বর্ণাকার

ক্ৰমে ক্রমে রাজস্বের বৃদ্ধি হইতে পারিবেক, এই অভিপ্ৰায়ে, ১৭৭২ সালে, পাঁচ বৎসরের নিমিত্ত, জমী সকল ইজারা দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু প্ৰথম বৎসরেই দৃষ্ট হইল, জমীদারের যত কর দিতে সমর্থ, তাহার অধিক ইজারা লইয়াছেন। খাজানা, ক্ৰমে ক্রমে, বিস্তর বাকী পড়িল। ফলতঃ, এই পাঁচ বৎসরে, এক কোটি আঠার লক্ষ টাকা রেহাই দিয়াও, ইজারদারদিগের নিকট এক কোটি বিশ লক্ষ টাকা রাজস্ব বাকী রহিল; তন্মধ্যে, অধিকাংশেরই আদায় হইবার সম্ভাবনা ছিল না। অতএব, কৌন্সিলের উভয় পক্ষীয়েরাই, নূতন বন্দোবস্তের নিমিত্ত, এক এক প্রণালী প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলেন; কিন্তু ডিরেক্টরেরা উভয়ই অগ্ৰাহ্য করিলেন। ১৭৭৭ সালে, পাট্টার মিয়াদ গত হইলে, ডিরেক্টরেরা, এক বৎসরের নিমিত্ত, ইজারা দিতে আজ্ঞা করিলেন। এইরূপ বৎসরে বৎসরে ইজারা দিবার নিয়ম, ১৭৮২ সাল পৰ্য্যন্ত, প্ৰবল ছিল।

১৭৭৬ সালে, সেপ্টেম্বর মাসে, কৰ্ণেল মন্সন সাহেবের মৃত্যু হইল; সুতরাং, তাঁহার পক্ষের দুই জন মেম্বর অবশিষ্ট থাকাতে, হেষ্টিংস সাহেব কৌন্সিলে পুনৰ্ব্বার ক্ষমতা প্ৰাপ্ত হইলেন; কারণ, সমসংখ্য স্থলে, গবৰ্ণর জেনেরালের মতই বলবৎ হইত।

১৭৭৮ সালের শেষ ভাগে, নবাব মুবারিক উদ্দৌলা, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া, এই প্রার্থনায় কলিকাতার কৌন্সিলে পত্ৰ লিখিলেন যে, মহম্মদ রেজা খাঁ আমার সহিত সৰ্ব্বদা কর্কশ ব্যবহার করেন; অতএব, ইহাকে স্থানান্তরিত করা যায়। তদনুসারে, হেষ্টিংস সাহেবের মতক্রমে, তাঁহাকে পদচ্যুত করিয়া, নায়েব সুবাদারের পদ রহিত করা গেল, এবং নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ এবং আয় ও ব্যয়ের পর্য্যবেক্ষণ কাৰ্য্যের ভার মণিবেগমের হস্তে অৰ্পিত হইল। ডিরেক্টরেরা এই বন্দোবস্তে সাতিশয় অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং অতি ত্বরায় এই আদেশ পাঠাইলেন, নায়েব সুবাদারের পদ পুনৰ্ব্বার স্থাপিত করিয়া, তাহাতে মহম্মদ রেজা খাঁকে নিযুক্ত, ও মণিবেগমকে পদচ্যুত, করা যায়।

১৭৭৮ খৃঃ অব্দে, বাঙ্গালা অক্ষরে সর্ব্বপ্রথম এক পুস্তক মুদ্রিত হয়। অসাধারণবুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন হালহেড সাহেব, সিবিল কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, ১৭৭০ খৃঃ অব্দে, এতদ্দেশে আসিয়া, ভাষাশিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। তিনি যেরূপ শিক্ষা করিয়াছিলেন, পূর্বে কোনও য়ুরোপীয় সেরূপ শিখিতে পারেন নাই। ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, রাজকাৰ্য্যনিৰ্ব্ববাহের ভার য়ুরোপীয় কৰ্ম্মচারীদিগের হস্তে অর্পিত হইলে, হেষ্টিংস সাহেব বিবেচনা করিলেন, এতদেশীয় ব্যবহারশাস্ত্রে তাঁহাদের জ্ঞান থাকা আবশ্যক। পরে, তদীয় আদেশে ও আনুকূল্যে, হালহেড সাহেব, হিন্দু ও মুসলমানদিগের সমুদয় ব্যবহারশাস্ত্র দৃষ্টে, ইঙ্গরেজী ভাষাতে এক গ্ৰন্থ সঙ্কলিত করেন। ঐ গ্ৰন্থ, ১৭৭৫ খৃঃ অব্দে, মুদ্রিত হয়। তিনি সাতিশয় পরিশ্রম সহকারে, বাঙ্গালা ভাষা শিখিয়াছিলেন; এবং বোধ হয়, ইঙ্গরেজদের মধ্যে, তিনিই প্ৰথমে এই ভাষায় বিশিষ্টরূপ বুৎপন্ন হইয়াছিলেন। ১৭৭৮ খৃঃ অব্দে, তিনি বাঙ্গালাভাষায় এক ব্যাকরণ প্ৰস্তুত করেন। উহাই সৰ্ব্বপ্রথম বাঙ্গালা ব্যাকরণ। তৎকালে রাজধানীতে ছাপার যন্ত্র ছিল না; উক্ত গ্ৰন্থ হুগলীতে মুদ্রিত হইল। বিখ্যাত চার্লস উইস্কিনস সাহেব এ দেশের নানা ভাষা শিখিতে আরম্ভ করেন। তিনি অতিশয় শিল্পদক্ষ ও বিলক্ষণ উৎসাহশালী ছিলেন। তিনিই সৰ্ব্বাগ্রে, স্বহস্তে খুন্দিয়া ও ঢালিয়া, বাঙ্গালা অক্ষর প্রস্তুত করেন। ঐ অক্ষরে তাঁহার বন্ধু হালহেড সাহেবের ব্যাকরণ মুদ্রিত হয়।

সুপ্রীম কোট নামক বিচারালয়ের সহিত গবৰ্ণমেণ্টের বিরোধ উপস্থিত হওয়াতে, অনেক বৎসর পর্য্যন্ত, দেশের পক্ষে অনেক অমঙ্গল ঘটিয়াছিল। ঐ বিচারালয়, ১৭৭৪ খৃঃ অব্দে, স্থাপিত হয়। কোম্পানির রাজশাসনের সহিত ইহার কোনও সম্পর্ক ছিল না। ভারতবর্ষে আসিবার সময়, জজদের এইরূপ দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, প্ৰজাদিগের উপর ঘোরতর অত্যাচার হইতেছে; সুপ্রীম কোর্ট তাহাদের ক্লেশনিবারণের এক মাত্র উপায়। তাঁহারা, চাঁদপাল ঘাটে, জাহাজ হইতে অবতীর্ণ হইয়া দেখিলেন, দেশীয় লোকেরা রিক্ত পদে গমনাগমন করিতেছে। তখন তাহাদের মধ্যে এক জন কহিতে লাগিলেন, দেখ ভাই! প্ৰজাদের ক্লেশের পরিসীমা নাই; আবশ্যক না হইলে আর সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হয় নাই। আমি সাহস করিয়া বলিতেছি, আমাদের কোট ছয় মাস চলিলেই, এই হতভাগ্যদিগকে জুতা ও মোজা পরাইতে পারিব।

ব্রিটিস সজেক্ট, অর্থাৎ ভারতবর্ষবাসী সমুদয় ইঙ্গরেজ, ও মহারাষ্ট্ৰখাতের অন্তর্বর্ত্তী সমস্ত লোক, ঐ কোর্টের এলাকার মধ্যে ছিলেন। আর ইহাও নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল, যে সকল লোক, সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরায়, কোম্পানি অথবা ব্রিটিস সজেক্টের কাৰ্য্যে নিযুক্ত থাকিবেক, তাহারাও ঐ বিচারালয়ের অধীন হইবেক। সুপ্রীম কোর্টের জজেরা, এই বিধি অবলম্বন করিয়া, এতদ্দেশীয় দূৰ্ববৰ্ত্তী লোকদিগের বিষয়েও হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা কহিতেন, যে সকল লোক কোম্পানিকে কর দেয়, তাহারাও কোম্পানির চাকরি। পার্লিমেণ্টের অত্যন্ত ত্রুটি হইয়া ছিল যে, কোর্টের, ক্ষমতার বিষয় স্পষ্ট রূপে নিৰ্দ্ধারিত করিয়া দেন নাই। তাঁহারা, এক দেশের মধ্যে, পরস্পরনিরপেক্ষ অথচ পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্ব, দুই পরাক্রম স্থাপিত করিয়া, সাতিশয় অবিবেচনার কার্য্য করিয়াছিলেন। এক্ষণে, উভয় পক্ষের পরস্পর বিবাদানল বিলক্ষণ প্ৰদীপ্ত হইয়া উঠিল।

সুপ্রীম কোর্টের কাৰ্য্যারম্ভ হইবা মাত্র, তথাকার বিচারকেরা আপনাদের অধিকার বিস্তার করিতে আরম্ভ করিলেন। যদি কোনও ব্যক্তি, ঐ আদালতে গিয়া, শপথ করিয়া বলিত, অমুক জমীদার আমার টাকা ধারেন, তিনি শত ক্রোশ দূরবর্ত্তী হইলেও, তাঁহার নামে তৎক্ষণাৎ পরোয়ানা বাহির হইত, এবং কোনও ওজর না শুনিয়া, তাঁহাকে ধরিয়া আনিয়া জেলখানায় রাখা যাইত; পরিশেষে, আমি সুপ্রীম কোর্টের অধীন নহি, এই বাক্য বারংবার কহিলেই, সে ব্যক্তি অব্যাহতি পাইতেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার যে ক্ষতি ও অপমান হইত, তাহার কোনও প্ৰতিবিধান হইত না। এই কুরীতির দোষ, অল্প কাল মধ্যেই, প্ৰকাশ পাইতে লাগিল। যে সকল প্ৰজা ইচ্ছা পূর্বক কর দিত না; তাহারা, জমীদার ও তালুকদারদিগকে পূর্বোক্ত প্রকারে কলিকাতায় লইয়া যাইতে দেখিয়া, রাজস্ব দেওয়া এক বারেই রহিত করিল। প্ৰথম বৎসর, সুপ্রীম কোর্টের জজেরা, সকল জিলাতেই, এইরূপ পরোয়ানা পাঠাইয়াছিলেন। তদৃষ্টে, দেশ মধ্যে, সমুদয় লোকেরই চিত্তে যৎপরোনাস্তি ত্ৰাস ও উদ্বেগের সঞ্চার হইল। জমীদারেরা, এই ঘোরতর নূতন বিপদ উপস্থিত দেখিয়া, সাতিশয় শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হইতে লাগিলেন। যে আইন অনুসারে, তাঁহারা বিচারার্থে কলিকাতায় আনীত হইতেন, তাঁহারা তাহার কিছুই জানিতেন না।

সুপ্রীম কোর্ট, ক্ৰমে ক্রমে, এরূপ ক্ষমতা বিস্তার করিতে লাগিলেন যে, তাহাতে রাজস্ব আদায়ের বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মিতে লাগিল। তৎকালে রাজস্ব কাৰ্য্যের ভার প্রবিন্সল কোর্ট অর্থাৎ প্রদেশীয় বিচারালয়ের প্রতি অর্পিত ছিল। পূর্বাবধি এই রীতি ছিল, জামীদারের করদান বিষয়ে অন্যথাচরণ করিলে, তাঁহাদিগকে কয়েদ করিয়া আদায় করা যাইত। এই পুরাতন নিয়ম, তৎকাল পৰ্য্যন্ত, প্রবল ও প্রচলিত ছিল। সুপ্রীম কোর্ট এ বিষয়েও হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। করদানে অমনোযোগী ব্যক্তিরা এই রূপে কয়েদ হইলে, সকলে তাহাদিগকে সুপ্রীম কোর্টে আপীল করিতে পরামর্শ দিত। তাহারাও, আপীল করিব মাত্ৰ, জামীন দিয়া খালাস পাইত। জমীদারেরা দেখিলেন, সুপ্রীম কোর্টে দরখাস্ত করিলেই, আর কয়েদ থাকিতে হয় না; অতএব, সকলেই কর দেওয়া রহিত করিলেন। এই রূপে রাজস্ব সংগ্ৰহ প্ৰায় একপ্রকার রহিত হইয়া আসিল।

সুপ্রীম কোট ক্রমে সৰ্ব্বপ্রকার বিষয়েই হস্তাৰ্পণ করিতে লাগিলেন। মফঃসলের ভূমিসংক্রান্ত মোকদ্দমা ও তথায় উপস্থিত হইতে লাগিল; এবং জজেরাও, জিলা আদালতে কোনও কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, ইচ্ছাক্রমে ডিক্ৰী দিতে ও হুকুম জারী করিতে লাগিলেন। পূৰ্ব্বে, ইজারদার অঙ্গীকৃত কর দিতে অসম্মত হইলে, তাহার ইজারা বিক্ৰীত হইত। কিন্তু সে, নূতন ইজারদারকে সুপ্রীম কোর্টে আনিয়া, তাহার সর্ব্বনাশ করিত। জমীদার কোনও বিষয় কিনিলে, যোত্রহীনেরা সুপ্রীম কোর্টে তাঁহার নামে নালিশ করিত, এবং তিনি আইনমতে খাজানা আদায় করিয়াছেন, এই অপরাধে, দণ্ডনীয় ও অবমানিত হইতেন।

সুপ্রীম কোর্ট প্রদেশীয় ফৌজদারী আদালতের উপরেও ক্ষমতাপ্ৰকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। গবৰ্ণমেণ্ট ঐ সকল আদালতের কাৰ্য্য মুরশিদাবাদের নবাবের হস্তে রাখিয়াছিলেন। সুপ্রীম কোর্টের জজেরা কহিলেন, নবাব মুবারিক উদ্দৌলা সাক্ষিগোপাল মাত্র, সে কিসের রাজা, তাহার সমুদয় রাজ্য মধ্যে আমাদের অধিকার। নবাব ইংলণ্ডের অধিপতির অথবা ইংলণ্ডের আইনের অধীন ছিলেন না; তথাপি সুপ্রীম কোর্ট তাঁহার নামে পরোয়ানা জারী করা ন্যায্য বিবেচনা করিলেন। জজের স্পষ্টই বলিতেন, রাজশাসন অথবা রাজস্বকাৰ্য্যের সহিত যে যে বিষয়ের সম্পর্ক আছে, আমরা সে সমুদয়েরই কর্ত্তা; যে ব্যক্তি আমাদের আজ্ঞা লঙ্ঘন করিবেক, ইংলণ্ডের আইন অনুসারে, তাহার দণ্ডবিধান করিব। কোম্পানির কৰ্ম্মচারীদিগের অবিচার ও অত্যাচার হইতে দেশীয় লোকদিগের পরিত্রাণ করিবার জন্য, এই বিচারালয় স্থাপিত হইয়াছে; এত অধিক ক্ষমতাবিশিষ্ট না হইলে, সে অভিপ্ৰায় সিদ্ধ হইতে পারে না। ফলতঃ, সুপ্রীম কোর্টকে সর্ব্বপ্রধান ও সুপ্রীম গবৰ্ণমেণ্টকে অকিঞ্চিৎকর করাই তাহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হইয়া উঠিয়াছিল।

উপরি লিখিত বিষয়ের উদাহরণ স্বরূপ একটি দেওয়ানী ও একটি ফৌজদারী মোকদ্দমা উল্লিখিত হইতেছে।

পাটনানিবাসী এক ধনবান মুসলমান, আপন পত্নী ও ভ্রাতৃপুত্ত্র রাখিয়া, পরলোকযাত্রা করেন। এইরূপ জনরব হইয়াছিল যে, ধনী ভ্ৰাতৃপুত্ত্রকে দত্তক পুত্ত্র করিয়া যান। ধনীর পত্নী ও ভ্রাতৃপুত্ত্র উভয়ে, ধনাধিকার বিষয়ে বিবদমান হইয়া, পাটনার প্রবিন্সল কোর্টে মোকদ্দমা উপস্থিত করেন। জজেরা, কাৰ্য্যনিৰ্ব্বাহের প্রচলিত রীতি অনুসারে, কাজী ও মুফতীকে ভার দেন যে, তাঁহারা, সাক্ষীর জবানবন্দী লইয়া, মুসলমানদিগের সরা অনুসারে, মোকদ্দমার নিম্পত্তি করেন। তদনুসারে, তাঁহারা অনুসন্ধান দ্বারা, অবগত হইলেন, বাদী ও প্রতিবাদী যে সকল দলীল দেখায়, সে সমুদায় জাল; তাহাদের এক ব্যক্তিও প্ৰকৃত উত্তরাধিকারী নহে; সুতরাং, ঐ সম্পত্তির বিভাগ সারা অনুসারে করা আবশ্যক। তাঁহারা, তদীয় সমস্ত ধনের চতুর্থ অংশ তাঁহার পত্নীকে দিয়া, অবশিষ্ট বার আন তাঁহার ভ্রাতাকে দিলেন। এই ভ্রাতার পুত্ত্রকে ধনী দত্তক করিয়া যান।

ঐ অবীরা সুপ্রীম কোর্টে আপীল করিল। এই মোকদ্দমা যে স্পষ্টই সুপ্রীম কোর্টের এলাকার বহির্ভূত, ইহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু জজেরা, আপনাদের অধিকারভুক্ত করিবার নিমিত্ত, কহিলেন, মৃত ব্যক্তি সরকারী জমা রাখিত, সুতরাং সে কোম্পানির কৰ্ম্মকারক; সমুদয় সরকারী কৰ্ম্মকারকের উপর আমাদের অধিকার আছে। তাঁহারা ইহাও কহিলেন, ইংলণ্ডের আইন অনুসারে, পাটনার প্রবিন্সল জাজদিগের এরূপ ক্ষমতা নাই যে, তাঁহারা কোনও মোকদ্দমা, নিম্পত্তি করিবার নিমিত্ত, কাহাকেও সোপর্দ্দ করিতে পারেন। অতএব তাঁহারা স্থির করিলেন, এই মোকদ্দমার সানি তাজবীজ আবশ্যক। পরে, তাঁহাদের বিচারে ঐ অবীরার পক্ষে জয় হইল, এবং সে তিন লক্ষ টাকা পাইল।

তাঁহারা এই পৰ্য্যন্ত করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন, এমন নহে; কাজী, মুফতী, ও ধনীর ভ্ৰাতৃপুত্ত্রকে গ্রেপ্তার করিবার নিমিত্ত, এক জন সারজন পাঠাইলেন; কহিয়া দিলেন, যদি চারি লক্ষ টাকার জামীন দিতে পারে, তবেই ছাড়িবে, নতুবা গ্রেপ্তার করিয়া আনিবে। কাজী আপনি কাছারী হইতে বাটী যাইতেছেন, এমন সময়ে, সুপ্রীম কোটের লোক তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিল।

এইরূপ ব্যাপার দর্শনে প্ৰজাদের অন্তঃকরণে অবশ্যই বিরুদ্ধ ভাবে জন্মিতে পারে; এই নিমিত্ত, প্ৰবিন্সল কোর্টের জজের অতিশয় ব্যাকুল ও উদ্বিগ্ন হইলেন। তাঁহারা দেখিলেন, গবৰ্ণমেণ্টের ক্ষমতা লোপ পাইল, এবং রাজকাৰ্য্যনিৰ্ব্বাহ এক বারেই রহিত হইল। অনন্তর, আর অধিক অনিষ্ট না ঘটে, এজন্য তাঁহারা তৎকালে কাজীর জামীন হইলেন।

যে যে ব্যক্তি, প্ৰবিন্সল কোর্টের হুকুম অনুসারে, ঐ মোকদ্দমার বিচার করিয়াছিলেন, সুপ্রীম কোর্ট তাঁহাদের সকলকেই অপরাধী করিলেন, এবং, সকলকেই রুদ্ধ করিয়া আনিবার নিমিত্ত, সিপাই পাঠাইয়া দিলেন; কাজী বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, কলিকাতায় আসিবার কালে, পথি মধ্যে তাঁহার মৃত্যু হইল। মুফতী ও অন্যূন চারি বৎসর জেলে থাকিলেন; পরিশেষে, পার্লিমেণ্টের আদেশ অনুসারে, মুক্তি পাইলেন। তাঁহাদের অপরাধ এই, তাঁহারা আপন কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্মের সম্পাদন করিয়াছিলেন।

জজেরা, ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া, প্ৰবিন্সল কোর্টের জজের নামেও সুপ্রীম কোর্টে নালিশ উপস্থিত করিয়া, তাঁহার ১৫০০০ টাকা দণ্ড করিলেন; ঐ টাকা কোম্পানির ধনাগার হইতে দত্ত হইল।

সুপ্রীম কোর্টের জজেরা, ফৌজদারী মোকদ্দমার নিস্পত্তি বিষয়ে, যে রূপে হস্তার্পণ করিয়াছিলেন, নিম্নলিখিত বৃত্তান্ত তাহার এক উত্তম দৃষ্টান্ত। সুপ্রীম কোটের এক যুরোপীয় উকীল ঢাকায় থাকিতেন। এক জন সামান্য পেয়াদা কোনও কুকৰ্ম্ম করাতে, ঐ নগরের ফৌজদারী আদালতে তাহার নামে নালিশ হয়। তাহার দোষ সপ্ৰমাণ হইলে, এই আদেশ হইল, সে ব্যক্তি যাবৎ না আত্মদোষের ক্ষালন করে, তাবৎ তাহারে কারাগারে রুদ্ধ থাকিতে হইবেক।

সকলে, তাহাকে পরামর্শ দিয়া, সুপ্রীম কোটে দরখাস্ত করাইল। অনন্তর, পেয়াদাকে অকারণে রুদ্ধ করিয়াছে, এই সূত্র ধরিয়া, সুপ্রীম কোটের এক জন জজ, ফৌজদারী আদালতের দেওয়ানকে কয়েদ করিয়া আনিবার নিমিত্ত, পরোয়ানা বাহির করিলেন। ফৌজদার, আপন বন্ধুবৰ্গ ও আদালতের আমলাগণ লইয়া, বসিয়া আছেন, এমন সময়ে পূর্বোক্ত য়ুরোপীয় উকীল এক জন বাঙ্গালিকে তাঁহার বাটীতে পাঠাইয়া দিলেন। সে ব্যক্তি, বাটীতে প্ৰবেশ পূর্বক, তাঁহার দেওয়ানকে কয়েদ করিবার উপক্রম করিল; কিন্তু, সকলে প্ৰতিবাদী হওয়ায়, তাহাকে আপন মনিবের নিকট ফিরিয়া যাইতে হইল। উকীল, এই বৃত্তান্ত শুনিবা মাত্র, কতকগুলি অস্ত্ৰধারী পুরুষ সঙ্গে লইয়া, বল পূর্ব্বক ফৌজদারের বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিবার উদ্যম করিলেন। সেই বাটীতে ফৌজদারের পরিবার থাকিত, এজন্য তিনি তাহাদিগকে প্ৰবেশ করিতে দিলেন না। তাহাতে ভয়ানক দাঙ্গা উপস্থিত হইল। উকীলের এক জন অনুচর, ফৌজদারের পিতার মস্তকে আঘাত করিল; এবং উকীলও নিজে, এক পিস্তল বাহির করিয়া, ফৌজদারের সম্বন্ধীকে গুলি করিলেন; কিন্তু, দৈবযোগে, তাহা মারাত্মক হইল না। সুপ্রীম কোর্টের জজ হাউড সাহেব, এই ব্যাপার শুনিয়া, তৎক্ষণাৎ ঢাকার সৈন্যাধ্যক্ষকে লিখিয়া পাইলেন, আপনি উকীলের সাহায্য করিবেন; আর ইহাও লিখিলেন, আপনি উকীলকে জানাইবেন, তিনি যে কৰ্ম্ম করিয়াছেন, তাহাতে আমাদের যথেষ্ট তুষ্টি জন্মিয়াছে; সুপ্রীম কোর্ট তাঁহার যথোচিত সহায়তা করিবেন। ঢাকার প্রবিন্সল কৌন্সিলের সাহেবেরা গবর্ণর জেনেরল বাহাদুরকে পত্র লিখিলেন, ফৌজদারী আদালতের সমুদয় কাৰ্য্য এক কালে স্থগিত হইল; এরূপ অত্যাচারের পর, সরকারী কৰ্ম্মের নির্বাহ করিতে আর লোক পাওয়া দুষ্কর হইবেক। গবৰ্ণর জেনেরল ও কৌন্সিলের মেম্বরেরা দেখিলেন, সুপ্রীম কোর্ট হইতেই গবৰ্ণমেণ্টের সমুদয় ক্ষমতা লোপ পাইল। কিন্তু, কোনও প্রকারে, তাঁহাদের সাহস হইল না যে, কোনও প্ৰতিবিধান করেন। জজেরা বলিতেন, আমরা ইংলণ্ডেশ্বরের নিযুক্ত; কোম্পানির সমুদয় কৰ্ম্মকারক অপেক্ষা আমাদের ক্ষমতা অনেক অধিক; যে সকল ব্যক্তি আমাদের আজ্ঞালঙ্ঘন করিবেক, তাহাদিগকে রাজবিদ্রোহীর দণ্ড দিব। যাহা হউক, পরিশেষে এমন এক বিষয় ঘটিয়া উঠিল যে, উভয় পক্ষকেই পরস্পর স্পষ্ট বিবাদে প্ৰবৃত্ত হইতে হইল।

কাশিজোড়ার রাজার কলিকাতাস্থ কৰ্ম্মাধ্যক্ষ কাশীনাথ বাবু, ১৭৭৯ সালের ১৩ই আগষ্ট, রাজার নামে সুপ্রীম কোর্টে এক মোকদ্দমা উপস্থিত করিলেন। তাহাতে রাজার উপর এক পরোয়ানা বাহির হইল, এবং তিন লক্ষ টাকার জামীন চাহা গেল। সেই পরোয়ানা এড়াইবার নিমিত্ত, রাজা অন্তর্হিত হওয়াতে, উহা জারী না হইয়া ফিরিয়া আসিল। তদনন্তর, তাঁহার স্থাবর অস্থাবর সমুদয় সম্পত্তি ক্ৰোক করিবার জন্য, আর এক পরোয়ানা বাহির হইল। সরিফ সাহেব, ঐ ব্যাপারের সমাধা করিবার নিমিত্ত, এক জন সারজন ও ষাটি জন অস্ত্ৰধারী পুরুষ পাঠাইয়া দিলেন।

রাজা গবৰ্ণমেণ্টে আবেদন করিলেন, সুপ্রীম কোর্টের লোকেরা আসিয়া আমার লোক জনকে প্ৰহার ও আঘাত করিয়াছে, বাড়ী ভাঙ্গিয়াছে, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে, জিনিস পত্র লুঠ করিয়াছে, দেবালয় অপবিত্ৰ করিয়াছে, দেবতার অঙ্গ হইতে আভরণ খুলিয়া লইয়াছে, খাজানা আদায় বন্ধ করিয়াছে, এবং রাইয়াতদিগকে খাজানা দিতে মানা করিয়াছে।

গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর কৌন্সিলের বৈঠকে এই নিৰ্দ্ধাৰ্য্য করিলেন, অতঃপর সতর্ক হওয়া উচিত; এমন সকল বিষয়েও ক্ষান্ত থাকিলে, রাজশাসনের এক কালে লোপাপত্তি হয়; অনন্তর, রাজাকে সুপ্রীম কোর্টের আজ্ঞাপ্ৰতিপালন করিতে নিষেধ করিয়া, তিনি মেদিনীপুরের সেনাপতিকে এই আজ্ঞাপত্ৰ লিখিলেন, তুমি সরিফের লোক সকল আটক করিবে। এই আজ্ঞা পঁহুছিতে অধিক বিলম্ব হওয়ায়, তাঁহাদের দৌরাত্ম্য ও রাজার বাটীলুঠের নিবারণ হইতে পারিল না; কিন্তু ফিরিয়া আসিবার কালে সকলে কয়েদ হইল। সেই সময়ে গবৰ্ণর জেনেরাল এরূপ আদেশও করিলেন যে, যে সমুদয় জমীদার, তালুকদার, ও চৌধুরী ব্রিটিস সবজেক্ট অথবা বিশেষ নিয়মে আবদ্ধ নহেন, তাঁহারা যেন সুপ্রীম কোর্টের আজ্ঞাপ্ৰতিপালন না করেন; আর, প্ৰদেশীয় সেনাধ্যক্ষদিগকে নিষেধ করিলেন, আপনারা সৈন্য দ্বারা সুপ্রীম কোটের সাহায্য করিবেন না।

সারজন ও তাঁহাদের সঙ্গী লোকদিগের কয়েদ হইবার সংবাদ সুপ্রীম কোটে পঁহুছিবা মাত্র, জজেরা, অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া, প্রথমতঃ কোম্পানির উকীলকে, তুমি সংবাদ দিয়াছ, তাহাতেই আমাদের লোক সকল কয়েদ হইল, এই বলিয়া জেলখানায় পূরিয়া চাবি দিয়া রাখিলেন। পরিশেষে, গবৰ্ণর জেনেরাল ও কৌন্সিলের মেম্বরদিগের নামেও এই বলিয়া সমান করিলেন যে, আপনারা কাশীনাথ বাবুর মোকদম উপলক্ষে, সুপ্রীম কোর্টের লোকদিগকে রুদ্ধ করিয়া, কোটের হুকুম অমান্য করিয়াছেন। কিন্তু হেষ্টিংস সাহেব স্পষ্ট উত্তর দিলেন, আমরা, আপন পদের ক্ষমতা অনুসারে, যে কৰ্ম্ম করিয়াছি, সে বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের হুকুম মান্য করিব না। এই ব্যাপার ১৭৮০ সালের মার্চ মাসে ঘটে ।

এই সময়ে কলিকাতাবাসী সমুদয় ইঙ্গরেজ ও স্বয়ং গবৰ্ণর জেনেরল বাহাদুর, সুপ্রীম কোর্টের অত্যাচার হইতে পরিত্ৰাণ পাইবার প্রার্থনায়, পালিমেণ্টে এক আবেদনপত্ৰ পাঠাইলেন। এ বিষয়ে বিশেষ বিবেচনা হইয়া, নূতন আইন জারী হইল। তাহাতে, সুপ্রীম কোর্টের জজেরা, সমস্ত দেশের উপর কর্তৃত্ব চালাইবার নিমিত্ত, যে ঔদ্ধত্য করিতেন, তাহা রহিত হইয়া গেল।

এই আইন জারী হইবার পূর্ব্বেই, হেষ্টিংস সাহেব জজদিগের বদনে মধুদান করিয়া, সুপ্রীম কোর্টকে ঠাণ্ডা করিয়াছিলেন। তিনি চীফ জষ্টিস সার ইলাইজা ইম্পি সাহেবকে, মাসিক ৫০০০ টাকা বেতন দিয়া, সদর দেওয়ানী আদালতের প্রধান জজ করেন, এবং আফিশের ভাড়া বলিয়া, মাসে ৬০০ টাকা দিতে আরম্ভ করেন; আর, এক জন ছোট জজকে, চুঁচুড়ায় এক নূতন কৰ্ম্ম দিয়া, বড় মানুষ করিয়া দেন। ইহার পর কিছু কাল, সুপ্রীম কোর্টের কোনও অত্যাচার শুনিতে পাওয়া যায় নাই।

এই সময়ে, হেষ্টিংস সাহেব, দেশীয় বিচারালয়ের অনেক সুধারা করিলেন; দেওয়ানী মোকদ্দমা শুনিবার নিমিত্ত, নানা জিলাতে দেওয়ানী আদালত স্থাপিত করিলেন; প্রবিন্সল কোর্টে কেবল রাজস্ব সংক্রান্ত কাৰ্য্যের ভার রাখিলেন। চীফ জষ্টিস, সদর দেওয়ানী আদালতের কৰ্ম্মে বসিয়া, জিলা আদালতের কৰ্ম্মনিৰ্ব্বাহার্থে কতকগুলি আইন প্রস্তুত করিলেন। এই রূপে, ক্ৰমে ক্রমে, নব্বইটি আইন প্ৰস্তুত হয়। ঐ মূল অবলম্বন করিয়াই, কিয়াৎ কাল পরে, লার্ড কর্ণওয়ালিস দেওয়ানী আইন প্ৰস্তুত করেন।

সর ইলাইজা ইম্পি সাহেবের সদর দেওয়ানীতে কৰ্ম্মস্বীকারের সংবাদ ইংলণ্ডে পঁহুছিলে, ডিরেক্টরেরা, অত্যন্ত অসন্তোষপ্রদর্শন পূর্ব্বক, ঐ বিষয় অস্বীকার করিলেন। কিন্তু তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন, হেষ্টিংস, কেবল শান্তিরক্ষার্থেই, তদ্বিষয়ে সম্মত হইয়াছেন। রাজমন্ত্রীরাও, সদর দেওয়ানীতে কৰ্ম্ম স্বীকার করিয়াছেন বলিয়া, সার ইলাইজা ইম্পি সাহেবকে, কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, ইংলণ্ডে প্ৰতিগমন করিতে আদেশ দিলেন, এবং তিনি পূৰ্ব্বোক্ত কৰ্ম্ম স্বীকার করিয়াছিলেন বলিয়া, তাঁহার নামে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। সর গিলবার্ট এলিয়ট সাহেব তাঁহার অভিযোক্তা নিযুক্ত হইলেন। ইনিই, কিছু কাল পরে, লার্ড মিণ্টো নামে, ভারতবর্ষের গবর্ণর জেনেরাল হইয়াছিলেন।

১৭৮০ সালের ১৯এ জানুয়ারি, কলিকাতায় এক সংবাদপত্র প্রচারিত হইল; তৎপূর্বে ভারতবর্ষে উহা কখনও দৃষ্ট হয় নাই।

হেষ্টিংস সাহেব, ইহার পর চারি বৎসর, বাঙ্গালার কাৰ্য্য হইতে অবসৃত হইয়া, বারাণসী ও অযোধ্যার রাজকাৰ্য্যের বন্দোবস্ত, মহীশূরের রাজা হায়দর আলির সহিত যুদ্ধ, ভারতবর্ষের সমুদয় প্রদেশে সন্ধিস্থাপন, ইত্যাদি কাৰ্য্যেই অধিকাংশ ব্যাপৃত রহিলেন। তিনি অযোধ্যা ও বারাণসীতে যে সমস্ত ঘোরতর অত্যাচার করিয়াছিলেন, সে সমুদয় প্রচারিত হওয়াতে, ইংলণ্ডে তাঁহাকে পদচ্যুত করিবার প্রস্তাব হইয়াছিল। কিন্তু ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির অধ্যক্ষগণের সম্মতি না হওয়াতে, তিনি স্বপদেই থাকিলেন। হেষ্টিংস, ১৭৮৪ সালের শেষ ভাগে, আর এক বার অযোধ্যাযাত্ৰা করিলেন। ১৭৮৫ সালের আরম্ভে, তথা হইতে প্ৰত্যাগমন করিয়া, তিনি আপন পদের উত্তরাধিকারী মেকফর্সন সাহেবের হস্তে ত্ৰেজরি ও ফোর্ট উইলিয়মের চাবি সমৰ্পণ করিলেন, এবং, জাহাজে আরোহণ করিয়া, জুন মাসে, ইংলণ্ডে উপস্থিত হইলেন।

১৭৮৪ সালে, এই দেশের পরম হিতকারী ক্লীবলণ্ড সাহেবের মৃত্যু হয়। তিনি, অতি অল্প বয়সে, সিবিল কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, ভারতবর্ষে আইসেন। পঁহুছিবার পরেই, ভাগলপুর অঞ্চলের সমস্ত রাজকাৰ্য্যের ভার তাঁহার হস্তে সমাপিত হয়। এই প্রদেশের দক্ষিণ অংশে এক পৰ্ব্বতশ্রেণী আছে, তাহার অধিত্যকাতে অসভ্য পুলিন্দজাতির বাস করিত। সন্নিকৃষ্ট জাতিরা সৰ্ব্বদাই তাহাদের উপর অত্যাচার করিত; তাহারাও, সময়ে সময়ে পৰ্ব্বত হইতে অবতীর্ণ হইয়া, অত্যাচারীদিগের সর্বস্বলুণ্ঠন করিত। ক্লীবলণ্ড, তাহাদের অবস্থার সংশোধন বিষয়ে, নিরতিশয় যত্নবান হইয়াছিলেন; এবং যাহাতে তাহারা সুখী হইতে পারে, সাধ্যানুসারে তাহার চেষ্টা করিতে ত্রুটি করেন নাই। তাহার এই প্ৰয়াস সম্পূর্ণ রূপে সফল হইয়াছিল। ক্রমে তাহার অধীনস্থ সমস্ত প্রদেশের অবস্থার পরিবর্তন হইল; পাৰ্ব্বতীয় অসভ্য পুলিন্দজাতিরাও, সভ্য জাতির ন্যায়, শান্তস্বভাব হইয়া উঠিল।

আবাদ না থাকাতে, ঐ প্রদেশের জল বায়ু অতিশয় পীড়াকর ছিল। তাহাতে ক্লীবলণ্ড সাহেব, শারীরিক অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া, স্বাস্থ্যলাভের প্রত্যাশায়, সমুদ্রযাত্রা করিলেন। তথায় তাঁহার মৃত্যু হইল। মৃত্যুকালে তাঁহার উনত্রিংশ বৎসর মাত্র বয়ঃক্রম ছিল। ডিরেক্টরেরা তদীয় সদগুণে এমন প্রীত ছিলেন যে, তাঁহার স্মরণার্থে সমাধিস্তম্ভনিৰ্ম্মাণের আদেশপ্ৰদান করিলেন। তিনি যে অসভ্য অকিঞ্চন পাৰ্ব্বতীয়দিগকে সভ্য করিয়াছিলেন, তাঁহারাও অনুমতি লইয়া, তদীয় গুণগ্রামের চিরস্মরণীয়তাসম্পাদনার্থে, এক কীৰ্ত্তিস্তম্ভ নিৰ্ম্মিত করিল। এতদ্দেশীয় লোকেরা, ইহার পূর্বে, আর কখনও, কোনও যুরোপীয়ের স্মরণার্থে, কীৰ্ত্তিস্তম্ভ নিৰ্ম্মিত করেন নাই।

১৭৮৩ সালে, সর উইলিয়ম জোন্স, সুপ্রীম কোর্টের জজ হইয়া, এতদ্দেশে আগমন করেন। তিনি, বিদ্যানুশীলন দ্বারা, স্বদেশে বিলক্ষণ খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার ভারতবর্ষে আসিবার মুখ্য অভিপ্ৰায় এই যে, তিনি এতদ্দেশের আচার, ব্যবহার, পুরাবৃত্ত, ও ধৰ্ম্ম বিষয়ে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে পারিবেন। তিনি, এ দেশে আসিয়াই, সংস্কৃত ভাষার অনুশীলন করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু পড়াইবার নিমিত্ত পণ্ডিত পাওয়া দুর্ঘট হইয়া উঠিল। তৎকালীন ব্ৰাহ্মণপণ্ডিতেরা মেচ্ছজাতিকে পবিত্ৰ সংস্কৃত ভাষা অথবা শাস্ত্রীয় বিষয়ে উপদেশ দিতে সম্মত হইতেন না। অনেক অনুসন্ধানের পর, এক জন উত্তম সংস্কৃতজ্ঞ বৈদ্য, মাসিক পাঁচ শত টাকা বেতনে, তাঁহাকে সংস্কৃত ভাষা শিখাইতে সম্মত হইলেন। সর উইলিয়ম জোন্স, স্বল্প দিনেই, উক্ত ভাষায় এমন বুৎপন্ন হইয়া উঠিলেন যে, অনায়াসে, ইঙ্গরেজীতে শকুন্তলা নাটকের ও মনুসংহিতার অনুবাদ করিতে পারিলেন।

তিনি, ১৭৮৪ সালে, ভারতবর্ষের পূর্ব্বকালীন আচার, ব্যবহার, রীতি, নীতি, ভাষা, শাস্ত্ৰ ইত্যাদি বিষয়ের অনুসন্ধানের অভিপ্ৰায়ে, কলিকাতায় এসিয়াটিক সোসাইটি নামক এক সভা স্থাপিত করিলেন। যে সকল লোক, এ বিষয়ে, তাঁহার ন্যায়, একান্ত অনুরক্ত ছিলেন, তাঁহার এই সোসাইটির মেম্বর হইলেন। হেষ্টিংস সাহেব এই সভার প্রথম অধিপতি হয়েন, এবং, প্ৰগাঢ় অনুরাগ সহকারে, সভার সভ্যগণের উৎসাহবৰ্দ্ধন করেন। সর উইলিয়ম জোন্সের তুল্য সৰ্ব্বগুণাকর ইঙ্গরেজ এ পৰ্য্যন্ত ভারতবর্ষে আইসেন নাই। তিনি, এতদ্দেশে, দশ বৎসর বাস করিয়া, উনপঞ্চাশ বর্ষ বয়ঃক্রমে, পরলোকযাত্ৰা করেন। ১৭৮৩ সালে, কোম্পানির কাৰ্য্যনিৰ্ব্বাহ প্ৰণালী পার্লিমেণ্টের গোচর হইলে, প্ৰধান অমাত্য ফক্স সাহেব, ভারতবর্ষীয় রাজশাসন বিষয়ে, এক নূতন প্ৰণালী প্ৰস্তুত করিলেন। ঐ প্ৰণালী স্বীকৃত হইলে, ভারতবর্ষে কোম্পানির কোনও সংস্রব থাকিত না। কিন্তু ইংলণ্ডেশ্বর তাহাতে সম্মত হইলেন না। প্ৰধান অমাত্য ফক্স সাহেব পদচ্যুত হইলেন। উইলিয়ম পিট সাহেব, তাঁহার পরিবর্ত্তে, প্ৰধান মন্ত্রীর পদে প্ৰতিষ্ঠিত হইলেন। তৎকালে তাঁহার বয়ঃক্রম চব্বিশ বৎসর মাত্র। কিন্তু তিনি, রাজকাৰ্য্যনির্বাহ বিষয়ে, অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। তিনি এতদ্দেশীয় রাজশাসনের এক নূতন প্ৰণালী প্ৰস্তুত করিলেন। ঐ প্ৰণালী, পার্লিমেণ্টে ও রাজসমীপে, উভয়ত্ৰই স্বীকৃত হইল।

এ পর্য্যন্ত, ডিরেক্টরেরাই এতদ্দেশীয় সমস্ত কাৰ্য্যের নির্বাহ করিতেন; রাজমন্ত্রীরা কোনও বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতেন না। কিন্তু, ১৭৮৪ সালে, পিট সাহেবের প্রণালী প্ৰচলিত হইলে, ভারতবর্ষীয় সমস্ত বিষয়ের পর্য্যবেক্ষণ নিমিত্ত, বোর্ড অব কণ্টোল নামে এক সমাজ স্থাপিত হইল। রাজা স্বয়ং এই বোর্ডের সমুদয় মেম্বর নিযুক্ত করিতেন। কোম্পানির বাণিজ্য ভিন্ন, ভারতবর্ষীয় সমস্ত বিষয়েই তাঁহাদের হস্তার্পণের অধিকার হইল।