পুলিশ অফিস।
মি. হারুন এবং মি. হোসেন ও অন্যান্য পুলিশ অফিসার বসে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল। শংকর রাওও সেখানে উপস্থিত রয়েছেন।
মনিরার ব্যাপার নিয়েই আলাপ চলছিল।
মি. হারুন বলেন–দেখলেন তো মি. রাও, আপনি বলেছিলেন মনিরাকে জোরপূর্বক চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু আসলে সে নিজেই বাড়ি থেকে চলে গেছে, তার প্রিয়জনের সঙ্গেই গেছে এবং এখন তার সঙ্গেই আছে।
শংকর রাও বিজ্ঞের মত মাথা দোলালেন-না, এটা আমি বিশ্বাস করি না মি. হারুন, কারণ আমি সেদিন চৌধুরী সাহেবের বাড়ির বেলকনিতে বেশ কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম। তা ছাড়া মিস মনিরার স্যান্ডেল সিঁড়িতে পাওয়া গেছে।
আপনি কি তাহলে মিস মনিরার চিঠি অস্বীকার করেন?
হ্যাঁ করি। এমনওতো হতে পারে চিঠিখানা মিস মনিরার হাতের লেখার অনুকরণে লেখা হয়েছে!
অসম্ভব, কারণ তার মামা চৌধুরী সাহেব ভাগনীর হাতের লেখা বেশ চেনেন।
দেখুন মি. হারুন, মিস মনিরা যে স্বেচ্ছায় যায়নি তার আরও একটি জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ-চৌধুরী সাহেবের বাড়ির পুরানো দারোয়ানের খুন। দস্যু বনহুরের সঙ্গেই যদি সে স্বেচ্ছায় যাবে, তাহলে একটা নিরীহ লোককে কেন খুন করা হবে?
এই সামান্য ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারছেন না মি. রাও? যখন তারা চৌধুরী বাড়ি থেকে পালাচ্ছিল তখন হয়তো সেই দারোয়ান বাধা দিতে গিয়েছিল। দস্যুর আবার দয়ামায়া!
এমন সময় একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক কক্ষে প্রবেশ করেন। চোখেমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ। ভারী পাওয়ারের চশমাটা ভালো করে চোখের ওপর তুলে দিয়ে বলেন–ইন্সপেক্টর মি. হারুন কে?
মি. হারুন লোকটার আচমকা প্রবেশে মনে মনে রেগে গিয়েছিলেন, গম্ভীর কণ্ঠে বলেন– কি চান?
প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলেন–আপনি বুঝি মি. হারুন?
হ্যাঁ, বলুন কি দরকার?
দেখুন, আমি মাধবগঞ্জের একজন ডাক্তার। আমার নাম নওশের আলী। গত রাতে আমাকে একজন লোক রোগী দেখার নাম করে ডেকে নিয়ে যায়। আমিও টাকার লোভে কিছু না ভেবে রোগী দেখতে যাই।
বসুন, বসে বলুন।
বৃদ্ধা বসে পড়ে বলতে শুরু করেন, আমাকে ওরা একটা ট্যাক্সিতে নিয়ে যায়। তারপর পায়ে হেঁটে-সে কি ভয়ংকর বন। বনের মধ্যে দিয়ে আমাকে নিয়ে ওরা যখন গন্তব্যস্থানে পৌঁছাল, তখন ভয়ে আমার কণ্ঠ শুকিয়ে এসেছে। এতক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম, তবু নিশ্চুপ রইলাম, কারণ কিছু বলতে গিয়ে শেষে জীবনটা হারাব নাকি?
আগ্রহভরা কণ্ঠে বলেন মি. হারুন-তারপর?
তারপর একটা পর্বতের পাদমূলে আমাকে নিয়ে ওরা হাজির করল। সেই পর্বতের নিকটে দাঁড়িয়ে একটা লোক তিনবার শিস দিল, সঙ্গে সঙ্গে পর্বতের গায়ের একটা বিরাট পাথর এক পাশে সরে গেল।
কক্ষের সবাই উদ্বিগ্নচিত্তে প্রৌঢ় ভদ্রলোকের কথা শুনছেন। সকলেরই চোখেমুখে বিস্ময়। মি. রাও বলেন–বলুন, তারপর কি হলো?
দেখলাম পাথরটা সরে গিয়ে তার মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো এক সুড়ঙ্গপথ।
সেই পথের ভেতরে প্রবেশ করলেন বুঝি?
হ্যাঁ, তবে ভেতরে প্রবেশ করে স্তম্ভিত হলাম। তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম-তারা স্বাভাবিক লোক নয়। এই যে দেশময় রাহাজানি আর লুটতরাজ চলছে, নারীহরণ চলছে, এর পেছনে রয়েছে সেই লোকগুলো। আসল কথা, তারা ডাকাতের দল এবং ওটা তাদের আস্তানা।
আশ্চর্য! অস্কুটধ্বনি করে ওঠেন মি. হারুন।
ভদ্রলোক আবার বলেন–আমি তাদের কথাবার্তায় আরও বুঝতে পেরেছি-সেই পর্বতটার নাম জম্বুর পর্বত এবং ঐ জায়গাটা পর্বতের দক্ষিণ কোণে। ইন্সপেক্টর সাহেব, আপনার কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনি পুলিশ ফোর্স নিয়ে সেখানে যান। তারপর পকেট হাতড়ে একটি কাগজ বের করে এগিয়ে দেন এই নিন, আমি সেই পর্বতের গুপ্ত দরজার ছবি তৈয়ার করে এসেছি, এতে পথ-ঘাটের ছবি সুন্দর করে আঁকা রয়েছে।
মি. হোসেন বলে ওঠেন-কি রোগী দেখলেন তা তো বললেন না?
হাঁ বলছি, একটু থেমে বলেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক-রোগীর কোন অসুখ নয়, শরীরে ভীষণ বেদনা আর জখম। হয়তো কোথাও মারধোর খেয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি ঔষুধপত্র দিয়ে বিদায় হলাম। ওরাই আবার আমাকে রেখে গেল। কিন্তু বাড়িতে নয়-একটা নির্জন পথের ধারে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো ওরা। এই তো ভোরবেলার কথা। আমি বাড়িতে গিয়েই ওষুধের বাক্সটা রেখে ছুটে এসেছি। ইন্সপেক্টর, আপনি ওদের পাকড়াও করার ব্যবস্থা করুন। আপনি পুলিশ ফোর্স পাঠাবার ব্যবস্থা করুন সেখানে, নইলে পালাবে ওরা।
মি. হারুন বলেন–আপনাকেও যেতে হবে পথ দেখিয়ে দেবার জন্য!
আমি-আমি যে বুড়ো মানুষ।
তবে বলতে এলেন কেন? জানেন এটা পুলিশ অফিস–
আমি এতটুকুও মিথ্যা বলিনি। কিন্তু রাত শেষ প্রহরে যাবেন, তার পূর্বে নয়।
আপনি যেতে পারবেন না?
আমার শরীর ভাল নয়, এইটুকু পথ এসেই হাঁপিয়ে পড়েছি।
শংকর রাও বলেন–মি. হারুন, ইনি যা বলছেন তা সত্য। আপনি এর কথামতই কাজ করুন, কারণ আমার মনে হয় সেই দুষ্ট শয়তানের দল পালিয়ে জম্বুর পর্বতে আশ্রয় নিয়েছে।
মি. হোসেন মি. শংকর রাওয়ের কথায় যোগ দেন–হ্যাঁ,আমারও সেই রকমই মনে হয়।
ভদ্রলোক তার পুরা নাম ঠিকানা দিয়ে বিদায় গ্রহণ করলেন।
ভদ্রলোক চলে যেতেই শংকর রাও বলেন–মি. হারুন, আপনি কি মনে করছেন?
হ্যাঁ, একবার যেতেই হবে সেখানে। লোকটার কথা বোধ হয় মিথ্যা নয়। তারপর ঐ ভদ্রলোকের দেয়া ম্যাপখানা মেলে ধরলেন টেবিলে।
মি. হারুন, মি. রাও এবং মি. হোসেনের মধ্যে ম্যাপ নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ-আলোচনা চলল, তারপর উঠে পড়লেন সকলে।
সন্ধ্যার পূর্বেই পুলিশ-ফোর্স নিয়ে তৈরি হয়ে নিলেন মি. হারুন। পুলিশদেরকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অতি গোপনে জন্ধুর পর্বতের দিকে রওনা দিতে নির্দেশ দিলেন। বহু দূরের পথ এই জম্বুর পর্বত। বহু বন, ঝোঁপঝাড়, ছোট ছোট পাহাড় টিলা পার হয়ে তবেই তারা পৌঁছবে সেই পর্বতে।
মি. হারুন আর মি. হোসেনের সঙ্গে শংকর রাও-ও চললেন। মি. হারুন টর্চলাইট ধরে পথ চিনে নিচ্ছিলেন। ম্যাপখানা এত সুন্দরভাবে আঁকা হয়েছিল যে, পথ চিনে নিতে এতটুকু কষ্ট হচ্ছিল না তাদের।
জম্বুর পর্বতের পাদমূলে পৌঁছে রেডিয়াম হাতঘড়ির দিকে তাকালেন মি. হারুন। রাত তখন। তিনটে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁরা এই পথ ধরে এসেছেন।
টর্চের আলো ফেলে আর একবার ম্যাপ দেখে নিলেন মি. হারুন এবং মি. হোসেন। খুশিতে তারা আত্মহারা হলেন-ঠিক জায়গায় পৌঁছতে তাঁরা সক্ষম হয়েছেন! ম্যাপ ধরে আরও কিছুটা দক্ষিণে এগুলেন, কিন্তু কই, এখানে তো কোন সুড়ঙ্গ বা পথের চিহ্ন নেই। শুধু পাথর আর পাথরে পর্বতের গা ঢাকা রয়েছে। স্থানে স্থানে ছোট ছোট আগাছা আর ঝোঁপঝাড়। আর রয়েছে অশ্বথ বৃক্ষ ও নাম না জানা কত বড় বড় গাছ।
মি. হারুন পর্বতের পাশে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালেন-হা, তাঁর পুলিশ ফোর্স এসে পৌঁছে গেছে। এক-একজন এক একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।
মি. হোসেন এবং শংকর রাও গুলীভরা রিভলবার হাতে মি. হারুনের পেছনে একটা ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে রইলেন।
মি. হারুন মুখের মধ্যে দুটি আংগুল দিয়ে খুব জোরে শিস দিলেন-একবার দু’বার তিন বার। হঠাৎ একটা হুড় হুড় শব্দ কানে এলো তাদের। মি. হারুন আশ্চর্য হয়ে দেখলেন-তাঁর সামনে পর্বতের গা থেকে একটি বিরাট পাথর একদিকে সরে যাচ্ছে। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল। তিনি স্পষ্ট দেখলেন-পর্বতের গায়ে একটি সুড়ঙ্গপথ বেরিয়ে এসেছে।
মি. হারুন সুড়ঙ্গপথে গিয়ে দাঁড়ালেন, সঙ্গে সঙ্গে বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। অমনি পুলিশ ফোর্স এবং মি. হোসেন ও শংকর রাও সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করলেন।
মি. হারুন এবং পুলিশ ফোর্স ভেতরে প্রবেশ করতেই দু’জন মশালধারী মশাল দূরে নিক্ষেপ করে ছুটে পালাল।
মি. হারুন এবং মি. হোসেন মশাল দু’টি কুড়িয়ে নিয়ে রিভলবার উদ্যত করে দ্রুতগতিতে এগুলেন, পেছনের পুলিশ ফোর্স ছড়িয়ে পড়ল সুড়ঙ্গের ভেতরে।
অল্পক্ষণের মধ্যে দশজন ডাকাতকে তাঁরা পাকড়াও করতে সক্ষম হলেন। কিন্তু নাথুরামকে। তারা ধরতে পারলেন না। নাথুরাম একটি গুপ্তগর্তে আত্মগোপন করে রইলো।
তখন মুরাদ মনিরাকে নিয়ে সন্ন্যাসীর কাছে গিয়েছে। তাই মি. হারুনের হাত থেকে এ যাত্রা পরিত্রাণ পেল সে।
মি. হারুন ডাকাতের দলকে পাকড়াও করে নিয়ে চললেন। পূর্ব আকাশ; তখন ফর্সা হয়ে আসছে!
সবাই চলে যাবার পর নাথুরাম তার গুপ্ত গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো, দাঁতে দ্রুত পিষে বলল–একটি আগেও যদি জানতাম তাহলে সমস্ত পর্বতটাকে উড়িয়ে পুলিশ বাহিনীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে ফেলতাম। তার কর্কশ কণ্ঠের প্রতিধ্বনি গুপ্ত গুহার দেয়ালে আঘাত খেয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা সুড়ঙ্গপথে।
মুরাদ আর মনিরা তখন জম্বুর বনের মধ্য দিয়ে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে।
সন্ন্যাসী বাবাজীর সামনে অগ্নিকুণ্ড দপ দপ করে জ্বলছে। পাশেই ধূমায়িত গাঁজার কলকেটা ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। সন্ন্যাসী দু’চোখ মুদিত অবস্থায় বিড়বিড় করে মন্ত্র পাঠ করছেন।
সময় অতিবাহিত প্রায়, এতক্ষণেও এলো না ভক্ত মুরাদ তার প্রিয়া মনিরাকে নিয়ে।
এমন সময় পদশব্দ শোনা যায়। একটু পরই মুরাদের উপস্থিতি জানতে পারেন সন্ন্যাসী বাবাজী! গম্ভীর স্থিরকণ্ঠে বলেন–মুরাদ, বড় বিলম্ব হয়ে গেছে, শিগগির প্রস্তুত হয়ে নাও।
মুরাদের দু’চোখে আনন্দের দ্যুতি খেলে যায়। সত্যিই বাবাজীর অপূর্ব ধ্যানবল। তাকে না দেখেই তার নাম উচ্চারণ করেছেন। করজোরে বলে মুরাদ–বাবাজী, আদেশ করুন কি করতে হবে?
তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াও, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
মুরাদ স্থির হয়ে দাঁড়ায়।
মনিরা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
সন্ন্যাসী বাবাজী আসন ত্যাগ করেন, এগিয়ে আসেন মুরাদের দিকে…হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দেন তার নাকের ওপর।
অমনি চিৎ হয়ে পড়ে যায় মুরাদ। এমন একটা অবস্থার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে যায় সে। তারপর বুঝতে পারে সন্ন্যাসী বাবাজী তার হিতাকাঙ্খী নয়।
মুরাদ উঠে দাঁড়াবার পূর্বেই সন্ন্যাসী পুনরায় মুরাদকে আক্রমণ করেন এবং ঘুষির পর ঘুষি লাগিয়ে ওকে আধমরা করে ফেলেন।
মুরাদের নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। ঠোঁট কেটেও রক্ত ঝরছে। মুরাদও রুখে দাঁড়াতে যায়। কিন্তু তার পূর্বেই সন্ন্যাসী হাতে তালি দেন। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ বেরিয়ে আসে পাশের ঝোঁপ-ঝাপের মধ্য থেকে। সন্ন্যাসীর ইংগিতে তারা মুরাদের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেয়।
মুরাদের অবস্থা তখন অবর্ণনীয়। মৃতের মুখের ন্যায় রক্তশূন্য হয়ে পড়ে তার মুখমণ্ডল। নিজেকে ধিক্কার দেয় সে। নিজে তো বন্দী হলোই, তার এত আরাধনার ধন মনিরাকেও হারালো। রাগে ক্ষোভে নিজের মাংস নিজেই চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
মুরাদকে নিয়ে পুলিশরা চলে যায়।
সন্ন্যাসী মনিরার সামনে এসে দাঁড়াল-তুমি এখন কি চাও?
মনিরা এতক্ষণ অপলক নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। মনে তার শত শত প্রশ্ন একসঙ্গে দোলা দিচ্ছিল। সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই পুলিশের লোক। সে কি ভুল করেছে? এর কাছে সব কথা খুলে বলা ঠিক হয়নি। দস্যু বনহুরকে সে ভালবাসে একথাও বলেছে সে তার কাছে। কি সর্বনাশ সে করেছে! মনে মনে ভয় পেয়ে যায় মনিরা। কোন জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ পঁড়িয়ে থাকে।
সন্ন্যাসী মনিরার মনোভাব বুঝতে পেরে হেসে বলেন–তুমি কোথায় যেতে চাও? মামা মামীর কাছে-না দস্যু বনহুরের পাশে।
মনিরা মৃদুকম্পিত সুরে বলে–মামা-মামীর কাছে।
বেশ, এসো আমার সঙ্গে।
সন্ন্যাসী আগে আগে চলেন, মনিরা চলে পেছনে পেছনে। কিছুদূর এগুনোর পর একটি পাল্কী দেখতে পায় মনিরা।
সন্ন্যাসী মনিরাকে পাল্কীতে উঠে বসতে ইঙ্গিত করলেন।
মনিরা পাল্কীতে বসে কতকটা আশ্বস্ত হলো। যা হউক সন্ন্যাসী যেই হউক সে তাকে তার মামা-মামীর কাছে পৌঁছে দেবে।
কিন্তু একি! এ যে গহন বনের ভেতর দিয়ে এরা তাকে নিয়ে চলেছে।
মনিরা উঁকি দিয়ে চারদিকে দেখলো।
দু’জন লোক মশাল হাতে আগে আগে চলেছে। মশালের আলোতে লক্ষ্য করলো মনিরা সন্ন্যাসী তো নেই। সে তবে গেল কোথায়!
ভোর হবার পূর্বে একটা পোড়োবাড়ীর সামনে এসে পাল্কী থেমে পড়লো। দু’জন মশালধারী মনিরাকে লক্ষ্য করে বলল–নেমে আসুন।
মনিরা ইতস্ততঃ করতে লাগল।
মশালধারী দু’জনের একজন বলে ওঠে-ভয় নেই, আসুন।
মনিরার হৃদয় কেঁপে উঠল, সে আবার এক নতুন বিপদের সম্মুখীন হলো নাকি। পোড়াবাড়ির দিকে তাকিয়ে কণ্ঠনালী শুকিয়ে উঠলো তার। কিন্তু নিরুপায় সে। কি আর করবে, অগত্যা মশালধারী লোক দুটিকে অনুসরণ করল সে।
অনেকগুলো ভাঙ্গা ঘর আর প্রাচীর পেরিয়ে একটি গুপ্ত দরজার নিকটে পৌঁছল তারা। মশালধারী দু’জন এবার দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন বলল–ভেতরে যান।
মনিরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও পা বাড়ালো। না জানি এ আবার কোন বিপদে পড়লো সে। সন্ন্যাসী-সেও কি তার সাথে চাতুরি করল। হৃদয়টা অজানা এক আশঙ্কায় কেঁপে উঠল।
কক্ষে প্রবেশ করে আশ্চর্য হলো মনিরা। সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটি কক্ষ। এই পোড়াবাড়ির মধ্যে এমন পরিষ্কার সাজানো গোছানো ঘর থাকতে পারে, ভাবতে পারে না মনিরা। অবাক হয়ে চারদিকে তাকায় সে। মেঝেতে দামী কার্পেট বিছানো। দেয়ালে সুন্দর কয়েকখানা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। একপাশে একটি মূল্যবান খাট, খাটে দুগ্ধফেননিভ শয্যা পাতা রয়েছে, কয়েকখানা। দামী সোফা সাজানো। মনিরা অবাক হয়ে দেখছে, এই গহন বনের ভেতর একটা পোড়াবাড়ির মধ্যে এত সুন্দর একটি কক্ষ!
হঠাৎ মনিরার নজরে পড়লো, এক পাশে একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলে স্তূপাকার ফলমূল। নাশপাতি, বেদানা, কমলালেবু, আংগুর আরও অনেক রকম ফল সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে।
এসব দেখেও মনিরা খুশি হতে পারলো না। না জানি তার জন্য আবার কোন বিপদ এগিয়ে আসছে। তার জন্য এত ব্যবস্থার দরকার কি? সন্ন্যাসীর যদি মতিগতি ভালই হত, তাহলে তাকে তার মামা-মামীর নিকটে পৌঁছে না দিয়ে এখানে আনবার কারণ কি? নিজের অদৃষ্টকে ধিক্কার দেয় মনিরা–তার অদৃষ্টে এত ছিল! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে মনিরার। কিন্তু কেঁদে কি হবে! এতদিন কেঁদে কেঁদে চোখের পানি তার যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে।
এক সময় ভোরের আলো ফুটে উঠল।
গাছে গাছে জেগে উঠল পাখির কলরব। মৃদুমন্দ বাতাস অজানা ফুলের সুরভি নিয়ে ছুটে এলো মুক্ত জানালাপথে। মনিরা দুগ্ধফেনিভ শয্যায় গা এগিয়ে দিল। চোখের পানি তার শুকিয়ে গেছে। ব্যথা সয়ে সয়ে হৃদয়টাও হয়ে উঠেছে পাথরের মত শক্ত।
কত দিন এমন সুন্দর বিছানায় শোয়নি সে। গোটা রাতের অনিদ্রায় দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনিরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো নিজেই জানে না।
মি. হারুন ডাকাতের দলকে গ্রেপ্তার করে খুশিতে মেতে উঠেছেন! তার জীবনে এটা এক চরম সাফল্য। মি. হোসেন এবং শংকর রাও-ও আনন্দে আত্মহারা। পুলিশ সুপার মি. আহম্মদ এই ভয়ংকর ডাকাতের দল গ্রেপ্তার হওয়ায় তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নিজে এসে তিনি দেখলেন, জবানবন্দিও নিলেন।
ডাকাতের দলের লোকগুলোর ভয়ংকর চেহারা দেখে এবং তাদের জবানবন্দি শুনে মি. আহম্মদ লোকগুলোকে হাঙ্গেরী কারাগারে আটকে রাখতে বললেন। বিচারের সময় আবার তাদের বের করে আনা হবে।
মি. আহম্মদের কথামতই কাজ হলো।
ডাকাতের দলকে হাঙ্গেরী কারাগারে প্রেরণ করার পর পরই কয়েকজন পুলিশ মুরাদকে পাকড়াও করে হাজির হলো–হুজুর, এই লোকটাও ছিল ডাকাতদের দলে।
মি. হারুন এবং শংকর রাও অবাক হয়ে দেখলেন, এ যে খান বাহাদুর হামিদুল হকের লন্ডন ফেরত পুত্র মুরাদ!
মুরাদের শরীরে অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলেন তারা। একটা চোখের ওপরে কালো জখম হয়ে রয়েছে। ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়েছিল, এখনও তা সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়নি। চোয়ালের নিচেও একটা জখম রয়েছে।
এমন সময় গতদিনের সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন।
মি. হারুন এবং মি. হোসেন ও অন্যান্য পুলিশ অফিসার প্রৌঢ় ডাক্তারকে দেখে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। মি. হারুন উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন–আসুন, আসুন!
প্রৌঢ় ডাক্তার আসন গ্রহণ করে বললেন–এবার আমার কথা কাজে এসেছে তো?
হ্যাঁ ডাক্তার সাহেব, আপনার কথামত কাজ করে আমরা আজ এক ভয়ংকর ডাকাতদলকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আর একটা সমস্যার সামনে পড়েছি এই যুবককে নিয়ে।
ডাক্তার তার মোটা পাওয়ারের চশমা নাকের ওপর থেকে চোখের ওপর তুলে দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে বলেন–এই সেই লোক, যাকে আমি সেই দিন চিকিৎসা করেছিলাম। আংগুল দিয়ে ওর জখমগুলো দেখিয়ে দিয়ে বলেন–এই দেখছেন সেই জখমগুলো।
প্রৌঢ় ভদ্রলোকের ওপর পুলিশ অফিসারগণের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল। এখন মুরাদ সেই ডাকাতদলের একজন বলে প্রমাণিত হওয়ায় তাকেও তারা হাজতে প্রেরণ করলেন।
মুরাদ হাজতে যাবার পূর্বে একবার কটমট করে তাকালো। বৃদ্ধকে মিথ্যা বলতে শুনে আশ্চর্য হলো সে। বৃদ্ধকে সে কোনদিন দেখেছে বলেও মনে পড়লো না। অথচ সে বলছে তাকে চিকিৎসা করেছে। জানে প্রতিবাদ জানিয়ে কোন ফল হবে না, তাই নীরব রইল সে।
মুরাদকে হাজতে পাঠানোর পর মি. হারুন বলেন–চলুন ডাক্তার সাহেব, পুলিশ সুপারের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেই। সত্যিই আপনি একজন মহৎ ব্যক্তি।
চলুন, উঠে দাঁড়ালেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক।
মি. হারুন মি. আহম্মদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে ঘটনাটা বিস্তারিত বলেন।
সব শুনে এবং প্রৌঢ় ভদ্রলোকটার অসীম বুদ্ধি বল দেখে মি. আহম্মদ মুগ্ধ হলেন। তিনি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলেন–আপনাকে আমরা পুরস্কৃত করব।
হেসে বলেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক-পুরস্কার আমি চাই না। আপনি সেই অর্থ দুষ্ট দমনে ব্যয়। করবেন। আচ্ছা, আজকের মত চলি। পুলিশ সুপারের সাথে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলেন তিনি।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক পুলিশ অফিস থেকে বিদায় গ্রহণ করার পর মি. হারুন এবং অন্যান্য পুলিশ। অফিসার নিজ নিজ কাজে মনোযোগ দিলেন।
এমন সময় বয় একটা চিঠি এনে মি. হারুনের হাতে দিয়ে বলল–যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক এইমাত্র পুলিশ অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন, তিনি এই চিঠিখানা আপনাকে দিতে বলে গেলেন।
মি. হারুন একটু অবাক হলেন, এইতো তাঁর সঙ্গে সামনা সামনি সমস্ত কথাবার্তা হলো, আবার চিঠিতে কি লিখলেন।
শংকর রাও বলেন–হয়তো কোনো গোপন কথা ওতে লিখে গেছেন।
মি. হারুন দ্রুতহস্তে খামখানা ছিঁড়ে চিঠিখানা বের করে নিলেন-একি! একখণ্ড চিরকুট। তাতে লেখা রয়েছে, “আপনাদের কাজে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। অশেষ ধন্যবাদ।”
–দস্যু বনহুর।
মি. হারুনকে হতবাক হয়ে যেতে দেখে মি. হোসেন কাগজের টুকরাখানা হাতে নিয়ে পড়লেন এবং সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন-গ্রেপ্তার করো! গ্রেপ্তার করো! দস্যু বনহুর! দস্যু বনহুর।
সমস্ত পুলিশ রাইফেল হাতে ছুটলো, কিন্তু কোথায় দস্যু বনহুর।
পুলিশ সুপার মি. আহমদ রাগে-ক্ষোভে অধর দংশন করলেন। পূর্বে যদি এতটুকু জানতে পারতেন, তাহলে আজ তারা দস্যু বনহুরকে কিছুতেই পালাতে দিতেন না। মি. হারুন এবং অন্যান্য অফিসারের অবস্থাও তাই।
শংকর রাও শুধু হেসে বলেন–কেন এত ব্যস্ত হচ্ছেন? দস্যু বনহুর তো আর কোন দোষ করেনি?
মি. হারুন রাগত কণ্ঠে বলেন–দোষীকে নতুন করে দোষ করতে হয় না মি. রাও। দোষী সব সময়ই অপরাধী। সুযোগ পেলে সে ছোবল মারবেই।
অনেক খোঁজাখুজি করেও দস্যু বনহুরকে আর পাওয়া গেল না।
মি. হোসেন এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মি. হারুন নিজেও বেরিয়ে পড়লেন, যাকে সন্দেহ হলো তাকেই পাকড়াও করলেন।
মি. আহমদ কড়া হুকুম দিলেন–দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করা চাই-ই।
মি. আহমদ দস্যু বনহুরের ওপর চটে রয়েছেন, কারণ সে তাঁকে কিছুদিন আগে ভয়ানক নাকানি চুবানি খাইয়ে ছেড়েছে। তাই দস্যু বনহুর যত ভাল কাজই করুক তবু সে তার চক্ষুশূল তাছাড়া সে অপরাধী–দস্যু।
পুলিশমহলে দস্যু বনহুরকে নিয়ে আবার একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল।
এদিকে দস্যু বনহুরের খোঁজে পুলিশ যখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে তখন বনহুর নিজের আস্তানায় একটা আসনে অর্ধশায়িত অবস্থান ঠেস দিয়ে বসে আছে। পায়ের কাছে একটি নিচু আসনে বসে রয়েছে রহমান।
বনহুর আর রহমানের মধ্যে মনসাপুরের জমিদার ব্রজবিহারী রায়ের কন্যা সুভাষিণীর অসুস্থতা নিয়ে আলোচনা চলছিল। কিছুদিন পূর্বেও রহমান বনহুরের নিকটে সুভাষিণীর অসুখের
কথা বলেছিল। বনহুর মনিরার নিখোঁজ ব্যাপার নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, যার জন্য অন্য কিছু ভাববার সময় হয় নি তার।
আজ কিন্তু বনহুর সুস্থির থাকতে পারে না। রহমানের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনে।
তারপর উঠে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ পায়চারী করে। ললাটে ফুটে ওঠে তার গভীর চিন্তারেখা।
রহমান বলে ওঠে–সর্দার, মেয়েটা যাকে ভালবাসে তাকে পাওয়া অসম্ভব।
থমকে দাঁড়িয়ে কুঞ্চিত করে বলে বনহুর–অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। আমি তো পূর্বেই বলেছি, যত অর্থ চায় দেব। নাহলে জোরপূর্বক তাকে পাকড়াও করে আনব।
বনহুরের কথায় রহমান কোন জবাব দেয় না, শুধু তার মুখে এক রহস্যময় হাসি ফুটে মিলিয়ে যায়। বনহুর তা লক্ষ্য করে না।
বনহুর পুনরায় পায়চারী শুরু করে।