রির নীরবতায় শিহরণ তুলে রুগ্ন বউটি আরো অনেকক্ষণ ধরে কাঁদবে। তারপর যখন তার কান্না বন্ধ হয়ে যাবে, তখন রাতকানা লোকটার দোকান-ঘরে তালা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে মার্থা। মার্থা গ্রাহাম। মায়ের দেয়া নাম।
আলনা থেকে ময়লা জামাটা নামিয়ে নিয়ে পরলো শওকত। শুকনো চুলের ভেতরে আঙ্গুলের চিরুনি বুলিয়ে নিলো। বাইরে বেরুবে সে। গন্তব্যের কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।
হয়তো একবার সেই পুরানো বেকারিতে যাবে। কিম্বা, লঞ্চ কোম্পানির অফিসে না হয় গুজরাটী সাহেবের ওষুধের দোকানে।
একটা চাকুরি ওর বড় দরকার। ভাবতে গিয়ে নিজের মনে স্নান হাসলো শওকত। গত উনিশ বছর ধরে অনেক চড়াই উত্রাই পেরিয়েও এখনো জীবনের একটা স্থিতি এলো না। প্রথমে খিদিরপুরের জাহাজ ঘাটে, তারপর এক বাঙালি বাবুর আটা-কলে। মাঝে কিছুকাল একটা রেলওয়ে অফিসে! হাইল ক্লার্ক। তারপর কোন এক নামজাদা রেস্তোরাঁ কাউন্টারে। ছমাস। সেটা ছেড়ে এক মলম কোম্পানির দালালি করেছে অনেক দিন। এক শহরে থেকে অন্য শহরে। ট্রেনে, টমাৱে। এরপর বছর দুয়েক জনৈক সূতো ব্যবসায়ীর সঙ্গে কাজ করেছে শওকত। তারপর আগাখানী আহমদ ভাইয়ের আধুনিক বেকারিতে। ওখানে বেশ ছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকতে পারলো না। ছেড়ে দিয়ে একটা আধা সরকারী ফার্মে টাইম ক্লার্কের চাকুরি নিলো শওকত। দশটা-পাঁচটা অফিস। মন্দ লাগতো না। কিন্তু ফাটা কপাল। বেতন বাড়ানোর ব্যাপার নিয়ে একদিন বড় সাহেবের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেলো। আর তার খেসারত দিতে গিয়ে সাত দিনের নোটিশে সে অফিস ছাড়তে হলো। সেই থেকে আবার বেকার।
ঘর থেকে বারান্দায় পা দিতেই একজন মোটা মহিলা ঝাড় হাতে চিৎকার করতে করতে সামনে দিয়ে জুটে গেলো। একটা বাচ্চা ছেলেকে তাড়া করছে সে। একটা বিড়াল ওদের পিছু পিছু দৌড়চ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার বাকে তিন হাত উঁচুতে দুপাশে দুটো জানালা। একটা জানালা থেকে আরেকটা জানালায় কে যেন এক টুকরো কাগজ ছুঁড়ে দিলো। সেটা যথাস্থানে না পোঁছে শওকতের সামনে এসে পড়লো। একেবারে পায়ের কাছে।
মুখ তুলে উপরে তাকালো শওকত।
স্কুল মাস্টার মতিন সাহেবের মেয়ে জাহানারা জানালার পেছন থেকে মুখ বের করে তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে মুখটা সরিয়ে নিলো।
আড়চোখে অন্য জানালার দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো শওকত।
আজমল আলীর ছেলে হারুন ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি জানালাটা বন্ধ করে দিলো।
সিঁড়ি থেকে কাগজের টুকরোটা হাতে তুলে নিলো শওকত! খুলে দেখলো একখানা চিঠি।
মেয়েলী হাতের গুটি গুটি লেখা। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ছাদে এলো। অনেক কথা আছে। দেখা হলে সব বলবো।
চিঠিখানা ধীরে ধীরে আবার বন্ধ করলো শওকত। উপরে চেয়ে দেখলো, জাহানারার অর্ধেকটা মুখ আর একজোড়া ভয়ার্ত চোখ অধীর আগ্রহে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে!
চিঠিটা বন্ধু জানালার কার্নিশে রেখে দিয়ে নিচে নেমে গেল শওকত। করিডোরে একটা বাচ্চা ছেলে টা টা করে কাঁদছে। ঝাড়ু হাতে মহিলা গজ গজ করতে করতে ফিরে যাচ্ছে উপরের দিকে। বিড়ালটা এখনো ওর পিছু পিছু চলেছে।
মার্থার ঘরের দরজায় ছোট্ট একটা তালা ঝুলছে। সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেছে সে। আজ দু বছর ধরে রাতকানা লোকটার ওষুধের দোকানে কাজ করছে সে। চাটগাঁয়ের খালেদ খান যেদিন তাকে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় ফেলে পালিয়ে গেলো সেদিন চারপাশে অন্ধকার দেখেছিলো মার্থা।
এ চাকুরিটা পেয়ে বেঁচে গেছে সে।
মৃত মার্থা। তাকে দেখে প্রথম দিন চমকে উঠেছিলো শওকত।
কুড়ি একুশ বছরের একটা সুদর্শন ছেলের সঙ্গে এ বাড়িতে এসে উঠলো মার্থা। ঘর ভাড়া নিলো। স্বামী-স্ত্রী বলে পরিচয় দিলো সবার কাছে। বেশ ছিলো ওরা।
একদিন ওকে একা পেয়ে শওকত জিজ্ঞেস করলো। মার কাছ থেকে শুনেছিলাম আপনি মারা গেছেন। সামনে এখন ভূত দেখছি নাতো?
মা মার কথা বলবেন না। মার্থা ঐ কুকে বললো। নিজের ব্যাপারে সবাই অমন অন্ধ হয়। মা যখন বাবাকে ছেড়ে সেই নিগ্রোটার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলো, তখন কোন অন্যায় হয়নি আর আমি গোমেসকে ছেড়ে মস্ত বড় পাপ করে ফেলেছি, তাই না?
ও! শওকত সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো। তাহলে লোকে যা বলছে সব সত্যি।
কি?
আপনি এই ছেলেটিকে বিয়ে করেছেন।
না, বিয়ে এখনো হয়নি। হাবে। এখানে এসে থামলো না মার্থা! যেন তার মনের অনেক জমে থাকা কৃথা কারো কাছে ব্যক্ত করে হাল্কা হতে চাইছিলো সে। তাই বললো, মায়ের ইচ্ছেকে সম্মান দিতে গিয়ে গোমেসকে বিয়ে করেছিলাম আমি। মিথ্যে বলবো না, ওর সঙ্গে আমি সুখেই ছিলাম। আমি খা চাইতাম সব দিতো সে। যা বলতাম সব করতো। স্বামী হিসেবে ওর কোন দোষ আমি এখনো দিইনে। খালেদের সঙ্গে গোমেস নিজে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো। একদিন রাতে এটা বল নাচের আসরে। বলতে গিয়ে থামলো মার্থা, মুহূর্ত কয়েকের জন্যে কি যেন চিন্তা করলো সে। তারপর হঠাৎ করে বললো। কি আশ্চর্য দেখুন তো, আপনারা সবাই আমাকে কালো বলে ক্ষ্যাপাতেন। মা বলতেন, আমার গায়ের রঙটা নাকি রীতিমত কুৎসিত। গোমেস অবশ্য এ ব্যাপারে কিছুই বলতো না। আর খালেদ, ওর কথা কি বলবো আপনাকে, ও অতি বড় ভালোবাসে আমায়, নইলে আমার গায়ের এই কালো রঙের কেউ এত প্রশংসা করতে পারে? আমার চোখের মধ্যে ও কি পেয়েছিলো জানি না। বলতে গিয়ে ঈষৎ প্রজ্জা পেলো মার্থা। মুখখানা নামিয়ে নিয়ে বললো। ও বলতে। এত সুন্দর চোখ ও নাকি এ জীবনে দেখেনি। জানেন? রোজ একটা করে ও চিঠি দিতো আমায়, আর কোনদিল আমাকে একা কাছে পেলে এমন বাড়াবাড়ি করতো যে, আমি নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে যেতাম।
এরপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মার্থা বললো। আজ বিকালে এ আসুক আপনার সঙ্গে আলাপ করে দেবো।
তারপর। একমাস। দুমাস তিন মাস।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে সত্যি। কিন্তু মার্থার জীবনে তার মায়ের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অমন অবিকলভাবে ঘটে যাবে সে কথা মার্থা কেন শওকতও কোনদিন কল্পনা করতে পারে নি।
করিডোর পেরিয়ে উঠোন, গিজ গিজ করছে লোকে।
কেউ কাঠ কাটছে। কেউ থালাবাসন মাজছে। কেউ জুলো ধরিয়েছে। কেউ চান করছে।
বউ-মারা কেরানির মার খাওয়া বউটি কলের পাশে দাঁড়িয়ে। মাথায় একটা লম্বা ঘোমটা। যেন তার ক্ষতভরা মুখখানা সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখার জন্যে এটা অত লম্বা করে টেনে দিয়েছে সে।
থিয়েটার পার্টির একটি মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছে। ঘরের মধ্যে একটা পুরানো গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজাচ্ছে ওর সঙ্গীরা ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রাণী। উঠোন পেরিয়ে সামনের করিডোরে এসে পড়লো শওকত।
বউ-মারা কেরানিটা বাজার থেকে ফিরছে।
জুয়াড়িদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো। মাছ কত দিয়ে কিনেছেন?
কেরানি জবাব দিলো, বারো আনা।
জুয়াড়ি বললো। খুব সস্তায় পাইলেন দেখি।
বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে নেমে এলো শওকত।
এক ফালি রোদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগীটা চুপচাপ বসে। হাত পায়ের নখ খুঁটছে আর পিটপিট করে তাকাচ্ছে চারপাশে। অদূরে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে মার্বেল নিয়ে খেলছে।
শওকত রাস্তায় নেমে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে তাতে আগুন ধরালো।