কিছুদিন ধরে বেশ শীত পড়তে শুরু করেছে।

দিনের বেলা ঈষৎ গরম। শেষরাতে প্ৰচণ্ড শীতে হাড়কাঁপুনি শুরু হয়। কাঁথার নিচেও দেহটা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।

এ সময়ে বাড়ির সবাই মাটির ভাঁড়ে তুসির আগুন জ্বেলে মাথার কাছে রাখে। মাঝে মাঝে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে অপ্তনটা উস্কে দেয়।

আজকাল ভোর হবার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠে যায় মন্তু। সোয়া দু-টাকা দিয়ে কেনা খদ্দরের চাদরটা গায়ে-মাথায় মুড়িয়ে নিয়ে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে মাঝিবাড়ির দিকে ছুটে সে। কদিন হলো করিম শেখ হাঁপানিতে পড়েছে। সারাদিন খুকখুক করে কাশে আর লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়।

মন্তু বলে, একডা কবিরাজ দেহাও মিয়া।

করিম বলে, কিছু হয় না মিয়া, অনেক দেহাইছি।

আম্বিয়া বলে, হাটে-গঞ্জে যাও, ভালো দেইখা ডাকতর দেখাইত পারো না?

করিম শেখ চুপ করে থাকে, কিচ্ছু বলে না।

আজ সকালে মাঝি-বাড়ির দিকে সবে রওনা দিয়েছে মন্তু। দাওয়া থেকে মকবুল ডেকে বললো, রাইতের বেলা একটু সকাল কইরা ফিরো মন্তু মিয়া। হীরনের বিয়ার ফর্দ হইব আইজ।

বাড়ির সকলকে আজ একটু সকাল—সকাল ঘরে ফিরে আসতে বলে দিয়েছে বুড়ো মকবুল। বিদেশ থেকে মেহমানরা আসবে, ওদের খাতির-যত্ন করতে হবে। আদর আপ্যায়ন করে খাওয়াতে হবে ওদের। নইলে বাড়ির বদনাম করবে ওরা।

মন্তুর উপরে আরো একটা ভার দিয়েছে মকবুল। নাও নিয়ে গিয়ে টুনিকে বাপের বাড়ি হতে নিয়ে আসতে হবে।

দু-একদিনের মধ্যে নবীনগরে যাবে মন্তু। করিম শেখের শরীরটা একটু ভালো হয়ে উঠলেই নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়বে সে।

পথের দু-পাশের ক্ষেতগুলোতে কলাই, মুগ, মটর আর সরষে লাগানো হয়েছে। সারারাতের কুয়াশায় এই সকালে সতেজ হয়ে উঠেছে ওরা। রোদ পড়ে শিশির ফোঁটাগুলো চিকচিক করছে ওদের গায়ে।

মাঝি-বাড়ির দেউড়ির সামনে অম্বিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মন্তুর। পুকুর থেকে এইমাত্ৰ গোছল করে ফিরছে সে। ঘন কালো চুলগুলো থেকে গড়িয়ে এখনো পানি ঝরছে। হাতের ভেজা শাড়িটার পানি নিংড়াতে নিংড়াতে আম্বিয়া বললো, মন্তু ভাই হুট কইরা চইলা যাইও না। পিঠা বানাইছি খাইয়া যাইও।

মন্তু বললো, এই সকালবেলা গোছল করছে, তোমার শীত লাগে না?

আম্বিয়া একটু হাসলো শুধু। কিছু বললো না।

সারারাত মিয়া-বাড়িতে ধান ভেনেছে সে। এই শীতের রাতেও ধান ভানতে গিয়ে সারা দেহে ঘাম নেমেছে ওর। পুরো গায়ের কাপড়ে ঘামের বিশ্ৰী গন্ধ। তাই সকাল-সকাল গোছল করে নিয়েছে আম্বিয়া। খেয়েদেয়ে একটু পরে ঘুম দেবে। উঠবে সেই অপরাহ্ণে। তারপর আবার মিয়া-বাড়ি চলে যাবে আম্বিয়া। ধান ভানবে সারারাত।

মন্তুকে একটা পিঁড়িতে বসতে দিয়ে ওর সামনে একবাসন পিঠা এগিয়ে দিলো আম্বিয়া্।

কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করে করিম শেখ বললো, খাও মিয়া খাও। বলে আবার কাশতে শুরু করলো সে। আম্বিয়া তখন পাশের ঘরে গিয়ে একটা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে মাথার চুল ঝাড়ছে। মাঝেমাঝে বুড়ো নন্তু শেখের সঙ্গে কী যেন কথা বলছে সে।

বেড়ার খুপরি দিয়ে চোরা চাউনি মেলে ওকে দেখতে লাগলো মন্তু। আঁটসাঁট দেহের খাঁজে-খাঁজে দুরন্ত যৌবন। আটহাতি শাড়ির বাঁধন ভেঙে ফেটে পড়তে চায়। আজ আম্বিয়াকে বড় ভালো লাগছে মন্তুর। চোখের পলকজোড়া ঈষৎ কেঁপে উঠলো।

হ্যাঁ, আম্বিয়াকে বিয়ে করবে। সে। হোক হাঁপানি। সে পরে দেখা যাবে। বুড়ো মকবুলকে আজকেই ওর মনের কথাটা জানিয়ে দেবে মন্তু। সহসা একটা সিদ্ধান্ত করে বসলো সে।

করিম শেখ লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো, কি মিয়া হাত তুইলা বইসা রইলা যে?

মন্তু তাড়াতাড়ি একটা পিঠা মুখে পুরে দিয়ে বললো, হুঁ হুঁ এই তো খাইতাছি। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো বাসনটা শূন্য করে দিলো মন্তু।

কাঁথাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে করিম শেখ কাঁপা গলায় বললো, আমার বুঝি দিনকাল শেষ হইয়া আইলো মিয়া, আর বাঁচুম না

আহা অমন কথা কয় না মিয়া। অমন কথা কয় না। পরীক্ষণে ওকে বাধা দিয়ে মন্তু বললো, মরণের কথা চিন্তা কইরতেই নাই, আয়ু কইমা যায়।

করিম শেখ তবু বিড়বিড় করে আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় শোক প্রকাশ করতে লাগলো।

রাতে এলো ওরা।

বরের মামা, চাচা, আরো দু-তিনজন লোক।

হীরনের বিয়ের ফর্দ হবে। আজ।

মকবুলের বাইরের ঘরটাতে ফরাশ পেতে বসানো হলো ওদের। গনু মোল্লা বসলেন সবার মাঝখানে।

আবুল, রশীদ আর সুরত আলী ওরাও বসলো সেখানে। বুড়ো মকবুল প্রথম আসতে রাজি হয়নি। বলছিলো, তোমরা সবাই আছো, ভালো মন্দ যা বুঝ আলাপ কর গিয়া। আমারে ওর মধ্যে টাইনো না।

রশীদ বললো, কী কথা, আপনের মাইয়া, আপনে না থাকলে চলবো কেমন কইরা?

ঘরের ভেতর থেকে বরের চাচা হাঁক ছাড়লো, কই, বেয়াই কই, তেনারে দেহি না ক্যান?

অবশেষে ঘরে এসে এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে পড়লো মকবুল।

প্ৰথমে মেহমানের ভাত খাওয়ানো হবে। তারপরে ফর্দ হবে বিয়ের।

এতক্ষণ খুঁজছিলো কখন বুড়ো মকবুলকে কিছুক্ষণের জন্যে একা পাওয়া যায়। তাহলে নিজের বিয়ের কথা ওকে বলবে সে। এই শীতে, হ্যাঁ এই শীতেই বিয়ে করে ঘরে বউ আনতে চায় মন্তু; কিন্তু মকবুলকে একা পাওয়া গেল না।

সারা বাড়িতে আজ ভিড়।

রান্নাঘরে ভিড়টা সবচেয়ে বেশি। বাড়ির মেয়ে পুরুষ কাচ্চাবাচ্চা সবাই গিয়ে জুটেছে সেখানে। সারাক্ষণ বকবক করছে। কার কথা কে শুনছে। কিছু বোঝা যায় না।

হাঁড়িপাতিলগুলো একপাশে টেনে নিয়ে বাসন-বাসন ভাত বাড়ছে আমেনা। হঠাৎ মন্তুকে সামনে পেয়ে আমেনা জিজ্ঞেস করলো, মানুষ কয়জন?

মন্তু বললো, আটজন।

আটজন! আমেনার মাথায় রীতিমতো বাজ পড়লো। আটজনের কি ভাত রানছি নাকি আমি? আমি তো রানছি চাইরজনের। তোমার ভাইয়েয় আমারে চাইর জনের কথা কইছিল।

বড় ঘর থেকে রান্নাঘরের দিকে আসছিলো মকবুল, কথাটা কানে গেল ওর। পরক্ষণে ভিতরে এসে রাগে ফেটে পড়লো সে। আমি কি জাইনতাম, আটজন আইবো ওরা? বারবার কইরা কইয়া দিছি। চারজনের বেশি আইসেন না আপনারা। ওরা তহন মইনা নিছে। আর এহন-বলে ঠোঁটজোড়া বিকৃত করে একটা বিশ্ৰী মুখভঙ্গি করলো মকবুল, হালার ভাত যেন এই জন্মে দেহে নাই হালারা।

হইছে হইছে। আপনে আর চিল্লায়েন না, থামেন। মেজো বউ ফাতেমা চাপা গলায় বললো, যান যা আছে তা দিয়া একবার খাওয়ান। আমরা নাহয় পরে খামু।

ফাতেমার কথায় শান্ত হয়ে চলে যাচ্ছিলো মকবুল; মন্তুর দিকে চোখ পড়তে বললো, তাইলে মন্তু মিয়া তুমি কাইল পরশু একদিন নবীনগর যাও। কেমন?

মন্তু সংক্ষেপে ঘাড় নাড়লো। নিজের কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না সে। সহসা তার মনে একটা নতুন চিন্তা এলো। টুনি ফিরে এলে ওকে দিয়ে কথাটা মকবুলকে বলবে মন্তু।

খাওয়া-দাওয়া শেষে ফর্দ করতে বসলো সবাই।

প্রথমে উঠলো দেনা-পাওনার প্রশ্নটা।

বরের চাচা ইদন শেখ বললো, অলঙ্কারপত্র বেশি দিবার পারমু না মিয়া। হাতের দুইজোড়া চুড়ি আর কানের দুইডা ঝুমকা।

গলার আর কমরেরডা দিবো কে? সুরত আলী সঙ্গে সঙ্গে বললো, ওইগুলাও দিতে অইবো আপনাগোরে।

পায়েরটরে বাদ দিয়া দিলা ক্যান অ্যাঁ? আবুল জোরের সঙ্গে বললো, পায়ের একজোড়া মলও দেওন লাগব।

বুড়ো মকবুল নড়েচড়ে বসলো। সুরত আর আবুলের দিকে পরম নির্ভরতার সঙ্গে তাকালো সে।

বরের মামা আরব পাটারী মৃদু হেসে বললো, এই বাজারে এতগুলান জিনিস দিতে গেলে কি কম টাকার দরকার মিয়া। আরো একটু কমসম কইরা ধরেন।

আচ্ছা, পায়েরটা নাহয় নাই দিলেন। মাঝখানে পড়ে মধ্যস্থতা করে দিলো রশীদ। বাকিগুলান তো নিবেন?

হ্যাঁ তাই সই। সুরত আলী বললো, সোনার জিনিস তো আর দিবার লাগছেন না, রূপার জিনিস দিবেন। তা মন কষাকষির কী দরকার?

মকবুল কিছুই বললে না। একপাশে বসে রইলো চুপ করে। গনু মোল্লা ও নীরব। শুধু তসবি পড়ছেন ঢুলে ঢুলে।

গহনার কথা শেষ হলে পরে মোহরানার কথা উঠলো;

ইদন শেখ বললো, সব ব্যাপারে আপনাগোডা মইনা নিছি। এই ব্যাপারে। কিন্তুক আমাগোডা মাইনতে অইবো।

আহা কয়েন না শুনি। রশীদ ঘাড় ঝাঁকালো।

ইদন বললো, মোহরানাড়া পাঁচ টাহাই ধরেন।

পাঁচ টাহা? অ্যাঁ, পাঁচ টাহা? কন কি? রীতিমতো খেপে উঠলো সুরত। মাইয়া কি মাগনা পাইছেন নাহি? অ্যাঁ? মাইয়ার কি কোনো দাম নাই?

আহ, দাম আছে। বইলাইতো পাঁচ টাহা কইবার লাগছি। নইলে কি আর তিন টাকার উপরে উঠতাম? আরব পটারীর কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ঝরে পড়লো। কণ্ঠস্বরে বিকৃতি এনে সে বললো, সক্কল দিক দিয়াই বাড়াবাড়ি করবার লাগছেন আপনারা। আচ্ছা যান, আরো আট আনা বাড়াইয়া দিলাম। মোট সাড়ে পাঁচ টাহা।

না বিয়াই। তা অয় না, অইবো না। এতক্ষণে কথা বললো বুড়ো মকবুল, এত কম মোহরানায় মাইয়ারে বিয়া দিবার পারমুনা, বলে হঠাৎ কেঁদে উঠলো সে, মাইয়া আমার কইলজার টুকরা বেয়াই। কত কষ্ট কইরা মানুষ করছি। দু-হাতে চোখের পানি মুছলো বুড়ো মকবুল। বিশটাহা যদি মোহরানা দেন। তাইলে মাইয়া বিয়া দিমু।

মকবুলের চোখের পানি দেখে অপ্রতিভ হয় গেল সবাই। মাঝরাত পর্যন্ত অনেক তর্কবিতর্কের পর সোয়া এগারো টাকায় মিটমাট হলো সব। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে মেহমানরা বিদায় নিয়ে গেলো।

মনে-মনে খুশি হলো মকবুল। সোয়া এগারো টাকা মোহরানায় এর আগে এ বাড়ির কোনো মেয়ের বিয়ে হয়নি।

Leave a Reply