ক্লাইব বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন, ভয় প্রদর্শন না করিলে, নবাব কদাচি সন্ধি করিতে চাহিবেন না। অতএব তিনি, কলিকাতা উদ্ধারের দুই দিবস পরে, যুদ্ধজাহাজ ও সৈন্য পাঠাইয়া, হুগলী অধিকার করিলেন। তৎকালে এই নগর প্রধান বাণিজ্যস্থান ছিল।

বোধ হইতেছে, কলিকাতা অধিকার হইবার অব্যবহিত পরে, ক্লাইব মুরশিদাবাদের শেঠদিগের নিকট এই প্রার্থনা করিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, তাঁহারা, মধ্যস্থ হইয়া, নবাবের সহিত ইঙ্গরেজদিগের সন্ধি করিয়া দেন। তদনুসারে তাঁহারা সন্ধির প্রস্তাব করেন। সিরাজ উদ্দৌলাও, প্রথমতঃ, প্ৰসন্ন চিত্তে, তাঁহাদের পরামর্শ শুনিয়াছিলেন; কিন্তু ক্লাইব, হুগলী অধিকার করিয়া, তথাকার বন্দর লুঠ করিয়াছেন, ইহা শুনিবা মাত্র, ক্ৰোধে অন্ধ হইয়া, সসৈন্যে অবিলম্বে কলিকাতা যাত্ৰা করিলেন। তিনি, ৩০এ জানুয়ারি, হুগলীর ঘাটে গঙ্গা পার হইলেন; এবং, ২রা ফেব্রুয়ারি, কলিকাতার সন্নিকটে উপস্থিত হইয়া, ক্লাইবের ছাউনির এক পোয়া অন্তরে শিবির নিবেশিত করিলেন।

ক্লাইব, ৭০০ গোরা ও ১২০০ সিপাই, এই মাত্র সৈন্য সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন। কিন্তু নবাবের সৈন্য প্ৰায় চত্বারিংশৎ সহস্ৰ।

সিরাজ উদ্দৌলা পঁহুছিবা মাত্র, ক্লাইব, সন্ধিপ্রার্থনায়, তাঁহার নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। নবাবের সহিত দূতাদিগের অনেক বার সাক্ষাৎ ও কথোপকথন হইল। তাহাতে তাঁহারা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, নবাব যদিও মুখে সন্ধির কথা কহিতেছেন, তাহার অন্তঃকরণ সেরূপ নহে। বিশেষতঃ, তাঁহাকে উপস্থিত দেখিয়া, কলিকাতার চারি দিকের লোক ভয়ে পলায়ন করাতে, ইঙ্গরেজদিগের আহারসামগ্ৰী দুগ্ধপ্রাপ্য হইতে লাগিল। অতএব ক্লাইব, এক উদ্যমেই, নবাবকে আক্রমণ করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন। তিনি, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাত্ৰিতে, ওয়াটসন সাহেবের জাহাজে গিয়া, তাঁহার নিকট ছয় শত জাহাজী গোরা চাহিয়া লইলেন, এবং তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া, রাত্রি একটার সময়, তীরে উত্তীর্ণ হইলেন। দুইটার সময়, সমুদয় সৈন্য স্ব স্ব অস্ত্ৰ লইয়া প্ৰস্তুত হইল, এবং চারিটার সময়, এক বারে নবাবের ছাউনির দিকে যাত্ৰা করিল। সৈন্য সমুদয়ে ১৩৫০ গোরা ও ৮০০ সিপাই। অকুতোভয় ক্লাইব, সাহসে নির্ভর করিয়া, এই মাত্র সৈন্য লইয়া, বিংশতি গুণ অধিক সৈন্য আক্রমণ করিতে চলিলেন। শীত কালের শেষে, প্ৰায় প্রতিদিন কুজ্বাটিকা হইয়া থাকে। সে দিবসও, প্ৰভাত হইবা মাত্র, এমন নিবিড় কুজ্বাটিকা হইল যে, কোনও ব্যক্তি, আপনার সম্মুখের বস্তুও দেখিতে পায় না। যাহা হউক, ইঙ্গরেজেরা, যুদ্ধ করিতে করিতে, বিপক্ষের শিবির ভেদ করিয়া চলিয়া গেলেন। হত ও আহত সমুদয়ে তাঁহাদের দুই শত বিংশতি জন মাত্র সৈন্য নষ্ট হয়। কিন্তু নবাবের তদপেক্ষায় অনেক অধিক লোক নিধন প্ৰাপ্ত হইয়াছিল।

নবাব, ক্লাইবের ঈদৃশ অসম্ভব সাহস দর্শনে, আতিশয় ভয় প্ৰাপ্ত হইলেন, এবং বুঝিতে পারিলেন, কেমন ভয়ানক শত্রুর সহিত বিবাদে প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন। অতএব, তিনি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে চারি ক্রোশ দূরে গিয়া ছাউনি করিলেন। ক্লাইব দ্বিতীয় বার আক্রমণের সমুদয় উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু নবাব, তদীয় অসম্ভব সাহস ও অকুতোভয়তা দর্শনে, যুদ্ধের বিষয়ে এত ভগ্নোৎসাহ হইয়াছিলেন যে, সন্ধির বিষয়েই সম্মত হইয়া, ৯ই ফেব্রুয়ারি, সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিলেন।

এই সন্ধি দ্বারা ইঙ্গরেজেরা, পূৰ্ব্বের ন্যায়, সমুদয় অধিকার প্রাপ্ত হইলেন। অধিকন্তু, কলিকাতায় দুৰ্গনিৰ্ম্মাণ ও টাকশালস্থাপন করিবার অনুমতি পাইলেন; আর, তাঁহাদের পণ্য দ্রব্যের শুল্ক দান রহিত হইল। নবাব ইহাও স্বীকার করিলেন, কলিকাতা আক্রমণ কালে যে সকল দ্রব্য গৃহীত হইয়াছে, সমুদয় ফিরিয়া দিবেন; আর যাহা যাহা নষ্ট হইয়াছে, সে সমুদয়ের যথোপযুক্ত মূল্য ধরিয়া দিবেন।

ইঙ্গরেজেরা যুদ্ধে জয়ী হইয়াছেন, এই ভাবিয়া, নবাব এই সকল নিয়ম তৎকালে অতিশয় অনুকুল বোধ করিলেন। আর ক্লাইবও এই বিবেচনা করিয়া সন্ধিপক্ষে নির্ভর করিলেন যে, য়ুরোপে ফরাসিদিগের সহিত ইঙ্গরেজদিগের যুদ্ধ আরব্ধ হইয়াছে; আর, কলিকাতায় ইঙ্গরেজদিগের যত য়ুরোপীয় সৈন্য আছে, চন্দন নগরে ফরাসিদিগেরও তত আছে। অতএব, চন্দন নগর আক্রমণ করিতে যাইবার পূর্ব্বে, নবাবের সহিত নিষ্পত্তি করিয়া, সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিন্ত হওয়া আবশ্যক।

ইঙ্গরেজ ও ফরাসি, এই উভয় জাতির য়ুরোপে পরস্পর যুদ্ধ আরব্ধ হইবার সংবাদ কলিকাতায় পঁহুছিলে, ক্লাইব, চন্দননগরবাসী ফরাসিদিগের নিকট প্ৰস্তাব করিলেন, য়ুরোপে যেরূপ হউক, ভারতবর্ষে আমরা কেহ কোনও পক্ষকে আক্রমণ করিব না। তাহাতে চন্দন নগরের গবর্ণর উত্তর দিলেন যে, আপনকার প্রস্তাবে সম্মত হইতে আমার আপত্তি নাই; কিন্তু, যদি প্ৰধান পদারূঢ় কোনও ফরাসি সেনাপতি আইসেন, তিনি এরূপ সন্ধিপত্র অগ্ৰাহ্য করিতে পারেন।

ক্লাইব বিবেচনা করিলেন, যাহাতে নিশ্চিন্ত হইতে পারা যায়, এরূপ নিম্পত্তি হওয়া অসম্ভব। আর, যত দিন চন্দন নগরে ফরাসিদের অধিক সৈন্য থাকিবেক, তাবৎ কাল পৰ্য্যন্ত কলিকাতা নিরাপদ হইবেক না। তিনি ইহাও নিশ্চিত বুঝিয়াছিলেন যে, সিরাজ উদ্দৌলা কেবল ভয় প্ৰযুক্ত সন্ধি করিয়াছেন; সুযোগ পাইলে, নিঃসন্দেহ, যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইবেন। বস্তুতঃ, সিরাজ উদ্দৌলা, এ পৰ্য্যন্ত, ক্রমাগত, ফরাসিদিগের সহিত ইঙ্গরেজদিগের উচ্ছেদের মন্ত্রণা করিতেছিলেন; এবং যুদ্ধকালে, ফরাসিদিগের সাহায্যার্থে কিছু সৈন্যও পাঠাইয়াছিলেন।

যাহা হউক, ক্লাইব বিবেচনা করিলেন, নবাবের অনুমতি ব্যতিরেকে, ফরাসিদিগকে আক্রমণ করা পরামর্শসিদ্ধ নহে। কিন্তু, এ বিষয়ে অনুমতির নিমিত্ত, তিনি যত বার প্রার্থনা করিলেন, প্ৰত্যেক বারেই, নবাব কোনও স্পষ্ট উত্তর দিলেন না । পরিশেষে, ওয়াটসন সাহেব নবাবকে এই ভাবে পত্ৰ লিখিলেন, আমার যত সৈন্য আসিবার কল্পনা ছিল, সমুদয় আসিয়াছে; এক্ষণে আপনকার রাজ্যে এমন প্রবল যুদ্ধানল প্ৰজ্বলিত করিব যে, সমুদয় গঙ্গার জলেও ঐ যুদ্ধানলের নির্ব্বাণ হইবেক না। সিরাজ উদ্দৌলা, এই পত্র পাঠে যৎপরোনাস্তি ভীত হইয়া, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের ১০ই মার্চ্চ, বিনয় করিয়া, এক পত্র লিখিলেন। ঐ পত্রের শেষে এই কথা লিখিত ছিল, যাহা আপনকার উচিত বোধ হয়, করুন।

ক্লাইব ইহাকেই ফরাসিদিগকে আক্রমণ করিবার অনুমতি গণ্য করিয়া লইলেন, এবং অবিলম্বে, সৈন্য সহিত, স্থলপথে, চন্দন নগর যাত্ৰা করিলেন। ওয়াটসন সাহেবও সমস্ত যুদ্ধজাহাজ সহিত, জলপথে প্ৰস্থান করিয়া, ঐ নগরের নিকটে নঙ্গর করিলেন। ইঙ্গরেজদিগের সৈন্য চন্দন নগর অবরোধ করিল। ক্লাইব, স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ সাহসিকতা সহকারে, অশেষবিধ চেষ্টা করিলেন; কিন্তু জাহাজী সৈন্যের প্রযত্নেই ঐ স্থান হস্তগত হইল। ইঙ্গারেজেরা, এ পৰ্য্যন্ত, ভারতবর্ষে অনেক যুদ্ধ করিয়াছিলেন; কিন্তু এই যুদ্ধ সর্বাপেক্ষা ভয়ানক। নয় দিন অবরোধের পর, চন্দন নগর পরাজিত হয়।

এরূপ প্ৰবাদ আছে, ইঙ্গরেজেরা ফরাসি সৈন্য ও সেনাপতি দিগকে উৎকোচ দিয়া বশীভূত করেন, তাহাদের বিশ্বাসঘাতকতাতেই চন্দন নগর পরাজিত হয়। এই প্রবাদের মূল এই, ফরাসি গবর্ণর, ইঙ্গরেজদিগের জাহাজের গতির প্রতিরোধের নিমিত্ত,  নৌকা ডুবাইয়া গঙ্গার প্রায় সমুদায় অংশ রুদ্ধ করিয়া, কেবল এক অল্পপরিসর পথ রাখিয়াছিলেন। এই বিষয় অতি অল্প লোকে জানিত। ফরাসিদিগের এক কৰ্ম্মচারী ছিল, তাহার নাম টেরেনো। টেরেনো, কোনও কারণ বশতঃ, ফরাসী গবৰ্ণর রোনড সাহেবের উপর বিরক্ত হইয়া, ইঙ্গরেজদিগের পক্ষে আইসে, এবং ক্লাইবকে ঐ পথ দেখাইয়া দেয়। উত্তর কালে, ঐ ব্যক্তি, ইঙ্গরেজদিগের নিকট কৰ্ম্ম করিয়া, কিছু উপাৰ্জন করে, এবং ঐ উপার্জ্জিত অর্থের কিয়াৎ অংশ ফ্রান্সে আপনি বৃদ্ধ পিতার নিকট পাঠাইয়া দেয়। কিন্তু তাহার পিতা এই টাকা গ্ৰহণ করেন নাই, বিশ্বাসঘাতকের দত্ত বলিয়া, ঘৃণা প্ৰদৰ্শন পূর্ব্বক ফিরিয়া পাঠান। ইহাতে টেরেনোর অন্তঃকরণে এমন নির্ব্বেদ উপস্থিত হয় যে, সে উদ্বন্ধন দ্বারা প্ৰাণত্যাগ করে।

সিরাজ উদ্দৌলার সহিত যে সন্ধি হয়, তদ্দ্বারা ইঙ্গারেজের টাকশাল ও দুর্গ নিৰ্ম্মাণ করিবার অনুমতি পান। ষাট বৎসরের অধিক হইবেক, তাঁহারা, এই দুই বিষয়ের নিমিত্ত বারংবার প্রার্থনা করিয়াও, কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। কলিকাতার যে পুরাতন দুর্গ নবাব অনায়াসে অধিকার করেন, তাহা অতি গোপনে নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। এক্ষণে, ক্লাইব, এই সন্ধির পরেই, এতদেশীয় সৈন্যে পরাজয় করিতে না পারে, এরূপ এক দুর্গ নিৰ্ম্মাণ করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং তাহার সমাধান বিষয়ে সবিশেষ সত্বর ও সযত্ন হইলেন। যখন নক্সা প্ৰস্তুত করিয়া আনে, তখন তিনি, তাহাতে কত ব্যয় হইবেক, বুঝিতে পারেন নাই। কাৰ্য্য আরব্ধ হইলে, ক্ৰমে দৃষ্ট হইল, দুই কোটি টাকার ন্যূনে নির্ব্বাহ হইবেক না। কিন্তু তখন আর তাহার কোনও পরিবর্ত্ত করিবার উপায় ছিল না। কলিকাতার বর্ত্তমান দুর্গ, এই রূপে, দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। সেই বৎসরেই, এক টাকশাল নিৰ্ম্মিত, এবং আগষ্ট মাসের উনবিংশ দিবসে, ইঙ্গরেজদিগের টাকা প্ৰথম মুদ্রিত হয়।

ক্লাইব, এই রূপে, পরাক্রম দ্বারা, ইঙ্গরেজদিগের অধিকার পুনঃস্থাপিত করিয়া, মনে মনে স্থির করিলেন, পরাক্রম ব্যতীত অন্য কোনও উপায়ে এ অধিকারের রক্ষা হইবেক না। তিনি, প্ৰথম অবধিই, নিশ্চিত বুঝিয়াছিলেন, ইঙ্গরেজেরা নিশ্চিন্ত থাকিলে চলিবেক না, অবশ্য তাহাদিগকে অন্য অন্য উপায় দেখিতে হইবেক। আর ইহাও বুঝিতে পারিয়াছিলেন, ফরাসিদিগের সাহায্য পাইলে, নবাব দুৰ্জয় হইয়া উঠিবেন। অতএব, যাহাতে ফরাসিরা পুনরায় বাঙ্গালাতে প্ৰবেশ করিতে না পায়, এ বিষয়ে তিনি সবিশেষ সতর্ক ও সচেষ্ট ছিলেন।

তৎকালে, দক্ষিণ রাজ্যে ফরাসিদিগের বুসি নামে এক সেনাপতি ছিলেন। তিনি, অনেক দেশ জয় করিয়া, সাতিশয় পরাক্রান্ত হইয়া উঠেন। সিরাজ উদ্দৌলা, ইঙ্গরেজদিগের প্রতি মুখে বন্ধুত্ব দৰ্শাইতেন; কিন্তু, ঐ ফরাসি সেনাপতিকে, সৈন্য সহিত বাঙ্গালায় আসিয়া, ইঙ্গরেজদিগকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত, পত্র দ্বারা বারংবার আহবান করিতেছিলেন। নবাব এ বিষয়ে যে সকল পত্ৰ লিখিয়াছিলেন, তাহার কয়েক খান ক্লাইবের হস্তে আইসে। ইঙ্গরেজেরা সিরাজ উদ্দৌলাকে খর্ব্ব করিয়াছিলেন; এজন্য, তিনি তাঁহাদের প্রতি অক্ৰোধ হইতে পারেন নাই। সময়ে সময়ে, তাঁহার ক্ৰোধ উদ্বেল হইয়া উঠিত। অর্বাচীন নির্বোধ নবাব, ক্ৰোধোদয় কালে, উন্মত্তপ্ৰায় হইতেন; কিন্তু, ক্ৰোধ নিবৃত্ত হইলে, ইঙ্গরেজদিগের ভয় তাহার অন্তঃকরণে আবির্ভূত হইত। ওয়াটস নামে এক সাহেব, তাঁহার দরবারে, ইঙ্গরেজদিগের রেসিডেণ্ট ছিলেন। নবাব, এক দিন, শূলে দিব বলিয়া, তাহাকে ভয় দেখাইতেন; দ্বিতীয় দিন, তাহার নিকট মৰ্য্যাদাসূচক পরিচ্ছদ পুরস্কার পাঠাইতেন; এক দিন, ক্ৰোধে অন্ধ হইয়া, ক্লাইবের পত্ৰ ছিড়িয়া ফেলিতেন; দ্বিতীয় দিন, বিনয় ও দীনতা প্ৰকাশ করিয়া, তাহাকে পত্ৰ লিখিতেন।

ইঙ্গরেজেরা বুঝিতে পারিলেন, যাবৎ এই দুৰ্দান্ত বালক বাঙ্গালার সিংহাসনে অধিরূঢ় থাকিবেক, তাবৎ কোনও প্রকারে ভদ্রস্থতা নাই। অতএব, তাঁহারা, কি উপায়ে নিরাপদ হইতে পারেন, মনে মনে এ বিষয়ের আন্দোলন করিতেছেন, এমন সময়ে, দিল্লীর সম্রাটের কোষাধ্যক্ষ পরাক্রান্ত শেঠবংশীয়েরা নবাবের সর্বাধিকারী রাজা রায়দুর্লভ, সৈন্যদিগের ধনাধ্যক্ষ ও সেনাপতি মীর জাফর, এবং উর্মিচাঁদ ও খোজা বাজীদ নামক দুই জন ঐশ্বৰ্য্যশালী বণিক, ইত্যাদি কতিপয় প্ৰধান ব্যক্তি তাঁহাদের নিকট এক পত্ৰ প্রেরণ করিলেন।

সিরাজ উদ্দৌলা, নিষ্ঠুরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা দ্বারা, তাঁহাদের অন্তঃকরণে নিরতিশয় বিরাগোৎপাদন করিয়াছিলেন। বিশেষতঃ, তাঁহারা আপনাদের ধন, মান, জীবন সর্ব্বদা সঙ্কটাপন্ন বোধ করিতেন। পূর্ব্ব বৎসর, সকতজঙ্গকে সিংহাসনে নিবেশিত করিবার নিমিত্ত, সকলে একবাক্য হইয়াছিলেন; কিন্তু তাহাদের সে উদ্যোগ বিফল হইয়া যায়। এক্ষণে তাঁহারা, সিরাজ উদ্দৌলাকে রাজ্যভ্ৰষ্ট করিবার নিমিত্ত, প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত পণ করিয়া, ইঙ্গরেজদিগের নিকট সাহায্য প্রার্থনায় গোপনে পত্রপ্রেরণ করেন।

ইঙ্গরেজেরা বিবেচনা করিলেন, আমরা সাহায্য না করিলেও, এই রাজবিপ্লব ঘটিবেক; সাহায্য করিলে, আমাদের অনেক উপকারের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু, তৎকালের কৌন্সিলের মেম্বরেরা প্ৰায় সকলেই ভীরুস্বভাব ছিলেন; এমন গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে তাঁহাদের সাহস হইল না। এডমিরেল ওয়াট্‌সন সাহেবও বিবেচনা করিয়াছিলেন, যাহারা এ পৰ্য্যন্ত কেবল সামান্যাকারে বাণিজ্য করিয়া আসিতেছে, তাহাদের পক্ষে দেশাধিপতিকে পদচ্যুত করিতে উদ্যত হওয়া অত্যন্ত অসৎসাহসের কৰ্ম্ম। কিন্তু ক্লাইব অকুতোভয় ও অত্যন্ত সাহসী ছিলেন; সঙ্কট পড়িলে, তাহার ভয় না জন্মিয়া, বরং সাহস ও উৎসাহের বৃদ্ধি হইত। তিনি উপস্থিত প্ৰস্তাবে সম্মত হইতে, কোনও ক্রমে, পরাঙ্মুখি হইলেন না।

ক্লাইব, এপ্রিল মে দুই মাস, মুরশিদাবাদের রেসিডেণ্ট ওয়াটস সাহেব দ্বারা, নবাবের প্ৰধান প্ৰধান কৰ্ম্মচারীদিগের সহিত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন; এত গোপনে যে, সিরাজ উদ্দৌলা কিছুমাত্ৰ বুঝিতে পারেন নাই। এক বার মাত্ৰ তাঁহার মনে সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল। তখন তিনি মীর জাফরকে ডাকাইয়া, কোরান স্পর্শ করাইয়া, শপথ করান। জাফর ও যথোক্ত প্রকারে শপথ করিয়া প্ৰতিজ্ঞা করেন, আমি কখনও কৃতঘ্ন হইব না।

সমুদায় প্রায় স্থির হইয়াছে, এমন সময়ে উমিচাঁদ সমস্ত উচ্ছিন্ন করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। নবাবের কলিকাতা আক্রমণ কালে, তাঁহার অনেক সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছিল; এ নিমিত্ত, মূল্যস্বরূপ তাঁহাকে যথেষ্ট টাকা দিবার কথা নিৰ্দ্ধারিত হয়। কিন্তু তিনি, তাহাতে সন্তুষ্ট না হইয়া, এক দিন বিকালে, ওয়াট্‌স সাহেবের নিকটে গিয়া কহিলেন, মীরজাফরের সহিত ইঙ্গরেজদিগের যে প্ৰতিজ্ঞাপত্ৰ হইবেক, তাহাতে আমাকে আর ত্ৰিশ লক্ষ টাকা দিবার কথা লিখিয়া দেখাইতে হইবেক; নতুবা, আমি এখনই, নবাবের নিকটে গিয়া, সমুদয় পরামর্শ ব্যক্ত করিব। উমিচাঁদ এরূপ করিলে, ওয়াট্‌স প্ৰভৃতি যে সকল ব্যক্তি এই ব্যাপারে লিপ্ত ছিলেন, তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের প্রাণদণ্ড হইত। ওয়াটস সাহেব, কালবিলম্বের নিমিত্ত, উমিচাঁদকে অশেষ প্রকারে সান্ত্বনা করিয়া, অবিলম্বে কলিকাতায় পত্ৰ লিখিলেন।

এই সংবাদ পাইয়া, ক্লাইব প্ৰথমতঃ এক বারে হতবুদ্ধি হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি, ধূৰ্ত্ততা ও প্রতারকতা বিষয়ে, উমিচাঁদ অপেক্ষা অধিক পণ্ডিত ছিলেন; অতএব, বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, উমিচাঁধ গর্হিত উপায় দ্বারা অর্থলাভের চেষ্টা করিতেছে; এ ব্যক্তি সাধারণের শত্রু; ইহার দুষ্টতা দমনের নিমিত্ত, যে কোনও প্রকার চাতুরী করা অন্যায় নহে। অতএব, আপাততঃ, ইহার দাওয়া অঙ্গীকার করা যাউক। পরে এ ব্যক্তি আমাদের হস্তে আসিবেক। তখন ইহাকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন হইবেক না। এই স্থির করিয়া, তিনি, ওয়াট্‌স সাহেবকে উমিচাঁদের দাওয়া স্বীকার করিতে আজ্ঞা দিয়া, দুই খান প্ৰতিজ্ঞাপত্ৰ প্ৰস্তুত করিলেন, এক খান শ্বেত বর্ণের, দ্বিতীয় লোহিত বর্ণের। লোহিত বর্ণের পত্রে উমিচাঁদকে ত্ৰিশ লক্ষ টাকা দিবার কথা লেখা রহিল, শ্বেত বর্ণের পত্রে সে কথার উল্লেখ রহিল না। ওয়াটসন সাহেব, ক্লাইবের ন্যায়, নিতান্ত ধৰ্ম্মজ্ঞানশূন্য ছিলেন না। তিনি, প্রতারণাঘটিত লোহিত বর্ণের প্রতিজ্ঞাপত্রে, স্বীয় নাম স্বাক্ষরিত করিতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু উমিচাঁদ অতিশয় চতুর ও অতিশয় সতর্ক; তিনি, প্ৰতিজ্ঞাপত্রে ওয়াটসনের নাম স্বাক্ষরিত না দেখিলে, নিঃসন্দেহ সন্দেহ করিবেন। ক্লাইব কোনও কৰ্ম্ম অঙ্গহীন করিতেন না, এবং, অভিপ্ৰেত সাধনের নিমিত্ত, সকল কৰ্ম্মই করিতে পারিতেন। তিনি ওয়াটসন সাহেবের নাম জাল করিলেন। লোহিত বর্ণের পত্র উমিচাঁদকে দেখান। গেল, এবং তাহাতেই তাঁহার মন সুস্থ হইল। অনন্তর, মীর জাফরের সহিত এই নিয়ম হইল, ইঙ্গরেজেরা যেমন অগ্রসর হইবেন, তিনি, স্বীয় প্রভুর সৈন্য হইতে আপন সৈন্য পৃথক করিয়া, ইঙ্গরেজদিগের সহিত মিলিত হইবেন।

এই রূপে সমুদয় স্থিরীকৃত হইলে, ক্লাইব সিরাজ উদ্দৌলাকে এই মৰ্ম্মে পত্ৰ লিখিলেন যে, আপনি ইঙ্গরেজদিগের অনেক অনিষ্ট করিয়াছেন, সন্ধিপত্রের নিয়মলঙ্ঘন করিয়াছেন, যে যে ক্ষতিপূরণ স্বীকার করিয়াছিলেন, তাহা করেন নাই, এবং ইঙ্গরেজদিগকে বাঙ্গালা হইতে তাড়াইয়া দিবার নিমিত্ত, ফরাসিদিগকে আহবান করিয়াছেন। অতএব, আমি স্বয়ং মুরশিদাবাদে যাইতেছি, আপনকার সভার প্রধান প্রধান লোকদিগের উপর ভার দিব, তাঁহারা সকল বিষয়ের মীমাংসা করিয়া দিবেন।

নবাব, এই পত্রের লিখনভঙ্গী দেখিয়া, এবং ক্লাইব স্বয়ং আসিতেছেন। ইহা পাঠ করিয়া, অতিশয় ব্যাকুল হইলেন, এবং ইঙ্গরেজদিগের সহিত যুদ্ধ অপরিহরণীয় স্থির করিয়া, অবিলম্বে সৈন্য সংগ্রহ পূৰ্ব্বক, কলিকাতা অভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। ক্লাইবও, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের জুন মাসের আরম্ভেই, আপন সৈন্য লইয়া প্ৰস্থান করিলেন। তিনি, ১৭ই জুন, কাটোয়াতে উপস্থিত হইলেন, এবং পর দিন তথাকার দুর্গ আক্রমণ ও অধিকার করিলেন।

১৯এ জুন, ঘোরতর বর্ষার আরম্ভ হইল। ক্লাইব, নদী পার হইয়া নবাবের সহিত যুদ্ধ করি, কি ফিরিয়া যাই, মনে মনে এই আন্দোলন করিতে লাগিলেন। কারণ, তিনি তৎকাল পৰ্য্যন্ত মীর জাফরের কোনও উদ্দেশ পাইলেন না, এবং তাঁহার এক খানি পত্রিকাও প্ৰাপ্ত হইলেন না। তখন তিনি, স্বীয় সেনাপতিদিগকে সমবেত করিয়া, পরামর্শ করিতে বসিলেন। তাঁহারা সকলেই যুদ্ধের বিষয়ে অসম্মতিপ্ৰদৰ্শন করিলেন। ক্লাইবও, প্রথমতঃ তাঁহাদের সিদ্ধান্তই গ্ৰাহা করিয়াছিলেন; কিন্তু, পরিশেষে, অভিনিবেশ পূর্ব্বক বিবেচনা করিয়া, ভাগ্যে যাহা থাকে ভাবিয়া, যুদ্ধপক্ষই অবলম্বন করিলেন। তিনি স্থির বুঝিয়াছিলেন, যদি, এত দূর আসিয়া, এখন ফিরিয়া যাই, তাহা হইলে, বাঙ্গালাতে ইঙ্গরেজদিগের অভ্যূদয়ের আশা এক বারে উচ্ছিন্ন হইবেক।

২২এ জুন, সূৰ্য্যোদয় কালে, সৈন্য সকল গঙ্গা পার হইতে আরম্ভ করিল। দুই প্রহর চারিটার সময়, সমুদয় সৈন্য অপর পারে উত্তীর্ণ হইল। তাহারা, অবিশ্রান্ত গমন করিয়া, রাত্ৰি দুই প্রহর একটার সময়, পলাশির বাগানে উপস্থিত হইল।

প্রভাত হইবা মাত্র, যুদ্ধ আরব্ধ হইল। ক্লাইব, উৎকণ্ঠিত চিত্তে, মীর জাফরের ও তদীয় সৈন্যের আগমন প্ৰতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু, তখন পৰ্য্যন্ত, তাঁহার ও তদীয় সৈন্যের কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। যুদ্ধক্ষেত্রে নবাবের পঞ্চদশ সহস্ৰ অশ্বারোহ ও পঞ্চত্রিংশৎ সহস্ৰ পদাতি সৈন্য উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু তিনি স্বয়ং, চাটুকারবর্গে বেষ্টিত হইয়া, সকলের পশ্চাদ্ভাগে তাবুর মধ্যে ছিলেন। মীর মদন নামক এক জন সেনাপতি যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিলেন। মীর জাফর, আত্মসৈন্য সহিত, তথায় উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হয়েন নাই।

বেলা প্ৰায় দুই প্ৰহারের সময়, কামানের গোলা লাগিয়া, সেনাপতি মীর মদনের দুই পা উড়িয়া গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ নবাবের তাঁবুতে নীত হইলেন এবং তাঁহার সম্মুখেই প্ৰাণত্যাগ করিলেন। তদৃষ্টে নবাব যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইলেন, এবং ভৃত্যাদিগকে বিশ্বাসঘাতক বলিয়া সন্দেহ করিতে লাগিলেন। তখন, তিনি মীর জাফরকে ডাকাইয়া আনিলেন, এবং তাহার চরণে স্বীয় উষ্ণীষ স্থাপিত করিয়া, অতিশয় দীনতা প্রদর্শন পূর্ব্বক, এই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন যে, অন্ততঃ আমার মাতামহের অনুরোধে, আমার অপরাধ ক্ষমা করিয়া, এই বিষম বিপদের সময়, সহায়তা কর।

জাফর অঙ্গীকার করিলেন, আমি আত্মধৰ্ম্ম প্ৰতিপালন করিব; এবং, তাহার প্রমাণ স্বরূপ, নবাবকে পরামর্শ দিলেন, আদ্য বেলা অত্যন্ত অধিক হইয়াছে, সৈন্য সকল ফিরাইয়া আনুন। যদি জগদীশ্বর কৃপা করেন, কল্য আমরা, সমুদয় সৈন্য একত্ৰ করিয়া, যুদ্ধার্থে প্ৰস্তুত হইব। তদনুসারে, নবাব সেনাপতিদিগকে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইবার আজ্ঞা পাঠাইলেন। নবাবের অপর সেনাপতি মোহনলাল ইঙ্গরেজদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিতেছিলেন; কিন্তু, নবাবের এই আজ্ঞা পাইয়া, নিতান্ত অনিচ্ছা পূৰ্ব্বক নিবৃত্ত হইলেন। তিনি অকস্মাৎ ক্ষান্ত হওয়াতে, সৈন্যদিগের উৎসাহভঙ্গ হইল। তাহারা, ভঙ্গ দিয়া, চারি দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। সুতরাং, ক্লাইবের অনায়াসে সম্পূর্ণ জয়লাভ হইল। যদি মীর জাফর বিশ্বাসঘাতক না হইতেন, এবং ঈদৃশ সময়ে এরূপ প্রতারণা না করিতেন, তাহা হইলে, ক্লাইবের, কোনও ক্রমে, জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল না।

তদনন্তর, সিরাজ উদ্দৌলা, এক উষ্ট্রে আরোহণ করিয়া, দুই সহস্ৰ অশ্বারোহ সমভিব্যাহারে, সমস্ত রাত্ৰি গমন করতঃ, পর দিন বেলা ৮টার সময়, মুরশিদাবাদে উপস্থিত হইলেন, এবং উপস্থিত হইয়াই, আপনার প্রধান প্ৰধান ভৃত্য ও অমাত্যবৰ্গকে সন্নিধানে আসিতে আজ্ঞা করিলেন। কিন্তু তাহারা সকলেই স্ব স্ব আলয়ে প্ৰস্থান করিল। অন্যের কথা দূরে থাকুক, সে সময়ে, তাঁহার শ্বশুর পর্য্যন্ত তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।

নবাব, সমস্ত দিন, একাকী আপন প্রাসাদে কালব্যাপন করিলেন; পরিশেষে, নিতান্ত হতাশ হইয়া, রাত্রি তিনটার সময়ে, মহিষীগণ ও কতিপয় প্ৰিয়পাত্ৰ সমভিব্যাহারে করিয়া, শকটারোহণ পূর্ব্বক, ভগবানগোলায় পলায়ন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, ফরাসি সেনাপতি লা সাহেবের সহিত মিলিত হইবার নিমিত্ত, তিনি নৌকারোহণ পূৰ্ব্বক জলপথে প্ৰস্থান করিলেন। ইতঃপূৰ্ব্বে, তিনি, ঐ সেনাপতিকে পাটনা হইতে আসিতে পত্ৰ লিখিয়াছিলেন।

পলাশির যুদ্ধে ইঙ্গরেজদিগের, হত আহত সমুদয়ে, কেবল কুড়ি জন গোরা ও পঞ্চাশ জন সিপাই নষ্ট হয়। যুদ্ধসমাপ্তির পর, মীর জাফর, ক্লাইবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহার রণজয় নিমিত্ত সভাজন ও হর্ষপ্ৰদৰ্শন করিলেন। অনন্তর, উভয়ে একত্ৰ হইয়া মুরশিদাবাদ চলিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, মীর জাফর রাজকীয় প্রাসাদ অধিকার করিলেন।

রাজধানীর প্রধান প্ৰধান লোক ও প্ৰধান প্ৰধান রাজকীয় কৰ্ম্মচারী সমবেত হইলেন। অবিলম্বে এক দরবার হইল। ক্লাইব, আসন হইতে গাত্ৰোত্থান করিয়া, মীর জাফরের কর গ্ৰহণ পূর্ব্বক সিংহাসনে বসাইয়া, তাহাকে বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বলিয়া সম্ভাষণ ও বন্দনা করিলেন। তৎপরে তাঁহারা উভয়ে, কয়েক জন ইঙ্গরেজ এবং ক্লাইবের দেওয়ান রামচাঁদ ও তাঁহার মুন্সী নবকৃষ্ণকে সঙ্গে লইয়া, ধনাগারে প্রবেশ করিলেন; কিন্তু, তন্মধ্যে স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয়ে দুই কোটি টাকার অধিক দেখিতে পাইলেন না।

তৎকালের মুসলমান ইতিহাসলেখক কহেন যে, উহা কেবল বাহ্য ধনাগার মাত্র। এতদ্ভিন্ন, অন্তঃপুরে আর এক ধনাগার ছিল; ক্লাইব, তাহার কিছু মাত্র সন্ধান পান নাই।

ঐ কোষে স্বর্ণ, রজত, ও রত্নে আট কোটি টাকার ন্যূন ছিল না। মীর জাফর, আমির বেগ খাঁ, রামচাঁদ, নবকৃষ্ণ, এই কয় জনে ঐ ধন যথাযোগ্য ভাগ করিয়া লয়েন। এই নির্দেশ নিতান্ত অমূলক বা অসম্ভব বোধ হয় না; কারণ, রামচাঁদ তৎকালে ষাটি টাকা মাত্র মাসিক বেতন পাইতেন; কিন্তু, দশ বৎসর পরে, তিনি এক কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকার বিষয় রাখিয়া মরেন। মুন্সী নবকৃষ্ণেরও মাসিক বেতন ষাটি টাকার অধিক ছিল না। কিন্তু তিনি, অল্প দিন পরে, মাতৃশ্ৰাদ্ধ উপলক্ষে, নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। এই ব্যক্তিই, পরিশেষে, রাজা উপাধি প্ৰাপ্ত হইয়া, রাজা নবকৃষ্ণ নামে বিখ্যাত হইয়াছিলেন।

এক্ষণে ইঙ্গরেজের সকল সঙ্কট হইতে মুক্ত হইলেন। ১৭৫৬ খৃঃ অব্দের জুন মাসে, তাঁহাদের সর্ব্বস্বলুণ্ঠন, বাণিজ্যের উচ্ছেদ, এবং কৰ্ম্মচারীদিগের প্রাণদণ্ড হয়। বস্তুতঃ, তাঁহারা বাঙ্গালাতে এক বারে সর্ব্ব প্রকারে সম্বন্ধশূন্য হইয়াছিলেন। কিন্তু, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের জুন মাসে, তাঁহারা কেবল আপনাদের কুঠী সকল পুনর্বার অধিকার করিলেন, এমন নহে; আপনাদের বিপক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে রাজ্যচ্যুত করিলেন, এবং অনুগত এক ব্যক্তিকে নবাবী পদ দিলেন; আর, তাহাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিরা বাঙ্গালা হইতে দূৱীকৃত হইলেন।

নবাব কলিকাতা আক্রমণ করাতে, কোম্পানি বাহাদুরের, এবং ইঙ্গরেজ, বাঙ্গালি, ও আরমানি বণিকদিগের যথেষ্ট ক্ষতি হইয়াছিল; সেই ক্ষতির পূরণ স্বরূপ, কোম্পানি বাহাদুর, এক কোটি টাকা পাইলেন; ইঙ্গরেজ বণিকেরা পঞ্চাশ লক্ষ; বাঙ্গালি বণিকেরা বিশ লক্ষ; আরমানি বণিকেরা সাত লক্ষ; এ সমস্ত ভিন্ন, সৈন্যসংক্রান্ত লোকেরা অনেক পারিতোষিক পাইলেন, আর, কোম্পানির যে সকল কৰ্ম্মচারীরা মীর জাফরকে সিংহাসনে নিবেশিত করিয়াছিলেন, তাঁহারাও বঞ্চিত হইলেন না। ক্লাইব ষোল লক্ষ টাকা পাইলেন; কৌন্সিলের অন্যান্য মেম্বরেরা, কিছু কিছু ন্যূন পরিমাণে, পুরস্কার প্রাপ্ত হইলেন। ইহাও নিৰ্দ্ধারিত হইল, পূর্বে ইঙ্গরেজদিগের যে যে অধিকার ছিল, সে সমস্ত বজায় থাকিবেক; মহারাষ্ট্ৰখাতের অন্তর্গত সমুদয় স্থান ও তাহার বাহ্যে ছয় শত ব্যাম পৰ্য্যন্ত, ইঙ্গরেজদিগের হইবেক; কলিকাতার দক্ষিণ কুল্পী পৰ্য্যন্ত সমুদয় দেশ কোম্পানির জমীদারী হইবেক; আর, ফরাসিরা, কোনও কালে, এ দেশে বাস করিবার অনুমতি পাইবেন না।

এ দিকে, সিরাজ উদ্দৌলা, ভগবানগোলা হইতে রাজমহলে পঁহুছিয়া, আপনি স্ত্রী ও কন্যার জন্য অন্ন পাক করিবার নিমিত্ত, এক ফকীরের কুটীরে উপস্থিত হইলেন। পূর্ব্বে ঐ ফকীরের উপর তিনি অনেক অত্যাচার করিয়াছিলেন। এক্ষণে ঐ ব্যক্তি তাঁহার অনুসন্ধানকারীদিগকে তৎক্ষণাৎ তাঁহার পঁহুছসংবাদ দিলে, তাহারা আসিয়া তাঁহাকে রুদ্ধ করিল। সপ্তাহ পূর্বে, তিনি ঐ সকল ব্যক্তির সহিত আলাপও করিতেন না; এক্ষণে, অতি দীন বাক্যে, তাহাদের নিকট বিনয় করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহারা, তদীয় বিনয়বাক্য শ্রবণে বধির হইয়া, তাহার সমস্ত স্বর্ণ ও রত্ন লুটিয়া লইল; এবং তাঁহাকে মুরশিদাবাদে প্ৰত্যানয়ন করিল।

যৎকালে, তিনি রাজধানীতে আনীত হইলেন, তখন মীর জাফর, অধিক মাত্রায় অহিফেন সেবন করিয়া, তন্দ্রাবেশে ছিলেন; তাঁহার পুত্ৰ পাপাত্মা মীরন, সিরাজ উদ্দৌলার উপস্থিতিসংবাদ শুনিয়া, তাঁহাকে আপনি আলয়ের সন্নিধানে রুদ্ধ করিতে আজ্ঞা দিল, এবং দুই ঘণ্টার মধ্যেই, স্বীয় বয়স্যগণের নিকট তাঁহার প্রাণবধের ভার লইবার প্ৰস্তাব করিল। কিন্তু, তাহারা একে একে সকলেই অস্বীকার করিল। মহম্মদিবেগ নামক এক ব্যক্তি আলিবর্দ্দি খাঁর নিকট প্রতিপালিত হইয়াছিল; পরিশেষে সেই দুরাত্মাই এই নিষ্ঠুর ব্যাপারের সমাধানের ভারগ্রহণ করিল। সে ব্যক্তি গৃহে প্ৰবেশ করিব মাত্র, হতভাগ্য নবাব, তাহার আগমনের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, করুণ স্বরে কহিলেন, আমি যে, বিনা অপরাধে, হুসেন কুলি খাঁর প্রাণদণ্ড করিয়াছিলাম, তাহার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আমায় অবশ্যই প্ৰাণত্যাগ করিতে হইবেক। তিনি এই বাক্য উচ্চারণ করিব মাত্র, দুরাচার মহম্মদিবেগ তরবারি প্রহার দ্বারা তাহার মস্তকচ্ছেদন করিল। উপযুপরি কতিপয় আঘাতের পর, তিনি, হুসেন কুলি খার প্রাণদণ্ডের প্রতিফল পাইলাম, এই বলিয়া, পঞ্চত্ব প্রাপ্ত ও ভূতলে পতিত হইলেন।

অনন্তর, মীরনের আজ্ঞাবহেরা নবাবের মৃত দেহ খণ্ড খণ্ড করিল; এবং, অযত্ন ও অবজ্ঞা পূর্ব্বক, হস্তিপৃষ্ঠে নিক্ষিপ্ত করিয়া, জনাকীর্ণ রাজপথ দিয়া, গোর দিবার নিমিত্ত লইয়া চলিল। ঐ সময়ে, সকলে লক্ষ্য করিয়াছিল, কোনও কারণ বশতঃ, পথের মধ্যে মাহুতের থামিবার আবশ্যক হওয়াতে, আঠার মাস পূর্বে সিরাজ উদ্দৌলা যে স্থানে হুসেন কুলি খাঁর প্রাণবধ করিয়াছিলেন, ঐ হস্তী ঠিক সেই স্থানে দণ্ডায়মান হয়; এবং, যে ভূভাগে, বিনা অপরাধে, তিনি হুসেনের শোণিতপাত করিয়াছিলেন, ঠিক সেই স্থানে, তাঁহার খণ্ডিত কলেবর হইতে কতিপয় রুধিরবিন্দু নিপতিত হয়।