অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
ঈশ্বরের বাগান
সাত
সকাল থেকেই সুরেনের মেজাজ বিগড়ে গেছে। সকালেই সে মেজ মেয়েটাকে সেই খারাপ লোকটার ঘরে যেতে দিল। লোকটা লম্বা ঢ্যাঙা। চুপচাপ জানালায় বসে থাকে। বিড়ি খায়। রেলে কাজ করে। মেসবাড়ির একটা আলগা ঘরে থাকে। জানালার একটা পাট বন্ধ থাকলে ভেতরে লোকটা কি করছে বোঝা যায় না। বাতাসী চা পাউরুটি এনে দেয় রাস্তা থেকে। কখনও বাতাসা মুড়ি। বিড়ি, পান যখন যা দরকার বাতাসীকে দিয়ে আনায়। সঙ্গে দশ-পাঁচটা পয়সা বেশি দেয়। একবার আলতার শিশি পাউডার কিনে দিয়েছিল। তা ছাড়া দরকারে-অদরকারে সুরেনকে পাঁচ-সাত টাকা ধার দেয়। ধার দিয়ে আবার ভুলেও যায়। কিন্তু এবারে কিছুতেই ভুলছে না। সকালবেলাতেই ডেকে বলল, অ সুরেন, টাকা কটা দেবে নাকি?
কদিন বাতাসীকে যেতে দেওয়া হয় নি। কুম্ভবাবুর বাসায় সকালেই চলে যায়। বাসি রুটি দু’খানা খেতে দেয় কুম্ভদার বৌ। দুপুরে ডাল-ভাতও দেয়। রাতে কুম্ভবাবু ফিরে না এলে ছুটি হয় না বাতাসীর। কুম্ভবাবুকে খুশি রাখার জন্য সে বাতাসীকে খারাপ লোকটার কাছ থেকে তুলে এনেছে। বাতাসী কত দিক সামলাবে! টাকাটা চাইতেই সে বাতাসীকে বলল, যা হামুবাবুর ঘরে যা। ঝাট-ফাট দিয়ে আয়। খুব চটে গেছে। তারপরই মনে হয়েছিল মেয়েটা যেন খুব খুশি বাপের কথা শুনে। বলল, যাচ্ছি! এবং চুলে কাঁকুই দিয়ে বেশ সেজে-গুজে যেতেই সুরেনের মেজাজটা বিগড়ে গেল। তোর বাপের বয়সী মানুষ তার কাছে এত সাজ-গোজের কি থাকে! কিন্তু টাকাটা বড়ই দায় তার। গেলে যদি টাকাটার কথা হামুবাবু ভুলে যায়। তারপরই মনের মধ্যে কূট কামড়। মেয়েটা তার ভাল করে বড়ই হয় নি—অথচ খুব পেকে গেছে। মাঝে মাঝে এমনভাবে পুরুষমানুষ দেখলে ফিক্ফিক্ করে হাসে যে তার বুকে হিম ধরে যায়। তখন কাশিটা বাড়ে। বাতাসীর ঘর ঝাঁট দিতে অত সময় লাগার কথা না। কি করে! মনের মধ্যে তার প্রবৃত্তি ছোট হয়ে যায়। টুক টুক করে জানালায় হেঁটে এসে বলে, অ হামুবাবু, বাতাসীর হল!
হামুবাবু জানলার ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলে, সুরেন নাকি!
হামুবাবু নিচের দিকে হাত টেনে কি সামলায়। ঘরে বাতাসী আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। হামুবাবু শুয়ে আছে। ঘরটায় আলো ঢোকে না। সব সময় কেমন অন্ধকার থাকে। হামুবাবু পোশাক-আসাকে বড়ই ঢিলেঢালা। যতক্ষণ ঘরে থাকবে শুধু একটা আণ্ডারওয়েয়ার পরনে। মাকুন্দ মানুষ, গায়ে একটা লোম নেই, চুল ছোট্ট করে ছাঁটা—মাথা নাকি এতে হাল্কা থাকে। একটা ছোট জানলা একটা ছোট দরজা। মেসবাড়ির ভেতরে না ঢুকলে দরজাটা দেখা যায় না। বাতাসী কি করছে! সুরেন বলল, বাতাসী, হয়েছে তোর!
বাতাসী ভেতর থেকেই বলল, এই হল যাই। হামুকাকার কাপ-ডিশ ধুয়ে যাচ্ছি।
—সকাল সকাল চলে যাস মা। কুম্ভবাবু বের হয়ে যাবে।
বাতাসী ফ্রক গায়ে দেয়। ফ্রক গায়ে দিলে বড়সড় লাগে না। আর যে বয়সে যতটা শরীরে বড় হওয়া দরকার ছিল, যেন তা বাতাসীর ঠিকঠাক বড় হয় নি। অকালে সব অপুষ্টির জন্য। কিন্তু মানুষের সব জায়গায় অপুষ্টি বুঝি এক রকম থাকে না। সুরেন ভাবল এটা-ওটা বলে দাঁড়িয়ে থাকা যাক—তাহলে এই যে গায়ে-ফায়ে হাত দেওয়া সেটা হামুবাবু পারবে না। তবে সে আর কতক্ষণ—আর একটু বাদেই অফিস, তখন ছানাপোনাগুলি বেড়ালছানার মত ম্যাও ম্যাও করে। এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। কিছু গন্ধটন্ধ পেলেই দাঁড়িয়ে যায়। তবে ঐ একটা সুবিধে। বয়স বাড়লে তার মেয়েরা আদর পায়। সুখীর বেলাতেও দেখেছে। শরীরে মাংস লাগতেই রাধিকাবাবু বললেন, বিয়ে দিয়ে দে। ভাল ছেলে। জমিজমা আছে। ইস্টিশনে ভাজাভুজির দোকান আছে। থাকবে ভাল, খাবে ভাল। প্ৰায় বলতে গেলে ওরা তুলে নিয়েই গিয়েছিল। বাতাসীও আজকাল আদর পেতে শুরু করেছে।
সুরেন বলল, সিগারেট আছে নাকি হামুবাবু?
আমি ত আজকাল গাঁজা খাচ্ছি সুরেন।
সুরেন কেমন ভীত গলায় বলল, অত কড়া সহ্য হবে না। গাঁজা খায় লোকটা সে শুনেছে। ইদানীং অফিসেও যায় না। এই ঘরটায় বসে বসে কেবল আইনের বই পড়ে। হামুবাবুর ধারণা, তার বিরুদ্ধে সবাই যড়যন্ত্র করছে। সেই ষড়যন্ত্র আটকাবার জন্য সে এখন আইনের বই ঘাঁটাঘাঁটি করছে। মাঝে দেখেছে কপালে লম্বা সিঁদুরের ফোঁটা টেনে কোথায় একবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। ফিরে এসে বলল, তীর্থে গেছিলাম। বাতাসীকে দিয়ে কাশী বিশ্বনাথের প্রসাদও পাঠিয়েছিল।
সুরেনের কাছে হামুবাবুর সবটাই ভাল, ঐ হাত-ফাত দেয় এমন একটা ধান্দা দেখা দিতেই মনটা বিগড়ে গেছে। আগে সে এটা বুঝতে পারত না। তার মেয়েদের আদর করে ডাকত ঘরে, বাতাসী টেবি সবাইকে। লজেন্স দিত খেতে। চা বানিয়ে নিজে খেত, মেয়ে তিনটেকে দিত। মুড়ি বাদাম ভাজা মেখে ভাগ ভাগ করে দিত। তিনটে মেয়েই হামুবাবুর ন্যাওটা। রথের মেলায় গেলে দশটা করে পয়সা। এত কে করে! কিন্তু বাতাসী না গেলে রাগ করে। পয়সা ফেরত চায়। এটা সুরেনের মনে ধন্দ ঢুকিয়ে দিয়েছে। কূট কামড়। সে ডাকল, হল বাতাসী?
—তুমি যাও না সুরেন! হলেই চলে যাবে।
—বাবু আমরা হলেম গে কপাল পোড়া মানুষ। তা ঘরে আপনার থাকলে হাতের কাজ এগিয়ে দিলে কার কি আসে যায়। কিন্তু কুম্ভবাবু অফিসে যাবে তো।
—তা বাতাসী কেন?
—উ কুম্ভবাবু আর ভরসা পায় না।
হামুবাবু সব জানে। নতুন বাড়ির ওদিকে জানালাটা খুলে গেলেই সব বোঝে। সে বলল, পাহারা দিয়ে কিছু হয় না সুরেন। এ হল গে ঘুসঘুসে আগুন। কেবল পোড়ে। আর পোড়ে।
—ভাল আছেন বাবু বিয়ে থা করলেন না। মুক্ত। কি খাব, কি খাওয়াব ভাবতে হয় না। ওরে বাতাসী হল?
হামুবাবু বিরক্ত হয়ে উঠে বসল। পা দুটো কাঠি কাঠি—রগফগ সব ভেসে উঠেছে। রুগ্ণ শরীর। মাংস না থাকলেও ছিবড়েটা আছে শরীরে। চোখ লাল করে বসে থাকে। গাঁজা খেলে চোখ সাদা থাকবে কি করে। তুরীয় ভাব সব সময়। কাজ-ফাজ করে যা পায়, তাও নেশা-ভাঙে ওড়ায়। খায়- দায় কম। মেসে দুবেলা খায় ঐ নামে। আর কেবল মানুষের বসে বসে আদ্যশ্রাদ্ধ করে। কোথায় মিছিল হচ্ছে, কোথায় প্লাবন হচ্ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাগজে দেখে। এতে তার খুব আনন্দ। কাগজটা মেলাই থাকে। অপঘাতে মৃত্যু, বালিকা হরণ, বাসের চাকায় চেপ্টে গেছে, বৌ পলাতক, এ-সব খবর পড়ে লোকটা মজা পায়।
সুরেন ভাবল, আজ কি মজার খবর আছে জেনে নেয়। এতে তারও মজা আছে। এই একটা জায়গায় হামুবাবুর সঙ্গে তার খুব মিল। সে বলল, কাগজে কি খবর হামুবাবু?
—খবর তো অনেক। তোমার রাজার মাথা ঠিক আছে ত!
সুরেন বুঝতে পারল না, এ-কথা কেন সে বলল,—রাজার কি অভাব আছে হামুবাবু, মাথা ঠিক থাকবে না!
—তুমি একখানা মানুষ বটে সুরেন। কাকের মত স্বভাব।
এই সক্কালে কাকের সঙ্গে তুলনা করায় সে খুব আহত হল। কাক হল নিম্নস্তরের প্রাণী। সে হল নবীনগরের গাঙ্গুলীবংশের মানুষ। দেশ ভাগ হয়ে গিয়ে এত ফের। তাই এই লোকটা তাকে যৎপরোনাস্তি কটুক্তি করছে। সে মুখ ব্যাজার করে বলল, কাক কেন বাবু, কোকিলের কথা বলুন।
—কোকিল কি আন্ধা আছে। তুমি একটা আন্ধার মত কথা বলছ। যেন কিছু জান না। খবর পাও নি!
সুরেন খুব মহামুশকিলে পড়ে গেছে।—কি খবর। এ-বাড়িতে ত সকাল হলেই খবর লেগে থাকে। সেই সেদিন, বৌরাণী নতুন ম্যানেজারকে অন্দরে ডেকে পাঠিয়েছিল বলে একটা খবর রটে গেল। ঘরে ঘরে এক কথা। এ-বাড়ির সব ভাঙছে। মানে সম্ভ্রমে সব। কোথাকার একটা উজবুককে শেষে কিনা অন্দরে ডেকে পাঠাল! কেবল ভাঙচুর হচ্ছে। এটাতেও সে মজা পায়।
তখনই হামুবাবু বলল, তোমার রাজার ফুটানি এবারে যাবে। বুঝেছ। বস্তি সব সরকার নিয়ে নেবে বলেছে। বিল আসছে।
সে বলল, তাই হয় যেন বাবু। সব যাক। ফিসফিস করে বলল, আমাদের রতনবাবু, চিনেন না, রাধিকাবাবুর শ্যালক। নলগায়ের এজেণ্ট ছিল, রাজা ওটাকে তাড়িয়েছে। লাখ টাকা নাকি মেরে দিয়ে সরে পড়েছে।
—রাজা কেস করছে না কেন?
—কেস! কি যে বলেন! রন্ধ্রে রন্ধ্রে পোকা। কোথাকার জল শেষে কোথায় গড়াবে—রাজা মামলা একেবারে পছন্দ করে না। কত খাবি, নে লাখ টাকা নিয়ে সুখে থাক।
—তাড়িয়ে দিল কেন! ওতো জেনে-শুনেই চোর পোষে। দু-পয়সা তোমার রাজারও হয়, তারও হয়। সাদা টাকা আর কে চায় এখন।
সুরেন বলল, তাহলে সিগারেট না থাকলে একটা বিড়ি দেন, ও বাতাসী তোর হল? আমার হয়েছে জ্বালা। বাবু আপনাকে কত বললাম, নবরে একটা কিছু করে দিন, মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। কাল সারারাত ফেরেনি। কি দুর্ভাবনা কন। সকালে হাজির। বললাম, কোথায় গেছিলি। তোর জননী সারারাত দুঃশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারেনি।
—কোথায় গেছিল!
—রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি গুনছিল নাকি।
—কে দিল এ-কাজ?
—নিজেই ঠিক করে নিয়েছে। পয়সা হাতে না থাকলে কি করবে। বলল, কাজটা খুবই ভাল। এতে কারো চোখ টাটায় না।
হামুবাবু বুঝতে পারল, বেকার থাকলে মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিতেই পারে।
—তুমি বললে না, গাড়ি গুণে কি হবে?
—আমার কথা শোনে!
—গাড়ি যখন গুণছে তখন ধূপকাঠি বিক্রি করছে না কেন?
সেটা বুঝিয়ে বলুন না আপনারা। তারপরই মনে হল, গাড়ির সঙ্গে ধূপকাঠির সম্পর্ক কি থাকতে পারে? সে বলল, এ কথা কেন বাবু?
—আজকাল দেখতে পাচ্ছ না, কত ধূপকাঠি জ্বলছে। সবাই ঘরে এখন ধূপকাঠি পোড়ায়। তোমাদের নতুন ম্যানেজারের নাকি গোছা গোছা ধূপকাঠি লাগে। ভাল খদ্দের। তারে পাকড়াও না।
—তারে ত কুম্ভবাবুরে ধরে সিট মেটালে ঢোকানো যায় কিনা দেখছি। কুম্ভবাবু নাকি হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে মানুষটাকে। কাজ একদম বোঝে না। কুম্ভবাবু পাশে না থাকলে চোখে আন্ধার দেখে।
—নবরে পাঠিয়ে দাও না নতুন ম্যানেজারের কাছে। কুম্ভ তোমাকে ঘোরাবে।
—পাঠাব কি বাবু পেনসিল নিয়ে বসে এখন অঙ্ক করছে।
—আবার পরীক্ষা দিচ্ছে নাকি!
—পরীক্ষা না বাবু। সকালে এসেই স্নানটান সেরে মাদুর বিছিয়ে বসে পড়েছে। কেবল গুণ অঙ্ক!
—এত গুণ দিয়ে কি হবে?
—কি নাকি হিসাব করে দেখছে। দেশের অপচয় কতটা দেখছে। এই অপচয় বন্ধ করলে, কতজন বেকার কাজ পেতে পারে তার একটা সরল অঙ্ক মাথায় এসে গেছে তার। কিছুতেই মাদুর থেকে ওঠানো গেল না।
—নবর মাথা পরিষ্কার ছিল। তুমি পড়ালে না সুরেন! আমার ঘরে এসে কাগজ পড়ে যায়। কত রকমের প্রশ্ন করে। আমি ঠিক উত্তর দিতে পারি না। হামুবাবুর মধ্যে এখন একটা ভালমানুষ দেখা দেওয়ায় খুব গম্ভীর গলায় কথা বলছে।
—খুব মনে রাখতে পারে। কিছু বললেই সাল তারিখ উল্লেখ করে বলবে, সব বেটা ফেরেববাজ। ঘুষখোর। ধান্দাবাজ। সেতো কাউকে মানে না বাবু। ঈশ্বর পর্যন্ত তার কাছে একটা হারামী। বলেন, এ ছেলের কি গতি হবে!
হামুবাবু এবার কি ভেবে বলল, এই বাতাসী যা। আজ আর আসতে হবে না। কাল সকালে কুম্ভবাবুর বাড়ি যাবার আগে একবার আসিস। আর সঙ্গে সঙ্গে বাতাসী বের হয়ে গেল। সুরেনের ইজ্জতে বড় লাগল। বাপের কথায় গ্রাহ্য নেই। বাপ নয়, কাকা নয়, মামাও নয় লোকটা, তার কথা কেবল শোনে। সুরেনের আবার কাশি উঠল। কফ উঠল। সে জানালার পাশেই কফটা ফেলে রাখল। কফের পোকা দেয়াল বেয়ে উঠুক। জখম করুক লোকটাকে। এ-মুহূর্তে সেও নেশাখোরের মত বলল, মানুষ জাতটাই হারামী। জাতটার সর্ব অঙ্গে ঘা হোক পোকা-হোক। বসে বসে দেখি। এবং এইসব বলতে বলতে সুরেনের মাথা গরম হয়ে গেল। সব তার হাতের নাগালের বাইরে। বড় ছেলে তাও বকে যাচ্ছে। সর্ব কনিষ্ঠটিও তার পুত্র সন্তান। হামাগুড়ি দেয়। উঠে দাঁড়ায় হাতে তালি বাজায়। পা পা করে হাঁটে। সামনে এক মানুষ সমান গর্ত। সারা বাড়ির মলমূত্র সেখান দিয়ে বয়ে যায়। ধর্মপত্নীকে বার বার সাবধান করে দিয়েছে, ডুববে। সব ডুববে। ধর্মপত্নীর এক কথা, কপালে থাকলে হবে। বিধাতার ওপর বড়ই বিশ্বাস! পাঁচ পাঁচটা নর্দমা পার হয়ে গেল, এই একটার বেলায় তেনার যত আদিখ্যেতা। কেউ তাকে মর্যাদা দেয় না। বাতাসী না, টেবি না, সুখী না। বড়টা তো এখন অঙ্ক নিয়ে বসেছে। কোথা থেকে বগল দাবা করে এনেছে কাটা কাগজ। তাতে একটা রোঁয়া ওঠা পেন্সিল দিয়ে লম্বা অঙ্ক করছে। কার মাথা ঠিক থাকে! এখন গিয়ে লাথি কষালে হয়! হারামজাদা ইতর, কাজের কাজ না করে অঙ্ক করা। অঙ্ক করবে বাবুরা। তেনাদের হিসাব রাখতে হয়। তোর আছেটা কি হিসাব রাখবি! নর্দমা পার হয়েই হাঁক পাড়ল, বাবা নব, অঙ্ক তোমার হল?
—না বাবা। এই আর একটু, তবেই হিসাব মিলে যাবে।
—বাবা নব, তুমি আর অঙ্ক কর না। হামুবাবু বলল, ধূপকাঠি বিক্রি করতে। পুঁজি কম লাগে। নতুন ম্যানেজার বড় খদ্দের। সময় থাকতে পাকড়ে ফেল।
নবর বড় বড় চুলে কপাল ঢাকা। সে নুয়ে অঙ্ক করছে। শিরদাঁড়াটা দাঁড়াশ সাপের মত মোটা হয়ে নেমে গেছে কোমরে। সব ক’টা পাঁজরের হাড় গোনা যায়। তবু অঙ্কের হিসাব মেলে না। যতবার গুনেছে এক দিকে দশটা অপর দিকে এগারটা। ডাক্তারবাবু তার পাঁজরার হিসাব দিয়েছিল, বাইশটা। কে ঠিক জানে না নব, না ডাক্তারবাবু। তার নিচে দুটো হলদে থলে পাঁঠার ফুসফুসের মত। তার ফুসফুসে নাকি বিজবিজে পোকা বাসা বানিয়েছে। সে ভাল হয়ে যাওয়া মানেই সেখানে বড় রকমের একটা হত্যাযজ্ঞ।
সে আবার বলল, বাবা নব, তোমার অঙ্কের বিষয়টা জানতে পারি? হামুবাবু বললেন, বিষয়টা জেনে নাও।
—হামুবাবুকে বলবে, ওকে ধরে আমি ঠ্যাঙাবো, অঙ্ক করছি, এখন ডিস্টার্ব করবে না।
—তুমি বারান্দা থেকে নেমে অঙ্কটা কষ। আমার স্নানের সময় হয়েছে। দুটো মুখে দেব বাবা। নব খুব দার্শনিকের মত উবু হয়েই বলল, খাওয়াটা বড় কথা নয়। খেলে পেট ভরে। এটুকু হলেই তোমার বাসনা উবে যায়। কিন্তু তারপরেও কিছু থাকে। তার খবর রাখ না!
—অত খবরে কাজ নেই বাবা নব। আমি অবগাহনে যাচ্ছি। তুমি নতুন ম্যানেজারকে গিয়ে বলে এস, এবার থেকে যত ধূপকাঠি লাগবে তুমি দেবে। পয়লা এই দিয়ে শুরু করে দাও। আলামোহন জীবন এ-ভাবেই শুরু করেছিলেন জান?
নব জানে, এগুলো সবই বাবার ধর্ম কথা। সেই কবে থেকে নজির টেনে আসছে। বাপের বিদ্যে ক্লাস এইট পর্যন্ত। ঐ বিদ্যায় যা খবর সংগ্রহ করেছিল সেটাই এখন জীবনে মূলধন হয়ে আছে। এই নিয়ে তার কাছে একশ আটাশবার বাবা আলামোহন দাসের নজির টানলেন। সে অঙ্কটা করছে বলে মাথা গরম করতে পারছে না। তা না হলে কুরুক্ষেত্র বেধে যেত। এটাও এ-বাড়ির সকাল বিকেলের ধর্মযুদ্ধ! সে তাই মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলল, অঙ্কের হিসেবটা শোনো তাহলেই মাথায় খাওয়া উঠে যাবে। ভি আই পিতে চব্বিশ ঘণ্টায় গাড়ির সংখ্যা তোমার সতের হাজার চারশ আটাশ। এই সংখ্যাকে তুমি গুণ দাও তিনশ পয়ষট্টি দিয়ে। তোমার মনে আছে ত এই কটা দিনে পৃথিবীতে বছর হয়। তারপর গুণ কর গড়ে চার লিটার তেল। তারপর গুণ কর।
—কি দিয়ে গুণ করব বাবা?
—দাম। তেলের দাম। কত টাকা হয় জান। তোমার মাথায় আসবে না। বাবুদের বাবুগিরিতে একটা পঞ্চাশ হাজার একর জমির চাষ বছরে ভি আই পিতে উবে যায়। এই দেশে কত এমন ভি আই পি আছে। কত পঞ্চাশ হাজার একর চাষ হতে পারে কত পঞ্চাশ লক্ষ বেকার চাকরি পেতে পারে ভেবে দেখ।
সুরেন ভাবল ছাওয়ালের মাথাটি গেছে। রেগে গেলে মাতৃভাষা তার লব্জে আসে। সে বলল, বাইর হ শুয়ার। বাইরাইয়া যা। সে কি খুঁজতে থাকল। বোধ হয় লাঠিটাটি, সে আত্মরক্ষার্তে লাঠি টেনে বের করতে গেল।
বাপের এই রাগকে নব গ্রাহ্য করে না। লাঠি টেনে এনে মাথায় তুলতেই খপ করে ধরে ফেলল। পাশের খুপরি থেকে তখন বের হয়ে আসছে ছুতোর হরিচরণ, তার বৌ, ছোট মেয়েটা। তার পাশ থেকে ছুটে এসেছে রাজমিস্ত্রি অধীর। বিপত্নীক বলে একা। সঙ্গে পুটি ডবকা ছুড়িটা। নবর সঙ্গে মাঝে মাঝে ঠাট্টা-তামাশা করে। কোলাহল শুনে বাবুর্চিপাড়ার লোকজনও ছুটে এল। এরা সব একই লাইনবন্দী লোক। দুঃখ-কষ্টে একই গোত্রের মানুষ। সুরেনের আজ আবার কি নিয়ে মাথা গরম হয়েছে! ওরা এসে দেখল নব বাপের লাঠি কেড়ে নিয়ে সুরেনের বুকের ওপর চেপে বসে আছে। আর মুখের ওপর আঠা দিয়ে জোড়া একটা লম্বা কাগজ। সে সেটা খুব নিবিষ্ট মনে দেখছে। নিশ্চিন্তে মুখ আড়াল করে হিসাবটা ফের মিলিয়ে দেখছে।
সবাইকে লক্ষ্য করে সুরেন বলল, বলেন, কার মাথা ঠিক থাকে। তুই আমার জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ, তুই আমার শ্রাদ্ধের অধিকারী আর তুই তোর পিতৃদেবকে কলা দেখাস। দিনরাত টোটো করে ঘুরে বেড়াস।
রাজমিস্ত্রি অধীর বলল, দিনকাল খুব খারাপ। আমাদের সময় যা হক করে কেটে গেল। বড় খারাপ দিন আসছে। লোক সব না খেয়ে মরে যাবে। কলিতে মানুষের হেনস্তা কত। আগে থেকে হিসেব করে না চললে তারপর ডডনং। রাস্তায় ঐ পাগলটার মত হাঁকতে হবে—কি যেন হাঁকে, ও হরিচরণ, কি যেন সাধুবাক্য কয়।
—ও মনে থাকে না। কাল দেখি পাগলার মাথায় একটা কাগের পালক বাঁধা মাঝ রাস্তায় ঊর্ধ্বনেত্রে দাঁড়িয়ে আছে।
তখনই কেমন হুঁশ ফিরে এল সুরেনের। তার জ্যেষ্ঠপুত্র পাগল হয়ে যাচ্ছে না ত। সে নবকে ঠেলে বুকের ওপর থেকে ফেলে উঠে বসল। পাগলের উপদ্রব খুবই বেড়েছে। দোতলা বাড়িটায় থাকে পাগলাবাবু নতুন ম্যানেজারের মাথায়ও কি নাকি গণ্ডগোল আছে! সারা রাত ধরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে নাকি বসে ছিল। আর পাগলাবাবুর ত কথাই নেই। নতুন বাবু আসার পরই কেমন বিবেচক মানুষ হয়ে গেল। বিকেলে এখন মাঠে বেড়াবার অনুমতি পর্যন্ত পেয়ে গেছে। সে বলল, বাবা নব, মাথা ঠাণ্ডা কর। মাথার মধ্যে গ্যাঁজা দিস না। ওতে বিপত্তি বাড়ে। তোর চাকরির ভাবনা কি। কুম্ভবাবু বলেছে সিট মেটালে তোর একটা কিছু হয়ে যাবে বাবা। ছেলের মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য সাহস দিল। যেন সব ঠিক হয়ে গেছে।
হরিচরণ বলল, তুমি যাও সুরেনদা। এখানে থাকলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। অগত্যা সুরেন অবগাহন করবে বলে বের হয়ে গেল। সামনেই দুটো বড় বড় পুকুর। এ-ছাড়া আছে অন্দরের পুকুর। অন্দরের পুকুরের চারপাশে উঁচু দেয়াল। তার ওপর কাঁটাতারের বেড়া। ও পাশে মাঠ। মাঠের পর গোয়ালবাড়ি—তারপর জেলখানার মত উঁচু পাঁচিল। অন্দরে নতুন বৌরাণী সকালে সাঁতার কাটেন। গায়ে-পায়ে প্রায় নাকি উলঙ্গই থাকেন তখন। একমাত্র খাস বেয়ারা শঙ্খ থাকতে পারে কাছে। তার হাতে তোয়ালে, গন্ধ সাবান এবং কতরকমের সুগন্ধী তেল। কুমারবাহাদুর বেতের চেয়ারে পাশের লনে বসে থাকেন। নভেল পড়েন। চুরুট খান। বৌরাণী এসেই একটা নিজস্ব ফুলের বাগান করেছেন। সেখানে দুজনে জ্যোৎস্না রাতে ঘুরে বেড়ান। কত সব পাথরের মূর্তি সেখানে। স্নানে গেলেই সুরেনের কেন যে মনে হয় পাঁচিল বেয়ে একবার অন্দরের পুকুরটা উঁকি দিয়ে দেখে। কি ফল, কি গাছ কি দেবদেবীর মূর্তি আছে ওখানে দেখার একটা ঘুসঘুসে ইচ্ছা পুকুরের পাড়ে এলেই সুরেনকে কেন জানি পেয়ে বসে। সে এই খোলা পুকুরে সাঁতার কাটছে, তাকে দেখার কেউ নেই। সেও একসময় মেঘনা নদী পার হয়ে যেত। সেও একবার আসমানদি চরে সাঁতার দিয়ে রুপোর মেডেল পেয়েছিল। ধর্মপত্নী তার সাক্ষী। আর তখনই টেবি সুখী আরও কেউ কেউ ছুটে আসছে। হাউহাউ করে চিৎকার করছে। আর্ত চিৎকার–বাবা তাড়াতাড়ি উঠে এস। দাদা কি করছে! কেমন করছে। সবাই জোরজার করে ধরে রেখেছে। বাবা! বাবা!
মাথার সব উবে গেল সুরেনের। সে এসে দেখল নবর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে সবাই। হরিচরণ হাত-পা বাঁধছে। সে বলল, কী হল নব বাবা? তোমরা ওকে ছেড়ে দাও। আমি দেখছি।
আরও সব লোকজন ছুটে এসেছে—প্রায় রাজবাড়ি ভেঙে। নব মাথা ঠুকছিল দেয়ালে। আমাদের ইজ্জত সব কেড়ে নিচ্ছে কেন। কেন, কেন? কপাল থেকে রক্ত পড়ছে। তারপরই সে কেমন হাত ছুঁড়ে বলল, খুন হবে, খুন। একটা খুন হবে। বলতে বলতে সে ছুটে রাজবাড়ির দেউড়ি পার হয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
অতীশ চেঁচামেচি শুনে বারান্দায় বের হয়ে এল। দেখল কিছু লোক দেউড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে দেখল কুম্ভবাবুর ভাইরা, দাসবাবু তার ছেলেমেয়ে, ওদিক থেকে আসছে। সে বলল, কি হয়েছে নিমু?
সুরেনের ছেলেটা বোধ হয় আত্মহত্যা করতে গেল।
—কোথায় গেল?
—রাস্তায়! গাড়ির তলায় চাপা পড়ে মরবে বলছে।
—কি হয়েছিল?
—চাকরি পাচ্ছে না। কাল নাকি সারা দিন ভি আই পিতে দাঁড়িয়ে গাড়ি গুনেছে।
এই অশুভ খবর অতীশকে খুবই বিড়ম্বনায় ফেলে দেয়। সে বুঝতে পারে না, সুরেন এতদিন এই বাড়িতে কালাতিপাত করেও কেন ছেলের একটা কাজ সংগ্রহ করতে পারে না। সে দেখল তখন সুরেন ফিরে আসছে। অতীশ ওপর থেকেই বলল, পেলে?
—না। সুরেন মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছিল। মানুষের সন্তান কত প্রিয়—এই মানুষটারও তাই। চোখ মুখ শুকনো বিপর্যস্ত এক মানুষ সুরেন। সে যদি এখন ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় তবু যেন তার সাতখুন মাপ। সে বলল, তুমি একবার দেখা কর সুরেন।
সে বলল, এখন ত হবে না বাবু। অফিসের টাইম হয়ে গেছে। পরে যাব।
আসলে মানুষ সেই কবে থেকে ক্রীতদাস পালন করে আসছে। তার থেকে মানুষ এখনও মুক্তি পায়নি। সুরেন এখন ক্রীতদাসের ভূমিকা পালন করছে। তার নিজের মরার সময়টুকু নেই। ঠিকমত হাজিরা না দিলে—কোনদিন একটা নোটিশ ধরিয়ে দেবে। তার লায়েক ছেলেটা কোথায় কি করছে এই মুহূর্তে তা নিয়ে ভাববারও সময় নেই। সবারই সন্তান-সন্তুতি থাকে। তার নিজেরও আছে। সে কেমন বিচলিত বোধ করল। সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকল। তারপর সুরেনকে ডেকে বলল, কোন দিকে গেছে বলতে পার?
সুরেন হতাশ গলায় বলল, মনু খানসামা লেন দিয়ে কোথায় চলে গেল।
অতীশের এই এক বিড়ম্বনা—কোথায় গেল বাপের কোনও তাড়া নেই। সে কুম্ভবাবুর বাড়ির পাশে আসতেই দেখল, একটা জটলা। অতীশকে দেখে কেউ কেউ চুপ করে গেল। কুম্ভবাবু দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অতীশকে দেখেই বলল, আসুন দাদা, ঘরে আসুন।
—সুরেনের ছেলেটা নাকি চলে গেছে?
—আবার আসবে।
—বাসটাসের তলায় পড়ে নাকি মরবে বলছে।
—কতবার মরে এরা। সে-নিয়ে আপনার মাথা খারাপ করে কি হবে দাদা। আমরা কি করতে পারি। সরকারই কিছু করছে না। রাজাকে বললেই বলবে, দেয়ার ইজ গভমেণ্ট, গো টু হিম। আমরা তো শোষণ করছি, আমাদের কাছে আর আসা কেন।
অতীশ এ-মুহূর্তে এই ছেলেটার জন্য আর কার কাছে যাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।
সকালে উঠেই অতীশের কিছু লেখালিখি থাকে। লেখা নিয়ে নিবিষ্ট থাকতে হয়। আজ সকালে উঠে একটা লাইন লেখা হয়নি। বাড়ির জন্য মনটা কেমন খারাপ হয়ে আছে। নির্মলা লিখেছে, টুটুলের জ্বর। বাবা নেই বলে মিণ্টুর মন খারাপ। সে স্ত্রী পুত্র ছেড়ে কোথাও এতদিন একা থাকেনি। সকালেই সে একবার তার কোয়ার্টার দেখতে গিয়েছিল। বড় বড় তিনখানা ঘর! সামনে লম্বা বারান্দা। রান্নাঘর বাথরুম। অন্দরের লাগোয়া ঘর। দরজায় দাঁড়ালে অন্দরের গাড়িবারান্দা দেখা যায়। সামনে সব বড় বড় পাতাবাহারের গাছ।
সবই ভাল—তবে খুব পুরানো বাড়ি বলে ঘরের পলেস্তারা সব খসে পড়েছে। এখন মেরামত হচ্ছে সব। মেঝের জায়গায় জায়গায় তাপ্পিমারা। উঁচু শিলিং। আগেকার আমলের ঘরবাড়ি যেমন হয়ে থাকে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব দরজা। মেরামত শেষ হলে হোয়াইট ওয়াস। তারপরই সে নির্মলাকে নিয়ে আসতে পারবে। শনিবারে ভেবেছিল বাড়ি চলে যাবে— কয়েকদিনেই সে এখানে কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে। কেমন একটা বন্দী জীবন—সব সময় নিরাপত্তা বোধের অভাব। বিশেষ করে তার অফিসে বসলে সে এটা বেশি টের পায়। লুজিং কনসার্ন। প্রিন্টিং সেকেলে, গ্লেজ ঠিক আসে না। লিথো প্রিন্টিং এখন অচল। এই অচল কারখানার সে ম্যানেজার। কর্মীদের মাইনে দেখে সে খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। সব চেয়ে বেশি বেতন পায় প্রিন্টিংম্যান মণিলাল সেটা দু’শ টাকাও নয়। হেলপারদের মাইনে সাতাশ টাকা। সাতাশ টাকায় কি হয়! সে একজন কর্মীকে ডেকে বলেছিল, তোর কে আছে? সে বলেছিল, কেউ নেই। সাতাশ টাকায় স্যার কেউ থাকলে চলে না! ফুটপাথে থাকি। চা-পাঁউরুটি খাই। তারপরও যা বলেছে তাতে সে আরও হতবাক হয়ে গেছিল। মাইনে পাবার দিনে শুধু ভাত খায়। মাইনে হলে সে কলের জলে ভাল করে স্নান করে নেয়। ঐ একটা দিনই তার প্রকৃতপক্ষে স্নান আহার। এ-সব শুনে সে আর বেশি কথা বলতে সাহস পায়নি। দেখলেই ভয় ধরে যায়। যে কোন মুহূর্তে এরা ওর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। তার এখন মনে হচ্ছে, সুরেনকে দেখা করতে বলে খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ করেনি। সে সুরেনের ছেলেকে একটা হেলপারের কাজ অবশ্য দিতে পারে। এতে সে তার নিজের বিরুদ্ধে আরও একজন শত্রু তৈরি করবে। তবু মনের মধ্যে কি থেকে যায়, সুরেনের জন্য তার কষ্টবোধ বাড়ে।
অফিসে যাবার সময় এ-নিয়ে একবার কুমারবাহাদুরের সঙ্গে কথা বলল। যে কোন কারণেই হোক কুমারবাহাদুর অতীশকে অন্য গোত্রের মানুষ ভেবে থাকে। তিনি বললেন, ব্যালেন্সসীট দেখেছ?
অতীশ বলল, দেখেছি।
—এরপর লোক নেওয়া ঠিক হবে কিনা ভেবে দ্যাখ।
অতীশ কেমন শিশুসুলভ হাসিতে বলল, একজন নিলে আপনার আর কত ক্ষতি হবে দাদা?
কুমারবাহাদুর জানেন, অতীশই এমনভাবে কথা বলতে পারে। তিনি বললেন, তোমার কারখানা, যা ভাল বোঝ করবে।
অতীশ বাইরে এসে দেখল, সুরেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকে বলল, কাল তোমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিও। কিছু একটা হয়ে যাবে। কুম্ভবাবু পাশের চেয়ারে বসেছিল। সে কথাটা শুনে চোখ কেমন ছোট করে ফেলল। অতীশের মাথা হেঁট করে কুমারবাহাদুরের ঘরে সে অবশ্য যেতে পারে না। তার সম্বল তার বাপ রাধিকাবাবু। কাবুল আর প্রাইভেট অফিসের স্যার—সনৎবাবু। সনৎবাবুকে সে গিয়ে চুপিচুপি বলল, স্যার অতীশবাবু সুরেনের ছেলেকে কারখানায় কাজ দেবে বলেছে। আপনি জানলেন না, আপনাকে না জানিয়ে এটা হচ্ছে। আমি নিজেই এতে অপমান বোধ করছি।
সনৎবাবু দলিলের কপি মেলাচ্ছিলেন বসে বসে। পাশে একজন সেরাস্তাদার। এই কপি নিয়ে আজই উকিলের কাছে ছুটতে হবে। সব বস্তি অঞ্চলটাকে একটা পাবলিক লিমিটেডে কেস দেওয়া হচ্ছে। বছরকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প জুডিসিয়েল স্ট্যাম্প সব জমা থাকে। সবই ব্যাক ডেটে করা হচ্ছে। রেজিস্টারকে বড় রকমের ঘুষ দিলেই বাকি কাজটা হয়ে যাবে। এ-সব খুবই নটঘটে কাজ। দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাথা খারাপ, ঠিক এই সময়ে এমন খবরে তিনি খুবই চটে গেলেন। বললেন, অতীশকে ডাকো।
কুম্ভবাবুর বাপ রাধিকাবাবু পাশের টেবিল থেকে উঠে এসে বলল, স্যার এখন না। আগে কুমারবাহাদুরের সঙ্গে কথা বলুন। মনে হয় অতীশ কুমারবাহাদুরের সঙ্গে কথা বলেই করেছে। ওখানে ঠিক না করে, অতীশকে বললে ভুল করবেন।
পরদিন সকালে অতীশকে এসে সুরেনই ডেকে নিয়ে গেল। রাস্তায় অতীশ বলল, ছেলেকে পাঠিয়ে দিও কিন্তু। কাল শুনলাম রাতে ফিরে এসেছে।
—যাবে বাবু। আপনি মা বাবা। একটু দেখবেন। আমার বড় আদরের ছেলে নব। জ্যেষ্ঠ সন্তান কার না আদরের হয় বলেন।
অতীশ কুমারবাহাদুরের ঘরে ঢুকেই দেখল তিনি একগাদা চিঠিপত্র নিয়ে ব্যস্ত। চিঠিগুলো তাঁর বেয়ারা সুরজিত কাঁচি দিয়ে মুখ কেটে রেখেছে। তিনি একটা করে চিঠি বের করছেন, আর লাল পেনসিলে টিক মেরে যাচ্ছেন। কোথাও সামান্য নোট দিচ্ছেন কিছু। সে যে দাঁড়িয়ে আছে তিনি যেন খেয়ালই করছেন না। চিঠি দেখতে দেখতেই সহসা বললেন, সুরেনের ছেলেকে কাজ দেওয়া ঠিক হবে না। অতীশ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তিনি ফের বললেন, কারো কারো ইচ্ছে নয় তার এখানে কাজ হোক। মাথা গরম ছোকরা, তুমি বিপদে পড়বে।
—কিন্তু কথা দিয়েছি।
—কথার দাম আমরা এখন ক’জন রাখতে পারি। সরকারই রাখতে পারছে না।
—এটা মানসম্মানের প্রশ্ন।
—সেটা আমাদের বাপ-জ্যাঠাদের আমলে ছিল।
অতীশ বলল, কতটা আর ও ক্ষতি করতে পারে?
—অনেক। আরে তুমি এতটুকুতেই বিচলিত হলে চলবে কি করে? চার পাশে চোখ মেলে দেখ। রাস্তায় পাঁচিলের পাশে কত আঁস্তাকুড়। তুমি ভাঙতে পারবে। বলেই তিনি বেল টিপলেন। দরজার পাশে অন্য কোনও আমলা অপেক্ষা করছে। তাকে তিনি ডেকে পাঠালেন। অতীশ বুঝতে পারল, কুমারবাহাদুর এ-নিয়ে তার সঙ্গে আর কোনও কথা বলতে চান না। তার চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে যাচ্ছে। গায়ের রক্তে কোথায় যেন অসম্মানের কাঁটা বিজবিজ করছে। মগজের ঘিলুতে কেউ সূচ ফোটাচ্ছে। সুরেনকে কি বলবে! তার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা আর্চির কাজ। আর্চির সেই প্রেতাত্মার প্রভাব। তার মাথার মধ্যে তক্ষুনি ঘণ্টাধ্বনি শুরু হয়। সেই কবে থেকে সেটা হয়ে আসছে। সে ঘেমে যাচ্ছিল। কুমারবাহাদুর তার দিকে একবার চোখ তুলেও তাকায়নি। ভারি ঠাণ্ডা ব্যবহার। কেন এমন হয়! সেতো কারো প্রতি বিরূপ নয়, শত্রুতা করেনি। তবে কেন তাকে এভাবে বিড়ম্বনার মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপরই শুনতে পেল সুদূর থেকে কারা যেন কিছু বলে যাচ্ছে—পৃথিবীতে সর্বত্রই আর্চিরা রয়েছে অতীশ, ঘাবড়ে যেও না। দূরাতীত কোনও গ্রহের মধ্যে জীবনের দেখা সেই তিন মহাপুরুষ যেন হাত তুলে দিয়েছেন—দেখল সেখানে ঈশম, সারেঙসাব, আর স্যালি হিগিনস—তাঁদের হাত সে দেখতে পেল অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। মাথা নিচু করে সে ধীরে ধীরে অগত্যা বের হয়ে এল। তার এখন সত্যি আর কিছু যেন করণীয় নেই।